হৈমন্তীকা পর্ব-৩০+৩১

0
556

হৈমন্তীকা

৩০.
থানা থেকে বের হয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটছে তারা। চারপাশের আবহাওয়া কি ভীষণ সুন্দর, শীতল, মনোমুগ্ধকর। চড়ুই পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে সূদুর হতে। মৃদুমন্দ অনলের তেজ বহমান। হৈমন্তীর নরম হাতটা নিজের হাতের ভাঁজে মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে তুষার। দৃষ্টি হৈমন্তীর অভিমানে ফুলে যাওয়া মুখপানে। অশ্রুসিক্ত স্নিগ্ধ নেত্রকোণে। তুষার দূর্বোধ্য হাসলো। কোমল স্বরে প্রশ্ন করলো, “আপনি কি রেগে আছেন হৈমন্তীকা?”

হৈমন্তী জবাব দিলো না। অন্যদিকে ফিরে রইলো। যার অর্থ, আমি রেগে আছি। তুষারের হাসি আরও বাড়লো এবার। একটু দূরত্বে একটা ছোট্ট মেয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ গোলাপ বালতিতে করে বেঁচা-কেনা করছে। একদম পিচ্চি মেয়েটা। তুষার সেদিকে এগোলো। ছোট্ট মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলো, “এই পিচ্চি, নাম কি তোমার?”
মেয়েটা পিটপিট নয়নে তাকালো। আধো আধো বুলিতে জবাব দিলো,
— “রুপা।”
— “বয়স কত?”
— “আট।”
— “আচ্ছা। গোলাপ কত করে?”
— “একটা দশ ট্যেকা কইরা।”
— “দশটা দাও তো আমাকে।”

মেয়েটা যেন খুশি হলো খুব। চোখ মুখে আলাদাই উজ্জ্বলতা খেলে গেল। সামান্য ওজনের বালতিটা রাস্তায় রেখে গুণে গুণে দশটা গোলাপ হাতে নিলো। তুষার পকেট হাতড়ে মানিব্যাগ বের করলো। টাকা বের করতে করতে হৈমন্তীকে উদ্দেশ্যে করে বললো,
— “এই পিচ্চি, আমাকে আর উনাকে একসাথে কেমন লাগে তোমার?”

রুপা নামের মেয়েটির সামনের মাড়ির দু’টো দাঁত নেই। ফোকলা দাঁত বের করে মেয়েটা বিস্তর হাসলো। একবার তুষারকে দেখে তারপর হৈমন্তীর দিকে তাকালো। অতঃপর হাসি-মুখে বললো,
— “খুব ভালা লাগে। আপনাগো একসাথে মানাইসে।”

তুষার মুচকি হাসলো। মেয়েটার মাথায় স্বস্নেহে হাত বুলিয়ে হাতে এক’শত টাকার নোট গুঁজে দিলো। উপার্জন পেয়ে মেয়েটা প্রফুল্ল মনে ছুট লাগালো রাস্তার অন্যধারে থাকা তার সাথীদের কাছে।
হাতের বাঁধন আরেকটু দৃঢ় করে আবারও হাঁটতে লাগলো তুষার। অন্যহাতে তার গোলাপের গুচ্ছ। হৈমন্তীকে এখনো দেয় নি সে। হৈমন্তী আড়চোখে গোলাপগুলোর দিকে তাকালো। মুখ গোমড়া করে ভ্রু কুঁচকালো। কি আশ্চর্য! দিচ্ছে না কেন গোলাপ? ভাবনার আকুল পাথারেই তুষার গোলাপগুলোর একটি হৈমন্তীর কানে গুঁজে দিলো হঠাৎ। বাকিগুলোও এগিয়ে দিলো। হৈমন্তী কাঁপা হাতে নিলো তা। তুষার চোখ বন্ধ করে প্রশান্তিময় এক নিশ্বাস ফেললো। চোখ মেলে বাদামী মণিজোড়া সামনে স্থির করলো। নিমগ্ন স্বরে অনুভূতিপ্রবণ হয়ে বলতে লাগল,
— “হৈমন্তীকা, আমাদের বিয়ের দিন রাতে আমরা এভাবেই হাতে হাত রেখে রাস্তায় হাঁটবো। আপনি লাল রঙের শাড়ি পড়বেন। আমি নির্নিমেষ চেয়ে রব। আপনি লজ্জায় মাথা নিচু করে লাজুক হাসবেন। আমায় আহত করে ক্ষত-বিক্ষত করে দেবেন। আমি বেসামাল হয়ে যাবো। শতভাগ অধিকার নিয়ে আপনাকে ছুঁবো। অধর ছোঁয়াবো আপনার ললাটে, ওষ্ঠে। আপনি কি তখন আমাকে বাঁধা দেবেন হৈমন্তীকা? ভয় পাবেন আমার হতে?”

বলে গভীর চোখে তাকালো সে। হৈমন্তীর গলা শুকিয়ে গেল। ওষ্ঠদ্বয় কেঁপে উঠল। কি বলবে সে? প্রতিউত্তরে কি বলা যায়? ছেলেটা এসব কথা বলছে কেন?
উত্তর না পেয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলল তুষার। কিছুসময় নিশ্চুপ থেকে হঠাৎ-ই উদাসীন চোখে আকাশ পানে চাইলো। গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলো,

মন ভাবে তারে,
এই মেঘলা দিনে।
শীতল কুয়াশাতে,
তার স্পর্শে।

মন ভাবে তারে,
এই মেঘলা দিনে।
শীতল কুয়াশাতে,
তার স্পর্শে।

তার রুমঝুম নুপুরের সাজে,
বাতাসে জেন মৃদু সুবাসে।

নিটল পায়ে রিনিক-ঝিনিক,
পায়েলখানি বাজে।
মাদল বাজে সেই সঙ্গেতে
শ্যামা মেয়ে নাচে।

রক্তিম মুখশ্রী নিয়ে আশেপাশে তাকালো হৈমন্তী। সবাই তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। কেউ হাসছে, কেউ অবাক হয়ে দেখছে, কেউ মুগ্ধ হচ্ছে, কেউ-বা বিরক্ত হচ্ছে। অথচ সেসবে খেয়াল নেই তুষারের। তার হাত শক্ত করে ধরে অবিরাম গেয়ে যাচ্ছে সে।

_____

আজ একটু দেড়ি করেই বাসায় ফিরলেন আসরাফ সাহেব। দরজা খুলে বাবার হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা হাতে নিলো হৈমন্তী। আসরাফ সাহেব শুধু একপলক তাকালেন। কিছু বললেন না। গম্ভীর অভিব্যক্তি নিয়ে জুতা খুললেন। ভেতরে ঢুকে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন। হৈমন্তী বাজারের ব্যাগটা রান্নাঘরে রেখে আবারও ছুটে এলো বাবার কাছে। জগ থেকে পানি ঢেলে গ্লাস এগিয়ে দিলো। আসরাফ সাহেব চুপচাপ গ্লাস নিয়ে পানি পান করলেন। হৈমন্তী হাসফাস করছে। মনে সাহস জুগিয়ে মিনমিনিয়ে ডাকল, “বাবা—।”

আসরাফ সাহেব উত্তর দিলেন না। একটু থেমে জড়োসড়ো কণ্ঠে হৈমন্তী আবার বললো,
— “হেমন্তের আগের মাসের বেতন দেওয়া হয় নি। এ মাসেরটাও দেওয়া হয় নি। ওর স্কুলের বেতন দেওয়া লাগবে।”
আসরাফের সাহেবের থমথমে গলা,
— “কত টাকা?”
— “এক হাজারের মতো।”
— “বেতন পেয়ে নি। দিয়ে দেবো।”

বলে আর বসলেন না তিনি। ক্লান্ত শরীর নিয়ে রুমে চলে গেলেন। ছাদ থেকে একটু পরই রাবেয়া আসলেন। সদর দরজার সামনে স্বামীর জুতো দেখে প্রশ্ন করলেন,
— “তোর বাবা চলে এসেছে?”
— “হ্যাঁ।”
হাতের কাপড়গুলো সোফায় রাখতে রাখতে তিনি আবার বললেন,
— “সকালে ওমন পাগলের মতো কোথায় গিয়েছিলি রে?”
হৈমন্তীর আমতা আমতা কণ্ঠস্বর, “ওই আরকি— একটু কাজ ছিল।”

শুনে হতাশ হয়ে কাপড় ভাঁজ করতে লাগলেন রাবেয়া। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু বললেন,
— “যা-ই করছিস হৈমন্তী, ভেবে-চিন্তে করিস।”

_____

রাত পৌনে বারোটা। ঘুম নেই হৈমন্তীর আঁখিপল্লবে। সে নিশ্চুপ, নির্বাক হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে। হালকা শীত শীত করছে। বাতাসের প্রভাব একটু বেশিই এখন। পরনের ওড়না ছড়িয়ে পুরো শরীর ঢেকে নিলো হৈমন্তী। এদিক-ওদিক তাকালো। হঠাৎ ল্যাম্পপোস্টের দিকে নজর গেল তার। আধো আধো পুরুষালী অবয় দেখা যাচ্ছে। হৈমন্তী প্রথমে ভাবলো, ওটা তুষার। কিন্তু সে ভুল। চোখের দৃষ্টি আরেকটু মনোযোগী হতেই বুঝতে পেল, ওটা নাওয়াজ। হৈমন্তী ভড়কালো। নাওয়াজ এত রাতে এখানে কি করছে? সে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে আবার তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে ম্লান হাসলো নাওয়াজ। হাত নাড়ালো। হৈমন্তী পাত্তা দিলো না। প্রচন্ড অস্বস্তিতে মন বিষিয়ে গেল। মেজাজ খারাপ হলো খুব। বারান্দায় আর না দাঁড়িয়ে দ্রুত রুমে ঢুকলো। বিছানার কোণে বসে পুরো এক গ্লাস পানি পান করলো। তুষারের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হলো খুব। বালিশের নিচ হতে ফোন বের করলো হৈমন্তী। তিনবার রিং হতেই কল রিভিস হলো। ওপাশ থেকে ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে তুষার বললো, “বলুন, হৈমন্তীকা।”

হৈমন্তী যেন শান্ত হয়ে গেল মুহুর্তেই। ভয়, অস্বস্থি, খারাপ লাগা নিমিষেই হারিয়ে গেল। ক্ষীণ আওয়াজে জিজ্ঞেস করলো সে,
— “ঘুমিয়ে গেছেন?”
জবাবে তার বেখেয়ালি উত্তর,
— “কিভাবে ঘুমাবো? আপনি তো ঘুমাতে দিচ্ছেন না। বিরক্ত করছেন ভীষণ। এত বিরক্ত কেন করেন হৈমন্তীকা?”

হৈমন্তী ভাবলো, হয়তো কল দেওয়ায় ঘুম ভেঙ্গে গেছে তুষারের। তাই সে তার প্রতি বিরক্ত। হৈমন্তীর মন খারাপ হলো। বললো, “তাহলে কল কেটে দেব?”
ওপাশ থেকে তুষারের ঘন নিশ্বাস ফেলার শব্দ পাওয়া গেল, “কল কেটে দিলেই-বা কি হবে হৈমন্তীকা? আমার অস্তিত্ব থেকে কি আলাদা করতে পারবেন নিজেকে?”

__________________

চলবে~

হৈমন্তীকা

৩১.
দু’টো মাসে নিজের হিংস্রতা দিয়ে অতিষ্ঠ করে দেওয়া নিষ্ঠুর, পাষাণ গ্রীষ্ম বিদায় নিয়েছে আজ প্রায় অনেকদিন। পৃথিবীতে আষাঢ় নেমেছে। নেমেছে বর্ষা। ঘন কালো মেঘের ভেলায় ঢেকে আছে বিশাল নভস্থল। এ সময় ফাঁকফোঁকর দিয়ে সোনালী রোদ্দুরের দেখা পাওয়া যে বড্ড কষ্টকর। বাজ পরছে। হুটহাট বৃষ্টিতে অপ্রস্তুত হচ্ছে মানুষ। বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ কানে বাজছে। ব্যাঙেদের ডাক শোনা যাচ্ছে। ঘ্যাঙরঘ্যাঙ, ঘ্যাঙরঘ্যাঙ। তুষার বাইক সাইড করে হৈমন্তীকে নিয়ে বাসস্টপের ছাউনিতে দাঁড়ালো। একহাতে নিজের ভেঁজা চুল ঝারতে লাগলো। পকেট থেকে মানিব্যাগ আর মোবাইল বের করে বললো, “এগুলো আপনার ব্যাগে রাখুন হৈমন্তীকা। পানিতে নষ্ট হয়ে যাবে।”

হৈমন্তী মাথা দুলালো। মানিব্যাগ আর মোবাইল রাখতে গিয়ে হঠাৎ-ই মানিব্যাগের ক্ষীণ ফাঁক দিয়ে অস্পষ্ট মেয়েলি ছবির অস্তিত্ব টের পেল। কৌতুহল বশত পুরো মানিব্যাগ খুললো সে। সঙ্গে সঙ্গে নিজের হাসোজ্জল ছবি ভেসে উঠল আঁখিজোড়ার সামনে। হৈমন্তী একহাত গালে ঠেকিয়ে বসে আছে। অন্যদিকে তাকিয়ে হাসছে। পরনে হলুদ রঙের তাঁতের শাড়ি।
তার মনে পরে গেল, নবীন বরণের দিন ঠিক এই শাড়িটি পরেই এভাবে অনমনা হয়ে বসে ছিল সে। মাঝে মাঝে পারুর কথায় হাসছিল। তারপর তো এ শাড়ি পরার আর সুযোগই পায় নি সে। তুষার কখন তার এ ছবি তুললো? হৈমন্তী বুঝলো না কেন?
হঠাৎ তুষারের গম্ভীর গলায় ঘোর কাটলো তার, “আমি আমার বউ ছাড়া ব্যক্তিগত জিনিস কাউকে ধরার অধিকার দেই নি, হৈমন্তীকা। ওগুলো ব্যাগে রাখুন।”

শুনে ভ্রু কুঁচকাল হৈমন্তী। ব্যাগের চেন আটকালো। বিমূঢ় কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
— “আমি আপনার বউ নই?”
— “হ্যাঁ। তবে পঞ্চাশ ভাগ। শতভাগ বউ করে নেই, তারপর এই আমিকেই দিয়ে দেবো আপনাকে।”

হৈমন্তী পিটপিট নয়নে এদিক-ওদিক তাকালো। নিশ্বাসের গতি অল্প কমলো। ইদানিং তুষার আশেপাশে থাকলে হৈমন্তীর লজ্জা মিশ্রিত অনুভূতি অনুভূত হয়। উপরন্তু তুষারের এহেন কথায় লজ্জা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। নাকের দু’পাশ সামান্য কেঁপে উঠে। তুষার আপাদমস্তক দেখলো তাকে। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। আলতো করে নাক টেনে বললো,
— “মুখ তো লাল হয়ে টমেটো দেখাচ্ছে। এত লজ্জা কোথা থেকে পান হৈমন্তীকা?”

হৈমন্তী জবাব দেয় না। মনে ভয়াবহ জোড় লাগিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ফলাফল শুণ্যই রয়ে যায়। তুষার দু’কদম এগিয়ে আসে। মাথার ঘোমটা-টি সাবধানে ফেলে দেয়। ওড়নার কোণাংশের বেশ খানিকটা হাতে পেঁচিয়ে স্বস্নেহে হৈমন্তীর কালো ঘন কেশ মুছে দিতে থাকে। হৈমন্তী নিশ্চুপ, চুপচাপ হতজানু হয়ে আছে। প্রখর অনুভূতিতে নিজেকে কেমন অনুভূতি শূণ্য মনে হচ্ছে। মৃদু, মৃদু কেঁপে উঠছে শরীর।

মাথায় আবারও ঘোমটা টেনে সরে এলো তুষার। পরনের ভেঁজা শার্ট-টা গায়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। কলারটা একটু টেনে প্যান্টের পকেটে হাত রেখে সটান হয়ে দাঁড়ালো সে। অবিরাম বৃষ্টিধারার দিকে তাকিয়ে একমনে বলতে লাগলো,
— “বৃষ্টি বেড়ে যাক, আপনি থেকে যান আরেকটু সময়।”

_____

সন্ধ্যার দিকে নাওয়াজ আর তার পরিবার এলো আসরাফ সাহেবের বাসায়। সঙ্গে করে চার-পাঁচেক মিষ্টির প্যাকেট, ফল-মূল আর কেকও এনেছেন। হৈমন্তী জানতো না ওরা এসেছে। নিজ রুমে মনোযোগ সহকারে বই পড়ছিল সে। হঠাৎ রাবেয়ার আগমন ঘটলো সেখানে। কোনোরুপ কথা না বলে তিনি আলমারির কাছে এগোলেন। একে একে গোছানো কাপড়গুলো উল্টেপাল্টে দেখলেন। সর্বশেষে তুষারের দেওয়া সেই নীল রঙা শাড়িটি হাতে নিয়ে হৈমন্তীর দিকে এগিয়ে এলেন। চিন্তিত সুরে বললেন,
— “শাড়িটা পড়ে দ্রুত রেডি হয়ে নেয় হৈমন্তী। দেড়ি করিস না। উঠ!”

হৈমন্তী উঠে দাঁড়ালো। শাড়ি হাতে নিলো। প্রশ্নবিদ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— “হঠাৎ রেডি কেন? কোথাও যাবে?”
— “হ্যাঁ।”
— “কিন্তু তাই বলে শাড়ি পড়তে হবে কেন? একটা কামিজ বের করে দাও।”
রাবেয়া চোখ রাঙালেন,
— “এত কথা বলিস কেন? এক কথায় হয় না? যা তাড়াতাড়ি রেডি হ!”

বলে চলে গেলেন রাবেয়া। হৈমন্তী হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল মায়ের যাওয়ার পানে। অতঃপর বাধ্য মেয়ের মতো তৈরি হয়ে নিলো।
কিছুক্ষণ পর রাবেয়া আবার এলেন। মেয়ের অল্প সাজসজ্জা দেখে রেগে গেলেও পরক্ষণে কি ভেবে মন গলে গেল উনার। এগিয়ে এসে হৈমন্তীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। পরম মমতাময় কণ্ঠে বললেন,
— “আমার মেয়েটা বড় হয়ে গেছে। কি সুন্দর দেখাচ্ছে! মাশাল্লাহ।”
তারপর একটু থেমে হেমন্তকে বললেন,
— “রুম থেকে বের হবি না। চুপচাপ পড়ালেখা কর।”

মায়ের ব্যবহার কেমন অস্বাভাবিক ঠেকলো হৈমন্তীর কাছে। কিন্তু কিছু বলতেও পারলো না সে। তার কিছু মুহুর্ত পর ড্রইংরুমে পা রাখতেই সবকিছু ঠাওর হলো মস্তিষ্কে। শরীর অবশ হয়ে গেল। নাওয়াজের পরিবার দেখতে এসেছে তাকে। আসরাফ সাহেব কি দারুণ প্রফুল্লতার সঙ্গে নাওয়াজের বাবার সঙ্গে কথা বলছেন! হাসি যেন সরতেই চাইছে না ঠোঁট হতে। হৈমন্তীর গলা শুকিয়ে গেল। পা এগাতে চাইলো না। রাবেয়া জোড় করে টেনে নিয়ে গেলেন তাকে। নাওয়াজের সামনা-সামনি বসানোর পূর্বে মৃদু স্বরে কানে ফিসফিসিয়ে বললেন, “উলটাপালটা কিছু করবি না হৈমন্তী। তোর বাবার এই হাসিটা আবারও হারাতে দিস না।”

এই এইটুকু বাক্যে আর কোনো মতবাদ প্রকাশের ইচ্ছেটুকু তৎক্ষণাৎ মিইয়ে গেল হৈমন্তীর। সে চুপচাপ সব হজম করে নিলো। নাওয়াজ তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ণ হাসি লেগে আছে। বড়দের আলোচনায় একবারও চোখ তুলে তাকালো না হৈমন্তী। তুষারের দেওয়া শাড়ি পরে যেখানে তার তুষারের সঙ্গে থাকার কথা ছিল, সেখানে নাওয়াজের দেওয়া আংটি অনামিকা আঙুলে পরিধান করতে হলো তাকে। সে সময়টা ছিল হৈমন্তীর জন্য সবচেয়ে করুণ, মর্মান্তিক মুহুর্ত। নেত্রকোণে জমা হয়েছিল ক্ষীণ বিন্দু কণার জল।

আংটি পড়ানো শেষে নাওয়াজ আর হৈমন্তীকে আলাদা কথা বলতে পাঠানো হয় তার রুমের বারান্দায়। হৈমন্তী কথা বলছে না। নাওয়াজ বরাবরই নিষ্পলক চেয়ে আছে তার মুখপানে। অস্বস্থিতে, ঘৃণায় আর রাগে শক্ত হয়ে আছে হৈমন্তী। নাওয়াজ কিছু বলছে না দেখে ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠে,
— “আপনি এমন কেন করেছেন, নাওয়াজ ভাইয়া?”
নাওয়াজ যেন বুঝলো না,
— “কি করেছি?”

হৈমন্তী অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো,
— “কি করেছেন জানেন না? আপনাকে বলেছিলাম আমার আর তুষারের বিয়ে হয়ে গেছে। তবুও কোন মনমানসিকতায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন আপনি?”

নাওয়াজ অবুজ চোখে তাকালো। হেসে বললো, “তুমি মিথ্যা বলছো। এমন কখনোই হতে পারে না। দেখ হৈমন্তী, আমি জানি তুমি আমাকে তেমন পছন্দ করো না। তাই বলে যে একদম অপছন্দ করো তা কিন্তু না। একটু বোঝার চেষ্টা করো আমাকে। আমি তোমাকে সুখে রাখবো।”
হৈমন্তীর অধৈর্য গলা,
— “আপনি কি বাংলা কথা বুঝেন না? কোনো কালেই আপনাকে পছন্দ নয় আমার। বিরক্তিকর লাগে আপনাকে। আমি শুধু তুষারকে ভালোবাসি। আর ওর সাথে আমার আইনত বিয়েও হয়েছে।”

নাওয়াজের মুখশ্রী করুণতায় ভরে গেল। হাসার চেষ্টা করে বললো,
— “আমি বিশ্বাস করি না। তুমি মিথ্যে বলছো।”
— “আপনাকে মিথ্যে বলে আমার কি লাভ? তবুও আপনার বিশ্বাস না হলে আপনাকে রেজেস্ট্রি পেপারের ছবি দেখাতে পারি। দেখতে চান?”

নাওয়াজের চোয়াল শক্ত। চোখে জলের স্বতঃস্ফূর্ত আভাস। কাঁপা স্বরে সে বললো,
— “তুমি সত্যিই তৈমুরকে ভালোবাসো?”
— “হ্যাঁ।”
— “আঙ্কেলকে কিছু জানিয়েছ এ ব্যাপারে? আঙ্কেলকে কিভাবে মানাবে?”

হৈমন্তীর কঠিন গলার উত্তর,
— “তা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি শুধু বিয়েটা ভেঙ্গে দিন। আমি উপকৃত হবো।”

সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে ফেলল নাওয়াজ। নিদারুণ কণ্ঠে বিড়বিড়িয়ে উঠলো,
— “আমার ভালোবাসা একপাক্ষিক রয়ে গেল, হৈমন্তী। আমি তোমায় আমার করে পেলাম না।”

________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা