হে সখা পর্ব-৫+৬+৭

0
205

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
পঞ্চম পর্ব

রেহবারের বেশিরভাগ সময় বাইরে কেটে যায়। অফিসে কাজের চাপ নেহাৎ কম নয়। গুলিস্তা সারাদিন বাড়িতে একা থাকে। সকালের দিকে ছুটা বুয়া এসে ধোয়া, মুছার কাজ করে দিয়ে যায়। রান্নাটা ও নিজে হাতে করে। আম্বিয়া খাতুন যাওয়ার আগে একটা মোবাইল কিনে দিয়েছিলো। প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে উনার সাথে ভিডিও কলে কিছুক্ষণ কথা হয়। আম্বিয়া খাতুন অতি উৎসাহ নিয়ে ওখানের গল্প করে, গুলিস্তা শুধু শুনে যায়। যেটুকু ওর কাছে জানতে চাওয়া হয় সেটুকুর উত্তর দেওয়ায় কথাবার্তা বেশি দূর আগায় না।
রেহবার ভেবেছিল তার ব্যস্ততা নিয়ে স্ত্রীর থেকে অভিযোগ শুনবে, অভিমানের পর্দা নামবে। কিন্তু সপ্তাহ খানেক পেরিয়ে গেলোও গুলিস্তার স্বাভাবিকতা দেখে রেহবার খানিক অবাক হলো। একদিন রাতে খেতে বসে সে বলল,
– সারাদিন বাড়িতে একা একা থাকতে তোমার খারাপ লাগছে না?

গুলিস্তা খাওয়া থামিয়ে রেহবারের দিকে তাকায়। তার চিরপরিচিত ঠান্ডা কন্ঠস্বরে বলল,
– নাহ। দিন তো কেটেই যাচ্ছে।
– তুমি চাইলে এখানে কলেজে ভর্তি হতে পারো। সময়ও কেটে যাবে, পড়াশোনাও থেমে থাকলো না।
– আর পড়বো না।

গুলিস্তা আবার খাওয়ায় মনোযোগ দেওয়ায় রেহবার আলোচনা থামিয়ে দিতে বাধ্য হলো। আগ্রহ না থাকলে জোর করে তো আর পড়াশোনা করানো যায় না। এই বয়সেই পড়াশোনার প্রতি তিক্ততা রেহবারের ভালো লাগলো না। মেয়েরা বিয়ের পরে পড়াশোনার সুযোগের জন্য কতো যুদ্ধটাই না করে ! এদিকে গুলিস্তার হাতে সুযোগ আসলেও সে এড়িয়ে গেলো। রান্নাবান্না, ঘর গুছানো, বাগান পরিচর্যা করে একটা মানুষ কীভাবে সুখে দিন কাটাতে পারে? রেহবার ভাবলো আর কিছুদিন পর যখন বিরক্ত হয়ে যাবে তখন নিজেই কলেজে ভর্তি হতে চাইবে। তাই আপাতত চুপ থাকাই শ্রেয়।

শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় এইদিনটি রেহবার বাড়িতেই কাটায়। তবে বিয়ের পর দুটো শুক্রবার সে বাড়িতেও থাকলেও ব্যস্ততায় দিন কেটে গেছে। মা ও ভাইয়ের দেশ ছাড়ার কাজে ব্যস্ত থাকায় অফিসের কিছু কাজ জমে গিয়েছিলো। কাজগুলো গুছিয়ে নিতে কয়েকদিন টানা কাজ করার পর অবশেষে বিশ্রাম নেওয়ার সময় পেলো।
সকালে নাস্তার টেবিলে এসে দেখলো ঘিয়ে ভাজা পরোটা ও পায়েস। সাথে ঘন দুধ চা। রেহবার ভীষণ ভোজনরসিক। খেতে ভালোবাসার স্বভাবের কারনে আম্বিয়া খাতুন নিজে হাতে যত্ন করে ছেলের খাওয়ার আয়োজন করতেন। তিনি চলে যাওয়ার পর সেই দায়িত্ব নীরবে কাঁধে তুলে নিয়েছে গুলিস্তা। আম্বিয়া খাতুন যাওয়ার আগে রেহবারের পছন অপছন্দ সম্পর্কে গুলিস্তাকে যথেষ্ট জ্ঞান দান করে গেছেন। খেতে বসে রেহবার বললো,
– তুমি দেখছি প্রতিদিন আমার পছন্দের খাবার রান্না করে যাচ্ছো। পছন্দের খাবার খেতে হয় বিশেষ বিশেষ দিনে। প্রতিদিন খেলে সেগুলো আর বিশেষ পছন্দের থাকে না।

গুলিস্তা মনে হয় ওর মজা করে বলাগুলো সিরিয়াসলি নিয়ে ফেলেছে। বিশেষ মনোযোগ দিয়ে রেহবারের দিকে তাকিয়ে থেকে কি যেনো ভাবলো। তারপর নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করার মতো করে বললো,
– মা যে বললো আপনি এগুলোই খেতে ভালোবাসেন। অন্য কোনো পদের কথা তো আমাকে বলেনি।

রেহবার হেসে সায় জানালো।
– অবশ্যই এগুলো আমি খেতে ভালো বাসি। কিন্তু অন্য কিছু রান্না করলে যে খাই না এমন নয়। আমি খেতে পছন্দ করি। অনেকে আছে একটু বেশি খেলেই মোটা হয়ে যায়। কিন্তু আমি যতো খাই না কেনো শরীরে কোনো প্রভাবে পরে না। তাই বোনাস হিসেবে যা ইচ্ছে খেতে পারি। তুমি তোমার পছন্দ মতো যেকোনো কিছু রান্না করে দিলেও আমি তৃপ্তিসহ খেয়ে নিবো।

গুলিস্তাকে মনে হয় কেউ অথৈ জলে ফেলে দিয়েছে এমন মুখখানা করে সে চুপচাপ নাস্তা খেতে লাগলো। রেহবার ভেবেছিলো গুলিস্তা কিছু বলবে। কিন্তু মেয়েটা প্রতিবার ওকে নিরাশ করে দিয়ে চুপ হয়ে যায়। বাড়িতে সারাদিন চুপচাপ থাকে। সারাদিন পর রেহবার অফিস থেকে ফিরলে নীরবে, নির্লিপ্তভাবে ওর জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আসবে। কাপড়চোপড়, জুতোজোড়া, ব্যাগপত্র গুছিয়ে রাখবে। রেহবার ফ্রেশ হয়ে বের হতে হতে এক কাপ ব্ল্যাক কফি দিয়ে আবার ছুটে যায় রান্নাঘরে। একাই নিস্তদ্ধ ঘরে ভূতের মতো পায়েচারী করে রেহবার। এই সময়টুকু তার মা ও ভাইয়ের কথা ভীষন মনে পরে। এখানে যখন সন্ধ্যা, ফ্লোরিডায় তখন সকালের অনেকটা পেরিয়ে গেছে। স্টাডি রুমে বসে মা ও ভাইয়ের সাথে ভিডিও কলে কথা বলে সময় কাটিয়ে দেয়। রান্না শেষে গুলিস্তা দরজায় নক করে রুমে উঁকি দিয়ে বলে, ডিনার রেডি।
রেহবার মাঝেমধ্যে ভাবে একটা মানুষ কীভাবে এতো চুপচাপ থাকে। এই বয়সে মেয়েরা ভীষণ চঞ্চল হয়। প্রজাপতির মতো ছুটে বেড়ায় । ঝর্ণার মতো কলকল করে কথা বলে। বায়না ধরে, আবদার করে। অথচ গুলিস্তা শান্ত নদীর মতো। রেহবার ইচ্ছে করে সেখানে ঢিল ছুড়ে দেখেছে। আলোড়োন সৃষ্টি হলেও তা ক্ষনস্থায়ী। কিছু সময় পর শান্ত নদী নিজের রুপে ফিরে যায়। যেনো কিছুই হয়নি।

ছুটা বুয়া আসায় গুলিস্তা তাকে কাজ বুঝিয়ে দিতে চলে গেলো। রেহবারের ভালো লাগছিলো না। কাজের ব্যস্ততাই মনে হয় ভালো ছিলো। সময়টুকু কেটে যেতো। বিয়ের পর পুরুষ মানুষেরা কাজ শেষ করে দ্রুত বাড়ি ফিরতে চায়। নারী হচ্ছে একটি বিস্ময়কর ধাঁধাঁ। সেই বিস্ময়কে জানার প্রচেষ্টা করে। নারী দেহের বাঁকে, মনের অন্তরালে লুকানো রহস্য উদঘাটনের উত্তেজনায় সারাক্ষণ মন আনচান করে। অথচ রেহবারের ক্ষেত্রে ঘটছে বিপরীত ঘটনা। বিয়ের আগেই বরং জীবনে রোমাঞ্চকতা ছিল।
সময় কাটাতে বাড়ির বাইরে এসে খানিক হাটাহাটি করছিলো গুলিস্তা এসে সামনে দাঁড়ালো। ওর প্রতিমা গড়ন মুখশ্রী হাসির দাবিবার। অথচ সেখানে সারাক্ষণ মেঘমেদুরের আনাগোনা দেখে রেহবারের ভীষন ইচ্ছে করে, ওকে কাছে টেনে আলতো করে ছুঁয়ে জিজ্ঞাসা করতে,
তোমার কি খুব মন খারাপ করেছে, ফুল?

কিন্তু বলা হয়ে উঠে না। গুলিস্তার এমন নির্লিপ্ততা নতুন তো নয়। সেই শুরু থেকে এমনই দেখে এসেছে। এই মুখশ্রীতে রোদ্দুরের মতো ঝলমলে হাসি দেখলে বরং আশ্চর্য হওয়া যায়। ভাবনাকে একপাশে রেখে রেহবার জানতে চাইলো,
– কিছু বলবে?
– দুপুরের জন্য কি রাঁধবো?

মেয়েটার ভালো স্বভাবের মধ্যে একটি হচ্ছে, সে সবসময় চোখে চোখ রেখে কথা বলে। কোনো লুকোচুপি নেই। এখনো সরাসরি রেহবারের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। রেহবার চোখ সরিয়ে নিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বললো,
– রান্না বিষয়ে আমি কিছু জানি না, ফুল। তোমার যা ভালো লাগে রান্না করো।

গুলিস্তা কোনো উত্তর দিলো না। ওকে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রেহবার বললো,
– আর কিছু বলবে?

গুলিস্তা মাথা নেড়ে না জানিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলো। তা দেখে রেহবারের ভীষণ মেজাজ খারাপ হলো। ইচ্ছে করলো বরফ কঠিন মেয়েটার রাস্তা আটকে বলতে, কেনো কিছু বলবে না তুমি? কিছু বলো। প্রয়োজনীয় কথাবার্তার দরকার নেই। অপ্রয়োজনীয় হলেও কথা বলো। আমার এই নীরবতা ভালো লাগছে না।

কিন্তু বলা হয়ে উঠে না। বাবার নিজে হাতে লাগানো বাগানে হাটাহাটি করলে রেহবারের মন ভালো হয়ে যায়। বনজ, ফলজ, ঔষধি গাছ দিয়ে ভরা বাগানের প্রতিটি গাছে হাত বুলিয়ে রেহবার বাবার কবরের পাশে এসে দাঁড়ালো। বাবার মৃত্যুর শোক সামলে উঠেছে অনেক বছর হলো। এখন বাবা ছাড়া অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মানুষ্য জাতিকে আল্লাহ শোক সামলানোর অদ্ভুদ ক্ষমতা দিয়েছেন। যাকে ছাড়া এক মুহুর্ত টিকে থাকা সম্ভব হতো না, যাকে ছাড়া নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। তার মৃত্যুর পর আমরা আশ্চর্যজনক ভাবে বেঁচে থাকি। একসময় ভালো থাকতেও শিখে যাই। তবুও হঠাৎ কোনো দুর্বল মুহুর্তে বাবাকে ভীষন মনে পরে রেহবারের। তখন এখানে এসে দাঁড়ালে মন ভালো হয়ে যায়। মনে হয় এইতো বাবা আছে। এখানেই আছে।
মাথার উপরে দাপুটে সূর্যটা খাড়াভাবে রোদ ছড়িয়ে দেওয়া শুরু করেছে। খোলা আকাশের নিচে থাকা সম্ভব হলো না। দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতরে আসতেই তার পা থমকে গেলো।

গুলিস্তা বসে আছে ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারে। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কাজের মেয়ে মালা। দৃশ্যটা অস্বাভাবিক নয়, তবুও রেহবারের কাছে অদ্ভুত ঠেকলো। সে দ্রুত এগিয়ে এসে বললো,
– কি হয়েছে?

প্রশ্নটা গুলিস্তার উদ্দ্যেশে করলেও উত্তর দিলো মালা। মেয়েটা কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল,
– দেহেন না ভাইজান, ভাবী সেই বেলা থাইকা এমনে বইসা রইছে।

উগ্রীব রেহবার গুলিস্তার পাশের চেয়ারে বসে ওর গালে হাতে হাত রেখে জানতে চাইলে,
– কী হয়েছে ফুল?

গুলিস্তা এতোক্ষণ মাথা নিচু করে টেবিলের উপর হাত দুটো রেখে বসে ছিলো। এতোক্ষণে রেহবারের দিকে তাকালো কিন্তু কিছু বললো না। মালা আবার বলে উঠলো,
– কি রানবে জিগাইলাম। কয় এখনো ঠিক করে নাই। তরকারী কাইটা দিয়া যাইতে হইবো। ভাবী তহন থাইকা যে ভাবতাছে এহনো কিছু কইলো না। সেই থাইকা খাড়ায় রইছি।
এতোক্ষণে গুলিস্তা মুখ খুললো,
– কি রান্না করবো বুঝতেছি না।

গুলিস্তার স্বাভাবিক কন্ঠ শুনে রেহবার অবাক হলো না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, সাড়ে বারোটা পার হয়ে গেছে। মালাকে চলে যেতে বলে, গুলিস্তাকে বললো,
– কি রাধবে সেই মেনু ঠিক করতে এতোক্ষণ ভাবার কি আছে ফুল? ঘরে যা আছে সেগুলো দিয়ে কিছু একটা রান্না করে নিলেই হতো।
– ঘরে সব আছে।
– তাহলে এতো ভাবার কি আছে?
– আপনি যে বললেন, পছন্দের বাইরে কিছু রাঁধতে। আপনার পছন্দের মেনুগুলোই মা বলে গেছেন।

রেহবার খেয়াল করলো, আম্বিয়া খাতুন যাওয়ার পর গুলিস্তা রেহবারের পছন্দের মেনুগুলোই ঘুরে ফিরে রান্না করেছে। হয়তো রান্না পারে না। মায়ের কাছে যেটুকু শিখেছে তাই দিয়েই কাজ চালিয়েছে।
– তুমি অন্যকিছু রান্না করতে পারো না?
– পারি।
– তাহলে এতো ভাবার কি আছে!
– কোনটা রাঁধবো সেটা সিলেক্ট করতে পারছি না।

রেহবার হতাশ হয়ে বললো
– যেকোনো একটা রান্না করলেই হয়ে যেতো। এখন আর রান্না করা লাগবে না। চলো বাইরে থেকে খেয়ে আসি। বিয়ের পরে কাজের চাপে তোমাকে নিয়ে বাইরে যাওয়া হয়ে উঠেনি। এই সুযোগে ঘুরে আসা যাবে।

(চলবে)

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
ষষ্ঠ পর্ব

(১৬+ সতর্কতা)

হালকা নীলচে আলোয় ঘরের চেনার পরিবেশ রহস্যময় হয়ে উঠে। এই আলো আধারীতে রেহবারের ঘুম ভালো হয়। সে ছোটবেলা থেকেই একদম অন্ধকারে ঘুমাতে পারতো না। ঘরে আলো জ্বেলে ঘুমাতো। ও ঘুমিয়ে গেলে আম্বিয়া খাতুন ছেলের ঘরে এসে আলো নিভিয়ে দিয়ে যেতো। রেহবার এখন বড় হয়েছে, আম্বিয়া খাতুনেরও বয়স হয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে উঠানামা খুব কম করেন। তাছাড়া রেহবারের বাড়ি ফেরার নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। কখনো বাড়ি ফিরতে ফিরতে মাঝ রাত হয়ে যায়। এখন সে ডীম লাইটের আলো জ্বালিয়ে রাখে সারারাত।

গভীর রাতে হঠাৎ করে রেহবারের ঘুম হালকা হয়ে গেলো। পাশ ফিরে শুতে গিয়ে দেখলো গুলিস্তা বিছানায় নেই। প্রথমে ভাবলো হয়তো ওয়াশরুমে গিয়েছে। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করেও ঘুম এলো না। মনের মধ্যে খচখচ করছে। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করার পর আবার চোখ খুলে নীলচে আলোয় ঘরের চর্তুদিকে নজর বুলিয়ে নিলো। গুলিস্তাকে ঘরের কোথাও দেখতে না পেয়ে উঠে বসলো। না চাইতেও মনের মধ্যে সন্দেহ ঘুরাঘুরি করছে। কিছুটা একটা ঠিক নেই, এই ভাবনা থেকেই আজকাল রেহবার সতর্ক চোখে সবকিছু নিরীক্ষণ করে।

বেড টেবিলের উপর গুলিস্তার মোবাইল রাখা। ওয়াশরুম চেক করে সেখানেও গুলিস্তাকে পাওয়া গেলো না। বাইরে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। হলরুমে দেখবে ভেবে ঘর ছেড়ে বের হতে গিয়ে কী যেনো মনে করে ব্যালকনির দিকে এগিয়ে গেলো। ব্যালকনির দরজা খুলতেই ঘরের হালকা নীল আলোয় অন্ধকার কেটে গুলিস্তার অবয়ব ভেসে উঠলো। গ্রীল ধরে এপাশে পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি আকাশের ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের দিকে। রেহবার সাবধানে গিয়ে ওর পাশে দাঁড়ালো। হঠাৎ কারো উপস্থিতিতে ভয় পেতে পারে ভেবে ধীর কন্ঠে ডাকলো,
– ফুল?

গুলিস্তা ভয় পেলো না। বরং স্বাভাবিক ভাবেই পাশ ফিরে তাকালো। ততোক্ষণে ব্যালকনির দরজা বন্ধ হয়ে চারদিক অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। মৃদু চাঁদের আলোয় আবছা অবয়ব ছায়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবুও ওরা একে অপরের দিকে চেয়ে রইলো।
– তুমি এখানে কি করছো?
– ঘুম আসছে না।
– আমাকে ডাকতে। এভাবে একা একা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকতে ভয় লাগছে না?
– আমার অন্ধকার ভালো লাগে।
– অদ্ভুত! তোমাকে আমি মাঝেমধ্যে বুঝতেই পারি না।

আজকাল রেহবারের দিন কাটে কাজে কর্মে আর বিশ্রাম নিয়ে। গভীর ঘুমের পর জেগে যাওয়ার কারনে এতোক্ষণে ঘুম কেটে গেছে। শরীর ও মনে ফুরফুরে ভাব। গভীর রাতে জীবন সঙ্গীর সাথে কিছু মুহুর্ত কাটানো মন্দ বলে মনে হচ্ছে না। রেহবার এক হাতে গুলিস্তাকে নিজের কাছে টেনে নিলো। গুলিস্তা প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি ছুড়ে দিলো ওর দিকে। সে দৃষ্টি উপেক্ষা করে রেহবার খোলা আকাশে তাকিয়ে বাহানা খুঁজে যাচ্ছে মন ভালো করার। মাথার উপরে খোলা আকাশ, তাতে তারার মতো উজ্জ্বল এক ফালি চাঁদ। চারদিকে নিস্তবদ্ধতা, বুকের সাথে লেপ্টে থাকা প্রিয়তমা স্ত্রী। মনে জমে থাকা অবান্তর মেঘগুলো উড়ে যেতে বেশি সময় লাগলো না। পরিষ্কার আকাশে কোথা থেকে মেঘ এসে খালিক পর পর চাঁদকে ঢেকে দিচ্ছে। তারপর ধীরে ধীরে চাঁদকে ছেড়ে চলেও যাচ্ছে। মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলায় চাঁদের আলো একেক সময় একেক ধাঁচের আলো বিলিয়ে দিচ্ছে ধরণীর বুকে। রেহবার দু হাতে শক্ত করে আগলে নিলো অদ্ভুত আচরণের মেয়েটিকে।

যেতে যেতে সময় অনেকখানি চলে গেছে। খানিকবাদেই চারপাশে আলো ফুটতে শুরু করবে। রেহবার গুলিস্তার মাথায় থুতনি ঠেকিয়ে শুধালো,
– ঘুম আসছে না এখনো?

মিথ্যা বলা গুলিস্তার কর্ম নয়। সে স্বল্প শব্দে উত্তর দিলো,
– উহু।

ভোরের আগমনের শুরুতে জেগে উঠা শরীরে সাথে তাল মিলিয়ে রেহবারের ঠোঁটে ফুটলো দূর্বদ্ধ হাসি। গুলিস্তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,
– রুমে চলো। তোমার ঘুমের ব্যবস্থা আমি করতেছি।

অবুঝ গুলিস্তা রেহবারের কথার অর্থ বুঝতে না পেরে তার দিকে তাকাতেই যাচ্ছিলো। কিন্তু ওকে সেই সুযোগ না দিয়ে রেহবার ওকে পাঁজাকোলে তুলে রুমে এনে বিছানায় শুইয়ে দিলো। বেড সাইডে টেবিল ল্যাম্প অন করে দিয়ে রেহবার গভীর দৃষ্টি দিলো গুলিস্তার স্নিগ্ধ মুখশ্রীতে। গুলিস্তা ততোক্ষণে আলতো করে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলেছে। রেহবার তার সম্মোহন কন্ঠে ডাকলো,
– ফুল, চোখ খোলো। তাকাও।

রেহবারের সম্মোহন বোধ হয় ঠিকঠাক কাজ করতে না পেরে বিফলে গেলো। গুলিস্তা উল্টো চোখদুটো শক্ত করে বন্ধ করে নিয়েছে। রেহবার ওর গালে আলতো করে এক হাতে ছুঁয়ে আবার ডাকলো,
– তাকাও প্লিজ।

গুলিস্তা পিটপিট করে চাইলো। একহাতে ভর দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে রেহবার। কালো চোখের মনি দুটিতে কামনার আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। কালো রং আরও কুচকুচে কালো দেখাচ্ছে। সেই চোখে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। তবুও স্বামীর অনুরোধের কারনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকা। রেহবারের তৃষ্ণার্ত ঠোঁট জোড়া গুলিস্তার শুষ্ক ঠোঁটে নেমে আসতেই সে আবারও চোখ বুজে নিলো। রেহবার আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে সে দৃশ্য দেখে হেসে ফেললো। ঠোঁট ছোঁয়ালো বুজে থাকা চোখ জোড়ায়। হাতের আঙ্গুলগুলো দক্ষ বাদকের মতোন পিয়ানোর কী প্যাডে মৃদু সংগীত সৃষ্টির মতোই নেচে উঠলো গুলিস্তার অনাবৃত শরীর জুড়ে। রেহবারের ঠোঁটের ছোঁয়া সমস্ত মুখশ্রীতে নিজের ছাপ ফেলে ক্রমশ নিচে নেমে আসতে শুরু করেছে। গ্রীবাদেশ ছুঁয়ে আরোও নিচে নামতেই আলতো ছোঁয়া আগ্রাসী হয়ে উঠলো। এতোক্ষণ নিশ্চল শুয়ে থাকা গুলিস্তা খানিকটা নড়েচড়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রেহবারকে। গুলিস্তার ছোঁয়া পেয়ে রেহবার নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলো না। বাইরে তখন নিশির বুক চিরে প্রভাতের আগমন ঘটেছে। ক্লান্ত রেহবার গুলিস্তার গ্রীবাদেশে ডুবিয়ে রাখা মুখটি তুলে গুলিস্তার দিকে তাকালো। মেয়েটা এখনো চোখ বন্ধ করে আছে। ওর মায়াময় মুখটা এলোমেলো চুলে ঢেকে আছে। এক হাতে যত্ন সহকারে চুলগুলো সরিয়ে গুলিস্তার শান্ত মুখের দিকে চেয়ে আরেকবার বন্ধ চোখের পাতায় চুমু খেলো।

সকালে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে দেখলো গুলিস্তা কিচেনে দাঁড়িয়ে রান্না করছে। কাজের মেয়েটা বোধ হয় আজকে আসেনি। ফাঁকিবাজ মেয়ে প্রায় এমন করে। গুলিস্তা একা হাতে সবটা সামলে নেয়। এ নিয়ে কখনোই কাজের মেয়েটাকে একটা প্রশ্ন অব্দি করে না। রেহবার ভেবেছিলো শুধু ওর বিষয়ে গুলিস্তার কোনো আগ্রহ নেই, অভিযোগ নেই। কিন্তু এখন বুঝতে পেরেছে, কোনো কিছু নিয়েই গুলিস্তার কোনো মাথা ব্যথা নেই। সে তার মত কাজ করে, খায় দায়, নিজের মতো সময় কাটায়। অন্য কেউ হলে হয়ত এমন বউ পেয়ে খুশি হতো। কিন্তু রেহবার খুশি হতে পারেনা। ওর মনে হয় একজন রোবটের সাথে সংসার করছে।

সকালবেলা এলোমেলো চিন্তার ঝুলি নিয়ে বসতে চায় না। তাই সেসব চিন্তা দূরে ঠেলে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালো। গুলিস্তা আজকেও শাড়ি পরেছে। বিয়ের পর থেকেই নিয়মিত শাড়ি পরে। প্রথম কয়েকদিন আম্বিয়া খাতুন সালোয়ার কামিজ পরিয়ে ছিলেন। উনি চলে যাওয়ার পর থেকে সেই যে শাড়ি পরা শুরু করেছে, আর সালোয়ার কামিজের ধারের কাছে যায়নি। প্রথম কয়েকদিন শাড়িতে এলোমেলো করে চলাফেরা করলেও দ্রুত মানিয়ে নিয়েছে। রেহবার খেয়াল করেছে গুলিস্তার ব্রেন ভীষণ শার্প এবং সে একজন কুইক লার্নার।

ভেজা চুলগুলো ঢিলা খোপা করায় পিঠের উপর হেলে পরেছে। রেহবার পেছনে দাঁড়িয়ে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে গালে আলতো করে চুমু দিলো। গুলিস্তা চুলায় প্যানকেক বানাচ্ছিলো। রেহবারকে দেখে প্যানকেকের প্লেট হাতে নিয়ে বললো,
– নাস্তা তৈরী হয়ে গেছে। এক্ষুনি টেবিলে দিয়ে দিচ্ছি।

রেহবার ওকে নিজের দিকে টেনে আরেকটু ঘনিষ্ট ভাবে জড়িয়ে ধরে বললো,
– স্বামী চুমু দিলে নাস্তা অফার করতে হয় না, ফুল। একটা চুমুর বিপরীতে দুটো চুমু ফিরিয়ে দিতে হয়।

গুলিস্তা প্যানকেকের প্লেট হাতে নিয়ে পেছন ফিরে রেহবারের দু গালে দুটো চুমু দিলো। রেহবার অবাক হয়ে চোখ বড় করে চেয়ে রইলো। বিস্ময়ে গুলিস্তার কোমড় জড়িয়ে ধরা হাত দুটো ছুটে গেছে। ওকে ওভাবে রেখে গুলিস্তা স্বাভাবিক ভাবেই কিচেন থেকে বেরিয়ে ডাইনিং সাজাতে লাগলো। তা দেখে সুবোধ বালকের মতো সেও গুটিগুটি পায়ে এসে ডাইনিং টেবিলে নাস্তা করতে বসলো। আজকেও গুলিস্তা রেহবারের পছন্দের ব্রেকফাস্ট তৈরী করেছে। মেয়েটার কি নিজের পছন্দের কোনো খাবার নেই? সবসময় রেহবারের পছন্দকে প্রায়োরিটি দিচ্ছে। ওর মতামত ব্যতীত কিছু করে না। নিজের কোনো ইচ্ছা ব্যক্ত করে না। এমন কেনো? শুধু কি সম্মান, ভালোবাসা থেকেই। নাকি ওর পরিবারকে থেকে ওকে এমন করতে বলা হয়েছে? বিয়ের পর মায়েরা মেয়েকে সংসার করার বিভিন্ন টিপস দিয়ে থাকে। আর মেয়েরা সংসার বিষয়ে আনাড়ি থাকায় মায়ের দেখানো পথ অন্ধের মতো অনুসরণ করে যায়। গুলিস্তার ক্ষেত্রেও কি ব্যাপারটি সেরকম কিছু? কিন্তু এই অতিরিক্ত পতি ভক্তি রেহবারের সহ্য হচ্ছে না।
(চলবে…)

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
সপ্তম পর্ব

রেহবারদের বাড়ি হতে খানিকটা দূরে একটি সুপারশপ আছে। বাজারসদাই করতে গুলিস্তাকে বেশিদূর যেতে হয়না।
আলমারির একটি ড্রয়ারে রেহবার নিত্যদিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করার জন্য এবং গুলিস্তার নিজস্ব প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট ক্যাশ রেখে দেয়। অন্যদিন গুলিস্তা মালাকে সাথে নিয়ে কেনাকাটা করে নিয়ে আসে। আজকে রেহবার বাড়িতেই আছে। মালাও কাজে আসেনি। এদিকে সবজি শেষ হয়ে গেছে। হলরুমে বসে রেহবার ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছিলো। স্টাডিরুমে বসে কাজ করতে পারতো কিন্তু নিচে কিচেনে গুলিস্তা একা একা কাজ করবে তাই ওকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য এখানে বসেই কাজ করছে। যদিও দুজনে নীরবে নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে। শুধু মাঝেমধ্যে রেহবারের অবাধ্য চোখ গুলিস্তার দিকে চলে যাচ্ছে। ভেজা চুলগুলো এখন পিঠে ছড়িয়ে দেওয়া। বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে থালা বাসন ধুচ্ছে। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। খানিক বাদে গুলিস্তা এলো এক কাপ ব্ল্যাক কফি হাতে। টেবিলের উপর না রেখে হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য সময় হলে ভীষণ ধীরে শব্দ না করে টেবিলের উপর রেখে চলে যেতো। যাতে রেহবারের কাজে ডিস্টার্ব না হয়। ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রেহবার বুঝে নিলো, ও কিছু বলতে চায়। এমন ছোটখাটো অব্যক্ত ভাষা, নীরব ইশারা সে বুঝতে শিখে গেছে কয়েক মাসের সাংসারিক জীবনে। ল্যাপট্যাপ হতে চোখ সরিয়ে হাত বাড়িয়ে কফি নিতে নিতে বললো,
– কিছু বলবে?

সামান্য সময় ব্যয় না করে গুলিস্তা উত্তর দিলো,
– সবজি শেষ হয়েছে। সুপারশপে যেতে হবে। আপনি কিছুক্ষন একা থাকতে পারবেন না?

কফির কাপে চুমুক দিয়ে রেহবার নিজের হাসি আটকালো। সে কি ছোট বাচ্চা যে নিজের বাড়িতে একা থাকতে ভয় পাবে?
– সেকি! আমি একা থাকবো মানে? একা থাকতে ভয় লাগবে। আমাকেও সাথে নিয়ে চলো প্লিজ।

রেহবারের নাটকীয় ভঙ্গিতে বলা কথাগুলো শুনে গুলিস্তা অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। ওর তাকানো দেখে রেহবার আর হাসি চেপে রাখতে পারলো না। হো হো করে ঘর ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো। গুলিস্তার হাত ধরে সোফায় বসিয়ে দিয়ে হাতের কফির কাপটা ওর হাতে ধরিয়ে দিলো।
– তুমি এখানে বসে কফি খাও। আমি চট করে রেডী হয়ে আসি।

সাদা টি শার্টের উপর গ্রে কালারের শার্ট চাপাতে গিয়ে রেহবারের মনে হলো, ও ব্ল্যাক কফি খেতে পারে তো? খেতে বললাম দেখে চোখ মুখ শক্ত করে ওই অখাদ্য গলাধঃকরণ করছে না তো?
ঝটপট রেডি হয়ে নিচে এসে দেখলো, মুখটা বাংলা পাঁচের মতো বাঁকিয়ে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে গুলিস্তা। তারপর চোখ মুখ খিঁচিয়ে সেই কফিটুকু গিলে ফেলছে। রেহবার দ্রুত ওর হাত থেকে মগটি নিয়ে বাকি কফিটুকু একবারে খেয়ে নিলো।

বহুতল ভবন বিশিষ্ট শপিংমলটির নিচতলায় সুপারশপ। ক্রেতারা ভারী পণ্য যাতে সহজেই বহন করতে পারে তাই নিচতলার পুরোটা জুড়ে বিভিন্ন সেকশনে কাঁচা বাজার, গ্রোসারি, বেবি ফুড, ক্রোকারিজ, ফাস্টফুড, স্পাইসেস, ড্রিংকস, ফ্রোজেন ফুড, ফ্রুটস, মাছ-মাংস ইত্যাদি রাখা হয়েছে। আন্ডার গ্রাউন্ডে পার্কিং এর ব্যবস্থা রয়েছে। রেহবার সেখানে কার পার্ক করে গুলিস্তার হাত ধরে সুপারশপে ঢুকলো। ভেতরে ঢুকে গুলিস্তা অন্য কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা কাঁচা বাজারের সেকশনে গিয়ে প্রয়োজনীয় সবজি নিতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। চর্তুরদিকে এতো এতো লোভনীয় খাবার দেখে রেহবারের জিভে জল চলে আসার উপক্রম অথচ তার স্ত্রী সেদিকে ফিরেও তাকালো না। রেহবারের ভীষণ লজ্জা পাওয়া উচিত। কিছুক্ষণের মধ্যে গুলিস্তা ফিরে এলো কয়েকটা ক্যাপসিকাম, রেড ক্যাবেজ, টমেটো নিয়ে। স্যালাড তৈরি করার জন্য এসবের নিত্য ব্যবহার করা হয়। নিত্যদিনের খাবার মেনুতে হাঁপিয়ে উঠেছিলো রেহবার। হঠাৎ করে মাথায় একটা আইডিয়া এলো। সে সামনে থেকে একটি কার্ট ট্রলি এনে গুলিস্তার হাত থেকে সবজিগুলো নিয়ে সেখানে রাখলো। গুলিস্তাকে বললো,
– ড্রয়িং রুমের জানালার পর্দাগুলোর রং ফিকে হয়ে গেছে। সুপারশপে অপরপাশে দেখো একটা শপ আছে। ওখানে কার্টেইনস পাবে।

পকেট থেকে ক্রেডিট কার্ড বের করে ওর হাতে দিয়ে বললো,
– এখানে আমার কিছু কেনাকাটা আছে। এই ফাঁকে তুমি জানালার জন্য কার্টেইন নিয়ে এসো।

গুলিস্তা একবার রেহবারের হাতে থাকা কার্ডের দিকে তাকাচ্ছে আর একবার রেহবারের মুখের দিকে। দ্বিধা দ্বন্দ শেষে কার্ডটি হাতে নিয়ে বললো,
– আমি কিনবো?
– হ্যাঁ। তুমি কিনবে। খুঁজে না পেলে সেলসম্যানকে বললেই হেল্প করবে। তাড়াতাড়ি যাও।

রেহবার একপ্রকার ঠেলে গুলিস্তাকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে ছুটলো কেনাকাটার উদ্দেশ্যে। ব্রকোলি, বিনস্, গাজর, মটরশুঁটি, চিংড়ি মাছ, মুরগির মাংস কিনতেই অনেকখানি সময় কেটে গেলো। এর মাঝে গুলিস্তা ফিরে এলে শুকনো মুখ করে। যেনো তার উপর দিয়ে টর্নেডো বয়ে গেছে। আইসক্রিম কর্ণার থেকে রেহবার দুটো কোন আইসক্রিম কিনে বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে।

বাড়ি ফিরে শপিংব্যাগ হতে কার্টেইনস বের করে রেহবারের চক্ষু চড়াক গাছ। ড্রয়িংরুমের জানালায় সাদা রঙের দুটো কার্টেইনস ঝুলানো ছিলো। সাদা কাগড়ের উপর অফ হোয়াইট রঙের কিছু পানপাতার নকশা ছিলো। গুলিস্তা যে দুটো কার্টেইনস নিয়ে এসেছে সেই দুটো হুবহু আগের কার্টেইনস এর মতোই। সে মূলত আগের কার্টেইনস এর নতুন এক জোড়া কিনে নিয়ে এসেছে। তাহলে নতুন কার্টেইনস এর দরকারই কি ছিলো! রেহবার তার বিগড়ে যাওয়া মেজাজকে বিড়বিড়কে বললো, কুল ডাউন। কুল ডাউন।

কার্টেইনস একপাশে সরিয়ে রেখে বলল,
– এগুলো এখন রাখো। জানালা অনেক উঁচুতে। আমি রাতে এসে সেট করে দিবো। তুমি পারবে না।

গুলিস্তা বাধ্য মেয়ের মতো সেগুলো গুছিয়ে বেড রুমের আলমারিতে তুলে রাখতে গেলো। এই ফাঁকে রেহবার গ্রোসারি নিয়ে কিচেনে গেলো। ফ্রিজ থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বের করে একে একে সবকিছু গুছিয়ে নিলো।
গুলিস্তা ফিরে এসে কিচেনের যেতে গিয়ে থমকে গেলো। কিচেন এপ্রোন পরে রেহবার দক্ষ রাঁধুনির মতো পেয়াজ কাটছে। গুলিস্তা দ্রুত পায়ে কিচেনে এসে দেখলো সেখানে এলাহি কান্ড কারখানা চলছে। পুরো কিচেন জুড়ে বিভিন্ন ইনগ্রিডিয়েন্ট সারিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এই সামান্য সময়ে রেহবার এতো কিছু গুছিয়ে নিয়েছে দেখে গুলিস্তা অবাক হলেও স্বাভাবিকভাবেই জানতে চাইলো,
– আপনি এখানে?

এর মধ্যে চুলায় বসানো পানি গরম হয়ে গিয়েছে। টগবগ করে ফুটতে থাকা গরম পানিতে বাসমতি চাল ছড়িয়ে দিয়ে রেহবার বললো,
– আজকে স্পেশাল শেফ এর হাতে রান্না খাওয়ানো হবে তোমাকে।

অন্য কেউ হলে নিশ্চিয়ই বলতো, রান্না খাওয়ার যোগ্য হবে তো? কিন্তু গুলিস্তা বিচলিত হলো না। শুধু এগিয়ে এসে নাইফ হাতে নিয়ে বললো,
– আমি কেটে দিচ্ছি।

রেহবার ওর হাত থেকে নাইফটি বেশ সাবধানে ছাড়িয়ে নিয়ে সবজির ঝুড়িটি হাতে ধরিয়ে দিলো।
– রান্নায় কোনো বিঘ্ন ঘটানো যাবে না। এদিকটা আমি সামলে নিচ্ছি। তুমি বরং সবজিগুলো ধুয়ে এনে দেও।

সবজি ধুয়ে নিয়ে এসে রেহবারের হাতে তুলে দিতেই রেহবার গুলিস্তাকে টুলে বসিয়ে দিলো বললো,
– তুমি এখানে বসে আমাকে কোম্পানি দেও। সেই সাথে এই মটরশুঁটির খোসা ছড়িয়ে দেও।

খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে গুলিস্তা রেহবারকে পর্যবেক্ষণ করছিলো। তখন টগবগে গরম পানিতে চাল দেওয়ার সময় সে খেয়াল করেছে রেহবার বেশ সুনিঁপুণ ভাবেই গরম পানিতে চাল ছড়িয়ে দিচ্ছিলো। যেনো সে এসবে অভ্যস্ত। এখন সবজিগুলো কাটছে দক্ষ হাতে। আরেকপাশে চিকেন মেরিনেট করে নিয়েছে। সেটা ফ্রিজে তুলে রাখলো।
নিস্তবদ্ধতা রেহবারের পছন্দ নয়। নিঃশ্বাসের শব্দও যেনো কানে বাজে। গুলিস্তা তো কিছু বলবে না। কৌতুহল হলেও জানতে চাইবে না। রেহবারের প্রতি আদোও তার কৌতুহল সৃষ্টি হয় কিনা সে জানে না। তাই নিজেই বলা শুরু করলো,
– ছোটবেলা থেকে রাহিল আর আমি ভীষণ মা ভক্ত ছিলাম। আমাদের বাইরে তেমন কোনো বন্ধু-বান্ধব তৈরি হয়নি। স্কুল ছুটি হতেই দৌড়ে বাড়ি চলে আসতাম। মা সংসারী মানুষ, দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে রান্নাঘরে । মায়ের সাথে আমাদের দুই ভাইয়েরও অনেকটা সময় এই রান্নাঘরেই কেটে গেছে। যখন ছোট ছিলাম, তখন মায়ের পাশে এমন করে টুলে বসে থাকতাম। মা নানান গল্প বলতো, আর আমরা দু ভাই মায়ের গল্প শুনতাম আর রান্না দেখতাম। এই ফুল, তুমি গল্প জানো?

গুলিস্তা মনোযোগ দিয়ে রেহবারের কথা শুনছিলো আর রেহবার কীভাবে চিকন করে এক সাইজে বিনস্ কাটছে সেটাই দেখছিলো। হঠাৎ করে ওর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে রেহবার যখন ওর দিকে তাকালো, গুলিস্তা খানিকটা হকচকিয়ে গিয়ে বললো,
– গল্প! না, জানি না।

রেহবার আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিয়ে বললো,
– যা ভেবেছিলাম। তো আমি কি যেনো বলছিলাম?
– টুলে বসে থেকে গল্প শুনতেন আর রান্না দেখতেন।

গুলিস্তা মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছে দেখে রেহবার পুলকিত হলো। বক্তা হিসেবে আনাড়ি হলেও গুলিস্তা শ্রোতা হিসেবে ভীষণ ভালো। সে গল্পে ফিরে গিয়ে বলতে লাগলো,
– ছোটবেলায় তো এসব ধারালো ছু*রি, চা*কু হাতে নেওয়া বারণ ছিলো। এরপর ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলাম। মায়ের কাজে টুকটাক হেল্প করা শুরু করলাম। আমি কলেজের উঠার পর মায়ের থেকে রান্না শিখেছিলাম। আমরা দু ভাই প্রায় সব ধরনের রান্না পারি। এখন তো কাজের চাপে রান্নাঘরে আসা হয়না। আগে এটাই ছিলো আমাদের আড্ডাস্থান। রান্না জানলেও মা কখনো রান্নাঘর আমাদের ভরসায় ছেড়ে দেয়নি। আমি বা রাহিল শখ করে কখনো কোনো রেসিপি ট্রাই করতে চাইলে মা যদিও পারমিশন দিতো কিন্তু স্ট্রিক গার্ডের মতো পাশে দাঁড়িয়ে পাহাড়াও দিতো। তার শখের রান্নাঘরের কখন, কোন সর্বনাশটা করে ফেলি বলা যায় না। আমি তোমার রান্নাঘর অগোছালো করে ফেলিনি তো আবার?

গুলিস্তা চারপাশে তাকিয়ে রান্নাঘরের হালচাল দেখে নিলো। কেবিনেট থেকে সকল মশলার কৌটা নিচে নামিয়ে রাখা হয়েছে। থালা বাসন দিয়ে চারপাশ ভরে আছে। সবকিছু একসাথে না নামিয়ে গোছালো ভাবেও কাজ করা যেতো। যাই হোক, রান্নাঘরে হঠাৎ করে আসা অতিথি একটু এলোমেলো তো করবেই। তাই সে বললো,
– গুছিয়ে নিলেই আবার আগের মতো হয়ে যাবে।

রেহবার তাকিয়ে দেখলো রান্নাঘরটি তে অনেকগুলো জিনিসপত্র দিয়ে ভরে গেছে। দেখতে একদম সবজি বাজারের মতো লাগছে।
অল্প সময়ের মধ্যে রেহবার মিক্সড ফ্রাইড রাইস, চিকেন রোস্ট, গলদা চিংড়ি ভুনা রেঁধে ফেলেছে। সেগুলো ডাইনিং এ সাজিয়ে রান্না ঘরে ফিরে দেখলো গুলিস্তা ক্যাবিনেটে কৌটাগুলো তুলে রাখছে। রেহবার নিজেও রান্নাঘর গুছানোর কাজে হাত লাগালো। অপরিষ্কার বোল, প্যানগুলো বেসিনে রেখে দিলো। উচ্ছিষ্ট অংশ, সবজির খোসা ডাস্টবিনে ফেলে, কিচেন পরিষ্কার করে ফেললো।
খেতে বসে গুলিস্তা প্রথম লোকমা মুখে তুলতেই রেহবার ভীষণ আগ্রহ নিয়ে ওর দিকে তাকালো। কেমন হয়েছে জানতে চাইতে লজ্জা লাগছে। কিন্তু তার রান্না গুলিস্তার ভালো লেগেছে কিনা জানার জন্য মন অস্থির হয়ে আছে। গুলিস্তা বুঝি সেই অস্থিরতা বুঝলো। ছোট্ট করে বললো,
– ভালো হয়েছে।
এইটুকু কথাতেই রেহবারের মনে হলো বুকের উপর থেকে কোনো ভার নেমে গেলো। সে হাসি মুখে নিজের প্লেট হতে খাবার তুলে মুখে দিলো।

(চলবে)