হ্যপি নিউ ইয়ার পর্ব-০১

0
4

#হ্যপি_নিউ_ইয়ার(ছোটগল্প)
#অনিমা_হাসান

প্রবাস জীবনে দেশের মতন করে নতুন বছর উদযাপন করতে না পারার প্রধান অন্তরায় হল বৈরী আবহাওয়া। ক্রিসমাসে বরফ না থাকলে এদেশের মানুষের মন খারাপ হয়ে যায়। এ বছর বোধহয় বিধাতা তাদের মন ভালো করার জন্যই বিশাল এক তুষার ঝরের আয়োজন করে ফেললেন। স্কাররোরো শহরের তুষারপাত এ বছর বিগত চল্লিশ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে।

তুষারপাত আমি বরাবরই ভীষণ অপছন্দ করি। বাড়ির উঠান, পার্কিং লট, সিঁড়ি এসবের বরফ পরিষ্কার করতে করতে কোমর ধরে যায়। এত বছরেও অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারিনি। মাঝে মাঝে মনে হয় এদেশে বাড়ি থাকাটা একটা অভিশাপ। প্রতি শীতেই আমি অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকি কবে সামার আসবে।

আমার বাড়ির উল্টোদিকের বাড়িটাতে নতুন প্রতিবেশী উঠেছেন। কর্তা গিন্নিকে প্রায়ই দেখি উঠোনে কাজ করতে, আর কাউকে বিশেষ দেখা যায় না। কাজে যাবার সময় একবার আলাপ হয়েছিল ভদ্রলোকের সঙ্গে। দেখতে বেশ সুদর্শন এবং ভীষণ অমায়িক। তাদের একমাত্র কন্যা ওয়াটার লু ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ছুটি ছাটায় আসে। অনেকদিন ধরেই চিন্তা করছিলাম ভদ্রলোককে একদিন বাড়িতে নিমন্ত্রণ করবো; নিউ ইয়ার উপলক্ষে সেই সুযোগটা পেয়ে গেলাম।
শীতের দিনগুলোতে আমাদের, মানে প্রবাসী বাঙ্গালীদের করার তেমন কিছু থাকে না বলে আমরা প্রচুর নিমন্ত্রণ করি একে অপরকে। নিউ ইয়ার উপলক্ষে আমি আমার সকল অফিস কলিগ, আর কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু বান্ধবের সাথে আমার প্রতিবেশী ভদ্রলোককে নিমন্ত্রণ করলাম।
আমি একটা কুকি ফ্যাক্টরিতে কাজ করি। প্রথমে যখন এসেছিলাম এখানেই কাজ নিয়েছিলাম, তখন ভেবেছিলাম কিছুদিন পর বদলে ফেলব, কিন্তু সুপারভাইজার বাঙালি হওয়াতে আর স্যালারিটা ও ভালো হওয়ার দরুন চাকরি আর বদলাতে হয়নি॥ এখানে প্রচুর বাঙালি কাজ করে। বেশ অনেকদিন ধরে চাকরি করাতে সবার সঙ্গেই একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, অনেকটা একটা পরিবারের মতন।

প্রতিবছরের মতন এবারেও আমি নিউ ইয়ার উপলক্ষে সবাইকে দাওয়াত করে ফেললাম। আমার স্ত্রীর রান্না চমৎকার, বাড়িতে দাওয়াত হলে সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে আসে। আজও তাই হয়েছে। সন্ধ্যা নাগাদ আসর জমে উঠেছে। বাইরে প্রবল তুষারপাত হচ্ছে ড্রয়িং রুমে ছেলেরা সবাই বসেছি, ভাবীরা ভেতরের ঘরে আর বাচ্চারা উপর তলায়। আমার স্ত্রী শায়লা চা পিয়াজু আর মাংসের পুর দেয়া সিঙ্গারা দিয়ে গেছে। গল্প জমে উঠেছে। এখানে আমরা সবাই পূর্ব পরিচিত, একই অফিসে চাকরি করি, শুধু আমার প্রতিবেশী ভদ্রলোকের সঙ্গে সবাইকে আলাপ করিয়ে দিতে হলো। ভদ্রলোকের নাম মুনির আহমেদ চৌধুরী। ইউনিভার্সিটি অফ টরেন্টতে অধ্যাপনা করছেন। চমৎকার করে কথা বলেন সারাক্ষণই মুখে একটা মিটিমিটি হাসি লেগেই থাকে। বয়স ৪৫ এর কাছাকাছি হবে। চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা। চমৎকার স্বাস্থ্য, দেখলে বোঝা যায় নিয়মিত শরীর চর্চা করেন, কাঁচা পাকা চুল। বয়স লুকানোর কোন চেষ্টা নেই। এতে তার সৌন্দর্য কিংবা ব্যক্তিত্ব কোনটাই কমেনি বরং বেড়েছে।

রাতের খাবারের এখনো অনেক দেরি। আমার জুনিয়ার মাসুদ হঠাৎ বলল
– চলুন আজকে সবার জীবনের গল্প শোনা যাক।
সবাই একটু নড়ে চড়ে বসলো। ঠিক হলো প্রত্যেকেই তার জীবনের প্রথম প্রেম এবং বিয়ের গল্প বলবে। আমরা এখানে মোট সাত জন আছি। প্রথমেই শুরু হল মাসুদকে দিয়ে, কারণ প্রস্তাবটা ওই করেছে। মাসুদের পেটের মধ্যে গল্পগুলো বোধহয় গুড় গুড় করছিল বের হয়ে আসার জন্য। মাসুদ প্রবল উৎসাহ নিয়ে ওর প্রেম এবং বিয়ের গল্প বলল। এমনকি মোবাইল বের করে প্রেম চলাকালীন সময়কার ছবি এবং বিয়ের ছবিও দেখালো। এরপর সানজিদের পালা। সানজিদ একটু ঠোঁট কাটা ধরনের ছেলে, ওর মুখে কিছু আটকায় না, তবে ওর গল্পটাও মজার ছিল। দুর্দান্ত প্রেমের গল্প। বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছিল। পুরোই হিন্দি সিনেমা। একে একে সবার গল্প বলা হলো। বাকি রইল শুধু মুনির স্যার আর আমাদের বস শওকত ভাই। শওকত ভাই একটু রাশভারী ধরনের লোক। তবুও সানজিদ সহস করে তার কাছে গল্পটা জানতে চেয়েই ফেলল। শওকত ভাইয়ের সোজা সাপ্টা উত্তর তার জীবনে কোন প্রেম নেই, একবারে দেখে শুনে বাবা-মা বিয়ে করিয়ে দিয়েছেন; প্রেম যা হয়েছে তা বিয়ের পরেই। শওকত ভাইয়ের কাছ থেকে অবশ্য আমরা এর বেশি কিছু আশা ও করিনি। বলা হয়নি এর মধ্যে সবাই আমাকেও চেপে ধরেছিল। আমার আর শায়লার গল্পটাও আমাকে বলতে হয়েছে। সবার গল্প শেষ হয়ে গেলে আমরা মুনির সাহেবকে ধরলাম। আমাদের মধ্যে মাসুদের বয়সই সবচেয়ে কম। ও বলল
– স্যার এবার আপনার গল্পটা কিন্তু বলতে হবে।
ভদ্রলোক হেসে ফেললেন; বলতে দ্বিধা নেই ভদ্রলোকের হাসি অসম্ভব সুন্দর। উনি বললেন
– প্রথমে আমাকে স্যার বলা বন্ধ করুন। আমি আপনাদের স্যর নই। মুনির ভাই বলতে পারেন। আমি বললাম
– আচ্ছা মুনির ভাই এবার আপনার গল্পটা বলুন।
– সবার অনুমতি থাকলে বলতে পারি।
সবাই তো শোনার জন্য লাফিয়ে ছিলামই, এমনকি শওকত ভাইও বললেন
– অবশ্যই বলুন।
ভদ্রলোক আয়েশ করে শুরু করলেন

আমার প্রথম প্রেমের গল্পটা একটু অদ্ভুত, কারণ আমি ওর প্রেমে পড়েছিলাম ওকে না দেখেই। যে সময়কার কথা বলছি তখন আমি চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। আমার বাড়ি ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দসই সাবজেক্ট না পাওয়ায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালযয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। হলে থাকতাম। তখন সবে সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছি। বরাবরই আমি একটু পড়ুয়া ধরনের ছাত্র। ফার্স্ট ইয়ার ফাইনালে রেজাল্ট অস্বাভাবিক ভালো হয়ে যাবার কারণে পড়াশোনাটা খুব সিরিয়াসলি নিয়েছিলাম। সারাদিন ক্লাস করতাম, বিকেলে লাইব্রেরীতে বসে নোট তৈরি করতাম তারপর গভীর রাত পর্যন্ত জেগে পড়াশোনা করতাম। আমার রুমমেট ছিল পলিটিক্যাল সাইন্সের নাসিম। আমার রাত জেগে পড়াশোনায় ও খুব বিরক্ত হতো।

নাসিম খুব আড্ডাবাজ ধরণের ছেলে ছিল। সারাদিন হৈ-হুল্লোড় করে বেড়াতো। মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে রাত জেগে গল্প করত, সেই গল্পের বেশিরভাগটা জুড়েই থাকতো ওর প্রেমিকা সোহানির গল্প। বছরখানেকের মধ্যে আমাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠলো। আমরা বেশ ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম।

ওই দিনটার কথা আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, তখন কেবল শীতের শুরু একদিন রাতে আমি কম্বল গায়ে জড়িয়ে বসে পড়াশোনা করছিলাম এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করছিলাম নাসিম নিজেও টেবিলে বসে কিছু লেখার চেষ্টা করছে। রাত প্রায় দেড়টার দিকে ও আমার কাছে এসে অনুনয় করে বলল
– দোস্ত একটা হেল্প করবি?
আমি অবাক হয়ে বললাম
– কি?
– একটা প্রেম পত্র লেখসি, একটু চেক কইরা দিবি?
– প্রেমপত্র তো খুব পার্সোনাল জিনিস, এটা তুই আমাকে দিয়ে চেক করাবি? তাছাড়া তোর প্রেমপত্র লেখার দরকার কি? একটু আগেই তো সোহানার সঙ্গে দেখা হলো।
– এইটা সোহানার জন্য না, এইটা অন্য পার্টি
আমার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। আমি বললাম

– নিজের প্রেম পত্র নিজে চেক কর, আমাকে দেখাতে আসিস না।
এরপর কয়েকদিন নাসিমের সঙ্গে আর কথা হলো না। সপ্তাহখানেক পর নাসিম আমার কাছে এসে কাঁদো কাঁদো হয়ে জানাল ওর ব্রেকআপ হয়ে গেছে। আরো কয়েকদিন পর নাসিম আবার আমার কাছে এলো প্রেমপত্রের কারেকশন নিয়ে। এবারে আমি আর কিছু বললাম না, মনে হল এমনিতেই বেচারার ব্রেকআপ হয়ে গেছে। এখন কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাক, কিন্তু সেই প্রেমপত্র পড়ে আমার কান গরম হয়ে গেল। কানের চেয়েও বেশি গরম হলো মেজাজ। আমি ওকে বললাম
– এই প্রেমপত্র তুই ওই মেয়েকে পাঠাবি?
– হ্যাঁ কেন, কি হইসে? একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে?
– একটু না অনেক বাড়াবাড়ি হয়েছে। আমি ওই মেয়ের জায়গায় হলে ট্রেন ভাড়া করে এসে তোকে জুতা দিয়ে পিটাতাম
– এমন তো কিছু লিখিনি। শুধু ব্রেসিয়ারের সাইজ জানতে চেয়েছি. এটা কি খুব বেশি বাড়াবাড়ি ?
– শুধু বাড়াবাড়ি নয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এইসব ফালতু বিষয় নিয়ে আমার কাছে আর আসবি না। নিজে যা পারিস কর
এরপর নাসিম দুইদিন আমার পেছনে পড়ে রইল ওর হয়ে চিঠিটা লিখে দেয়ার জন্য। প্রথমে আমি রাজী হলাম না। সময়টা ১৯৯৯ সন, তখন এখনকার মতন এরকম হাতে হাতে মোবাইল থাকত না; কাজেই চিঠি লেখা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। অনেকক্ষণ ঝোলা ঝুলির পর আমি নাসিমের প্রস্তাবে রাজি হলাম।

এভাবে কারো সম্পর্কে কিছু না জেনে তো আর চিঠি লেখা যায় না তাই আমি সেই মেয়ের সম্পর্কে জানতে চাইলাম। নাসিম জানাল ওর নাম অনিমা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়ে। ওখানেই হলে থাকে। নাসিম আরো জানালো অনিমা ওর এক বন্ধুর খালাতো বোন। বন্ধুর বাড়িতেই দাওয়াতে দেখা হয়েছিল, দেখে ভীষণ ভালো লেগেছে তারপর একদিন ফোনে কথা হয়েছে। তখনই বলেছে চিঠি লেখার কথা। নাসিম চিঠি না লিখে নিউ ইয়ারে ওকে একটা ভিষন দামি কার্ড গিফট করেছে। তারই জবাবস্বরূপ অনিমা ওকে এক বিশাল চিঠি লিখে পাঠিয়েছে। সেই চিঠির জবাব এ নাসিমা একটা চিঠি লেখার চেষ্টা করেছে কিন্তু আমার মতে চিঠিটা অত্যন্ত অশ্লীল।

আমি এই জীবনে কোনদিন প্রেম পত্র লিখিনি। প্রেমপত্র তো দূরে থাক কাউকে কোনদিন চিঠিই লিখিনি। আমার বাবা-মা আর ছোট বোন থাকে ঢাকায়। সপ্তাহে দুদিন ফোনে তাদের সঙ্গে কথা হয়। চিঠি লিখে সময় নষ্ট করতে ওনারাই আমাকে মানা করেছেন। তবে চিঠি না লিখলেও আমি প্রচুর বই পড়েছি। বই পড়া ছাড়া আমার অন্য আর কোন শখ নেই। সাহিত্য বিজ্ঞান, ফিকশন, নন-ফিকশন এমন কোন টপিক নেই যেটা আমি পড়িনি। কাজেই চিঠি লিখতে গিয়ে তেমন কোন সমস্যা হলো না। কলম কামড়ে বসে থাকতে হলো না। একবার লেখা শুরু করার পর কি করে যেন লেখাটা চলতেই থাকলো। প্রথম চিঠিতে আমি খুব বেশি কিছু লিখলাম না। ওর কুশল জানতে চাইলাম। এখানকার জীবনের দু একটা গল্প করলাম, কেমন করে আমরা ট্রেনে করে ইউনিভার্সিটিতে যাই, খানিকটা প্রকৃতির বর্ণনা দিলাম। সবমিলিয়ে খারাপ হলো না। শেষ করে আমি নাসিমকে বললাম, এটা যেন কপি করে পাঠিয়ে দেয়।
একটা মজার ব্যাপার হল চিঠিতে কিন্তু প্রেমের কোন আভাস ছিল না, খানিকটা বন্ধুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার ছিল; সম্ভবত এই বিষয়টি ওর খুব ভালো লেগেছিল। এটা বুঝতে পারলাম যখন চিঠির জবাব এলো তিন দিনের মাথায়। এবারেও নাসিম আমার শরণাপন্ন হল। আমার লেখা প্রথম চিঠির জবাবে কি লিখেছে সেই কৌতূহলেই চিঠিটা পড়া হলো এবং পড়ার পর জবাব না লেখা পর্যন্ত নাসিম আমাকে ছাড়লো না।
বেশ কিছুদিন এভাবে চলার পর আমি একদিন নাসিমকে জিজ্ঞেস করলাম এতে কোন ওর কি লাভ হচ্ছে। চিঠি আমি লিখে দিচ্ছি জবাবও পাঠাচ্ছে। নাসিম জানাল ও প্রতি সপ্তাহে দুইবার ওকে ফোন করে। যদিও বেশিরভাগ সময়ই কথা হয় চিঠি সংক্রান্ত, বেশিরভাগ সময়েই কানেকশন ভাল থাকেনা। অনিমা হলের কয়েন ফোন দিয়ে ফোন করে। ওকে বলেছিল দোকান থেকে ফোন করতে কিন্তু ও বলেছে ওর অসুবিধা হয়। দোকানদার হা করে তাকিয়ে থাকে।

শীত গড়িয়ে গ্রীষ্ম চলে এলো। আমার মিড টার্ম পরীক্ষা শুরু হয়েছে।। আমি পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।এ সময় চিঠি লিখে সময় নষ্ট করার মতন সময় আমার নেই। কিন্তু আমি খুব আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম আমার কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। পড়ায় মন বসাতে পারছি না। লজ্জার মাথা খেয়ে একদিন নাসিমকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম যে ওর আর চিঠি এসেছে কিনা। নাসিম জানালো ফোনে কথা হয়েছে ওর শরীর খারাপ। জ্বর এসেছে কদিন ধরে তাই চিঠি লিখতে পারছে না। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। বেচারি জ্বরে পড়ে আছে, এ সময় নাসিমের উচিত একটা বড় করে চিঠি লেখা অথচ ও কিছুই করছে না। তখনই মনে পড়লো, ও তো কিছু করতে পারবে না, যা করার করতে হবে আমাকে। আমি নাসিমকে বললাম
– তুই সুন্দর করে একটা চিঠি লেখ। জ্বরের মধ্যে চিঠি পেলে ওর মন ভালো হয়ে যাবে।
আমি জানতাম নাসিম আবারো আমাকে চেপে ধরবে। এবারে আমি মনে মনে প্রস্তুতই ছিলাম। আমি লিখলাম

অনিমা অনিমা
গত চিঠিতে লিখেছো তোমার শরীর খারাপ কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তোমার শুধু শরীর খারাপ নয়, তোমার মনও খারাপ। আমার ধারনা যদি সত্যি হয় তাহলে এখন তুমি চাদর মুড়ি দিয়ে অন্ধকারে টর্চা লাইট জ্বেলে আমার লেখা পড়ছো। বেশি রাত জেগো না, আর অন্ধকারে পড়তে নেই, মাথা ব্যথা করবে, এমনিতেই তোমার মাইগ্রেনের সমস্যা। বাইরের দেশগুলোতে অডিও বুক নামে একটা জিনিস এখন ভীষণ চলছে। বইগুলো কেউ পড়ে শোনায় তোমার কষ্ট করে পড়তে হবে না। তুমি শুধু অডিও চালু করে গল্পটা শুনবে। মজার না?

আমাদের এখানে ভীষণ গরম পড়েছে ঢাকাতেও নিশ্চয়ই তাই, আবার মাঝে মাঝে বৃষ্টিও হয়। খুব মেঘ করে যখন বৃষ্টি নামে আমার তোমার কথা খুব মনে পড়ে। তুমি লিখেছিলে আকাশ যখন মেঘ করে ঘন অন্ধকারে ছেয়ে যায় তখন তোমার আমার কথা মনে পড়ে। আরো লিখেছিলে ঝকঝকে নীল আকাশে অনেক মেঘের মধ্যে যখন আমরা আমাদের প্রিয়জনের মুখ খুঁজি তুমি সে সময় আমাকে দেখতে পাও। সত্যি করে বলতো তুমি কি সত্যিই আমাকে দেখতে পাও? আমি তো সব সময় মেঘের মধ্যে বিশাল বিশাল সব হাতি আর জলহস্তী দেখি, মাঝে মাঝে অবশ্য হাঙরও দেখতে পাই। তুমি নিশ্চয়ই আমাকে সেই হোঁতকা পেটুক হাঙরের মতন দেখ না। তবে তোমাকে একটা মজার কথা বলি। আমাদের এখানে একটা পুকুর আছে, সেই স্বচ্ছ পুকুরের জলে আমি যখন তাকাই আমি তোমার মুখ দেখতে পাই। আমি তো কখনো তোমাকে দেখিনি তাই কল্পনায় তোমার মুখ দেখি।

পাশে থেকে নাসিম বলল “এটা কি লিখেছিস? আমি তো ওকে দেখেছি”। আমি আমি লিখতে লিখতে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম, হঠাৎ করে সম্বিত ফিরে পেয়ে ধাতস্থ হয়ে আবার লিখলাম। তোমাকে অবশ্য অনেক আগে দেখেছি। মাঝে মাঝে মনে হয় “তোমাকে দেখেছি সেই কবে কোন বৃহস্পতিবার তারপর এক কোটি বছর তোমাকে দেখি না”।

এলেবেলে কথা বলে আর তোমার মাথা ধরিয়ে দেব না। তোমার জন্য একটা বই পাঠাচ্ছি। এই বইটা পড়ো। আমার ভীষণ প্রিয় একটা বই।
আর একটা কথা বলে শেষ করব। আমি জানি বৃষ্টি তোমার ভীষণ প্রিয় তবে এখন বৃষ্টিতে ভিজে আবার ঠান্ডা বাধিও না।। ভালো থেকো, আর দ্রুত সুস্থ হয়ে আমাকে আবার চিঠি লিখা শুরু করো। তোমার চিঠি না পেলে নিজেকে খুব অসম্পূর্ণ লাগে।

ইতি তোমার নাসিম

লেখা শেষ করে চিঠিটা নাসিমের হাতে দিয়ে বললাম
– একটু বড় হয়ে গেল দোস্ত। কষ্ট করে কপি করে নিস। নাসিম আমার পিঠ চাপড়ে বলল
– দোস্ত তুই যা লেখস না, একদম সুরসুরি উঠায়ে দেওয়ার মতন।
– মানে?
মানে, এই যে দুইবার নামটা লেখস, আরে দোস! কি কমু একদম অর্গাজম হয়ে যাওয়ার মতন
আমার মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। এত চমৎকার একটা মেয়ে অথচ কিসের পাল্লায় পড়েছে। এর জন্য কি আমি দায়ী?

পরের পর্বে সমাপ্ত