হে সখা পর্ব-১১+১২+১৩

0
161

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
একাদশ পর্ব
🚩18+, abusive & disturbed content

প্রায় রাতে গুলিস্তা বিছানা ছেড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে। রেহবার দিনভর কাজেকর্মে ব্যস্ত, অফিসের কাজে ছুটোছুটি করে এসে রাতে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পরলে আর টের পায় না। সকালে আবার তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে হয়। কখনো মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে গুলিস্তাকে পাশে না পেলে এখন আর বিচলিত হয় না। সেদিনের ঘটনার পর সে বুঝে গেছে গুলিস্তা কোথায় যেতে পারে।
ডিনারের পর রেহবার নিজেই আজ দাঁড়িয়ে আছে ব্যালকনিতে। গুলিস্তার সঙ্গ তাকেও আঁধারের প্রতি আকৃষ্ট করে ফেলছে ভেবে নিজেই খানিকটা হেসে নিলো।
খোলা চুলগুলো বেণী করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে ঘরে এসে রেহবারকে দেখতে পেলো না গুলিস্তা। ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলো রেহবার সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। সকালের কথা মনে হতেই ব্যালকনির দরজায় টোকা দিয়ে মৃদু শব্দ করে রেহবারের মনোযোগ আর্কষণের চেষ্টা করলো। রেহবার চকিতে পেছন ফেরে দেখে গুলিস্তা দাঁড়িয়ে আছে৷
– ফুল, এদিকে এসো। দেখো আজকে চাঁদটা কী সুন্দর দেখাচ্ছে।

গুলিস্তা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যেতেই রেহবার ওকে নিজের কাছে টেনে নিলো। গুলিস্তার পিঠ ঠেকেছে রেহবারের বুকে৷ দু হাতে আড়াআড়িভাবে উদর জড়িয়ে ধরে থুতনি ঠেকালো ওর কাধে। আকাশের চাঁদ যেনো আজ জমিনের একটু বেশি কাছে চলে এসেছে। ছোট্ট চাঁদের আকার আজ বহুগুণ বেড়েছে। আলোর তেজে চারদিক চকচক করছে। চাঁদের গায়ে লেপ্টে থাকা কলঙ্ক ক্ষীণ দেখাচ্ছে। গুলিস্তা সেদিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। ওর চোখে মৃদু নমনীয়তা।
উদাসীন চোখের এই পরিবর্তন রেহবারের দৃষ্টি এড়ালো না। চাঁদের সাথে গুলিস্তার কীসের এতো সখ্যতা? যে দৃষ্টি কখনো নিজ পতীর প্রতি নমনীয় হয় না, সে চাঁদের কাছে এতো কোমল কেনো!

গুলিস্তার গায়ে সী গ্রিন কালারের একটি শাড়ি জড়ানো। রাউন্ড নেকের ব্লাউজ পরার কারনে গলা, পিঠের বেশ কিছু অংশ অনাবৃত৷ চাঁদের আলোয় অনাবৃত ফর্সা ত্বকে আলোর প্রতিফলন রেহবারের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। সে আলতো চুমু দিলো গলার অনাবৃত অংশে। হঠাৎ স্পর্শে গুলিস্তা চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। ওকে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে থাকার কারনে ওর শরীরের প্রতিটি পরিবর্তন রেহবার বুঝতে পারছে৷ রেহবারের মূল লক্ষ্য স্ত্রীকে আদর করা নয়, বরং তার প্রতিটি প্রতিক্রিয়া গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্যই এমন পদক্ষেপ নেওয়া।
চমকে উঠলেও গুলিস্তা দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো। পিঠ হতে বেণী সরিয়ে রেহবার সেখানে এলোমেলো চুমুতে ভরিয়ে দিতে থাকলো৷ চাঁদ হতে দৃষ্টি সরিয়ে গুলিস্তা তাকিয়ে আছে নিজের পায়ের দিকে। পা দুটো কি একটু কেঁপে উঠলো? হয়তো না। রেহবার কোনো পরিবর্তন খুজে পেলো না। সেই আগের মতোই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। শরীরে জাগেনি কোনো শিহরণ। রেহবারের ছোয়া তাকে এলোমেলো করে দিতে পারেনি। পা টলে উঠেনি। কেপে উঠে স্ব-শরীরের ভার রেহবারের উপর ছেড়ে দেয়নি।
শুধু শক্ত করে আঁচল চেপে ধরেছে হাতের মুষ্টিতে৷
চাঁদের পবিত্র মোহনীয় আলোয় যেখানে চারিধারের আঁধার কেটে যাচ্ছে সেই মুহুর্তে চোখজোড়া বন্ধ করে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির প্রতি রেহবারের ভীষণ ঘৃণা জন্মালো। এতো বছরের জমানো ভালোবাসার সম্পূর্ণটুকু ঢেলে দিয়েছে নিজের স্ত্রীকে। আর সে কিনা দিনের পর দিন তার ভালোবাসার পবিত্র ছোঁয়াকে এভাবে অপমান করে! ভালো না লাগলে অন্তত প্রতিবাদ করুক। দু হাতে ঠেলে দিক রেহবারকে৷ রেহবার আর কক্ষনো ফিরে চাইবে না, ছুয়ে দিবে না। ভালোমন্দ কিছু তো বলুক। এভাবে অনুভূতিহীন দাঁড়িয়ে থাকার মানে কি?

মাথার ভেতরে দপদপ করা রোগটা ফিরে এসেছে। শিরায় লোহিত কণিকাদের তীব্র বেগে ছোটাছুটি। দাঁতে দাঁত চেপে অনিয়ন্ত্রিত মেজাজকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইছে। তবুও আজ কেনো যেনো নিজেকে সামলানো দায় হয়ে উঠেছে। হাত পা শিরশির করছে। ব্যালকনিতে সুসজ্জিত আছে কিছু সবুজ গুল্মলতা। চোখে আরামদায়ক সেই উদ্ভিদগুলোকে টবসহ ফ্লোরে আছড়ে ফেললে রাগ কিছুটা সংবরণ করা যেতো। নিজের ভেতরে জেগে উঠা অনিয়ন্ত্রিত সত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে রেহবার বেশ খানিকটা সময় নিয়ে লম্বা শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ছাড়লো।

ওর ভেতরে চলন্ত ঝড়ের কোনো আভাসই পেলো না গুলিস্তা। ওকে যখন কোলে নিয়ে ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো, তখনো অন্যসব রাতের মতোই গুলিস্তা নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো। আলতো ছোঁয়ায় কিছুক্ষণ চোখ বুজে সয়ে নিবে।

গুলিস্তাকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া মাত্রই সে স্বভাব অনুয়ায়ী চারদিকে আঁধার ছড়িয়ে নিজের চোখের ঝাপি বন্ধ করে দিলো। কিন্তু রেহবার আজ হেরে যাওয়া কিছুতেই মেনে নিবে না। সে দু হাতে ভর দিয়ে গুলিস্তার উপর ঝুকে কিছুক্ষণ ওকে পর্যবেক্ষণ করলো। সমত বয়ে যাচ্ছে, গুলিস্তার সেই প্রথম খানিকটা অস্বস্তি হলো। অস্থিরভাবে দুপাশে মাথা দোলালো। রেহবার ওর গালে হাত রেখে বললো,
– চোখ খোলো। আজকে একদম চোখ বন্ধ করবে না।

যে কন্ঠ এতোদিন উষ্ণতা ছড়াতো সেখানে আজ অন্তরে কাঁপন ধরা শীতলতা। গুলিস্তা চোখ মেলে চাইতে বাধ্য হলো। ঘরে নীলচে মৃদু আলো জ্বলছে। এই সামান্য আলোতেও রেহবার নিজের এই রুক্ষতার প্রতিফলন দেখার সাহস পেলো না। হাত বাড়িয়ে নিভিয়ে দিলো একমাত্র আলোর উৎস।
ব্যালকনির দরজা খোলা। চাঁদের আলো হুড়মুড়িয়ে ঢুকছে ঘরের ভেতর।
সেই আলোতে গোলাপি ঠোঁটের সন্ধান পেতে রেহবারের খুব একটা সমস্যা হলো না। পাতলা ঠোঁটজোড়া রেহবার ঠোঁট আকড়ে ধরতেই গুলিস্তার চোখজোড়া নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেলো। রেহবার যখন সে দৃশ্য দেখলো, শক্ত হাতে গুলিস্তার চোয়াল চেপে ধরলো। দাতে দাঁত চিপে ওর মুখের কাছে হতে মুখ না সরিয়ে বলল,
– চোখ বন্ধ করতে বারণ করেছি না? একদম অবাধ্যতা করবে না। এর ফল ভালো হবে না কিন্তু।

এর বেশি কিছু গুলিস্তাকে বলতে হলো না। সে লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজের চোখে নিজের বাস্তবতা দেখার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো। মায়াহীন, অনুভূতিহীন বিশ্রী একজোড়া দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে রেহবারের গা গুলিয়ে উঠলো। সারা শরীরে ছড়িয়ে পরলো ক্ষোপের রোশানল। ঠোঁটের ছোয়া আলতো হতে রুক্ষ হলো। নিজের গায়ের পাঞ্জাবিটা এক হাতে টেনে খুলে ফেলে দূরে কোথাও ছুড়ে ফেললো।
গুলিস্তার জ্বল জ্বল করা চোখ দুটোতে কোনো ভাষা নেই৷ যেনো কালো রঙের দুটো কাগজ মাত্র। যেখানে আছে শুধু আঁধার। রেহবারের মনে হলো, এর থেকে বদ্ধ চোখজোড়াই বুঝি বেশি ভালো ছিলো। ভালোবেসে আলতো করে চুমু দিলে মন শান্ত হয়ে যেতো।
গ্রীবাদেশে এলোমেলো চুমু গুলিস্তাকে টলায় না, অথচ ওর শরীরের মিষ্টি ঘ্রাণ রেহবারের নাসিকারন্ধ্রে প্রবেশ মাত্র মস্তিষ্কে মাদকতা ছড়িয়ে পরে। শরীরের প্রতিটি লোম পর্যন্ত জেগে উঠে। শাড়ির আচল সরিয়ে দিলে উন্মুক্ত হয় কারুকার্যময় শরীরের খাঁজ। মসৃণ ত্বকের উদরে রেহবার পরম ভালোবাসায় চুমু এঁকে দেয়। গুলিস্তা দুপাশে দু হাতে বিছানার চাদর খামচে ধরে তাকিয়ে আছে সিলিং এর দিকে৷ রেহবারের করুণ দৃষ্টি ওর মুখের দিকে ক্ষীণকাল স্থির রয়৷ ‘একবার চাও, ফুল। ভালোবেসে না হোক, তীব্র অবহেলা নিয়ে অথবা একগাদা অভিযোগ নিয়ে হলেও একবার এই চোখে চোখ রাখো।’
নিষ্ঠুর প্রিয়তমা সে আকুতি শুনে না।
বক্ষ বন্ধনী অনাবৃত করে সুউচ্চ উপত্যকায় হারিয়ে যায় রেহবার। কতো ছলাকলা, কতোশত ছোয়া তবুও গুলিস্তার হাত দুটো ওর মাথার চুল আকড়ে ধরে না। সে শক্ত হাতে বিছানার চাদরকেই আকড়ে রয়৷ রেহবারের মাথার চুলগুলো ভীষণ শিরশির করে উঠে। নিদারুণ অবহেলায় তারা বোধহয় খুব প্রতিবাদ করলো। রেহবারের আর কিছু ঠিকঠাক মনে নেই। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তলিয়ে গেলো কোনো অতল আঁধারে৷

শিরা উপশিরাগুলো শান্ত হয়ে এলে ক্লান্ত শরীরের ভার ছেড়ে দিলো গুলিস্তার শরীরের উপর৷ ওর বুকে মাথা রেখে জোরালো শ্বাস নিয়ন্ত্রণে আসার অপেক্ষা করলো৷ খানিকবাদে স্বাভাবিক হয়ে এলো হৃৎপিন্ডের গতি৷ নিজের বালিশে মাথা ঠেকিয়ে তাকালো গুলিস্তার দিকে৷ ওর চোখ দুটো প্রায় নিভু নিভু। খুব বেশি ক্লান্ত হয়ে পরেছে কি? ঘুম পেয়েছে মনে হয়৷ রেহবার ওর গালে হাত ঠেকিয়ে ডাকলো,
– ফুল, এই ফুল।

গুলিস্তা সাড়া দিলো না। রেহবারের ডাকে ওর ফুল কখনো সাড়া দেয়নি এমনটা অসম্ভব। মুখে কিছু না বললেও সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ ঠিকই রাখে। তবে আজ ফিরে চাইলো না কেনো? খুব রাগ করেছি কি? রেহবার মাথা উচু করে খানিকটা ঝুঁকে ডাকলো। ততোক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে গুলিস্তার চোখ জোড়া। গুলিস্তার হাত দুটো ওর মাথার উপরের দিকে দু পাশে অবহেলায় পরে আছে। তা দেখে রেহবারের মনে হলো কিছু একটা ঠিক নেই। বিছানা থেকে উঠে দ্রুত ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিলো। গুলিস্তার হাত দুটো মাথার দিক হতে নামিয়ে আনতে গিয়ে রেহবার চমকে উঠলো। দু হাতের কব্জি ভীষণ লাল হয়ে আছে। ফর্সা ত্বকে সেই আঘাত দেখে মনে হচ্ছে চামড়া ভেদ করে রক্ত গলিয়ে পরছে। রেহবারের নিঃশ্বাস আটকে যাবার উপক্রম। কীভাবে হলো এমন?
গুলিস্তার গায়ে চাদর মোড়ানো। রেহবার কাঁপাকাঁপা হাতে চাদর সরাতেই ভয়ংকর এক দৃশ্য দেখে ওর গলা শুকিয়ে গেলো। গুলিস্তার অনাবৃত দেহে নীলচে দাগ। কোথাও কোথাও সামান্য রক্ত লেগে আছে। গ্রীবাদেশের নিচ হতে বুকের দিকে ক্রমশ বেড়েছে সেই আঘাতের চিহ্ন।
রেহবার দুহাতে নিচের চুল খামচে ধরলো। চিন্তিত গলায় গুলিস্তাকে বেশ কয়েকবার ডাকলো৷ কিন্তু সে সাড়া দিলো না। গুলিস্তা জ্ঞান হারিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই৷ বারংবার ডাকেও সাড়া না পেয়ে রেহবার নিজেকে সামলে নিলো। যা হবার হয়ে গেছে। এখন পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে দ্রুত।
ওয়াশরুমে গিয়ে গরম পানিতে বাথটাব ভরে সেখানে গুলিস্তাকে শুইয়ে দিলো। পাশে বসে খুব সাবধানে গায়ের ক্ষত থেকে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত পরিষ্কার করতে লাগলো৷
তীব্র আক্রোশে রেহবারের বিবেক বুদ্ধি লোপ পেয়েছিলো। আলতো ছোয়া কখন রুক্ষ হয়ে গুলিস্তার শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে টেরই পায়নি। রেহবারের রুক্ষ ছোয়ার ফাঁকে দাতের আঘাত যখন গুলিস্তার পাতলা ত্বক ভেদ করে রক্ত বেরিয়ে আসছিলো, তীব্র যন্ত্রণায় গুলিস্তা দু হাতে রেহবারকে নিজের শরীর থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলো। উদ্ভ্রান্ত রেহবার ওর হাত দুটো নিজের একহাতে শক্ত করে ধরে মাথার উপরে আটকে দেয়৷
রেহবারের উগ্র ছোয়া, রুক্ষ আদরে গুলিস্তার চোখ বেয়ে অনেকদিন পর নোনাজল ঝরেছে।
সেই চোখের জলের শুকিয়ে যাওয়া দাগ আলতো হাতে মুছে দিলো রেহবার৷
হঠাৎ খেয়াল হলো, ওর নিজের চোখ বেয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পরছে। কখন থেকে কাঁদছে ও?
দু চোখ মুছে গুলিস্তার সংজ্ঞাহীন দেহটাকে বাথটাব থেকে তুলে নিলো। নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে গেস্টরুমে গিয়ে গুলিস্তাকে শুইয়ে দিলো। দেহের ক্ষতে মেডিসিন লাগিয়ে দিয়ে শিয়রে বসে রইলো। ভোর হতে আর কতোক্ষণ বাকি? ফুলের জ্ঞান ফিরলে কী করে তার সাথে দৃষ্টি মিলাবে? এমন অন্যায় করার পরে নিজের সাথে তো নিজের দৃষ্টি মেলানোই দায়।

চলবে…

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
দ্বাদশ পর্ব

কড়া শাসনে কঠোর নিয়মতান্ত্রিক জীবন কেটেছে গুলিস্তার। বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্য হওয়ার সুবাদে বড়দের সকল ধরনের আদেশ উপদেশ মেনে চলতে বাধ্য থাকতো। রাতে খাওয়ার পর সোজা বিছানায় যেতে হবে এবং খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে। এমনি আদেশ ছিলো গুলিস্তার মায়ের। একটুখানি দেরী হওয়া মানে সেদিন কপালে ঝাড়ুর বারি আর গালাগালি জুটবে নিশ্চিত। দিনের পর দিন প্রচেষ্টা করে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস রপ্ত হয়ে গিয়েছে। আজ বহু বছর পর সেই নিয়মের ব্যাঘাত ঘটিয়ে সকাল নয়টার দিকে গুলিস্তা চোখ মেলে পিটপিট করে চাইলো। ঘরের জানালার পর্দা সরানো হয়নি তখনো। তবুও তেজি সূর্যের প্রখর রোদ জানালা ভেদ করে গুলিস্তার চোখে এসে পরলো। মাথার ভেতর ভীষণ যন্ত্রণা। মনে হচ্ছে কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে৷ খানিকটা নড়েচড়ে উঠতেই অবশ শরীরে নিমিষেই ব্যথা ছড়িয়ে পরলো। ব্যথায় নিঃশ্বাস আটকে যাওয়ার যোগাড়। তীব্র যন্ত্রণায় গুলিস্তার চোখের কোণ ভিজে এলো। হাতের উপর ভর দিয়ে উঠতে চাইলে কব্জির আঘাত নিজের অস্তিত্ব জানান দিলো। যন্ত্রণায় মুখ হতে ‘আহ’ শব্দ বেরিয়ে আসতেই আঘাতপ্রাপ্ত হাত দুটো দিয়ে মুখ চিপে ধরলো। যতোই কষ্ট হোক, আর্তনাদ করা বারণ। দীর্ঘদিন এমন আঘাত না পাওয়ায় সহ্য ক্ষমতা হয়তো একটু কমে গিয়েছে৷ এজন্য একটু আঘাতেই জ্ঞান হারিয়ে গেলো। দাতে দাত চিপে ব্যথা সহ্য করে উঠার চেষ্টা করতেই শক্তপোক্ত দুটো হাত ওকে থামিয়ে দিলো।
– উঠো না। রেস্ট নেও।

গুলিস্তা বাধ্য মেয়ের মতো থেমে গেলো। ওকে বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া করে বসিয়ে দিয়ে অপরপ্রান্তে বসলো রেহবার। দুজনের কেউ কোনো কথা বলছে না। গুলিস্তা তার স্বভাব অনুযায়ী চুপচাপ থাকলেও ঠিকই চেয়ে রইলো রেহবারের দিকে৷ কিন্তু রেহবার? সে তো নিজ কৃতকর্মে এতোটাই লজ্জিত যে গুলিস্তার দিকে তাকানোর সাহসটুকুও পাচ্ছে না।
মাথা নিচু করে স্যুপের বাটি এগিয়ে দিলো গুলিস্তার দিকে।

রাতভর গুলিস্তার পাশে বসে থেকে ওর সেবা যত্ন করেছে৷ শেষরাতের দিকে মেয়েটার গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছিলো। শারীরিক ব্যথার প্রতিক্রিয়া স্বরুপ সেই জ্বরের মাত্রা নেহাৎ কম ছিলো না৷ ঠান্ডা পানিতে কাপড় ভিজিয়ে অনবরত জলপট্টি দেওয়ার কারণে ভোরের দিকে জ্বর কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছিলো। গুলিস্তা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলে রেহবার ফিরে গিয়েছিল নিজের ঘরে। ঘর গুছিয়ে সোজা কিচেনে চলে যায়। নিজের জন্য এক কাপ ব্ল্যাক কফি বানিয়ে তাতে চুমুক দেয়। সারারাত জেগে থাকার ফলে মাথা ধরেছিলো। ক্যাফেইনের প্রভাবে তা ধীরে ধীরে কেটে যেতে থাকে। ফ্রিজ হতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বের করে বেশ সময় নিয়ে গুলিস্তার জন্য স্যুপ তৈরি করে নিলো৷ তা নিয়ে ঘরে এলে দেখতে পেলো গুলিস্তা জেগে গেছে।

স্যুপের বাটি হাতে নিয়ে বসে আছে গুলিস্তা। চামচা দিয়ে হালকা নাড়াচাড়া করছে বাটির মধ্যে থাকা তরলটুকু। আঘাতপ্রাপ্ত হাতে চামচ নড়াতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এই হাতে কীভাবে স্যুপ তুলে মুখে দিবে তাই ভাবছে।
– খাচ্ছ না কেনো? ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

ব্যথা সহ্যের প্রস্তুতি নিয়ে এক চামচ স্যুপ মুখে কাছে নিয়ে আসতেই রেহবার ওর হাত হতে চামচটি নিজের হাতে নিয়ে নিলো। ব্যথার বহিঃপ্রকাশ না করলেও গুলিস্তার মুখে যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট। মুখে ফুটে উঠা রক্তিম ভাব দেখে রেহবার নিজেই বুঝে নিলো। স্যুপের বাটি নিজের কাছে নিয়ে গুলিস্তার কাছাকাছি বসে ওকে খাইয়ে দিতে লাগলো। পুরোটা সময় গুলিস্তা নির্মিষেষ চেয়ে রইলো রেহবারের দিকে। কিন্তু রেহবারের পূর্ণ মনোযোগ স্যুপের বাটিতে। ক্লান্ত চোখজোড়া বড়োজোর গুলিস্তার ঠোঁটে নিবদ্ধ হচ্ছে৷ কিন্তু ওই চোখে ভুল করেও তাকিয়ে দেখছে না।
খেতে ইচ্ছে না করলেও গুলিস্তা পুরোটা খাবার রেহবারের হাতে বিনাবাক্য খেয়ে নিলো।
গুলিস্তার হাতে স্যুপের খালি বাটি রেখে ড্রয়ার হতে পেইনকিলার বের করে সেটি গুলিস্তাকে খাইয়ে দিলো। গুলিস্তার সামনে থাকতে রেহবারের ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। ওর সামনে বসে থাকার অর্থ নিজের অন্যায়ের সম্মুখীন হওয়া। যতো দ্রুত এখনা থেকে বেরিয়ে যাওয়া যায় ততোই স্বস্তি।
– বিছানা থেকে উঠতে হবে না। রেস্ট নেও।

মিনমিনিয়ে কথাগুলো বলে গুলিস্তার হাত হতে খালি স্যুপের বাটি নিতে গেলে গুলিস্তা সেটি আরও শক্ত করে ধরলো। আর একবার চেষ্টা করেও গুলিস্তার হাত হতে বাটি নিতে না পেরে রেহবার অবাক চোখে গুলিস্তার দিকে তাকালো। গুলিস্তা চেয়ে আছে ওর দিকে। সেই প্রথম নির্লিপ্ত চোখজোড়ায় কিছু একটা দেখতে পেলো রেহবার। ওই চোখ জোড়ায় ঘৃণা, অবহেলা, তিরস্কার থাকার কথা। কিন্তু সেখানে জায়গা করে নিয়েছে কিছু জানার আকাংঙ্খা।
তবুও রেহবার বেশিক্ষণ চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। গুলিস্তার হাত দুটোর উপর নিজের হাত দুটো রেখে কোনোরকম ক্ষমা চাইলো।
– স্যরি ফুল। কীভাবে কি হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি।

রেহবারের দুর্বল কন্ঠস্বর, আত্মগ্লানিতে ভরা দৃষ্টি। মাথা ঝুঁকিয়ে সামনে বসে আছে।
হাতের ধরে থাকা স্যুপের বাটিটি পাশের টেবিলে রেখে কোমল একটি হাত রেহবারের গাল স্পর্শ করলো। ধীর কন্ঠে জানালো,
– সব ঠিক আছে। আমি ঠিক আছি।

আত্মগ্লানিতে ডুবে পূর্ণজ্ঞান লোপ না পেলে এই মুহূর্তটি রেহবারের নিকট ভীষণ প্রিয় হয়ে উঠতো। পুলকিত হতো ওর তৃষ্ণার্ত হৃদয়। এই প্রথম গুলিস্তা নিজে থেকে ওকে ছুয়েছে। হাত বাড়িয়ে ভালোবেসে একটুখানি স্পর্শ করেছে। ওর নরম হাতের আলতো ছোয়ার প্রত্যাশী ছিলো যেই ব্যক্তিটি সে এখন সকল ভালোলাগার উর্ধ্বে গিয়ে ডুবে আছে নিজ অপরাধের অনুতাপে। গুলিস্তার পবিত্র ছোঁয়া পেতেই রেহবারের আত্মদহনের লেলিহান শিখা ফুলে ফেপে উঠলো। তখনো গুলিস্তার বাম হাত রেহবারের দুহাতের মাঝে আবদ্ধ। সেই বাম হাতে একফোঁটা নোনাজল টুপ করে পরতেই গুলিস্তার সারা শরীর কেঁপে উঠলো। মানুষটা কি কাঁদছে?
রেহবার মাথা ঝুঁকিয়ে বসে থাকায় ওর মুখমণ্ডল দেখা যাচ্ছে না। গুলিস্তা অবাক চোখে খেয়াল করলো ক্ষণে ক্ষণে মৃদু কেঁপে উঠছে রেহবারের বলিষ্ট দেহ।
হায় খোদা! এমন দৃশ্য গুলিস্তার কাছে একদম নতুন, অপ্রত্যাশিত। নির্বোধ মস্তিষ্কের চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে মনে হয়৷ কী করবে বুঝতে পারছে না। এদিকে রেহবার করুণ কন্ঠে বলে চলেছে,
– স্যরি, স্যরি, ভীষণ স্যরি। আমি এমন কিছু করেছি, বিশ্বাসই হচ্ছে না। কখন এতোটা আঘাত করে ফেলেছি, মনে করতে পারছি না। তোমাকে আঘাত করতে চাইনি বিশ্বাস করো। কীভাবে কি হয়ে গেলো! তুমি আমাকে এতো সহজে ক্ষমা করো না। যা শাস্তি দিতে ইচ্ছে করে, দেও। আমি মাথা পেতে নিবো।

রেহবারের ভেতরটা ভেঙেচূড়ে যাচ্ছে৷ নিজ নীতির বাইরে গিয়ে এমন কর্মকাণ্ডের কারনে স্বীয় বিবেক অনবরত দংশন করে চলেছে৷ এতোদিন গুলিস্তার অবহেলাকে নিজের উপর হওয়া অন্যায় মনে হতো, কিন্তু আজ সে নিজে যা করেছে এই অন্যায় তো গুলিস্তার সমস্ত অন্যায়কে পেছনে ফেলে দিয়েছে। যে মিলন ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ, তা কলঙ্কিত হয়েছে রেহবারের আগ্রাসী কামনায়। কিন্তু সে তো ভালোবেসে কাছে টেনে নিয়েছিলো, কখন এতোটা আগ্রাসী হলো! এতো কীসের ঘৃণা! যার উপর রেহবারের নিজেরই নিয়ন্ত্রণ রইলো না।
চোখ তুলে চাইলো গুলিস্তার দিকে। মেয়েটি এখনো অবাক চোখে চেয়ে আছে তারই দিকে। সেই চোখে নিজের কৃতকর্মের ছায়া দেখতে পেয়ে রেহবার বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না৷ চোখজোড়া বন্ধ করে আনমনে বললো,
– আমার আচরণ পশুর থেকেও অধম। যে মানুষ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে সে তো পশুর সমান।

গালের উপর থাকা গুলিস্তার হাতটি নিজের হাতে জড়িয়ে নিজ গালে আঘাত করতে করতে বললো,
– তুমি চুপ করে থেকো না৷ আমাকে এতো সহজে ক্ষমাও করো না। আঘাতের বিপরীতে আঘাত করো। আমাকে শাস্তি দেও।

আকস্মিক আক্রমণে গুলিস্তা হকচকিয়ে গেলো। অন্যহাতে রেহবারকে আটকানোর চেষ্টা করে সুবিধা করতে পারলো না।
বিয়ের পর থেকে রেহবারকে যেভাবে দেখে এসেছে তার সাথে আজকের রেহবারের কোনো মিল নেই। এতো সম্পূর্ণ ভিন্ন রুপ। সদা প্রাণবন্ত, হাস্যোজ্জ্বল রেহবার গুলিস্তার সাথে কখনো উঁচু গলায় কথা বলেনি, অভিযোগ করেনি, রাগ দেখায়নি। গুলিস্তার মতো একজন অসুস্থ, নির্বোধ মেয়েকে নিজের করে নিয়েছে, আগলে রেখেছে। কখনো মুখে স্বীকার না করলে গুলিস্তা বুঝতে পারে, রেহবার ওকে ভালোবাসে। গুলিস্তার নিজেরও ভালো লাগে অমায়িক, উদার মনের এই মানু্ষটিকে। কিন্তু গুলিস্তা তো সহজ হতে পারে না। রেহবার যতো সহজে কাছে টেনে নেয়, গুলিস্তা ততোটা সহজভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারে না। রেহবার যখন আপনমনে কাজ করে, গুলিস্তা দূর হতে তাকিয়ে দেখে। খুব যত্ন করে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে নিজ হাতে রান্না করে। নিজের কমতিগুলো মেনে নিয়ে তবুও সর্বোত্তম চেষ্টা করে ভালো থাকার। সর্বদা সতর্ক থেকে চেষ্টা করে ভুলে ভরা জীবনে আর কোনো ভুল না করার। কিন্তু সেই তো, তার করা ভুলের কারনে মানুষটা কষ্ট পাচ্ছে। কী তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করছে!
গুলিস্তা ভাবছে নিজ আঘাতের কারনে সে তো নিজেই দায়ী।
এমন কিছু তো হতো না, যদি আমি হেয়ালি না করতাম। নিশ্চয়ই আমার কোনো আচরণে রুষ্ট হয়ে রেহবার আমার উপরে চড়াও হয়েছিলো। আমি যদি ভালোবেসে দু’হাতে তাকে আগলে নিতাম তবে সে এতোটা বেপরোয়া হতো না৷ খেই হারিয়ে ফেলে যখন অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পরেছিলো তখন যদি শক্ত হাতে প্রতিরোধ করতাম, তবে সে নিশ্চিত থেমে যেতো। দোষ তো তার একার নয়। তবে সে কেনো নিজেকে দোষী ভাবছে?
একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষকে এভাবে ভেঙে পরতে দেখা গুলিস্তার জন্য ভীষণ বেদনাদায়ক হয়ে উঠলো৷ নার্ভাসনেসের কারনে ওর নিজের শরীরও কাঁপছে। তবুও হালকা ঝুঁকে একহাতে রেহবারকে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলো। অস্তিত্বের টানাপোড়েনে নিজেকে হারিয়ে ফেলার মুহুর্তে এমন একটি আশ্রয় রেহবারের ভীষণ দরকার ছিলো।

পরের কয়েকটা দিন গুলিস্তাকে সাংসারিক কোনো কাজে হাত দিতে দেওয়া হলো না। বুয়ার সাহায্য নিয়ে ঘরের কাজ গুছিয়ে নিলো রেহবার। টুকটাক রান্নাটা সে নিজেই করলো। ক্রমশ রেহবারের আচরণ পুরনো দিনের মতো স্বাভাবিক হয়ে উঠলেও মনের দিক থেকে সে আরও বেশি হতাশাগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে। সেদিনের পর গুলিস্তা আবারও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। নিয়মিত মেডিসিন, অফুরন্ত বেডরেস্টের কারনে দেহের আঘাত মিলিয়ে গেলো দ্রুত। আর মনে আঘাত? গুলিস্তাকে দেখে মনে হলো না, তার মনে সেই ঘটনার কোনো প্রভাব পরেছে। সে আগের মতোই স্বাভাবিক। এদিকে রেহবার স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রাণপণে। গুলিস্তা সুস্থ হয়ে উঠার পর নিয়মিত অফিস যাতায়াত শুরু করলো। জীবনযাপন আগের মতোই শীতল ও বোরিং হয়ে গেলো। ফিরে এলো রেহবারের সেই খুঁতখুঁতে অনুভূতি। কিন্তু রেহবার এবার বদ্ধ পরিকর, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ কিছুতেই হারাবে না।

চলবে…

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
ত্রয়োদশ পর্ব

মনের মধ্যে সন্দেহ দানা বাঁধলে সেটা সংক্রমণ রোগের মতো ছড়িয়ে পরতে থাকে। রেহবার নিজের সাথে নিজে প্রতিনিয়ত দ্বন্দ করে হাঁপিয়ে উঠেছে। ওর ভরসার একমাত্র স্থান, মা। তাই অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই ব্যাপারে আম্বিয়া খাতুনের সাথে কথা বলবে। কিন্ত সে তো নিজেই জানে না, গুলিস্তার সাথে তার কি সমস্যা হচ্ছে। বিবাহিত জীবনের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার অন্য কাউকে জানানোর কাজটি সে করতে পারবে না। হোক অপরপাশের ব্যক্তিটি তার মা। তবুও সব কথা বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তাই রেখে ঢেকে যতোটুকু বলা সম্ভব, সেইটুকুই বলবে।

ছেলের উদাস চেহারা দিকে তাকিয়ে আম্বিয়া খাতুন শংকিত হলেও স্বাভাবিকভাবেই রেহবারকে প্রশ্ন করলেন,
– তুমি ঠিক আছো? অসুস্থ মনে হচ্ছে।

রেহবার খানিকটা হাসার চেষ্টা করলো, কিন্তু সেই হাসি তার চেহারাতে আরও বেশি করুণ দেখালো।
– আমি ঠিক আছি।
– তাহলে মুখ এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেনো?

মায়ের মন সন্তানের অনুভূতি জানতে বেশি সময় নেয় না। সন্তান চাইলেও মায়ের থেকে লুকিয়ে রাখতে পারে না। মা যদি পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় কি হয়েছে জানতে চায়, সন্তান তার ভয়ংকর অপরাধের কথাও স্বীকার করে ফেলতে পারে। রেহবার ফোনের স্ক্রীনে ভেসে থাকা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মনের সকল কষ্ট নিয়ে ডাকলো,
– মা?

আম্বিয়া খাতুনের বুকটা এক নিমিষেই হু হু করে উঠলো। রেহবার উনার প্রথম সন্তান। মাতৃত্বের প্রথম অনুভূতি। ছেলের থেকে দূরে থাকতে সারাটা ক্ষণ মন পুড়ে। তিনি অস্থিরতা বোধ করলেও নিজেকে শান্ত রেখে জানতে চাইলেন,
– কি হয়েছে রেহবার? কোনো সমস্যায় পরেছ?

রেহবার অনেক দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করলো,
– তোমার মনে হয় না গুলিস্তার সাথে আমার বিয়েতে অনেক তাড়াহুড়ো করে ফেলেছি? কোনো খোঁজ খবর নিলাম না, কোনো কথাবার্তা হলো না। দেখা হলো, বিয়ে হলো।
– পরিস্থিতিই এমন ছিলো। কিন্তু এতোদিন পর এসব কথা আসছে কেনো? বিয়ে যেভাবেই হোক, এখন তো আলহামদুলিল্লাহ সবকিছু ভালোই চলছে। তাহলে এসব বলছো কেনো?
– কিছু একটা ঠিক নেই মা। বিদায়ের সময় দেখেছো, গুলিস্তার বাড়ির লোকজনের আচরণ কেমন অদ্ভুত ছিলো। যেনো মেয়ে বিদায় করে দিলেই বেঁচে যায়। বিয়ের পর রীতিমতো যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। মেয়ে কেমন আছে, তার কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা, শ্বশুরবাড়ির লোকজন ভালো কিনা -এসব নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। ও বাড়ির কেউ আমাদের সাথে যোগাযোগ করে না। বিয়ের পর গুলিস্তার ছোট ভাই দু একবার কল দিয়ে খোঁজ নিয়েছিলো। এখন তো সেটাও করে না।
– তুমি হঠাৎ ওর বাবার বাড়ির লোকজনদের নিয়ে চিন্তা করছো কেনো? শ্বশুরবাড়ির আদর-আপ্পায়ন মিস করছো? তোমার কথাবার্তা টিপিক্যাল বাঙালিদের মতো শোনাচ্ছে। শ্বশুরবাড়ির লোকজন খোঁজ নেয় না, দাওয়াত দেয় না, কোনো উপহার পাঠায় না।
– তোমার কি সত্যি আমাকে এমন মনে হয়? এসবের অপ্রয়োজনীয় রীতিনীতি আমার কখনোই পছন্দ ছিলো না।
– তাহলে এসব নিয়ে এতো ভাবছো কেন? তোমার বুঝা উচিত, উনারা ব্যস্ত মানুষ। পারিবারিক ব্যবসা নিয়ে সবার দিনরাত ছোটাছুটি করে। আপন বলতে আছে গুলিস্তার মা। উনি বৃদ্ধ মানুষ। বেশিরভাগ সময় বিছানায় শুয়ে বসে কাটায়। সেই বগুড়া থেকে সিলেট এসে মেয়ের খোঁজ খবর নেওয়া সম্ভব নয়।
– কল দিয়েও তো খোঁজ নেওয়া যায়।
– পুরনো আমলের মানুষজনের প্রযুক্তি ব্যবহারে একটি আধটু অনীহা থাকে। তাছাড়া সবাই যে তোমার আমার মতো করে ভাববে সেটা তো নাও হতে পারে। উনারা হয়তো মেয়ের বিয়ের পর তার সাথে যোগাযোগ কম রাখে। অনেকে জায়গায় মেয়েদের পরের বাড়ি সম্পদ হিসেবেই গণ্য করা হয়। বিয়ের আগ পর্যন্ত তাকে পরের আমানত হিসেবে দেখভাল করে। বিয়ের পর তাকে নিয়ে আর চিন্তা করে না। দায়িত্ব থেকে মুক্তি মিলেছে এই ভেবে নিজের জীবনে এগিয়ে যায়।
তোমার বিয়ে হয়েছে গুলিস্তার সাথে, আমরা বাড়ির বউ করে ওকে এনেছি। ওর পুরো পরিবারের দায়ভার নিয়ে সে আসে নি। তাই অন্যদের আচরণের প্রেক্ষিতে ওকে বিচার করবে না।
– তোমার গুলিস্তাকে অস্বাভাবিক মনে হয় না?

রেহবার ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে মাকে প্রশ্নটা করেই ফেললো। আম্বিয়া খাতুন ভ্রু কুচকে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। কি উত্তর দিবেন ভেবে পাচ্ছেন না। গুলিস্তার সাথে তিনি সময় কাটিয়েছেন, মাত্র ছয়দিন। মেয়েটা সারাক্ষণ উনার গা ঘেঁষে থাকতো। আদেশ-উপদেশ বিনাবাক্যে শুনেছে। দেশ ছেড়ে আসার পর প্রতিদিন নিয়ম করে গুলিস্তাই কল দিয়েছে। এখন আম্বিয়া খাতুন নিজেই ব্যস্ত হয়ে পরায় প্রতিদিন নিয়ম করে কথা বলা হয় না। তবে সপ্তাহে অন্তত একবার হলেও দুজনের কথা হয়। কখনো কোনো কিছু অস্বাভাবিক মনে হয়নি। মেয়েটা যথেষ্ট ভদ্র এবং আদব কায়দা সম্পন্ন। শুধু একটু কথা কম বলে। এই আর কি। কিন্তু এটা তো দোষের কিছু নয়। তিনি গম্ভীর স্বরে ছেলের কাছে জানতে চাইলেন,
– কি বলতে চাইছো তুমি?

মা রেগে গেলো গলার স্বর গম্ভীর হয়ে যায়৷ প্রশ্নটা যে মায়ের পছন্দ হয়নি, তা টের পেয়ে রেহবার সতর্ক হলো। চেয়ার খানিকটা নড়েচড়ে বসে আমতাআমতা করে বললো,
– না মানে সারাক্ষণ চুপচাপ থাকে, কথা বলে মেপে মেপে। ধরতে গেলে নিজে থেকে কখনো কথা বলেই না।
– চুপচাপ থাকা কোনো দোষের কথা না। আমরা একেকজন একেকরকম মানুষ। কেউ স্বল্পভাষী হলেই সে অস্বাভাবিক হয়ে যায় না।
– ও কখনো হাসে না, কাঁদে না। মন খারাপ পর্যন্ত করতে দেখি নি।
– হাসতে হলে কারন লাগে। অহেতুক কারা হাসে জানো? পাগল। তুমি ওকে হাসির কারন দিতে পারোনি, এটা তোমার ব্যর্থতা। আর কখনো কাঁদেনি, এটা তোমার জন্য ভালো। যদি কখনো কাঁদিয়েছো, আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। ওকে আমি বাড়ির বউ করে নিয়ে আসিনি। নিজের মেয়ে মেনেছি। আশা করি আমার মান রাখবে।

রেহবার চুপ করে আছে। বলার আরও অনেককিছু থাকলেও সেসব মাকে বলা যায় না। মাকে কীভাবে বলবে, তোমার মেয়েসম বৌমাকে চুমু দিলে সে লজ্জা পায় না। বরং ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। কাছে টেনে নিলে লজ্জা পায় না, নির্লিপ্ত চেহারা লুকাতে বুকে মুখ গুজে থাকে। ও কখনো তীব্র কামনায় ভেসে যায় না। একটা জ্যান্ত লাশের মতো বিছানায় পরে থাকে।
রেহবার এক হাতে মাথার চুল টানছে। ছেলের মনের অস্থিরতা দেখে আম্বিয়া খাতুন খানিকটা নরম হলেন। আদুরে গলায় ছেলেকে ডাকলেন,
– রেহবার?

রেহবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকালো। আম্বিয়া খাতুন পারছেন না ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। সে কি এক অপারগতা! শুধু মায়ের মন বুঝে সেই অসহায় অনুভূতি। তবুও তিনি ছেলেকে আশ্বস্ত করতে চাইলেন।
– গুলিস্তার সাথে আমার প্রায় রোজ কথা হয়। সে কখনো তোমার নামে নালিশ দেয়নি। কোনো কিছু নিয়ে অভিযোগ করেনি। অথচ তুমি অভিযোগের পসরা সাজিয়ে বসে আছো। এটা তো ঠিক নয়।
তোমার মন অস্থির হয়ে আছে, আমি জানি। রাহিল, আমি চলে আসায় একা হয়ে গেছো। মানসিকভাবে ভেঙে পরেছো। আমাদের ছাড়া কখনো থাকোনি। তাই একাকিত্ব তোমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। আমাদের এভাবে তোমাকে একা রেখে আসা উচিত হয়নি। আমি ভেবেছিলাম নতুন জীবনের ব্যস্ততায় আমাদের কমতি তোমাকে বেশি পোড়াবে না। জীবনে নতুন মানুষের আগমন তোমার উপরে প্রভাব ফেলতে পারছে না কেনো বুঝতে পারছি না। হতে পারে তোমার অবচেতন মন বিয়েটা এখনো স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। চলে আসার তাড়াহুড়ায় এক প্রকার জোর করেই তোমার বিয়ে দেওয়াটা ভুল হয়েছে।
– বারবার নিজেকে দোষী প্রমাণ করতে চাইছো কেনো মা? বিয়েতে আমার সায় ছিলো বলেই তো বিয়েটা হয়েছে। তোমরা কেউ আমাকে জোর করো নি।
– যা ঠিক তাই বলছি। কিন্তু যা হয়ে গেছে সেটা বদলাতে পারবো না। এখন তোমাকে কষ্ট করে হলেও মানিয়ে নিতে হবে। যদি একবার মন থেকে মেনে নিতে পারো, যে সবকিছু ঠিক আছে। তবে দেখবে আর কোনো কিছু অস্বাভাবিক লাগছে না। বিয়ের দিন তুমি বলেছিলে, মেয়ের বয়স কম। সেই কথাটা সবসময় মাথায় রাখবে এবং সেই অনুপাতে গুলিস্তাকে ট্রিট করবে। ও যৌথ পরিবারে বেড়ে উঠেছে। বিয়ের পর হঠাৎ সিলেট চলে এলো। এখানে সারাদিন একা থাকে, তুমি থাকো অফিসে। ওর ও তো একাকিত্বে ভুগে। হয়তো তোমাকে ভরসা করে উঠতে পারেনি বলে বলতে পারছে না। আমরা তার কাছেই নিজেকে প্রকাশ করি, যাকে ভরসা করা যায়। ওর ভরসার স্থানটা দখল করতে পারলে দেখবে তোমার সাথে অভিমান করবে, অভিযোগ দিবে, আবদার করবে। তোমরা নিজেদের অনুভূতিগুলো একে অপরের থেকে লুকিয়ে রেখেছো। কষ্টগুলো বুকের ভেতর চেপে রেখে নিজের মতো ভালো থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছো।
নিজেরা স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা না করে একে অপরের প্রতি নির্ভরশীল হও।

মায়ের সাথে কথা বলার পর রেহবার সিদ্ধান্ত নিলো, সে এতো সহজে হাল ছেড়ে দিবে না। ধৈর্য্য ধরে প্রচেষ্টা করে গেলে অবশ্যই সমাধান খুঁজে পাবে। সত্যি কোনো সমস্যা থেকে থাকলে সেটা গুলিস্তার থেকে জানতে হবে। আদর যত্নের কাছের হিংস্র পশুরাও হার মানে। গুলিস্তা তার ভালোবাসায় একদিন ঠিকই সাড়া দিবে।

আম্বিয়া খাতুন ঘুমাতে যাওয়ার আগে ছেলের সাথে একবার কথা বলেন। কয়েক মিনিট কথা বলেই ঘুমিয়ে যান। কিন্তু আজকে কথোপকথন এতো দীর্ঘ ছিলো যে রাত পেরিয়ে নতুন দিনের সূচনা হতে চললো, অথচ উনার চোখে ঘুম নেই। ফোন রেখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন ভোর তিনটা বাজে। আজকাল রাহিলের নতুন শখ হয়েছে, সকালে ঘুম থেকে উঠে পার্কে হাঁটতে যাওয়া। আম্বিয়া খাতুনের নাকি বয়স হয়েছে এখন নিয়মিত ব্যায়াম না করলে শরীরে রোগ বাসা বাধবে। তাই সকাল সকাল ছেলের সাথে হাঁটতে যেতে হয়। এখন ঘুমালে হাতে গোনা তিন ঘন্টা ঘুম হবে। তবুও কি আর করার! লাইট অফ করে শুয়ে পরলেন।

রেহবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হতাশ হতে গিয়েও মায়ের কথা স্মরণ করে নিজেকে শাসালো। মন উদাস না করে ধৈর্য্য ধরতে হবে। গুলিস্তা কখনোই অকারণ রেহবারের খোঁজ করে না। সারারাত বাড়ি না ফিরলেও দেখা যাবে এই মেয়ে নাক ডেকে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।

আনমনে হেসে ঘরে ঢুকে দেখলো গুলিস্তা বিছানায় আধশোয়া হয়ে উপন্যাস পড়ছে। দরজা বন্ধ করতে করতে বলল,
– তুমি দেখি এখনো জেগে আছো!

গুলিস্তা বই থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রেহবারের দিকে তাকালো। ওর ডাগর ডাগর চোখের অদ্ভুত দৃষ্টি রেহবারের পরিচিত। গুলিস্তার উত্তরের অপেক্ষা না করে সে নিজেই বললো,
– ঘুম আসছে না, তাই জেগে আছো। এটাই তো বলবে?

বিছানায় গুলিস্তার পাশের জায়গাটি দখল করে ওর হাত থেকে বইটি নিয়ে সযত্নে বেড টেবিলে রেখে দিলো। তারপর ওকে বালিশে শুইয়ে দিতে দিতে বললো,
– এসো, আমি ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।

গুলিস্তা চকিতে রেহবারের দিকে তাকালো। এর পরের ঘটনা সে আন্দাজ করে ফেলেছে। ওর ওমন করে তাকানো দেখে রেহবার হো হো করে হেসে বলল,
– কোনো দুষ্টুমি করবো না। সত্যি বলছি। ভদ্রভাবে ঘুম পাড়িয়ে দিবো। এই যে এভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, চুলে বিলি কেটে দিলে দ্রুত ঘুম চলে আসবে। তুমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকো।

রেহবার এক হাতে ভর দিয়ে শুয়ে অন্য হাতে অল্প কিছুক্ষণ গুলিস্তার চুলে বিলি কেটে দিলো। এরমধ্যেই গুলিস্তার ভারী নিঃশ্বাস পরছে। রেহবার নিজের বালিশে মাথা ঠেকিয়ে তাকিয়ে রইলো ঘুমন্ত গুলিস্তার দিকে। হালকা নীলচে আলোয় গুলিস্তার সরল মুখশ্রী আরও সরল ও নিশপাপ দেখাচ্ছে।

চলবে..