হে সখা পর্ব-৮+৯+১০

0
184

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
অষ্টম পর্ব

মন যখন অস্থির হয়ে কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকে তখন মস্তিষ্ক ভালো-মন্দ বিচার করার সুযোগ পায় না। উত্তাল সমুদ্রে কিছু আঁকড়ে ধরে স্থিরতা লাভের আশায় হাত-পা ছোড়াছুড়ি করতে থাকে৷ রেহবারকে বাইরে থেকে স্বাভাবিক দেখালেও তার মনের সমুদ্রে চলছে প্রলয়কারী ঝড়। মস্তিষ্ক জুড়ে ক্ষণে ক্ষণে আকাশ পাতাল এক করে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে৷ স্থির হওয়ার প্রচেষ্টায় মস্তিষ্ক জুড়ে তুমুল আলোড়ন। অথচ তার চোখের পাতা জোড়া ভীষণ স্থির। একনিষ্ঠে চেয়ে আছে সামনে থাকা ফাইলের দিকে। দেশের জনপ্রিয় একটি কোম্পানি Freez নামক নতুন একটি ড্রিংকস লঞ্চ করেছে। প্রোডাক্টির আউটডোর ইভেন্ট মার্কেটিং এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রেহবারের এজেন্সিকে। এজেন্সির একটি চৌকস টিমকে সেই দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা নিরলসভাবে গত এক সপ্তাহ ধরে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ইভেন্ট আয়োজন করে প্রোডাক্ট মার্কেটিং করছে। রেহবার এতোক্ষণ গতকালের প্রোগ্রেসিং রিপোর্ট দেখছিলো। সামনে বসে আছে, ওর পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট লিতুন।

সদ্য গ্রাজুয়েশন সম্পন্নকারী বুদ্ধিমতী, সুন্দরী এবং চটপটে লিতুন এজেন্সির শুরু থেকেই যুক্ত আছে। বরাবর শান্ত থাকা মেয়েটিকে আজকে ডেস্কের অপরপাশে বসে উশখুশ করতে দেখে রেহবারের মনোযোগ তার দিকে ছুটে যাচ্ছিলো। ঠিকঠাক রিপোর্ট চেক করতে না পারায় সে বিরক্ত হয়ে হাতে ধরে থাকা কলমটি ফাইলের উপর শব্দ করে রেখে লিতুনের দিকে শীতল দৃষ্টিপাত করে শুধালো,

– কি সমস্যা তোমার?

লিতুন চমকে উঠে চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বললো,

– কোনো সমস্যা নেই স্যার৷

– তাহলে এমন নড়াচড়া করছো কেনো? পেটে গন্ডগোল দেখা দিয়েছে? টয়লেটে যেতে হবে?

– না স্যার।

– তাহলে নড়াচড়া বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকো।

লিতুনের কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও সফল হলো না। অস্থির চিত্তে আবারও মুঠোফোন হাতে নিয়ে স্ক্রল করতে শুরু করলো। রেহবার হাতের ফাইলটি পাশে সরিয়ে রেখে লিতুনের দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে শুধালো,

– পার্সোনাল ইস্যু?

লিতুন মাথা দুলিয়ে উত্তর দিলো,

– ইয়েস স্যার।

– ওয়ান্না টক এবাউট ইট।

বলবে না, বলবে না করেও লিতুন ফট করে খানিকটা উচ্চস্বরেই বলে ফেললো,

– আপনারা ছেলেরা লয়্যাল থাকতে পারেন না কেনো?

রেহবার প্রথমে থমকালো। অবাক চোখে লিতুনের দিকে তাকিয়ে খানিকটা নড়েচড়ে বসে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বললো,

– হোয়াট ডু ইউ মিন?

লিতুন নিজের বোকামি ততোক্ষণে বুঝতে পেরেছে। আরেকজনের কর্মকান্ডের জন্য পুরো পুরুষজাতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ঠিক নয়। তবুও এই মুহুর্তে পুরো পুরুষজাতিকেই ঠকবাজ মনে হচ্ছে। তবুও মন চাইলে তো আর নিজের বসকে এভাবে বলা যায়। পরে চাকরী নিয়ে টানাটানি পরে যেতে পারে।

– স্যরি স্যার। দ্যাটস নট লাইক হোয়াট আই মিন।

– এমন ডিস্টার্ব থাকলে কাজে মনোযোগ দিতে পারবে না। আগে নিজের মুড ঠিক করে এসো। তারপর কাজ।

– তাই তো চেষ্টা করছি। কিন্তু বেয়াদবটা মেসেজ সীন করতেছে না।

লিতুনের মিনমিনিয়ে বলা কথাগুলো রেহবার শুনতে পেলো। সে চেয়ে আসছে শান্ত মেয়েটার দিকে। যে সবসময় কাজে মনোযোগী ছিলো। যার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, প্রখর স্মৃতিশুক্তি, অসীম ধৈর্য্য রেহবারকে সদা মুগ্ধ করে।

– কিছুক্ষণ ব্রেক নেও। বাইরে থেকে ঘুরে এসে।

লিতুন সে কথা শুনলেও চেয়ার ছেড়ে উঠলো না। মনে হচ্ছে মেয়েটা এখানে থাকলেও ওর মন চলে গেছে অন্য কোথাও। কিছু একটা তাকে ভাবাচ্ছে। রেহবার ওর টেবিলের উপর ঢেকে রাখা পানির গ্লাসটা লিতুনের দিকে এগিয়ে দিলো।

– পানি খাও। ভালো লাগবে।

পানির গ্লাসে একটু চুমুক দিয়ে রেহবারকে বললো,

– একটা মানুষ আপনার বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ করেছে। সেটা যদি মিথ্যে হয়, তাহলে আপনার কি উচিত নয় সত্যটা তাকে জানানো? যখন কেউ অন্যায় করে তখন এভাবে চুপ করে থাকে। নির্দোষ হলে জোর গলায় প্রতিবাদ করতো।

রেহবার কিছু বুঝলো না। শুধু চেয়ে রইলো। তা দেখে লিতুন লম্বা একটা দম ফেলে বলতে শুরু করলো,

– আমাদের রিলেশনটা অনেকদিনের। সেই কলেজ লাইফ থেকে। এতোদিনে একজন আরেকজনকে পুরোপুরি চিনে ফেলেছি। বয়স বেড়েছে সেই সাথে ম্যাচুরিটি এসেছে। তাই বলে অনুভূতি তো পাল্টে যায়নি। আগে যেমন ভালো বাসতাম এখনো বাসি। তো স্বাভাবিকভাবে আগে যতোটা ইনসিকিউরিটি ফিল হতো এখনোও হবে, তাই না?

রেহবার সাথে সাথেই উত্তর দিলো,

– অবশ্যই, অবশ্যই।

– সেদিন ও গেলো ওর এক বন্ধুর বিয়েতে। রাতভর সেখানে পার্টি করলো, আড্ডা দিলো। পুরোটা সময় আমাকে একবারও কল করেনি, মেসেজ করেনি। আমি কিন্তু এই নিয়ে কোনো ঝামেলা করিনি। বন্ধুর বিয়েতে অন্য সব বন্ধুরা আসবে, নিজেদের মতো সময় কাটাবে। সেখানে আমাকে কি আর মনে থাকে! বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে এসে সে নিয়ে আমাদের মাঝে কোনো কথা হলো না। ও আমাকে কোনো আপডেটও দেয়নি। আমিও আর কথা বাড়াইনি। আজকে হঠাৎ কি দেখলাম জানেন?

রেহবার আগ্রহ ভরে জানতে চাইলো,

– কি?

– ওর এক বান্ধবী সেদিনের কিছু পিকচার ফেসবুকে আপলোড করেছে। দেখে তো আমার মাথায় হাত। ওয়েট, আপনাকে দেখাচ্ছি।

লিতুন ওর হাতে ধরে থাকা মুঠোফোন থেকে একটা ছবি রেহবারকে দেখালো। কিছু সুদর্শন ছেলের সাথে গর্জিয়াস সাজে চারটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে বিয়ের অনুষ্ঠানে বন্ধুরা গ্রুপ ফটো তুলেছে। রেহবার অনেক খুঁজে, সূক্ষ্ম নজরে চেয়ে দেখেও অস্বাভাবিক কিছু খুঁজে পেলো না। প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি মেলে লিতুনের দিকে চাইতেই দেখলো সে আগ্রহ ভরে রেহবারের দিকেই চেয়ে আছে। রেহবার আমতা আমতা করে বললো,

– গ্রুপ ফটো । বেশ সুন্দর এসেছে।

– আহা, আপনি ভালো করে দেখলেন না। এই যে এখানে দেখুন তুহিনের সাথে এই মেয়েটাকে দেখুন। কীভাবে কাঁধে হাত দিয়ে গায়ে ঢলে পরে ছবি তুলেছে।

ছবিটি জুম করে রেহবারকে দেখালো। ছবিটিতে একপাশে দাঁড়ানো একটি যুবকের পাশে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। মেয়েটি ছেলেটির কাঁধে কনুই ঠেকিয়ে দাড়িয়েছে। বন্ধুরা যেভাবে দাঁড়ায়। রেহবারের চোখে সেটি স্বাভাবিক ঠেকলেও একজন প্রেয়সীর চোখে তার পার্টনারের পাশে দাঁড়ানো মেয়েটির সাথে এমন ঘনিষ্টতা স্বাভাবিক লাগছে না। তাই রেহবার বললো,

– জ্বী দেখতে পেয়েছি।

– এমন একটা ছবি দেখে আমার রেগে যাওয়া কি স্বাভাবিক নয়! আমি তবুও রেগে যাইনি। শুধু জানতে চেয়েছি এই মেয়েটার সাথে তার কি সম্পর্ক ? কেনো এভাবে গায়ের সাথে লেপ্টে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছে? ও আমার প্রশ্নের জবাব তো দিলোই না, উল্টো বলতেছে আমি নাকি তাকে সন্দেহ করেতেছি। ওর উপর নাকি আমার ভরসা নেই। ওদের বন্ধুত্বকে আমি অপমান করছি। এই বলে ফোন কেটে দিলো। এখন আমার মেসেজের রিপ্লাইও করতেছে না। কেনো মেজাজটা বিগড়ে যাবে না বলুন? আমার রেগে থাকা উচিত ছিলো। উল্টো আমি ওর রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করতেছি। আমার তো মনে হচ্ছে ও আমার সাথে চিট করতেছে। আমি এতোদিন কিছু বুঝতে পারিনি। এখন এই সামান্য ব্যাপারকে কেন্দ্র করে ও আমার থেকে পিছু ছাড়ার পায়তারা করতেছে।

রেহবার অবাক হয়ে খেয়াল করলো শক্তপোক্ত মেয়েটার চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। গলার স্বর ভারী, মনে হচ্ছে এখনি কেঁদে ফেলবে। হিংসা মেয়েদের সহজাত স্বভাব।পার্টনারের পাশে অন্য কাউকে সহ্য করা মেয়েদের পক্ষে অসম্ভব। যেকোনো পার্সোনালিটির মেয়ে এই এক জায়গায় এসে আটকে যায়। সেই সাথে যখন যুক্ত হয় সন্দেহ। সম্পর্কে ভাঙনের শুরুটা এখান থেকেই হয়।

– রাগের মাথায় মস্তিষ্ক ঠিকঠাক কাজ করতে পারে না। মনে অদ্ভুত সব খেয়াল আসে। এই যে তোমার মনে হচ্ছে তুহিন তোমার সাথে চিট করতেছে। এমন একটা চিন্তা তো এই ছবিকে কেন্দ্র করেই তোমার মস্তিষ্কে উদয় হয়েছে। এর আগে কখনোই তোমার এমন কথা মনে হয়নি। ইউ গাইজ ওয়াজ অ্যা হ্যাপি কাপল। তাহলে একটা ছবি দেখে এমন অ্যালিগেশন আনাটা ভুল হবে। যেখানে তুমি উপস্থিত ছিলে না, নিজে চোখে কিছু দেখোনি। হতে পারে সাধারণভাবে, বন্ধুত্বের খাতিরে কাঁধে হাত রেখেছে। তুমি সেখানে উপস্থিত থাকলে তোমার কাছে স্বাভাবিক মনে হতো। তাছাড়া ছবির অ্যাঙ্গেলও ম্যাটার করে। ছবিতে দুজনের মধ্যকার দূরত্বের সংকীর্ণতা দেখা যাচ্ছে। ক্যামেরার কারসাজির কারনে এমন দেখাচ্ছে। হতে পারে ওদের দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা অনেক সুন্দর এবং সম্মানের। তুমি এভাবে রিয়েক্ট করায় তুহিন হয়তো মনে কষ্ট পেয়েছে। তোমাদের এতোদিনের সম্পর্ক। সম্পর্কের মূল ভিত্তি বিশ্বাস। সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় তুহিন হয়তো আশাহত হয়েছে। তোমরা সামনাসামনি বসে এ বিষয়ে কথা বলো। সন্দেহ না করে স্বাভাবিকভাবে জানতে চাও। দুজনের ক্লোজ পিক দেখে তোমার খারাপ লেগেছে, এ কথা ভালোভাবে জানাও। ও নিশ্চয়ই তোমাকে এক্সপ্লেইন করবে।

লিতুন কিছু বললো না। পুরোটা সময় গভীর মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনলো। রেহবার ফাইল গুছিয়ে ওকে বললো,

– আজকে আর অফিস করতে হবে না। লিভ নেও। প্রবলেম সলভ করে কালকে যথাযথ সময়ে অফিসে চলে এসো।

– কাজটা শেষ করে যাই, স্যার। ফাইলটা বুঝিয়ে দিতে বেশিক্ষণ সময় লাগবে না।

লিতুন চলে যাওয়ার পর রেহবার মনে মনে অনেকক্ষণ ভাবলো। হিংসার ক্ষেত্রে সব মেয়ে যেহেতু একই রকম প্রতিক্রিয়া দেখায়, রেহবারের সাথে অন্যকে দেখলে গুলিস্তাও কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে? নির্লিপ্ত, বোবা মেয়েটার মুখে কি প্রশ্নের দেখা মিলবে? সেও কি রাগ করবে, বোকাবোকা অভিযোগ তুলবে?

(চলবে..)

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
নবম পর্ব

হাতে ধরে থাকা আরণ্যক বইটি পড়া শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। এতোক্ষণ বইয়ের পাতা উল্টিয়ে চুম্বকাংশগুলো আরেকবার পড়ে দেখছিলো। সেগুলোও পড়া শেষ হয়ে গেলে বইটি বেড টেবিলে রেখে ঘড়ির দিকে তাকালো। রাত প্রায় একটা বাজতে চললো। রেহবার এখনো বাড়ি ফিরেনি। এদিকে অপেক্ষা করতে করতে গুলিস্তা পর পর দুটো উপন্যাস পড়ে ফেলেছে। একটানা পড়ার কারনে মাথাটা ভীষণ ধরেছে,প্রচন্ড যন্ত্রণা করছে। এখন আর বই সামনে নিয়ে বসে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু এভাবে বসে থাকলে এক্ষুণি ঘুমিয়ে পরবে। স্বামী বাড়িতে ফিরেনি অথচ সে ঘুমিয়ে পরেছে এ কথা মায়ের কাছে পৌছালো, ওকে আস্ত রাখবে না। গুলিস্তা হাই তুলতে তুলতে কিচেনের দিকে গেলো। সকালের জন্য পরোটার ডো বানিয়ে রাখলে কাজও এগিয়ে যাবে, সময় কাটবে। এক কাপ চা খেলে মাথা ব্যথাটা কমে যেতো। কিন্তু এখন চা খেলে আবার ঘুম কেটে যাবে। ঘুমের ব্যঘাত ঘটলে সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরী হবে। সবদিক বিবেচনা করে আর চা বানালো না।
রেহবার ফিরলো কিছুক্ষণ পর। স্বাভাবিক ভাবে বাড়িতে প্রবেশ করে গুলিস্তাকে রান্নাঘরে দেখে বললো,
– এতো রাতে রান্নাঘরে কি করছো? ঘুমাওনি কেনো এখনো?
– সকালের জন্য কিছু কাজ গুছিয়ে রাখছিলাম। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন, টেবিলে খাবার দিয়ে দিচ্ছি।

স্বাভাবিকভাবেই কথাগুলো বলে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। রেহবার ভেবেছিলো ওর দেরীতে বাড়ি ফেরা নিয়ে গুলিস্তা অন্তত প্রশ্ন করবে। সেজন্যই তো ইচ্ছে করে অফিস থেকে দেরী করে বাড়ি ফিরলো। নাহ, এই মেয়ে এতো সহজে পথে আসবে না। শুধু শুধু এতোক্ষণ অফিসে বসে পিঠের ব্যথা ধরালো। রেহবারের মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো।

খেতে বসে রেহবার এক হাতে ফোন ধরে রেখেছে। খুব মনোযোগ দিয়ে কিছুটা একটা দেখছে আর মিটিমিটি হাসছে। এদিকে মাথা ব্যথার কারনে গুলিস্তা কিছু খেতে পারছে না। প্লেটের খাবার নাড়াচাড়া করে যাচ্ছে। রেহবারের খাওয়া শেষ হলে সে উঠে যাবে। সবকিছু দ্রুত গুছিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে পারলেই শান্তি। কিন্তু রেহবারের খাওয়া শেষ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। সে ফোনে মুখ গুঁজে কোনোরকম দু চারটে ভাত মুখে তুলছে। এভাবে খেতে থাকলে রাত পার হয়ে যাবে তবুও প্লেটের খাবার শেষ হবে না। আর সহ্য করতে না পেরে গুলিস্তা টেবিল ছেড়ে উঠে পরলো। তা দেখে রেহবার ফোন হতে চোখ তুলে চাইলো।
– খাওয়া শেষ? কিছুই খেলে না দেখছি। প্লেটে খাবার ওভাবেই পরে আছে।

খাবার অপচয় করা গুলিস্তার পছন্দ নয়। বাধ্য হয়ে আজকে খাবার ছেড়ে উঠতে হলো। তার উপর রেহবারের প্রশ্নে থমথমে খেয়ে বললো,
– খেতে ইচ্ছে করছে না।

ও উঠে চলে যেতেই রেহবার ফোন রেখে দ্রুত খেয়ে নিয়ে টেবিল গুছানোর কাজে সাহায্য করলো। দুজনে মিলে কাজ করাতে দ্রুত কাজ শেষ হয়ে গেলো। ঘরে গিয়ে হঠাৎ ট্রাউজারের পকেটে হাত দিয়ে ফোন খুঁজে না পেয়ে গুলিস্তাকে বললো,
– ফোনটা মনে হয় টেবিলের উপর রেখে এসেছি। নিয়ে এসো না, প্লিজ।

গুলিস্তাকে ফোন নিয়ে আসতে হলরুমে ফিরে যেতে দেখে রেহবার আরাম করে বিছানায় শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। এবার তার বরফ কঠিন ডোন্ট কেয়ার টাইপের স্ত্রী আর চুপ করে থাকতে পারবে না। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে গুলিস্তা স্বাভাবিকভাবেই ঘরে ফিরে এলো। ফোন হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিছানায় অপরপ্রান্তে নিজের জায়গায় শুয়ে পরলো। হতম্বভ রেহবার কিছুক্ষণ পর ওর ভারী নিঃশ্বাসের আওয়াজ পেয়ে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালো। ফোন চেক করে শিওর হয়ে হলো ওর প্ল্যান ঠিকমতো কাজ করেছিলো। স্ক্রীনে এখনো ছবিটি দেখা যাচ্ছে। তাহলে আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া পেলো না কেনো?

ফোনের স্ক্রীনে রেহবারের সাথে একটি মেয়ে ভীষণ কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। দুজন দুজনের কাঁধে হাত দিয়ে হাস্যোজ্জবল মুখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে। যে কেউ এক পলক দেখে, পারফেক্ট লাভ বার্ডের খেতাপ দিতে বাধ্য। মূলত ভার্সিটির ফেস্টিভ্যালের একটি ড্রামার একটি অংশের মোমেন্ট ক্যাপচার করা হয়েছে ছবিটিতে। আজ সারাদিন অনেক খুঁজে গুগল ড্রাইভ থেকে ছবিটি উদ্ধার করে পরিকল্পনা সাজিয়েছে। ইচ্ছে করেই ডাইনিং টেবিলের উপর ফোনটি রেখে এসেছিলো। স্ক্রীনটাইম বাড়িয়ে পাঁচ মিনিট করে রেখেছিলো। যাতে গুলিস্তা ফোনের কাছে গিয়ে উজ্জ্বল স্ক্রীনে এই ছবিটি দেখতে পায়। প্ল্যান অনুসারে দেখেছিলোও কিন্তু পরবর্তী ধাপে হিংসা কিংবা সন্দেহের যে অংশটি ছিলো সেটি আর দেখা গেলো না। রেহবার হতাশ হয়ে ফোনটি রেখে বিড়বিড় করে বললো, কোনো পাত্তাই দিলো না। আজব!

পরদিন অফিসে লিতুনের মেজাজ ফুরফুরে থাকলেও বসের মেজাজ ছিলো তুঙ্গে। সামান্য ভুলেও একে ওকে ধমকে বকে একাকার অবস্থা। অফিসের সবাই তটস্থ হয়ে কাজ করছে। এমনকি নির্ধারিত সময়ের পরেও অনেকে লাঞ্চ ব্রেকে গেলো না। ভুল সংশোধন করার কাজে ব্যস্ত থাকলো।
লাঞ্চের পর রেহবারের জন্য এক কাপ ব্ল্যাক কফি নিয়ে যায় লিতুন। আজ কফি কাপ হাতে কেবিনের ভেতরে যাওয়ার আগে সাহস যোগাতে হচ্ছে। লিতুন বুঝতে পারছে না, গতকাল যে মানুষটা ফুরফুরে মেজাজে ছিলো তার আজকে হঠাৎ কি হলো! ক্ষণিকেই মনে পরলো, স্যারের তো এখন বিয়ে হয়েছে। ঘরে বউ থাকলে বউয়ের মুড সুয়িং এর সাথে ছেলেদের মেজাজের পরিবর্তন ঘটে। তাই বিয়ের পর মেজাজের এমন খেই হারানো অস্বাভাবিক কিছু নয়।

কেবিনের শীতল আবহাওয়ায় রেহবারের গম্ভীর মুখখানা দেখে লিতুনের আত্মা পালাই পালাই করছে। বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে সে কফির মগ এগিয়ে দিলো।
– স্যার আপনার কফি।

রেহবার হাত বাড়িয়ে কফি নিয়ে শীতল কন্ঠে আদেশ দিলো,
– বসো।

লিতুন ভেবেছিলো কফি দিয়েই সে ফুড়ুৎ করে উড়াল দিবে। তা আর হলো না। বাধ্য মেয়ের মতো চেয়ার টেনে নিঃশব্দে বসলো। রেহবার আয়েশ করে কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললো,
– তুহিনের সাথে অন্য মেয়ের ছবি দেখে তুমি রিয়েক্ট করেছিলো কেনো?

লিতুন অবাক হয়ে ক্ষীনকাল চেয়ে রইলো। অফিসের এমন থমথমে পরিবেশে বস তার সাথে ব্যক্তিগত বিষয়ে আলোচনা করছে, ব্যাপারটা ওর বিশ্বাস হচ্ছে না। রেহবার উত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে আছে দেখে হড়বড় করে বললো,
– আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে কেউ এভাবে ছবি তুলবে আমি কিছু বলবো না!
– অবশ্যই বলবে। কিন্তু কেনো বলেছো?
– ছবিতে অন্য মেয়ের সাথে ওকে দেখে আমার খারাপ লেগেছে, রাগ হয়েছে।
– সব মেয়েরা এমন রিয়েক্ট করে?
– অবশ্যই করে। আমরা মেয়েরা নিজেদের জিনিস নিয়ে অনেক পজেসিভ। এখানে তো লাইফ পার্টনারের কথা। সামান্য কারনেই বুক ছ্যাঁত করে উঠে। হারিয়ে ফেলার ভয়ে মাথায় উল্টাপাল্টা খেয়াল আসে। ভয়ের কারনেই রিয়েক্ট করে বসি। যেমনটা গতকাল আমি করেছিলাম।
– আর কেউ যদি এমন সিচ্যুয়েশনে রিয়েক্ট না করে, তাহলে?
– মানে? বুঝলাম না স্যার।
– মানে, তোমার কোনো জিনিস তোমার থেকে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখতে পেয়েও তুমি কোনো রিয়েক্ট করলে না। কখন করবে এমনটা? কেনো করবে?

লিতুন খানিকক্ষণ ভাবলো। কিছু হারিয়ে গেলে, অন্য কারো দখলে চলে গেলে খারাপ লাগবে না, কিছু অনুভব করবে না। এমনটা কি হতে পারে? লিতুন বরাবর নিজের জিনিসপত্রের প্রতি ভীষণ যত্নশীল এবং পজেসিভ। সাজগোজের জিনিসপত্রও ছোটবোনকে ছুতে দেয় না। শুধু একবার নিজের সুন্দর একটা ড্রেস ওকে দিয়েছিলো। লিতুন তখন থ্রিপিস পরতো না। কিন্তু ছোট খালা ওর জন্য ইন্ডিয়া থেকে একটি থ্রিপিস এনে দিয়েছিলো। মায়ের জেদে সেটি একবার পরার পর আর কখনো গায়ে জড়ায়নি। দেখতে খুব সুন্দর ছিলো বিধায় ছোটবোন একদিন পরতে চেয়েছিলো। লিতুন সেটা ওকে একেবারে দিয়েছে।

– তখনই রিয়েক্ট করবো না, কষ্ট পাবো না, কোনো কিছু অনুভব করবো না যখন সেই জিনিসের প্রতি আমার কোনো আগ্রহ থাকবে না। আমার পছন্দের কিছু হলে সেটির প্রতি ভালো লাগা থাকবে। তাই সেটি হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখলে আপনা থেকেই প্রতিক্রিয়া চলে আসবে এবং রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবো।
– জরুরি কিছু হলেও প্রতিক্রিয়া দেখাবে না?

লিতুন ভাবলো, ড্রেসটি জরুরি একটি পণ্য ছিলো কিন্তু সেটির বিকল্প অন্য অনেক ড্রেস ছিলো। তাই প্রয়োজনবোধ অন্য ড্রেস দ্বারা পূর্ণ হয়েছে।
– হাতে অল্টারনেটিভ থাকলে খুব একটা প্রয়োজনবোধ হয় না। হারিয়ে গেলোও অভাববোধ হবে না। থাকা না থাকা সমান। বরং কাছে থাকলে হাঁসফাঁস লাগতে পারে। চোখের সামনে পরলে অস্বস্তি হতে পারে। যতো দ্রুত নজরের বাইরে করে ফেলা যায়, স্বস্তি মিলে। আর জরুরি প্রয়োজনটি যদি অন্য কিছু দ্বারা পূর্ণ করা সম্ভব হয় এবং সেটি আমাদের হাতের নাগালে থাকে, বিকল্পটি আমাদের বেশি পছন্দের হয় তাহলে শুধু শুধু হারিয়ে যাওয়া বস্তুর কথা ভেবে সময় নষ্ট কেনো করবো? লাইফ গোস অন, রাইট? তাই আমরাও মুভ অন করে যাই।

রেহবার মনে মনে প্রশ্ন করতে থাকলো, আমার প্রতি তোমার আগ্রহ নেই, নাকি আমি তোমার জীবনে জরুরি কেউ নই? আমার অল্টারনেটিভ কেউ আছে নাকি আমাকে তোমার প্রয়োজন নেই? তোমাকে আমি বুঝি না, ফুল? কিন্তু আমার যে এই ধাঁধার উত্তর চাই। সে যে করেই হোক।

চলবে..

#হে_সখা
#অক্ষরময়ী
দশম পর্ব

এলোমেলো চিন্তাদের মাথায় নিয়ে রেহবারের দিন কেটে যায়। নির্ঘুম রাত জেগে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রয় ঘুমন্ত গুলিস্তার দিকে৷ লোকে শুনলে হয়তো বলবে, সমস্যা কোথায়? এতো চিন্তা ভাবনা না করে সেভাবে চলছে চলুক না। ঘরের বউ যতো চুপচাপ থাকে ততোই ভালো। মান অভিমান করছে না, রাগ-অভিযোগ কিছুই করছে না৷ এতো মশাই সাত কপালের ভাগ্য। এমন বউ সবাই চায়, আর তুমি পেয়েও সুখী নও। উল্টো আকাশ কুসুম চিন্তা করে মনের অশান্তি বাড়াচ্ছো। কিন্তু রেহবার তো এমন চায়নি। সে নিজে একজন প্রানোচ্ছ্বল মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই নিজের মতোই একজন জীবনসঙ্গীর কামনা সে করে। নিজের মতো না হোক, অন্তত আর পাচটা স্বাভাবিক মেয়ের মতো যদি হতো তবুও রেহবারের আপত্তি ছিলো না। যারা এমন বুলি কপচায় তারা নিজের সদ্য বিয়ে করা স্ত্রীর থেকে এমন রোবোটিক বিহেভিয়ার পেলে রেহবারের কষ্টটা বুঝতো। একজন মানুষ তার আশেপাশে আছে, কিন্তু আচরণ এমন করছে যেনো সে নেই। রেহবারের উপস্থিতি তাকে খুব একটা প্রভাবিত করে না। পাশে থাকা, না থাকা খুব একটা ভাবায় না। এমন অবহেলা মেনে নেওয়া যায়?

রেহবার চায় গুলিস্তা তাকে অনুভব করুক, যেমনটা একজন স্ত্রী তার স্বামীকে করে৷ তারও তো ইচ্ছে করে অফিস থেকে ফিরে স্ত্রীর উদগ্রীব মুখের দর্শন পেতে৷ সেও চায় বাড়ি ফিরতে দেরী হলে গুলিস্তা একটা মেসেজ কিংবা একটা কল দিয়ে ওর খোঁজ নিক। হাস্যকর হলেও সত্যি, গুলিস্তা আজ পর্যন্ত ওর ফোনে কোনো কল বা মেসেজ করেনি৷ ফোন নাম্বারটা সেভ করা আছে কিনা সেটাই সন্দেহ হয়৷

বিছানার একপাশে গভীর ঘুমে মগ্ন গুলিস্তা। বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে ঘুমাচ্ছে। ও খুবই পরিপাটি হয়ে ঘুমায়। ঘুমের মাঝে একটুও নড়াচড়া করে না৷ যেপাশে শোয়, ঘুম থেকে জেগে নিজেকে সেপাশেই পায়। রেহবার নিজেও বেশ পরিপাটি ছিলো। কিন্তু আজকাল নির্ঘুম রাত কাটার দরুণ, রাতভর এপাশ ওপাশ করতে থাকে। গুলিস্তার কপালে আলতো চুমু একে রেহবার মুচকি হেসে বিড়বিড় করলো,
– রোবট একটা।

আর ঘুম হবে না জেনে বিছানা ছাড়লো। মাথাটা দপদপ করছে। কফি খাওয়া দরকার৷ কিচেনে গিয়ে নিজের জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে বাড়ির বাইরে চলে এলো৷ ভোরের পরিশুদ্ধ বাতাস গায়ে লাগতেই শরীর ও মন দুটোই চনমনে হয়ে উঠলো। শীতের আগমনের বার্তা নিয়ে এসেছে সকালের মৃদু বাতাস। গা কেমন শিরশির করে উঠে। পাতলা সুতি পাঞ্জাবি গায়ে এমন বাতাস ঠান্ডা ছড়িয়ে দিলো। গরম কফির কাপে চুমুক দিয়ে রেহবার বাগানের মধ্যে খানিকক্ষণ পায়েচারি করে কাটিয়ে দিলো।

দেয়াল ঘড়িতে সময় সাতটা। গুলিস্তা তখনো ঘুম থেকে উঠেনি। হয়তো এক্ষুনি উঠে পরবে। রোজ এই সময় ওর ঘুম ভেঙে যায়। কোনো এলার্ম ছাড়া আপনাআপনি জেগে উঠে।

দোতলায় নিজের ঘরের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে কিচেনের দিকে পা বাড়ালো। হাতে যেহেতু কোনো কাজ নেই, ব্রেকফাস্ট বানিয়ে ফেলা যাক। রোজ তো গুলিস্তা তৈরী করে। আজকে ও একটু বিশ্রাম করুক। ফ্রিজ থেকে ডিম বের করে সেগুলো ফেটিয়ে তাতে খানিকটা লবণ মিক্সড করে পাউরুটি ভিজিয়ে নিলো। ফ্রাইপ্যানে তেল গরম হতে দিয়েছে৷ হঠাৎ পাশ থেকে গুলিস্তা বললে উঠলো,
– আমি ভেজে দিচ্ছি।

রেহবার চমকে উঠলো। নিস্তব্ধ বাড়ির মধ্যে হালকা শব্দ হলেও গা ছমছম করে উঠে। এদিকে রেহবারের পুরো মনোযোগ ছিলো ডিম পাউরুটির দিকে৷

রেহবার ওর ছুটতে থাকা হৃৎপিন্ডের উপর হাত রেখে নিজেকে শান্ত করলো।
– তুমি কখন এলে? এভাবে হঠাৎ করে কেউ কথা বলে! হাটাচলা তো করো বিড়ালের মতো একটুও আওয়াজ পাওয়া যায় না।

উত্তেজনার কারনেই হয়তো রেহবারের কথাগুলো মিষ্টি সকালে একদম তেতো এবং জোরালো শোনালো। আজকাল আবার মনের অবস্তাও ঠিক নেই৷ যাকে দেখলে এতোদিন মনের ভেতর প্রশান্তি বয়ে চলতো, ফুলেল স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পরতো এখন তার উপস্থিতি মনের ভেতরটায় ভীষণ পোড়ায়। মস্তিষ্কে আলোড়ন ছড়িয়ে দিয়ে অহেতুক প্রশ্নের ঢেউ তুলে দেয় নিশ্চুপ সমুদ্রে৷

গুলিস্তা অবাক চোখে চেয়ে আছে রেহবারের দিকে। ঘুম থেকে উঠার কারনে ওর চোখ মুখ খানিকটা ফুলে আছে। ভীষণ আদুরে দেখাচ্ছে। ওর ফোলা চোখগুলো গোল গোল হয়ে চেয়ে আছে রেহবার এর দিকে। নীরবে যেন প্রশ্ন করছে, এমন করছেন কেনো?

রেহবার তড়িতে নিজের ভুল বুঝতে পেরে মেজাজের রাশ টেনে ধরলো। এভাবে চিল্লানো উচিত হয়নি।
– স্যরি। হঠাৎ করে কথা বললে তো। ভড়কে গিয়েছিলাম।

গুলিস্তা জড়োসড়ো হয়ে দাড়িয়ে ছিলো। এবার মিনমিনিয়ে বললো,
– আপনি ডাইনিং এ গিয়ে বসুন। আমি ব্রেকফাস্ট রেডি করছি। বেশিক্ষণ লাগবে না।

ফ্রাইপ্যানে ব্রেড ভাজতে দিয়ে গুলিস্তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রেহবার বললো,
– ব্রেকফাস্ট আমি তৈরি করে নিচ্ছি৷ তুমি হেল্প করতে চাইলে ফ্রুট জুসটা তৈরি করতে পারো।

ক্ষীণকাল বিলম্ব না করে গুলিস্তা ফ্রিজ হতে ফল বের করে জুস তৈরি করতে লাগলো। ওর ছুটে ছুটে কাজ করা দেখে রেহবার নিজের কাজ বন্ধ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা নিজে থেকে কিছু বলবে না। ও হয়তো ভাবছে ওর ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়েছে। রেহবারের নিশ্চয়ই ক্ষুধা লেগেছে তাই নিজেই ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে শুরু করেছে। এসবের কারন নিজের ঘুম থেকে উঠতে দেরী হওয়া। মেয়েটা নিজের ভুল ভেবে এখন কষ্ট পাচ্ছে৷ রেহবার ওর কাছে গিয়ে দু কাধে দু হাত রেখে বললো,
– হেই, রিলেক্স৷ ইউ আর নট লেইট। আমার তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গিয়েছে। তাই ভাবলাম ফ্রি আছি যেহেতু, ব্রেকফাস্টটা আমি তৈরি করি। প্রতিদিন তুমি তৈরি করো। আজকে আমার হাতের ব্রেকফাস্ট করে দেখো। জুস তৈরি হয়ে গেলে ওটা নিয়ে টেবিলে গিয়ে বসো। আ’ম কামিং উইথ ব্রেকফাস্ট।

গুলিস্তা অনড়ভাবে দাঁড়িয়ে রেহবারের কথা শুনলো। হু, বলে জুস তৈরিতে আবার মনোযোগ দিলো।

রেহবার আজকাল নিজে থেকে কিছু এক্সপেরিমেন্ট করছে। প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পর রেহবারের জন্য এক কাপ কফি নিয়ে আসে গুলিস্তা। কফির কাপ রেখে আবার নিজের কাজে ফিরে যেতো। কিন্তু এখন আর রেহবার তাকে ফিরে যেতে দেয় না। ব্যালকনিতে বসে যতোক্ষণ কফি খায় গুলিস্তাকে পাশে বসিয়ে রাখে, বিভিন্ন ধরনের কথা বলে।
– বাড়ির কথা তোমার মনে পরে না? বিয়ের দিন চলে এলে তারপর থেকে এখানেই আছো।

রেহবারের পাশে মেরুদণ্ড সোজা করে বসে আছে গুলিস্তা। ওর সতর্ক দৃষ্টি রেহবারের দিকে। সবসময় এমন সতর্ক থাকার কারণে রেহবারের ভীষণ অস্বস্তি হয়৷ তবুও সে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, ওদের মধ্যে সবকিছু যেনো স্বাভাবিক হয়। কিন্তু গুলিস্তা বললো,
– মাঝেমধ্যে পরে।
– তুমি চাইলে বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে পারো৷ না মানে, তোমার যদি যেতে ইচ্ছে করে।
– নাহ। আমি এখানেই ঠিক আছি।

এরপর রান্নার অজুহাতে যেখান থেকে বেরিয়ে আসে। প্রতিদিন এমনই টুকটাক আলাপচারিতায় খুব একটা পরিবর্তন আসে না৷ রেহবার প্রতিবার অনেক উৎসাহ নিয়ে গুলিস্তার কাছে যায় কিন্তু গুলিস্তার শীতল প্রতিক্রিয়া তাকে হতাশ হয়ে ফিরতে বাধ্য করে। এমন করে প্রতিনিয়ত একটু একটু ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে রেহবার। তবুও কোথা থেকে যেনো মনে সাহস চলে আসে। তারপর আবার নতুন কোনো পন্থায় খুঁজতে শুরু করে প্রিয়তমার হৃদয়ের কাছাকছি পৌছানোর পথ।

অফিস থেকে ফেরাদ পথে ফুলের মার্কেট হয়ে আসতে হয়। প্রতিদিন সেখানে ফুলের দোকানের ফুল দেখে গুলিস্তার কথা মনে পরে৷ আজকে কয়েকটি হালকা গোলাপি রঙের গোলাপ চোখে পরায় রেহবার সেগুলো কিনে নিয়েছে৷ ঘরে প্রবেশ করে সেগুলো গুলিস্তার দিকে এগিয়ে দিলো৷ গুলিস্তা খানিকক্ষণ থমকে তাকালো তারপর হাত বাড়িয়ে সেগুলো গ্রহণ করে চিরচেনা রোবোটিক ভয়েসে বললো,
– থ্যাঙ্কিউ।

মুখে না আছে কোনো লজ্জাময় হাসি, না কোনো উজ্জ্বলতা। কন্ঠে নেই কোনো উচ্ছাস কিংবা ভালোলাগা। ফুলগুলো নিয়ে ফুলদানিতে সাজিয়ে রেখে কিচেনে চলে গেলো। ডাইনিং টেবিলের উপর সাদা চিনামাটির ফুলদানীতে খিলখিলিয়ে হাসছে হালকা গোলাপী রঙের ফুলগুলো। তা দেখে রেহবারের ইচ্ছে হলো এই বিচ্ছিরি ফুলগুলোকে তুলে ফ্লোরে ছুড়ে ফেলতে৷ যেই ফুল প্রিয়তমার মুখে হাসি ফোটাতে পারে না তাদের পায়ে পিষে ফেলা উচিত৷

চলবে…