হৃদয়ে লুকানো প্রেম পর্ব-২৭+২৮

0
637

#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৭
টানা দেড় ঘণ্টা জারিফের থেকে পড়া বুঝে রাত বারোটায় শেষ হলো। প্রিয়া লম্বা হাই তুলে বলে,

“সব ক্লিয়ার। এইবার পরীক্ষার সময় মনে থাকলেই হয়। এতো পড়া উফ! ফাইনালটা শেষ হলে একটু শান্তি দশ-পনেরো দিনের জন্য। আচ্ছা শুনুন?”

জারিফ টেবিলের উপর গালে দুই হাত ঠেকিয়ে বসে বসে ল্যাপটপের স্ক্রিনে প্রিয়াকে দেখছিল। প্রিয়া জারিফের গতিবিধির উপর নজর দেয়নি। এবার প্রিয়ার ডাকেও জারিফ সেই একই ভঙ্গিতে বসে আছে। দৃষ্টিতে মা*দ*কতা। প্রিয়া কথা বলতে বলতে স্ক্রিনে জারিফের দিকে নজর গেলে ভ’ড়কে উঠে। থতমত খেয়ে যায় জারিফের পলকহীন দৃষ্টিতে। কপালের সামনে পরে থাকা চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়। কলম দিয়ে টেবিলে কিছুটা শব্দ করে যাতে জারিফ নড়েচড়ে বসে। কিন্তু জারিফ মোটেও নড়লো না। অনড় অবস্থায়ই ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,

“বলো শুনছি।”

প্রিয়া অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলে,
“আপনি এভাবে থাকলে আমি তো বলতে পারব না।”

“কেনো আমার এভাবে থাকাতে তোমার কী সমস্যা?”

জারিফের কা*টকা*ট প্রশ্নে কিয়ৎক্ষণ মৌন রইল প্রিয়া। তারপর ঢোক গিলে বলল,

“না মানে সমস্যা না কিন্তু আমার কথা বলাতে মনোযোগ আসছে না।”

জারিফ হাতের উপর থেকে মুখ তুলে হালকা হাসলো অতঃপর চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বলল,

“নাও তোমার মনোযোগ ফেরানোর ব্যাবস্থা করলাম।”

প্রিয়া জারিফের মুখাবয়ব দেখে চমৎকার হাসলো।

“অ্যাই ফিল, অ্যাই অ্যাম দা মোস্ট লাকিয়েস্ট ওমেন ইন দিস ওয়ার্ল্ড! ডোন্ট নো হোয়াই।”

জারিফ চোখে হেসে প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।

“অনেক রাত হলো ঘুমাও। তিন দিন পর সেমিস্টার ফাইনাল। গুড নাইট।”

প্রিয়া কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হলো। জারিফ বলে,

“নারীর অভিমানও সুন্দর যদি দৃষ্টিতে ভালোবাসা থাকে।”

থমকে যাক প্রহর একে অপরের নয়নযুগলে দৃষ্টি নিবদ্ধ থেকে। হৃদয়ে লুকানো প্রেম চোখের ভাষায় প্রকাশ পাক। পূর্ণ হোক হৃদয়।

__________

অপেক্ষমাণ সময় বড্ড দ্রুত গতিতে চলে। পরীক্ষার সময় মনে হয় ঘড়ির পেন্ডুলাম অতি দ্রুত গতিতে চলে। এক অস্থীরতা পূর্ণ মূহুর্ত। আজ ফাইনালের শেষ পরীক্ষা। পরীক্ষা দিয়ে এসে গ্রাউন্ডে একেকজন হাত-পা ছাড়িয়ে বসেছে। সাদ বলে,

“উফ কী যে এক প্যারার মধ্যে সপ্তাহটা পার করেছি! এটলাস্ট একটু রিলিফ পেলাম। এক্সাম যেমনই হোক না কেনো, এখন শান্তি শান্তি ফিলিং হচ্ছে। এই কয়টা দিন যেনো গ*লা কা*টা মু*র*গীর মতো ছটফট করেছি। এতক্ষণে জা*নে পানি এসেছে।”

সাদ কথাটা বলেই পাশে তাকিয়ে দেখলো ওর কথার সাথে কেউই তাল মিলাচ্ছে না। মেয়ে চারটা মাথা হাঁটুতে ঠেকিয়ে বসে আছে আর আয়ান ও রাদ ফোনে কি যেনো করছে। সাদ ভ্রুঁ কুঁচকে আয়ানের পেছোনে গিয়ে কাঁধ পেঁচিয়ে ধরলো। সাদ দেখলো আয়ান অনলাইনে বাসের কিছু একটা দেখছে। সাদ কিছুটা জোরেই বলে উঠলো,

“কী মামা! ফাইনাল শেষ হতেই ট্যুর প্ল্যান? আহা! তো কোথায় প্ল্যান করলি?”

সাদের কথায় ঝিমিয়ে থাকা বাকিরাও নড়েচড়ে বসে। অর্ষা বলে,

“নট ফেয়ার ইয়ার। কয়দিন পর প্রিয়ার বিয়ে। হাতে ছয়-সাত দিন আছে। এখন ট্যুর প্ল্যান করলে প্রিয়া যেতে পারবে না। ওর বিয়ের পর যাই। ও স্যারকে নিয়ে শর্ট হানিমুনে গেলো আর আমরা ট্যুর। জোস না?”

মাঝ থেকে রাদ বলে উঠে,
“না। জোস না। প্রিয়া হানিমুনে যাবে সেখানেও আমরা যাবো! তাও স্যারের সাথে? কেমন অ’ড লাগে।”

আয়ান ওদের এতো আকাশকুসুম চিন্তা-ভাবনাতে এক বালতি জল ঢেলে বলে,

“কেউ যাবে না। জাস্ট আমি একা। আমি কোনো ট্যুরে যাচ্ছি না। একটা কাজেই যাচ্ছি। ”

সাদ আয়ানের কাঁধে ধা*ক্কা দিয়ে বলে,
“আগেরবারও এই রকমই করেছিস। এবার আমরা যাবোই। অন্তত আমি ও রাদ তো মাস্ট। তোর কোনো কথা শুনব না।”

আয়ান ওদেরকে হতাশ স্বরে বলে,
“বিলিভ মি। এটা কোনো ট্যুর না। সাজেক, বান্দরবান, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন এসব কোথাও বা কোনো টুরিস্ট স্পটেই যাচ্ছি না। আমি খাগড়াছড়ি যাচ্ছি। একটা বিশেষ কাজে। আর্জেন্ট।”

“তোর আর্জেন্ট কাজে আমরা দুইজনও যাবো। দেখ সেমিস্টার ব্রেক। কোনো কাজ-কাম নাই। বাসায় শুধু শুয়ে বসে ঘুমানো ছাড়া। আমাদের জন্যও টিকেট বুকড কর।”

আয়ান ওদের বুঝানোর প্রয়াস করলো কিন্তু দুইজনের অকা*ট্য যুক্তিতে হার মেনে শেষে রাজি হলো। ওদিকে নিশি, মিম, অর্ষা, প্রিয়া বাঁকা নজরে এই তিন বন্ধুকে দেখছে। ওদের তিনজনের তো এই চারজনের দিকে সামান্যতমও ভ্রুঁক্ষেপ নেই। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ওদের মনোযোগ আকর্ষণে ব্যার্থ হলে মিম ব্যাগ থেকে কলম বের করে সাদের পিঠে গুঁ*তো দেয়।

“তোদের তিনটাকে সামনের খা*লে ফে*লে দিবো। এতো নি*র্দয় কেনো তোরা? আমাদের চারজনকে কি তোদের চোখে লাগে না? গোনায় ধরিস না আমাদের।”

আয়ান অসহায় কন্ঠে বলে,
“বিশ্বাস কর, এই দুটোকে যে নিচ্ছি এটাই তো আমার জন্য প্রবলেম হয়ে যাচ্ছে। তোদেরকে কিভাবে নিবো? দুইদিনে জন্য যাবো। কাল সকালে রওনা করব। পরশুদিন ও তার পরেরদিন থেকে রওনা করব। আর প্রিয়ার তো বিয়ে। তোদেরও তোড়জোড় আছে তাই না?”

“তাই না! এখন তো বাহানা। যাহ্ যাবো না।”

নিশির মুখ বাঁ*কানো কথায় আয়ান বিপাকে পরে গেলো। কিন্তু সত্যি সে ছেলো দুটোকে নিতে পারলেও মেয়েদের পারবেই না। হতাশ নিঃশ্বাসে অভিমান মেনে নিলো।

__________

ছাদে বসে পড়ন্ত বিকেলে চা বিলাশ করছে দুটো মানব-মানবী। এপ্রিলের শেষ দিন। প্রকৃতিতে গ্রীষ্মের তাপদাহ প্রখর হতে প্রখর। বিকেলের সময়টা কিছুটা শীতলতা বিরাজ করে। মুন্নি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চোখে হেসে আকাশ দেখছে। তার বিপরীতে বসা রাদিফ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মুন্নির মুখচ্ছবি বোঝার চেষ্টা করছে। হালকা টিয়া রঙের থ্রিপিসে ফর্সা গড়নে ফুটে উঠেছে। রাদিফ বলে,

“আপনি সবসময় আকাশপানে কী দেখেন?”

“আমার সুখ!”

মুন্নির ভাবলেশহীন জবাবে রাদিফ বিভ্রান্ত হয়ে হাসলো। মেয়েটার দৃষ্টি কিন্তু একটুও তার দৃষ্টিসীমা থেকে হটেনি। রাদিফ বলে,

“মানে?”

“একটা গান শুনবেন?”

মুন্নির হঠাৎ এহেনো নিঃসঙ্কোচ আবদারে রাদিফ মানা করতে পারলো না।
“দূর হতে আমি তারে সাধিব
গোপনে বিরহডোরে বাধিব
দূর হতে আমি তারে সাধিব
গোপনে বিরহডোরে বাধিব
বাধনবিহীন সেই যে বাধন
অকারণ
মায়াবন বিহারিনী

মায়াবন বিহারীনি হরিনী
গহন-স্বপন-সঞ্চারিণী
কেন তারে ধরিবারে করি পণ
অকারণ
মায়াবন বিহারীনি”

“জানেন এইটুকু আমার অনেক ভালো লাগে। মনে গেঁথে আছে একদম।”

রাদিফ মুগ্ধচিত্তে মুন্নির গান ও কথাগুলো শুনলো। মুন্নি এখন হাসি চোখে আকাশ দেখছে। রাদিফ বলে উঠলো,

“আপনি গান শিখেছেন কখনও?

ঘার ঘুরিয়ে রাদিফের দিকে চেয়ে বলে,
“হ্যাঁ ছোটোবেলায়।”

“আপনার গানের গলা খুব সুন্দর।”

“ধন্যবাদ।”

পরন্তু দুজনেই মৌন। আজ রাদিফ জলদি ফিরেছে কারণ কালকে সে শিফট হবে মেসে। রাদিফ এই কয়দিনে মুন্নির প্রতি খানিকটা দুর্বল হয়ে পরেছে। ইতস্তত করে বলে,

“আপনার ফেসবুক আছে? ফ্রেন্ডলিস্টে কী জায়গা হবে আমার?”

মুন্নি বলে,
“আপাততো ডিএক্টিভ।”

“আপনার বাবা-মা তো আজকে রাতের বাসে ঢাকা যাবেন। আপনার জন্য মালা খালাকে রেখে গেলেন। শুনেছি আপনার মামাতো ভাইয়ের বিয়ে। বিয়ের তারিখটা পেছোলেও পারতো।”

রাদিফের কথায় মুন্নির চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। কা*টকা*ট জবাব দেয়,

“না পারতো না। জলদি বিয়ে হলেই ভালো। সন্ধ্যা নামছে আমি নিচে গেলাম।”

এই বলে মুন্নি হনহন করে ছাদ থেকে নেমে গেলো। রাদিফ বোকার মতো বসে রইল। সে কী এমন বলল যে মুন্নি এভাবে চলে গেলো তা ভেবে পেলো না।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৮
দুইদিন ধরে আয়ানরা খাগড়াছড়ি শহরে বিভিন্ন জায়গায় খুঁজে চলেছে। কোথাও পিহু বা তার বন্ধুদের পাচ্ছে না। প্রায় অনেকগুলো পার্ক খুঁজেছে। কলেজে খুঁজে লাভ নেই কারণ এইচএসসির জন্য ক্লাস হচ্ছে না। আজকে তৃতীয় দিন খুঁজছে। না পেলে ফিরে যাবে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। রাস্তার কিনারে পথচারী চলার স্থান দিয়ে পকেটে হাত গুঁজে হাঁটছে আয়ান। আর ওর দুই বন্ধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোক খাচ্ছে। আশেপাশে অনেক স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েরা হাঁটাহাঁটি করছে। কিছু ছেলে-মেয়েরা ফুচকা, আইসক্রিম, ক্যান্ডি ফ্লসের দোকানে ভীড় জমিয়েছে। কোথাও পিহুকে খুঁজে পায়নি। অদূরে মসজিদ থেকে মাগরিবের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। আজান শোনে আয়ান সাদদের কাছে আসতে নিলে একটা মেয়ের গলার স্বরে থমকে দাঁড়ায়। পেছোনে ঘুরে দেখে হিজাব পরা মেয়ে। মেয়েটির পেছোন সাইড দেখা যাচ্ছে কিন্তু তার বন্ধুদের চেহারা ঠিক দেখা যাচ্ছে। আয়ানের মনে হচ্ছে সবটা তার ভ্রম। সে চোখ কঁচলে আবার তাকালো। আরেকটু এগিয়ে গেলো। মেয়েটি বলছে,

“কীরে ভাই! একটা রিকশাও কি পাবো না? সবগুলোই নাকি বুকিং করা। আজান পরে গেছে।”

আয়ানের ওষ্ঠকোণে নিজের অজান্তেই হাসি ফুটলো। সে থমকে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল মেয়েটির পেছোনে ফেরার অপেক্ষায়। আকাশে এখনও অন্ধকার পুরোপুরি নামেনি। পিহু বিরক্তি প্রকাশ করতে করতে পেছোনে ঘুরে। ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্ব*লে উঠেছে এখন। পিহু এখনও আয়ানকে লক্ষ্য করেনি। পিহুর ছেলে বন্ধু দুজনের মধ্যে একজন বলে উঠলো,

“আমরা নামাজ পড়ে আসি। তোরা দাঁড়িয়ে ফুচকা খা নাহয়। রিকশা পেলে উঠে যাস।”

ওরা দুজন চলে গেলো। আয়ান কি করবে করবে ভেবে সেও নামাজে যাওয়ার জন্য তার দুই বন্ধুকে একটু জোরেই ডাক দিলো। এদিকে পিহু আয়ানের মতো কন্ঠ শোনে হকচকিয়ে চমকে উঠে। প্রায় তিন মাস পর কন্ঠস্বর শুনছে। যখন পরিচিত কন্ঠস্বর আমাদের সামনে আসলে ঠিক মস্তিস্কে ক্যা*চ করে। পিহুরও হয়েছে তাই। তবে আমরা মাঝে মাঝে মনে করতে না পারলেও মনের মাঝে খুব করে খচখচ করে। আর পিহু তো তার স্বপ্নে এই কন্ঠস্বরের মালিককে ভাবে। পিহু পেছোনে ঘোরাতে আয়ানের সাথে দেখা হলো। দুইজন দুটো ল্যাম্পপোস্টের নিচে। মাঝের দূরত্ব কয়েক হাত মাত্র। আয়ান মুচকি হেসে সাদ ও রাদকে নিয়ে মসজিদের দিকে গেলো। আর পিহু অবাক হয়ে নিষ্পলক দৃষ্টিতে সেই গমন পথের দিকে চেয়ে আছে। স্বপ্ন না বাস্তব তা সে পার্থক্য করতে পারছে না। অন্য কাউকে আয়ান কল্পনা করছে কিনা ভেবে পাচ্ছে না। স্বপ্নও বুঝি এতো সুন্দর হয়! একদম নিজের কল্পনা করা একটা মূহুর্তের মতো। গৌধূলি সন্ধ্যায় ল্যাম্পপোস্টের নিচে তার সাথে আবার দেখা হওয়ার ইচ্ছে মনে পোষণ করেছিল পিহু। তেমনটাই হলো। কিন্তু কবে কখন কল্পনার আবির্ভাব হয়েছিল তা মনে করতে পারছে না।
______________
রাত পোহালে নতুন ভোর সাথে উৎসব মুখর দিনের সূচনা। মুন্নি নিজের ঘর অন্ধকার করে বসে আছে। রান্নাঘরে মালা খালা দুইজনের জন্য খাবার গরম করছে। আগামীকাল ও পরশু মুন্নির পরীক্ষা নেই বলে সে নির্বিঘ্নে পড়াশোনা ছাড়া রুম আঁধার করে বসে আছে। রাদিফ ডাইনিংয়ে এসে মুন্নির ঘরের বন্ধ দরজার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রুমে ফিরে গেছে। মুন্নি খোলা জানালা দিয়ে আঁধার অম্বরপানে চেয়ে নিজে নিজেই স্বগোতক্তি করে,

“আমার জীবনে কেউ আসুক। যে আমার আঁধার জীবনের আলোর দিশারী হবে। যার পদার্পণে আমি অতীতের টান ছাড়তে পারব।”

দীর্ঘশ্বাসে সব দুঃখ বের করার প্রয়াস করলো। মুন্নির মা গোছগাছ করছে। বিয়ে আর তিনদিন পর। তাকে ও তার স্বামীকে জারিফের বাবা অনেক অনুরোধ করে রাজী করিয়েছেন। তাই ভাইয়ের বিশেষ অনুরোধে যাচ্ছেন তারা। মুন্নির বাবা তার স্ত্রীর কাছে একটা স্বর্ণের আংটি দেখিয়ে বললেন,

“দেখো তো। এটা জারিফের বউয়ের জন্য নিলাম। কেমন হলো?”

জমিলা বেগম স্বামীকে হাসি দিয়ে বলেন,
“ভালোই। ভাই যদি ওমন অনুরোধ না করতো তবে শুধু আংটিটা কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতাম নয়তো কখনও গেলে দিয়ে দিতাম। নিজের মেয়ের কস্টের থেকে এসব গুরুত্বপূর্ণ না। নেহাত মুন্নিও বারবার করে যেতে বলেছে। মালাকে তো বললাম, তিনদিন থাকতে। এতো বছর ধরে এই বাড়িতে কাজ করছে। ওকেই রেখে গেলাম।”

“হ্যাঁ। যাই হোক। রাদিফও আগামীকাল চলে যাবে। ওর সাথেও কথা বলতে হবে। বাস তো রাত দশটায়। তোমার গোছানো শেষ করো দ্রুত।”

মুন্নির বাবা গেলেন রাদিফের সাথে দেখা করতে। মুন্নির মা চটজলদি গোছগাছ করে মেয়ের ঘরে যাবেন।

__________

নামাজ পড়ে আয়ানরা সেই স্থানে এসে দাঁড়ায়। রাহাত, সাইফরাও সাথে আছে। মসজিদে নামাজের পর ওদের দেখা হয়েছে। রাহাত ও সাইফ তো আয়ানকে প্রথমে ঠিকভাবে চিনতে না পারলেও আয়ান নাম বলার পর চিনে ফেলেছে। ওরা আয়ানকে শুধু পিহুকে খা*দ থেকে তোলার সময় দেখেছিল তারপর পিহুর মুখে আয়ান নাম শুনেই এসেছে। দুজনে আয়ানকে দেখে খুশি হয়। পিহুকে ঝ*টকা দিবে বলে ওরাও উৎসুক।

পিহু এতক্ষণ ধরে অস্থীর ভাবে হাঁটাচলা করছিল। আরেকবার চোখের সন্তুষ্টির জন্য আয়ানকে দেখতে চায়। কাছে গিয়ে কথা বলতে চায়। অপেক্ষার প্রহরের সমাপ্তি ঘটিয়ে সাইফদের সাথে আয়ানকে আসতে দেখে স্থীর হয়ে যায়। রাহাত এসে পিহুর চোখের সামনে চুটকি বা*জিয়ে বলে,

“কীরে? দেখ তো চিনিস কী না?”

পিহু যেনো বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। পিহুর বান্ধুবীরাও অবাক হয়ে গেছে। সাইফ, রাহাত, রাদ, সাদ মুখ চেপে হাসছে। আয়ান ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে পিহুর দিকে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে বলে,

“হাই। মাইসেল্ফ আয়ান মাহমুদ। নাইস টু মিট ইউ এগেইন। ”

পিহু হা করে তাকিয়ে আছে। পিহুর বান্ধুবী রাখি পিহুকে আলতো ধা*ক্কা দিলে পিহু হকচকিয়ে নড়েচড়ে দাঁড়ায়। নিজের হাত কাঁপা কাঁপা ভাবে এগোয়। আয়ান পিহুর হাতটা ধরতেই পিহু নিজের হাত টান দিয়ে ছুটিয়ে নেয়। আয়ান পিহুর চোখে ও ব্যাবহারে এতোটা বিহ্বলতা দেখে হেসে ফেলে।

“এই মিস ছটফটে। এতো ভয় পাচ্ছো কেনো? তোমার জন্য তিন দিন ধরে খাগড়াছড়ির রাস্তাঘাটে ঘুরছি আর তুমি কীনা এখন শ*ক*ড হয়ে দাঁড়িয়ে আছো! দ্যাটস নট ফেয়ার ইয়ার।”

আয়ানের কথাগুলো পিহুর কানে ঝংকার তুললো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,

“আপনি আমার জন্য এসেছেন? সত্যি?”

“হ্যাঁ। চলো কোথাও বসি।”

পিহু ঘোরের মধ্যে আয়ানের কথায় চলতে থাকে। ওরা রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের নিচে পথচারী হাঁটার স্থানে বসে। সেখানে অনেকেই বসে থাকে।

_______

সকাল থেকে বাড়িতে আত্মীয় স্বজনদের ভীড় হতে দেখে প্রিয়া নিজের ফোনটাও পাচ্ছে না। আবারও ওর ইফা আপু এসে ওকে নানারকমের রূপচর্চাতে শামিল করছে। এদিকে জারিফ কয়েকবার প্রিয়াকে ফোন করে পায়নি। প্রতিবার যেকোনো কাজিন ফোন ধরে বলে প্রিয়া এটা করে ওটা করে। ব্যাস কথা আর বলতে দেয় না।
রাতে প্রিয়া কাউকে না জানিয়ে ছাদে উঠে। তারপর জারিফকে কল করে। জারিফ রিসিভ করার পর প্রিয়া সালাম দিয়েই বলে,

“সো সরি। ওরা আমাকে ফোন ধরতেই দিচ্ছিলো না। ”

“ইটস অকে। তা এখন কেউ নেই?”

প্রিয়া হেসে বলে,
“নাহ্। আমি ছাদে চলে এসেছি কাউকে না বলে।”

জারিফ অবাক হয়ে যায়। দ্রুততার সাথে বলে,

“জলদি ছাদ থেকে নামো। তোমার সাথে কথা বলাটা এখন অতোটাও মেন্ডেটরি না। দাদী বলতো, বিয়ের কনেকে একা একা সন্ধ্যার পর ছাদে উঠতে হয় না। অ্যাই ডোন্ট নো, কতটা সত্য। কিন্তু রিস্ক নেওয়ার দরকারটা কী বলো। পরশু তো হলুদের অনুষ্ঠানে দেখা হচ্ছেই।”

প্রিয়া জারিফের কথাগুলো ভাবলো। তারও এখন গা ছমছম করছে তাই বলে,
“তাহলে বারোটার পর কথা হবে। ওদের ঘুম পারাতে দরকার পরলে চায়ের সাথে স্লি*পিং পি*ল দিবো।”

জারিফ খানিক শব্দ করই হাসে। তারপর বলে,
“তা দরকার নেই। এই দুইদিন কাজিনদের সাথে সুন্দর টাইম স্পেন্ড করো। তারপর তুমি সারাজীবনের জন্য আমার সাথে নিজের বাকি জীবন কা*টাবে। কিছু কথা জমে থাকুক।”

প্রিয়া লাজরাঙা হলো। ওদের টুকটাক কথা হচ্ছিলো প্রিয়া ঘরের সদর দরজায় যাওয়া পর্যন্ত। তারপর কল কে*টে প্রিয়া ওর মায়ের কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। মাকে ছেড়ে চলে যাবে ভাবতেই বিষণ্ণতা ভর করছে মনে। আগের মতো যেকোনো সময় মায়ের ব*কাব*কি, আদর, জড়িয়ে ধরা হবে না। প্রিয়ার মাও মেয়েকে জড়িয়ে কপালে চু*মু খেলেন। মেয়ে বিদায় দিবেন ভেবে তারও ক*লিজা ছিঁ*ড়ে যাচ্ছে। মেয়েকে কাছে পেয়ে শান্তি লাগছে।

চলবে ইনশাআল্লাহ্‌,