হ্যপি নিউ ইয়ার পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
2

দ্বিতীয় এবং শেষ পর্ব

আমি তীব্র অপরাধবোধে দগ্ধ হতে লাগলাম। ওকে আর চিঠি পাঠাবো না বলে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম। নাসিমকে সত্যিকারভাবে জেনে, ও যদি ওর সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতে চায় তাহলে আমার তো কোন অসুবিধা নেই। আমি ওদের দুজনের মাঝখানে আসতে চাই না; যদিও ওকে একবার দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমি কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারছিলাম না। এই চিন্তাটা জোর করে মাথা থেকে সরিয়ে নাসিমকে যখন চিঠি না লেখার কথাটা জানালাম তখন ওর চোয়াল ঝুলে পড়ল। ও কাতর গলায় বলল
– দোস্ত, এইভাবে গাছে ওঠাইয়া মই টাইনা নেওয়াটা কি ঠিক।? আর কয়টা মাসের মামলা একটু কোঅপারেট কর
– আর কয় মাস পর কি হবে?
– আমি ওর লগে দেখা করতে যামু। তখন সব বইলা দিমু। তর লগেও আলাপ করায়া দিমু। দেখবি তখন কত হাসবো আমরা সবাই। এইতো আর কয়টা দিন দোস্ত, একটু ওয়েট কর।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার সেই অজানা পথে হাঁটার জন্য পা বাড়ালাম, যার কোন গন্তব্য নেই।
আবার শুরু হলো আমাদের পত্র বিনিময়। আমি ধীরে ধীরে লক্ষ্য করছিলাম মেয়েটা নাসিমের মানে আমার প্রতি কেমন যেন মানসিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিল। ছোট ছোট সমস্যার কথা চিঠিতে লিখত, কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না পারলে সেটাও জানাত। এরমধ্যে একদিন চিঠির একটা কথা আমাকে খুব নাড়া দিয়ে গেল। ও লিখেছে আমার যখন খুব মন খারাপ হয় আমার তোমাকে চিঠি লিখতে ইচ্ছা করে, খুব জা্নাতে ইচ্ছা করে তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে কিন্তু আমি ফোন করি না। ফোনে করলে তোমাকে কেমন অচেনা লাগে।

তখন প্রকৃতি হেমন্ত শেষে শীতের আগমনী বার্তা জানান দিয়ে যাচ্ছে। চারিদিক কুয়াশাচ্ছন্ন, তার থেকেও বেশি কুয়াশায় ছেয়ে আছে আমার মন। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি আর এসবের মধ্যে থাকবো না। ফোনে নাসিমের সঙ্গে ওর সম্পর্কের গভীরতা কতখানি আমি জানিনা, নাসিম ওকে কতটা বুঝিয়ে বলতে পারবে সেটাও জানি না, তবে একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পারছি ও যতটা না জড়িয়ে যাচ্ছে তার থেকে অনেক বেশি জড়িয়ে যাচ্ছি আমি নিজে। আমার জীবনে অন্য কেউ নেই। যদি থাকত তাহলে হয়তো বিষয়টা অন্যরকম হতো।
আমার ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা চলে এসেছে। এই অজুহাতে এসব থেকে বেরিয়ে আসবো বলে ঠিক করলাম। আমি ভেবেছিলাম নাসিম এটা জানালে হয়তো ঝামেলা করবে কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ও বলল
সমস্যা নাই আর কয়দিনের তো ব্যাপার।
আমি জোর করে অনিমাকে আমার মাথা থেকে সরিয়ে দিয়ে পরীক্ষায় মন দিলাম। পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই ঢাকার টিকেট কাটলাম; কেন যেন এখানে আর ভালো লাগছিল না। মনে হল একবার বাবা মার সঙ্গে দেখা করে আসি।

ঢাকার উদ্দেশ্যে যেদিন রওনা দেব সেদিন অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম নাসিমো তৈরি হয়ে আমার সঙ্গে যাচ্ছে। আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
– তুমি কোথায় যাচ্ছিস ঢাকায়
– ঢাকায়। কেন?
– তোর বাড়িতে এখানে
– যাই একটু ডার্লিং এর সঙ্গে সময় কাটাইয়া আসি
– ঢাকায় কোথায় উঠবি? তোর না কেউ নেই ওখানে
– হোটেলে উঠুম। ডার্লিংরেও ডাইকা লুম
আমি কিছু বললাম না ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম। নাসিম হাসতে হাসতে বলল
– আরে ফাইজলামি করতাছি দোস্ত। ফাইনাল কিছু তো আর করতে দিব না, এই হালকার উপর ঝাপসা যা পারি আরকি

আমি আর কিছু বললাম না। সত্যি কথা বলতে কি আমার খুব খারাপ লাগছিল। কেন এত খারাপ লাগছিল নিজেই বুঝতে পারছিলাম না। ঢাকা যাচ্ছি প্রায় বছরখানেক পর, এর মধ্যে দুবার বাবা-মা এসে দেখা করে গেছে। বাড়িতে এসে ভীষণ ভালো লাগছিল আমার পুরনো ঘর, বইয়ের আলমারি, পড়ার টেবিল বারান্দায় রাখা আমার ছোট ছোট গাছগুলো এখনো সেরকমই আছে। ছোট বোন নাজমা এই গাছগুলোর ভীষণ যত্ন নেয়। আসার পরপরই ওর সঙ্গে খানিকক্ষণ ঝগড়া হলো। আগে প্রতিদিন ওর সঙ্গে ঝগড়া না করলে আমাদের রাতে ঘুম হতো না। ভেবেছিলাম এতদিন পর দেখা হচ্ছে হয়তো জড়িয়ে ধরে কাঁদবে কিন্তু তা না আসতে না আসতেই ঝগড়া শুরু করে দিল।
সবাইকে পেয়ে আমার নিভে যাওয়া মনটা ভালো হয়ে গেল। জোর করে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম যে ওদের দুজনের দেখা হবে নিশ্চই ওরাও ভালো থাকবে।

ডিসেম্বর মাস শেষ হয়ে এসেছে। নিউ ইয়ার চলে এসেছে। সনটা ১৯৯৯। পুরো একটা মেলিনিয়াম পার হয়ে যাচ্ছে, তাই নিউ ইয়ার নিয়ে সবার উত্তেজনা অন্যরকম এই বছর। আমি বরাবরই একটু লাজুক অন্তরমুখী মানুষ। এসব হৈ হুল্লোড় আমার ভালো লাগেনা, তাই নিউ ইয়ার নিয়ে আমার মধ্যে কোর,বাড়তি উত্তেজনা নেই। এদিকে নাজমা লাফিয়ে আছে থার্টিফার্স্ট নাইটে বাইরে যাবে বলে, বাবার কাছ থেকে অনুমতি পায়নি বলে আমাকে এসে ধরেছে। আমি পরিষ্কার জানিয়ে দিলাম এই বিষয়ে আমি কিছু করতে পারবো না। এক তারিখে কোন বন্ধুর বাসায় যেতে চাইলে তার জন্য সাহায্য করতে পারি কিন্তু থার্টি ফার্স্টে বাইরে থাকার ব্যাপারে আমি কোন সাহায্য করতে পারব না। নাজমা মন খারাপ করে চলে গেল। আমার একটু খারাপই লেগেছিল তখন কিন্তু এক তারিখ সকাল বেলা উঠে মনে হল ওকে বাইরে যেতে না দিয়ে বেশ ভালো হয়েছে।

ঢাকার টিএসসিতে থার্টিফার্স্ট নাইটে ভাল রকমের ঝামেলা হয়েছে। বাধন নামের এক মেয়েকে নিয়ে নানান কেলেঙ্কারি কথা পত্রিকায় উঠে এসেছে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে নানান রকমের ঘটনা ঘটেছে বলেও পত্রপত্রিকায় এসেছে। এক তারিখ সকালে নাজমা আবার এসে আমাকে ধরল। বিকেলবেলা ওর এক বান্ধবীর বাসায় গেট টুগেদার আছে সেখানে পৌছে দিতে হবে।

কিন্তু দুপুরের পর ঘটলো অন্য ঘটনা। ভাত খেয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম সেই সময় নাসিমের ফোন এলো। জানাল আজ বিকেলে ওরা ধানমন্ডি লেকে দেখা করবে। আমি একটু নিশ্চিন্ত বোধ করলাম। যাক, তার মানে হোটেলে দেখা করার ব্যাপারটা রসিকতা ছিল কিংবা অনিমা রাজি হয়নি।

আমি এসবের মধ্যে আর জড়াতে চাইছিলাম না। এখন তো ওদের মধ্যে সব ঠিকই হয়ে যাবে। সামনাসামনি একজন মানুষের আবেদনই অন্যরকম, এই কটা চিঠি লিখে আর কি এমন সম্পর্ক তৈরি হয়। তাছাড়া নাসিম দেখতে অসম্ভব সুদর্শন ওকে একবার দেখার পর যে কোন মেয়ে ওর প্রেমে পড়তে বাধ্য। কিন্তু নাসিম কোন রকম ঝুঁকি নিতে চাইল না, বলল আমাকে ওদের সঙ্গে যেতে হবে। আজই পুরো ব্যাপারটা এসপারসপার করে ফেলতে চায় ও। চিঠি লিখতে আমি ওকে একটু সাহায্য করেছি এই ব্যাপারটা বলা পর্যন্তই আমার পার্ট। তারপর আমার যবনিকা পাত। আমারও মনে হল এটাই তো হওয়া উচিত। একটা সম্পর্ক শুরু হলে তার মধ্যে স্বচ্ছতা থাকাটা জরুরি,তাই আমি রাজি হয়ে গেলাম।

এত বছর পর আসলে আর লুকানোর কিছু নেই, সত্যি কথাটা আপনাদের বলি। ওকে একবার দেখার একটা প্রবল ইচ্ছা আমার মধ্যে ছিল। আমার কল্পনায় ওর একটা রূপ ছিল। আমি মিলিয়ে দেখতে চাইছিলাম আমার কল্পনার সঙ্গে সেটা কতটুকু মেলে। তাই যথাসময়ে আমি নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে গেলাম।

আমার সময় জ্ঞান সবসময়ই বেশ প্রখর। চারটা বাজার দশ মিনিট আগেই পৌঁছে গেলাম। তখনো দুজনের কেউই এসে পৌঁছায়নি। লেকের পাশের এই জায়গাটা বেশ সুন্দর। একটা বাঁধানো চত্বর, আশেপাশে কিছু ছোটখাট দোকান। আমার ডানদিকে একজন বসেছে ফুল নিয়ে অন্যদিকে একজন বিশাল আকৃতির ফ্লাক্সে করে চা বিক্রি করছে। এখনকার মতন এত রেস্টুরেন্ট তখন ছিল না। ঝকঝকে বিকেল হলেও রাতের নানান ঘটনার কারণেই বোধহয় পার্কে খুব বেশি কপোত কপোতি দেখা গেল না।
আমার সময় কাটছিল না, বারবার ঘড়ি দেখছিলাম। প্রথমবার দেখা করতে এসেছি বলে আমি ওর জন্য একটা বই নিয়ে এসেছিলাম সেটাই খুলে পড়ার চেষ্টা করছিলাম। খুব আহামরি কোন বই না হুমায়ূন আহমেদের “তোমাকে”, আমার ভীষণ প্রিয় একটা বই। পড়তে পড়তেই টের পেলাম কেউ একজন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। খুব মৃদু একটা সুগন্ধ ভেসে এলো, অনেকটা বুনো ফুলের মতন। আমি মুখ তুলে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। এত মায়াবী, সারল্যে ভরা মুখ আমি আগে কোনদিন দেখিনি। মেয়েটা খুব সাধারণ পোশাক পরে এসেছে, সাদার উপর হলুদ ফুল তোলা জামা, শীত বলেই বোধহয় একটা বাসন্তী রঙের শাল জড়িয়েছে। ওকে দেখে আমার মনে হল একগুচ্ছ সোনালী সোনালু ফুল। আমাকে অবাক করে দিয়েও ও হাসিমুখে বলল
– নাসিম ?
আমি বিব্রত মুখে বললাম
– আমি নাসিম নই, নাসিম এক্ষুনি চলে আসবে
– তাহলে তুমি কে?
আমি নাসিমের বন্ধু। আমার নাম মুনির
– তুমি নিশ্চয়ই অনিমা। তোমার কথা অনেক শুনেছি নাসিমের কাছে
মেয়েটা কেমন অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
আমি আবারো ঘড়ি দেখলাম। ৪ টা ২০ বাজে নাসিমটা যে কেন এখনো আসছে না। বললাম
– তুমি বসো। চা খাবে?
আমি পাশের চা ওয়ালাকে ডেকে বললাম
– ভাই বেশি করে লেবু দিয়ে একটা রং চা দেন তো
অনিমা কাপ হাতে নিয়ে বসতে যাবে তখন আমি বললাম
– অনিমা একটু দাড়াও, এখানে বাদামের খোসা পড়ে আছে তোমার না বাদামে এলার্জি। আমি হাত দিয়ে ঝেড়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে দিলাম। ও বসে চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলল
– এই খেলাটা তুমি আর কতক্ষণ খেলবে?
আমি অবাক হয়ে বললাম
– কিসের খেলা?
– তুমি নাসিম না এটা প্রমান করার খেলা
আমার নিজের উপরই বিরক্ত লাগছে। কেন যে এসব বলতে গেলাম। এলার্জির ব্যাপারটা একটু সিরিয়াস বলেই বলেছিলাম তা না হলে কোনদিনও বলতাম না। আমি পরাজিত ভঙ্গিতে বললাম
– অনিমা, আমি সত্যিই নাসিম না। আমি আর নাসিম একই রুমে থাকি। ও তোমার ব্যাপারে অনেক গল্প করে সেই থেকেই তোমার ব্যাপারে আমার একটু ধারণা জন্মেছে
– ধারণা?
একথা বলে ও আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি আর কিছু বলবো না বলে ঠিক করলাম। যত কথা বলছি ততই জড়িয়ে যাচ্ছি। নাসিমের বাচ্চাটা যে কেন এখনো আসছে না।
অনিমা কিছু বলল না, চুপচাপ চা খেতে শেষ করল।
একবার ভাবলাম বইটা ওকে দেই, পরমুহূর্তেই মনে হলো, না থাক, এই বইটা নিয়ে চিঠিতে একবার ওর সঙ্গে অনেক আলোচনা হয়েছিল, আবার কি থেকে কি বুঝে ফেলে।

বেশ কিছুক্ষণ আমরা কেউ কোনো কথা বললাম না। আমি বারবার ঘড়ি দেখছি। সাড়ে চারটার বেশি বেজে গেছে এখনো নাসিমের আসার কোন নাম নেই। অনেকক্ষণ পর অনিমা হঠাৎ করে বলল
– আকাশে কি সুন্দর মেঘ দেখেছো
আমি আনমনা করে বললাম হু
– তুমি একবার আমাকে ক্লাউড হান্টিং এর কথা লিখেছিলে মনে আছে? আচ্ছা তুমি কি এখনও ওই পুকুরটার মধ্যে আমাকে দেখতে পাও?
আমি জবাব দিলাম না। অনিমা মন খারাপ করা গলায় বলল
– ঐ পুকুরে আমাকে যেমন দেখতে, আমি কি তেমন না? তার থেকে খারাপ?
আমি পাশে তাকিয়ে দেখলাম, ও আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি ওর চোখে চোখ রেখে বললাম
– অনিমা আমি নাসিম না
মুহূর্তে ও চোখ ছল ছল করে উঠলো। ও ভেজা কন্ঠে বলল
– আমাকে কি তোমার এত খারাপ লেগেছে যে তুমি নাসিম এটা স্বীকার করতেও তোমার ইচ্ছা করছে না। আমি তো তোমার কাছে কিছু চাইনি কিন্তু এই মিথ্যা নাটকের তো কোন দরকার নেই। অনিমা উঠে দাঁড়ালো
আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার কারণে ওদের প্ল্যানটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি আবার ঘড়ি দেখলাম, পাঁচটা বেজে গেছে। নাসিম এখনো আসছে না। কি যে করি। আমি ওর হাত ধরে বললাম
– আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। কাঁদতে হবে না বসো। উই ক্যন টক আবাউট ইট
অনিমা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বলল
– তোমার হাতে ওটা কি
– বই। তোমার জন্য এনেছিলাম। এই বলে আমি বইটা এগিয়ে দিলাম। বইটা হাতে নিয়ে ও উল্টেপাল্টে দেখল। বলল
– তুমি এখনো বলবে তুমি নাসিম না?
আমি অসহায় কন্ঠে বললাম
– আমি আসলেই নাসির না অনিমা
– আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে এখানে এটা লিখে দাও।
ও বইটা খুলে উৎসর্গের পাতাটা আমার দিকে এগিয়ে দিল, সেই সঙ্গে একটা কলমও দিল
আমি লিখলাম “অনিমা অনিমা, আমি সত্যি বলছি আমি নাসির নই”। বইটা ওকে ফিরিয়ে দিয়ে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম, এবার নিশ্চয়ই ও বিশ্বাস করবে। ও অনেকক্ষণ লেখাটার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম ওর মুখের মেঘ কেটে গেছে। পুরো মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে যাচ্ছে। তখন বিকেলের আলোর মতে আসতে শুরু করেছে। শেষ বিকেলের কমলা রঙয়ের রোদ ওর মুখের উপর এসে পড়েছে। সেই কনে দেখা আলোয় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দিশেহারা বোধ করলাম।
ও আমার চোখে চোখ রেখে বলল
এখনো স্বীকার করবে না? এই এক বছর ধরে আমি তোমার হাতে লেখা দেখছি, আর আমি চিনতে পারব না।
আমার মেরুদন্ডদ বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। তার মানে ওই বদমাইশের বাচ্চা নাসিম আমার চিঠিগুলো কপি করেনি, যেমন ছিল তেমনি পাঠিয়ে দিয়েছে। আর আমার কোন পথ নেই। আমি উঠে দাঁড়ালাম।

এতটুকু বলে ভদ্রলোক থামলেন আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতন শুনছিলাম। আমি আর থাকতে না পেরে বললাম
– তারপর, তারপর কি হলো?
– তারপর ও উঠে এসে আমার হাত ধরে বলল “চলো
– আর আপনি? আপনি কি করলেন?
ভদ্রলোক হাসতে হাসতে বললেন
– আমি আর কি করবো ? গত পঁচিশ বছর ধরে সেই হাত ধরেই আছি।
– ইয়েস! ভাই, এ তো ফাটাফাটি অবস্থা
আমার পাশে থেকে সাঞ্জিদ বলল
– আর ওই সালা নাসিমের কি হইল?

নাসিম আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ করেনি। হলে ফেরার পর দেখলাম ও হল ছেড়ে দিয়েছে। তবে হলে ফেরার কদিন পর সোহানি এসেছিল। ওর কাছেই জানতে পারলাম আসলে ওদের ব্রেকাপ হয়নি। সম্ভবত নাসিম আমাকে দিয়ে চিঠিগুলো লেখানোর জন্য মিথ্যা কথা বলেছিল। সোহানি আরো জানাল নিউ ইয়ারে ও নিজেও ঢাকায় গিয়েছিল। ওখানে ওর এক বন্ধুর কাছ থেকে জানতে পারে নাসিম তার খালাতো বোনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে। ওকে হাতেনাতে ধরার জন্য ওরা সেদিন ধানমন্ডি লেকে গিয়েছিল এবং যাবার পর ওকে খুঁজেও পেয়েছিল।
তারপর?
তারপর আর কি? নাসিম নাকি ওদের দেখিয়েছে যে ওখানে ও নয় আমি একজনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। ওর কোন দোষ নেই। সম্পর্কটা ওর সঙ্গে নয় আমার সঙ্গে। তাই ওদের ব্রেকআপটা আর হয়নি।
সঞ্জিদ বরাবরই ঠোঁট কাটা এবং মারদাঙ্গা ধরনের ছেলে, ও হঠাৎ করেই বলে উঠলো
-হারামজাদা কত বড় শয়তান। ওই মাঙ্গের পোলারে পাইলে…
আমি সানজিদকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। সামনেই আমাদের বস বসে আছেন এর মধ্যে ও এসব কি শুরু করেছে। সানজিদ এর কথা শুনে হঠাৎ করে শওকত স্যার ভীষণ রকম কাশতে আরম্ভ করলেন। আমি দ্রুত পানি নিয়ে এসে তাকে খাওয়ালাম। ঠিক সেই সময়েই বিদ্যুৎ চমকের মতন আমার মনে পড়ল যে আমার বসের নাম শওকত ওসমান। ডাক নাম নাসিম। তবে কি উনি সেই নাসিম!?

সমাপ্ত
হ্যপি নিউ ইয়ার