১৫ বছর বয়সী মা পর্ব-২০+২১

0
25

#১৫_বছর_বয়সী_মা (২০)
#সোফিয়া_সাফা

বউভাতের আয়োজন শেষ হতে হতে সন্ধ্যার শেষ আলোটুকুও নিভে গিয়েছে। গাঢ় নীল আকাশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে রাতের শান্ত ছায়া। মির্জা ভিলার চত্বরে তখন ধীরে ধীরে নেমে এসেছে নিরবতা। আলো ঝলমলে দিনের উৎসবমুখরতা এখন শুধু অতীতের প্রতিচ্ছবি। সবাই একেবারে রাতের খাবার খেয়ে নিজেদের রুমে চলে গেছে। কিছু কিছু আত্মীয়রা আগামীকাল সকালেই নিজেদের বাসস্থানে ফিরে যাবেন। বাকিরা পরশুদিন নাগাত চলে যাবেন বলেই ঠিক করে রেখেছেন। ঊর্মিলা কিছুক্ষণ আগেই গায়ে থাকা গাঢ় পিংক রঙের শাড়িটি খুলে হালকা আরামদায়ক পোশাক পরে নিয়ে ক্লান্ত চোখে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছিলো, ঠিক তখনই তার ফোনে একটি মেসেজ আসে। ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই চোখে ভেসে ওঠে,
“আমি তোমাদের বাড়ির পার্কিং লটে অপেক্ষা করছি। একবার একটু এসো প্লিজ।”
প্রেরক: দিহান।

মেসেজটা পড়ে ঊর্মিলা দ্বিধা নিয়েই উঠে দাঁড়ায়। ঘর অন্ধকার, আলো জ্বালেনি সে। মাথায় একটা ওড়না জড়িয়ে নীরবে রুমের দরজা ঠেলেই বেরিয়ে পড়ে। আজ তিশার স্বামী আসায় ইশা একাই অলির সাথে শুয়েছে। নিঃশব্দ পায়ে ঊর্মিলা অন্ধকার ড্রইংরুম পেরিয়ে মেইন দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসে। বাড়ির ভেতরে আলো জ্বললেও বাইরে তখন এক নিস্তব্ধ নৈঃশব্দ্য—শুধু দূরে কোথাও কুকুরের হালকা ঘেউ ঘেউ শোনা যাচ্ছে। ঊর্মিলা পার্কিং লটে এসে দেখে, দিহান গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ফোন টিপছে। মাথা নিচু, চোখ ফোনের স্ক্রিনে নিবদ্ধ। আবছা আলোয় তার অবয়বটা যেনো খানিকটা অন্যরকম ঠেকলো ঊর্মিলার চোখে…
“আপনি কিভাবে ভাবলেন যে এতো রাতে আপনার ম্যাসেজ পেয়েই আমি ছুটে চলে আসবো? আ’ম ইউর জাস্ট ফ্রেন্ড। এতোকিছু আশা করবেন না আমার থেকে।”

ঊর্মিলার কণ্ঠে ছিল ঠান্ডা প্রতিবাদ, কিন্তু তার চোখের গভীরে ফুটে উঠছিল দ্বিধা। দিহান হালকা হেসে উঠলো, যেনো ঊর্মিলার এই বিরূপ স্বরটাও তার নিকট পরিচিত।
“হাসবেন না, যান এখান থেকে।”

ঊর্মিলার গলার স্বর কঠিন শোনালেও দিহান জানে, তাকে একা দেখে ঊর্মিলার বুকের ভেতরে একধরনের অস্থিরতা ঠিকই কাজ করছে।
“তুমি বলতে চাইছো যে আমি তোমার অপেক্ষা করে ভুল করিনি, তাই তো?”

ঊর্মিলা নীরব থাকে। চোখ নামিয়ে নেয় পাথরের পেভমেন্টে। মুহূর্ত খানেক পর ধীরে বলে ওঠে—
“কি বলবেন তারাতাড়ি বলুন।”

“কিছুই বলবোনা। তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করলো তাই আসতে বলেছি।”

ঊর্মিলা তাকিয়ে দেখে, দিহানের ঠোঁটের কোণে একটুকরো হালকা হাসি। লোকটা অকারণেই হাসে, তবে প্রয়োজনে হাসতে যেনো কষ্ট হয়।
“আমাকে দেখতে ইচ্ছা করলো কেনো আপনার? বেশ তো ছিলেন ২দিন। এখন এতো আলগা দরদ দেখাচ্ছেন কেনো?”

দিহান যথারীতি দূরত্ব বজায় রেখেই দাঁড়িয়ে থাকে।
“আমি কিছুক্ষণ আগে কল দিয়েছিলাম, রিসিভ করোনি কেনো?”

ঊর্মিলার মুখের অভিব্যক্তি মুহূর্তেই বদলে গেলো। ভেতরে জমে থাকা অপ্রকাশিত অপেক্ষাগুলো যেন হঠাৎ বিস্ফোরিত হলো। ভেতরে থাকা রাগ যেনো দপ করে জ্বলে উঠলো,
“রিসিভ করবোনা, কল দিবেন না আমাকে।”

দিহান ধীর ভঙ্গিতে ফোনটা পকেটে রেখে বুকের উপর হাত জড়ো করে দাড়ালো, চোখে নরম অথচ অদম্য এক প্রশ্ন—
“রেগে যাচ্ছো কেনো, সেটা তো বলবে?”

“আমি মোটেও রাগ করছিনা। আপনি ছাড়াও আমার অনেক গুলো ফ্রেন্ডস আছে। তাদের সাথে কথা বলেই আমার টাইম পাস হয়ে যাবে।”

“আমি তোমাকে আমার সাথে টাইম পাস করতে বলছিনা ঊর্মি।”

“ঊর্মি বলে ডাকবেন না আমাকে। এখন থেকে আমরা আর বন্ধু নই। ঊর্মিলা বলে ডাকবেন।”

ঊর্মিলা সামনে ফিরে হাঁটতে শুরু করে। তার চিবুক নিচু, পায়ের ভঙ্গিমায় দৃঢ়তা। কিন্তু সে কিছুদূর যেতেই দিহান তাড়াতাড়ি কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়।
“আমিও তোমার বন্ধু হয়ে থাকতে চাইনা, ঊর্মিলা।”

“তাহলে?”

দিহান এক মুহূর্তের জন্য কোনো শব্দ খুঁজে পায়না। নিঃশ্বাস টেনে সাহস জড়ো করে, হঠাৎ দ্বিধা ভেদ করেই বলে ফেলে—
“আই লাভ ইউ ঊর্মিলা, উইল ইউ বি মাই লাইফলাইন?”

মুহূর্তেই সময় যেন থেমে যায়। বাতাস থমকে যায় চারপাশে। ঊর্মিলার মুখে অনড় বিস্ময়ের ছায়া। তার পুরো শরীর জমে আসে। ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করে অস্ফুটস্বরে শুধায়—
“কি বললেন?”

দিহান এবারও একচিলতে হাসি নিয়ে বলে—
“আই লাভ ইউ।”

ঊর্মিলা দাঁড়িয়ে থাকে নিশ্চুপ, মুখে একরাশ বিষ্ময়। তার চোখে মেঘ জমে, ঠোঁটে কোনো উত্তর আসেনা।
“উত্তর দিবেনা?”

ঊর্মিলা ধীরে মাথা নাড়ে—না। তারপর আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না। দিহানকে পাশ কাটিয়ে দৌড়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে যায়। দিহান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শেষবারের মতো মির্জা ভিলার দিকে তাকায়। তারপর গাড়িতে উঠে বসে, এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ইঞ্জিন স্টার্ট দেয়। গাড়ির হেডলাইটে ঝিলমিল করা ধুলোবালি ঘিরে ধরে তার যাত্রার পথকে। রাত গভীর হয়ে আসে,
*
অলি বিছানায় শুয়ে ছিলো। জানালার কাচের ওপারে রাত গভীর হয়ে এসেছে, পাশেই ইশা কারো সঙ্গে নিম্নকন্ঠে ফোনে কথা বলছে যা অলির ঘুমে বিঘ্ন ঘটাচ্ছিল। অলির চোখে তখনও ঘুম জমে ছিল, কিন্তু শান্তিতে ঘুমাতে পারছিল না। সে বিরক্ত ভঙ্গিতে, আধো কণ্ঠে বলে ওঠে,
“আপু সামির ভাইয়া তো বিকেলে এসেছেই। তুমি বরং ফোনে কথা না বলে সামনা-সামনি গিয়ে কথা বলো।”

ইশা নরম স্বরে বিরক্তি ঝেড়ে দিয়ে উত্তর দেয়,
“বনু তুই ঘুমা না। আমি তো আস্তে আস্তেই কথা বলছি। ফোনে যতটা সহজ ভাবে কথা বলা যায় সামনা-সামনি সেভাবে কথা বলা যায়না।”

অলি আর কোনো কথা না বলে মুখ ঘুরিয়ে চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়। তার চোখে ঘুম ভর করলেও কানের মধ্যে ইশার কণ্ঠ একটা শোরগোল তুলছে, কিছুতেই নিস্তার মিলছেনা। ঠিক তখনই হঠাৎ তার পাশে থাকা বালিশের নিচে রাখা ফোনটা জোরে বেজে ওঠে।
“আরে আপু ফোনটা রিসিভ করো।” – অলির গলায় বিরক্তির ঝাঁজ।

ইশা তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে নিজের ফোনটা চেপে ধরে, ফিসফিস করে বলে—
“আমার না, তোর ফোন বাজছে।”

এ কথা শুনে অলি তড়িঘড়ি করে উঠে বসে। তার চোখ ছলছল করছে ঘুমে, কিন্তু মনের ভিতর চিন্তার ঢেউ। মা-বাবা ছাড়া তার ফোন নম্বর তো আর কেউ জানেনা। তাহলে তারাই কি কল দিয়েছে? সে দ্রুত বালিশের পাশে রাখা ফোনটা হাতে তুলে নেয়। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নম্বরটা দেখে অচেনা উত্তেজনায় গলা শুকিয়ে আসে তার।
“এটা তো ওনার নম্বর! উনি এত রাতে আমাকে কেনো কল দিচ্ছেন?”

অলি এখনো দ্বিধায়, রিসিভ করবে কি না—ততক্ষণে কল কেটে যায়। অন্যদিকে, অলি কল রিসিভ না করায় আলভীর মনটা খারাপ হয়ে যায়। একধরনের হতাশা আর অধৈর্যের তাড়নায় সে আবারও অলির নম্বর ডায়াল করলো।
অলি ফোনটা রাখতেই যাচ্ছিল, তার আগেই আবারও কল আসে। এবার আর দেরি না করে অলি কলটা রিসিভ করে ফোনটা কানে লাগিয়ে ছোট্ট করে বলে,
“হ্যালো।”

তার ঘুমভাঙা কণ্ঠ শুনেই আলভীর নিদ্রাহীন চোখে যেন আরও রাত জেগে ওঠে। অন্য প্রান্ত থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে অলি ভ্রু কুঁচকে স্ক্রিনের দিকে তাকায়। আবার ফোনটা কানে লাগিয়ে বলে,
“হ্যালো? কল দিয়ে ঘুমিয়ে গেছেন নাকি?”

আলভী কী বলবে বুঝতে পারছে না। কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকার পর, শান্ত গলায় বলে ওঠে,
“হানিবি, আমি ঘুমাতে পারছিনা।”

‘হানিবি’ ডাকটা শুনে অলির কপালে ভাঁজ পড়ে। একটু বিরক্তি এলেও পরের কথাটা শুনে সে ভাবনায় পড়ে যায়—
“কেনো, আপনার কি শরীর খারাপ?”

আলভীর কণ্ঠে তখন হালকা ক্লান্তির সুর,
“না, শরীর খারাপ লাগলে মেডিসিন খেয়ে নিতাম। আমার তো মন খারাপ।”

অলি একটু থেমে, নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“কেনো? কী হয়েছে আপনার?”

“জানিনা…” আলভী একটুখানি থেমে যায়।
তারপর ধীর কণ্ঠে বলে ওঠে,
“তুমি একবার আসবে আমার রুমে?”

অলি থমকে যায়। কথাটার মধ্যে যেন একটা ভিন্ন রকম আবেদন ছিলো, যা তাকে দ্বিধায় ফেলে দেয়।
“আমি গিয়ে কি করবো?”

আলভী আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, যেন নিজের আবেগ সামলাতে ব্যস্ত সে। তারপর এক নিঃশ্বাসে বলে ওঠে,
“আচ্ছা তুমি ঘুমাও, রাখছি।”

অলি কিছু বলার আগেই কল কেটে যায়। সে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা পাশে রেখে দেয়। ইশার কথাবার্তা ইতিমধ্যেই শেষ। অলি আবার শুয়ে পড়তেই ইশা জানতে চায়,
“কে কল দিয়েছিলো?”

অলি শান্তভাবে উত্তর দেয়,
“তোমার ভাই।”

আলভী কল দিয়েছে শুনে ইশা খুশিমনে শুধায়,
“ভাইয়া এত রাতে কল দিয়েছিলো কেনো?”

অলি মুখ ভার করে বললো,
“বললো তার নাকি মন খারাপ। আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘কেনো?’ সে উত্তরে বললো ‘জানিনা, তুমি একটু আসবে আমার রুমে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘আমি কি করতে যাবো?’…”

অলির কথার মাঝেই ইশা হো হো করে হেসে ওঠে।
অলি বিরক্ত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
“হাসছো কেনো আপু? উনি ডাক্তার মানুষ—শরীর বা মন খারাপ লাগলে নিজের চিকিৎসা নিজেই তো করে নিতে পারে, তাই না? আমাকে যেতে বলছে কেনো?”

ইশা হাসি থামিয়ে একসময় গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে,
“মন খারাপের কোনো মেডিসিন নেইরে অলি। ভাইয়ার হয়তো তোকে প্রয়োজন। তোর উচিৎ তার কাছে যাওয়া।”

ইশার কথায় অলির গলার রন্ধ্রে যেন কিছু একটা আটকে গেলো। মুহূর্তেই মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে আসে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই অন্ধকার রাতটা—যখন আলভীর রুমে আটকে পড়েছিল সে। সেই স্মৃতি শরীরের প্রতিটি কোষে ভয় ছড়িয়ে দেয়। ঠোঁট কেঁপে ওঠে। কয়েকবার ঢোক গিলে সে বলল,
“আমি তার কাছে যেতে পারবোনা আপু। তাকে দেখলে আমার ভয় করে।”

অলির ভয়ানক বিব্রত মুখ দেখে ইশা খানিক অবাক হলেও, তার বয়সের কথা মাথায় রেখে এবার কণ্ঠস্বরটা একটু নরম করল,
“আমি এবার বুঝতে পারলাম যে ভাইয়া তোকে আলাদা রুমে কেনো রেখেছে। প্রবলেমটা ভাইয়ার নয় প্রবলেমটা তোর। তুই-ই হয়তো আলাদা রুমে থাকতে চেয়েছিস তাইনা?”

অলি মাথা নিচু করে ধীরগতিতে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। ঘরের বাতাস যেন ভারী হয়ে আসে। ইশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“বাচ্চামো করিস না অলি। আমাদের নানুর যখন ১২ বছর বয়স ছিলো তখন নানাভাইয়ের সাথে তার বিয়ে হয়েছিলো। তার দ্বিতীয়বার পিরিয়ড হওয়ার আগেই সে কন্সিভ করেছিলো। সে কি নিজেকে মানিয়ে নেয়নি? তোরও নিজেকে মানিয়ে নেওয়া উচিৎ।”

অলির বুকের ভেতর কেমন জানি একটা অস্বস্তির স্রোত বইতে থাকে। তবু ইশা থামে না,
“যদিও এভি ভাই সেরকম নয়। কিন্তু পরিশেষে সেও একজন পুরুষ মানুষ। আর পুরুষ জাতি বউকে কাছে না পেলে বাইরে নজর দেবে সেটাই স্বাভাবিক।”

কথাটা শুনে অলি চমকে তাকায়। তার চোখেমুখে রাগ ও হতাশার ছাপ স্পষ্ট। ইশার কথাগুলো যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো। আলভীর সম্পর্কে মনে আবার আজেবাজে ভাবনা আসে। ঠোঁট চেপে, নিজমনেই বলে ওঠে—
“তোমরা ওনাকে যতটা মহান মনে করো, উনি ততোটাই অসভ্য আর খারাপ লোক। আমি তার কাছে যাই বা না যাই উনি তো বাইরে নজর দেবেই। তাই শুধু শুধু হরিণ হয়ে বাঘের গুহায় যাওয়ার কোনো মানেই হয় না। নিশ্চয়ই খারাপ কোনো উদ্দেশ্যেই আমাকে নিজের রুমে ডাকছেন উনি।”

“কি ভাবছিস?”
অলি নাবোধক মাথা নাড়ায়।

ইশা আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“তুই প্রেগন্যান্ট অলি। ভাইয়া একজন ডক্টর। আপাতত তোর ভয় পাওয়ার কারণ দেখছিনা। তুই নিশ্চিন্ত মনে ভাইয়ার রুমে যা।”

“নাহহহহহ!”

অলি হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে, যার তীব্রতায় ইশা খানিকটা চমকে যায়।
“আমি ওনার রুমে কিছুতেই যাবোনা।”
অলির গলায় দারুণ রাগ আর ভয়।

“জেদ করছিস কেনো? তোর এসব বাচ্চামো শুধুমাত্র এভি ভাই বলেই সহ্য করছে, অন্য কেউ হলে এতোক্ষণে তুলে নিয়ে যেতো।”

অলি দুহাতে নিজের কানজোড়া চেপে ধরে, মৃদুস্বরে বলে ওঠে।
“উনি তেমনটা করতে পারবেনা আপু।”

ইশার মুখটা এবার মলিন হয়ে আসে। হালকা কণ্ঠে বলে,
“বেচারা ভাইটার জন্য কষ্ট লাগছে। সেই সাথে তোর উপর ভীষণ রাগ উঠছে। আরে ওর রুমে গেলে ও কি তোকে খেয়ে ফেলবে?”

ইশার কথাগুলো অলি কান থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলেও প্রতিটি শব্দ যেন তার মনের ভেতর খচখচ করে বাজছে। অলি এবার কান থেকে হাত সরিয়ে রাগী কণ্ঠে বলে ওঠে,
“আপু ওনার জন্য আজকে আমার এই অবস্থা। আর তুমি প্রশ্ন করছো আমাকে খেয়ে ফেলবে কিনা?”

অলির কথায় ইশা যেন কিছুটা স্তব্ধ হয়ে যায়।
“এটা কোনো কথা? তোকে প্রেগন্যান্ট বানিয়ে দিয়েছে বলে তুই সারাজীবনে আর ভাইয়ার কাছে যাবিনা?”

অলি মাথা নেড়ে স্পষ্টভাবে বলে,
“হ্যাঁ ঠিক ধরেছো।”

ইশা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,
“তাহলে আর কি, ভাইয়ার জন্য আর একটা ম্যাচিউর টাইপের মেয়ে খুজতে হবে দেখছি।”

“মানে?”
অলির প্রশ্নে ইশা শুয়ে পড়তে পড়তে বলে ওঠে,
“মানে আবার কি? তুই ভাইয়ার কাছে না গেলে ভাইয়াকে আবার বিয়ে করাতে হবেনা?”

অলি এবার শান্ত গলায় কিন্তু দৃঢ়ভাবে বলে,
“উনি আর বিয়ে করতে পারবেনা।”

“হুহ দেখা যাবে।”
ইশা চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ে।

রুমটা খানিকটা নীরব হয়ে আসে। অলি কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে বসে থেকে একসময় আস্তে করে অন্যপাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। বাইরে তখন গভীর রাত। জানালার ওপারে নিঃশব্দে ঝরে পড়ছে পুকুরপাড়ের পাতাগুলো, আর অলির বুকের ভেতরেও নেমে এসেছে কুয়াশাভেজা এক অস্থিরতা।

দুই দিন পর…

সময় নিঃশব্দে গড়িয়ে গেছে। আজ সকালেই আলভীর মামা-খালার পরিবারের সদস্যরা মির্জা ভিলা ছেড়ে চলে যাবে। সকাল গড়িয়ে দশটা বাজতেই, একে একে সকলে লাগেজ টেনে, ব্যস্ত পায়ে ড্রইংরুমে এসে জড়ো হয়। আলভী আজকে খুব সকালেই হসপিটালে চলে গেছে। সবাই চলে যাবে ভাবতেই অলির মন খারাপ হয়ে যায়। বিশেষ করে ইশা চলে যাচ্ছে সেই জন্য সে বেশি চিন্তিত। একা একা ঘুমাতে হবে ভাবতেই তার গলা শুকিয়ে আসছে। ইশা আর তিশা শেষবারের মতো অলিকে জড়িয়ে ধরে তারপর সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাকিদের সাথে বেরিয়ে যায়। ঊর্মিলা, রূপসা আর ইয়াদ সকাল ৮ টা বাজেই ভার্সিটিতে চলে গেছে। বাড়ি যেন হঠাৎ করেই ফাঁকা হয়ে গেলো। চেনা শব্দের ভিড়ে যে কোলাহল ছিল, আজ তার বদলে আছে একঘেয়ে নীরবতা।

বিকেলের রোদ একটানা হেলে পড়ছে দাদুমনির ঘরের জানালায়। অলি তার পাশেই বসে আছে, মুখে অল্প কাঁচা হাসি। সামনে একটা ছোট্ট বাটিতে নিজহাতে বানানো পান এগিয়ে দেয় দাদুমনির দিকে।
“দাদুমনি এটা খেয়ে বলো কেমন হয়েছে?”

দাদুমনি কাঁপা হাতে পানটা মুখে নিয়ে হাসিমুখে বলে ওঠে—
“অনেক ভালা হয়েছে নাতবউ। তুমি যেমন মিষ্টি দেখতে, তোমার হাতের পানখানাও বহুত মিষ্টি খেতে।”

অলি চোখ নামিয়ে মৃদু হেসে বলে,
“তাহলে এখন একটা গল্প শোনাও।”

বৃদ্ধা দাদুমনির কণ্ঠে একটা মায়ামাখা সুর ভেসে আসে ঘরজুড়ে, সে স্মৃতির ভাঁজ থেকে গল্প টেনে এনে অলিকে শোনাচ্ছে আর অলিও মুগ্ধ হয়ে শুনছে। হঠাৎ করেই সেই শান্ত দৃশ্য ভেঙে দিয়ে রূপসা রুমে প্রবেশ করে। রূপসার চোখে ঈর্ষার ছায়া। ঠোঁটে একরকম তাচ্ছিল্যভরা হাসি।
“দাদুমনি এসো চুল বেধে দেই”

দাদুমনি একবার রূপসার দিকে তাকিয়ে বললো,
“নাতবউ চুল বেধে দিয়েছে। রূপ তুই এখানে এসে বোস।”

কথাটা শুনে রূপসার মুখের হাসি মুহূর্তেই হিম হয়ে যায়। মুখে যদিও সংযত হাসি ফুটিয়ে বলে ওঠে,
“তোমার নাতবউ দুদিন আগে এসেই আমার জায়গা দখল করে নিয়েছে দেখছি।”

অলির মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। সে ধীরস্বরে জবাব দেয়,
“আমি আপনার জায়গা নেইনি আপু। এই বাড়ির বউ হিসেবে কি আমি দাদুমনির কাজ করে দিতে পারিনা? আপনি এভাবে বলছেন কেনো?”

রূপসা কোনো উত্তর দেয় না, শুধু অগ্নিচোখে অলির দিকে তাকিয়ে থাকে। ঠিক তখনই ভেসে আসে গম্ভীর, স্পষ্ট একটা কণ্ঠস্বর—
“অলিইইইই”

ডাকটা শুনে অলিসহ বাকিরা দরজার দিকে তাকালো আলভী অলিকে ডাকতে ডাকতে এদিকেই আসছে।
“দাদুমনি, অলি কি এইরুমে আছে?”

কথাটা শুনে দাদুমনি বললো,
“হ্যাঁ দাদুভাই তোমার বউ এখানেই আছে। অতো অধৈর্য্য হয়োনা”

আলভী রুমে ঢুকে কোনোদিকে না তাকিয়ে অলির উদ্দেশ্যে বললো,
“অলি চলো”

“কোথায় যাবো? আপনি কখন আসলেন?”

“আমি কিছুক্ষণ আগেই এসেছি। তোমার রুমে তুমি ছিলেনা তাই খুজতে খুজতে এখানে চলে আসলাম। চেক-আপের জন্য তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। রেডি হয়ে নেও”

অলি একটা ঢোক গিলে বললো,
“আমি হাসপাতালে যাবোনা”

আলভী অলির দিকে এগিয়ে গেলো। রূপসা একদৃষ্টিতে আলভীর দিকে তাকিয়ে আছে। আলভী যেনো রূপসাকে দেখেইনি। আগে যাও তার সাথে দু একটা কথা বলতো কিন্তু অলি এইবাড়িতে আসার পর থেকে আলভী যেনো তাকে চোখেই দেখেনা। আলভী অলির সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“তুমি বাবুকে দেখতে চাওনা?”

অলি চুপ করে রইলো। আলভী শান্তকন্ঠে বলে,
“ভয় পেয়োনা আল্ট্রাসাউন্ড করাবো শুধু, রেডি হয়ে নেও কুইক”

অলি ঠোঁট চেপে নিচের দিকেই তাকিয়ে রইলো। দাদুমনি স্নেহমাখা কন্ঠে বললো,
“দাদুভাইয়ের সাথে যাও নাতবউ। স্বামী সাথে থাকলে ভয় কিসের?”

অলি মাথা নেড়ে উঠে দাড়ালো। বাধ্য মেয়ের মতো রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। এমনিতেও বাবুর জন্য সে সবকিছুই করতে পারবে। আলভী ড্রইংরুমে বসে কারো সাথে ফোনে কথা বলছিলো। অলি রেডি হয়ে আসতেই আলভী অলিকে উপরনিচ পরখ করে নিলো। অলি বোরকা পড়েছে মাথায় হিজাব, হাতে একটা ছোট্ট ব্যাগ। আলভীর চাহনি দেখে অলি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে ব্যস্ত হাতে নিজের হিজাব ঠিক করতে লাগলো। আলভী একটা শ্বাস ফেলে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,
“ওড়না ঠিকঠাকই আছে। লেটস গো”

আলভী হাটা ধরলো। অলি তাকে অনুসরণ করে বেরিয়ে গেলো। আলভী সেইফলি কার ড্রাইভ করে হাসপাতালের সামনে গাড়ি পার্ক করলো। অলি বেশ বিরক্ত হয়েছে আলভী অনেক আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়েছে। সে বেশ কয়েকবার স্পিড বাড়াতে বলেছিলো কিন্তু বিনিময়ে আলভী শুধু শীতল চাহনি নিক্ষেপ করেছে।

হাসপাতালের চত্বরে গাড়ি থেমে যায়,
“নামো”

আলভীর কন্ঠ শুনে অলি তাকাতেই দেখতে পেলো আলভী কার ডোর ওপেন করে দাঁড়িয়ে আছে। অলি ধীরপায়ে গাড়ি থেকে নেমে দাড়ালো। আলভী একবার অলির দিকে তাকিয়ে হাটা ধরলো। পথিমধ্যে বেশ কয়েকজন পরিচিত চিকিৎসক আর নার্স আলভীর সাথে কথা বলেছে। তবে কেউ অলিকে ততোটা গুরুত্ব দেয়নি। তারা লিফটে করে ৭ তলায় এসে থামলো। লিফট থেকে নামতেই দিহান এগিয়ে আসলো,
“দিহান সব রেডি করে রেখেছিস?”

“হুম, ভাবী কেমন আছেন?”

‘ভাবী’ ডাকটা অলির কানে অদ্ভুত এক রেশ ফেলে, অলি উত্তর না দিয়ে মুখে সৌজন্যমূলক হাসি টানলো। আলভী অলিকে নিয়ে সোনোগ্রাফি রুমে প্রবেশ করলো। পুরো হাসপাতালেই এয়ার কন্ডিশনার লাগানো যার জন্য অলির একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। যদিও মির্জা ভিলাতেও এসি আছে কিন্তু হাসপাতালের এসির টেম্পারেচার একটু বেশিই ঠান্ডা। অলি বেডের উপর বসতেই আলভী সোনোগ্রাফি রুমের ডোর লক করে দিলো ফলস্বরূপ অলি বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়,
“দরজা আটকালেন কেনো?”

“কেনো আবার তোমার আল্ট্রাসাউন্ড করা হবে সেইজন্যই বন্ধ করে দিলাম”

অলি ভ্রু কুচকে বললো,
“ডাক্তার তো আসেনি। আল্ট্রাসোনোগ্রাম কে করবে?”

আলভী সোনোগ্রাফি মেশিনের সামনে চেয়ার টেনে বসলো। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি থাকতে আবার ডক্টরের কি প্রয়োজন? পেটের উপর থেকে কাপড়টা সরিয়ে ওখানে শুয়ে পড়ো”

“কিহহহহহ”

চলবে,,,

#১৫_বছর_বয়সী_মা (২১)
#সোফিয়া_সাফা

“কিহহহহহ”

অলির মৃদু চিৎকার শুনে আলভী কপাল কুচকে অলির দিকে তাকায়।
“কি সমস্যা? চিল্লাচ্ছো কেনো?”

অলি একটা ঢোক গিলে বললো,
“এখানে আর কোনো ডাক্তার নেই?”

আলভী শান্তকন্ঠে বললো,
“আমি নিজেই বেবির কন্ডিশন দেখতে চাইছি। সেইজন্য বেশি রিয়্যাক্ট না করে চুপচাপ শুয়ে পড়ো।”

অলি কি বলবে খুঁজে পেলোনা। সে ভীষণ নার্ভাস ফিল করছে, অলিকে চুপ থাকতে দেখে আলভী অলির সামনে এসে দাড়ালো। অলি দুপা পিছিয়ে গিয়ে বোরকার একপ্রান্ত খামচে ধরলো। তার বুকের ভেতর ধুকপুক ধুকপুক করছে। আলভী একটা শ্বাস ফেলে বললো,
“দেখো, এতোটা অপ্রস্তুত হওয়ার কোনো দরকার নেই। এই মুহূর্তে আমাকে শুধুমাত্র একজন ডক্টর ভাবো।”

অলি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো, আলভীর মেজাজ বিগড়ে গেলো। ফিসফিসিয়ে বললো,
“৫ সেকেন্ডের মধ্যে নিজে থেকে না শুয়ে পড়লে। আমিই তোমাকে জোর করে শুইয়ে দেবো”

কথাটা শুনে অলি বাধ্য হয়ে বেডের উপর বসলো,
“লাই ডাউন”

অলি ধীরগতিতে শুয়ে পড়লো। আলভী সোনোগ্রাফি মেশিনের সামনে বসলো। অলি ঠোঁট চেপে চুপচাপ শুয়ে আছে। আলভীর চোখে ধূসর ফ্রেমের চশমা, গায়ে এপ্রোন। আল্ট্রাসাউন্ড প্রোবটা হাতে নিয়ে সেটার উপর কিছুটা জেল লাগিয়ে নিলো। আলভী কার্ডিওলজিস্ট হলেও আল্ট্রাসাউন্ড করতে সে জানে, মেডিকেল লাইফে বহুবার মেশিনটি ব্যবহার করেছে হার্ট পেশেন্টদের ইকোকার্ডিওগ্রাম করার জন্য। ইকো এবং প্রেগন্যান্সি আল্ট্রাসাউন্ডে কিছু পার্থক্য থাকলেও, সাউন্ড ওয়েভের প্রিন্সিপল একই। যাই হোক আজ প্রথমবার সে আল্ট্রাসাউন্ড করবে তাও আবার নিজের বেবির কন্ডিশন দেখতে।

আলভী অলির দিকে তাকিয়ে বললো,
“কাপড়টা সরাও”

অলির ভীষণ কান্না পাচ্ছে, লজ্জায় সে যেনো জমে গেছে। আলভী কোমলকন্ঠে বললো,
“শুধু পেট থেকেই সরাতে বলেছি। আজেবাজে কিছু ভেবোনা। আই অ্যাম ভেরি কিউরিয়াস টু সি দ্য বেবি। প্লিজ লেট মি সি”

অলি আলভীর থেকে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকায়। লজ্জা গুলোকে সাইডে রেখে প্রথমে বোরকা টা বুক পর্যন্ত তুলে ফেলে। আলভী শান্তচোখে অলির দিকেই তাকিয়ে আছে। অলির পরণে ডার্ক রেড কালারের স্কার্ট। তবে টপসের রঙ টা আপাতত দেখা যাচ্ছেনা।
“এর আগে তো মনে হয় আল্ট্রাসাউন্ড করেছিলে তাইনা? তাহলে তো জানার কথা যে ড্রেস কতোটুকু সরাতে হবে”

অলি একটা শ্বাস ফেলে বললো,
“যখন আল্ট্রাসোনোগ্রাম করা হয়েছিলো তখন আমি অজ্ঞান ছিলাম তাই জানিনা”

আলভী এবার ফোনটা বের করে একটা ছবি খুঁজে বের করলো। স্ক্রিনে একটা মেডিকেল ইলাস্ট্রেশন ভেসে উঠলো। সে ছবিটা সামনে এগিয়ে ধরে বললো—
“ঠিক এইভাবে ড্রেস সরাও।”

রুমের মধ্যে যেন হিম শূন্যতা। বাতাসেও জমে আছে অজানা অস্বস্তি। অলি নিঃশব্দে শুয়ে থাকলেও তার ভেতরের কোলাহল যেন ছাপিয়ে আসছে দৃষ্টিতে, দেহভঙ্গিতে। তার চোখে জমে থাকা চাপা ভয়, বুকের গভীরে গেঁথে থাকা পুরোনো দুঃসহ স্মৃতিরা একসাথে আচ্ছন্ন করে রাখছে তাকে। সে জানে, এই অনুভূতিগুলো কেবল একজন ধ/র্ষি/তাই বুঝতে পারবে। বাকিদের কাছে এসব হয়তো শুধু বাড়াবাড়ি বলেই মনে হবে, “অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা” বলে হেসে উড়িয়ে দেবে সবাই।
অলির অবস্থা দেখে আলভীর ভেতরেও ক্লান্তি জমেছে। চেষ্টার পর চেষ্টা করেও সে যেন অলির মনের ভেতরের সেই ভয়ের দেয়াল ভাঙতে পারছে না। ধীরে ধীরে হতাশা এসে তাকে গ্রাস করে। একটা দীর্ঘ বিরক্তির শ্বাস ফেলে সে চশমাটা চোখ থেকে খুলে পকেটে ঢুকিয়ে নেয়। মাথায় যেন টনটন করছে কিছু একটা। চোখেমুখে অবসন্নতা ফুটে উঠেছে। সে আর কিছু না বলে পেছন ফিরে রুমের দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
তখনই অলি তড়িঘড়ি করে উঠে বসে। কণ্ঠটা ভয়ে আর অনুতাপে কেঁপে ওঠে—
“কোথায় যাচ্ছেন?”

আলভী নাতো উত্তর দিলো আর নাতো অলির দিকে ফিরে তাকালো সে চুপচাপ দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। অলি বোকাচোখে দরজার দিকেই তাকিয়ে আছে,
“লোকটা রেগেমেগে আমাকে একা ফেলেই চলে গেলো নাকি?”

অলি দ্রুতপায়ে বিছানা থেকে নেমে দাড়ালো দরজা খোলার জন্য হাত বাড়াতেই একজন মহিলা ডক্টর দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করলো। অলি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সে বলে ওঠে,
“আপনি তাসনীম স্যারের ওয়াইফ?”

অলি একটা ঢোক গিললো। তাসনীম নামটা শুনে সে মাথা খাটিয়ে বুঝতে পারলো ইনি আলভীর কথাই বলছে। অলি সাথে সাথেই হ্যাঁবোধক মাথা নাড়লো। উত্তরে মহিলাটি সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বললো,
“স্যার আমাকে আপনার আল্ট্রাসাউন্ড করে দিতে বললো। আপনি এসে শুয়ে পড়ুন।”

ডক্টর সোনোগ্রাফি মেশিনের সামনে গিয়ে বসলো। অলির একটু খারাপ লাগলো। আলভী বেবিকে দেখতে চেয়েছিলো কিন্তু অলির নার্ভাসনেসের কারণে দেখতে পারলোনা। সে কি একটু বেশিই চড়া ব্যবহার করে ফেললো?
*
আল্ট্রাসাউন্ড শেষে রিপোর্ট হাতে রুম থেকে বের হতেই দিহানকে দেখে অলি অবাক হলো। দিহান হাসিমুখে বললো,
“ভাবী চলুন আমি আপনাকে বাড়িতে রেখে আসছি”

অলি ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার বন্ধু কোথায়?”

“ও বললো ওর নাকি কাজ আছে। সেই জন্য আমাকেই দিয়ে আসতে বললো। চলুন”

অলি না বোধক মাথা নাড়ালো। সে জানে দিহান হচ্ছে আলভীর বন্ধু। আর রিফাতও আলভীর বন্ধু ছিলো। দিহান যদি রিফাতের মতো তাকে একজায়গার কথা বলে অন্য জায়গায় নিয়ে যায় তখন তার কি হবে? অলিকে না সূচক মাথা নাড়াতে দেখে দিহান চমকিত নয়নে তাকালো,
“আমার সাথে যাবেন না?”

“না আপনার বন্ধুকে আসতে বলুন”

“আরে ভাবী ও নিজেই আমাকে পাঠিয়েছে। আপনি চলুন না আমার সাথে। আমি একদম আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েই আসবো”

অলি সন্দিহান চোখে দিহানের দিকে তাকায়। কয়েক মূহুর্ত যেতেই ঝাঝালো কন্ঠে বলে ওঠে,
“আপনি গিয়ে আপনার বন্ধুকে পাঠিয়ে দিন। উনিই আমাকে এনেছে তাই উনিই আমাকে রেখে আসবে।”

দিহান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। সে ভেবেছিলো এই ফাঁকে ঊর্মিলাকে দেখে আসবে। ঊর্মিলা সেদিনের পর থেকেই তার কল রিসিভ করছেনা।
“কি হলো যান না। ওনাকে গিয়ে পাঠিয়ে দিন”

দিহান উপায়ন্তর না পেয়ে অন্যসাইডে গিয়ে আলভীকে কল করলো। তারপর অলির কথা বললো। কয়েক মিনিট যেতেই আলভী এসে হাজির হলো। অলি সরু চোখে আলভীর দিকে তাকিয়ে আছে। আলভী অলির দিকে না তাকিয়েই বললো,
“অলি দিহান তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবে ওর সাথেই চলে যাও”

আলভীর রাগীকন্ঠ শুনে অলি মাথা নিচু করে নিলো। সে বুঝতে পেরেছে তখনকার ঘটনাটার জন্য আলভী তার উপর বেশ অসন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু সে দিহানের সাথে কিছুতেই যাবেনা। আলভীর বন্ধুদের উপর তার কোনো ভরসা নেই।অলিকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আলভী চাপাস্বরে বলে ওঠে,
“দেখো এটা নাটক করার জায়গা নয়। আমার কাজ আছে, দিহানের ও কাজ আছে সেসব রেখেই তোমাকে দিয়ে আসতে রাজি হয়েছে। তাই চুপচাপ ওর সাথেই চলে যাও”

আলভীর কথায় অলি কেপে উঠলো, নিম্নস্বরেই বললো,
“আমি আপনার সাথেই যাবো”

অলির এই কথাটা শুনে আলভীর রাগ দপ করেই নিভে যায়। তবুও সে গম্ভীর কণ্ঠেই বলে,
“আমার কাজ শেষ হতে হতে রাত হয়ে যাবে। তুমি ততক্ষণ থাকতে পারবে?”

অলি সাথে সাথেই মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে। আলভী একটা শ্বাস ফেলে দিহানকে বলে,
“তুই নিজের কাজে যা।”

দিহান আর কি করবে? ভেবেছিলো ঊর্মিলার দেখা পাবে কিন্তু তাও হলোনা। যাক আগামী কালকে ঊর্মিলার কলেজের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার প্ল্যান করতে করতে নিজের চেম্বারের দিকে চলে গেলো। আলভী একবার অলির দিকে তাকায় তারপর উল্টো দিকে ঘুরে হাটা ধরে। অলিও ব্যস্ত পায়ে তাকে অনুসরণ করতে লাগলো।

রাতেরবেলা,

আলভী একের পর এক রোগী দেখতে ব্যাস্ত। সবাই সিরিয়াল অনুযায়ী আলভীর অ্যাপোয়েন্টমেন্ট নিচ্ছে। আলভী তাদের মধ্যে নতুনদের প্রয়োজন সাপেক্ষে কিছু টেস্ট লিখে দিচ্ছে। আর যারা টেস্ট করে এনেছে তাদের রিপোর্ট দেখে মেডিসিন লিখে দিচ্ছে। অলি পাশে থাকা সোফায় বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হচ্ছে। সে বেশ কিছুক্ষণ মায়ের সাথে কথা বলেছে তারপর গেমস খেলেছে কিন্তু কিছুতেই তার সময় কাটছেনা।
অলি মুখটাকে মলিন করে বসে আছে। বসে থাকতে থাকতে তার ঘুম আসছে, লাস্ট রোগিকে দেখা শেষ হলে আলভী হাফ ছেড়ে বাচে সে এগিয়ে যায় অলির দিকে। অলি সোফায় বসে থাকতে থাকতেই ঘুমিয়ে গেছে। আলভী বেশ কিছুক্ষণ অলির ঘুমন্ত মুখপানে তাকিয়ে রইলো। পাশেই অলির আল্ট্রাসাউন্ডের রিপোর্ট পড়ে আছে। আলভী রিপোর্টটা হাতে নিয়ে চোখ বুলালো। সবকিছু স্বাভাবিকই আছে। আলভী একটা শ্বাস ফেলে পুনরায় অলির দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো অলি ঘুমের ঘোরেই সোফা থেকে পড়ে যাচ্ছে। আলভী ধরতে যাবে তার আগেই অলির ঘুম ভেঙ্গে যায়।
আলভী দ্রুত গতিতে অলির থেকে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ায়।
“রোগী দেখা শেষ?”

অলির ঘুমজড়ানো কন্ঠ শুনে আলভী ধাক্কা খেলেও নিজেকে সামলে বলে ওঠে,
“হুম বাড়িতে চলো এবার।”

অলি টালমাটাল পায়ে উঠে দাড়ালো হাত দিয়ে চোখ দুটো কচলে স্বাভাবিক ভাবে তাকালো। আলভী চিন্তিত কন্ঠে শুধালো,
“আর ইউ স্লিপি?”

অলি মাথা নাড়িয়ে না বললো,
“চোখ লেগে গিয়েছিলো। চলুন”

অলি ব্যাগ আর রিপোর্ট রেখেই দরজার দিকে হাটা ধরলো। আলভী একটা শ্বাস ফেলে সেগুলো হাতে তুলে নিলো তারপর অলির পিছুপিছুই চলে গেলো।
*
আলভী গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট দিতেই অলি গোমড়া মুখে বলে ওঠে,
“আমি আর কোথাও আপনার সাথে যাবোনা, আপনি একটা দায়িত্বজ্ঞানহীন লোক”

অলির কথায় আলভী কোনোপ্রকার ভ্রুক্ষেপ করলোনা সে তো মন দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। আলভীর থেকে উত্তর না পেয়ে অলি বলে ওঠে,
“আপনি আজকে এতো ব্যস্ত ছিলেন তাহলে আমাকে আনলেন কেনো? শুধুশুধু বসিয়ে রেখেছেন। আপনি অনেক খারাপ”

আলভী একটা শ্বাস ফেলে বললো,
“তোমার আফসোস হচ্ছে নাকি আমাকে বিয়ে করে? হলে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেও।”

আলভীর কথাগুলো শুনে অলি স্তব্ধ হয়ে গেলো। সেই সাথে আলভীর প্রতি রাগটাও যেনো বেড়ে গেলো।
“আফসোস হয়তো আপনার হচ্ছে। সেই জন্যই ডিভোর্স দিতে বলছেন। এই জন্যই আপনার হাতে ডিভোর্স দেওয়ার ক্ষমতা দেইনি আপনি ১৯ থেকে ২০ হলেই আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার হুমকি দিবেন সেটা আমি আগেই বুঝে গিয়েছিলাম”

আলভী নিম্নস্বরে বললো,
“আমার সাথে এই টোনে আর কখনো কথা বলবেনা। আই ডোন্ট লাইক ইট”

“আই ডোন্ট কেয়ার। আপনি আমার লাইফ হেল করে দিয়েছেন। আমি আপনার সাথে এভাবেই কথা বলবো। কি করবেন আপনি?”

আলভী অলির দিকে শীতল চাহনি নিক্ষেপ করলো। আলভীর সেই চাহনি দেখে অলির শরীর হিম হয়ে এলো। আলভী পুনরায় সামনের দিকে তাকিয়ে বললো,
“বেশি কিছুনা জাস্ট নিখোঁজ হয়ে যাবো। আর কক্ষনো কারো সামনে আসবোনা। এমনিতেও আমার থাকা না থাকায় তোমার তো কিছু যাবে আসবেনা। আমার মনে হচ্ছে আমি না আসলেও তুমি তোমার বেবিকে নিয়ে ভালো ভাবেই বাচতে পারতে”

অলি ভীত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কোথায় যাবেন আপনি?”

“অফকোর্স আই ওন্ট টেল ইউ,”

“আপনি কিন্তু ভয় দেখাচ্ছেন আমাকে”

“আমি ভয় দেখাচ্ছি না শুধু ওয়ার্ন করছি। অবশ্য তোমার চিন্তা করতে হবেনা আমার অবর্তমানে আমার সব সম্পত্তি তো তুমিই পাচ্ছো।”

অলি মাথা নিচু করে নিলো।
“আমার আপনার সম্পত্তির উপর কোনো লোভ নেই। ওরকম শর্ত দিয়েছিলাম বাবুর কথা চিন্তা করে। আপনি ভবিষ্যতে যাতে ওকে কোনোকিছু থেকে বঞ্চিত করতে না পারেন সেইজন্য।”

আলভী নিশ্চুপ রইলো।
“তুমি আমাকে শুধুমাত্র বাবুর কথা ভেবে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছো তাইনা?”

অলি স্বাভাবিকভাবেই হ্যাঁবোধক মাথা নাড়ায়,
“আমাকে দেখলে ভয় লাগে তোমার? ঘৃনা করো আমাকে?”

অলি অবাক চোখে আলভীর দিকে তাকালো, আলভীর দৃষ্টি সামনের দিকেই নিবদ্ধ,
“তোমাকে তখন দিহানের সাথে আসতে বললাম আসলেনা কেনো?”

অলি স্বাভাবিক স্বরেই বলে ওঠে,
“উনি আপনার বন্ধু সেই জন্য আমি ওনাকে বিশ্বাস করিনা। আপনার এক বন্ধু আমাকে আপনার রুমে আটকে দিয়েছিলো। এই বন্ধুও যে সেরকম কিছু করবেনা তার কি গ্যারান্টি আছে?”

আলভী হঠাৎ করেই গাড়িটা ব্রেক করলো। অলির দিকে তাকিয়ে রাগীকন্ঠে বললো,
“দিহানকে নিয়ে এরকম চিন্তা একদম করবেনা। ও মোটেও রিফাতের মতো নয়। রিফাতের মতো হলে আমি ওকে তোমাকে নিয়ে আসতে বলতাম না”

“আমি কি চিন্তা করলাম না করলাম সেটা আমার বিষয়। আপনার বন্ধু আমার তো আর বন্ধু নয়। আপনার সাথে তো আপনার সেই বন্ধুও খারাপ কিছু করেনি। যা করার আমার সাথে করেছে।”

আলভী অবিশ্বাসী সুরে প্রশ্ন করলো,
“খারাপ কিছু করেনি মানে? ও আমাকে ধ/র্ষ/ক বানিয়ে দিয়েছে আর তুমি বলছো শুধু তোমার সাথেই খারাপ করেছে। তোমার কি মনে হয় ধ/র্ষ/ক নামটা শুনতে আমার অনেক ভালো লাগে?”

অলি অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনার তো খারাপ লাগার কথা নয়। আপনি যা করেছেন ইচ্ছাকৃত ভাবেই তো করেছেন। কেউ তো আপনাকে বাধ্য করেনি”

আলভী হাল ছেড়ে দিলো শুধু শুধু অলির সাথে তর্ক করে লাভ হবেনা। সে যদি বিষয় টা বুঝিয়ে বলতে যায় অলি তার কথা বিশ্বাস করবেনা। উল্টো অলি অবিশ্বাস করলে অলির প্রতি সে উগ্র হয়ে উঠবে নিজের রাগটাকে আর কন্ট্রোল করে রাখতে পারবেনা। আলভী পুনরায় গাড়ি স্টার্ট দিলো। অলিও ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরের দিকে তাকালো। পুরোটা রাস্তা দুজনের মাঝে আর কোনো প্রকার কথা হলোনা।
,
রাত্রী ১১ টা অলি বাড়ির সবার সাথে ডিনার করে সবেমাত্র নিজের রুমে এসে বসেছে।
“আজকে একাই ঘুমাতে হবে আমাকে। উফ একটা রাতেরই তো ব্যাপার কালকে যেভাবেই হোক আমি বাড়িতে চলে যাবো। এই অদ্ভুত বাড়িতে আমি আর থাকবোনা”

অলি খাটের ডান পাশে শুয়ে খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু ঘুমাতে পারলোনা, কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে ফোনটা হাতে নিয়ে গেমস খেলতে লাগলো। এরইমাঝে দরজা ঠেলে আলভী রুমে প্রবেশ করে। অলি শোয়া থেকে উঠে বসে মাথায় ওড়না প্যাচিয়ে নেয়। তার চুলগুলো এলোমেলো বিকালে হাসপাতালে যাওয়ার আগে বিনুনি করেছিলো এখনো সেরকমই আছে। আলভী এসে অলির পাশেই বসলো,
“তোমার ঘুমাতে প্রবলেম হলে আমার রুমে চলো”

অলি মাথা নাড়িয়ে বলে,
“না আমি ঠিক আছি। আপনি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন”

হঠাৎ করেই আলভী অলির বিছানায় শুয়ে পড়লো। অলি ঘাবড়ে গিয়ে কিছুটা দূরে সরে বসলো,
“আচ্ছা আমার রুমে তোমার যেতে কষ্ট হলে আমিই বরং এখানে শুয়ে পড়ি,”

অলির এবার ভীষণ কান্না পাচ্ছে, ইচ্ছা করছে দেয়ালের সাথে মাথা ঠুকতে,
“আপনি নিজের রুমে যান প্লিজ,”

“নো। আজকে আমি এই রুমেই ঘুমাবো”

অলি বিছানা থেকে নেমে দাড়িয়ে বলে,
“আচ্ছা আপনি তাহলে এখানে ঘুমান আমি দাদুমনির রুমে গিয়ে ঘুমাচ্ছি”

“ফুপু আর দাদুমনি একসাথে ঘুমায়। সেখানে যাওয়াটা তোমার জন্য ঠিক হবেনা। তাছাড়া দাদুমনি বয়স্ক মানুষ তোমার ঘুমানোর যেই স্টাইল তোমার সাথে একদিন ঘুমালে পরেরদিন আর সে ঘুমাতে চাইবেনা।”

অলি অবাক হয়ে গেলো,
“আমার ঘুমানোর স্টাইল সম্পর্কে আপনি জানলেন কিভাবে?”

আলভী কথা ঘুরিয়ে বললো,
“ইশা বলেছে। ও তো বাধ্য হয়েই তোমার সাথে ঘুমিয়েছিলো। কাজিন বলে নাও করতে পারেনি।”

“কিহ ইশাপু বলেছে? বিশ্বাস করিনা আমি। সে আমাকে নিয়ে এমন বাজে কথা কিছুতেই বলতে পারেনা।”

“তাহলে আমি জানলাম কিভাবে বলো?”

অলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে ওঠে,
“আমার ঘুমানোর স্টাইল সম্পর্কে জানার পরেও আপনি আমার সাথে ঘুমাতে চাইছেন কেনো?”

আলভী শোয়া থেকে উঠে বসে বললো,
“আমার একটা মাত্র বউ তুমি। শোয়ার স্টাইল যেরকমই হোকনা কেনো আমাকে তো তোমার পাশেই শুতে হবে তাইনা? আরেকটা বিয়ে করার তো অপশনও রাখোনি যে সেই বউয়ের সাথে ঘুমাবো”

“দেখুন বিয়ের আগেই বলে দিয়েছিলাম যে আমি আলাদা রুমে থাকবো। আপনি আমাকে টাচ করবেন না।”

“তোমাকে তো আলাদা রুমেই থাকতে দিয়েছি। আর টাচ কোথায় করলাম?”

অলি চুপ করে রইলো। আলভী শান্তস্বরে বললো,
“দেখো অলি, আমি চাইনা এই অবস্থায় তোমার ঘুমাতে প্রবলেম হোক। বা তুমি কোনোভাবে বেবিটাকে হার্ট করে ফেলো। কথা দিলাম তুমি না বলা পর্যন্ত বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া তোমাকে টাচ করবোনা। প্লিজ আমাকে এখানে শুতে দেও”

“বিশেষ প্রয়োজন মানে?”

“তখন স্টেজের উপর যেমন বিশেষ প্রয়োজনে টাচ করেছিলাম ঠিক সেরকম”

আলভীর কথায় অলি একটু সাহস পেলো। তাছাড়া আলভীকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখাই যায়,
“আচ্ছা আমি আপনার সাথে শুবো কিন্তু লাইট জ্বালানো থাকবে আর দরজা খোলা থাকবে।”

আলভী মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো,
“এবার এসে শুয়ে পরো,”

অলি দ্বিধা নিয়ে অন্যপাশে শুয়ে পড়লো,
“এদিকে এসে শোও খাট থেকে পড়ে যেওনা আবার”

অলি ঠিকভাবে শুয়ে পড়তেই আলভী নিজের জায়গায় শুতে যাবে তখনই কেউ দরজায় নক করে। অলি তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো। আলভী বিরক্ত সূচক শব্দ উচ্চারণ করে বললো,
“কে? দরজা খোলাই আছে ভেতরে এসো”

ইয়াদ দরজা ঠেলে ভেতরে এসে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো আমতা-আমতা করে বললো,
“স্যরি ভাইয়া, হয়তো বিরক্ত করে ফেলেছি। আসলে তুমি নিজের রুমে ছিলেনা সেই জন্যই এখানে খুজতে এসেছিলাম”

আলভী স্বাভাবিক স্বরেই বললো,
“কিছু বলবি?”

ইয়াদ মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
“হুম ভাইয়া। আসলে নিউ প্রজেক্টটা নিয়ে আমার কাছে একটা আইডিয়া আছে। সেটা নিয়েই তোমার সাথে ডিসকাশন করতে এসেছিলাম”

আলভী না চাইতেও উঠে দাড়ালো অলির উদ্দেশ্যে বললো,
“তুমি ফোন চেপে টাইম পাস করো আমি একটু পরেই আসছি”

অলি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো।

প্রায় আধাঘন্টা পর আলভী অলির রুমে ফিরে আসে কিন্তু সে এসে আর অলিকে খুঁজে পায়না।
“অলিইই”

অলির কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেলোনা।
“মেজাজটাই ঠিক রাখতে পারবোনা এবার। এই মেয়েটা এতটুকু সময়ের মধ্যে কোথায় হাওয়া হয়ে গেলো?”

আলভী বেশি কিছু না ভেবে অলিকে কল দিলো। ২ বার রিং হতেই অলি কলটা রিসিভ করলো।
“হ্যালো, কোথায় গেছো তুমি?”

অপরপাশ থেকে ভেসে আসা অলির উত্তরটা শুনে আলভীর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।

চলবে,,,

শব্দসংখ্যা- ২৩৫০+