হে সখা পর্ব-১+২

0
277

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
সূচনা পর্ব


রান্নাঘরে বড় পাতিলে পানি ফুটছে টগবগ করে। শর্মীর সেদিকে খেয়াল নেই। সে সমস্ত মনোযোগ একাগ্র করে পাশের বসার ঘরের আলোচনা শোনার চেষ্টা করছে। স্পষ্ট কিছু বুঝা না গেলেও সীমা বেগমের কর্কশ কণ্ঠস্বর ঠিকই কানে বাজছে। এই তো খানিকক্ষণ আগেই ছোট ছেলের উপর রুষ্ট হয়ে চিল্লিয়ে উঠলেন,
ওর আবার মতামতের কি আছে? আমরা যা বলবো তাই করবে।

সীমা বেগমের কথায় সবাই স্বস্তি পেলেও শর্মীর মনটা ভার হয়ে গিয়েছিলো। মেয়েটার জন্য শর্মীর বড় মায়া হয়। কেমন পুতুলের মতো সবাই নাচাচ্ছে তাকে। যে যার মতো সুতোয় টান দিচ্ছে আর মেয়েটা দুলে উঠছে। সবার চোখে সেই দুলে আবার উঠা তিক্ত ঠেকে। তারপর শুরু হয় পাশবিক নির্যাতন। শর্মীর মন পুড়লেও সে চুপ থাকে। এ সংসারে টিকে থাকতে হলে চোখ বুজে, বিবেকের দরজায় তালা বদ্ধ করে রাখতে হয়। এতোদিন অবশ্য সে তাই করে এসেছে। কিন্তু এই শেষবেলা এসে মনটা কেমন করে উঠছে।
বসার ঘর থেকে সীমা বেগম চিল্লিয়ে উঠলেন,
– বড় বউ, চা বানাতে পাঠাইলাম। তুমি দেখি পানি সেদ্ধ করে গ্যাসের সিলিন্ডার খালি করা শুরু করছো। সেই কখন থেকে পানি উতাল দিতেছে! আমি এই ঘর থেকে শুনতে পাচ্ছি। তোমার কানে যাচ্ছে না? কাজকর্মে মন নাই, খালি ধান্দাবাজী।

শাশুড়ির চিল্লানিতে শর্মীর ধ্যান ভাঙলো। আসলেই অনেকক্ষন ধরে পানি ফুটছে। সে দ্রুত হাতে চা বানিয়ে নিলো। শাশুড়ির আদেশ মতো রং চায়ে খানিকটা লবণও মিশিয়ে দিলো। এতে নাকি চিনি কম লাগে। লবণের কারনে হালকা মিষ্টিও কড়া স্বাদ দেয়। এদিকে যে চায়ের স্বাদ নষ্ট হয়ে যায় সেদিকে কে নজর দিবে!

বসার ঘরের একপাশে একটি চৌকি রাখা। সেখানে গদি বিছিয়ে তার উপর বেডশীট, কুশন দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। সীমা বেগমের সারাদিন কাটে এই চৌকির উপর বসে কিংবা শুয়ে। তবুও গভীর রাতে শোবার ঘরে যেতে উনার বেশ কষ্ট হয়। ক্লান্ত শরীরটা নাকি আর চলতে চায় না। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকেই তিনি অসুস্থ বোধ করছেন। সংসার টিকিয়ে রাখতে তড়িঘড়ি করে বড় ছেলের বিয়ে করিয়ে শর্মীকে নিয়ে এলেন। কথা ছিলো সংসারের দায়িত্ব ছেলের বউয়ের হাতে তুলে দিয়ে তিনি এবেলা বিশ্রাম করবেন। কিন্তু সরল চোখে ঘটনা এমন দেখালেও সিংহাসন ছাড়ার পরেও সমস্ত ক্ষমতা এখনো সীমা বেগমের মুঠোর মধ্যেই রয়েছে। শর্মী শুধু উনার আদেশের পালন করে।

ট্রেতে চায়ের কাপ সাজিয়ে বসার ঘরে প্রবেশ করতেই শর্মীর গা কাঁটা দিয়ে উঠলো। আকবর বংশের রাজসভায় আজ সকল কূটনৈতিক ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে। সবাই গম্ভীর মুখে বসে আছে। শীতল চোখগুলো তাকিয়ে আছে শর্মীর দিকেই । শর্মী প্রথম চায়ের কাপটা শাশুড়ির হাতে তুলে দিলো। সামান্য ভুলের কারনে এক্ষুণি শুনতে হতে পারে, শর্মীর মুরুব্বি জ্ঞান নেই। বাবার বাড়ি থেকে কোনো ভালো শিক্ষা পায়নি। নিচু জাতের ঘর থেকে বউ আনলে এমনি দুর্দশা হয়। আরও কতো কি! আগে প্রতিটা বাক্য শর্মীর মনে থাকতো। সেসব মনে করে চোখের জল ফেলতো। এখন সেসব সহনশীলতার পর্যায়ে চলে এসেছে দেখে আর মনে থাকে না।

একে একে দুই চাচা শ্বশুরকে চা দিয়ে দিদারের হাতে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো। দিদার এমনভাবে শর্মীর হাত থেকে চায়ের কাপ গ্রহণ করলো যেনো সামনে দাঁড়িয়ে আছে অপরিচিত কেউ। সামনে স্বয়ং তার স্ত্রী দাঁড়িয়ে অথচ একবার চোখে চোখ রাখলো না, কোনো উষ্ণতা ছুঁয়ে গেলো না। হতাশ শর্মী দ্রুত সরে গিয়ে দাঁড়ালো ছোট দেবর দিহানের সামনে। ওর চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে আছে। নিশ্চয়ই সারারাত না ঘুমিয়ে সিনেমা দেখেছে আর এখন অনিদ্রার অভাবে মাথা ব্যথা নিয়ে এখানে মুখ কালো করে বসে আছে। ভাবীর হাতের চা অবশ্য সে হাসি মুখেই নিলো। ছোট করে ধন্যবাদ জানাতেও ভুললো না।
চা পরিবেশনের সময়টুকু সবাই চুপ রইলো বলে শর্মী কথা শুরু করতে পারছে না। সে ট্রে হাতে একপাশে দাঁড়িয়ে সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকলো। তা দেখে সীমা বেগম বললেন,
– দুপুরের রান্নার ব্যবস্থা না করে দাঁড়ায় আছো কেন?
– কি রাঁধবো আজকে?
– এতোদিন ধরে সংসার করতেছো, এখনো একবেলা রান্নাটা সামলাইতে পারতেছো না? সব কাজ আমারেই দেখায় দেওয়া লাগে। কয়দিক সামলাবো আমি! ফ্রিজ থেকে মুরগীটা বের করো। মুরগীর সাথে বড় বড় করে কয়েকটা আলু কেটে দিবা। করলা কয়েকটা চিকন করে কেটে ভাজি করে নেও।

শর্মী মাথা নেড়ে সায় জানালো। প্রতিদিন এই ঘটনাই ঘটে। একই এপিসোড রিপিট টেলিকাস্ট। শুরুর দিকে একদিন শর্মী নিজের মতো খাবারের আইটেম করেছিলো। সীমা বেগমের সেকি রাগ! ঘরের বউ তাকে সম্মান দেয় না। রান্নার আগে একবার জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করেনি। নিজে মাতাব্বরি করে ছোটলোকের মতো শাকপাতা রান্না করে বসে আছে। সেসব দিয়ে তিনি আর সেবেলা ভাত খেতে পারেননি। এরপর আর শর্মী নিজের বিবেক-বুদ্ধি অপচয় না করে সীমা বেগমের কাছে ছুটে এসে প্রতিদিন নিয়ম করে রান্নার আইটেম জেনে নেয়।
রান্না ঘরের দিকে ফিরে যেতে যেতেও শর্মী ঘুরে দাঁড়িয়ে শাশুড়িকে মিনমিনিয়ে বললো,
– কলেজটা শেষ করে বিয়ের আয়োজন করলে হতো না, আম্মা?

চকিতে ঘরের সবাই অবাক হয়ে শর্মীর দিকে তাকালো। সীমা বেগম তো পারলে চোখ দিয়ে শর্মীকে ভস্ম করে দেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে দিদার ধমকে উঠলো,
– তোমার এতোকিছু না ভাবলেও চলবে, তুমি রান্নাঘর সামলাও।

সীমা বেগম মনে মনে খুশি হলেন। ছেলেরা তার শিক্ষা ভুলে যায়নি। চার ছেলেই মায়ের সম্মান, ভালোবাসায় কোনো কমতি রাখে না। তিনি শর্মীকে বললেন,
– এক পোয়া চাল বেশি করে দিবা। তোমার চাচা শ্বশুরেরা দুপুরবেলা এখানে খাবেন।

শর্মী আর দেরী না করে সেখান থেকে প্রস্থান করলো। ভাগ্য ভালো দিদার শুধু ধমক দিয়েছে। চাচা শ্বশুর দুজন উপস্থিত না থাকলে নিশ্চিত দুটো চড় জুটতো শর্মীর কপালে।
শর্মী রান্নাটা চুলায় চাপিয়ে দিয়েছে মাত্র। সীমা বেগম রান্না ঘর পরিদর্শনে এলেন। উনার কথা মত কাজ কতটুকু হলো, তা না দেখা পর্যন্ত উনি স্বস্তি পান না। আজকালকার মেয়েছেলের হাতে কাজ ছেড়ে দিলে গড়বড়ের আশংকা থাকে বেশি। সবকিছুর দিকে তিক্ষ্ন দৃষ্টিপাত করতে করতে শর্মীকে উদ্দেশ্যে করে বললেন,
– মাইয়া মানুষেরে বেশিদিন ঘরে রাখা মানে, হাতের তালুতে জ্বলন্ত কয়লা নিয়া ঘুরা। সারাক্ষণ হাত জ্বালা করে। মাইয়ার বিয়ার বয়স হইছে। গায়ে গতরে তরতর কইরা বাড়তাছে। তার নিজেরও তো স্বামীর ঘর করার শখ কম না। গায়ের জ্বালা বেশি বইলাই তো আমাগো মান সম্মানের কথা চিন্তা না করে এক বছর আগেই কম কান্ড ঘটায় নাই। পড়াশোনায় মনোযোগ থাকলে কেউ এমন কাজ করে না। যেই মাইয়ার মনে একবার শরীরের ক্ষুধা জেগে উঠে তারে আর ঘরে রাখতে নাই। কথা কওয়ার আগে আগ পাছ বিবেচনা কইরা কইবা।

দুপুরবেলা খাওয়া শেষে সকলে বিদায় নিলো। রান্নার তোরজোড়ে আলোচনায় কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো তা শর্মী জানতে পারেনি। তবে সে নিশ্চিত বিয়েটা হচ্ছে। তবুও মন মানছে না। দিহান এখনো নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছে। ওর জন্য খাবার আলাদা করে রেখে বাকিগুলো ফ্রিজে তুলে রাখলো। ডাইনিং টেবিল থেকে নোংরা থালা-বাসন নিয়ে বেসিনে রাখলো। গুলিস্তা আজকাল নিজের ঘরেই খায়। এঁটো প্লেট আনতে আবার ওর রুমে যেতে হবে। কোণার মাঝারি আয়তনের একটা ঘরে থাকে গুলিস্তা। দরজায় নক করতে গিয়ে দেখলো দরজা লক করা নেই। শর্মী ওকে না ডেকেই ঘরে প্রবেশ করলো। ডাকলেও জবাব মিলবে না সেটা ও জানে।
জানালার পাশে চেয়ারে টেবিলে বসে বই পড়ছিলো গুলিস্তা। ঘরে শর্মীর প্রবেশ বুঝতে পেরেও মাথা তুলে তাকালো না। একমনে অংক কষে যাচ্ছে। ফ্লোরে একপাশে রাখা এঁটো থালা বাসন গুছিয়ে নিয়ে শর্মী ওর দিকে তাকালো। এতো মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে দেখে শর্মীর ভীষণ রাগ হলো। এদিকে মেয়ের জীবন নিয়ে টানাটানি, আর সে বইয়ে মুখ গুজে বসে আছে। তিরিক্ষি মেজাজে গলায় ঝাঁঝ নিয়ে সে বললো,
– বইপত্র এবার ছাড়ো। এখন ওসব পড়ে আর কি হবে? এবার অন্যদিকে একটু মনোযোগ দেও। সবাই মিলে বসে তোমার বিয়ে ঠিক করতে লেগে পরেছে। বইপত্র বস্তাবন্দী করে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার প্রিপারেশন নেও।

প্রশ্নবিদ্ধ চোখে গুলিস্তা বড় ভাবীর দিকে তাকালো। দুপুর পেরিয়ে যাচ্ছে। তেজ কমে আসা আলো জানালা পেরিয়ে গুলিস্তার ফর্সা মুখে এসে পরেছে। গোলাপি মুখখানায় পবিত্রতা উপচে পরছে। লম্বা চুলগুলো দুপাশে বেণুনী করা। গোল গোল দুটো চোখে কৌতুহল। অথচ শর্মী ভেবেছিলো ওই দুই সমুদ্রে থাকবে হতাশার নোনা জল। মেয়েটা এমনি, ভাবনার বাইরে কাজকর্ম করে চমকে দেয়। শর্মীর ইচ্ছে হলো, মেয়েটাকে আলতো হাতে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরতে। কেনো যেনো লজ্জা লাগে। গুলিস্তার পাশে বেশিক্ষণ থাকলে মেয়েটা ওকে মায়ায় ভাসিয়ে নিতে চায়। পবিত্রতায় ভরা মায়াবী মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে না পেরে ঘর ছাড়লো শর্মী। বের হতে হতে বলে এলো,
– গত সপ্তাহের আনা প্রস্তাবটাতে সবার আগ্রহ আছে। বিয়ের কথাবার্তা শুরু করতে যাচ্ছে। নিজেকে তৈরি করো।

গুলিস্তার বিচলিত হলো না। শুধু নিজের ঘরটার দিকে ঘুরে ফিরে তাকালো। দীর্ঘদিন ধরে তার বাস এই ঘরে। কতো নির্ঘুম রাত, কতো দীর্ঘশ্বাস, কতো চোখের জলের সাক্ষী এক ছোট্ট ঘরটা। এই ঘর ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে হবে ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। অবশ্য দম বন্ধ হয়ে যাক, এটাই তো আজকাল একমাত্র চাওয়ায় পরিণত হয়েছে।
গুলিস্তার মনে হলো এই ঘর ছেড়ে যাওয়ার থেকে এই দুনিয়া ছেড়ে যাওয়া বুঝি বেশি সহজ। জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকালো। এখান থেকে ঝাঁপ দিলে তার কি মুক্তি মিলবে? মন উত্তর দিলো দ্রুত। এই দোতলা থেকে ঝাঁপ দিলে হাত-পায়ের হাড়টুকুও ভাঙবে কিনা সন্দেহ আছে। মরে যাওয়া তো দূরের কথা। গুলিস্তা চেয়ার ছেড়ে টেবিলের উপর পা মুড়ে বসে পরলো। তারপর প্রিয় গণিত বইটার একটা একটা করে পাতা ছিড়ে জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দিলো। দস্যি পাতাগুলো সোজা নিচে না পরে খানিক উড়াউড়ি করে একটু দূরে গিয়ে পরছে। গুলিস্তা একেরপর এক পাতা ছিঁড়ে নিচে ফেলে দিচ্ছে কিন্তু কোনোভাবেই সেগুলো সোজা নিচের দিকে যাচ্ছে না। একে তো পাতলা কাগজ তার উপর বাইরে বইছে মাতাল হাওয়া।

চলবে…।

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
দ্বিতীয় পর্ব

বগুড়া সদরে আকবর পরিবার ব্যবসায়িক অঙ্গনে ভীষণ পরিচিত মুখ। অনেক বছর ধরে এরা বগুড়ায় সবজির ব্যবসা করে আসছে। কাঁচা বাজারে তাদের সবজির আড়ত। এছাড়াও এখন স্টক বিজনেস এর দিকে ঝুঁ কেছে। আলী আকবর ছিলেন এই বংশের বড় ছেলে। উনার ছোট দুই ভাই আতেফ আকবর, আদিল আকবর মিলে সবজির আড়তের ব্যবসার পরিব্যপ্তি বাড়িয়েছিলেন। আলী আকবর মারা যাওয়ার পর উনার বড় ছেলে বাবার ব্যবসার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। আলী আকবরের ঘরে চার ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে দিদার ও ছোট ছেলে দিহানের ব্যবসার প্রতি আগ্রহ থাকলেও অন্য দুজন ছেলে দানেশ ও দাউদের আগ্রহ ছিলো লেখাপড়ায়। ওরা দুজন লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে এখন ঢাকা শহরে ভিন্ন দুটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরী করছে। দিদার সবজির আড়ত সামলায় আর দিহান সামলায় স্টক বিজনেস। যদিও যুবক দিহান ব্যবসায় সময় দেয় খুব কম। অল্প মনোযোগ দিয়েও তার ব্যবসা যে এখনো টিকে আছে এবং সামান্য লাভের দেখাও মিলছে তাতেই দিদার খুশি। তার বিশ্বাস বয়সের ফেরে দিহান একদিন ঠিকই দায়িত্বশীল হয়ে উঠবে। আর এখন তার বয়সটাই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার, ঘুরে বেড়ানোর। দিদার সেই সকালে আড়তের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়, ফিরে আসে রাতে। তারপর খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরে। সকাল ছয়টায় তার আড়তে থাকা চাই, চাই।

আজ ঘুমানোর প্রস্তুতি নেওয়ার সময় শর্মী বললো,
– আর একটা বছর পরেই মেয়েটার এইচএসসি কমপ্লিট হয়ে যেতো। তারপর বিয়ের তোড়জোর করলে হতো না? কী বা বয়স হয়েছে ওর!

দিদার বালিশে মাথা দিয়ে চোখে বন্ধ রেখেই উত্তর দিলো,
– পড়াশোনা করে কি হবে শুনি? তুমি নিজেও তো অনার্স শেষ করে বিয়ে করেছো। সেই তো সংসার সামলাচ্ছো। তাছাড়া ওর নিজেরই তো ঘরে মন টিকতেছে না। স্বামীর ঘর করার তাড়া বেশি কিনা।

বোনের জন্য ভাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে শর্মী ভীষণ বিরক্ত হলো। কিন্তু সে পাক্কা অভিনেত্রীর মতো অনুভুতি লুকাতে শিখে গেছে অনেক আগেই। তাই বিরক্তিকে একপাশে রেখে বলল,
– সন্দেহের বশে মেয়েটাকে তো অনেক ভুগতে হলো। সেই এক কারনে এখন বিয়েও দিয়ে দিতে চাইছো? সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে….
– সামান্য ব্যাপার মানে? এখন কি পাড়ায় ছিঃ ছিঃ রব পরার অপেক্ষা করবো? তারপর কোন ভালো ছেলেটা ওকে নিতে আসবে? আমার বোনের একটা ভালো ঘর হতে প্রস্তাব এসেছে বলে তুমি হিংসায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছো । সকাল থেকেই দেখছি সমন্ধ ভেস্তে দেওয়ার পায়তারা করছো।

শর্মীর কথা শেষ করার আগেই দিদার ধমকে উঠলো। অপরদিকে শর্মী হতবাক। সে হিংসা করছে? এতে তার কী লাভ! এই বাড়ির মানুষগুলোকে শর্মীর অদ্ভুত মনে হয়। নেহাৎ গরীব ঘরের মেয়ে শর্মীর কোথাও ঠাঁই নেই, তাই শত অপমান সহ্য করে ও এখানে পরে আছে। এতোদিন অবশ্য সব দেখেশুনে, বুঝেও চোখ বন্ধ করে নির্বিকার জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। গুলিস্তার বিয়ের তোড়জোড় দেখে মনটা মানছিলো না দেখে একটু চেষ্টা করে দেখতে চাইছিলো। কিন্তু হিতে বিপরীত হচ্ছে দেখে শর্মী সিদ্ধান্ত নিলো সে এই ব্যাপারে আর কিছু বলবে না। নির্বিকার ভাবে দর্শকের মত শুধু দেখে যাবে।

দানেশ যে কোম্পানিতে চাকরী করে সেখানের কলিগ আসাদের মাধ্যমে গুলিস্তার বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। আসাদের বন্ধুর বড় ভাইয়ের জন্য জরুরি ভিত্তি পাত্রী খোঁজা হচ্ছিলো। অফিস ক্যান্টিনে বসে আড্ডার মাঝে আসাদ সে কথা বলেছিলো। দানেশের তখন গুলিস্তার কথা মনে পরে যায়। বাড়িতে বিয়ের বয়সী মেয়ে থাকায় প্রেমিকার বাড়ি থেকে বিয়ের আয়োজনে গাইগুই করছে। এদিকে দানেশের বউ ছাড়া আর চলছে না। ঢাকা শহরে একা থাকছে, বুয়ার হাতে খাচ্ছে। এই নিয়ে রত্নাকে যতোবার বলা হয়েছে, সে বলেছে তোমার বোনের বিয়ে হয়ে যাক। সংসারের সব দায়িত্ব মিটিয়ে নেও তারপর আমরা নতুন করে সংসার শুরু করবো।

সুযোগ দেখে দানেশ আসাদকে চেপে ধরলো। যেহেতু ছেলে পক্ষের তাড়া বেশি তাই ফোনে মাধ্যমে ছবি পাঠিয়ে দেওয়া হলো আসাদের বন্ধু রাহিলকে। রাহিলের বাবা বেঁচে নেই, তাই ভাইয়ের বিয়ের দায়িত্ব আপাতত সে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। দানেশও ছেলের ছবি ফোনেই দেখেছে। গুলিস্তার থেকে বয়স তুলনামূলক বেশি হলেও চেহারা দেখে তা বুঝার উপায় নেই। তাছাড়া ছেলের সিলেটে নিজের বাড়ি আছে, বিজনেস আছে। দুই ভাই ও মা নিয়ে ছোট্ট সংসার। ছিমছাম ছোট্ট সংসার। তাড়াহুড়ো থাকলেও নিজের একমাত্র ছোট বোনকে দানেশ তো আর জলে ফেলে দিতে পারে না।

আসাদের থেকে অল্পস্বল্প কিছু তথ্য যোগাড় করে ফোনালাপেই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়ে গেলো।
পাত্রের মা আম্বিয়া খাতুন একবার সরাসরি মেয়েকে দেখার কথা তুলেছিলেন কিন্তু সিলেট থেকে বগুড়া এসে মেয়ে দেখে যাওয়া অনেক ঝামেলার ব্যাপার।
অবশেষে দুই পরিবার মিলে সিদ্ধান্ত নিলো, পাত্রপক্ষ সরাসরি এসে মেয়েকে দেখবে। যদি পছন্দ হয় তাহলে ছোট পরিসরে আয়োজন করে সেদিনেই বিয়ে সম্পন্ন করা হবে। ছেলেপক্ষের আত্মীয়স্বজন তেমন কেউ নেই। মা-ছেলে মিলে মাত্র তিনজন। তারা এসে দেখার পর যদি পছন্দ না হয় তাহলে চুপচাপ ফিরে যাবে। আর পছন্দ হলে বউ নিয়ে ফিরে যাবে।

এদিকে দানেশের দৃঢ় বিশ্বাস, তার বোনের মতো অপরুপ সুন্দরী মেয়েকে কেউ অপছন্দ করতেই পারে না। তাই নিজ পরিবারকে বিয়ের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বলেছে। কিন্তু সীমা বেগমের কড়া নির্দেশ, বাড়ির বাইরে একটা কাকপক্ষীও যেনো বিয়ের আভাস না পায়। একে তো মেয়ে তাদের মানসম্মান মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। লোকজন এখন মুখ বন্ধ করে সব ভুলে থাকার ভান করতেছে। কিন্তু যখনি মেয়ের বিয়ের আলোচনা চলে তখনি অতীতের ঘটনার সাথে মশলা মিশিয়ে পাত্র পক্ষের কানে তুলে দেয়। এমন ধনী পরিবার হাত ফসকে বেরিয়ে যাক, এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারবেন না বাড়ির কর্ত্রী সীমা বেগম।

সবার এতো পরিকল্পনার মাঝে কেউ আয়োজনের মূল চরিত্রকে নিয়ে ভাবলো না। কথায় আছে না, যার বিয়ে তার হুশ নাই, পাড়া পড়শির ঘুম নাই।

গুলিস্তাকে কেউ একবার এসে জিজ্ঞাসাও করেনি, সে বিয়ের জন্য প্রস্তুত কিনা। অন্য সকল দিনে সে যেমন ঘরবন্দী থাকে এখনো তেমনি আছে। নিজের ঘরে খাচ্ছে, ঘুরছে, ঘুমাচ্ছে। শর্মী না থাকলে মনে হয় সে জানতেও পারতো না যে তার বিয়ের আলোচনা চলছে। রাতে খাবার দিতে এসে শর্মী বললো,
– কাল ছেলের বাড়ির লোকজন আসবে তোমাকে দেখতে। পছন্দ হলে কালকেই হয়তো বিয়ে হয়ে যাবে।

যথারীতি গুলিস্তা উত্তর দেয়নি। বরং মুখ ভর্তি ভাতের মাঝে আরেক নলা ভাত নিয়ে মুখে পুরেছিলো।

সে রাতে অনেক দিন পর সীমা বেগম মেয়ের ঘরে এলেন। গুলিস্তা ছলছল চোখে মায়ের দিকে তাকালো। মায়ের চেহারায় কি কোন পরিবর্তন হয়েছে? সেই পরিবর্তন বুঝতে গভীর মনোযোগ দিয়ে বেশিক্ষন তাকিয়ে দেখতে হলো না। মেয়ের চোখে মায়ের আনন্দে ঝলমল করা চেহারাটা সহজেই স্পষ্ট হয়ে উঠলো। যদিও সীমা বেগম যথেষ্ট গম্ভীর ভাব নিয়ে রুমে প্রবেশ করেছেন। কিন্তু গুলিস্তা বুঝে ফেলেছে তার মায়ের মন আজ ভীষণ ভালো। সীমা বেগম গুলিস্তার বিছানার উপর বসে ওকে বললেন,
– টুলটা নিয়ে এসে এখানে বস।

গুলিস্তা টুল নিয়ে এসে মায়ের সামনে মেঝেতে বসলো। এরপর সীমা বেগম অনেক বছর পর মেয়ের মাথায় যত্ন সহকারে তেল মালিশ করে দিতে লাগলেন। মেয়ের চুল কবে কোমড় ছুঁয়েছে তিনি মনে করতে পারছেন না। শেষ যখন তেল দিয়ে দিয়েছিলেন তখন গুলিস্তার ঝাঁকড়া চুল ছিলো। সে তখন স্কুলে পড়তো। থ্রি অথবা ফোরে ছিলো, সীমা বেগমের এখন ঠিক মনে পরছে না।
মাথায় তেল দেওয়া শেষ করে শক্ত করে একটা বেনী গেঁথে দিলেন। লম্বা, মোটা বেণী দেখে মন ভরে গেলো। দুধে আলতা গায়ের রং, কোমড় সমান কুচকুচে কালো ঘন চুল, লম্বায় ভাইদের কাছাকাছি। মেয়ে হিসেবে এককথায় সবদিক থেকে সেরা। এমন মেয়েকে দেখতে এসে ফিরে যায় এমন সাধ্য কার আছে?

তেল দেওয়া শেষে বাটিতে নিয়ে আসা ফেসপ্যাক মেয়ের মুখে মাখিয়ে দিতে শুরু দিলেন। এই ফেসপ্যাকটা তিনি আতেফ আকবরের বড় মেয়ের থেকে বানিয়ে নিয়ে এসেছেন। পুরোটা সময় গুলিস্তা শান্তভাবে মায়ের আদেশ অনুযায়ী কাজ করছে। কতোদিন পর মায়ের স্পর্শ পেয়ে আর কোনো চিন্তা মাথায় আস্তানা গড়তে পারছে না। এই মুহুর্তটা শুধু তার এবং মায়ের। সীমা বেগম কাজ শেষ করে গুলিস্তাকে বললেন,
– এক ঘন্টা পর ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলবি। তারপর চুপচাপ ঘুমায় যাবি। কালকে যেনো দেখতে ফ্রেশ লাগে। চন্ডালের মতো দেখা গেলে মানুষজন যেই পথে আসবে ওই পথেই বিদায় নিবে। আর এমন যদি হয়, তোরে আমি নিজে হাতে খু*ন করে নদীতে ভাসা দিবো। অনেক অশান্তি দিছিস তুই আমারে। চুপচাপ বিয়ে করে বিদায় হয়ে আমাদের শান্তি দে।

মেয়ের অহেতুক ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে সীমা বেগমের মেজাজটা আরও বিগড়ে গেলো। এসব হোমমেড হেয়ার ওয়েল, ফেসপ্যাক সংগ্রহ করতে গিয়ে উনার উপর বেশ ধকল গেছে। শরীরটা বিশ্রাম চাইছে। কালকের আয়োজনের উপর আবার তীক্ষ্ম নজর রাখতে হবে। হাজার হোক শর্মী পরের বাড়ির মেয়ে। হিংসা করে যদি খাবারের আয়োজনে ঘাটতি করে ? বরপক্ষ না করার বাহানা পেয়ে যাবে। নাহ, রান্নার দিকটা উনাকেই দেখতে হবে। বাড়িতে কুটূম আসার কথা যেনো আবার বাইরে না যায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

(চলবে)