হে সখা পর্ব-৪২+৪৩+৪৪

0
217

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
দ্বিচত্বারিংশ পর্ব

ডেলিভারির ডেট নিকটে চলে এসেছে সেই সাথে বেড়েছে রেহবার ও গুলিস্তার ব্যস্ততা। শেষ মুহুর্তে প্রস্তুতি সেই সাথে সতর্কতা দুটোতেই কমতি নেই৷ মালা আজকাল এ বাড়িতেই থাকে। কিচেনের পাশে একটা ছোট ঘর বদ্ধ পরেছিলো। সেখানেই মালার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। মালা অবশ্য থাকতে চায়নি৷ রেহবার অফিস চলে গেলে গুলিস্তা একা থাকে৷ ব্যস্ততার কারনে আজকাল ঘরে ফিরতে খানিক দেরী হয় রেহবারের। সবদিক বিবেচনা করে শেষমেশ রাজি হয়েছে।
ভারী শরীরের কারনে একপাশে বেশিক্ষণ শুয়ে থাকা সম্ভব হয় না। বিছানার অপরপাশে ল্যাপটপে কি যেনো করছে রেহবার। গুলিস্তাকে অস্থিরভাবে এপাশ-ওপাশ করতে দেখে ল্যাপটপ ছেড়ে উঠে কিচেনে গেলো। কিছু ফল কেটে এনে গুলিস্তার হাতে দিলো। রাত অনেক গভীর হয়েছে। ডিনার করার এতোক্ষণ পরে ক্ষুধা লাগা স্বাভাবিক৷ কয়েক টুকরো ফল মুখে দিয়ে প্লেট সরিয়ে রাখলো গুলিস্তা৷ খেতে ইচ্ছে করছে না। ক্লান্তিতে চোখ নেতিয়ে পরছে কিন্তু ঘুম আসছে না। সবে মাত্র ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিলো রেহবার। গুলিস্তাকে আবার শুয়ে পরতে দেখে ওরদিকে তাকালো। হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে গিয়ে পায়ের নিচে থাকা বালিশটি পায়ের ধাক্কায় নিচে পরে গেলো। কোনোকিছু না ভেবে সেটা তোলার জন্য নিচে ঝুঁকতেই যাচ্ছিলো গুলিস্তা। চকিতে রেহবার ছুটে এসে আটকে দিলো। সেই সাথে কড়া স্বরে ধমকে দিলো।
– করছো কি তুমি? বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে নাকি? এই অবস্থায় ঝুঁকতে যাচ্ছিলে কোন আক্কেলে? এতো রাত হয়েছে ঘুমাচ্ছো না কেনো তুমি? চুপচাপ ঘুমাতে যাও।

বিছানায় শুইয়ে দিয়ে পায়ের নিচে বালিশগুলো ঠিকঠাক রেখে আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসে পরলো রেহবার। এদিকে গুলিস্তার ভীষণ মন খারাপ হলো। সে না হয় ভুলেই ঝুঁকতে যাচ্ছিলো, তাই বলে এভাবে বকে দিবে? চোখে ঘুম না আসলে কীভাবে ঘুমাবে? এতোক্ষণ থেকে শুয়ে থাকতে থাকতে পিঠ ব্যথা হয়ে গিয়েছে। আজকাল পুরো শরীরে ব্যথা অনুভব হয়। বিশেষ করে কোমড়ের নিচ থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত। ঘুমাও বলে দিয়েই রেহবারের দায়িত্ব শেষ। এসব প্যারা সামলাতে তো হয় গুলিস্তাকে।
অভিমানে মুখ ফুলিয়ে একপাশে কাত হয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলো। রেহবার অবশ্য এতো কিছু ভাবার সময় পায়নি। কাল বাদে পরশু ইভেন্টের আয়োজন করা হয়েছে। খোলা মাঠে স্টেজ সাজানোর কাজ প্রায় শেষ। কালকে লাইটিং এর কাজ শুরু হবে। অথচ এখন আবহাওয়া বার্তা বলছে ঝড় বৃষ্টি হতে পারে। এই অসময়ে বৃষ্টি হবে কে জানতো! কোনো ব্যাকআপ প্ল্যান রাখা হয়নি। চিন্তায় রেহবারের মাথা ঘুরছে। টিমের প্রত্যেক ব্যক্তির ঘুম উড়ে গেছে। সবাই রাত জেগে ইনডোর প্ল্যানের কাজ করছে নিজ দায়িত্বে। যদি সত্যি ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়ে যায় তাহলে ইনডোরে প্রোগ্রাম এক্সিকিউট করতে হবে। অন্য সব কিছু সামলানো গেলেও অন্তিম মুহুর্তে কোনো কনভেনশন সেন্টার বুকিং করা সম্ভব হচ্ছে না। পরিচিত সকল স্থানে খোঁজ চালাচ্ছে রেহবার৷ এমন সময় গুলিস্তার ধীমে কন্ঠ শোনা গেলো।
– রেহবার ঘুম আসছে না।

উঠতি মেজাজের রেশ টেনে ধরতে কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে রইলো রেহবার। এরপর গুলিস্তার দিকে তাকিয়ে বললো,
– ডিমলাইট অফ করে দিবো? আলোর কারনে হয়তো ঘুম আসছে না।
– নাহ থাক। তুমি কাজ করছো করো।
– খুব জরুরি কাজ করছি। ঘুম না এলেও চুপ করে শুয়ে থাকো। এভাবে ডাকাডাকি করায় কন্সেন্ট্রেশন ব্রেক হচ্ছে। সকালে কথা হবে। গুড নাইট।

এর বেশি বিরক্ত করা গুলিস্তা পক্ষে সম্ভব হলো না। মাথা পর্যন্ত কাথা মুড়ে চুপচাপ চোখের জল ফেললো। কি সমস্যা হচ্ছে, কোথায় সমস্যা হচ্ছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না। শুধু অস্থির লাগছে৷ কিছু একটা ঠিক নেই এমন এক অনুভূতি হচ্ছে।
আধো ঘুমে আধো জাগরণে রাত কেটে গেলো। ফজরের নামাজ পরে ঘুমিয়েছিলো রেহবার। অনেক রাত করে ঘুমানোর কারনে গুলিস্তাকে আর ডাকেনি। পাশে শুয়ে ওর খোলা চুলে কিছুক্ষণ আলতো হাত বুলিয়েছে। পেটের উপর হাত বুলিয়ে চুমু এঁকে বলেছিলো,
– মাকে কম জ্বালাতন করো। মা ঘুমাতে পারছে না। এমন করলে বাবা কিন্তু বকে দিবো।

গুলিস্তা ঘুমায়নি। চোখ বন্ধ করে এইটুকু যত্ন উপভোগ করেছিলো। সাতটা বাজতেই বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে কিচেনে চলে গেলো। মালা উঠে পরেছে। গুলিস্তা দেখে মিষ্টি হাসলো।
– আন্ধন ঘরে আইসেন না আপা। টেবিলে বইসা থাকেন। খাওয়ন দিতাছি।

ছুটে এসে চেয়ার টেনে গুলিস্তাকে বসতে দিয়ে আবার ছুটে গেলো কিচেনে৷ তখনি সিড়ি বেয়ে হুড়মুড়িয়ে নামলো রেহবার৷ এতো সকালে গায়ে অফিসের পোষাক দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন নিয়ে তাকালো গুলিস্তা।

– ইভেন্ট ভেন্যুতে সামান্য ঝামেলা হয়েছে৷ ওখানেই যাচ্ছি৷ শহরের বাইরে গ্রামের দিকে। নেটওয়ার্কের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। ফোনে না পেলে টেনশন করো না। দ্রুত ফিরে আসবো। কোনো সমস্যা হলে মালা তো রইলো।

গুলিস্তার সামনে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বললো রেহবার। অথচ ওর ভেতরটা অস্থিরতায় পূর্ণ। একটু আগেই ভেন্যু এরিয়াতে প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সিলেটের এই এক সমস্যা। সময় অসময়ে ঝুমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। তবে রেহবারকে ঝামেলায় ফেলতে নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে ঝড়। ইতোমধ্যে টিমের সকলে রওনা দিয়েছে৷ রেহবারকেও দ্রুত বেরিয়ে যেতে হবে। গুলিস্তা শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। ওর কি মন খারাপ লাগছে আবারও? প্রশ্ন করলো রেহবার।
– তুমি ঠিক আছো?
– হ্যাঁ। এখনি বের হবে?
– হুম।
– নাস্তা করে যেতে।
– সময় নেই। আসছি।

গুলিস্তার কপালে চুমু দিয়ে মাত্রই পা বাড়িয়েছে রেহবার। কিচেন থেকে মালার গলার আওয়াজ শোনা গেলো।
– কিছু একটা মুখে দিয়া যান। আপনের চিন্তায় আপা আবার ঠিকঠাক খাইতে পারবো না।

রেহবার ঘুরে তাকালো গুলিস্তার দিকে। মালার কথায় গুলিস্তার মুখে লাজুক হাসি। কী ভেবে যেনো ফিরে এসে চেয়ারে বসলো। চিল্লিয়ে মালাকে বললো,
– কিছু একটা তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো মালা। তোমার আপার ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া নিশ্চিত করে দিয়েই যাই।

রেহবার চলে যাওয়ার পর আম্বিয়া খাতুনের সাথে কিছুক্ষণ কথা বললো। প্রতিদিন নিয়ম করে গুলিস্তার খোঁজ খবর নেন উনি। প্রয়োজন বুঝে দিকনির্দেশনা দেন। এসময় একজন অভিজ্ঞ মানুষের পরামর্শের কী যে দরকার তা অনুভব করতে পেরেছে গুলিস্তা। বিশেষ করে মায়ের প্রয়োজনবোধ করছে। কিন্তু নিজের মা তো প্রেগন্যান্সির খবর শোনার পর আর খোঁজ নেয়নি৷
ডাইনিং টেবিলে বসে সবজি কাটতে মালাকে সাহায্য করতেছিলো গুলিস্তা৷ কোমড়ে চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলো। চোখ মুখ কুচকে তাকাতেই হাতের কাজ ফেলে মালা অস্থির হয়ে জানতে চাইলো,
– ও আপা কি হইছে?
– কোমড় ব্যথা করছে। অনেকক্ষণ থেকে বসে আছি তো।
– ওইগুলা রাখেন। আমি কাইটা নিমু। আপনে একটু হাটাহাটি করেন।

মালার কথা মেনে হলরুমে ধীর গতিতে পায়েচারি করলো কিছুক্ষণ। হঠাৎ মনে পরলো তিতানের খাবার দেওয়া হয়নি। সিড়ির কাছাকাছি যেতেই মালা আঁতকে উঠলো,
– আপা কই যান?
– উপরে। তিতানের খাবার দেওয়া হয়নি।
– কোমড়ের ব্যথা নিয়ে সিড়ি ভাঙ্গার দরকার নাই। আমি দিয়া আইতেছি।

মালার বয়স খুব বেশি নয়। বিশ বাইশের কাছাকাছি হবে। অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে। ঘরে দুটো সন্তান। স্বামী ট্রাক ড্রাইভার৷ নিয়মিত বাড়ি আসে না। টাকাপয়সা দেয় না। বৃদ্ধা শাশুড়ির কাছে বাচ্চা দুটোকে রেখে কাজের জন্য সারাদিন বাইরে কেটে যায় মালার। টানাপোড়েনের জীবন ওকে অল্প বয়সেই শক্তপোক্ত করে তুলেছে। শুকনো লিকলিকে শরীরে যথেষ্ট শক্তি। লম্বা লম্বা পা ফেলে একসাথে দুটো সিড়ির ধাপ পার করে মুহুর্তেই চলে গেলো বেডরুমে। ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে সে দৃশ্য দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো গুলিস্তা। শরীরটা আজকাল এমন ভারী হয়েছে সে সামান্য একটু পথ অতিক্রম করতেই অনেক সময় লেগে যায়। পিঠের পেছনে কুশন রেখে আরেকটু আরাম করে বসলো। পিঠের কোমড়ের ব্যথা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসেছে তলপেটের দিকে। চিনচিনে ব্যথায় অস্থির লাগছে৷

– আমাকে একটু পানি দিয়ে যাও, মালা আপা।

বাটিতে একটুখানি পায়েসসহ এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো মালা।
– পায়েস খাবো না। অ্যাসিডিটি হয়েছে মনে হয়৷ বুকে, পিঠে ব্যথা হচ্ছে৷
– একটুখানি মুখে দিয়া পানি খান। খালি পেডে পানি খাইলে পেড উল্টাইবো৷

দু চামচ পায়েস মুখে দিয়ে পানিটুকু খেলো৷
– ব্যথাটা ঠিক কোথায় হচ্ছে বুঝতে পারছি না৷ একটু আগে কোমড়ে ছিলো, তারপর পেটে, বুকে৷ এখন আবার থেমে গেলো।

খালি গ্লাস হাতে নিয়ে ফিরে যেতেও মালা ঘুরে তাকালো। বলবে না বলবে না করেও জিজ্ঞাসা করলো,
– কয়দিন পর ডেট আছে?
– হু? কীসের ডেট?
– বাচ্চা হওয়ার।
– আরও দু সপ্তাহ৷ চৌদ্দদিন।
– লক্ষণ কিন্তু ঠিক লাগতাছে না আপা। আপনের চোখ মুখ কেমন জানি হইয়া গেছে৷ আবার কইতাছেন কোমড়ের বেদনা ঘুরতাছে৷ আমার পোলাডা হওনের সময় এমন হইছিলো। ব্যাডা ছাওয়াল হওনের সময় বেশি বেদনা জাগে না। এই বেদনা উঠে আবার নাই হইয়া যায়। পহিলা ছাওয়াল ওতো কিছু বুঝি নাই। পানি ভাঙার পর না হুশ হইলো। ছুটাছুটি কইরা দাঁই আনলো, ডাক্তার আইলো৷ পোলাডা হওনের আগে আগে সেকি বেদনা। মনে হইতেছিলো রুহু ধইরা টান মারতাছে।

গুলিস্তার পিঠ বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো। ভেতরে ভেতরে হালকা ঘামতেছিলো এতোক্ষণ। মালার কথা শুনে কপালে ঘাম জমতে শুরু করলো। সকাল থেকেই ব্যথাটা কোমড় ও তলপেটে ঘুরাঘুরি করতেছে। কখনো বাড়ে, কখনো একদম হারিয়ে যায়। তখন ওতোটা পাত্তা না দিলেও এখন চিন্তা হচ্ছে। রেহবারও বেরিয়ে গেলো। নিশ্চিত না হয়ে ওকে জানানো ঠিক হবে না। বের হওয়ার সময় দেখে মনে হয়েছিলো জরুরি কাজে যাচ্ছে। তাছাড়া এখন আর অকারণ হৈ হুল্লোড় করে, নিজের অপারগতা জাহির করে নিজেকে ছোট করতে, অন্যের দয়ায় সমস্যার সমাধান করতে ইচ্ছে করে না।

– ডাইনিং টেবিলে আমার ফোন আছে। নিয়ে এসো। ক্যাব বুক করি। হাসপাতালে গিয়ে একবার দেখিয়ে আসি। আমি তো কিছু বুঝছি না।

মালা ছুটে গিয়ে কিচেনের চুলা বন্ধ করলো। ডাইনিং থেকে ফোন এনে গুলিস্তার হাতে দিয়ে বললো,
– একলা যাওনের দরকার নাই। এই শরীর নিয়া একলা কেমনে চলবেন! আমিও সাথে যাই।
– ঠিক আছে। ঘরে গিয়ে দেখো আলমারিতে আমার পার্স রাখা আছে। নিয়ে এসো।
– আলমারি খুলমু?
– হ্যাঁ খুলবে। যাও নিয়ে এসো।

মালা তার লম্বা লম্বা পা ফেলে মুহূর্তেই চোখের সামনে থেকে সরে গেলো। খানিকবাদে ফিরে এলো একটা কাপড়ের ব্যাগ হাতে নিয়ে৷
– এটা কেনো নিয়েছো?
– আমার মনে কয়, এই যাওনেই শেষ যাওন। এরপর একেবারে বাচ্চা কোলে নিয়া ফিরবেন। এইজন্যি সব গোছগাছ কইরা লইছি।

মালার কথা শুনে গুলিস্তা থমকালো। কানে বাজছে, এই যাওনেই শেষ যাওন। সত্যি কি? কেমন হবে যদি আর কখনো এই বাড়িতে ফেরার সৌভাগ্য না হয়? বাড়িটি কি ওর শূণ্যতায় খাঁ খাঁ করবে? অনেক বছর পরে এখানে কি গুলিস্তার কোনো চিহ্ন পাওয়া যাবে? সময়ের সাথে সাথে স্মৃতিরাও ফিঁকে হয়ে যায়। কারো হাতের ছোঁয়া মুছে যেতে কতোক্ষণ!

– এসবের দরকার হবে না। এখনো সময় আছে। আচ্ছা নিয়েছো যেহেতু সাথে নিয়েই চলো।
– গাড়ি আইছে?
– আসতেছে। পাঁচ মিনিট লাগবে।
– এই ফাঁকে রান্ধনঘরটা গুছাই নেই।

সদর দরজায় তালা দেওয়ার সময় গুলিস্তার মনে পরলো তিতানের কথা। ওর সাথে তো দেখা হলো না। নিচ থেকে দোতলার ব্যালকনি দেখা যাচ্ছে। তিতানের খাঁচাটা দেখা গেলো তিতানকে ঠিকঠাক দেখা যাচ্ছে না।
– মালা, তিতানকে খাবার দিয়েছো?
– হ। তহন দিলাম না!
– পানি?
– দিছি। বেশি কইরাই দিছি সব। চিন্তা কইরেন না।

তবুও চিন্তা হলো গুলিস্তার৷ ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো, আসছি তিতান।

মন থেকে কাউকে অনুভব করলে সে নাকি বুঝতে পারে। তবে তিতানের কাছেও পৌঁছে যাবে গুলিস্তার বিদায়বার্তা।

চলবে…

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
ত্রয়শ্চত্বারিংশ পর্ব

শহর থেকে দূরে একটি খামারবাড়ি। কাঠের তৈরি ছোট এক কামরার একটি দোতলা বাড়িটিকে ঘিরে বিশাল বাগান। ঘাট বাধানো পুকুরের পাশে ফাঁকা স্থানে ইভেন্টের আয়োজন করা হয়েছে। সকালের ঝড় বৃষ্টিতে সাজানো গোছানো স্টেজের কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। শেষ মুহুর্তে টিমের লোকজন এসে খুব অল্প পরিমাণ জিনিসপত্র উদ্ধার করতে পেরেছে।
দোতলার চারকোনা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই ধ্বংসস্তুপের দিকে তাকিয়ে আছে রেহবার। লিতুন এসে সন্তপর্ণে পাশে দাড়ালো। ধীর কন্ঠে ডাকলো,
– স্যার?
– ওরা বেরিয়েছে?
– হ্যাঁ।
– কতোক্ষণ লাগবে?
– বৃষ্টির কারনে রাস্তায় কাদা পানি জমেছে। একটু সময় লাগবে।
– ফোন করেছিলে?
– সম্ভব নয়নি। নেটওয়ার্ক পাচ্ছে না। তবুও আমি ট্রাই করছি। আকাশ পরিষ্কার হলে এইখানে সামান্য নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে।
– ওরা না আসা পর্যন্ত কোনো কাজ নেই। সবাইকে রেস্ট নিতে বলো। জিনিসপত্র চলে এলে আবার নতুন করে সবকিছু সাজিয়ে ফেলতে হবে।
– স্যার, আবার যদি ঝড় হয়?
– আবহাওয়াবার্তা তো এমন কিছু বলছে না। আকাশও পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। আরেকটু অপেক্ষা করি। বৃষ্টি থেমে গেলে বুঝা যাবে।

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি বন্ধ হতে হতে দুপুর গড়িয়ে গেলো। কালো মেঘ সরে যেতেই ঝলমল করে নিজের অস্তিত্বের জানান দিলো তেজী সূর্য। নিজের তাপের দাপটে কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টির পানি শুষে নিয়ে চারপাশ ঝরঝরে হয়ে উঠলো। হাতে হাত লাগিয়ে সবাই নেমে পরলো অন্তিম মুহুর্তে শুরু থেকে প্রস্তুতি নিতে। ব্যয় দ্বিগুণ হলেও আফসোস নেই। লাভ-লোকসান মিলিয়ে ব্যবসা চলে। লাভ হলে যেমন খুশি হয়ে সামনে এগিয়ে যাই, তেমনি লোকসান হলেও মন খারাপকে সঙ্গী করে এগিয়ে যেতে হয়। রেহবারের কাছে এই মুহুর্তে নিজের দায়িত্ব পালন করাটাই মূখ্য বিষয়৷ প্রতিকূল আবহাওয়ায় কারো হাত নেই। ক্লায়েন্টের পক্ষ থেকেও যথেষ্ট সাপোর্ট পাচ্ছে৷
নতুন করে সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে নিতে বিকাল গড়িয়ে গেলো। লাইটিং এর কাজ ইলেকট্রিশিয়ানকে বুঝিয়ে দিয়ে ওরা ফিরে এলো দোতলার ঘরটিতে৷ বাকি কাজ রাত জেগে করতে হবে। সেগুলো ফিল্ড মেম্বাররা সামলে নিবে। এই মুহুর্তে ডিপার্টমেন্টের উর্ধতন কর্মকর্তাদের আর কোনো কাজ নেই। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই ফোনে মিসড কল এলার্টের মেসেজ আসলো।
আননোন নাম্বার হলেও সকল ধরনের ফোনকল রেহবারের জন্য জরুরি। নেটওয়ার্কের কারনে হয়তো কল আসেনি তাই মিসড কল এলার্ট এসেছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে কল ব্যাক করলো।
ওপাশ থেকে কর্পোরেট ভোকালিস্ট ধরনের এক নারী কন্ঠ জানান দিলো সে শহরের নামকরা একটি হাসপাতাল থেকে বলছে৷
রেহবার খানিকটা নড়েচড়ে বসলো। বাড়ি থেকে দূরে থাকাকালীন হাসপাতাল থেকে আসা যেকোনো ধরনের ফোনকল সর্বপ্রথম বিপদের হাতছানি দেয়।
নিজের পরিচয় দিয়ে রেহবার জানালো কিছুক্ষণ আগে এই নাম্বার থেকে কল এসেছিলো।

লেট মি চেক, বলে ক্ষীণকাল নিশ্চুপ রইলো রিনরিনে কন্ঠের অধিকারীনি৷ তারপর বললো,
– কিছুক্ষণ আগে নয় স্যার। আপনাকে ফোন করা হয়েছিলো সকালবেলা। দশটা ঊনচল্লিশ মিনিটে। আপনার ফোন বন্ধ ছিলো।
– স্যরি। নেটওয়ার্ক ইস্যু ছিলো। কি কারনে কল দিয়েছিলেন জানতে পারি?
– আপনার স্ত্রীকে আমাদের হাসপাতালে এডমিট করা হয়েছিলো। সাথে কোনো গার্ডিয়ান নেই। আপনি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসুন।

বিন্দুমাত্র মুহুর্ত ব্যয় না করে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ধুপধাপ করে নিচে নেমে গেলো রেহবার৷ ফোন কানে ধরেই গাড়ি স্টার্ট দিলো।
– কেমন আছে ও?
– আমি জানি না। ডাক্তার বলতে পারবে। আপনি নিজে এসে জিজ্ঞাসা করে নিয়েন৷

ওপাশ থেকে খট করে কেটে দিলো কলটা৷ রেহবারের মেজাজ চূড়ান্ত লেভেলের খারাপ হলো। এতোক্ষণ ধরে অযথা কথা প্যাচালো। অথচ প্রয়োজনীয় তথ্য তার কাছে নেই৷ রেহবারের পিছুপিছু ছুটে এসেছিলো লিতুন। রেহবারকে চলে যেতে দেখে জিজ্ঞাসা করলো,
– স্যার, কোথায় যাচ্ছেন? এখানের কাজ শেষ…
– এদিকটা সামলে নিও। হসপিটালে যেতে হবে।

লিতুনের কথা শেষ না হতেই কথাগুলো বলে বেরিয়ে এলো রেহবার। কাঁদায় ভরা রাস্তা তখনো কিছুটা পিচ্ছিল। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে ড্রাইভ করার চেষ্টা করছে রেহবার। বারবার নিজেকে বলছে, ওখানে গুলিস্তার সাথে কেউ নেই। আমাকে সুস্থভাবে ওর কাছে পৌঁছাতে হবে।

আধাঘন্টার পথ পেরোতে সময় আগলো এক ঘন্টা। রিসিপশনে খোঁজ নিয়ে সোজা চলে গেলো ডেলিভারি সেকশনে। বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আছে মালা। ওর চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। রেহবারের বুক ধক করে উঠলো। পায়ের গতি ধীর হলো। মালার সামনে দাঁড়াতেই ভেজা চোখ নিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
– ছেলে হইছে ভাইজান। আলহামদুলিল্লাহ বলেন।

প্রশান্তির মিষ্টি বাতাস ছুঁয়ে গেলো রেহবারকে। মনে মনে শুকরিয়া জানালো সৃষ্টিকর্তার নিকট। মালা অবাক চোখে দেখলো হাসি মুখের একটি যুবকের বাম চোখ থেকে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো। যুবকটি তাতে লজ্জা পেলো না, অশ্রু লুকালো না। শুধু জানতে চাইলো,
– ফুল কোথায়?

ভার হলো মালার মুখ। বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে বললো,
– সেই যে সক্কালবেলা নিয়া গেলো আর দেহি নাই। ডাক্তার আপায় আইসা কি সব কইয়া বকাঝকা কইরা গেলো। আপনেরে ফোন দিছিলো আপনে নাকি ধরেন নাই। সেই নিয়া আবার খেপছে।
– বাবুর কথা কে বললো তাহলে?
– ভিতর থাইকা নার্স আইছিলো। হেয় কইলো। তয় পোলারে এহনো বাইরে আনে নাই।

রেহবার বুঝলো কিছুটা একটা ঠিক নেই। কিন্তু কি ঠিক নেই সেটা জানতে না পারা আরও বেশি যন্ত্রণার, ভয়ের। সামনে কোন বিপদ ধেয়ে আসছে, জানা না থাকলে লড়বে কি করে? খানিকবাদে সাদা ড্রেস পরিহিতা একজন সেবিকাকে দেখা গেলো। বন্ধ দরজার দিকে যেতে গিয়েও রেহবারকে দেখে থামলো।
– আপনি পেশেন্টের হাসবেন্ড?
– জ্বী।
– কোথায় ছিলেন এতোক্ষণ?
– স্যরি। আসতে দেরী হয়ে গেলো। পেশেন্টের কি অবস্থা?
– আপনার ছেলে হয়েছে। শ্বাস নিতে একটু সমস্যা হচ্ছিলো তাই আপনাদের কাছে দেওয়া হয়নি। এখন ঠিক আছে। একটু পরেই নিয়ে আসছি।
– আমার ওয়াইফ?
– আপনার ওয়াইফের প্রেগন্যান্সিতে কমপ্লিকেশন তো আগে থেকেই ছিলো। অবস্থা তেমন একটা ভালো না। তবুও ডাক্তাররা চেষ্টা করছে। সরকারি হাসপাতাল থেকে ডাক্তার এসেছেন আরেকজন। উনি বেশ অভিজ্ঞ। দোয়া করতে থাকেন, ভালো কিছু হবে ইনশাআল্লাহ।

রেহবার তার বোকা বোকা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে। ওকে ওমন হতবিহ্বল রেখে সেবিকা ভেতরে চলে গেলেন। প্রেগন্যান্সিতে কমপ্লিকেশন কবে হলো? কই কেউ তো ওকে জানায়নি! নাহ ডাক্তার কিছু বলেছে, নাই বা বলেছে গুলিস্তা। এই মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে দায়িত্ব-জ্ঞানহীন স্বামী মনে হচ্ছে নিজেকে। যে নিজের স্ত্রী সম্পর্কে জানে না, তার কমপ্লিকেশন সম্পর্কে জানে না। রেহবার যেনো বসতেও ভুলে গেছে। মাথার ভেতর হাতড়ে বেড়াচ্ছে বিগত আট মাসের স্মৃতি। কোথাও কি কিছু এড়িয়ে গেছে? উহু, তেমন কিছু খুঁজে পেলো না।
বন্ধ দরজা খুলে গেলো। সেবিকা এগিয়ে এলো সাদা তোয়ালেতে মোড়ানো একটি মানব শিশুকে নিয়ে।
রেহবারের দিকে এগিয়ে দিতেই কাঁপাকাঁপা হাতে শিশুটিকে কোলে তুলে নিলো রেহবার। কতোটুকু লম্বা হবে শিশুটি? রেহবারের এক হাতের কনুই পর্যন্ত দৈর্ঘ্য। এতোটুকু হয় মানব শরীর! ধরতে নিলে মনে হচ্ছে হাত ফসকে বেরিয়ে যাবে।

রেহবারের কাঁপতে থাকা শরীরের দিকে তাকিয়ে মালা বললো,
– এইখানে চেয়ারে বসেন।

রেহবার বসলো তারপর গভীর চোখে তাকালো নিজের ছেলের দিকে। নিজের দেহের অংশ। ফর্সা শরীরটা হাত পা গুটিয়ে শুয়ে আছে। মাথা ভর্তি কুচকুচে কালো চুল। বন্ধ চোখের লম্বা পাপড়ি। সামান্য ভোতা নাক। তার নিচে লাল টুকটুকে ছোট্ট দুটো ঠোঁট। আবেগে রেহবারের ভেতরটা ভেসে যাচ্ছে। আপনা আপনি ঠোঁট নেমে এলো ছেলের কপালে।
বাবার স্পর্শে ডাগর ডাগর চোখ মেলে চাইলো গুলিস্তা-রেহবারের একমাত্র সন্তান।

ভিডিও কলে নাতির মুখ দেখে খুশিতে কেঁদে ফেললেন আম্বিয়া খাতুন। হাসছেন, কাদছেন, আবার নিজেকে সামলাচ্ছেন৷
– ছেলের কানে আযান দিয়েছো?

মায়ের কথায় আলতো হেসে দুদিকে মাথা দোলালো রেহবার।

***

দীর্ঘ একঘন্টা পর ডাক্তারের সাথে দেখা করার ডাক এলো। নার্স এসে সাবধানে নিয়ে গেলো বাচ্চাটিকে।
ডাক্তার আভার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে হালকা ঘামছে রেহবার। আভার মুখশ্রীতে ক্লান্ত ভাব। দীর্ঘ যুদ্ধ শেষে ভীষণ ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত৷ কিন্তু যুদ্ধের শেষ পরিণতি এখনো জানতে পারেনি রেহবার। তাই এতো উৎকন্ঠা।
– আমার ওয়াইফ ঠিক আছে তো ডক্টর?

বিরক্তি ঝরে পরছে আভার দৃষ্টিতে। জগত সংসারের উপর ভীষণ বিরক্ত সে। এ জগতের মানুষেরা ডেকে বিপদ আনবে, তারপর নিজে সেই বিপদে ঝাপ দিবে। এরপর ডাক্তারের কাছে এসে বলবে, বাঁচাও, বাঁচাও।

– এমন পরিণতি হবে আগেই বলেছিলাম, এখন এতো চিন্তিত হচ্ছেন কেনো?

রেহবারের উৎকন্ঠায় ভাটা পরলো। অপমানে চুপসে এলো মুখখানি। আভার অল্পস্বল্প মায়া হলো। কন্ঠে নমনীয়তা এনে বললেন,
– এখন সুস্থ আছে। জমে মানুষে টানাটানি পরে গিয়েছিলো। আল্লাহর অশেষ রহমত ছিলো বলেই এ যাত্রায় বেঁচে গেছে। আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম, অন্তত একটা দুঃসংবাদ নিয়েই ফিরবো। যদিও বেবির কোনো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো না। বিপদের মুখে ছিলো আপনার ওয়াইফ। ভাগ্যিস সরকারি হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধান সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। আমি তো আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। আজকাল মানুষজন বাচ্চার জন্য এতো মরিয়া হয়ে উঠে কেনো কে জানে! বাচ্চা জন্ম দেওয়াই যেনো জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। আরে নিজের জীবনের কথাটাও তো ভাবতে হবে নাকি? আপনার ওয়াইফ না হয় আবেগ দিয়ে ভাবছিলো, আপনি বিবেক দিয়ে ভাবতে পারেননি?

রেহবারের বলতেও লজ্জা লাগছে যে সে কিছু জানতো না। এমনকি এখন পর্যন্ত সে কিছুই জানে না। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
– দেখা করতে পারবো?
– আর কিছুক্ষণ পরে বেডে দেওয়া হবে তখন দেখা করতে পারবেন।

অনেক ইতস্ততভাব নিয়ে রেহবার জিজ্ঞাসা করেই বসলো,
– সমস্যা কি হয়েছিলো ডক্টর?

ভূত দেখেছে এমনভাবে চমকালো আভা।
– আগেই না বলেছিলাম আপনাদের, ডেলিভারিতে কমপ্লিকেশন দেখা দিতে পারে? সেটাই হয়েছে৷
– আসলে ডক্টর, এ ব্যাপারে আমি কিছু জানতাম না। আমার ওয়াইফ আমাকে কিছু জানায়নি।

আভা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। রেহবারের মুখভঙ্গি দেখে কথার সত্যতা যাচাই করে যখন সুনিশ্চিত হলো, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
– এমন রোগীও বহু দেখেছি৷ স্বামীর ইচ্ছে পূরণে নিজেকে বিপদে ফেলে সন্তান জন্ম দেয়। স্বামীকে সন্তান সুখ দিতে, বংশকে উত্তরাধিকারী দিতে মেয়েদের বরাবর কিছু ত্যাগ করতে হয়। কেউ কেউ তো নিজেকেই ত্যাগ করে দেয়।
আপনার ওয়াইফ যেদিন প্রথম আসে যেদিনই উনাকে বলেছিলাম, প্রেগন্যান্সিতে সমস্যা না হলেও ডেলিভারিতে যথেষ্ট সমস্যা হবে। আমরা কোনোভাবে বাচ্চাকে আশংকামুক্ত রাখতে পারলেও ওকে নিয়ে টানাটানি পরে যাবে। নর্মাল ডেলিভারিতে প্রচুর পরিমাণে রক্তক্ষরণের আশংকা রয়েছে। সি সেকশন সম্ভব নয়। কারন হরমোনাল ইমব্যালেন্সের কারনে উনার ডায়াবেটিস বেড়ে যাবে, ব্লাড প্রেশার হাই থাকবে। পূর্বের ঔষধের সাইড ইফেক্ট বলতে পারেন। সকল কিছু জেনেশুনেও আপনার ওয়াইফ বাচ্চাটি জন্ম দিতে চাইলেন। উনাকে বলেছিলাম কয়েক বছর পর বেবি নিয়েন। তখন হয়তো মেডিসিনগুলোর সাইডইফেক্ট কিছুটা কমে যাবে, রিস্ক কম থাকবে। কিন্তু আপনার ওয়াইফ নাছোড়বান্দা। বাচ্চা তার চাই, চাই।
বড্ড সাহসী মেয়ে। আজকে একা একা হাসপাতালে চলে এসেছে। প্রথমবার মা হচ্ছে তো, ব্যথা মাত্র উঠতে শুরু করেছিলো। তৎক্ষনাৎ হাসপাতালে চলে এসেছে। এমন কেসে নতুন মায়েরা সচরাচর ব্যথা বুঝতে পারে না। হাসপাতালে আনতে আনতে ওয়াটার ব্রোক হয়। আপনার ওয়াইফের ওয়াটার ব্রেক হয়েছে ডেলিভারি সেকশনে। ডেলিভারির আগ পর্যন্ত ঠিক ছিলো। এরপরেই শরীর খিঁচুনি দিয়ে উঠছিলো। অনেক ব্লাড লস হয়েছে। এই ঘাটতি পূরণ করতে অনেক সময় লেগে যাবে। পরবর্তীতে বেবি নেওয়ার ভালোভাবে ভেবেচিন্তে নিবেন।

ডাক্তারকে ধন্যবাদ দিয়ে রেহবার বেরিয়ে এলো। মনে মনে বললো, যা ক্ষতি হয়েছে একবারই হয়েছে৷ জানতাম না বলে ঘটনা গড়িয়েছে এতোদূর। দ্বিতীয়বার এমন ভুল আর হবে না।

গুলিস্তাকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। সেন্স ফিরেনি এখনো। পাশেই বেবিকটে গুলিস্তার ছেলে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। মায়ের পেটে যেমন নিশ্চিন্ত ছিলো, এখনো তেমন রয়েছে। এদিকে মায়ের জীবন যায় যায়। সাথে বাবারও। সাথে নিয়ে আসা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে কেবিন সাজিয়ে মালা চলে গেছে। বেডের পাশে টুল নিয়ে বসে আছে রেহবার। দৃষ্টি ঘুমন্ত গুলিস্তার দিকে। ফর্সা মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে আছে। কয় ব্যাগ রক্ত দিয়েছে কে জানে! তবুও মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, সকল রক্ত কোনো ভ্যাম্পায়ার চুষে নিয়েছে। বাম হাতে স্যালাইন চলছে৷ ডান হাত আকড়ে ধরে আছে রেহবার। গুলিস্তার যখন জ্ঞান ফিরলো তখন বেশ রাত। চারদিকে অন্ধকার নামলেও হাসপাতালের কেবিনে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে। পিটপিট করে চোখ খুললেও সেই আলো এসে ধাক্কা দিচ্ছে চোখে। অনেক চেষ্টার পর আলো যখন সহনীয় হয়ে এলো, নিজের একপাশে রেহবারকে আবিষ্কার করলো। গুলিস্তার হাতে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছে। একটু দূরেই বেবিকটের দিকে তাকিয়ে বুঝলো ওখানে তার সন্তান রয়েছে। যাকে দীর্ঘ কয়েকমাস নিজের গর্ভে ধারণ করেছিলো। রেহবারের মাথার নিচ থেকে হাতটি সরিয়ে আলতো করে রেহবারের এলোমেলো চুল বুলিয়ে দিতে লাগলো। তাতেই ঘুম ভেঙে তাকালো রেহবার। দেখলো গুলিস্তার মুখের ক্লান্ত হাসি। রেহবার হাসলো না। একদৃষ্টিতে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলো। অতঃপর অভিযোগ করে বললো,
– শাস্তিটা একটু বেশি হয়ে গেলো না, ফুল?

বাচ্চা চাই বলে সেদিনের মনোমালিন্য গুলিস্তার মনে গভীরভাবে দাগ কেটেছিলো৷ সুস্থ হয়ে উঠছিলো একটু একটু করে, বুঝতে শিখছিলো। মনে অনুভূতির অদ্ভুত জোয়ার। এলোমেলো ঢেউ৷ নানান আবেগ, অনুভূতি একসাথে সামলে উঠা মুশকিল। হাটতে শেখার সময় এলোমেলো পা ফেলে শিশুরা এগিয়ে চলে, সামান্য ধাক্কায় ভারসাম্য হারিয়ে লুটিয়ে পরে মাটিতে৷ কারণ হাটতে শিখলেও নিজেকে সামলে নেওয়া তখনো শিখেনি৷ গুলিস্তা ছিলো তেমন একটি মুহূর্তে। সেই সময় রেহবারের সামান্যতম একটি ভুলে গুলিস্তা মুখ থুবড়ে পরেছিলো। জেদ তৈরি হয়েছিলো, অভিমান জমেছিলো। রেহবার তার উপর কিছু চাপিয়ে দিবে না সেই বিশ্বাসের ভীত নড়ে উঠেছিলো৷ বাচ্চাদের যদি বলা হয় আগে বই পড়ো, তারপর খাবে। অভিমান করে টানা পড়াশোনা করতেই থাকে। আজকে আর ভাত খাবোই না। পড়তে পড়তে শহীদ হয়ে যাওয়ার গোঁ ধরে বসে৷
নিজের ঔরসজাত সন্তানের কথা উঠতে কে না আবেগতাড়িত হয়ে পরে! রেহবারও হয়েছিলো। ভুলে গিয়েছিলো রানুর সতর্কবার্তা। অন্যদের থেকে পাওয়া আঘাতের থেকেও রেহবারের সামান্য কথাও গুলিস্তার উপর সর্বোচ্চ প্রভাব ফেলবে। কারন এই মুহূর্তে সে আপন বলতে রেহবারকেই চিনে৷ তার উপরই নির্ভরশীল। গুলিস্তার হাতে মাথা ঠুকে নিজের বোকামির কথাই ভাবছিলো রেহবার। গুলিস্তা চুপচাপ সব মেনে নিয়েছিলো বলে রেহবার ভুলেই গিয়েছিলো সামান্য ঘটনা ওর মনে কীভাবে দাগ কেটে যায়৷ কেনো একবার পাশে বসে নিজে থেকে বলেনি, বাচ্চার কথা এখন ভাবার দরকার নেই। আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করি। সেদিন আবেগের বশে বলে ফেলেছিলাম। তুমি এসব নিয়ে ভেবো না।
রেহবার বললে গুলিস্তা বুঝে যেতো। যেমনটা রেহবারের কথায় গুলিস্তা বুঝেছিলো, এই মুহূর্তে একটা বাচ্চা রেহবার কতো করে চাইছে।

বাচ্চার জন্য সেদিন কতো বাজে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। টানা এক সপ্তাহ কেটেছে নরক যন্ত্রণায়। গুলিস্তার ভয় ছিলো, বাচ্চার সুত্র ধরে আবার না ঝগড়া লেগে যায়, কথা বন্ধ হয়ে যায়। সামান্য দুরত্ব সৃষ্টি হলে সেটা গুলিস্তা মেনে নিতে পারবে না। তাই তো সেদিনই জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিকে পেছনে ফেলে এসেছিলো। কিন্তু বাচ্চা পেয়ে রেহবারের খুশি হওয়ার কথা। মানুষটা এমন কাঁদছে কেনো! একটু বেশি আবেগতাড়িত হয়ে পরেছে কি? নাকি রাগ করেছে?

গুলিস্তা জানে রেহবার কোন শাস্তির কথা বলছে। অভিমান করে বাচ্চার সকল দায় দায়িত্ব একা পালন করেছে। কোনোরকম ঝামেলায় রেহবারকে টানেনি। বাচ্চা চাই তো? তাই একটা বাচ্চা দুম করে হাতে তুলে দিয়ে বলতে চেয়েছিলো, নেও ধরো তোমার বাচ্চা।
কিন্তু এই মুহুর্তে নিজের স্বপক্ষে বলার মতো কোনো ভাষা নেই গুলিস্তার। জেদ করতে গিয়ে নিজে তো কম ভয় পায়নি। সারাক্ষণ মনে হতো সে হারিয়ে যাবে রেহবারের জীবন থেকে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো, আর দেখা হচ্ছে না রেহবারের সাথে। মানুষটাকে একনজর দেখার জন্য ছটফট করেছিলো। ফিরে আসার জন্য লড়াই করেছে প্রাণপণে। এখন থাক সেসব কথা। যা চলে গেছে, তা অতীত।

জলে ভরে উঠা চোখের আবছা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রেহবারের চুলে হাত বুলিয়ে দিলো অনেকক্ষণ।
রেহবার জিজ্ঞাসা করলো,
– ছেলেকে দেখেছো?
– হুম।

ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথেই গুলিস্তার বুকের উপর ওকে রেখেছিলো। তখনই দেখেছে। এরপর খিচুনি শুরু হলো। জ্ঞান হারিয়ে ফেলে গুলিস্তা। ভালোভাবে দেখতে পারেনি ছেলের মুখ। দেখতে ইচ্ছে করলেও ওর ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে করলো না। রেহবার অবশ্য উঠে গিয়ে ঘুমন্ত ছেলেকে খুব সতর্কতার সাথে নিয়ে এলো গুলিস্তার কাছে। ওর পাশে শুইয়ে দিয়ে বললো,
– দেখো, আমাদের ছেলে দেখতে তোমার মতোই হয়েছে।

গুলিস্তা তো চায়নি ওর মতো হোক। ওর মতো আরও কেউ জন্ম নিক এই পৃথিবীতে। দুঃখ পাক, কষ্ট পাক।ছেলের দিকে মাত্রই হাত বাড়িয়েছিলো। রেহবারের কথা শুনে গুটিয়ে নিলো সেই হাত।

চলবে..

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
চতুঃচত্বারিংশ পর্ব

হাসপাতালে থাকতে হলো মোটে তিনদিন৷ চতুর্থদিনে সব গুছিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলো। এই কয়েকদিন রেহবারের উপর দিয়ে অনেক ঝড় ঝাপটা বয়ে গেছে। ইভেন্টের ভেন্যুতে আর যাওয়া হয়নি৷ টিমের বাকিরা সেসব সামলে নিলেও ফোনে যাবতীয় তদারকি করতে হয়েছে রেহবারকে। গুলিস্তার ঔষধ, বিভিন্ন টেস্ট, খাবারদাবার ইত্যাদির পিছনে ছুটতে হয়েছে। ছেলে কিছুক্ষণ পর পর কেঁদেকেঁটে হাসপাতাল মাথায় তুলে নেয়। ছেলের মা তীব্র আতংক নিয়ে তাকিয়ে থাকে রেহবারের দিকে। বাধ্য হয়ে রেহবারকে কোলে তুলে নিতে হয় ছেলেকে। বাবা হওয়ার শখ যেনো এই কয়েকদিনেই মিটে গেছে। গুলিস্তা ওকে খাওয়াতে পারে না, কোলে নিতে পারে না। জোর করে কোলে তুলে দিলে কোলে নিয়ে পাথরের মতো বসে থাকে। নড়াচড়া বন্ধ। যেনো একটু নড়লেই ছেলে কোল থেকে পরে যাবে না।

গাড়ি থেকে নেমে গুলিস্তার কোল থেকে ছেলেকে নিজের কোলে তুলে নিলো। এরপর গুলিস্তা গাড়ি থেকে নামলো। ঘরবাড়ি অবশ্য মালা রোজ এসে পরিষ্কার করে রেখে যায়। রেহবার নিজেও সকালের দিকে একবার এসে ঘুরে যেতো।
বেডরুমে ওদের বিছানার উপর ঠিক মাঝে জায়গা করে নিয়েছে ছোট আরেকটা বেড। সেখানে ছেলেকে শুইয়ে দিলো। গুলিস্তা কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা চলে গেলো বারান্দায়। কতোদিন তিতানকে দেখে না!
রেহবার ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমের দিকেই যাচ্ছিলো, গুলিস্তার চিৎকারে দ্রুত ব্যালকনির দিকে ছুটে গেলো। গিয়ে দেখলো ফ্লোরে বসে আছে গুলিস্তা।
ব্যালকনিতে এসে ফাঁকা খাচা দেখে গুলিস্তার বুক ধক করে উঠে। চারপাশে খুঁজে কোথাও পেলো না তিতানকে। ফ্লোরের দিকে তাকাতেই নজরে এলো, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তিতানের ধূসর পালক। রেহবার বলে চিৎকার করে ফ্লোরে বসে পরলো গুলিস্তা।

খাঁচার ভেতর ভেঙে পরে আছে মাটির হাড়ি৷ খাবার প্লেট, পানির পাত্র উল্টে পরে আছে৷ নিচে ছড়িয়ে থাকা তিতানের গায়ের পালক। সবকিছু সাক্ষ্য দিচ্ছে, তিতান নেই। তার সাথে ভয়ংকর কিছু ঘটেছে। হতবিহ্বল রেহবার নিজেও বসে পরলো গুলিস্তার পাশে৷ আলতো করে কাঁধে হাত রেখে বললো,
– গতকাল সকালেই ওকে দেখে গিয়েছি৷ খাঁচার ভেতরেই ছিলো। খাবার, পানি দিয়ে আমি চলে গিয়েছিলাম। কীভাবে যে কি হলো! দেখে মনে হচ্ছে বিড়াল আক্রমণ করেছিলো।

আলুথালু বেশে ফ্লোরে বসে কাঁদছিলো গুলিস্তা। সদ্য মা হওয়া মেয়েটি এখন সন্তান হারানোর শোকে কাতর। মানতেই পারছে না, তিতান নেই। কারনে ওকারনে ফুল বলে কেউ ডাকবে না। ঝগড়া করবে না, ওকে রাগিয়ে দিবে না। গুলিস্তার যে তিতান ডাকার মতো আর তো কেউ রইলো না। ভাবতেই বুকের ভেতরটা ভেঙেচুড়ে যাচ্ছে।
রেহবার কি বলবে বুঝতে পারছে না। নীরবে বসে রইলো গুলিস্তার পাশে। পাখিটির সাথে গুলিস্তার কতোটা সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো, তার সাক্ষী রেহবার নিজেই। গুলিস্তার জীবন থেকে রেহবারকে সরিয়ে অনেকখানি স্থান সে দখল করে বসে ছিলো।
হঠাৎ ছেলের কান্নার আওয়াজে দ্রুত পায়ে সেখান থেকে বিদায় নেয় রেহবার। গুলিস্তা বয়ে রয় নিশ্চল। বসে বসে দেখে কতো দ্রুত মানুষ অতীতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়। ঘরের মধ্যে ছেলেকে কোলে নিয়ে পায়েচারি করছে রেহবার। ছেলেকে কিছু একটা বলছে হেসে হেসে। ছেলেও কান্না থামিয়ে বাবার কথা শুনছে মনোযোগ দিয়ে।

নাতি জন্মের খবরে আম্বিয়া খাতুন অস্থির হয়ে পরেছিলেন, দেশে আসবেন। রাহিলের ছুটি মিলছে না দেখে দেরী হচ্ছিলো। কিন্তু ছেলের মুখে যখন শুনলেন ওরা দুজনে মিলে ছোট্ট শিশুটিকে সামলানোর মতো কঠিন কাজটি করতে পারছে না, তখন আর আম্বিয়া খাতুনকে আটকানো গেলো না।
কোনোকিছু না ভেবে একাই রওনা দিলেন দেশের উদ্দেশ্যে। বহুদিন বাদে নিজের বাড়িতে, নিজের ঘরে ফিরে স্বস্তিবোধ করছেন। স্বস্তির সাথে এখন আবার যুক্ত হয়েছে নাতি পাওয়ার আনন্দ। আম্বিয়া খাতুন ফিরে আসায় রেহবারের ব্যস্ততা কমেছে অনেকখানি। রেহবারের ছেলের খাওয়াদাওয়া, গোসল, ঘুমপাড়ানো, হাঁটাহাঁটি করা, রোদ পোহানো সবকিছু নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন আম্বিয়া খাতুন। শুধু খাওয়ানোর সময় দরকার হয় গুলিস্তার। এছাড়া ওর আর কোনো কাজ নেই। শুয়ে বসে বিশ্রাম নিয়েই দিন কাটছে প্রসূতি মায়ের। আম্বিয়া খাতুন বলে দিয়েছেন, দেড়টা মাস কষ্ট করে হলেও বিছানায় শুয়ে রেস্ট নেও। স্বাস্থ্যকর খাবার খাও। এই কয়েকটা দিনের উপর তোমার পরবর্তী জীবনে সুস্থ থাকা নির্ভর করছে। গুলিস্তা কোনো দ্বিমত করেনি।

রেহবার বাড়ি ফিরলে আম্বিয়া খাতুন বললেন,
– ছেলের নাম রাখবি না?
– তেমন কিছু ভাবিনি। তোমার পছন্দের কোনো নাম থাকলে রেখে দেও।
– সন্তানের নাম রাখবে বাবা-মা। আমার ছেলেদের নাম আমি রেখেছি, এখন তোর ছেলের নাম তুই রাখ।
– গুলিস্তার সাথে কথা বলে জানাচ্ছি৷

গুলিস্তাকে জিজ্ঞাসা করায় সে বললো,
– আমার কোনো পছন্দের নাম নেই। তোমার ইচ্ছে মতো রাখো।
– নেই তো খুঁজে দেখো।
– ইচ্ছে নেই।

রেহবার বড্ড হতাশ হলো। ছেলের বিষয়ে বড্ড গা বাঁচিয়ে চলে গুলিস্তা৷ একটুখানি খাইয়ে দিয়ে আর কোনো খোঁজ খবর নেয় না। ভাগ্যিস আম্বিয়া খাতুন আছেন না হলে ছোট্ট বাচ্চাটার কী অবস্থা হতো কে জানে!
– ছেলের ব্যাপারে এতো উদাসীন কেনো তুমি? নাম খোঁজার কথা না হয় বাদ দিলাম, ওর অন্য কোনো ব্যাপারে তুমি কখনো আগ্রহ দেখিয়েছো? কখন কাঁদছে, কখন হাসছে, খেলছে কিংবা ঘুমাচ্ছে কোনো খবর তুমি রাখো? স্বার্থপরের মতো নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকো সারাক্ষণ। মায়ের আদর ছাড়া আমার বাচ্চাকে বড় হতে হচ্ছে৷ একটা পাখির নাম খোঁজার বেলায় দিনরাত এক করে খুঁজে বেড়িয়েছো। এখন নিজের ছেলের নাম খোঁজার বেলায় খুঁজতে পারবে না। যত্তোসব নাটক!

মেজাজের খেই হারিয়ে এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে বেড়িয়ে গেলো রেহবার। গুলিস্তা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। শুণ্য ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করলো,
– আমি নাম রেখেছি বলেই এখন আর তিতান বলে ডাকার মতো কেউ রইলো না। আমার তিতান আমাকে রেখে চলে গেলো।

পুত্র ও পুত্রবধূর কলহ দেখে আম্বিয়া খাতুন নিজেও চিন্তায় পরে গেলেন। রাতে খাবার সময় ছেলের পাশে বসে বললেন,
– অফিসে কাজের চাপ কেমন?
– মোটামুটি।
– বেশি চাপ মনে হলে কয়েকদিন ছুটি নে। বাড়ি ফিরে এভাবে চিল্লাচিল্লি করা ঠিক না।

রেহবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের দিকে তাকালো। শান্ত চোখে চেয়ে বললো,
– তুমি দেখছো না ওর কার্যকলাপ? সারাদিন ছেলে থাকছে তোমার কাছে। রাতের বেলাও তুমি পাশে নিয়ে ঘুমাও। মা হিসেবে কোন দায়িত্বটা ও পালন করেছে? নাম রাখতে বললাম বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখালো না।
– তুই রেখে দিলেই তো হচ্ছে। এতো ঝামেলা করার কি দরকার। ও অসুস্থ মানুষ। শরীর ভালো নেই। প্রসবের পর মায়েদের শরীরের সাথে সাথে মানসিক টানাপোড়েনও সৃষ্টি হয়। হরমোনের উঠানামার কারনে নানান ধরনের খেয়াল আসে মাথায়। একাকিত্বে ভুগে, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। এই সময় তুই যদি ওকে সাপোর্ট না দিস, তাহলে মেয়েটা কোথায় যাবে? ওর তো আগে থেকেই প্রবলেম ছিলো। সেটা আরও বাড়লে কি করবি?
– এসব ওর মানসিক কোনো সমস্যা নয় মা। আমার উপর জেদ করে এমন করছে। বাচ্চা নিয়ে একবার ঝামেলা হয়েছিলো সেই থেকে জেদ দেখাচ্ছে আমাকে। জেদ করে বাচ্চা নিলো। এখন বাচ্চার কোনো দায়িত্ব পালন করছে না। আমাকে বুঝাচ্ছে, সে বাচ্চা নিয়েছে শুধু আমার জন্য। আমি বাচ্চা চেয়েছি, সে আমাকে দিয়েছে। এখন আমার বাচ্চা নিয়ে আমি কি করবো না করবো সেটা আমার ব্যাপার। বড্ড হিংসুটে হয়েছে আজকাল।
– পাগলের প্রলাপ বকিস না তো। তোর মাথাটাও গেছে মনে হয়। আগডুম বাগডুম কী সব বলে যাচ্ছিস! এসব মাথা থেকে বের করে ওর সাথে ভালোভাবে কথা বল। বাজে ব্যবহার একদম করবি না।
– সেসব দেখা যাবে। শোনো, আজকে থেকে বাবুকে রাতের বেলায় ওর মায়ের কাছে দিয়ে যাবে।
– রাতে উঠে কান্নাকাটি করে। তোর ঘুম ভেঙে যাবে।
– বাবা মা হয়েছি। এইটুকু কষ্ট সহ্য করতেই হবে।

রাতে ছেলেকে নিয়ে ঘরে এলো রেহবার। বিছানার মাঝখানে শুইয়ে দেওয়া হলো। পুরোটা সময় চেয়ে চেয়ে দেখলো গুলিস্তা। ছুঁলো না, এগিয়ে গিয়ে ধরলো না। ছেলের সাথে টুকটাক কথা বলে রেহবার গিয়েছে ওয়াশরুমে ওমনি ঘর কাঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে গুলিস্তার আত্মজ। ধুরমুর করে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রেহবার দেখলো কান্নারত শিশুর পাশে গুলিস্তা নিজেও বসে আছে কাঁদো কাঁদো মুখ করে। রেহবারকে দেখতেই অসহায় চাহনিতে বললো,
– থামছে না তো।

রেহবার সামান্য হাসলো। এগিয়ে এসে গুলিস্তার ওপরপাশে নিজেও বসলো। গুলিস্তার ডান হাতটি নিজের হাতে নিয়ে রাখলো ছেলের বুকের উপর। মায়ের হাতের আদর পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে কান্না থেমে গেলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো গুলিস্তা। ছেলে ঘুমিয়ে পরতেই নিজেও ঘুমালো।

সেই রাতে অনেকদিন পর রানুর সাথে আবারও যোগাযোগ করলো রেহবার। সব শুনে রানু বললো,
– আপনি নিজেও কি বদলে যাননি রেহবার? সামান্য বিষয়ে রেগে যাওয়া, রিয়েক্ট করার স্বভাব তো আপনার ছিলো না। মানুষ মাত্রই পরিবর্তনশীল। গুলিস্তা সবসময় একই ধাচের আচরণ করবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ও সবে মাত্র সুস্থ হতে শুরু করেছিল, আপনার উপর ভরসা করে, আপনাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলো। আর আপনি কি করলেন? অন্য সবার মতো আপনিও ওর উপর একটা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলেন। দ্বিমত করায় নারাজ হলেন। যদি পাশে বসে ভালোভাবে জানতে চাইতেন, সে কেনো এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তবে ও আপনার উপর থেকে ভরসা হারাতো না। প্রথম আঘাতটা আপনিই ওকে করেছেন রেহবার।

– আই নো। আই ওভাররিয়েক্টটেড। ও যে সেই কষ্ট এখনো মনে পুষে রেখেছে, আমি বুঝতে পারিনি। এখন আর কোনোকিছুই আমার সাথে কনসাল করে না। সতর্কতার সাথে দুরত্ব বজায় রাখে। আমি চেয়েও ওর জগতে প্রবেশ করতে পারছি না।

– কথা বলুন। সামনাসামনি বসে কথা বললে প্রায় সকল সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়। আগে যেমন আগ্রহ দেখাতেন, ওকে বুঝার চেষ্টা করতেন সেটা করুন। আপনি ধরেই নিয়েছেন গুলিস্তা এখন পুরোপুরি সুস্থ। ওকে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো ট্রিট করা শুরু করেছেন। আপনাকে বলে রাখি, সারাজীবন ওর স্পেশাল টেককেয়ার প্রয়োজন হবে। যদি করতে পারেন, তবেই ওর মনের কাছাকাছি ঠাঁই হবে আপনার।

রেহবার ফিরে এসে দেখে গুলিস্তা ঘুমিয়ে পরেছে৷ অনেকদিন পর ঘুমন্ত মুখপানে গভীর চোখে চেয়ে দেখলো রেহবার। চুমু আঁকলো কপালে। তাতেই চোখ মেলে তাকালো গুলিস্তা। রেহবার আলতো হাসলো। বিভ্রান্ত দেখালো গুলিস্তাকে। ওকে আরেকদফা অবাক করে দিয়ে পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে ব্যালকনির দিকে এগিয়ে গেলো রেহবার। পড়ে যাওয়ার ভয়ে গুলিস্তা শক্ত করে রেহবারের গলা জড়িয়ে ধরলো। নিজে দোলনায় বসে গুলিস্তাকে কোলে বসিয়ে নিলো রেহবার। শান্ত রাতে ফাঁকা ব্যালকনি গুলিস্তাকে বড্ড পোড়ালো। তিতানের খাঁচাটা এখানে নেই। ওর সকল জিনিসপত্র স্টোর রুমে সরিয়ে দিয়েছে রেহবার। তবুও গুলিস্তার মন থেকে তিতানের স্মৃতি ফিকে হয়নি। ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রেহবার বললো,
– আরেকটা পাখি এনে দিবো?
– নাহ।
– তিতানের মতোই আরেকটা নিয়ে আসবো। গ্রে প্যারোড। খুব দ্রুত তিতানের মতোই কথা বলতে শিখে যাবে।

গুলিস্তা ভীষণ রেগে গেলো। নাকের পাটা ভুলে উঠলো। তিতানের অভাব অন্য কেউ কীভাবে পূরণ করবে! চিৎকার করে বললো,
– বললাম তো লাগবে না। কোনো পাখি চাই না আমার। কিচ্ছু আনবে না তুমি।

এতোটা রেগে যেতে দেখে রেহবার অবাক হলো৷ তিতানের বিরহে এতোটা কাতর হয়ে আছে কে জানতো! যেদিন তিতানকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না সেদিন শুধু একটু কান্নাকাটি করেছিলো গুলিস্তা। তারপর আর সেই প্রসঙ্গে কোনো কথা বলেনি৷ রেহবার ভেবেছে ধীরে ধীরে ভুলে যাবে। গুলিস্তা ভুলেনি। বুকের মধ্যে চেপে রেখেছিলো। ওর গালে আলতো করে হাত রেখে বললো,
– আচ্ছা। আনবো না। তিতানের জায়গা তিতানেরই থাকুক।

বেশ কিছুক্ষণ নীরব রইলো দুজনে। বুকের মাঝে গুলিস্তাকে জড়িয়ে রেখে রেহবার ডাকলো,
– ফুল?
– হুম।
– তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?
– নাহ।

সোজাসাপ্টা উত্তরে রেহবার হতাশ হলেও মানিয়ে নিলো। আবার প্রশ্ন করলো,
– তুমি কেমন আছো, ফুল?

বুক থেকে মাথা তুলে রেহবারের মুখের দিকে চাইলো গুলিস্তা। রেহবার ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে জানার আগ্রহ। সে সত্যি জানতে চায় গুলিস্তা কেমন আছে। রেহবারের বুকের সাথে মিশে গিয়ে গুলিস্তা বললো,
– ভয় লাগছে।
– কীসের ভয়?
– রিনাতের জন্য।

রেহবার ঝুঁকলো গুলিস্তার মুখের কাছে। চোখে চোখ রেখে জানতে চাইলো,
– রিনাত কে?

হাত উঁচু করে তর্জনী দিয়ে ঘরের দিকে ইশারা করলো গুলিস্তা। কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো রেহবারের বুঝতে। অবাক হলেও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললো,
– ছেলের নাম রিনাত রেখেছো?

মাথা উপর নিচে ঝাঁকালো গুলিস্তা। তা দেখে আলতো হাসলো রেহবার।
– খুব সুন্দর নাম। রিনাত। কিন্তু রিনাতের জন্য ভয় পাচ্ছো কেনো?
– এতো ছোটো! কিছু বলতে পারে না। আমিও কিছু বুঝতে পারি না৷ কখনো হাসছে, কখনো কাঁদছে। তখন ঘুমের মধ্যে কীভাবে যেনো হাসছিলো! তারপর হঠাৎ কেঁদে উঠলো। আমি যদি মায়ের মতো আমার ছেলের উপর জুলুম করি? সেও যদি আমার কাছে আসতে ভয় পায়? আমার সিদ্ধান্ত ওকে যদি কষ্ট দেয়? কষ্ট পেলে নিশ্চয়ই আমাকে বলবে না। আমিও বুঝবো না৷ ওর কষ্ট আরও বাড়বে।
– মায়েরা সব বুঝতে পারে। তুমিও পারবে। সন্তানের জন্য যেটা ভালো মনে হবে সেটাই করবে৷ ও কষ্ট পাবে না৷
– কষ্ট পায় কিন্তু বলে না। ধরুন ওর খেতে ইচ্ছে করছে না, আমি জোর করে খাওয়াচ্ছি। এতে ওর কষ্ট হবে না? অবশ্যই হবে। আমি তো বুঝতেই পারি না ওর কখন ক্ষুধা লাগে। মা কীভাবে যেনো বুঝে যায়!
– মায়ের থেকে জেনে নিও কীভাবে বুঝতে পারে। ভয় পেয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখলে হবে না। চেষ্টা করো, নিজের উপর বিশ্বাস রাখো। তুমিও পারবে। না পারলেও কোনো সমস্যা নেই। আমি আছি না?

আমি আছি কথাটি গুলিস্তা বরাবর ভরসা খুঁজে পায়। আজোও পেলো। তবে রিনাতের সাথে খুব একটা সখ্যতা গড়ে তুলতে পারলো না। ওকে সামলানোর জন্য আম্বিয়া খাতুনকেই ছুটাছুটি করতে হয়।

সেদিন আম্বিয়া খাতুন নামাজ পড়তে বসেছিলেন, রিনাত ছিলো গুলিস্তার ঘরে। হাত পা নাড়িয়ে আপন মনে খেলছিলো। হঠাৎ কি যেনো মনে করে চোখ মুখ কুঁচকে কাঁদতে শুরু করলো। পুরনো সব টেকনিক খাটিয়েও কান্না থামাতে পারলো না গুলিস্তা। অবশেষে হতাশ হয়ে ক্রন্দনরত ছেলের পাশে বসে রইলো নিশ্চল। আর কিইবা করতে পারে সে? এতো চেষ্টা করেও কান্না থামছে না। রেহবার গিয়েছে অফিসে। এখন শুধু আম্বিয়া খাতুনের নামাজ শেষ হওয়ার অপেক্ষা। রিনাতের কান্নার আওয়াজে কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। গুলিস্তার ভীষণ হতাশ লাগছে৷ বাতাসে ব্যালকনির পর্দাটা উড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে গুলিস্তা আনমনে তিতানকে স্মরণ করলো।
– তিতান, তুই নেই কেনো রে?

আশ্চর্যজনক ভাবে মায়ের কথা শুনে রিনাতের কান্না থেমে গেলো। মুখ থেকে অস্পষ্ট উউউ আওয়াজ করে ডাগর ডাগর চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো৷ জল ভরা সেই চোখ দুটোকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে গুলিস্তা বিভ্রান্ত হলো। হঠাৎ করে কান্না থামিয়ে দিলো কেনো? নিজের সন্দেহের নিশপত্তি করতে ধীর কন্ঠে আবার ডাক দিলো,
– তিতান?

রিনাত এক হাত বাড়িয়ে মায়ের মুখ ধরার চেষ্টা করে আবার জবাব দিলো, উউউউ…

চলবে…