হে সখা পর্ব-৫১+৫২

0
292

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
৫১

রেহবারের কর্ণকুহরে তখন রানুর কথাগুলো বাজছে৷
“এ ধরনের রোগীরা হীনমন্যতায় ডুবে থাকতে থাকতে একসময় বেঁচে থাকার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলে। টিকে থাকাটা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পরে৷ তারা স্ব-ইচ্ছায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়৷ একদিন চলে যায় নীরবে। এদিক থেকে আপনি অবশ্য ভাগ্যবান। নিজের ক্ষতি করার কিংবা মৃত্যু প্রত্যাশার কোনো প্রবণতা গুলিস্তার মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। এমন হলে সামলানো মুশকিল হয়ে যেতো।”

রেহবার ভুলতে চায় সেসব কথা, ফ্লোরিডার সেই ভ্রমনের কথা। ওসব অতীত। গুলিস্তা এখন সুস্থ। স্বাভাবিক তার চলাফেরা। তাহলে আবার এমন হলো কেনো? কিছু না বলে, বিন্দুমাত্র সময় বিলম্ব না করে গুলিস্তাকে পাঁজাকোলে তুলে নিলো রেহবার। বিছানায় এনে শুইয়ে দিয়ে গায়ে চাদর ঢেকে দিলো। কোনো কিছুতে বাধা দিলো না গুলিস্তা। সে যেনো অনুভূতিহীন। ওর পাশে পা ঝুলিয়ে বসলো রেহবার৷
– এখন একটু ঘুমাও। ঘুম থেকে উঠলে দেখবে ভালো লাগছে। তখন আমরা এসব নিয়ে কথা বলবো।

কপালে চুমু দিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে, জামাকাপড় বদলে নিলো। মনটা পরে আছে শয়নকক্ষে৷ যেখানে শুয়ে থাকা মেয়েটার কাছে৷ মাত্র কয়েক মিনিটের মাঝে ফিরে এসে দেখলো গুলিস্তা খোলা চোখে সিলিং এর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। রেহবার নিজেও গুলিস্তার পাশে শুয়ে পরলো। ওকে নিজের কাছে নিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলয়ে দিতে থাকলো। অনেকক্ষণ সময় লাগলেও একসময় গুলিস্তা ঘুমিয়ে গেলো। ওর ভারী হয়ে আসা নিঃশ্বাসের সাথে বাড়লো রেহবারের দীর্ঘশ্বাস।
খুব সাবধানে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। রিনাতকে ফোন করে ডেকে নিয়ে এলো রুমে। রুমের একপাশে থাকা সোফাসেটে মুখোমুখি হয়ে বসলো। নিচুস্বরে প্রশ্ন করলো রেহবার।
– এসব কীভাবে হলো? বাড়িতে কেউ এসেছিলো? ফুলকে কিছু বলেছে?

রিনাত তৎক্ষনাৎ কিছু বললো না। মাথা নিচু করে বসে রইলো। কী বলবে সে! কার নামে নালিশ করবে? নিনাতের নামে? সে যে মায়ের মতোই প্রিয় রিনাতের কাছে। রেহবারের ধৈর্য্য আজ বড্ড সীমিত।হবেই না বা কেনো! গুলিস্তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে, আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে কম পরিশ্রম সে করেনি। একদিন দুদিন নয়, বছরের পর বছর চেষ্টা চালিয়ে গেছে। আদর, যত্নে সতেজ করে রাখা রেহবারের ফুলটি এক মুহূর্তে আবার মুষড়ে গেলো কীভাবে? জীবনে প্রথমবারের মতো ছেলেকে প্রচন্ড ধমক দিলো রেহবার৷
– রেহনেওয়াজ রিনাত, এই মুহূর্তে আমার পক্ষে ধৈর্য্য ধারণ করা সম্ভব নয়৷ যা জানো দ্রুত বলে ফেলো৷

নিচুস্বরের ধমকেও কেঁপে উঠলো রিনাত। বাবার ধমক খেয়ে অবাক হলো না সে। বাবা ওর মাম্মামকে কতোটা ভালোবাসে, সেটা বুঝার মতো বয়স রিনাতের হয়েছে৷ তাছাড়া বাবা মায়ের ভালোবাসাময় ছোট ছোট অনেক মুহুর্তের সাক্ষী সে ইতোমধ্যে হয়েছে। মাথা নিচু রেখেই রিনাত জানালো স্কুল থেকে ফিরে নিনাত মায়ের সাথে চোটপাট করেছে৷ ঠিক কি কি বলেছে সবটা রিনাত জানে না। যেটুকু শুনেছে সেইটুকুর পুরো বিবৃতি সে দিলো৷ যা শুনে রেহবার বিস্ময়ের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে৷ এই মুহুর্তে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও সে অবাক হবে না। রেহবারের মেয়ে, নিনাত! সেই ছোট্ট নিনাত গুলিস্তাকে এভাবে অভিযুক্ত করতে পারে কখনো কি ভেবেছে রেহবার! দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করেনি সে। অনেকখানি সময় সোফায় গা এলিয়ে বিমূঢ় হয়ে বসে রইলো। তারপর জিজ্ঞাসা করলো,
– নিনাত কোথায়?
– ওর ঘরে।
– তুমি যাও। ওকে আসতে বলো।
– ঘরের দরজা বন্ধ। সেই যে বন্ধ করেছে আর খুলেনি৷ অনেক ডেকেছি, সাড়া দেয়নি৷

রেহবার তাকালো বেডের দিকে। যেখানে শান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে গুলিস্তা৷ এই ঘুম ভাঙলে কোন গুলিস্তার দেখা মিলবে রেহবার জানে না। জানতেও ইচ্ছে করছে না। বেশ হতো, যদি আজকের দিনটা জীবন নামক খাতার পাতা হতে মুছে ফেলা যেতো।

– তুমি ফুলের পাশে বসো৷ আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত এখান থেকে কোথাও যাবে না৷ ও যেনো তোমার নজরের আড়াল না হয়৷
ছেলেকে কঠোরভাবে আদেশ দিয়ে কক্ষ ত্যাগ করলো রেহবার। নিনাতের দরজা বাইরে থেকে বার দুয়েক ডাক দিলেই সে দরজা খুলে দিলো৷ গায়ে এখনো স্কুলের ইউনিফর্ম, চুল এলোমেলো, চোখ ফোলা৷ বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে কেঁদেছে বুঝাই যাচ্ছে৷ ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে বিছানায় বসে মেয়ের উদ্দেশ্যে বললো,
– ফ্রেশ হয়ে এসো। বাবা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করবে৷

বাবাকে যতোটা ভালোবাসে নিনাত, ততোই ভয়ও পায়। আবার শ্রদ্ধাও করে। তাই অবাধ্য হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
ফ্রেশ হয়ে, কাপড়চোপড় বদলে এলে একটি চেয়ার টেনে ওকে সামনাসামনি বসালো রেহবার। তারপর শান্ত কন্ঠে বলতে শুরু করলো,
– আমার অনুপস্থিতিতে বাড়িতে কি কি ঘটেছে তার বিবরণ কিছুটা শুনেছি রিনাতের কাছে। পুরো ঘটনা ও জানে না৷ যতোটুকু শুনেছি তারপর আর পুরো ঘটনা জানার ইচ্ছেও আমার নেই।
রিনাতের ভাষ্যমতে, তুমি তোমার মায়ের সাথে উঁচু গলায় কথা বলেছো, চিল্লিয়েছো, বেয়াদবি করেছো৷ মায়ের বিরুদ্ধে তোমার কিছু অভিযোগের কথাও আমি শুনেছি। সেসবের ব্যাপারে পরে কথা বলছি৷ প্রথমত বড়দের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সেটা তুমি ভুলে গিয়ে একটা অন্যায় করেছো। এ বাড়িতে গলার স্বর উঁচু করে কথা বলা নিষেধ। এটা আমার আদেশ ছিলো। তুমি সেটাও অমান্য করেছো৷ ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ যা প্রচন্ড বেয়াদবি। সেটাও তুমি করেছো। এসব কি তুমি অস্বীকার করতে চাও?

চেয়ারে বসে মাথা নিচু করে মাথা ডানে বামে দোলালো নিনাত। তা দেখে রেহবার বললো,
– কথা বলো। আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।

কাঁপাকাঁপা গলায় নিনাত মিনমিনিয়ে বললো,
– অস্বীকার করছি না। এগুলো আমি করেছি৷ এজন্য স্যরি৷ তখন মাথা ঠিক ছিলো না। রাগের মাথায় ভুল করে ফেলেছি। স্যরি।
– অন্যায় রাগের মাথায় করলেও সেটা অন্যায়, ঠান্ডা মাথায় করলেও সেটা অন্যায়। তোমার আচরণে আমি খুবই কষ্ট পেয়েছি। আমার লালনপালনে প্রশ্ন উঠেছে। তুমি আমাকে হেয় করেছো।

রেহবারের কথায় খুবই মন খারাপ হলো নিনাতের৷ বাবাকে কষ্ট দেওয়ার কথা সে কখনো ভাবতেই পারে না। কিন্তু মায়ের কারনে ও সেটাও করে ফেললো। আর কতো সমস্যার মুখে ওকে পরতে হবে মায়ের কারনে! হতাশার জল নামলো দু চোখ বেয়ে।
– পিতা হিসেবে আমি ব্যর্থ৷ সন্তানকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারিনি, আদব কায়দা শেখাতে পারিনি৷ এর দায় আমি মেনে নিলাম।

আর সহ্য হলো না নিনাতের। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললো,
– তুমি এভাবে কেনো বলছো বাবা! আমি অন্যায় করেছি, এর দায় সম্পূর্ণ আমার। তুমি মোটেও ব্যর্থ নও।

রেহবারের মন গললো না। গুলিস্তার ব্যাপারে সে বরাবর সিরিয়াস। কোনোকিছুতেই কম্প্রোমাইজ করে না। গলার স্বর অপরিবর্তন রেখে বললো,
– কান্না থামাও। এবার মাকে নিয়ে তোমার অভিযোগের ব্যাপারে আসা যাক৷ তুমি কোন সমস্যায় পরছো, কোন বিষয়টি তোমার পছন্দ হচ্ছে না, তুমি কি চাইছো সেগুলো স্বাভাবিকভাবে বসে জানানো যেতো৷ এইটুকু বয়সে তোমার এতো সাহস কি করে হয়, নিজের মায়ের সাথে এভাবে কথা বলার? কোথায় শিখেছো এসব?
– আমি কোন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, কতো কিছু ফেস করছি সেসব নিয়ে কেউ ভাবছো না৷ ভাই আমাকে ধমক দিলো, এখন তুমি এসে বকছো। অথচ দিনের পর দিন মা আমাকে অবহেলা করে গেছে, এখনো যাচ্ছে সেসব নিয়ে তোমরা কেউ কিছু বলছো না।
– তোমার কেনো মনে হলো তোমাকে অবহেলা করা হচ্ছে? কোন আচরণে মনে হয়েছে?
– সিরিয়াসলি বাবা! তুমি বুঝতে পারছো না? মায়ের কোন আচরণটা স্বাভাবিক মনে হয় তোমার কাছে? মা কখনো আমাদের সাথে বসে দুটো কথা বলেছে? কখনো আড্ডা দিয়েছে আমাদের সাথে? আমার সব বন্ধুদের মা কতো ফ্রেন্ডলি! অথচ আমার মাকে দেখো কেমন গেয়ো টাইপের।
– নিনাত, ভাষা সংযত করে কথা বলো৷ উনি তোমার মা।

গর্জে উঠলো রেহবার। চেয়ারসহ নিনাত বুঝি থরথর করে কেঁপে উঠলো। ভয় পেয়ে নিনাতের কান্নার গতি আরও বেড়ে গেলো।
– তোমরা কেউ আমাকে বুঝতে চাইছো না৷ আমার জায়গায় থাকলে বুঝতে পারতে৷ কেজি স্কুলে সবাই আমার মাকে নিয়ে হাসাহাসি করতো। আমাকে কতো কথা শুনতে হয়েছো জানো? জানো না। আমি কাউকে বলিনি। ওরা সবাই আমাকে ক্ষেপাতো, আমার মা আমাকে স্কুলে নিয়ে যায় না, ফেরত আনে না। কখনো ঘুরতে নিয়ে যায় না। পরীক্ষা দিতে নিয়ে যায় না। প্যারেন্টস মিটিং এ আসে না। টিচার পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করেছে, নিনাত সত্যি তোমার মা আছে তো? কখনো ভেবে দেখেছো আমার কেমন লাগে যখন দেখি আমার বন্ধুরা মায়ের হাত ধরে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে৷ ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিচ্ছে, গালে চুমু দিচ্ছে, জড়িয়ে ধরছে? মা কখনো আমাকে ওভাবে আদর করেছে? করেনি। আমাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, রেডি করে দেওয়া, চুল বেধে দেওয়া, ঘুরতে নিয়ে যাওয়া সবকিছু তুমি করেছো। কেনো? এসব তো মায়ের কাজ। আমার মা আছে, তবুও সে কেনো করে না?

রেহবার সব শুনলো। শান্তভাবে বসে মেয়ের অভিযোগ ও অভিমান বুঝার চেষ্টা করলো। ছোট্ট মনে অনেকদিন ধরে অল্প অল্প করে আচড় কেটেছে মাকে কাছে না পাওয়ার যন্ত্রণা৷ সেই সাথে বন্ধুদের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি রকমের হাসাহাসি, অবান্তর আগ্রহ। এতোদিন বাবার থেকে লুকিয়ে গেছে। স্কুলের অভ্যন্তরীণ ঘটনাগুলো সেখানেই চেপে রেখে হাসি মুখে স্কুল গেটে এসেছিলো বলে রেহবার মেয়ের মন খারাপ ধরতে পারেনি। আজ সুযোগ এসেছে, সবটা জানতে চায় রেহবার।

– আজকে কি হয়েছিলো?
– এতোদিন স্কুলে সাফার করেছিলাম এবার হাইস্কুলেও শুরু হয়েছে। আমার এক স্কুল ফ্রেন্ড আমার সাথে একই সেকশনে আছে। সে সবাইকে বলেছে, নিনাতের মা স্বাভাবিক নয়। ভীতু, ভ্যাবলা। সেই থেকে সবাই আমার পেছনে লেগেছে। আজকে সবাই আমার লাঞ্চবক্স নিয়ে হাসাহাসি করেছে। সবাই লাঞ্চে কতো ভ্যারাইটি খাবার নিয়ে আসে আর আমাকে রোজ দেওয়া হয় ভাত-তরকারী। মুরগী কষানো, মাছ ভুনা, গরুর ঝোল ইত্যাদি হাবজাব খাবার। আজকাল এসব কে নিয়ে যায় টিফিনে! কেনো হাসবে না ওরা বলো? এসব দেখে আমার খারাপ লাগে না বুঝি? ভীষণ খারাপ লেগেছে। সাথে মেজাজও খারাপ হয়েছে। তাই ওভাবে রিয়েক্ট করেছি। এর জন্য আমি মোটেও স্যরি নই।
– আর কোনো অভিযোগ আছে তোমার?

রেহবারের শীতল কন্ঠস্বরে নিনাত নার্ভাস ফিল করলেও শরীরে তখন বয়ঃসন্ধিকালের নানান হরমোনের জোয়ার। সাহস তাই একটু বেশি বেড়েছে। কৌতুহলের কাছে, জানার ইচ্ছের কাছে কোনো প্রকার নার্ভাসনেস তুচ্ছ।
– আমাদের সাথে ঠিকঠাক কথা বলে না, অথচ তোমার সাথে ঠিকই মন খুলে হাসে, কতো কতো কথা বলে। আমি প্রায়ই দেখি। আমার মনে হয়, মাম্মাম আমাকে ভালোবাসে না, পছন্দ করে না। তোমাকে হিংসে করছি না। আমি শুধু বলছি তোমার সাথে একরকম অথচ আমাদের সামনে আরেকরকম। এমন দু ধরনের পার্সোনালিটির কারন কি?

মেয়ে বড় হচ্ছে, মনে প্রশ্ন জাগছে। রিনাতকে ছোট থেকেই গুলিস্তার সমস্যাগুলোর ব্যাপারে একটু একটু করে জানানো হয়েছিলো৷ কিন্তু নিনাত এ ব্যাপারে পুরোপুরি জ্ঞানহীন। যদিও গুলিস্তার আচরণ এখন অনেকটা স্বাভাবিক। তবুও আত্মবিশ্বাসের কিছুটা অভাব রয়েই গেছে। বিশেষ করে ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে। সে ভাবে তার মায়ের আচরণ যেমন তার উপর চাপের সৃষ্টি করেছিলো, সেও নিশ্চয়ই তার ছেলেমেয়ের উপর চাপ সৃষ্টি করে ফেলবে। তাই তো ওদের দায়িত্ব পুরোপুরি রেহবারের হাতে তুলে দিয়েছে।

– তোমার মায়ের সাথে যখন আমার প্রথম পরিচয় হলো, তখন ওর অবস্থা অনেক হতাশাজনক ছিলো। নিজের মতো থাকতো, কারো সাথে কথা বলতো না, মিশতো না। এমনকি আমার সাথেও না। ওর সোশ্যাল এঞ্জাইটি ছিলো প্রখর। সেখান থেকে বের হয়ে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসা সহজ ছিলো না৷ আমাকে অনেক ধৈর্য্য ধরতে হয়েছিলো৷ অনেক সময় নিয়ে ধীরে ধীরে ওর বিশ্বাস অর্জন করতে সফল হয়েছি। মনে ভরসার জায়গা তৈরি করতে পেরেছি৷ ও এখনো হুট করে যে কারো সাথে সহজ হতে পারে।
– আমরা তার সন্তান। যে কেউ নই।
– তোমাদের সাথে ও কিন্তু স্বাভাবিক আচরণই করে৷ হয়তো অন্যদের মতো ওতো বেশি কথা বলে না, মুখে ভালোবাসার বুলি ফোটায় না, প্রকাশ্যে আদর করে না। তাই বলে ও যে তোমাদের ভালোবাসে না,এমনটা নয়। শুধু তোমাদের কাছে আসতে ভয় পায়। আমরা যখন বসে গল্প করি, তখন আমাদের পাশে এসে বসে না, যদি তোমাদের অস্বস্তি হয়৷ তোমাদের ঘরে যায় না, যদি বিরক্ত হও। প্রাইভেসি ভঙ্গ হওয়ায় তোমাদের মনে চাপ পরে৷ শুনতে হাস্যকর হলেও ও এভাবেই ভাবে। তোমাদের সহজ সরল সুন্দর শৈশবে কোনোরুপ বাধা হতে চায় না। আসলে তোমার মায়ের শৈশব খুব একটা ভালো কাটেনি। প্রচন্ড চাপে ছিলো। তাই ও চায় না নিজের সন্তানদের শৈশব ওর মতো কাটুক। তবে তোমরা কাছে গেলে কখনো কিন্তু ফিরিয়ে দেয়নি৷ মনে করে দেখো দেখি, মায়ের কাছে কিছু চেয়েছো আর সে দেয়নি৷ এমনটা কখনো ঘটেছে?

নিনাত মাথা দোলায়। এমনটা কখনো ঘটেনি। যদিও ওদের সব আবদার বাবার কাছেই। বাবার অনুপস্থিতিতে কখনো বাধ্য হয়ে মায়ের কাছে কিছু চাইলে সে হয়তো হাসি মুখে সেটি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় না। তবে কিছুক্ষণ পরেই ওরা নিজের পড়ার টেবিলে কাঙ্খিত বস্তুটি ঠিকই পেয়ে যেতো।

– মায়ের সাথে সময় কাটাতে ইচ্ছে করলেও তুমি কখনো নিজে থেকে মায়ের কাছে গিয়ে বসোনি। আড্ডায় কখনো মাকে ডেকে বসতে বলোনি। মনে মনে অভিমান পুষে রেখেছো। টিফিনে যদি ভাত নিয়ে যেতে ইচ্ছে না করে তবে সেটা মাকে জানিয়ে দেখতে। সে বিনাবাক্য মেনে নিতো। যেটা আবদার করতে সেটাই বানিয়ে দিতো। হয়তো তুমি নিজেও জানো না, লাঞ্চে ভাত খেতে তুমি কতোটা পছন্দ করো। বাইরে থেকে পেট ভরে স্নেকস খেয়ে ফিরলেও তুমি কিন্তু ঠিকই খাবার টেবিলে বসে পরো। সামান্য হলেও ভাত খাও। এসব তুমি খেয়াল না করলেও তোমার মা ঠিকই খেয়াল করেছে। ও আসলে এমনি। দেখিয়ে দেখিয়ে যত্ন করতে পারে না। আড়ালে থেকে আগলে রাখে। প্রতি জন্মদিনে তোমরা যে ড্রেস দেখে খুশি হও, সেটাও তোমার মায়ের কেনা। শুধু নিজে না দিয়ে আমার হাতে পাঠায়৷ তুমি বুঝতে শিখেছো ঠিকই কিন্তু তোমার মাকে বুঝার চেষ্টা করোনি। তোমার আজকের আচরণে আমি খুবই কষ্ট পেয়েছি। এমনটা করা তোমার উচিত হয়নি।

নিনাতের পক্ষে এতো ভারী কথা একপলকে বুঝে ফেলা সম্ভব হলো না। কিছুটা বুঝলো, বাকিটা মাথার ভেতর অচেনা সুরের মতো বাজতে থাকলো। এইটুকু বয়সের জেদ তাকে হার মানতে দিলো না। কান্না ততোক্ষণে থেমে এসেছে৷ তবুও গাল ফুলিয়ে বললো,
– লোকের কথা আমাকে শুনতে হয়, আমার খারাপ লাগে।
– লোকের কথার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিলে লাইফে কখনো সাকসেসফুল হতে পারবে না। সবসময় নিজের বিবেচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিবে৷ পিছনে কথা বলা লোকগুলো তোমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ নয়। তোমার জন্য তুমি গুরুত্বপূর্ণ, তারপর তোমার পরিবার৷

উঠে দাঁড়ালো রেহবার। এই মুহূর্তে কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। গুলিস্তার কাছে ফিরে যেতে যেতে বললো,
– লোকের কথায় পাত্তা দিলে তুমি, আমি, আমরা এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতাম না৷ তোমার মায়ের সাথে সুখী একটা সংসার আমার করা হতো না৷

রেহবার যখন ফিরে গেলো তখন গুলিস্তার গায়ে ভীষণ জ্বর। দিশেহারা রিনাত অনবরত মায়ের কপালে জলপট্টি দিয়ে যাচ্ছে। রাত অনেক হয়েছে। ছেলেকে ঘরে পাঠিয়ে সে দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলো রেহবার। শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণায় গুলিস্তার মুখ হালকা নীলবর্ণ ধারণ করেছে। তা দেখে রেহবারের কী ভীষণ অসহায় লাগছিলো বলে বুঝানো যাবে না৷ অনেক কষ্টে আঁকানো একটা চিত্র, একটা সুখী পরিবার। এক পলকে কয়েক ফোঁটা কালো রঙে কী বিশ্রীভাবে নষ্ট হয়ে গেলো! কোথাও না কোথাও রেহবার নিজের দোষ খুঁজে পাচ্ছে। হয়তো সে যথেষ্ট সতর্ক ছিলো না।

গভীর রাত পর্যন্ত জলপট্টি দিয়েও গুলিস্তার জ্বর নামলো না। গায়ের অতিরিক্ত উত্তাপে গুলিস্তার ঘুম ভেঙে গেছে। ঘেমে-নেয়ে একাকার। অনেক কষ্টে দু চোখ মেলে দেখতে পেলো ভেজা কাপড় চিপে পানি ঝরাচ্ছে রেহবার। কপালে দিতে গেলেই মুখ ঘুরিয়ে নিলো গুলিস্তা।
– সরাও এসব।
– গায়ে অনেক জ্বর। জলপট্টি দিলে দ্রুত কমে যাবে।
– লাগবে না। কিছু লাগবে না আমার। এসব করবে না তুমি। যাও গিয়ে ঘুমাও।
– আমার উপর কেনো রেগে যাচ্ছো! এমন করো না প্লিজ৷ দেখি সোজা হও।
– বললাম না, লাগবে না? সরাও এসব৷ সরাও, সরাও, সরাও।

বিছানায় শুয়ে থাকলেও রিনাতের ঘুম এলো না। রাতের অর্ধেক প্রহর পেরিয়েছে তবুও ঘুম আসার নাম নেই। বিরক্ত হয়ে বিছানা ছাড়লো। মায়ের খবর নেওয়া দরকার। জ্বর না ছাড়লে বাবা নিশ্চয়ই এখনো জেগে আছে৷ ঘর থেকে বের হতেই নিনাতের সাথে দেখা। মনটা অস্থির হয়ে আছে। ঘুম আসছিলো না ওর। যা করেছে বেশ করেছে। কোনো অন্যায়বোধ নেই৷ তবুও কেনো যেনো মনে হচ্ছে একটু বেশি রিয়েক্ট করে ফেলেছে। পাশাপাশি দুটো রুম। রিনাতের রুমের দরজা খুলতেই নিনাত শব্দ পেলো। এতো রাতে কোথায় যাচ্ছে? নিনাতকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে রিনাত বললো,
– মায়ের ভীষণ জ্বর। কমলো কিনা দেখে আসি। টেনশন হচ্ছে।

নিনাতের বিরক্ত লাগলো। একদিনের কিছু অভিযোগেই এই অবস্থা। জ্বর বাধিয়ে একাকার। তবুও কেনো যেনো রিনাতের পিছুপিছু বাবা মায়ের বেডরুমে ঢুকে পরলো। দরজাটা হালকা খোলাই ছিলো৷ মা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। পাশে বসে বাবা অসহায় মুখে বললো,
– ভারী জেদ করছো আজকাল। আচ্ছা ঠিক আছে জলপট্টি দিতে হবে না। খাবার নিয়ে আসি৷ একটু মুখে দিয়ে ঔষধ খাও।

একটু আগেই বাবার কন্ঠ ছিলো শীতল একদম বরফের ন্যায় কঠিন। এখন নরম, আদুরে। ভালোবাসা ঝরে ঝরে পরছে৷ জেদ করলে বাবা বরাবর কঠিন চোখে তাকায়। এই স্বভাবটা বাবার মোটেই পছন্দ নয়। এতেই ওরা দু ভাইবোন সুরসুর করে জেদ পেছনে ফেলে বাবার আদেশ মেনে নিতো৷ অথচ মায়ের কথায় কেমন চট জলদি হার মেনে নিলো। রাগ হয়ে কঠোর চোখে তাকানো তো দূরের কথা।

– কিচ্ছু খাবো না আমি। সামনে থেকে বিদায় হও।

গুলিস্তার রাগী কন্ঠস্বর এই প্রথম কানে এলো ওদের৷ তুলোর মতো নরম মানুষটা রাগ করতেও জানে! মায়ের রাগ দেখে রিনাত-নিনাতের বড্ড ভালো লাগলো। রাগলে কন্ঠটা একটু ভারী শোনায়৷ কিন্তু বাবার অসহায়ত্ব, বিধ্বংস্ত চেহারাটা দেখে মায়া হলো। মনে হচ্ছে এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে৷ গুলিস্তার হাত নিজের হাতে জড়িয়ে অসহায় কন্ঠে বললো,
– রাগটা কিছুক্ষণের জন্য স্থগিত করা যায় না? সুস্থ হলে তখন আরও বেশি করে রাগ দেখিও৷ পিঠ পেতে বসে থাকবো৷ ইচ্ছেমতো কিলঘুষি দিয়ে রাগ ঝেরে ফেলো। এখন রাগ করে না খেয়ে থাকলে ঔষধ খাবে কীভাবে?
– কোনো ঔষধ খাবো না। যাও তো এখান থেকে।

রিনাত এগিয়ে গিয়ে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
– আমি স্যুপ তৈরি করে নিয়ে আসছি৷ তুমি এখানেই থাকো।

ছেলেকে দেখে ভড়কে গেলো গুলিস্তা। কখন এসেছে ঘরে? চাদর টেনে টুপ করে ভেতরে ঢুকে মাথা পর্যন্ত নিজেকে আড়াল করে নিলো। নিনাত দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখলো। একটু আগেই না বাবার সাথে চোটপাট করছিলো। এখন এমন চুপসে গেলো কেনো? রিনাতকে দেখে? অবাকই লাগলো নিনাতের।

– তুমি পারবে?
রেহবারের প্রশ্নে রিনাত মুচকি হাসলো। মায়ের সাথে কিচেনে টুকটাক কাজ সে করে। চা বানানো, তরকারি নেড়েচেড়ে দেওয়া, তেলের ভাজাপোড়া বানানোর সময় সেগুলো উল্টে দেওয়া, তেল থেকে উঠানো এগুলো সে প্রায় করে৷ শুরুতে গুলিস্তার পছন্দ ছিলো না। কিন্তু ওই যে, সন্তানকে না করতে পারেনি। পাছে আবার মন খারাপ করে বসে। তবে ছেলেকে একা ছাড়েনি৷ সবসময় পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছে চুপচাপ। এখন বুঝা যাচ্ছে, এসব রেহবারকে জানায়নি গুলিস্তা। মা-ছেলের এমন অনেক সিক্রেট সে জানে না।
অবাক চোখে মুখ ঢেকে রাখা গুলিস্তার দিকে তাকালো একবার, আরেকবার রহস্যময় হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলের দিকে।
– আর কতো কি লুকিয়েছো মা-ছেলে?

রিনাত যখন স্যুপ বানাচ্ছিলো পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো নিনাত৷ এতো যত্ন নিয়ে যে বানাচ্ছে, মা যে বললো খাবে না? অবশ্য ছেলের বানানো খাবারের আগে গুলিস্তার জেদ একদমই টিকলো না।

– উঠে স্যুপটা খেয়ে নেও। রিনাত নিজে হাতে তোমার জন্য বানিয়েছে।
রেহবারের কথা শুনে সাথেই বিছানায় উঠে বসেছিলো। এক চামচ স্যুপ মুখে দিয়ে মাথা নিচু করেই বললো,
– ভালো হয়েছে।

ঔষধ খাওয়ার প্রায় ঘন্টা খানেক পর জ্বর ছেড়েছে গুলিস্তার৷ তারপর সবাই শান্তিতে ঘুমালো। পরেরদিন সব আগের মতোই চললো। সূর্য উঠলো, সবাই রেডি হলো, নিজ নিজ গন্তব্যে ছুটলো। তবে খেতে বসে সবাই জানলো, বুঝলো, ঝড় থেমে গেলেও তান্ডবের চিহ্ন রয়ে গেছে। নিজের ঘর থেকে বের হয়নি গুলিস্তা। রান্নাবান্না করেছে মালা। নিনাতের টিফিনবক্সে আজ ভাত দেওয়া হয়নি৷ চিকেন রোল, শাহী কাবাব, নুডলস, টমেটো সস প্যাক করে নিনাতকে দেখালো মালা।
– দেহো দেহি সব ঠিক আছে কিনা? পছন্দ না হইলে কও, অন্য কিছু বানায় দেই৷ তোমার পছন্দ মতো টিফিন দিতে কইছে৷ ভর দুফুর বেলা এইসব তেলের জিনিস কেডা খায় কে জানে!!

মালা গজগজ করতে করতে নিনাতকে দেখিয়ে টিফিন প্যাক করলো। টিফিনবক্স হাতে নিয়ে নিনাত সামনে তাকিয়ে দেখলো বাবা-ভাই দুজনে ওর দিকে তাকিয়ে। চোখে চোখ পরতেই পরোটা ছিড়তে ব্যস্ত হয়ে গেলো। এসব কীভাবে খাচ্ছে কে জানে! নিনাত তো সামান্য একটু খেয়েই প্লেট সরিয়ে রেখেছে। পরোটাগুলো অন্য দিনের মতো সফট হয়নি। বুটের ঘন ডালের মধ্যে অতিরিক্ত লবণ। এমন খাবার খাওয়ার অভ্যাস নেই কারো।

চলবে…

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
৫২

আজকাল নিনাতের বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না৷ সেদিনের ঘটনার সপ্তাহখানেক কেটে গেছে৷ সবকিছু চলছে আগের মতোই। শুধু গুলিস্তা নিজেকে ঘরে আটকে ফেলেছে। আজকাল খুব প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হয় না। রান্নাবান্নার কাজ সামলাচ্ছে মালা। রাঁধে ভালো তবে মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ পাওয়া যায় না। নিনাতের টিফিনবক্সে একেকদিন একেক খাবার আসে৷ মজাদার প্যানকেকস, স্ট্রবেরি সিরাপ, বার্গার, পিৎজা, চিকেন শর্মা আরও কতো কি! যেগুলো মুখে তুলতে ইচ্ছে করা না নিনাতের। খেতে বসলেই ভাতের জন্য মন আনচান করে। লজ্জায় ভাতের কথা বলতে পারে না নিনাত। কোন মুখে বলবে? এই টিফিন নিয়ে কতো কাহিনী হয়ে গেলো! তাই স্কুল থেকে ফিরেই ভাতের প্লেট নিয়ে খেতে বসে যায়৷ দুপুরের সব পদ ওর জন্য আলাদা করে তুলে রাখা হয়। গরম করে নিয়ে আসে মালা। নিনাত জানে, মায়ের নির্দেশেই মালা এসব করে। সেদিনের আচরণের জন্য আফসোস হয় কিন্তু ক্ষমা চাইতে লজ্জা লাগে৷

বাড়িটা আজকাল মৃত্যুপুরীর মতো অদ্ভুতুরে লাগে৷ পুরোটা দিন ব্যালকনিতে বসে কাটায় গুলিস্তা। গাছে পানি দেয়, পরিচর্চা করে, দোলনায় বসে বই পড়ে কিন্তু হলরুমে আসে না। আগে হাঁটতে চলতে মানুষটাকে চোখের দেখা তো দেখা যেতো। কিচেনে রান্না করছে, ডালে বাগাড় দিতেই কী সুন্দর ঘ্রাণ! ড্রয়িংরুমের সোফা, টেবিল পরিষ্কার করছে। কাপড় দিয়ে ঝাড় দিতেই ধুলো এসে নাকে লাগে। সন্ধ্যায় ওরা দুই ভাইবোন পড়তে বসে। ডাইনিং টেবিলে বসে সবজি কাটতো গুলিস্তা। এখন সেসব স্মৃতি বড্ড পোড়ায় নিনাতকে। পাশে না বসুক, জীবনে মায়ের উপস্থিতি তো ছিলো। জোরালো সেই অনুভূতি এখন ফিকে হয়ে যাচ্ছে।
খাবারটাও এখন আর ডাইনিং টেবিলে বসে খায় না। গুলিস্তাকে ছেড়ে একা খেতে ওদের সবার কষ্ট হয়। সবচেয়ে বেশি মনমরা থাকে রেহবার। কোনোরকম দু মুঠো মুখে তোলে। বাচ্চাদের সঙ্গ দিতেই জোর করে খাবার মুখে তোলে ওদের বাবা। সবই বুঝে নিনাত। সন্তান যতো অন্যায় করুক, বাবা কখনো নিজের দায়িত্ব থেকে পিছপা হয় না৷
এই যে এতো ঝামেলার মধ্যেও নিনাতকে স্কুল থেকে ফিরিয়ে নিতে আসতে চেয়েছিলো। নিনাত বারণ করে দিয়েছে। এখন সে বড় হয়েছে। একাই রিক্সা নিয়ে আসা যাওয়া করতে পারবে।

গুলিস্তাকে একা ছাড়তে নারাজ রেহবার। খানিকটা দূর থেকে নজরে নজরে রাখে৷ সকালবেলা রিনাতের স্কুল থাকে, তাই ঘরে থেকে যায় রেহবার৷ গুলিস্তা চোখ রাঙিয়ে তাকায়। মুখ কালো করে বসে থাকে। ঘর ছেড়ে বারান্দায় বসে থাকে চুপচাপ। রেহবারের বাড়াবাড়ি রকমের চিন্তা ওর বিরক্ত লাগে। কিন্তু মুখে কিছু বলে না। আজ কয়েকদিন ধরে মৌনব্রত পালন করছে যে। এই সুযোগে রেহবারও পেয়ে বসেছে। নিজের মনমর্জি মতো চলছে। হাফ বেলা অফিস করছে। রিনাত ফিরে এলেই রেহবার অফিসে যায়। তখন বাবার ডিউটি পালন করে রিনাত৷ ও আবার দূরের ধার ধারে না। মায়ের কোলঘেষে বসে থাকে। গুলিস্তা আবার সন্তানকে না করতে পারে না। নিজের অজান্তেই ছেলের মাথায় হাত চলে যায়। চুল বুলিয়ে দিতে থাকে। ভাইকে দেখে নিনাতের হিংসে হয়। সে কেনো সহজ হতে পারে না? এভাবে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকতে পারে না। ভাই তো নিজে থেকেই মায়ের কাছে চলে যায়। মা কখনো ডাকে না। নিনাত নিজেও তো চাইলে যেতে পারে। সে জানে মা ফিরিয়ে দিবে না। তবুও… ওই যে জড়তা।

শেষের দিকে একটা দুটো করে শিক্ষার্থী স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে যায়। সবাই চলে যাওয়ার পর ধীর পায়ে বের হয় নিনাত। গেট পেরিয়ে অপেক্ষা করে রিক্সার৷ এসময় রিক্সা খুব কম পাওয়া যায় না। নিনাত খেয়াল করলো ওর পাশে একটি মহিলা এসে দাঁড়িয়েছে। সেটা সমস্যা নয়। সরকারি রাস্তা যে কেউ যেখানে সেখানে দাঁড়াতে পারে। সমস্যা হচ্ছে মহিলাটি ওর খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। বারবার নিনাতের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। নিনাত এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো। মহিলা তাকিয়েই আছেন। বাধ্য হয়ে প্রশ্ন করলো,
– কিছু বলবেন আন্টি?

ভদ্রমহিলার বয়স ত্রিশ হবে ছুঁইছুঁই। আর পাঁচটা বাঙালি ঘরের বউদের মতো গায়ের গঠন, মাঝারি উচ্চতা, গায়ে কমদামি একটা শাড়ি জড়ানো৷ ক্যাটক্যাটে লাল-বেগুনী রঙের মিশেল। চুলে তেল দিয়ে মাথার পেছনে মুড়িয়ে হেয়ারক্লিপ দিয়ে আটকানো। গায়ের রঙ সামান্য চাপা। দেখতে মোটামুটি সুন্দরী ভদ্রমহিলা নিনাতের কথায় ভড়কালো না। যেনো প্রস্তুতি নিয়েই এসে দাঁড়িয়েছেন। মিষ্টি হেসে বললেন,
– তোমার নাম কি?

অযাচিত প্রশ্ন নিনাতের পছন্দ নয়। চোখ মুখ শক্ত করে রেখে উত্তরে শুধু নামটা বললো। এই মুহুর্তে একটা রিক্সাও দেখা যাচ্ছে না।

– বাড়ি যাবা?
মহিলার প্রশ্নে নিনাত তাকালো না উনার দিকে। রাস্তার দিকে তাকিয়েই উত্তর দিলো,
– হুম।
– এখনি রিক্সা পাবে না। সামনের দিকে বিশাল জ্যাম লেগেছে। একটু সময় লাগবে।
– ওহ।
– দুপুরে কিছু খাও নাই? মুখটা শুকনা লাগছে।

মহিলার কথায় কিছু বললো না নিনাত। ঠোঁট টেনে মেকি হাসলো।
– সামনের দোকানে বসি চলো। তোমাকে কিছু কিনে দেই।
– স্যরি আন্টি। আপনাকে আমি চিনি না। অপরিচিত কারো থেকে কিছু নিতে নেই।
– আমি তোমার অপরিচিত নই। তুমি শুধু আমাকে চেনো না।
– বাড়ি গিয়ে খেয়ে নিবো। থ্যাঙ্কিউ আন্টি।
– আচ্ছা কিছু খেতে হবে না। চলো ওখানে গিয়ে বসি। তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে নিনাত।

নিনাত ভ্রু কুচকে তাকালো। প্রথম দেখাতে যা ভেবেছে তাই হলো। মহিলার মধ্যে ঘাপলা আছে।

– তোমার মায়ের ব্যাপারে।
কপালের ভাঁজ ধীরে ধীরে মুছে গেলো। এই আরেকজন হাজির হয়েছে। আজ সমস্ত ল্যাঠা চুকেবুকে যাক। লোকের কথায় জীবন চলে না, বাবা বলেছিলো। তুমি আমাকে হতাশ করেছো। নিনাত বাবাকে হতাশ করবে না। এই মহিলার কথায় সে পাত্তা দিবে না। মায়ের সমালোচনা শুনে এবার শান্ত থাকবে। নিনাত গিয়ে বসলো চায়ের দোকানের একটি চেয়ারে। ভীড় থেকে একটু দূরেই চেয়ার টেনে বসেছে। ভদ্র মহিলা নিজেও একটা চেয়ার টেনে বসলেন।

– তোমাকে একটা গল্প শোনাই। তোমার মায়ের ও আমার গল্প।

এ আবার নতুন কোন গল্প? জানে না নিনাত৷ তবুও আগ্রহী হলো। মায়ের গল্প শুনতে সকল সন্তানই বড্ড আগ্রহী হয়।

– গ্রামের বাজারে আমার বাবার একটা ছোট কনফেকশনারি ছিলো। সারাদিন লোকজনের ভীড় থাকতো। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ক্রেতার দেখা মিলে কিন্তু আয় হয় সামান্য। এক কাপ চা, এক পিচ কেকের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা ওরা আড্ডা দেয়। আমরা চারবোন, দুই ভাই। ভাই দুটো ছোট। ওই বয়সেই বাবার সাথে দোকানে বসে। এটা ওটা এগিয়ে দেয় ক্রেতাদের। আমরা চারবোন মায়ের সাথে সংসারে কাজ করি। বাড়ির সাথেই আবাদী জমি। সারাবছর কাজ লেগেই থাকে। ধান, গম, পাট, ভুট্টা, বাদাম, মরিচ কোনোকিছু চাষ করা বাদ যায় না। সেসবের পেছনে খাটতে হয় সারাবছর। জিরোনোর সময় কই!

নিনাতের মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। ভদ্র মহিলা চাপা হাসলেন। দোকানের ছেলেটা দু কাপ চা রেখে গেলো। ভদ্র মহিলা এক কাপ চা হাতে নিলেও নিনাতের কাপটা ওভাবেই রয়ে গেলো।

– আমার গল্প শুনে বিরক্ত হচ্ছো? ভাবছো এই গল্পে তোমার মা কোথায়? আছে। একটু ধৈর্য্য ধরে শুনো।
ভাইবোনের মধ্যে আমি আবার সবার বড়। তাই দায়িত্বটা আমার বেশি। কিন্তু আমার আবার পড়াশোনার বড্ড নেশা। কাজ ফেলে রেখে স্কুলে ছুটে যাই। স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগ রেখে আবার কাজে নামি৷ সব ভালোই চলছিলো। ভুল করলাম সাইন্স নিয়ে৷ সামনে এসএসসি পরীক্ষা। এদিকে আমার পুরো সিলেবাস বাকি৷ প্রাইভেট পড়ার টাকা নেই। আমার অবস্থা দেখে আমার এক বান্ধবী একদিন জোর করে ওর প্রাইভেটে নিয়ে গেলো। স্যারের সাথে কথা বলিয়ে দিবে৷ লজ্জায় আমি এককোনায় জড়োসড়ো হয়ে বসেছিলাম। ছুটির পর ওই সব কথা বললো। গরীব মেধাবী স্টুডেন্ট, টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই। সবশুনে স্যার বললেন, পরীক্ষার আর মাত্র কয়েকমাস বাকি এই মুহুর্তে কীভাবে সিলেবাস কমপ্লিট হবে! তবুও তিনি ভরসা দিলেন। গরীব মেধাবী ছাত্রী। একটু সাহায্য পেলেই ভালো রেজাল্ট হবে। স্কুলের আগে সকালবেলা আমাকে এক্সট্রা সময় দেখিয়ে দিবেন, আবার বিকালের ব্যাচেও আসতে বললেন। ভোরবেলা উঠেই কাজকর্ম গুছিয়ে দিয়ে আমি চলে যাই প্রাইভেট পড়তে। ছাত্রী আমি একাই। টিনের চালা ঘরটাতে ব্যাচ করে পড়ানো হতো। সামনে বেঞ্চে আমি বসতাম। আমার সামনেই চেয়ার নিয়ে স্যার বসতো। ভার্সিটি পড়ুয়া মেধাবী স্টুডেন্ট। নিজে পড়ার ফাঁকে দুটো ব্যাচ পড়ান। আমার জন্য সকালের ঘুম বাদ দিয়ে ছুটে আসে৷ দীপ্ত কন্ঠে পড়া বুঝান। আমি মুগ্ধ হই৷ মুগ্ধতা এক পর্যায়ে ভালোবাসায় রুপ নেয়। কিশোরীর চোখে মুখে উচ্ছ্বাস, সাথে ভীরু লজ্জা। উনার বুঝতে সময় লাগে না। এসব নিয়ে আমরা কথা বলি না৷ পড়তে পড়তে শুধু দু একবার বইয়ের পাশে রাখা অবহেলিত হাতে হাত লেগে যায়। আমি কেঁপে উঠি। এভাবেই সম্পর্ক আরও গভীর হয়। এতোটাই গভীর যে আমিই তলিয়ে গেলাম।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে গলা ভিজিয়ে নেন ভদ্র মহিলা।
– তুমি তো কিছুই খেলে না! ক্ষুধা পেয়েছে নিশ্চয়ই। চলো উঠা যাক। বাড়ির রাস্তা ধরে একটু হাটি। গল্প শেষ হলে রিক্সায় উঠে যেও।

রাস্তার বামপাশ ধরে ওরা পাশাপাশি হাঁটছে৷
– সামনে এসএসসি পরীক্ষা। আমার কতো পড়া বাকি! সবকিছু আমি জানি, কিন্তু মুখস্ত করা বাকি৷ দিন দুনিয়া ভুলে আমি পড়তে থাকি৷ পরীক্ষার এক মাস আগে স্কুল, প্রাইভেট বন্ধ দেওয়া হলো। আমরা দিনরাত এক করে পড়লাম। টানা এক মাসের যুদ্ধ শেষে সবাই স্বস্তি পেলো। দারুণ পরীক্ষা হয়েছিলো। যেখানে পাশ নিয়ে টানাটানি ছিলো সেখানে এ প্লাস পাওয়ার মতো পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষা শেষে স্যারের সাথে দেখা করতে গেলাম। উনি ভীষণ ব্যস্ত। নতুন ব্যাচে অনেক শিক্ষার্থী। দরজায় দাঁড়িয়ে এক মিনিট কথা বলে ভেতরে চলে গেলেন। আমি ভীড়ের মধ্যে সাধারণ ছাত্রী হয়ে রইলাম। কিন্তু ভাগ্য আমাকে সাধারণ থাকতে দিলো না। পরীক্ষার আমেজ কেটে যেতেই আমার হুশ হলো, কয়েকমাস ধরে পিরিয়ড বন্ধ৷ ভয়ে গলা রোধ হয়ে আসে। কাকে বললো, কি করবো! আমার পাগলপ্রায় দশা। তবুও স্বাভাবিক থেকে বাড়ির কাজ করার চেষ্টা করি। কিন্তু মায়ের চোখ এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব ছিলো। দূরে থেকেও মা তার সন্তানের দিকে নীরবে নজর রাখেন। কিছু একটা হয়েছে মা বুঝে গেলেন। আমাকে চেপে ধরতেই আমিও কেঁদেকেঁটে সবটা বলে দিলাম। সব শুনে মা হতভম্ব। কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে ছিলেন। তারপর প্রচুর মারধর করলেন। সারারাত আমিও কাঁদলাম, মাও কাঁদলো। সাহায্যের জন্য ডাক পরলো আমার ছোট খালার। খালা অনার্স পাশ, শিক্ষিতা, বুদ্ধিমতি। সবশুনে উনার কাছে নিয়ে যেতে চাইলেন। এলাকায় খবর ছড়ালে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তার থেকেও বড় ভয় আমার বাড়িতেই। আমার বাবা। এলাকার পরিচিত মুখ। সকল আলোচনা সমালোচনার আসর তো উনার দোকানেই বসে। সেখানে মেয়ের নামে গালগপ্প শুরু হলে টিকে থাকা দায় হয়ে পরবে। খালার সাথে আসার আগে আমি দিশেহারা হয়ে তার সাথে দেখা করতে গেলাম। টিনের চালা ঘরটাতে অনেক মুখ। এইখানেই এক সকালে ফাঁকা ঘরে আমার কপাল পুড়েছিলো। একবার, দুবার, কতোবার কাছে এসেছি হিসেব নেই। যা একসময় ভালোবাসার ছোঁয়া মনে হতো, ওই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে ছু রির আঘাত মনে হচ্ছিলো। উনি এলেন মুখ ভার করে। একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে সবটা শুনলেন শান্ত মুখে৷ তারপর বললেন, এসব নাকি সাময়িক আবেগ ছিলো। দুজনের প্রয়োজন ছিলো, কাছে এসেছি। প্রয়োজন ফুরিয়েছে এখন নিজের নিজের রাস্তা দেখো। অহেতুক পিছুটান রেখে ঝামেলা বাড়ানোর দরকার নেই৷ আমি ঝামেলা বাড়াতে চাইলে, এর দায় উনি নিবেন না।

আমিও ঝামেলা বাড়াতে চাইনি। চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরে খালার সাথে উনার শ্বশুরবাড়িতে চলে এলাম। খালু নিতান্তই ভদ্র গোছের মানুষ। কোনো প্রশ্ন করলেন না। বউ নিয়ে একলা বাড়িতে থাকেন। অতিথি আসায় খুশি হলেন। খুশি শুধু আমি হতে পারিনি৷ ঘরে নির্জীব পরে থাকতাম। দিন গড়িয়ে মাস গড়ালো। যন্ত্রণা দাঁতে পিষে বন্ধ দরজার আড়ালে একদিন মা হলাম। ঘৃণায় ওর মুখ দেখতে ইচ্ছে করছিলো না। খালা বলেছিলো চুপিসারে গিয়ে অনাথ আশ্রমে দিয়ে আসি৷ আমি যেতে দেইনি। কী দরকার দুনিয়াতে আরেকটা পাপ জিইয়ে রাখার৷ নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি ফিরে পেতেই খালাকে ফাঁকি দিয়ে বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘর ছাড়লাম৷ আলুথালু বেশে বাচ্চা লুকিয়ে হাঁটছি৷ লোকে হয়তো পাগল ভাবছিলো। কৌতুহলী চোখে তাকাচ্ছিলো৷ তীরের মতো এসে বিঁধছিলো ওই নজরগুলো। আমি শুধু একটা নির্জন জায়গা খুঁজছিলাম। এমন এক পড়ন্ত বিকেলে পেয়েও গেলাম মনমতো জায়গা। যেখানে আমার পাপের সমাপ্তি ঘটানো যায়৷ এই যে এখানে, দাফন করে গিয়েছিলাম আমার অতীতকে৷

ভদ্র মহিলার আঙ্গুলের ইশারায় সেদিকে তাকালো নিনাত৷ কোলাহলের বাইরে নির্জন, শান্ত, প্রাচীরঘেরা একটি বাড়ি। লোহার গ্রিল দেওয়া একটি দরজা। ধাক্কা দিলেই খুলে যাবে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর নিনাত জায়গাটিকে চিনতে পারলো। সেই সাথে বাড়িটিকেও৷ আরে এটা তো ওদেরই বাড়ি। চকিতে ঘুরে তাকালো মহিলাটির দিকে। উনার মুখে চওড়া হাসি।

– সেদিন দরজাটা এভাবে বন্ধ ছিলো। আমি একটু ধাক্কা দিতেই হাট করে খুলে গেলো। ঘোরগ্রস্তের মতো সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। বাড়ি পেরিয়ে জঙ্গলের মতো জায়গাটা৷ ওপাশে আরও নির্জনতা। আমার বেশ পছন্দ হলো। গাছগাছালি পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। ঐ শেষ মাথায় একটা পুকুর আছে৷ অযত্নে ফেলে রাখা। তবে পানি ছিলো যথেষ্ট। ওতেই আমার কাজ হয়ে যাবে। বাঁধানো সিঁড়িঘাটে দাঁড়িয়ে দু হাত তুলে পাপের বোঝা ছুঁড়েই মারছিলাম তখন পেছন থেকে একটি আওয়াজ এলো। আমি চমকে ফিরে তাকালাম। মহিলাটি কী যেনো বলছিলো শুনতে পাচ্ছিলাম না। চোখের সামনে পুকুর, আমার গঙ্গাস্নানের বড় তাড়া৷ আবার ছুঁড়ে মারতে যাবো ওমনি কানে এলো,
– ফেলো না। ওকে আমার কাছে দেও।
– কেনো দিবো?
– তুমি তো ফেলেই দিচ্ছিলে!
– অপ্রয়োজনীয় জিনিস।
– ফেলে দিলে নষ্ট হয়ে যাবে। আমাকে দেও আমি যত্ন করে রাখবো।

আমি কিছুতেই দিবো না। ওই মহিলা ছাড়বে না। বড্ড জেদি, একরোখা, কেমন মাতাল, উন্মাদ গোছের মহিলাটি। আমার সাথে অনেকক্ষণ ধস্তাধস্তি করলেন। অযত্নে বড় হওয়া আমার বড় বড় নখে উনার হাত কাটলো৷ চামড়া থেকে রক্ত বের হলো। তবুও থামলেন না। আমি ক্লান্ত হয়ে ছেড়ে দিতেই উনি বুকে আগলে নিলেন। চোখে মুখে সে কি কাঠিন্য! চোখ দিয়ে যেনো ভস্ম করে দিবেন। জোরালো ধমক দিলেন,
– বেরিয়ে যাও। আর কখনো ফিরবে না৷ আমার বাড়িতে পা রাখবে না।

আমি দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এসেছিলাম৷ পেছনে ফেলে এসেছিলাম আমার এক কলঙ্কিত অধ্যায়, আমার মেয়ে।

নিনাতের মনে হলো তার পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে৷ সে তলিয়ে যাচ্ছে মাটির গভীরে। যেখানে অক্সিজেনের বড়ই অভাব। না হলে এমন শ্বাস নিতে কষ্ট হবে কেনো! সামনে দাঁড়ানো মহিলাটির মুখে এখনো চওড়া হাসি। যেনো কোনো যুদ্ধ জয় করে ফিরলেন। নিনাতের চোখের সামনের দৃশ্যগুলো ঝাপসা হয়ে আসছে।
– এবার বুঝতে পারলে তো, গল্পটা শুরু থেকে তোমার মায়ের ছিলো?

ভদ্র মহিলার কথায় নিনাতের খেয়াল হলো, ওর চোখে জল। গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে পরছে৷ ছিঃ ছিঃ ওকি কাঁদছে! তাও আবার এই ভদ্র মহিলার সামনে। ভদ্রমহিলা! ভদ্রমহিলা কাকে বলছে? এ কি ভদ্র নাকি? মহিলা, শুধুই মহিলা। দ্রুত চোখ মুছে নিনাত প্রশ্ন করলো,
– আদেশ অমান্য করে ফিরে এলেন কেনো?
– অমান্য করিনি তো। বাড়িতে প্রবেশ করতে বারণ করেছিলো। করিনি। এখনো বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।
– আমাকে এসব কথা কেনো বলছেন?
– সেবার বাড়ি ফিরে কয়েকমাস পরেই আমার বিয়ে হয়৷ স্বামী একটু বয়স্ক। গ্রামীণ ব্যাংকের ম্যানেজার। এ পাড়া, ও পাড়া ঘুরে ঘুরে সংসার করি। অনেকগুলো বছর বাদে, ভাগ্য আবার এই শহরে নিয়ে এলো। ভাবলাম অতীতের এতো কাছে এসে মুখ ফিরিয়ে না নিয়ে একটু দেখা করে আসি৷
– অতীত ঘাটতে নেই। দূর্গন্ধ ছড়ায়। আপনার ফিরে আসা উচিত হয়নি। আর কখনো আসবেন না।

নিনাত ঘুরে দাঁড়ায়৷ অযথা অনেক সময় ব্যয় করা হয়েছে৷ আর নয়। লোহার গেটে ধাক্কা দিতেই ক্যাচ করে শব্দ হলো।

– তোমার মায়ের নামটাও জানতে চাইবে না?
– আমার মায়ের নাম গুলিস্তা৷ আর সে কেনো উন্মাদ, মাতাল নয়। সে একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ।

পিছু ফিরে দৃঢ় কন্ঠে ঘোষণা দিলো নিনাত। ওর চোখে মুখে রাগী রেহবারের মুখের মতোই কাঠিন্য। হেলে পরা সূর্যের আলোয় মুখটাও গুলিস্তার মুখের মতো লাগছে৷ মহিলাটির মুখে হাসিটা এখন আর দেখা যাচ্ছে না।

চলবে..