হে সখা পর্ব-৩০+৩১+৩২

0
191

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
ত্রিংশ পর্ব

ফজরের নামাজের পর সায়ীদা জামান ও আম্বিয়া খাতুন বারান্দায় বসে চা পান করছেন। ভোরের স্নিগ্ধ সময়টাতে বারান্দায় বসে কাটাতেই ভালো লাগে। সকালের বাতাসে কিছু একটা আছে যা গা ঝরঝরে করে। সায়ীদা জামানের কাপে গ্রিন টি। বেশ স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ তিনি। আম্বিয়া খাতুনের আবার দুধ চা ছাড়া চলে না। তিনি বেশ আয়েশ করে চিনি যুক্ত দুধ চায়ে চুমুক দিলেন। নিরবতা ভেঙে সায়ীদা জামান বললেন,
– রেহবারের ব্যাপারে কি ভাবলে আম্বিয়া?

আম্বিয়া খাতুন ঘাড় ঘুরিয়ে সায়ীদা জামানের দিকে তাকালেন। উনার মনোভাব বুঝার চেষ্টা করছেন। তিনি কি কোনোভাবে বিরক্তবোধ করছেন? নিজ সংসারে অযাচিত উপস্থিতি কেউই বেশিদিন সহ্য করতে পারে না। মেহমান বড়জোর সপ্তাহখানিক ভালো লাগে। এরপর হাঁসফাঁস লাগা স্বাভাবিক। চেহারায় কোনোরকম বিরুপ প্রতিক্রিয়া খুঁজে না পেলেও বিচক্ষণ আম্বিয়া খাতুন বললেন,
– গুলিস্তার সমস্যা যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে পুষে রাখা, তাই চিকিৎসার প্রসেস একটু লং। বছরখানেক এখানে থাকতে হচ্ছে। নতুন অফিসের কাছাকাছি কোনো ফ্ল্যাট দেখে ওরা দ্রুত শিফট করে নেবে।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে আম্বিয়া খাতুনের কথায় অবাক হয়ে মাঝপথে থেমে রইলেন সায়ীদা জামান। গলার স্বর খানিকটা উঁচু করেই বললেন,
– তুমি কি পাগল হয়েছো আম্বিয়া? আমি কি এসব জানতে চেয়েছি! রেহবার আমাদের ঘরের ছেলে। ওর এখানে থাকতে ইচ্ছে করলে এক বছর কেনো, দশ বছর থাকবে। ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার কথা আসছে কেনো? আমার বয়স হয়েছে। এ সময় একলা বাড়িতে থাকতে ভয় লাগে, দমবন্ধ অনুভূতি হয়। তোমরা আছো বলে একটু স্বস্তিতে আছি। কয়েকদিন আগেও অসুস্থ হয়ে বিছানায় পরে থাকতাম। আজ এই অসুখ তো কালটা আরেকটা। এখন দেখো, কেমন হেসেখেলে দিন কেটে যাচ্ছে৷

– না মানে হয়েছে কি ভাবি, ওদের সুবিধা অসুবিধার একটা ব্যাপার আছে না। রেহবার এখানে থাকতে চাইছে না। অফিসে যেতে আসতে অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। গুলিস্তাকে নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তিত থাকে। তাই অফিসের কাছাকাছি থাকতে চাইছে।

– এজন্যই রেহবারের ব্যাপারে তোমাকে ভাবতে বলছি আম্বিয়া। এভাবে কতোদিন? ছেলেটার নিজস্ব জীবন বলে কিছু আছে তো নাকি! আসছে থেকে দেখছি বউকে নিয়ে ছোটাছুটি করছে। ওর নিজের কথা যেনো ভুলেই গেছো। এবার ছেলেটার একটা গতি করে দেও।

– কী বলছো ভাবী? ঠিক বুঝতে পারলাম না।

– তোমরা মেয়ে দেখার সময় বুঝতে পারোনি, এই মেয়ের মাথায় সমস্যা আছে?

– মাথায় সমস্যা নেই ভাবী। সামান্য মানসিক সমস্যা আছে। মানুষের সাথে সহজে মেলামেশা করতে পারে না। কথা একটু কম বলে। এই আরকি।

– ওই একই হলো। আমি তো প্রথম দেখাতেই বুঝে গেছি কিছু একটা গন্ডগোল আছে। তুমি এতো বিচক্ষণ মানুষ। নিজের ছেলের ব্যাপারে এতো বড় ভুলটা কীভাবে করলে বলো তো! আমাদের রাজপুত্রের মতো ছেলেটার কপালে একটা পাগল মেয়ে জুটলো। এটা মেনে নেওয়ার মতো?

– যা হবার হয়ে গেছে। ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছি।

– তা বললে তো হবে না আম্বিয়া। ছেলের এখন বয়স কম। জীবন সম্পর্কে ও কতোটুকুই বা জানে, বোঝে! তোমাকেই সবকিছু করতে হবে। ওর এখনো পুরো জীবনটা পরে আছে। বিয়ে করে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে হেসে খেলে জীবন কাটানোর বয়সে রোগী নিয়ে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। ওর মামার কাছে শুনলাম, কোম্পানিটাও নাকি বিক্রি করে দিচ্ছে। শুনে আমার কী যে খারাপ লেগেছে! আমরা তো দেখেছি, ও কীভাবে দিনরাত পরিশ্রম করে কোম্পানিটাকে দাঁড় করিয়েছে। চাকরী করবে না বলে কতো জেদ করতো। সেই ছেলে নাকি এখন অন্যের কোম্পানি চাকরী করবে। নিজের ইচ্ছায় চাকরী করতে চাইলে তবুও আমি মেনে নিতাম। ওই মেয়েটার জন্য ওকে বাধ্য হয়ে অন্যের কোম্পানিতে খাটতে হবে। এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। ছেলেটার জন্য তোমার কি একটুও খারাপ লাগছে না?

– কী বলবো বলো। রেহবার হয়েছে ওর বাবার মতো। একদম ঘড়কুনো মানুষ। সারাদিন এখানে ওখানে ঘুরেফিরে রাতের দিকে বাড়ি ফিরবেই। নিজের বাড়িতে, নিজের বিছানায় না ঘুমালে নাকি ঠিকঠাক ঘুম হয় না। সেই ছেলেটা নিজের বাড়ি ছেড়ে, নিজের শহর ছেড়ে এখানে থাকবে। ও যতো সহজে কথাগুলো বলছে, ব্যাপারটা ওর জন্য ওতোটা সহজ নয়। আমি তো মা, আমি জানি আমার ছেলেটার কতোটা কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সেসব ও স্বীকার করবে না।

কথাগুলো বলতে গিয়ে আম্বিয়া খাতুনের গলা ধরে এলো। শাড়ির আঁচলে আড়ালে চোখ মুছলেন। খালি চায়ের কাপটি সরিয়ে রেখে সায়ীদা জামান বললেন,
– যা হবার হয়ে গেছে। এখন তোমাকে শক্ত হাতে ছেলের জীবনটা গুছিয়ে দিতে হবে। ও কিছু না বুঝে উল্টাপাল্টা পদক্ষেপ নিলে, তুমি তাতে সায় দিচ্ছো কেনো?

– কি করবো ভাবী? এছাড়া কোনো উপায় দেখছি না। মেয়েটাকে সুস্থ করে তুলতে হবে। এই বয়সের মেয়েরা হেসেখেলে প্রজাপতির মতো ছুটে বেড়ায়। চঞ্চলতায় ঘর মাতিয়ে রাখে। অথচ গুলিস্তাকে দেখো কেমন শান্ত, নীরব। ফাঁকা বাড়িতে ওর নীরবতায় আমার ছেলেটার দম বন্ধ হয়ে আসে। দুটো কথা বলার মানুষের বড়ই অভাব। রোজ রাতে ফোন দিয়ে আমি কথা বলি। ছেলেটা কেমন মলিন চেহারা নিয়ে ফিকে হাসে। মাকে বুঝায় সব ঠিক আছে। আসলে কিচ্ছু ঠিক নেই। আমাদের পরিবার ছোট হলেও হাসি-আনন্দে ভরপুর ছিলো। ভরা পরিবারের মাঝে বেড়ে উঠা ছেলেটা হঠাৎ একলা হয়ে গিয়েছে। এজন্যই তো তাড়াহুড়ো করে ওর বিয়ে দিলাম। ঘরে ফিরে মন খুলে কথা বলার মতো একটা মানুষ থাকলে আহ্লাদ, খুনসুটিতে অলস বিকাল কেটে যাবে। যা ভেবেছিলাম, হলো তার উল্টো।

– হতাশ হচ্ছো কেনো? সব শেষ হয়ে যায়নি। যাদের মেয়ে তাদের ঘরে ফিরিয়ে দিয়ে এসো। এক প্রকার ধোঁকাবাজি করে অসুস্থ মেয়েকে তোমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে, ওরা ভেগে গেছে। তোমরা কেনো ওই মেয়ের জন্য নিজের সুখ-শান্তি নষ্ট করবে। নিজের মেয়ে প্রতি উনাদের কোনো দায়িত্ব নেই? শুনেছি, বিয়ের পরে নাকি আর কোনো খোঁজ খবরও নেয় না।

– কী যে বলো তুমি! ও এখন আমাদের বাড়ির বউ। ওর সকল দায়িত্ব এখন আমাদের।

– এই যুগে এসে এসব ন্যায় নীতির কথা বলো না। সকল দায়িত্ব তোমাদের একলা ? সবটা জেনেশুনে যদি বিয়ে হতো তাও মানতাম। ওরা তোমাদের থেকে আসল কথা চেপে গেছে। ওদের মেয়েকে ফিরিয়ে দিয়ে আসলে, এখানে উনারা কোনো অভিযোগ করতে পারবে না। কারন অন্যায়টা উনারা করেছে। তোমরা যে এতোদিন এই মেয়েকে সহ্য করেছো, ঘরে ঠাঁই দিয়েছো এটাই অনেক। আমার কথা শোনো, গুলিস্তাকে ওর বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেও। ভরণপোষণের দায়িত্ব না হয় রেহবার নিলো। প্রতি মাসে প্রয়োজনের থেকে একটু বেশি করেও টাকা পাঠিয়ে দিবে। চিকিৎসার দরকার হলে, সেই দায়িত্ব মেয়ের পরিবার নিবে। আমরা এতো চাপ নিবো কেনো? প্রয়োজন হলে চিকিৎসার খরচটাও না হয় রেহবার দিলো। বেচারা একলা মানুষ। নিজের ব্যবসা ফেলে, কাজকর্ম রেখে এভাবে ছোটাছুটি ও করতে পারে! তার উপর এতো মানসিক অশান্তি। পুরুষ মানুষ সারাদিন ঘরের বাইরে কাজে-কর্মে থাকে। ঘরে ফিরে যদি এসব চিন্তা করা লাগে, তাহলে মন মেজাজ কতোক্ষণ ঠিক রাখা যায়। তবুও মানতেই হবে, রেহবারের অনেক ধৈর্য্য। অফিস থেকে ফিরে ইমুর আব্বু কোনো ঝামেলা নিতেই পারে না। বাচ্চাদের যতো আবদার, যতো সুবিধা-অসুবিধা সব আমাকে দেখতে হয়। তুমি ভেবে দেখো তো, ওদের যখন বাচ্চাকাচ্চা হবে ওই মেয়ে কি পারবে বাচ্চাদের সামলাতে? নাকি আজীবন রেহবারকে বাচ্চারুপী গুলিস্তাকে সামলে যেতে হবে? রেহবারের নিজের ইচ্ছা নেই? বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সুখে শান্তিতে একটা জীবন কাটানোর স্বপ্ন সবাই দেখে।

– মুখে বলা যতোটা সহজ, বাস্তবে তা করা ততোটা সহজ নয়। গুলিস্তা এখন রেহবারের স্ত্রী। ওর সকল দায়িত্ব রেহবারের। আর রেহবার কখনো নিজের দায়িত্বের অবহেলা করবে না।

– স্ত্রী বলেই এখন এতোকিছু করছে। নতুন বিয়ে হয়েছে, বউয়ের প্রতি টান তো থাকবেই। কিন্তু বিয়ের রেশ কেটে গেলে তখন এই বিয়ে গলার ফাঁস মনে হবে আম্বিয়া। ছেলে কথা না শুনলে, জোর খাটাও। ওই মেয়েকে দূরে পাঠালে ধীরে ধীরে মোহ কেটে যাবে। একসময় রেহবার নিজেই এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চাইবে। আমার যতোদূর মনে হয়, গুলিস্তার সমস্যা এতো তাড়াতাড়ি ঠিক হবে না। আদোও সুস্থ হবে কিনা তার গ্যারান্টিও নেই। চোখের আড়াল হলে, মনের আড়াল হতে কতোক্ষণ? সুযোগ বুঝে ওবেলা একটা লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে দেখে রেহবারের আরেকটা বিয়ে দিয়ে দিও। এই বউ না হয় থাকলো। এমনিতেও আমাদের ধর্মে চার বিয়ের পারমিশন দেওয়া আছে। ছেলে আমাদের দেখতে শুনতে মাশাআল্লাহ অনেক ভালো। ব্যবসা বানিজ্য, ঘর বাড়ি সবই আছে। এমন ছেলেকে কে মেয়ে দিতে চাইবে না! ছেলে মানুষের একটা কেনো, দশটা বিয়ে হলেও ডিমান্ড কমে যায় না। শুধু শুধু একটা অসুস্থ মেয়ের জন্য আমাদের ছেলে কেনো নিজের জীবন নষ্ট করবে? ওর কোন দায় পরেছে। এমন তো নয় যে প্রেমের বিয়ে। ভালোবাসার কারনে বাধ্য হয়ে নিজেকে এমন কষ্ট দিতে হচ্ছে। আজকাল অবশ্য বহু বছরের ভালোবাসাও বিয়ের পর নিঃশেষ হয়ে যায়। এখানে তো ওদের এরেঞ্জ ম্যারেজ। একটু চেষ্টা করলেই বেরিয়ে আসতে পারবে।

আম্বিয়া খাতুন মলিন হেসে সায়ীদা জামানের কাঁধে হাত রাখলেন। নিজেকে যথা সম্ভব শান্ত রেখে বললেন,
– আমাকে যা বলেছো, এ কথা অন্য কাউকে বলো না ভাবী। আমি জানি, রেহবারের জন্য তোমার চিন্তা হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু মেয়েটার ব্যাপারেও তোমার ভাবা উচিত। গুলিস্তার যে মানসিক সমস্যা এটা কিন্তু ওর পরিবারের কারনেই হয়েছে। ওর মায়ের অতিরিক্ত শাষণ ও নির্যাতনের কারনে ওর শৈশব একটা ট্রমার মধ্যে কেটেছে। সেই চাইল্ডহুড ট্রমার কারনে মেয়েটা আজও ভুগছে। আর তুমি ওকে আবার সেই জাহান্নামে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে বলছো! এ পাপ আমার দ্বারা কখনো হবে না। যদি কখনো রেহবার ওকে ছেড়ে দিতে চায়, তবুও আমি গুলিস্তাকে ও বাড়িতে পাঠাবো না। দরকার পরলে আমার কাছে রেখে দিবো। ওই যে বললে না, আমি বিচক্ষণ মানুষ এত বড় ভুলটা কীভাবে করলাম। বিশ্বাস করো, এই ভুল করা নিয়ে আমার খুব একটা আফসোস হয় না। বরং মেয়েটার দিকে তাকালে আমার মনে হয়, ভাগ্যিস ভুলটা করেছিলাম। না হলে আরও কতো বছর মেয়েটা নির্যাতন সহ্য করতে হতো কে জানে! রইলো রেহবারের কথা। গুলিস্তা ওর বিয়ে করা বউ। নিজের বউয়ের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করতে ও বাধ্য। এতে যদি ওকে নিজের সর্বস্ব বিলীন করে দিতে হয়, আমি ওকে হাসি মুখে তা বিলীন করে দিতে বলবো। আমরা মেয়েরা অনেক দুর্বল ভাবী। আমাদের একটা শক্ত হাতের প্রয়োজন হয়। আমরা সব সময় একটা আশ্রয় চাই। এর বিনিময়ে আমরা নিজের সবটুকু দিয়ে দেই। অথচ দিনশেষে সেই আশ্রয়টুকু কি আদোও পাই, বলো? বিয়ের পর মেয়েরা নিজের বাবা-মায়ের কাছে পরের বাড়ির সম্মান বলে ঘোষিত হয়। এদিকে স্বামীর বাড়িতে দেওয়া হয় পরের বাড়ি মেয়ের তকমা। সারাটা জীবন আমি শুধু একটাই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে গেছি, আমি আসলে কার আপন? কারো না। বিয়ের পর স্বামীর বাড়ির সব দায়িত্ব আমাকে নিতে হলো, কিন্তু আমার সমস্ত দায়িত্ব কিন্তু আমার স্বামী নিলো না। আমি শুধু তার ঘরের বউ হয়ে রয়ে গেলাম। আমি চাইনি আমার ছেলেরা সমাজের এই তথাকথিত পুরুষদের মতো গড়ে উঠুক। আমি ওদের এমনভাবে মানুষ করেছি, যাতে ওরা দায়িত্ব নিলে পুরোটা নেওয়ার সাহস রাখে। রেহবারকে দেখে এখন মনে হচ্ছে, মা হিসেবে আমি স্বার্থক। তুমি হয়তো জেনে অবাক হবে, রেহবারকে এভাবে অস্থির হতে দেখে, চিন্তিত দেখে, ছুটাছুটি করতে দেখে আমার খানিকটা কষ্ট হলেও আবার অনেক ভালোও লাগছে। গুলিস্তাকে শুধুমাত্র নিজের দায়িত্ব না ভেবে ওকে নিজের সর্বস্ব করে নিয়েছে। ভালোমন্দ সবটা মিলিয়ে নিজের স্ত্রীকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। ওদের দেখলে আমার এতো শান্তি লাগে!

সায়ীদা জামান বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পেলেন না। শুধু চেয়ে থাকলেন চোখের জলে ভেজা আম্বিয়া খাতুনের হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে। যেখানে কোনো দুঃখ নেই। আছে প্রাপ্তি ও পরিপূর্ণতার ছাপ।

বারান্দার এপাশে দাঁড়িয়ে থাকা গুলিস্তার পক্ষে আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হলো না। পা দুটো কেমন দূর্বল লাগছে। হাঁটুও মনে হয় কাঁপছে ঠকঠক করে। দেয়ালে হাত রেখে নিজের পতন ঠেকিয়ে সে ধীরে ধীরে বসে পরলো ফ্লোরে উপর। রেহবার, তার রেহবার। একমাত্র আশ্রয়স্থল সেটুকুও কি আর থাকবে না?

(চলবে..)

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
একত্রিংশ পর্ব

রেহবারের ঘুম ভাঙ্গলো একটু বেলা করে। রোজকার অভ্যাস অনুযায়ী চোখে মেলে গুলিস্তাকে দেখতে না পেয়ে বিচলিত বোধ করলো। ওয়াশরুমের দিকে তাকিয়ে অলস কন্ঠে ডাকলো,
– ফুল, এই ফুল?

কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। পাশাপাশি দুটো বেডরুমের সামনের অংশে হলরুম। ওয়াশরুম, ব্যালকনি কোথাও নেই গুলিস্তা। রেহবার ঘুম ছুটে গেছে এতোক্ষণে। গুলিস্তা সাধারণত কটেজ ছেড়ে সকালের দিকে কোথাও যায় না। সাগরপাড়ে গেলেও সেটা বিকালবেলা। তাছাড়া ঘড়িতে ঘন্টার কাটা এখনো সাতের ঘর ছোয়নি। এতো সকালে কোথায় গেলো মেয়েটা? মোবাইলে কল দিয়ে দেখা গেলো, রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ রিসিভ করছে না। দ্রুত পায়ে কিচেনে এসে দেখলো সায়ীদা জামান ও আম্বিয়া খাতুন সকালের নাস্তা তৈরি করছে। আশেপাশে কোথাও গুলিস্তা নেই৷
– মা, গুলিস্তা কোথায়?

সবজির কড়াইয়ে ঢাকনা চাপিয়ে আম্বিয়া খাতুন ছেলের দিকে তাকালেন।
– ঘর থেকে বের হতে তো দেখলাম না। আমি ভাবলাম, ঘুমাচ্ছে বোধহয়। ও ঘরে নেই?
– নাহ।
– ব্যালকনিতে দেখেছিস? ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে প্রায় সময়।
– নেই। আমি সব জায়গায় দেখেছি।

আম্বিয়া খাতুনের ভারী দুশ্চিন্তা হলো। ছেলের কাছে এগিয়ে এসে বললেন,
– সেকি রে! এতো সকালে কোথায় গেলো?

মায়ের চিন্তিত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো। স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
– আরে চিন্তা করো। ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেছে হয়তো। ওর আবার নিরিবিলিতে হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস আছে। ভোরবেলা হাঁটতে বেরিয়েছে গেছে হয়তো। আমি ভাবলাম ওকে বেরিয়ে যেতে তুমি দেখেছো বোধহয়। আমি একটু আশেপাশে খুঁজে দেখছি। এতোক্ষণে ফিরে আসার কথা ছিলো।

আম্বিয়া খাতুন নিজেও খুঁজতে বের হতে চাইলেন। রেহবার মানা করে দিলো। এমনিতেই মায়ের হাটু ব্যথা। বেশি হাঁটাহাঁটি করলে অসুস্থ হয়ে পরবে৷ মাকে বুঝিয়ে ঘরে রেখে সে নিজে বেরিয়ে পরলো৷ সকালবেলা রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা। একটু দূরে একটি স্কুলবাস দাঁড়িয়ে আছে। দু চারটে বাচ্চা এগিয়ে যাচ্ছে বাসের দিকে। সুনসান সড়কে এলোমেলো হাঁটতে গিয়ে রেহবারের মনে অদ্ভুত সব খেয়াল আসছে। বোকা ফুলটা অপরিচিত এই শহরে হুট করে হারিয়ে যেতে পারে। খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবুও সেসব সম্ভাবনাকে জোর করে দূরে ঠেলে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে রেহবার। প্রধান সড়কের কোথাও গুলিস্তাকে দেখতে না পেয়ে এগিয়ে গেলো বীচের দিকে। দর্শনার্থীরা হাঁটতে বেরিয়েছে। হয়তো সূর্যাস্ত দেখার পর রুমে ফিরে যায়নি। সারাবছর হলিউড বীচ দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত থাকে। এই এলাকায় বেশিরভাগ হোটেল আর রেস্টুরেন্ট। স্থানীয় মানুষজন খুবই কম। বহিরাগতদের আগমনের কারনে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এখানে প্রায়শই ঘটে। এজন্যই বেশি চিন্তা হচ্ছে। দূর দূর হতে বিচিত্র ধরনের মানুষ আসে এখানে। বিচলিত রেহবার একেরপর এক কল করে যাচ্ছে গুলিস্তার মোবাইলে। কিন্তু অদ্ভুত মেয়েটা ফোন তুলছে না। রাগে, দুশ্চিন্তায় নিজের মাথার চুল নিজে টেনে ছিড়তে ইচ্ছে করছে। আর কতো টর্চার করবে মেয়েটা! নিজেও মানসিক যন্ত্রণায় দিন কাটাচ্ছে, সাথে রেহবারকেও যন্ত্রণা দিচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো রেহবার নিজেও একজন মানসিক রোগীতে পরিণত হবে। তারপর দুজনে সুখের সংসার করবে।

আর সংসার! আগে খুঁজে তো পাই। বিড়বিড় করে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করে সাগরপাড় ছেড়ে আবার বাড়ির সামনের রাস্তা ধরে সোজা হাঁটতে শুরু করলো। খানিকটা ভয় হচ্ছে৷ কোনো বিপদে না পরলেই হয়। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে। এদিকে আগে কখনো আসা হয়নি৷ লোকালয় থেকে একটু ভেতরে হওয়ায় অযত্নে বেড়ে উঠা গাছপালায় ছেয়ে আছে জায়গাটা। দিনের বেলাতেও কেমন অন্ধকারাচ্ছন্ন আবহাওয়া। অচেনা পাখিদের কলতান ভেসে আসছে খুব নিকট হতে৷ বহুদিন এখানে কোনো মানুষের পা পরেছে কিনা সন্দেহ হচ্ছে৷ এমন ভীতু পরিবেশে অন্তত গুলিস্তা আসবে না। সে এমনিতেই আতংকে থাকে। ঘরের কোণে চুপটি করে বসে থাকতে পারলেই যেনো খুশি৷ ঘুম থেকে উঠে ছোট হাতের টিশার্ট এবং ট্রাউজার গায়েই বেরিয়ে পরাটা ভুল হয়েছে৷ এখানের আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। পায়েও ঘরে পরার সাধারণ স্যান্ডেল। দু হাতের তালু ঘষে কিছুটা তাপ উৎপন্ন করার চেষ্টা করতে করতে রেহবার উল্টোপথ ধরলো। ফিরে যেতে হবে।
গুলিস্তাকে আরেকবার কল দিতে গিয়ে পকেট থেকে মোবাইলটি বের করতেই কোথা থেকে স্বচ্ছ আলো এসে স্ক্রীনে সুন্দর প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করলো। রেহবার মুগ্ধ হয়ে দেখলো সে দৃশ্য। প্রকৃতির মাঝে কতো চমৎকার সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে! ঘুরে তাকালো মায়াময় আরণ্যকের দিকে। সবুজ পাতায় ঢেকে আছে চারপাশ৷ পাতার ফাঁক ফোকর দিয়ে কিছু আলোর রেখা প্রবেশ করেছে। যা রেহবারের মোবাইলের স্ক্রীনে প্রতিবিম্বের সৃষ্টি করেছিলো। দুশ্চিন্তার মাঝেও রেহবারের মুখে এক চিলতে হাসি দেখা গেলো। গুলিস্তাকে সাথে নিয়ে আরেকদিন ভোরবেলা এখানে আসতে হবে। এই ভেবে ফিরে আসতে যাবে তখনি চোখ আটকে বিস্ময়কর একটি দৃশ্যে। মোহে ভেসে রেহবার ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে৷

পূর্বদিকে গাছপালায় ঘেরা একটি ছোট পুকুর। খুব বেশি বড় নয় তবে জল দেখে বেশ গভীর মনে হচ্ছে। নিভৃতে অযত্নে পরে থাকা সুগভীর এই খালের পানি ভীষণ স্বচ্ছ। তেজী সূর্যের আলো খালের পানিতে আড়াআড়িভাবে পতিত হয়ে ঝিকমিক করছে। পানিতে সৃষ্টি হওয়া রুপোলী আলো যেকারো মন কেড়ে নিতে সক্ষম। খালের কাছাকাছি যেতেই রেহবার সতর্ক হলো৷ পাড়ের দিকে শ্যাওলা জমে জায়গাটি পিচ্ছিল হয়ে আছে। পিছলে পরার সম্ভাবনা প্রবল। নিজেকে সামলে নিতেই জলে একটা মানব ছায়ার মতোন চোখে পরলো। সরু চোখে ভালোভাবে লক্ষ্য করলে বুঝা গেলো গাছের ছায়ার মাঝে একটি মানব ছায়া স্পষ্ট। চকিতে খালের ধারে নজর দিতেই রেহবারের আত্মা প্রায় উড়ে গেলো৷ খালের ধারে বিপদজনকভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই অদ্ভুত মেয়েটি, যাকে খুঁজতে খুঁজতে রেহবারের প্রাণ যায় যায় দশা। এই ভীতু মেয়েটা এখানে এলো কীভাবে? তাও আবার একদৃষ্টিতে জলের দিকে তাকিয়ে কিইবা ভাবছে৷
খুব সাবধানে পিচ্ছিল মাটিতে পা টিপে টিপে হেঁটে গুলিস্তার খানিকটা কাছাকাছি পৌঁ ছে ধীরে ডাক দিলো,
– ফুল, এই ফুল?

গুলিস্তা যেনো নিজের মধ্যে নেই। চিকন একটি বন্য বৃক্ষে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চল। আর এক পা এগিয়ে গেলে সোজা খালের জালে পরবে নিশ্চিত। উত্তেজনা ও অশনির আশংকায় রেহবারের গা কাঁপছে। তবুও নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করলো। পরপর গভীর শ্বাস ফেলে বার কয়েক গুলিস্তাকে ডাকলো। পকেট থেকে ফোন বের করে গুলিস্তার ফোনে কল দিলো। ওর কুর্তির পকেটে ফোনটি ভাইব্রেট হচ্ছে, অথচ সে যেনো বুঝতেই পারছে না। জায়গা সংকটের কারনে গুলিস্তার কাছাকাছি যেতে পারছে না রেহবার। গুলিস্তা যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে আরেকজনের দাঁড়ানোর জায়গাটুকু অবশিষ্ট নেই। আশেপাশে তাকিয়ে কিছুটা দূরে সাইপ্রাস গাছের শঙ্কু দেখতে পেলো। দ্রুত কয়েকটি হাতে তুলে নিয়ে ঢিল ছুঁড়ে দিলো গুলিস্তার দিকে। নিশানা বরাবর মাথায় আঘাত হানলো শক্ত শঙ্কু। একটুখানিও বিচলিত হলো না গুলিস্তা। শুধু ঘাড় ঘুড়িয়ে শান্ত চোখে তাকালো পেছনে। রেহবারকে দেখে বার কয়েক ঘন ঘন চোখের পলক ফেললো। দ্রুত ওর সামনে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো রেহবার৷
– হাত ধরে সাবধানে এসো।

বিনাবাক্য হাতে হাত রাখলো গুলিস্তা। কাদামাটির চারদিকে স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে। গাছের উঁচুনিচু শেকড় মাটির উপরে উঠে এসেছে৷ মনে হচ্ছে সেগুলোর সাথে ধাক্কা খেয়ে এক্ষুনি হুড়মুড়িয়ে পরে যাবে। রেহবারের ভীষণ মেজাজ খারাপ হলো৷ ইচ্ছে হলো বলতে, এখন কেনো কাঁপছো? আসার সময় মনে ছিলো না?

কাছাকাছি আসতেই ওকে টেনে নিরাপদ অবস্থানে নিয়ে এলো। খুব নিকটে দাঁ ড় করিয়ে চিবুক ধরে চোখে চোখ রাখতে বাধ্য করলো। জানতে চাইলো,
– কি করছিলে এখানে? এমন জায়গায় কেউ একা আসে! জায়গাটা কতোটা বিপদজনক তোমার ধারণা আছে? কখন বেরিয়ে এসেছো তুমি? আমাকে জানাওনি কেনো?

একের পর এক প্রশ্নের পরও উত্তর দেওয়ার কোনো ইচ্ছা গুলিস্তার মধ্যে দেখা গেলো না। সে শুধু নিজের চিবুক ছাড়িয়ে রেহবারকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। বুকের মাঝে মুখ গুজে সকালের কথা ভাবতে লাগলো।

ভোরবেলা হুট করে ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো। মাঝখানে দূরত্ব বজায় রেখে বিছানার অপরপ্রান্তে রেহবার তখন ঘুমে বিভোর। তৃষ্ণা পেয়েছিলো ভীষণ। পানির বোতল খালি দেখে বিছানার ছেড়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে এলো। এখানে ফ্রিজ রাখা আছে। পানি পান করে, বোতলে পানি ভরিয়ে নিয়ে ফিরেই যাচ্ছিলো তখন সায়ীদা জামানের কথা শুনতে পেলো। রেহবারের নাম শুনে খানিকটা আগ্রহ জন্মেছিলো। তাই মনোযোগ দিয়ে কথা শুনতে গিয়ে নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছে৷ ফ্লোরিডা আসার কারণ যে তার চিকিৎসা এটা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি৷ এতোদিন লোকে তাকে আধপাগল বলে সম্বোধন করলে সেটা তাকে খুব একটা ভাবাতো না৷ নিজেই বুঝতে পারে, সে অন্য সবার থেকে আলাদা। অন্যদের যা ভালো লাগে, ওর তা ভালো লাগে না। এখানে আসার পর বাকিটা রানু বুঝিয়ে দিলো। কিন্তু তার সমস্যার কারনে রেহবারকে এতো কিছু ত্যাগ করতে হচ্ছে এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

আকস্মিক কাছে আসায় রেহবার খানিকটা হকচকিয়ে গেছে। গুলিস্তা নিজে থেকে কখনো এতো কাছে আসেনা। সেই রাতের ঘটনার পর রেহবার নিজেও শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেছে। আজকে সূর্য কোনদিকে উঠেছে কে জানে! গুলিস্তা নিজে থেকে ওকে জড়িয়ে ধরেছে৷ সে কি স্বপ্ন দেখছে! রেহবার আরেকদফা অবাক হলো, মৃদু ফোপাঁনোর শব্দ শুনে। নির্জন অরণ্যের নিস্তব্ধতা ভেদ করে সেই মৃদু শব্দটি শুনতে কোনো প্রকার অসুবিধা হলো না। তবুও কেনো যেনো রেহবারের বিশ্বাস করতে চাইছে না। পাথুরে এই ফুলটাকে কখনো কাঁদতে দেখেনি সে। ওকে নিজের বুক থেকে সরিয়ে নিতে চাইলো। একি ভ্রম নাকি সত্যি কাঁদছে দেখা দরকার। কিন্তু গুলিস্তা ওকে ছাড়লো না। আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো। বাধ্য হয়ে রেহবার প্রশ্ন করলো,
– এই তুমি কি কাঁদছো? এই ফুল? কি হয়েছে বলবে তো। কাঁদছো কেনো?

উত্তরে গুলিস্তা দুদিকে মাথা ঝাঁকালো। সে কাঁদছে না। তার কিছু হয়নি। উপায় না পেয়ে রেহবার নিজেও জড়িয়ে ধরলো নীরবে কাঁদতে থাকা মেয়েটিকে। মাথায় চুমু দিয়ে চিবুক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। অপেক্ষা করলো ওর শান্ত হওয়ার।

কতোক্ষণ সময় অতিবাহিত হয়েছে জানা নেই। রেহবারের মনে হচ্ছে এই সময়টা এখানেই থেমে যাক। এই প্রথম গুলিস্তা ওকে নিজে থেকে কাছে টেনে নিয়েছে। নিজেকে একজন কিশোর মনে হচ্ছে।সেই বয়সের উচ্ছ্বাস, ভালোলাগা। এতো বেশি আনন্দ হচ্ছে! কারো কান্নায় এতোটা আনন্দ অনুভব হতে পারে আগে জানা ছিলো না। গুলিস্তা তখনো বুকের মাঝে বন্দী৷ তবে হাতের বাঁধন খানিকটা শিথিল হয়েছে। রেহবার বললো,
– বাড়ি ফিরবে না? এতো বেলা হয়েছে! ক্ষুধা লাগেনি?

সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে গুলিস্তা নিজে থেকে কিছু জানতে চাইলো।
– আমরা বাড়ি ফিরবো কবে?

কান্নাভেজা সতেজ মুখটি সারারাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা সবুজ পাতার মতো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। টি-শার্টের কালো বোতামটি দু আঙ্গুলের মাঝে নিয়ে খেলতে থাকা মেয়েটির প্রেমে আরেকবার পরতে বাধ্য হলো রেহবার।
– এখানে ভালো লাগছে না? আমি তো ভাবছি এখানেই থেকে যাবো।

গুলিস্তা উত্তর দিলো না। শুধু ওর হাত থমকে গেলো। খোলা চুলগুলো বাতাসে উড়ে এসে ঢেকে দিয়েছে গুলিস্তার মুখ। সেগুলো এক হাতে সরিয়ে দিয়ে গালে আলতো করে হাত রাখলো রেহবার। খানিকটা হেসে বললো,
– তুমি কোথায় থাকতে চাও বলো? যেখানে যেতে চাইবে সেখানে চলে যাবো।

রেহবারের চওড়া বুকে গাল ঠেকিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে কোনো দ্বিধা ছাড়াই গুলিস্তা আবদার করলো,
– বাড়ি যেতে চাই। চলুন ফিরে যাই।

(চলবে..)

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
দ্বাত্রিংশ পর্ব

রেহবারের কথায় রানু খুব বেশি অবাক হলো না। প্রায়ই সময় এমনটাই ঘটে। খুব আগ্রহ নিয়ে চিকিৎসা শুরু করার পর মাঝপথে এসে থেমে যায়। এমন অনেক অভিজ্ঞতা আছে রানুর। তবে সে রেহবারকে অন্য সবার থেকে আলাদা ভেবেছিলো। পেশাগত স্থানে আবেগ দিয়ে ভাবলে চলবে না। হতাশা নিজের মধ্যে আবদ্ধ রেখে স্বাভাবিকভাবেই বললো,
– চিকিৎসা কনটিনিউ করা কিংবা অফ করে দেওয়া সম্পূর্ণ আপনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এক্ষেত্রে আমি হস্তক্ষেপ করতে পারি না। তবে আমার ব্যক্তিগত মতামত জানতে চাইলে বলবো, ভুল করছেন। গুলিস্তা সবেমাত্র নিজের সমস্যা বুঝতে শুরু করেছে। নিজেকে থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইছে। ওর মনে অনেক প্রশ্ন জাগবে৷ অনেক মানসিক পরিবর্তন ঘটবে৷ ওর সাহায্যের প্রয়োজন হবে। অথচ আপনি এই মুহুর্তে ফিরে যেতে চাইছেন!

রেহবার চুপ করে রইলো। সে কি একটু স্বার্থপর হচ্ছে না? অবশ্যই হচ্ছে। নিজেই এখানে থাকতে চাইছে না। গুলিস্তার খাতিরে থাকতে বাধ্য হয়েছিলো। এরপর গুলিস্তা যখন বাড়ি ফিরে যাওয়ার আবদার করছে, এখন আর কোনোভাবেই মন টিকছে না।
– চিকিৎসা বন্ধ করে দিচ্ছি না ডক্টর। এই কয়েকদিন ওকে সরাসরি দেখেছেন, অবজারভ করেছেন। সে অনুযায়ী যে মেডিসিন দিয়েছেন সেগুলো রেগুলার নিচ্ছে। বাকি থাকলো কাউন্সিলিং। সেটা অনলাইনে কি কোনোভাবে সম্ভব নয়? একচুয়েলি আমার নিজেরও এখানে ভালো লাগছে না। গুলিস্তাও ফিরতে চাইছে।
– অনলাইন ও অফলাইনের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। অফলাইনে সামনে বসা মানুষটির মনের অবস্থা খুব সহজেই বুঝতে পারা যায়। চোখের ভাষা, বসার ধরণ, কথার বলার ভঙ্গি, গলার স্বর কিংবা বডি মুভমেন্ট এগুলো কি একটি যান্ত্রিক ডিভাইস ঠিকঠাকভাবে আমাকে দেখাতে পারবে?

রেহবারের কাছে কোনো উত্তর নেই। সে নিজেও জানে ব্যাপারটা এতোটা সহজ হবে না।
– কিছুটা কমতি হয়তো থেকে যাবে কিন্তু বাড়িতে যে মানসিক শান্তিটুকু পাওয়া যেতো সেটা এখানে পাচ্ছি না। এখানে আসার পর থেকে গুলিস্তা নিজেও ঘরের কোণে বসে থাকে। শুধুমাত্র আপনার সাথে দেখা করতে যা একটু বের হয়। অথচ আমাদের বাড়িতে সারাদিন পুরো বাড়ি জুড়ে ঘুরে বেড়াতো। এটা ওটা কাজ করতো।

মানুষ যেখানে বাস করে সেই জায়গাটির সাথে আত্মিক বন্ধন গড়ে উঠে। এজন্যই তো নিজের শহরে, নিজের এলাকায় ফিরতেই চেনা বাতাসের গন্ধে মনটা নিমিষেই ভালো হয়ে যায়। ঘর ছেড়ে দূরের গেলে ক্লান্ত মনটা ছুটে যেতে চায় বিছানার চাদরের সেই পরিচিত সুবাসে। এই খুব সাধারণ সাইকোলজিকাল ফ্যাক্টটি বুঝতে রানুর খুব বেশি অসুবিধা হলো না। ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার সাধ্য বা ইচ্ছা তার নেই। মনে মনে অখুশি থাকলেও মেনে নিলো।
– যেতে চাইছেন বাধা দিবো না। তবে এতে আপনার দায়িত্ব বহুগুণ বেড়ে যাবে। নিজের সমস্যাগুলো বুঝতে পারার পর গুলিস্তার পাশে এখন কাউকে প্রয়োজন। ওর মনের চারপাশে যে শক্ত দেয়ালটি ছিলো সেটির ভিত্তি নড়ে উঠেছে। সেই দেয়াল ভেঙে ফেলার দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে। দেয়ালের মাঝে আটকে থাকা মেয়েটিকে বাইরে নিয়ে আসতে হবে এবং হাত ধরে পথ চলা শেখাতে হবে। যে মেয়েটা এতোদিন নিজেকে ঘরবন্দী রেখেছিলো সে এখন কারো প্রতি নির্ভরশীল হতে চাইবে। এটাই উত্তম সময়। এ সময় আপনি যদি ওর মনে বিশ্বাসের জায়গাটি নিতে পারেন, তাহলে সারাজীবনের জন্য সে আপনাকে নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষ হিসেবে গ্রহণ করে নিবে। এই মুহূর্তে গুলিস্তার সুস্থতা আপনার সহযোগিতার উপর নির্ভর করছে। বুঝতে পারছেন তো?
– আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।
– শুধু চেষ্টা করলে হবে না। আপনাকে যথেষ্ট সচেতন থাকতে হবে। আপনার দ্বারা সামান্য আঘাত পেলে গুলিস্তা ভয়ংকরভাবে ভেঙে পরবে। যেখান থেকে ওকে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। পথ যেহেতু দীর্ঘ তাই আপনাকে প্রচুর ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে। মনে রাখবেন, কিছুদিন পর লক্ষণগুলো চলে গেলে ঔষধ বন্ধ করে, ফলোআপ বন্ধ করে দিবেন না। এর ফলে পরবর্তীতে রোগ আরও জোরালো হয়ে উঠবে।
– চিন্তা করবেন না। আমি নিয়মিত আপনার সাথে যোগাযাগ রাখবো। আপনি আমাকে দিকনির্দেশনা দিয়ে সাহায্য করুন।
– এর জন্য আপনাকে গুলিস্তার মানসিক অবস্থা বুঝতে হবে। সহজ ভাষায় বলি। শিশু বয়সে অবহেলা ও নির্যাতনের কারনে নিজেকে রক্ষা করতে ও নিজের চারপাশে অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিয়েছে। যেখানে নিজস্ব জগতে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছে। এরজন্য ওকে বিসর্জন দিতে হয়েছে নিজের আবেগ, অনুভূতিকে। মেডিকেলের ভাষায় ব্যাখ্যাও আপনার জানা প্রয়োজন। এটি মূলত আবেগগত, উপলব্ধিগত সমস্যা।
মায়ের বিরুপ আচরণের কারনে ওর শৈশব অস্বাভাবিক ছিলো। মায়ের থেকে বিভিন্ন সময় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের স্বীকার এবং পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধু বান্ধবের হাসির পাত্র হওয়া, একাকীত্ব ইত্যাদি কারনে চাইল্ডহুড ট্রমার স্বীকার হয়েছে। যা দীর্ঘদিন ধরে ওকে ভেতরে ভেতরে নিঃশেষ করে দিয়েছে।
অসুস্থতা চেপে রাখতে রাখতে ভিন্ন ধরনের ফোবিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে সোশ্যাল অ্যাংজাইটি বা সামাজিক উদ্বেগ ব্যাধির প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। এসব রোগীর মধ্যে অপরিচিতদের ভয় পাওয়া, অপমানের ভয়, অন্যদের দ্বারা বিচার করার ভয় দেখা যায়। এজন্য তারা সামাজিক পরিস্থিতিগুলি এড়িয়ে চলে। এছাড়াও স্কিজয়েড পারসোনালিটি ডিসওর্ডারের ক্ষেত্রে সারাক্ষণ হাস্যরসহীন, নিস্তেজ থাকে। আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক ও প্রতিক্রিয়ার অভাব দেখা দেয়। এদের অস্বাভাবিক মাত্রায় একাকী দেখায়। অকারন মন খারাপ থাকে, নিজেকে গুটিয়ে রাখে। যৌন অস্বস্তি, নিক্রিয়ভাব, উদ্যোগের অভাব, অদক্ষতা ও ভুলে যাওয়ার মতো সমস্যাতে ভুগে। আপনাকে এই বিষয়গুলো মনে রেখে প্রতিনিয়ত নির্দিষ্ট সমস্যা চিহ্নিত করে ওকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। সমস্যার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে হাতে ধরে অক্ষমতাগুলো দূরীকরণে সহায়তা করাই হবে আপনার কাজ। ওর ভয়গুলোকে জয় করতে সাহস দেবেন, সঙ্গ দেবেন। ওর সাথে কথা বলবেন, মনের কথা জানতে চাইবেন। জনসম্মুখে কথা বলা ও চলাফেরা করতে শেখাবেন। যেভাবে একটি শিশুর হাতে ধরে ছোট ছোট বিষয়গুলো শেখানো হয় সেভাবে। ধরে নিন, আপনার উপর একটি শিশুর লালন-পালনের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।

রানুর কথা শুনে রেহবার সামান্য হেসে উঠলো। বাচ্চা জন্ম দেওয়ার বয়সে নিজেই বাচ্চা হয়ে বসে আছে। কী অদ্ভুত! ওর হাসি দেখে রানু বললো,
– আপনি হাসছেন! এটা মোটেও সহজ কোনো কাজ হবে না। কারো ভয় দূর করার কাজটি আসলে অনেক কঠিন।
– খুব বেশি কঠিনও নয় ডক্টর। ওর সমস্যাকে, ভয়কে নিজের করে নিলে আর কঠিন মনে হবে না।
– তবে রেহবার, চিকিৎসার পরেও রোগীর মধ্যে কিছু লক্ষণ ও অক্ষমতা থেকে যেতে পারে। আপনাকে সেভাবে মেন্টাল প্রিপারেশন নিয়ে রাখতে হবে।

চিন্তিত মুখশ্রী নিয়ে রেহবার তাকিয়ে রইলো রানুর দিকে। সত্যি কি আগামি দিনগুলো খুব বেশি কঠিন হতে চলেছে? চ্যালেঞ্জিং দিনগুলোতে রেহবার পারবে তো গুলিস্তার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে?
– আপনাকে একটা সিক্রেট বলি, অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনতে পারলে ওর হারিয়ে যাওয়া সমস্ত আবেগ, অনুভূতির একগুচ্ছ অধিপতি কিন্তু আপনিই হবেন। এতদিন যে ভালোবাসার জন্য হাপিত্যেশ করছেন, তার দ্বিগুণ পাবেন। ওর গোটা পৃথিবী শুধুমাত্র আপনাকে ঘিরে হবে। তাই এখন একটু ধৈর্য্য ধরুন।

মিষ্টি হেসে রেহবারকে অনুপ্রেরণা যোগালো রানু। ভালোবাসা ছাড়া কতোজনে সংসার করছে। রেহবার চাইলে এভাবে সংসার করে যেতে পারতো। মানসিক শান্তি কিংবা এক্সাইটিং এক্সপেরিয়েন্সের জন্য ঘরের বাইরে অনৈতিক সম্পর্ক তৈরি এখন খুব সহজ এবং জনপ্রিয় পদ্ধতি। গুলিস্তার মতো স্ত্রী ঘরে থাকলে ধরা পরার ভয়ও থাকে না। তবুও এই ছেলেটা নিজের দেশ ছেড়ে, নিজের কাজ ফেলে, স্বপ্ন ফেলে ছুটে এসেছে স্ত্রীর স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করতে।

– আমাদের জন্য দোয়া করবেন ডক্টর। সামনের সপ্তাহে আমাদের ফ্লাইট। মা, ভাইকে এখানে রেখে যাচ্ছি। মাঝেমধ্যে আসবো আপনার শহরে। আপনার সাথে দেখা হবে। পেশাগত দায়িত্বের বাইরে গিয়ে আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছেন। আপনিই প্রথম ব্যক্তি যার সাথে গুলিস্তা এতোসময় ধরে এতো কথা বলেছে। আপনাকে আমার হিংসা করা উচিত আসলে। আমি ওর হাসবেন্ড হয়েও এতো এটেনশন পাইনি। আমরা দুজনে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো।
– নিজের দেশের মানুষের সাথে কি শুধু পেশাদারী সম্পর্ক হয় নাকি! গুলিস্তা এতো মায়ামতী একটা মেয়ে, যে কেউ ওকে ভালোবেসে ফেলবে। আপনাদের দুজনকে একসাথে দেখলে ভীষণ ভালো লাগে রেহবার। চোখের শান্তি, মনের শান্তি। ওকে কখনো একা ছাড়বেন না। দোয়া করি দুজনে একসঙ্গে সুখী হন। যেকোনো প্রয়োজনে বিনা দ্বিধায় আমার সাহায্য চাইবেন। আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করবো।

এই সাতদিন গুলিস্তার উপর দিয়ে যেনো ঝড় বয়ে গেলো। আশেপাশের যতো ভালো রেস্টুরেন্ট আছে সবগুলোর খাবার টেস্ট না করিয়ে সায়ীদা জামান ক্ষ্রান্ত হলেন না। পুরোটা সময় অস্বস্তিতে গাট হয়ে রেহবারের পাশে গুটিশুটি হয়ে বসে থেকেছে গুলিস্তা। এতো লোকজনের ভীড়ে ওর গলা দিতে খাবার নামতে চায় না। তবুও বাধ্য হয়ে দু চামচ মুখে দেয়। অন্যদিকে আম্বিয়া খাতুন পারলে পুরো শপিংমল তুলে নিয়ে আসেন। গুলিস্তা একা শপিং করতে পারে না, এই কথা উনার মনে আছে। তাই গুলিস্তাকে সাথে নিয়ে শপিংমলে ঘুরে ঘুরে অনেকগুলো ড্রেস কিনে দিলেন। পুরোটা সময় গুলিস্তার হাত ধরে ঘুরলেন। বাড়িতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলেন।

– রেহবার কোনো ঝামেলা করলে, কথা না শুনলে অথবা তোমাকে বিরক্ত করলে আমাকে শুধু কল দিয়ে জানাবে। বাকিটা আমি দেখে নিবো। দূরে থাকি বলে ভেবো না ওকে শাসন করতে পারবো না। দরকার হলে এখান থেকে গিয়ে দুটো থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে আসবো।

উত্তরে ডান পাশে মাথা হেলিয়ে গুলিস্তা আস্তে করে জানায়,
– আচ্ছা।

অফিস-ভার্সিটির ব্যস্ততার মাঝেও সময় করে রাহিল আজ মার্কেটে গিয়েছে। রেহবার ও গুলিস্তার জন্য কিছু গিফট কিনে হাজির হলো রেহবারের ঘরে। রেহবার ও গুলিস্তা মিলে লাগেজ গোছাতে ব্যস্ত। এতো জামাকাপড় কীভাবে নিবে তাই ভাবছে। দরজায় নক করে রাহিল ডাকলো,
– ভাই আসবো?

অনুমতি পেয়ে ধুপ করে বসে পরলো এলোমেলো করে রাখা বিছানার উপর। ছড়ানো কাপড়গুলো রাহিলের নিচে চাপা পরতে দেখে রেহবার কপাল কুচকে বললো,
– কাপড়গুলোর উপর বসে পরলি! কবে বড় হবি তুই?
– বড় হয়ে কাজ নেই আমার। আমি এভাবেই ঠিক আছি। তোমাদের জন্য গিফট নিয়ে এসেছি। দেখো তো পছন্দ হয় কিনা?

বিছানায় গা এলিয়ে কাপড়ের উপরেই গড়াগড়ি দিতে থাকলো। ওর দিকে খানিকক্ষণ হতাশা ভরা দৃষ্টি দিয়ে তা সরিয়ে নিলো রেহবার। গুলিস্তা তখনো একপাশে দাঁড়িয়ে বিছানার উপরে রাখা বক্সগুলো দেখছে। রেহবার কিছু বলার আগেই রাহিল বললো,
– এই পিচ্চি ভাবী, তুমি খুলে দেখো। পছন্দ না হলেও বলবে পছন্দ হয়েছে। কেনাকাটার ব্যাপারে আমি একদম কাঁচা। হাতের কাছে যা পেয়েছি তুলে নিয়ে এসেছি।

এগিয়ে এসে বিছানার এককোণে বসে বক্স খুলতে শুরু করলো। গুলিস্তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলো রেহবার। বক্সের ভেতর রেহবারের জন্য একটি ঘড়ি এবং পারফিউম। গুলিস্তার জন্য কয়েকটি চকলেট বক্স, সোল্ডার ব্যাগ, একটি নেকলেস। কেনাকাটায় নিজেকে অদক্ষ বলে দাবী করলেও রাহিলের কেনা প্রতিটি গিফট ভীষন সুন্দর এবং ক্লাসি। বিখ্যাত ব্রান্ডের দামী হাত ঘড়ির দিকে রেহবারকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রাহিল বললো,
– পছন্দ হয়নি? আমি আগেই বলেছিলাম, এসব আমি পারি না।
– এটা অনেক দামী। কী দরকার ছিলো এসবের?

একহাতের উপর ভর দিয়ে একপাশে শুয়ে রাহিল সরাসরি তাকালো ওর ভাইয়ের দিকে।
– সবসময় তোমরা আমাকে দিয়েছো। যা চেয়েছি সাথেসাথেই পেয়ে গেছি। এখন আমি আয় করতে শুরু করেছি। প্রথম স্যালারি পেয়ে সবার জন্য সাধ্যমতো গিফট কিনেছিলাম। তোমার আর ভাবীর গিফট বাকি ছিলো। এই সুযোগে তোমাদেরটা দিয়ে দিলাম। বাবা আগেই ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো। তাই বাবার ভাগেরটাও তোমার।

এক সময় এই পিচ্চি ছেলেটা হাত ধরে হাঁটতো। এই তো কয়েকদিন হলো, ভাই, ভাই বলে পিছনে ছুটেছিলো। রেহবার ক্রিকেট খেলতে যাবে বলে কতো লুকিয়ে চুপিয়ে বাড়ি থেকে হতো! খেলা শেষে বাড়ি ফিরে দেখতো রাহিল তখনো কাঁদছে। ভাইকে দেখতে পেয়ে সব ভুলে ছুটে এসে কোলে ঝাঁপিয়ে পরতো। সময়গুলো কতো দ্রুত ফাঁকি দিয়ে চলে যায়! রাহিলের মাথায় হাত বুলিয়ে রেহবার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। বাবার কথা ভীষণ মনে পরছে।

– তোমার পছন্দ হয়েছে, পিচ্চি ভাবী?
– হ্যাঁ।
– চকলেট কিন্তু তোমাদের দুজনের। একলা খেয়ে ফেলো না যেনো।

রাহিল চলে যাওয়ার পর গুলিস্তার মনে হলো, সেকি রেহবারকে সবার থেকে আলাদা করে দিচ্ছে? কোনোকিছু বিবেচনা না করে শুধু নিজের কথা ভেবে বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা বলা উচিত হয়নি। এখানে মা, ভাইয়ের সাথে রেহবার হয়তো বেশি ভালো থাকবে। খুঁজতে গিয়ে দেখা গেলো রেহবার দাঁড়িয়ে আছে জানালার পাশে। এবাড়ির তিনটি দিকে দারুণ বীচ ভিউ পাওয়া যায়। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দূরের সাগরের ঢেউয়ে রেহবার যেনো নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। গুলিস্তা গিয়ে ওর পাশে দাঁড়ালো। বিরক্ত হবে কিনা এইভেবে নিশ্চুপ রইলো। ওর উপস্থিতি বুঝতে পেরে সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে ওকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে নিলো রেহবার।
– বাবাকে ভীষণ মনে পরছে ফুল। সময় কতো দ্রুত চলে যায় দেখেছো? এই তো সেদিন এলাম। দেখতে দেখতে এক মাস পেরিয়ে গেলো! কালকেই আবার ফিরে যেতে হবে।

বুকে পাথর চেপে গুলিস্তা উত্তর দিলো,
– আপনার যেতে ইচ্ছে না করলে আমরা থেকে যাই।
– যেতে ইচ্ছে করছে না কে বললো! সিলেটের বাতাসের অভাবে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। এখানে মা,ভাইকে রেখে যেতে কষ্ট হচ্ছে শুধু। এই কয়েকদিনে সবাইকে সাথে নিয়ে থাকার অভ্যাস হয়ে গেছে। তাই ছেড়ে যাওয়ার বেলায় আগের মতই কষ্ট হচ্ছে।
– খুব কষ্ট হচ্ছে?

গুলিস্তাকে আরোও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু এঁকে দিয়ে বললো,
– এখন একটু কম হচ্ছে।

এই মুহুর্তে সত্যি রেহবারের কষ্ট অনেকটা কমে গিয়েছে। গুলিস্তা কি খেয়াল করেছে, এই প্রথম সে নিজে থেকে রেহবারের মনের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চেয়েছে? রেহবারের দুঃখ অনুভব করতে পেরেছে। কষ্ট ভাগাভাগি করে নিতে এগিয়ে এসেছে। ও খেয়াল না করলেও রেহবার খেয়াল করেছে। গুলিস্তার ছোটোখাটো সকল বিষয়ই রেহবার খেয়াল করে। ওর শ্বাস প্রশ্বাসের স্থায়িত্বের পরিমাপও লক্ষ্য করে। এই যে এই মুহুর্তে গুলিস্তার মধ্যে কোনো অস্বস্তি নেই, জড়তা নেই। রেহবারের বুকে পরম নির্ভরতায় নিজের ভার ছেড়ে দিয়েছে। রেহবার সেটাও খেয়াল করেছে। যা তার চিত্ত পুলকিত করলো।

(চলবে…)