১৫ বছর বয়সী মা পর্ব-১৮+১৯

0
26

#১৫_বছর_বয়সী_মা (১৮)
#সোফিয়া_সাফা

লজ্জার চাপে অলি যেন জমে গেছে। পা দুটোও নড়ছে না।বেশ কিছুক্ষণ সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকার পর অবশেষে সে নিজেকে সামলে নিয়ে, মাথা নিচু করে একছুটে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমের দিকে রওনা দিলো। পথে ঊর্মিলা আর রূপসার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেলো। ঊর্মিলা হাত দিয়ে মুখ চেপে কোনোরকমে হাসি আটকানোর চেষ্টা করছে, আর রূপসা রাগী চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তবে সেটা নিছক রাগ নয়—তার চোখদুটো চিকচিক করছে, ঠোঁট কেঁপে উঠছে কান্না চেপে রাখার চেষ্টায়। তবে অলি সেসব লক্ষ্য করেনি। সে ভীষণ অপ্রস্তুত, সে পুনরায় পা ফেলে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো।

এদিকে আলভীর কথাগুলো স্পষ্ট শুনেছেন শাহানাজ বেগম, রুনা খাতুন আর নূরনাহার। তাঁরা রান্নাঘর থেকে সবাইকে দেখতে এসেছিলেন, কিন্তু এসব কথা শুনে থমকে যান জায়গাতেই। পরিস্থিতি সামাল দিতে আমেনা খাতুন এগিয়ে এসে হাসিমুখে বললেন,
“আপা, ভালোই তো হয়েছে। বৌভাত খেতে এসেছিলাম, এখন তো একেবারে নাতি-নাতনির আগমনের খুশির খবরও শুনে গেলাম! ঘটনাটা এতোটা প্যাচালো সেইজন্যই বুঝি ফোনে কিছুই বলেননি?”

শাহানাজ বেগম কিছু না বলেই দাঁড়িয়ে রইলেন। পাশে থাকা নূরনাহার হেসে পরিস্থিতি বদলানোর চেষ্টা করলেন,
“আরে হ্যাঁ, সেই জন্যই তো। ভাবী, আগে আসুন, হাতমুখ ধুয়ে একটু নাস্তা করুন। বাকি সব কথা বলার জন্য ব্যাপক সময় আছে।”

অন্যদিকে অলি বিছানায় বসে নিজের নখ কামড়ে চলেছে। আলভী কীভাবে এমন গুছিয়ে একটা গল্প বানালো, সেটাই তাকে ভাবিয়ে তুলছে।
“লোকটা অনেক ডেঞ্জারাস…” নিজমনেই বিড়বিড় করলো সে।

“নখ খাচ্ছো কেনো? ক্ষুধা লেগেছে নাকি?”

আলভীর গলা শুনে অলি চমকে তাকায় দরজার দিকে। সদ্য শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে আলভী। পরনে সাদা টি-শার্ট, কালো ট্রাউজার। সিল্কি ভেজা চুলগুলো কপালের ওপর এলোমেলো। অলির বুকের ভেতর ধক করে উঠলো, অজান্তেই মুখ থেকে আঙুল সরিয়ে নিলো সে। আলভী হালকা গলায় বললো,
“নখ খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না,”

অলি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“আপনার আত্মীয়রা হঠাৎ করে না বলেই এসে পড়লো কেনো?”

“কাল আমাদের রিসেপশন। তাই এসেছেন। আর এমনি এমনি আসেনি, তাদের ইনভাইট করা হয়েছে।”

অলি খানিকটা অবাক হলো,
“আমাকে তো কেউ কিছুই বললো না!”

“সকালে বলার জন্যই এসেছিলাম, কিন্তু কথায় কথায় ভুলে গেছি।”

“ওহ…”

“তোমার বাবা-মাকে আসতে বলো।”

“না, তাদের আসতে হবে না। বাবা আজ আসতে চেয়েছিলেন, আমিই নিষেধ করেছি।”

আলভীর কপাল কুঁচকে গেলো,
“কেনো? তুমি আসতে নিষেধ করেছো কেনো?”

অলি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
“আমি চাই না, তারা আবার অপমানিত হোক।”

আলভী বুঝে গেলো অলির ভেতরের কষ্টটা।
“দেখো অলি, আমি তো আছি। কেউ কিছু বলবে না। তাদের আসতে বলো।”

“না, আমি চাইনা আপনি সবাইকে ভয় দেখিয়ে তাদেরকে অপমানিত হওয়া থেকে বাচান। আমি চাই তারা এমনিতেই সম্মান পাক, কিন্তু সেটা আশা করাটাও ভুল।”

আলভী শান্ত গলায় বললো,
“তারা না এলে দেখতেও খারাপ দেখাবে। তুমি তো তাদের একমাত্র মেয়ে, তাদেরও তো মন চায় তোমাকে দেখতে। অপমানিত হবার ভয়ে তারা কি না এসে থাকতে পারবে?”

“দেখুন আমি যখন বলে দিয়েছি যে তারা আসবেনা তো তারা আসবেনা এমনিতেও আগামী কালকে আমার সেখানে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিলো। এখন যেহেতু কালকে অনুষ্ঠান আছে সেহেতু পরশুদিন যাবো।”

এই কথা শুনে আলভী যেন চমকে উঠলো,
“তুমি যাবে কেনো?”

অলি ভ্রুদ্বয় কুঞ্চিত করে বললো,
“এতে আবার কেনোর কি আছে? আমি কি একেবারে এসে পড়েছি নাকি? তাছাড়া এই বাড়িতে আমার ভালো লাগছেনা”

আলভী একটা ঢোক গিললো। অলি চলে যাবে শুনে তার হার্টবিট বেড়ে গেছে। এই মেয়েটা যদি চলেই যাবে তাহলে এসেছিলোই বা কেনো? সে তো রেখে আসতেই চেয়েছিলো।
“আচ্ছা তো তুমি বেড়াতে যেতে চাইছো তাইনা?”

অলি সরু চোখে আলভীর দিকে তাকালো। আলভী তড়িৎ গতিতে চোখ সরিয়ে নিলো। অলি সোজাসাপ্টা ভাবে বলে ওঠে,
“আমার বাড়িতে আমিই কেনো বেড়াতে যাবো? আমি তো এখানে বেড়াতে এসেছিলাম”

“তো তোমার বেড়ানো শেষ?”

অলি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো। আলভী অন্যদিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো,
“আবার কবে বেড়াতে আসবে?”

অলি কিছুক্ষণ উপরের দিকে তাকিয়ে ভাবনা চিন্তা করে নির্লিপ্ত সুরে বললো,
“একমাস পর এসে আবার একদিন থেকে যাবো”

এই কথাটা শুনে আলভী একদম স্থির হয়ে গেলো। মনে হলো কেউ যেনো বুক থেকে এক ঝটকায় হৃদপিন্ডটাকে বের করে নিয়েছে। এই মেয়ে হয়তো একদিন সত্যি সত্যিই তার হার্ট অ্যাটাক করিয়ে ছাড়বে। আলভী নিজেকে এবার আর স্বাভাবিক রাখতে পারলোনা সে অলির দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললো,
“আমি তো তোমাকে সাথে করে আনতেই চাইনি। তুমিই জোর করে এসেছিলে। যাক যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন একটা কথা শুনে রাখো এই বাড়িতে এসেছো নিজের ইচ্ছায় কিন্তু বের হবে আমার ইচ্ছায়। যদি আমার অনুমতি ব্যতীত একপা এই বাড়ির বাইরে রাখার সাহস দেখিয়েছো তাহলে আর কখনো এই বাড়িতে ঢুকতে পারবেনা। বলে দিলাম”

কথাটা শুনে অলি হতভম্ব হয়ে গেলো,
“এটা আবার কেমন কথা? আপনি আমাকে জোর করে আটকে রাখবেন নাকি?”

“না, শুধু সতর্ক করে দিলাম। এটা তোমার মামাবাড়ি নয় যে ইচ্ছে হলেই একদিনের জন্য বেড়াতে আসবে।”

আলভীর রাগীকন্ঠ শুনে অলি ঠোঁট চেপে মাথা নিচু করে নিলো। ফলস্বরূপ আলভীর রাগ হাওয়া হয়ে যায়। আলভী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কন্ঠে কোমলতা এনে বলে,
“আমি তোমাকে যেতে নিষেধ করিনি। তুমি চাইলে বেড়াতে যেতে পারো। তবে কয়দিনের জন্য যাবে সেটা ডিসাইড করো আগে”

অলি ক্ষীণ গলায় বললো,
“আপনি তো আনতেই চাননি আমাকে, আমি নিজে থেকে এসেছি। সেই হিসেবে আমি যেখানেই থাকিনা কেনো আপনার কি সমস্যা?”

আলভী একমূহুর্ত চুপ থেকে বলে ওঠে,
“বললাম তো এসেছো তোমার ইচ্ছায়, বের হবে আমার ইচ্ছায়।”

অলি তড়াক করে আলভীর চোখে চোখ রেখে বলে ওঠে,
“তাহলে আপনার ইচ্ছাটা কি সেটা আগে বলুন”

আলভী থমকে গেলো। সত্যিই তো, তার ইচ্ছাটা কী? সে কেনো এত প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে? অলি তো ছোট মেয়ে, তার বাবা-মার কাছে ফিরে যেতে চাওয়াটা তো অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এই সহজ কথাটাই যেনো তার মনটা মানতে চাইছেনা সে বুঝে গিয়েছে যে এই মেয়েটাকে ছাড়া সে থাকতে পারবেনা। আলভী কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,
“দেখো ভুলটা তোমার ছিলো আমার সাথে এসে তুমি ভুল করেছো।”

অলি হতবাক। কিছুই বুঝতে পারছেনা,
“আমি আপনার সাথে এসে ঠিক কি ভুল করেছি বলবেন আমাকে?”

জবাব না দিয়ে আলভী উঠে দাঁড়ালো। পকেট থেকে একটা ফোন বের করে অলির কোলের উপর রাখলো।
“এটা তোমার ফোন। আজই কিনেছি। বাবামায়ের সঙ্গে কথা বলো যতবার খুশি। ভিডিও কল দাও, চাইলে ওদের এখানে এনে রাখো। অনেক গুলো অপশন আছে যেকোনো একটা বেছে নেও—শুধু বাড়ি থেকে বের হবে না।”

অলি ফোনটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো। গাল ফুলিয়ে বললো,
“আমি তো এই ফোন চালাতে পারিনা। আর তাছাড়া আমার বাবা মায়ের কাছে এই ফোন নেই। আমি কিভাবে ভিডিও কলে কথা বলবো?”

আলভী একটা শ্বাস ফেলে বললো,
“এখন এমনি নম্বরে কল দিয়ে কথা বলো। পরে ভেবে দেখছি কি করা যায়”

অলি ফোনটা আলভীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“কল দিয়ে দিন”

আলভী ফোনটা হাতে নিয়ে বিরবির করে বললো,
“যাক মেয়েটার মাথা থেকে বাড়িতে যাওয়ার ভূতটা আপাতত নেমেছে”

আলভী অলির বাবার নম্বরে কল দিয়ে ফোনটা অলির দিকে এগিয়ে দিলো। অলি হাসিমুখে ফোনটা নিয়ে বাবার সাথে কথা বলতে লাগলো। আলভী পুরোটা সময় নিষ্পলক ভাবে অলির দিকে তাকিয়ে রইলো। কথা বলা শেষে অলি আলভীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“ধন্যবাদ”

আলভী ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ফর হোয়াট?”

অলি মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
“ফোনের জন্য। আমার অনেক দিনের শখ ছিলো এমন একটা ফোন চালানোর”

“এটা চালানোর জন্য দেইনি। শুধু বাবা মায়ের সাথে কথা বলার জন্য দিয়েছি”

অলির হাসি থেমে গেলো। অলির রিয়েকশন দেখে আলভী বলে ওঠে,
“তোমার এখনো ফোন চালানোর বয়স হয়নি। তবে বিশেষ প্রয়োজনে ফোনটা দিয়েছি।”

অলি মুখে কিছু না বলে ফোনটা দেখতে লাগলো। ফোনের পেছনে একটা আপেলের লোগো আছে। যেটা দেখে অলি অবাক হয়ে গেলো,
“এটা তো আইফোন।”

আলভী মাথা নেড়ে বললো,
“হুম সো হোয়াট?”

অলি বড়বড় চোখে আলভীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনি এতো দামি ফোন আমাকে কেনো দিচ্ছেন?”

“ফোনের ব্যাপারে অনেক কিছুই জানো দেখছি। তাহলে ফোন চালাতে পারোনা কেনো?”

অলি মাথা নাড়িয়ে বললো,
“আমার বান্ধবী শায়লাদের বাড়িতে একবার গিয়েছিলাম সেখানে ওর বড় ভাইয়ের কাছে এই ফোনটা ছিলো। শায়লা আমাকে বলেছিলো এটা অনেক দামি ফোন ওর ভাই যখনই বাড়িতে আসে তখনই ও নাকি মাঝে মাঝে এটা দিয়ে ছবি তোলে। এটা দিয়ে নাকি অনেক ভালো ছবি তোলা যায়”

অলির কথা শুনে আলভীর মাঝে কৌতুহল কাজ করলো। সে হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করলো,
“তারপর তুমি তোমার বান্ধবীর ফোন দিয়ে ছবি তুলেছিলে তাইতো?”

অলি হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়িয়ে বললো,
“হ্যাঁ তুলেছিলাম তো সেদিন ওদের বাড়ির ছাদে গিয়ে আমরা দুজন অনেক ছবি তুলেছিলাম।”

কথাটা শুনে আলভী ভীষণ রেগে গেলো। সে কঠিন গলায় বলে ওঠে,
“তুমি কখনো শায়লার ভাইকে দেখেছো?”

অলি নাবোধক মাথা নাড়িয়ে বলে,
“না আমি শুধু একবারই ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম”

আলভী মনেমনে বলে ওঠে,
“এই মেয়েটা এতো বোকা কেনো? কথা তো বলে প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের মতো কিন্তু কাজগুলো করে একদম বাচ্চাদের মতো”

“কি ভাবছেন?”

আলভী সোজা হয়ে বসলো। গলা পরিষ্কার করে বললো,
“শায়লার ভাই কে সেটা জানো?”

অলি কপাল কুচকে বললো,
“বললাম তো আমি কখনো তাকে দেখিনি। সে অনেক ব্যস্ত থাকে। আর বেশিরভাগ সময় তাদের থেকে দূরে থাকে। তাহলে আমি জানবোই বা কিভাবে যে শায়লার ভাই কে? আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে শায়লার ভাইয়ের সম্পর্কে জেনে আমি করবো টাই বা কি?”

আলভী প্রথমে বিরবির করে বললো,
“ইডিয়েট,”

তারপর স্বাভাবিক স্বরেই বললো,
“তুমি জানোনা যে অপরিচিত কারো ফোন দিয়ে ছবি তুলতে নেই?”

“আরে ছবি তুলেছিলাম কিন্তু তারপর আবার শায়লাকে ডিলিট করে দিতে বলেছিলাম তো।”

“ও ডিলিট করেছিলো শুধু গ্যালারি থেকে কিন্তু trash bin থেকে করেনি।”

অলি আলভীর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়,
“গ্যালারি থেকে ডিলিট করার পরেও trash bin এ সেই ডিলিট কৃত ছবিটা ১ মাস সুরক্ষিত থাকে বুঝলে?”

কথাটা শুনে অলি চমকে তাকালো। সেই সাথে ভীষণ ভয় পেয়েও গেলো।
“আল্লাহ কি বলছেন? তার মানে,,, ধুর ভয় দেখাবেন নাতো। শায়লা নিশ্চয়ই ভালোভাবেই ডিলিট করে দিয়েছে”

“দেয়নি”

অলির হার্টবিট বেড়ে গেলো। এই লোকটা তাকে ভয় দেখাচ্ছে। অলি একটা ঢোক গিলে বললো,
“আপনি কিভাবে জানেন যে দেয়নি?”

“তুমি কিভাবে জানো যে দিয়েছে?”

“একদম আজেবাজে কথা বলবেন না। ও হয়তো ডিলিট করে দিয়েছিলো। আর আপনি তো বলেছেন যে ১মাস সুরক্ষিত থাকে তাহলে এতোদিনে নিশ্চয়ই অটোমেটিক ভাবে ডিলিট হয়ে গেছে”

আলভী কিছু বলতে চাইলে অলি বাধা দিয়ে বলে,
“আমাকে ভয় দেখাবেন না। যান এখান থেকে”

“ভয় দেখালাম কোথায়? আমি তো সত্যিটাই বলেছি। আর তুমি কি জানো যে একটা ছবি দিয়ে কি কি করা যায়?”

অলি একটা শুকনো ঢোক গিললো,
“শায়লার ভাই এরকম কিছু কেনো করবে তার সাথে তো আমার কোনো শত্রুতা নেই। আর তাছাড়া করার হলে অনেক আগেই করতো।”

আলভী আনমনেই বলে ওঠে,
“হুম করেছে তো যা করার করেছে”

অলি চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কি করেছে?”

আলভী বলতে চেয়েও বললোনা। সে ব্যাপারটা নিজেই দেখে নেবে। এমনিতেই অলি তাকে অপছন্দ করে তার উপর সেসব কথা বলে সে খাল কেটে কুমির আনতে চায়না।
“বাদ দেও। তোমার শরীর ঠিক আছেতো?”

অলি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো। তখনই ইশা, ঊর্মিলা, তিশা আর সামিরা অলির রুমে ঢুকলো। আলভীকে অলির রুমে দেখে ঊর্মিলা বললো,
“ভাইয়া এই রুমে তোর প্রবেশ নিষেধ,”

আলভী রাগী চোখে ঊর্মিলার দিকে তাকাতেই ঊর্মিলা সামিরার পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। সামিরা আর আলভী সমবয়সী। সামিরা ২ মাসের বড়। সেই হিসেবে আলভী সামিরাকে রাগ দেখাতে পারবেনা। সামিরা বুকে হাত বেধে শাসনের ভঙ্গিমায় বললো,
“ও ঠিকই বলেছে এভি। শুনলাম তুই নাকি রুম শেয়ার করতে পারবিনা বলে বউকে আলাদা রুমে রেখেছিস এটা কি সত্যি?”

আলভী গা ছাড়া ভাব নিয়ে বললো,
“হুম তো কি হয়েছে?”

“নাটক কম করো পিও। তুই এতো মহান হলে বউকে দেখে আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে গিয়েছিলি কিভাবে? তখন রুম শেয়ার করলি ক্যামনে?”

সামিরা থেমে গিয়ে কিছুক্ষণ পর বলে ওঠে,
“ওয়েট ব্যালকনি শেয়ার করেছিলি নাকি?”

সামিরার কথা শুনে অলি বিষম খেলো। বাকি সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। আলভী তো স্ট্যাচু হয়ে নিজের জায়গাতেই জমে গেছে,
“কথায় যুক্তি আছে। ভাইয়া এক্সপ্লেইন করো প্লিজ”

তিশার কথায় তাল মিলিয়ে ঊর্মিলা বললো,
“হুম হুম বল ভাইয়া। সবাইকে এক্সপ্লেইন কর।”

আলভী স্বাভাবিক স্বরেই বলে ওঠে,
“বড় ভাইয়ের সাথে এভাবে কথা বলতে লজ্জা করছেনা তোদের? ভাগ এখান থেকে নইলে সব কয়টাকে থাপ্পড় থেরাপি দেবো”

সামিরা এগিয়ে এসে বললো,
“অই আমি তোর বড় আফা। আমাকে তুই থাপ্পড় দিতে পারবিনা। এক্ষুনি রুম থেকে বের না হলে উল্টো আমিই তোর কান ধরে তোকে বের করে দেবো”

আলভী বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। বুকের উপর হাত বেধে ভ্রু কুচকে বলে,
“তাইনা, আচ্ছা কান ধর দেখি। তুই কতোবড় সেটা প্রমাণ হয়ে যাক”

সামিরা হতভম্ব হয়ে গেলো। বাকিরা তো হেসেই উঠলো। অলিও লজ্জা ভুলে মিটিমিটি হাসছে। সামিরা বেশ বুঝতে পেরেছে যে আলভী তার হাইট নিয়ে ঠাট্টা করেছে। সামিরা রেগেমেগে অলির দিকে এগিয়ে যায়। খপ করে অলির হাত ধরে অলিকে বেড থেকে নিচে নামায়। আলভী ভ্রু কুচকে সেদিকেই তাকিয়ে আছে,
“তুই এখানেই থাক। আমরা বরং তোর বউকেই নিয়ে যাচ্ছি”

আলভী ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই সামিরা অলিকে টেনে সাথে করে নিয়ে বেরিয়ে যায়। আলভী পেছন থেকে চেচিয়ে বলে ওঠে,
“ওই সাবধানে ধর, ওর শরীর ভালো নেই। ও ব্যাথা পেলে কিন্তু তোদের একটারও গাল সঠিক কন্ডিশনে থাকবেনা।”

ঊর্মিলা দাত কেলিয়ে বলে ওঠে,
“তুই এবার নিজের রুমে গিয়ে আরমসে ঘুম দে আজকে আর বউয়ের দেখা পেতে হবেনা।”

আলভী কিছু বলার আগেই ওরা ৪ জন অলিকে নিয়ে ঊর্মিলার রুমে চলে যায়। আলভী একটা শ্বাস ফেলে বেডের উপর তাকাতেই দেখে অলি ফোনটা এখানেই রেখে গেছে,
“ওহ গড, ফোনটাই সামলে রাখতে পারছেনা। এই মেয়ে বাচ্চা সামলাবে কেমনে?”

চলবে,,,

#১৫_বছর_বয়সী_মা (১৯)
#সোফিয়া_সাফা

রাত্রি তখন ১১টা, ছাদের রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে রূপসা। আকাশে আজকে অর্ধচন্দ্রের উপস্থিতি। চারদিক মৃদু আলোয় আলোয় আলোকিত।
“একটা মেয়েকে দেখামাত্রই তাকে ভালোবাসতে পারলে, আমাকে এতোবার দেখেও ভালোবাসতে পারোনি? আমি কি এতোদিনে একবারও তোমার মন স্পর্শ করতে পারিনি? কেনো করলে আমার সাথে অবিচার? আমি কখনো ভাবতেই পারিনি যে আমাকে এই রকম পরিস্থিতিতে পড়তে হবে।”

রূপসা নিঃশব্দে কেদেই চলেছে। জীবনের প্রথম ভালোবাসা যে তাকে এভাবে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলবে সে ভাবতেও পারেনি। আলভী যে কখনো এরকম করতে পারবে সেটা সে দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। রূপসা দুহাতে চোখজোড়া মুছে ঘুরে দাড়াতেই একটা মানব আকৃতির ছায়া ছাদের দরজা থেকে সরে যায়। রূপসা বুঝতে পারে যে সেখানে কেউ না কেউ আছে।
“কে ওখানে?”

ছায়াটা কিছুক্ষণ স্থীর ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে উধাও হয়ে যায়। রূপসা না চাইতেও কিছুটা ভয় পেয়ে দ্রুত পায়ে ছাদ ত্যাগ করে।
,
আলভীর কাজিনদের সাথে গল্প করতে করতে একপর্যায়ে ঊর্মিলার রুমেই অলি ঘুমিয়ে যায়। ১২ টার দিকে আলভী এসে ঊর্মিলার রুমের দরজার সামনে দাঁড়ায় তাকে দেখেই ঊর্মিলা বলে ওঠে,
“কিরে আজকেও কি আমার রুম দখল করার ধান্দায় আছিস নাকি?”

আলভী দরজায় একহাত ঠেকিয়ে বললো,
“তুই গতরাতেই বলেছিলি যে ওকে এই রুমে জায়গা দিবিনা। আর আজকেই ভুলে গেলি?”

বাকিরা সবাই সরু চোখে ঊর্মিলা আর আলভীর দিকে তাকিয়ে আছে। তারা কিছুই বুঝতে পারছেনা। ইশা বলে ওঠে,
“কোন বিষয়ে কথা বলছো তোমরা?”

“আর বলিসনা, কালকে রাতে অলি আমার রুমে ঘুমানোর জন্য এসেছিলো”

সামিরা জিজ্ঞেস করলো,
“কেনো? ও কি একা ঘুমাতে পারেনা নাকি?”

তিশা বললো,
“না পারেনা। আগে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসলে তো আমার সাথেই ঘুমাতো”

সবাইকে থামিয়ে ইশা বললো,
“আরে তারপর কি হয়েছিলো সেটা বল ঊর্মি আপু”

ঊর্মিলা একবার আলভীর দিকে তাকিয়ে দেখলো আলভী নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে,
“অলি আমার সাথেই ঘুমিয়েছিলো। কিন্তু আমার মহান ভাইটা মাঝরাতে এমন ভান করলো যেনো বউ ছাড়া তার অক্সিজেন গ্রহন করতেও সমস্যা হচ্ছে। আমাকে হুমকি ধমকি দিয়ে দরজা খুলিয়ে আমাকেই রুম থেকে বের করে দিলো। তারপর নিজে বউয়ের সাথে আমার রুমেই আরামসে ঘুমিয়ে গেলো।”

“কিহ!”

সবাই একসাথে চিল্লিয়ে উঠতেই অলি ধড়ফড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো,
“কি হয়েছে আপু? ভূমিকম্প হচ্ছে নাকি?”

অলির ভীত কন্ঠ শুনে সবাই একসাথে অলির দিকে তাকালো। ভয়ে অলির গলা শুকিয়ে আসছে। সবাই কেনো এভাবে চিল্লিয়ে উঠলো সেটাই সে বুঝতে পারছেনা। অলি চোখ কচলে নরমস্বরে বললো,
“কি হলো বলছোনা কেনো?”

আলভী ভেতরে ঢুকে অলির সামনে এসে দাড়ালো,
“তুমি এখানে ঘুমাতে পারবেনা। যাও গিয়ে নিজের রুমে গিয়ে ঘুমাও”

আলভীর কথা শুনে অলি অসহায় চোখে তার দিকে তাকায়,
“আমি এখানে ঘুমালে আপনার কি সমস্যা?”

আলভী কপাল চুলকে ঊর্মিলার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আরে সমস্যা আমার নয় সমস্যা টা হচ্ছে ঊর্মির। আসলে ও তোমাকে কালকে না করতে পারেনি। কিন্তু আজকে ও আমার কাছে নিজের সমস্যার কথা জানিয়েছে।”

কথাটা শুনে ঊর্মিলা কাশতে শুরু করলো। অলি ঠোঁট ফুলিয়ে ঊর্মিলার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপু আমি এখানে শুলে তোমার প্রবলেম হবে?”

ঊর্মিলা হাসার চেষ্টা করে নাবোধক মাথা নাড়ায়। সামিরা বলে ওঠে,
“আরে অলি সমস্যাটা ঊর্মির নয় সমস্যাটা আমাদের মহান ভাইটার, উনিই চায়না যে তুমি এখানে ঘুমাও”

আলভী ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে বলে,
“সমস্যাটা ঊর্মির তবে তার প্রভাব অবশ্যই আমার উপরেই পড়বে।”

অলি খাট থেকে নেমে আলভীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়,
“আপনি কি বলতে চান? তারাতাড়ি বলুন আমার ঘুম আসছে”

আলভী অলির সামনে ঝুকে বলে,
“ঊর্মির স্লিপওয়াকিং ডিসওর্ডার আছে। সেই সাথে ও ঘুমের ঘোরে অনেক হাত পা ছোড়াছুড়ি করে।”

আলভীর কথা শুনে অলি অবাক চোখে ঊর্মিলার দিকে তাকায়,
“আপু তুমি সত্যিই ঘুমের মাঝে হাটাচলা করো?”

আলভী রাগীচোখে ঊর্মিলার দিকে তাকাতেই ঊর্মিলা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে। যদিও এটা সত্যি কথা যে মাঝে মাঝেই ঊর্মিলা ঘুমের ঘোরে রুম থেকে বেরিয়ে যায় কিন্তু সে মোটেও হাতপা ছোড়াছুড়ি করেনা। অলি আলভীর দিকে তাকাতেই আলভী বলে ওঠে,
“তুমি প্রেগন্যান্ট অলি। আমি চাইনা ঊর্মি ঘুমের ঘোরে হাতপা ছোড়াছুড়ি করে তোমার বাবুর হাত পা ভেঙ্গে ফেলুক”

আলভীর কথা শুনে অলির হাতপা ঠান্ডা হয়ে যায়। সে কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে ঊর্মিলার দিকে তাকায়। ঊর্মিলা মলিন হেসে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। বাকিরা সবাই বুঝতে পারলো যে আলভী কেনো চায়না যে অলি ঊর্মিলার সাথে ঘুমাক। আলভী গলা পরিষ্কার করে বললো,
“যাও নিজের রুমে গিয়ে ঘুমাও”

অলি কি বলবে বুঝতে পারছেনা। কিন্তু এসব শোনার পরে সে ঊর্মিলার সাথে ঘুমাতে পারবেনা। অলি করুন স্বরে বললো,
“আমি তো একা ঘুমাতে পারিনা”

আলভী কিছু বলতে যাবে তার আগেই তিশা বলে ওঠে,
“অলি তুই নিজের রুমে চল আমি আর ইশা তোর সাথে ঘুমাবো। আমাদের হাতপা ছোড়াছুড়ি করার অভ্যাস নেই।”

কথাটা শুনে অলি খুশি হলেও আলভীর মেজাজ খারাপ হলো।
“তোর হাজব্যান্ড আসেনি কেনো বলতো?”

তিশা স্বাভাবিক স্বরেই বললো,
“ভাইয়া তোমাকে তো আগেই বললাম যে ও কালকে আসবে। ওর কাজ আছে, এভাবে হঠাৎ করে বললেই কি আসতে পারে বলো?”

আলভী আর কিছু না বলে রেগেমেগে নিজের রুমে চলে গেলো। অলি তিশার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
“আচ্ছা আপু চলো তাহলে”

তিশা আর ইশা অলির সাথে অলির রুমে চলে গেলো। সামিরা তো ঊর্মিলার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হেসেই যাচ্ছে।
“হেসোনা তো আপু”

“আরে আমি তোর জন্য হাসছিনা। আমি তো এভির জন্য হাসছি। বেচারা বউকে ছাড়া থাকতে পারবেনা বলে কতো পরিশ্রম করে কাহিনি সাজিয়ে বউকে নিয়ে যেতে আসলো। কিন্তু পরিশেষে তিশা আর ইশার জন্য ওর সব প্ল্যান ভেস্তে গেলো”

ঊর্মিলা একটা শ্বাস ফেলে বললো,
“আমি তো এটাই বুঝতে পারছিনা যে ভাইয়া বউকে ছাড়া থাকতে না পারলে আলাদা রুমে কেনো থাকতে বললো”

সামিরা নিজেও ব্যাপারটা বুঝতে পারলোনা,
“সেটা জানিনা কিন্তু রুম শেয়ার করতে না পারার ব্যাপারটা পুরোই মিথ্যা। এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে”

ঊর্মিলা আর কিছুই বললোনা। এরই মাঝে সামিরার হাজব্যান্ড দরজার সামনে এসে দাড়ালো তার কোলে তাদের ৩ বছর বয়সী মেয়ে ঘুমিয়ে আছে।
“তোমার দেখছি মেয়েকে নিয়ে কোনোপ্রকার মাথাব্যথাই নেই সামিরা।”

সামিরা খাট থেকে নেমে তার হাজব্যান্ডের সামনে গিয়ে দাড়ালো,
“মেয়ে তো সারাক্ষণ তোমার কাছে থাকতে চায় আমি কি করবো বলো?”

“হয়েছে এখন ঘুমাতে চলো”

সামিরা মাথা নেড়ে চলে গেলো। ঊর্মিলা দরজা লক করে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো, ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই তার বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। প্রতিদিন দিহান নিজে থেকেই কল দিতো কিন্তু আজকে সারাদিনেও কল দেয়নি।
“আমার কি একবার কল দেওয়া উচিৎ?”

ঊর্মিলা ভাবলো কিন্তু মাথা নাড়িয়ে নিজ মনেই বললো,
“না থাক। যেই লোকটা এতোদিনেও আমাকে সামান্য প্রপোজ টুকুও করে উঠতে পারলোনা। তার সাথে আমার কোনো কথা নেই। অবশ্য সে আমাকে হয়তো ভালোও বাসেনা। আমিই ভুল ভেবেছিলাম”

পরেরদিন,

সকাল হতেই অলি আর আলভীর রিসেপশনের এরেঞ্জমেন্ট করা শুরু হয়ে যায়। দুপুরের দিকে সবাই সেজেগুজে রেডি হয়ে নেয়। অলির পরণে গাঢ় খয়েরী রঙের একটা ভারী জর্জেটের শাড়ি। এতোগুলো মানুষের সামনে চুল বের করে রাখাটা অলির কাছে বেশ অস্বস্তিকর হতো সেই জন্যই অলি নিজেই হিজাব পড়েছে, হিজাবের উপর একটা খয়েরী রঙের জোরাও আছে। আলভীর পরণে কালো রঙের স্যুট হাতে ঘড়ি। চুলগুলো ভালোভাবে জেল দিয়ে সেট করা। অলি আর আলভী দুজনেই স্টেজে পাশাপাশি বসে আছে। আলভী বারবার অলির দিকে তাকিয়ে অলির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। অলির মন ভালো ছিলোনা, সে এসব কিছু চায়নি। অবশ্য তাদের বিয়ের ব্যাপারটা সবাইকে জানাতে সে অবশ্যই চেয়েছিলো। সেই সাথে সে মা বাবাকেও অনেক বেশিই মিস করছে। অলি নিজের ভাবনায় মগ্ন আর আলভী অলিকে দেখায় ব্যস্ত।
“মেয়েটাকে এভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে এতোগুলো লোকের সামনে বসিয়ে রাখাটা কি বেশিই জরুরী?”

কথাটা ভেবেই আলভী অলির সামনে গিয়ে দাড়ালো। অলি ভ্রু কুচকে মাথা উঁচু করে আলভীর দিকে তাকায়,
“সামনে থেকে সরুন”

“বাড়ির ভেতরে গিয়ে বসো। এখানে আর বসে থাকতে হবেনা।”

“আপুরা সবাই খেতে গিয়েছে, যাওয়ার আগে আমাকে এখানেই বসে থাকতে বলে গেছে। ওরা আসুক তারপরই যাবো”

“নিজে থেকে যাবে নাকি তুলে নিয়ে যাবো?”

আলভীর কথা শুনে অলি দাড়িয়ে যায়। এখন বেলা ৩ টা বাজে রোদের তাপ কম স্টেজে এসি লাগানো থাকায় তার বিশেষ কষ্ট হচ্ছে না। কিন্তু ভারী শাড়িতে তার দমবন্ধ হয়ে আসছে,
“আমি এখানে বসে থাকলে আপনার কি সমস্যা?”

আলভী ঘাড় কাত করে অলিকে উপরনিচ দেখে বলে ওঠে,
“তুমি আমার বউ, কোনো শোপিস নও। খাওয়া দাওয়ার পরে স্টেজের সামনে অনেক লোকজন আসবে আমি চাইনা তারা তোমাকে দেখুক”

অলি বিষয়টা বুঝতে পেরে স্টেজ থেকে নেমে যেতে নেয়। কিন্তু শাড়িটা অনেক ভারী থাকায় স্টেজের সিড়ি পাড় করার সময় সে পড়ে যেতে নিতেই আলভী একহাতে অলির কোপড় চেপে ধরে। অলি অবাক চোখে আলভীর দিকে তাকায়,
“এভাবেই তুমি বাবুকে সামলে রাখবে তাইনা?”

“আপনি আমাকে স্পর্শ করেছেন।”

“তাহলে কি ছেড়ে দেবো?”

অলি পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখে আলভী ছেড়ে দিলে সে একদম নিচে গিয়ে ল্যান্ড করবে। অলি চোখ মুখ খিচে আলভীর হাত প্যাচিয়ে ধরে,
“ছাড়বেন না প্লিজ”

আলভী মুখে কিছু না বলে অলিকে টেনে কোলে তুলে নেয়। অলি চোখ বন্ধ করে আলভীর গলা জড়িয়ে ধরে। আলভী অলিকে কোলে নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকতেই ড্রইংরুমে থাকা উপস্থিত সবাই অবাক চোখে আলভীর দিকে তাকায়। আলভী কারো দিকে না তাকিয়ে অলিকে নিয়ে সোজা উপরে চলে আসে। অলিকে বিছানার উপর বসাতেই অলি চোখ মেলে তাকায়। চারদিকে তাকিয়ে দেখে এটা অলির রুম। অলি কপাল কুচকে আলভীর দিকে তাকায়,
“কি হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?”

“আপনি আমাকে স্পর্শ করেছেন, কোলে তুলেছেন তাও আবার আমার অনুমতি ব্যতীত”

আলভী একটা শ্বাস ছেড়ে বলে,
“হ্যাঁ তো বলো তুমি এবার কি করবে?”

অলি অন্যদিকে তাকিয়ে বলে,
“কি আর করবো। আপনি না ধরলে আমি পড়ে যেতাম সেই জন্য এই বারের মতো আমি কিছুই মনে করিনি। কিন্তু আমি এতো সুন্দর করে সেজেছি। কোথায় একটু ছবি তুলবো তাও আপনার জন্য তুলতে পারলাম না। আপুরা বলেছিলো একসাথে অনেক ছবি তুলবো।”

কথাটা শুনে আলভী নিজের পকেট থেকে অলির ফোনটা বের করে অলির হাতে দিতেই অলি খুশি হয়ে যায়,
“আরে ফোনটা আপনার কাছে ছিলো? আমি তো ভেবেছি হারিয়েই ফেলেছি”

“হুম, শোনো ফোনটা নিজের কাছেই রাখবে। আর এটা দিয়ে যতো ইচ্ছা ছবি তোলো। ওদের খাওয়া শেষ হলে আমি ওদেরকে পাঠিয়ে দেবো”

অলি খুশি হয়ে মাথা নাড়ায়। আলভী রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

বিকাল ৫ টা অলি সেলফি তুলতে তুলতে ক্লান্ত হয়ে গেছে। তখনই ঊর্মিলা, সামিরা, ইশা আর তিশা তার রুমে ঢোকে ঊর্মিলা অলির কাছে গিয়ে বলে,
“অলি চলো আমাদের সাথে। এখন ছবি তোলা হবে”

অলি একটু ইতস্ততবোধ করে বলে,
“না আপু অতো মানুষের সামনে আমি যেতে পারবোনা”

ইশা বললো,
“বাইরের মানুষ খাওয়া দাওয়া করেই চলে গেছে এখন শুধু আত্মীয় স্বজনরাই আছে। ভাইয়াই তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে”

আলভী বলেছে শুনে অলি উঠে দাড়ালো। সামিরা আর তিশা গিয়ে অলির হাত ধরলো,
“এভি বলেছে তোমাকে সাবধানে নিয়ে যেতে”

সামিরার কথা শুনে অলি একটু লজ্জা পেলো।
,
দিহান কিছুক্ষণ আগেই মির্জা ভিলাতে এসেছে। সে স্টেজের সামনে বসে আলভীর সাথে কথা বলছিলো।
“ওহ এবার বুঝতে পারলাম যে রিফাত অলির ছবি কোথা থেকে পেয়েছিলো”

আলভী রেগেমেগে দিহানের দিকে তাকায়,
“নাম ধরে বলছিস কেনো?”

“নাম ধরে বলবোনা তাহলে কি ওকে রিফাত আব্বা বলে ডাকবো? আজব কথা বললি,”

“আমি ওর কথা বলিনি ছাগল।”

“তাহলে কার কথা বলেছিস পাগল?”

আলভী একটা শ্বাস ফেলে বললো,
“অলির কথা বলেছি। ঊর্মির মতো বেয়াদব হোসনা। ভাবী বলে ডাক”

ঊর্মিলার নাম শুনে দিহান মুখটাকে মলিন করে ফেললো। সে নাহয় রাগ করে কল দেয়নি তাই বলে ঊর্মিলা কি পারতোনা তাকে একবার কল দিতে? দিহান তো আসবেনা বলেই ভেবে রেখেছিলো কিন্তু শেষমেষ থাকতে না পেরে এসেই পড়েছে। দিহান সামনের দিকে তাকাতেই অলি আর ঊর্মিলা সহ বাকিদের দেখতে পেলো,
“ভাবী এসে গেছে”

দিহানের কথা শুনে আলভী সামনের দিকে তাকিয়ে অলিকে দেখলো। সে অলিকে দেখে অবাক হয়না। অলিকে না সাজলেও ভালো লাগে। তার চোখে অলির সর্বাবস্থায় সবচেয়ে সুন্দরী দেখতে লাগে। আলভী এগিয়ে যায় অলির দিকে দিহান চুপচাপ বসে ঊর্মিলার দিকেই তাকিয়ে আছে। পিংক রঙের শাড়িতে ঊর্মিলাকে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে। ঊর্মিলা প্রথমে দিহানকে খেয়াল করেনি। যখন খেয়াল করলো তখন দেখলো দিহান তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ঊর্মিলা একনজর তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নেয়। দিহান হাল্কা হেসে মনেমনেই বলে,
“রাগ তো আমি করেছিলাম। কিন্তু তুমি সেই রাগ না ভাঙ্গিয়ে উল্টো নিজেই রাগ করে বসে আছো রাগিনী?”

দিহানের থেকে কিছুটা দূরের চেয়ারে বসে আছে রূপসা। সে অনেকক্ষণ যাবত এখানেই বসে ছিলো। সে আজকে বিশেষ সাজগোছ করেনি ঊর্মিলা অনেকবার তাদের সাথে থাকতে বলেছিলো কিন্তু সে সবকিছু থেকেই নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে। আলভী আর অলিকে একসাথে দেখে রূপসা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। তার চোখ ভিজে আসছে। অলির জায়গায় তার থাকার কথা ছিলো। সে এসব মেনে নিতে পারছেনা। রূপসা বসা থেকে উঠে একদৌড়ে বাড়ির ভেতর চলে যায়। ইয়াদ ক্যামেরাম্যানের সাথে কথা বলছিলো। সে রূপসাকে চলে যেতে দেখেছে কিন্তু সেদিকে সে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করেছে বলে মনে হলোনা।
এরপরের একঘন্টা নাগাদ চললো ফটো তোলার সেশন। আলভী আর অলির একসাথে অনেকগুলো ছবি তোলা হয়েছে। সেই সাথে বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্যর সাথেও ছবি তুলেছে। পরিশেষে একটা গ্রুপ ছবি তোলা হবে তখনই রূপসার খোজ পড়লো। রুনা খাতুন রূপসাকে আনতে যেতে চাইলে ইয়াদ বলে ওঠে,
“ফুপি তুমি থাকো আমি ওকে ডেকে নিয়ে আসছি।”

ইয়াদ দ্রুতপায়ে রূপসার রুমের সামনে এসে দেখে দরজা লক করা।
“রূপ দরজা খোল। বাইরে সবাই তোকে খুজছে”

রূপসা দরজা খুলে দিতেই ইয়াদ রাগীকন্ঠে বলে ওঠে,
“তুই সিনক্রিয়েট করতে চাইছিস নাকি? বাড়িতে অনুষ্ঠান চলছে তার মধ্যে তুই এভাবে ঘরবন্দী হয়ে থেকে কি প্রমাণ করতে চাইছিস? কাকিমাও তো নতুন বউকে মেনে নিতে পারেনি সে কি সবকিছু সহ্য করে নিচ্ছেনা তাহলে তুই কেনো পারছিস না?”

রূপসা ক্ষীণ স্বরে বললো,
“আমার কিছুই হয়নি। শরীর ভালো লাগছিলো না সেই জন্যই শুয়ে ছিলাম। আমাকে খুজছে কেনো?”

“গ্রুপ ফটো তোলা হবে সেই জন্যই খুজছে। আর নয়তো তোকে দিয়ে তাদের কি দরকার?”

রূপসা হাসিমুখে বললো,
“গ্রুপ ফটো তুলতেও আমাকে প্রয়োজন হবার কথা নয়। আমি তো এই বংশের কেউ নই। আমি না থাকলেও ছবি অসম্পূর্ণ হবেনা”

ইয়াদ একটা শ্বাস ছেড়ে বলল,
“ভাইয়ার খালার মামার ফ্যামিলির সবাই এই ছবিতে থাকবে আর তুই থাকবিনা বলছিস? ব্যাপারটা ভালো দেখাবেনা”

“আমার মনে হয় উল্টো আমি থাকলেই ব্যাপারটা খারাপ দেখাবে”

ইয়াদ ভ্রু কুচকে রূপসার দিকে তাকায়,
“আমার থাকার কথা ছিলো এভির পাশে সেখানে আমি থাকবো এককোনায় আগাছার ন্যায়ে? ব্যাপারটা আমার চোখে মোটেও ভালো দেখাবেনা ইয়াদ। তুমি চলে যাও”

রূপসা দরজা আটকে দিতে নিলে ইয়াদ রূপসার হাত ধরে ফেলে। রূপসা অবাক চোখে তাকায়,
“তোর থেকে আমি পুরো ৭ মাস ২৩ দিন ৯ ঘন্টার বড়। জাস্ট মনে করিয়ে দিলাম”

বলেই ইয়াদ রূপসার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো। ছবি তোলার জন্য বিশাল জায়গা জুড়ে ফোটোব্যুথ বানানো হয়েছে। রূপসা আসা মাত্রই সবাই একসাথে ছবি তোলার জন্য দাড়ালো। সবার মাঝখানে দাদুমনি বসে আছে, তার ঠিক পেছনে আলভী তার একপাশে অলি আরেক পাশে শাহানাজ বেগম শাহানাজ বেগমের সামনে ঊর্মিলা আর পেছনে উসমান মির্জা তারপাশে ইয়ামিন মির্জা, নূরনাহার। দাদুমনি অন্যপাশে দাড়িয়েছে ইয়াদ। ইয়াদ এখনো রূপসার হাত ধরে রেখেছে। রূপসা ছাড়ানোর চেষ্টা করলে ইয়াদ হাতের বাধন আরও শক্ত করে। ব্যাথায় রূপসা অবাক চোখে ইয়াদের দিকে তাকায় তখনই ক্যামেরাম্যান ছবি তুলে নেয়।

অলি ঘাড় উঁচু করে আলভীর দিকে তাকিয়ে তাদের উচ্চতার ব্যবধান দেখে বিষ্মিত হচ্ছে। সে উচ্চতায় আলভীর বুক বরাবর। এই ফ্যামিলির মানুষগুলো আলভীর মতোই খাম্বা টাইপের ইয়াদ নামের ছেলেটাও অনেক লম্বা এমনকি ঊর্মিলা মেয়ে হয়েও অলির থেকে বেশ অনেকটা লম্বা। অলির চাহনি দেখে আলভী ভ্রু কুচকে তাকায়,
“ক্যামেরা তোমার সামনে, আমার মুখে লাগানো না। তাই সামনে তাকাও”

কথাটা শুনে অলি সামনের দিকে তাকালো।

চলবে,,,

শব্দসংখ্যা- ২২৫০+