#১৫_বছর_বয়সী_মা (৩১)
#সোফিয়া_সাফা
“একদম চুপ”
আলভীর জোরালো কন্ঠে পুরো বাড়িটাই যেনো কেপে উঠলো,
“একদম নিজেদের সীমা লঙ্ঘন করবেন না। আপনাদের সাহস হয় কি করে আমার সামনে এই ধরনের মন্তব্য করার?”
শাহানাজ বেগম বললেন,
“তুই যতোই আমাদের উপরে চিল্লাস না কেনো। তুই নিজেও কি একদম জোর দিয়ে বলতে পারবি যে ওটা তোর বাচ্চা?”
আলভী শাহানাজ বেগমের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
“তোমাদেরকে কখনো কেউ এরকম প্রশ্ন করেছিলো? কেউ জিজ্ঞেস করেছিলো? যে আমি উসমান মির্জার ছেলে কিনা? কাকীমা, আপনার দিকে কেউ আঙুল তুলে জিজ্ঞেস করেছিলো যে ইয়াদ—ইয়ামিন মির্জার ছেলে কিনা? ফুপি, আপনাকে করেছিলো কেউ এই ধরনের প্রশ্ন?”
আলভীর কথা শুনে সবাই হতভম্ব হয়ে আলভীর দিকেই তাকিয়ে আছে,
“তাহলে আপনারা কোন সাহসে এই ধরনের প্রশ্ন করছেন?”
শাহানাজ বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে ওঠে,
“এভি তুই ভুলে যাচ্ছিস আমি বনেদি পরিবারের মেয়ে। কখনো তোর মায়ের চরিত্র নিয়ে কাউকে বাজে মন্তব্য করতে শুনেছিস? কেউ বাজে মন্তব্য এই জন্যই করতে পারেনি কারণ আমার চরিত্রে এই পর্যন্ত কোনো দাগ লাগতে দেইনি আমি। সেই জন্যই আমাকে কেউ প্রশ্ন করতে আসেনি যে তুই উসমান মির্জার ছেলে কিনা। শুনে রাখ আমাদের সাথে তোর চরিত্রহীনা বউয়ের তুলনা করতে আসিস না। তোর বউয়ের চরিত্রে দাগ আছে বিধায় ওকে এই সমস্ত প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে আর ভবিষ্যতেও হবে”
আলভী বলার মতো আর কিছু খুঁজে পেলোনা। সে জানে অলিকে তারা পছন্দ করেনা সেই জন্যই সুযোগ পেয়ে সবাই মিলে এভাবে আক্রমণ করছে। আর এই সুযোগটা মূলত অলিই তাদেরকে করে দিয়েছে। আলভী কারো দিকে না তাকিয়ে বেসিন থেকে হাত ধুয়ে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে হাটা ধরলো। অলি এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেও আলভীকে চলে যেতে দেখে সেও তার পিছু পিছু ছুটে গেলো।
আলভী গাড়ির দরজা খোলার উদ্দেশ্যে হাত বাড়াতেই অলিকে তার দিকে ছুটে আসতে দেখে থমকে যায়। অলি কোনো কিছু না বলে চুপচাপ আলভীর সামনে এসে দাড়ালো,
“কি চাই? পিছুপিছু ঘুরছো কেনো?”
অলি নিজের চোখজোড়া মুছে মাথা নত করে বললো,
“আমি আপনার সাথেই যেতে চাই। প্লিজ আমাকে একা রেখে যাবেন না।”
আলভী ঘুরে দাড়াল অলির দিকে,
“আমার সাথে কোথায় যাবে?”
অলি কিছুক্ষণ ঠোঁট চেপে পেভমেন্টের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
“২ দিন আগে আমার মা এক্সিডেন্ট করেছিলেন। তাকে নিয়ে হসপিটালে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখান থেকেই আপনার বন্ধু রিফাত—নোমান ভাইয়াকে দিয়ে আমাকে কিডন্যাপ করিয়ে নিয়েছিলো। আমি এখন পর্যন্ত জানিনা আমার মা কেমন আছে। আপনি যদি আমাকে সেখানে নিয়ে যেতেন…
আলভী অবাক হয়ে বলল,
“ওয়েট ওয়েট, আম্মু কিভাবে এক্সিডেন্ট করেছিলেন? আমি তো এই বিষয়ে কিছুই জানতে পারলাম না”
অলি কান্না আটকে বলল,
“শপ থেকে ফেরার পথে ছিনতাইকারী মায়ের ব্যাগ নিয়ে যায় মা তাদের পিছু নিলে উল্টো দিক থেকে আসা একটা গাড়িতে মায়ের এক্সিডেন্ট হয়েছিলো। আমি আপনাকে কল দিয়েছিলাম কিন্তু আপনার ফোন তো অনেকদিন ধরেই বন্ধ বলছে”
আলভী কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“তুমি বললে যে, তোমাকে সেখান থেকে কিডন্যাপ করা হয়েছিলো? তারমানে গতকালকের সবকিছু তোমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়ে তোমাকে দিয়ে ফোর্সফুলি করিয়েছিলো তাইতো?”
অলি উপরনিচ মাথা নাড়ালো। আলভী বলল,
“তাহলে এখন তুমি ছাড়া পেলে কিভাবে? তারা তোমাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিলো?”
অলি বেশিকিছু না ভেবেই বলে ওঠে,
“আমাকে ভয় দেখিয়ে ডিভোর্স পেপারে সাইন দিতে বলেছিলো। তাদের প্ল্যান ছিলো ডিভোর্স পেপারে সাইন করিয়ে আমাকে মে*রে ফেলবে। ভাগ্যিস নোমান ভাইয়া ছিলো। নইলে তো এতোক্ষণে ওরা আমাকে আর বাবুকে মে*রেই ফেলতো। সত্যিই নোমান ভাইয়া অনেক ভালো”
অলির মুখ থেকে নোমানের প্রশংসা শুনে আলভী বেশ রেগে যায়। অলি সেটা না বুঝেই বলে ওঠে,
“আপনার কাজ শেষ হলে কি আমাকে একবার মায়ের কাছে নিয়ে যাবেন?”
আলভী কোনোকিছু না ভেবেই বলে ওঠে,
“পারবোনা। তুমি বরং তোমার নো-ম্যান সাইয়ার সাথেই চলে যাও। সে তো অনেক ভালো তাইনা? তোমাকে সেইফলি তোমার মায়ের কোলে ল্যান্ড করিয়ে দেবে।”
কথাটা বলেই আলভী গাড়ির দরজা খুলে গাড়িতে উঠে বসতে যাবে তখনই অলি পেছন থেকে আলভীর ওভারকোটের কোণা টেনে ধরে। আলভী ভ্রু কুচকে অলির দিকে তাকায়। অলির চোখজোড়া ছলছল করছে। আলভী একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল,
“ভাবছি চুক্তিনামায় আমিও একটা শর্ত এড করবো। এইযে সকাল থেকে তুমি আমার জামাকাপড় ধরে টানাটানি করছো এটা আমার মোটেও ভালো লাগছেনা।”
অলি আলভীর ওভারকোট ছেড়ে দিল,
“প্লিজ আমাকে নিজের সাথে নিয়ে যান।”
আলভী কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে উঠে ইঞ্জিন স্টার্ট দিলো। তখনই অলি বলে ওঠে,
“আপনি আমাকে রেখে গেলে আমার যেদিকে দুচোখ যাবে আমি সেদিকেই চলে যাবো। এই জীবনে আর কক্ষনো আপনার মুখোমুখি হবোনা।”
আলভী গাড়ির উইন্ডো দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলে,
“তাতো জানিই এখন তো তোমার যাওয়ার জায়গাও আছে তাইনা? তো তোমার সেই শুদ্ধ পুরুষ নো-ম্যানের কাছে যাবে নাকি অন্য কারো কাছে যাবে?”
অলি কিছু একটা ভেবে বলে ওঠে,
“অফকোর্স আই ওন্ট টেল ইউ,”
অলির কথায় আলভী স্তব্ধ হয়ে যায়। মেয়েটা সুযোগ পেলেই তার কথা তাকেই ঘুরিয়ে দেয়। আলভীকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে অলি উল্টো দিকে ঘুরে হাটা ধরলো। আলভী না থাকলে তাকে নিজের জন্য একটা সেইফ প্লেস খুজতে হবে। তার হাতে বেশি সময় নেই। না জানি ওদিকে নোমানের উপর দিয়ে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অলি কয়েক পা এগিয়ে যেতেই আলভী পেছন থেকে ডেকে ওঠে,
“মিসেস অলি তাসনীম মির্জা, আপনার দুচোখ যেন আমার দিকে ছাড়া আর অন্য কোনো দিকে না যায়। সেই বিষয়ে খেয়াল রাখবেন। ইউ হ্যাভ অনলি ফাইভ সেকেন্ডস তারাতাড়ি আমার দিকে চলে আসুন কুইক।”
অলির ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। এইমূহুর্তে আলভীর সাথে থাকাটাই তার জন্য সবচাইতে সেইফ। কারণ আলভীর কোনো ক্ষতিই সেই লোকগুলো করবেনা। যদিও অলি জানেনা যে আলভীকে ২য় বিয়ে করিয়ে তাদের কি এমন লাভ হবে বা আলভীকে তাদের ঠিক কি কাজে লাগবে। তবে রিফাতের কথাগুলো থেকেই অলি বুঝে গেছে, আপাতত আলভীর কোনো ক্ষতিই তারা করবেনা।
অলি দ্রুতপায়ে আলভীর দিকে চলে যায়। আলভী অলির জন্য ডোর ওপেন করতেই অলি গাড়িতে উঠে বসে।
বেলা এগারোটা বাজে।
দেয়ালঘড়ির টিকটিক শব্দটা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, কারণ অফিসরুমের পরিবেশ নিঃস্তব্ধ। বড় একজোড়া জানালা দিয়ে রোদের নরম আলো এসে পড়েছে সাদা পর্দার ওপর। পর্দার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়া রোদের রেখা ছায়া ফেলছে অফিসরুমের এককোণে রাখা ধূসর রঙের সোফার ওপর। সেই সোফাতেই বসে আছে অলি।
সে নিঃশব্দে বসে আছে, কিন্তু চোখেমুখে বিরক্তি স্পষ্ট। দুই কনুই হাঁটুর ওপর ভর করে থুতনি ঠেকিয়ে রেখেছে তালুর ভেতর। তার পায়ের তালু দুটো বারবার কার্পেটের গায়ে ঘষা খাচ্ছে। কখনো সে আলভীর দিকে তাকায়, কখনো দেয়ালে ঝুলে থাকা কালো ফ্রেমের অদ্ভুত কিছু আর্ট দেখে। কয়েক মিনিট পরপরই সে বিরক্ত মুখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
অলির সামনে বসা আলভী একেবারে ডুবে আছে নিজের কাজে। চোখ দুটো স্ক্রিনে আটকে, একের পর এক মেইল পড়ছে, প্রেজেন্টেশন যাচাই করছে। মাঝে মাঝে কী-বোর্ডে টাইপ করার শব্দ ভেঙ্গে দিচ্ছে অফিসরুমের নিঃস্তব্ধতা।
আলভীর ডেস্কের পাশে কফির কাপ ঠান্ডা হয়ে গেছে, কিন্তু সে খেয়ালই করছে না। রুমে থাকা সেন্টের মৃদু সুবাস আর এসির ঠান্ডা বাতাসেও অলির অস্থির মন শান্ত হচ্ছে না।
অলি শুধু ভাবছে কখন সে মায়ের কাছে যাবে। মায়ের জন্য ভীষণ চিন্তা হচ্ছে তার। হঠাৎ করেই অলির পেট থেকে গুড়গুড় শব্দ ভেসে আসে। অলি আঁতকে উঠে আলভীর দিকে তাকায়—আলভী শুনেছে কিনা বোঝার চেষ্টা করে। কিন্তু না, আলভী তখনো মন দিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে, টাইপ করে যাচ্ছে।
কিন্তু… কয়েক সেকেন্ড যেতেই আলভীর আঙুল থেমে যায়। সে আস্তে করে মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে অলির দিকে তাকায়। অলি এখন সোফার পাশের বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে। ঠোঁটের কোণে ক্লান্তি। আলভীর মনে পড়ে যে অলি সকাল থেকে এই পর্যন্ত কিচ্ছুটি খায়নি। কাজের প্রেশারে সে ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছিল। আলভী অলির থেকে চোখ সরিয়ে তার পিএ সোহেলকে মেইল পাঠালো।
—আমার অফিসরুমে খাবার পাঠিয়ে দেও।
সোহেল নিজের ডেস্কে বসে কাজ করছিলো। আলভীর মেইল দেখে সে বেশ অবাক হয়ে যায়। তবে পরক্ষণেই মনে পড়ে যে আজকে মিসেস তাসনীম মির্জাও আলভীর সাথে এসেছেন। ভাবনাটা মাথায় আসতেই সোহেল জিজ্ঞেস করে,
—কি খাবার পাঠাবো স্যার?
—নুডলস, স্যান্ডউইচ, পেস্ট্রি, আর জুস… যত তারাতাড়ি সম্ভব পাঠাও,
মেইলটা পাঠিয়ে আলভী পুনরায় অলির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“ডাম্ব গার্ল, ক্ষুধা লেগেছে সেটাও মুখ ফুটে বলতে পারছেন না। আমার সাথেই যত্তসব ন্যাকামি। ওই নো-ম্যানের সাথে গিয়ে তো ভালোই নুডলস অর্ডার করে খেতে পেরেছিল”
আলভী পুনরায় কাজে মন দেয়, যেন কিছুই হয়নি।
১৫ মিনিট না পেরোতেই কেউ একজন দরজায় নক করে। যার শব্দে অলি তড়িঘড়ি করে উঠে বসে নিজের মাথার ওড়না ঠিক করে নেয়। বোরকা না পড়ে আসাতে তার একটু অস্বস্তি লাগছে কিন্তু তখন বোরকা পড়ে আসার মতো সময় ছিলোনা তাছাড়া তার সব কাপড়চোপড় সে বাবার বাড়িতেই রেখে এসেছে। আলভী স্ক্রিনের দিকে চোখ নিবদ্ধ রেখেই
ছোট্ট করে বলল,
“কাম ইন”
অনুমতি পাওয়া মাত্রই একজন স্টাফ ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে রুমে ঢুকে পড়ে। ট্রে ভর্তি খাবার দেখে অলির চোখ আটকে যায়। স্টাফ ট্রে টা অলির সামনের টেবিলের উপরে রেখে অফিসরুম থেকে বেরিয়ে যায়। অলি একবার আলভীর দিকে তাকায় কিন্তু আলভীর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে সে নিজের কাজে অনেক ব্যস্ত। অলি বেশি কিছু না ভেবে নুডলসের বাটিটা হাতে নিয়ে খেতে লাগলো। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা থাকায় নুডলস টা যেন অমৃত বলেই মনে হচ্ছে। অলির খাওয়ার গতি দেখে আলভীর চোখ আটকে যায়। মেয়েটা এতো বেশি ক্ষুধা নিয়েও চুপচাপ বসে ছিলো?
খাওয়ার মাঝেই হঠাৎ অলির চোখ যায় আলভীর দিকে। আলভীকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অলি মুখের খাবার টুকুও যেন গিলতে ভুলে যায়। অলির রিয়েকশন দেখে আলভী চোখ সরিয়ে পুনরায় স্ক্রিনের দিকে মনোযোগ দিলো। কিছুক্ষণ যেতেই কাধের উপর কারো আলতো স্পর্শে আলভী ভ্রু কুচকে পাশে তাকাতেই দেখলো অলি পেস্ট্রি হাতে দাঁড়িয়ে আছে,
“কি চাই?”
আলভীর গম্ভীর কণ্ঠ শুনে অলি একটা শুষ্ক ঢোক গিলে মিনমিনিয়ে বলল,
“স্যরি, আমি হয়তো আপনার জন্য আনা খাবার গুলো খেয়ে ফেলেছি।”
অলির কথা শুনে আলভী থমকে গেলো। আলভীকে চুপ থাকতে দেখে অলি পুনরায় বলে ওঠে,
“আপনি এটা খেতে পারেন। আমি এটায় হাতও লাগাইনি।”
আলভী একবার অলির হাতে থাকা পেস্ট্রির দিকে তাকিয়ে পুনরায় অলির দিকে তাকায়। আলভীর সাথে চোখাচোখি হওয়া মাত্রই অলি মাথা নিচু করে নেয়,
“খাবার গুলো তোমার জন্যই আনা হয়েছিল। তাই এটাও তুমিই খেয়ে নেও”
আলভীর শীতল কন্ঠে অলির শরীর অসাড় হয়ে এলো৷ সে প্লেটটা নিয়ে ফিরে আসার জন্য ২পা এগিয়ে আবারও আলভীর দিকে ফিরে তাকায়। আলভী এখনো অলির গতিবিধিই পর্যবেক্ষণ করছিলো। অলি একটু ইতস্তত করে বলেই ফেলে,
“আপনিও তো সকালে ব্রেকফাস্ট শেষ না করেই চলে এসেছিলেন। আপনার ক্ষুধা লাগেনি?”
আলভী স্ক্রিনের দিকে ফোকাস করে বলল,
“কাজ করার সময় আমি ক্ষুধা অনুভব করিনা। যাও এখান থেকে”
“এটা কিভাবে সম্ভব এখন বেলা সাড়ে এগারোটা বাজে আর আপনি বলছেন কাজ করছেন সেই জন্য ক্ষুধা অনুভব করছেন না?”
“আমি অনেক ব্যস্ত আছি। বিরক্ত কোরোনা।”
অলি আর বেশিকিছু না বলে আলভীর কাছ থেকে সরে যায়। আলভী একবার আড়চোখে অলির দিকে তাকিয়ে আবারও কাজে মন দেয়। কিছুক্ষণ যেতেই অলি আবারও আলভীর পাশে এসে দাড়ালো। এইমূহুর্তে আসমা বানুর বলা একটা কথা তার মনে পড়ছে,
*আচ্ছা তুই কখনো এরকম কিছু করেছিস যার জন্য আলভীর তোর কথা মনে পড়বে?*
অলি সব ভাবনা সাইডে রেখে এক টুকরো পেস্ট্রি হাতে নিয়ে আলভীর মুখের সামনে ধরলো। আচমকা এরকম হওয়াতে আলভী হকচকিয়ে অলির দিকে তাকায়। অলি দ্রুতগতিতে বলে ওঠে,
“দেখুন আমি নিজের হাত খুব ভালো করে ধুয়ে এসেছি। আপনাকে কোনো কিছু অনুভব করতে হবেনা শুধু হা করুন”
আলভী কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই অলি পেস্ট্রির টুকরোটা আলভীর মুখে ঢুকিয়ে দেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় আলভীর চোখ বড়বড় হয়ে যায়। তবে সে অলিকে কিছুই বলতে পারেনা। আলভীকে চুপচাপ খেতে দেখে অলির ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে ওঠে। আলভী মুগ্ধ হয়ে অলির দিকেই তাকিয়ে আছে। অলির গালের দাগগুলো কালচে রঙ ধারণ করতে শুরু করেছে। আলভী আনমনেই অলির গালে হাত রেখে বলে ওঠে,
“এগুলো মেক-আপ নয়, তাইনা?”
আলভীর আলতো স্পর্শেও অলি খানিকটা ব্যাথা পেয়ে যায়, মুখ ফসকে বলে ফেলে,
“হাত সরান প্লিজ”
অলির কথাটা আলভীর পছন্দ হলোনা সে নিজের হাত সরিয়ে বলল,
“আমি তোমাকে স্পর্শ করার জন্য ডেস্পারেট নই। জাস্ট মেক-আপ গুলো একটু বেশিই রিয়েলিস্টিক লাগছিলো। সেই জন্যই…
আলভী কথাটা শেষ করতে পারলোনা তার আগেই অলি নিজের দুহাত দিয়ে আলভীর ডান হাতটা ধরলো তারপর আলভীর সেই হাতটা নিজের গালে ঠেকাল। আলভী অবাক চোখে অলির দিকেই তাকিয়ে আছে। অলির হাতের কম্পন সে অনুভব করতে পারছে। অলির হাতদুটো অসম্ভব রকমের কাপছে। অলি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে ওঠে,
“আপনি আমাকে যখন ইচ্ছা তখন স্পর্শ করতে পারেন আমি অনুমতি দিয়ে দিলাম। আর ১,৩ নম্বর শর্ত বাদে বাকি শর্তগুলোও আমি তুলে নেবো।”
আলভী কিছু বলতে যাবে তার আগেই দরজায় নক পড়ে। অলি আলভীর হাত ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে সরে দাঁড়ায়। অলি জানেনা কেনো কিন্তু আলভীকে এখনো সে ভয় পায়। আলভীর হাত ধরা আর সিংহের হাত ধরা তার কাছে সমান ছিলো। এদিকে এমন টাইমে ডিস্টার্ব করায় আলভী বেশ বিরক্ত হলো তবুও দরজার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে বলল,
“কাম ইন”
সোহেল হাতে করে অনেকগুলো ফাইল নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো। ফাইলগুলো আলভীর ডেস্কের উপর রেখে বললো,
“স্যার ফাইলগুলোতে আপনার সাইনের প্রয়োজন।”
আলভী ফাইলগুলোর দিকে তাকিয়ে বেশ বিরক্ত হলো। সাইন চাইলেই কি সাইন দিয়ে দেওয়া যায়? সেগুলো তো আগে চেক করতে হবে তাইনা? কিন্তু এতো গুলো ফাইল সে কতোক্ষনে চেক করবে? আলভী একবার অলির দিকে তাকালো। মেয়েটা অন্যদিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আলভী কিছু একটা ভেবে বলে ওঠে,
“ইয়াদ অফিসে আছে?”
সোহেল বলল,
“না স্যার, ইয়াদ স্যার আজকে অফিসে আসেননি।”
“ওকে, তুমি যাও। আমি এগুলোতে সাইন করে তোমাকে ডাক দেবো”
সোহেল মাথা নেড়ে চলে যায়। ফাইলগুলো দেখে আলভীর প্রচন্ড রাগ উঠছে। সে তো সব কাজ তারাতাড়ি শেষ করতে চাইছিলো। কিন্তু কাজ আরও বেড়ে গেল। তার উপর ইয়াদও আসেনি। উসমান মির্জা আর ইয়ামিন মির্জাও নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছেন। তাছাড়া এই ফাইলগুলো অনেক বেশিই ইম্পোর্ট্যান্ট, তার নিজেরই চেক করে দেখা উচিৎ। আলভী একটা শ্বাস ফেলে ফাইলগুলো চেক করতে লাগলো। অলিও বুঝতে পারলো যে আলভীর অনেক কাজ আছে। সে আর আলভীর কাছে না গিয়ে সোফায় গিয়ে বসে পড়লো।
অন্যদিকে—
“বস বিশ্বাস করুন, আমি নিজেও জানিনা যে মেয়েটা কিভাবে পালিয়ে গেছে।”
নোমানের কথা শুনে রাগে ফেটে পড়ে ফোনের ওপাশে থাকা রিফাত,
“আমার কেনো মনে হচ্ছে যে তুই নিজেই ওকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিস?”
“বস আপনি এসব কি বলছেন? আপনি তো জানেনই যে টাকাগুলো আমার কতো বেশি প্রয়োজন। তাছাড়া আমি যদি মেয়েটাকে বাচাতেই চাইতাম তাহলে কি কিডন্যাপ করে নিয়ে আসতাম? আপনিই বলুন,”
ফোনের ওপাশে থাকা রিফাতের হাত থেকে অন্য লোকটা ফোনটা নিয়ে বলে ওঠে,
“অতোগুলো গার্ডস থাকতে কি করে মেয়েটা পালিয়ে গেলো? তুই কি করছিলি তখন?”
“বস আমি মেয়েটার হাতে ঘুমের ইঞ্জেকশন পুশ করে দিয়ে নিজের রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তারপর আমার আর কিচ্ছু মনে নেই। সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গতেই দেখলাম আমি হসপিটালে আছি। বস মেয়েটা প্রচন্ড চালাক, আমাকেই ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে পালিয়ে গেছে।”
ফোনের ওপাশে থাকা লোকটা কর্কশ কন্ঠে বলে ওঠে,
“আমি জানিনা কিভাবে কিন্তু মেয়েটাকে আবারও বন্দি কর নোমান। নয়তো ওই মেয়েটার জায়গায় তোর নানীকেই ক*বর দেবো আমি। তুই আমাকে চিনিস না।”
লোকটার কথা শুনে নোমান আঁতকে উঠল। লোকটা যে এতটা নৃশংস সেটা নোমান ভাবতেও পারেনি। নোমান যদি জানতো যে আঘাত টা তার নানুর উপর এসে পড়বে তাহলে অলিকে সে কোনোভাবেই পালিয়ে যেতে সাহায্য করতোনা। টুট টুট আওয়াজে কল কেটে যায়,
—
বিকেল ৩টা আলভীর কাজ কিছুক্ষণ আগেই শেষ হয়েছে। আলভী সব ফাইল গুলো গুছিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালো। রুমের কোণায় থাকা সোফার দিকে চোখ পড়তেই থমকে গেল। সেখানে বসে থাকতে থাকতে অলি কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে, সে নিজেও টের পায়নি। চোখ বোজা মুখটায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। অলির গালের দাগগুলো দেখে আলভীর বুক কেঁপে উঠলো। সে চোখ নামিয়ে ধীরে ধীরে অলির সামনে এসে বসল। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ—চোখে একরাশ অপরাধবোধ।
“তোর চেহারার এই অবস্থা রিফাত করেছে তাইনা? আমি ওকে ছাড়বোনা হানিবি। আ’ম স্যরি আমি তোকে প্রোটেক্ট করতে পারিনি। আমার উচিৎ ছিলো তোকে জোর করে নিজের কাছে আটকে রাখা। আসলে আমি শুনেছিলাম ভালোবাসলে নাকি আটকে রাখতে নেই। মুক্ত করে দিতে হয়। আর মুক্ত করে দেওয়ার পরেও যে চলে না গিয়ে ফিরে আসে তাকে অনেক যত্ন করে আগলে রাখতে হয়। আমি জানিনা কি হচ্ছে বা ভবিষ্যতে কি হবে কিন্তু আমি আজ থেকে তোকে প্রটেক্ট করবো, তোকে আগলে রাখবো। প্রমিস করলাম”
অফিসরুমের ভেতরে যেন একটা ভারী নীরবতা নেমে এলো। জানালার পর্দা নড়ছে ধীরে ধীরে, আলভী নীচু হয়ে অলির চুলে হাত বুলিয়ে দিলো নিঃশব্দে।
চলবে,,,
শব্দসংখ্যা- ২৪০০+
#১৫_বছর_বয়সী_মা (৩২)
#সোফিয়া_সাফা
বিকেলের নরম আলোয় সূর্যের তেজ যেন একটু একটু করে মিইয়ে এসেছে। আকাশের এক কোণে ছড়িয়ে থাকা মেঘেদের গায়ে লেগে আছে হালকা সোনালি আভা। প্রশস্ত রাস্তায় সুনসান নীরবতা, এই নির্জন বিকেলবেলায়, ছায়া-ছায়া আলো গায়ে মেখে, একটি গাড়ি ছুটে চলেছে শহরের ফাঁকা রাস্তায়। স্টিয়ারিংয়ে আলভীর শক্ত কিন্তু শান্ত হাত। তার দৃষ্টি সামনে, পাশের সিটে অলির নিরুত্তাপ উপস্থিতি। অলি নিঃশব্দে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে, উইন্ডোর কাচের উপর তার কপাল ঠেকানো। আলভী চট করে অলির দিকে তাকিয়ে বলল,
“লাঞ্চ করতে বললাম সেটাও করলে না। মায়ের কাছে যাবার জেদ ধরেছো। বললাম ড্রাইভারের সাথে চলে যাও সেটাও শুনলেনা। কি সমস্যা তোমার?”
অলি কোনো উত্তর দিলো না। পূর্বের ন্যায়েই গাড়ির উইন্ডোতে মাথা ঠেকিয়ে বসে রইলো। তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। আলভী সামনের দিকে দৃষ্টি রেখেই এবার নিচু স্বরে বলল,
“আজকে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিলো। কতোগুলো প্যাশেন্টকে এসে ফিরে যেতে হবে, সেই ধারণা আছে?”
অলি হালকা গলায় বলল,
“আমি জেদ ধরেছিলাম তবে জোর তো করিনি। আপনি আসলেন কেনো?”
এক মুহূর্তের নীরবতা। এরপর আলভী ধীর গলায় উত্তর দিলো,
“আম্মু অসুস্থ, জামাই হিসেবে আমার যাওয়াটা উচিৎ বলে মনে হয়েছে সেই জন্যই এসেছি।”
অলি এবারও আলভীর দিকে না তাকিয়েই বলল,
“রোগী দেখার পরেও যাওয়া যেতো”
আলভী এবার অলির দিকে তাকালো, কিন্তু অলি এখনো জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। যেন এক অদ্ভুত শীতলতা ছড়িয়ে আছে অলির অভিব্যক্তিতে। আলভী হতাশার শ্বাস ফেলে বলল,
“আমার জায়গায় আরেকজন ডক্টর রোগী দেখবে বলে কথা দিয়েছে।”
“বেশ তো, তাহলে রোগীদের ফিরে যেতে হবে কেনো?”
আলভী এবার আরেকটা গভীর শ্বাস ফেলে চোখ ফেরালো রাস্তায়, তারপর উদাহরণ টেনে বললো,
“ধরো তুমি ডেইজি ফুল কিনতে গিয়েছো কিন্তু গিয়ে দেখলে সেখানে গোলাপ ফুল বিক্রি করা হচ্ছে। তখন তুমি কি করবে?”
অলি এবার প্রথমবারের মতো মাথা তুলে আলভীর দিকে তাকালো। চোখেমুখে কোনোরকম রাগ নেই, স্বাভাবিক স্বরেই বললো,
“অবশ্যই আমি গোলাপ ফুলই কিনে নেবো।”
আলভী ভ্রু কুঁচকে অলির দিকে তাকাতেই, অলি একটু হেসে আবারও বললো,
“আমি ডেইজি ফুলের চাইতে গোলাপ ফুল বেশি পছন্দ করি। সেই হিসেবে আমি গোলাপ ফুল পেয়ে আরও বেশিই খুশি হয়ে যাবো।”
আলভী নিজমনেই বলে উঠলো,
“এতো ফুলের মধ্যে গোলাপ ফুলই পছন্দ করতে হলো? যেটাতে আমার এলার্জি? হাহ আমাদের পছন্দ অপছন্দ সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী তাইনা?”
—
গাড়ির ইঞ্জিনের মৃদু গুঞ্জন ছাড়া চারপাশে নিখাদ নীরবতা। যেন শব্দগুলোও একে অপরকে এড়িয়ে যাচ্ছে।
অলি আরো কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে প্রশ্ন ছুড়লো,
“আচ্ছা, আপনারও কি মনে হয় যে বাবুটার বাবা আপনি নন?”
প্রশ্নটা এমনভাবে তেড়ে এলো, যেন কোনো অতর্কিত ঝড় জানালার কাঁচ ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। আলভী একদমই প্রস্তুত ছিলো না এমন কিছু শোনার জন্য। একঝটকায় সে গাড়ি ব্রেক করলো। গাড়িটা থেমে গেল রাস্তার পাশে। সে অলির দিকে তাকাল—চোখে না ছিলো বিস্ময়, না রাগ—একটা শূন্যতা, যেন কোনো অনুভূতির অস্তিত্বই নেই তার ভেতরে।
“আই ডোন্ট কেয়ার, বাচ্চাটার বাবা কে সেটা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।”
কথাগুলো যেন অলির মুখের রঙ পাল্টে দিলো। তার চোখেমুখে ভেসে উঠলো বিস্ময়।
“তার মানে আপনারও সন্দেহ হচ্ছে?”
আলভী এবার স্টেয়ারিং-এ হাত রেখে গম্ভীর গলায় বলল,
“একটা কারণ দেখাও যার জন্য আমার সন্দেহ করা উচিৎ নয়। একটা কারণ দেখাও যার ভিত্তিতে আমি সবাইকে জোর গলায় বলতে পারবো যে হ্যাঁ, ওটা আমারই সন্তান।”
অলি বহু চেষ্টা করেও এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। তার চোখের কোনা ভিজে উঠলো। দ্রুত হাতে চোখ মুছে সে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
আলভী নিস্তরঙ্গ কণ্ঠে বলে উঠল,
“আমি জানি তিশার মেহেন্দির রাতে আমাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিলো। কিন্তু বিশ্বাস করো আমার সেই রাতের কথা কিছুই মনে নেই।”
অলি কান্না আটকে আলভীকে বললো,
“তাহলে আপনি জানলেন কিভাবে যে আমাদের মধ্যে সেই রাতে কিছু হয়েছিলো?”
আলভী আড়চোখে অলির দিকে তাকিয়ে বলল,
“বিছানায় র*ক্ত লেগে ছিলো। তাছাড়া আমার শারীরিক কন্ডিশন দেখেই আমি উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম”
“বাহঃ তার মানে আপনার হয়তো এটাও মনে নেই যে সেইরাতে কে আপনার সাথে ছিলো?”
আলভী একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও না বোধক মাথা নাড়ায়। অলির এবার ভীষণ খারাপ লাগছে,
“আপনি তাহলে কিভাবে বুঝলেন যে আমিই আপনার সাথে ছিলাম?”
“তুমি আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছিলে। তাছাড়া আমি তোমার নূপুর পেয়েছিলাম। প্রথমে আমি সেসব থেকেই ধরে নিয়েছিলাম। তারপর রিফাতের ম্যাসেজ আর তোমার আচরণ দেখেই আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম যে তুমিই আমার সাথে ছিলে”
অলি আলভীর দিকে এগিয়ে এসে বললো,
“তাহলে আপনি নিশ্চিত হবার পরেও কেনো সন্দেহ করছেন যে এটা আপনার বাচ্চা নয়?”
আলভী কিছুক্ষণ অলির দিকে তাকিয়ে থেকে একপ্রকার হতাশ গলায় বলল,
“কাম অন অলি, বাচ্চা হওয়ার প্রক্রিয়া এতো সহজ নয়। আর তাছাড়া আমি বললাম তো, রাতের ঘটনা আমার কিছুই মনে নেই। আচ্ছা, তোমার তো সব মনে আছে তাইনা? তুমি কি আমাকে বলতে পারবে? তাহলে আমি বুঝতে পারবো।”
এই কথাগুলো শুনে অলি যেন থমকে গেলো। চোখজোড়াও বিস্ময়ে বড় হয়ে এলো। কিছু সেকেন্ডের নীরবতার পর মৃদু স্বরে বলল,
“আমার বেশি কিছু মনে নেই। শুধু মনে আছে আমি চিৎকার করতে করতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।”
আলভীর কপালে চিন্তার রেখা প্রগাঢ় হয়ে উঠেছে। সে সংযতভাবে জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা বুঝতে পারলাম, কিন্তু জ্ঞান হারানোর পূর্বের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? তুমি আমাকে সেটুকুই বলো।”
অলি একটা শুষ্ক ঢোক গিলে, নিজের সিটে ফিরে এল। তার দৃষ্টি জানালার বাইরে কিন্তু মন যেন বহু দূরে। একটু কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“আ…আমার কিছুই মনে নেই।”
আলভী কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“আমার মনে না থাকলেও আমি বলতে পারি যে আমি হয়তো তোমাকে অনেক গুলো লিপকিস করেছিলাম”
এই কথায় অলির গাল গরম হয়ে উঠলো। সে ভীষণ লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো। কিন্তু আলভী থামলো না, একটু হেসে বলল,
“নিশ্চয়ই ভাবছো আমি কিভাবে জানলাম? আরে এতটুকু বোঝার মতো কমন সেন্স সবারই থাকে। তোমার ঠোঁট দেখেই তো আমি বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমার ঠোঁটের কি হয়েছিলো সেটা আমি এখনো বুঝতে পারছিনা। সাম হাউ তুমি আমার ঠোঁটে বাইট করোনি তো?”
অলি নিজের ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ বসে থেকে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে ওঠে,
“হ্যাঁ করেছিলাম। আমার ইচ্ছা করছিলো আপনাকে মে*রে ফেলতে কিন্তু আপনি সত্যিই অনেক শক্তিশালী। আপনার ভেতরে সেদিন একটা পশু ভর করেছিলো। আপ…আপনি আমাকে খুব বাজে ভাবে স্পর্শ করেছিলেন। সেদিনের ঘটনা মনে পড়লে আমার আজও ইচ্ছা করে আপনাকে মে*রে ফেলতে। দয়া করে আর কক্ষনো সেইসব কথা জিজ্ঞেস করবেন না। আমি সেইরাত টাকে ঘৃণা করি।”
অলি একনাগাড়ে কথাগুলো বলে চুপ হয়ে গেল। কিন্তু অলির কথাগুলো শুনে আলভীর হৃৎস্পন্দন কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেলো। সে অনুভব করলো তার গলা শুকিয়ে আসছে। চোখ নামিয়ে নিলো সে—কারণ সত্যি বলতে তো সেও সেই রাতটাকে ঘৃণা করেন।
চুপচাপ ইঞ্জিন চালু করলো আলভী। গাড়িটা আবার চলতে শুরু করলো। নিস্তব্ধতার মাঝেই দীর্ঘ সময় কেটে গেল। তারপর আচমকাই আলভী বলে উঠলো,
“আমার সাথে বিয়ে হবার আগে তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড ছিলো?”
অলি জানালার দিকেই তাকিয়ে রইলো। উত্তর দিলো না। আলভীর প্রশ্ন তাকে কষ্ট দিচ্ছে, বিরক্তও করছে।
আলভী এবার মৃদু স্বরে বলল,
“চুপ করে থাকলে আমি হ্যাঁ ধরে নেবো।”
অলি বিস্ময়ে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“নাহ ছিলোনা, আমার বয়সই বা কত? আমি এতটুকু বয়সে বয়ফ্রেন্ড কোথায় পাবো?”
“খুব ভালো। তো নো-ম্যানকে লাইক করো নাকি?”
“নাহ আমি তাকে লাইক করিনা। সে তো রিফাতের লোক, আমি কেনো তাকে লাইক করবো?”
“তাহলে তখন ভালো বলছিলে কেনো?”
“সে ছিলো বলেই আমি এখনো বেচে আছি। সে অবশ্যই ভালো লোক। তাই বলেই কি আমি তাকে পছন্দ করবো?”
আলভীর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। মনের ভেতর জমে থাকা সব দ্বন্দ্ব যেন আরও জট পাকাতে শুরু করলো। অথচ সেই সময়েই অলি শান্ত গলায় বলে উঠলো,
“আপনার যখন সন্দেহ হচ্ছে যে আপনি এই বাচ্চার বাবা নন, তাহলে আপনি কেনো আমাকে বিয়ে করেছিলেন? আর অতো গুলো টাকাই বা কেনো দিয়েছিলেন?”
“বিয়ের আগে আমার এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহই ছিলোনা। আর সত্যি বলতে এই সন্দেহ তোমার বিহেভিয়ারের কারণেই জন্মেছে।”
শব্দগুলো যেন অলির বুকে ঢিলের মতো আছড়ে পড়লো। সে জানে না ঠিক কেন, কিন্তু এবার তার ভেতরের রাগ, ক্ষোভ সব একসাথে জ্বলে উঠলো।
“আপনি ও যদি আমার চরিত্র নিয়ে আজেবাজে ধারণা করেন তাহলে আমি অবশ্যই আপনাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবো। আপনার ফ্যামিলি ইতোমধ্যেই আমাকে অনেক কিছু বলে ফেলেছে। আমি সব সহ্য করে নিয়েছি। কিন্তু আপনি আমাকে নিয়ে তিল পরিমাণ খারাপ মন্তব্য করলে আমি আর ফিরে যাবোনা আপনার কাছে”
মুহূর্তেই ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই একহাতে অলিকে একটানে নিজের দিকে টেনে নিলো আলভী। তার চোখ দুটো জ্বলছে—আলভী আরেক হাতে অলির ঘাড় চেপে ধরে বলল,
“আমি তোমাকে আর কোথাও যেতে দিচ্ছিনা। তখন ড্রাইভারের সাথে আসতে কেনো বলেছিলাম জানো? জানোনা, তোমার প্রতি আমার অনেক অভিমান আছে অভিযোগ আছে। আমি বারবার আশা করি যে তুমি আমার অভিমান বুঝবে। নিজে থেকেই আমার কাছে আসবে। কিন্তু তুমি সেটা কখনোই করোনা। তুমি কখনোই আমাকে বোঝোনা। আমি তোমার উপর ভীষণ রেগে আছি। আর সেই রাগের কথাও আমাকেই মুখ ফুটে বলতে হচ্ছে। তুমি কি বুঝতে পারছো আমি কতোটা অসহায়? পারছোনা, এমনকি তুমি আমাকে বুঝতেও চাইছোনা।”
আলভীর কণ্ঠে এতটা তীব্র অনুভূতির ঘনঘটা শুনে অলি কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলো। কিছুক্ষণ যেতেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“আমি আর কিছু না বুঝলেও এটা বুঝে গেছি যে আপনি আমার বাবুকে নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন। আর এটাই আপনাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। আপনার কাছেও যদি আমাকে প্রমাণ দিতে হয়। তাহলে সেটা আমার জন্য অপমানজনক আমার কাছে মৃত্যুসম”
অলির কথা শুনে আলভী অবাক হয়ে যায়। অলি প্রায়ই একদম প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের মতোই কথা বলে কিন্তু আজকে এটা অলি কিভাবে বলল? অলি আলভীর শার্টের কলার চেপে ধরে বলল,
“একটা কথা মনে রাখবেন যেদিন আমাকে এই বিষয়ে প্রমাণ দিতে হবে সেদিনই আমাদের শেষ দেখা হবে।”
আলভী একবার নিজের কলারের দিকে তাকিয়ে আবারও অলির দিকে তাকালো। তারপর নির্লিপ্ত সুরে বলল,
“আমাদের শেষ দেখা একমাত্র সেদিন হবে যেদিন আমাদের মধ্যের একজনের মৃ*ত্যু হবে। তার আগ পর্যন্ত আমাদের দেখা হতেই থাকবে মিসেস অলি তাসনীম মির্জা।”
এই মুহূর্তে অলির রাগ যেন বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। উত্তেজিত স্বরে সে বলে উঠলো,
“আপনি কেনো বিশ্বাস করছেন না যে বাচ্চাটা আপনার?”
আলভী হাস্কিস্বরে বলতে লাগল,
“আই ডোন্ট কেয়ার। সত্যি বলতে বাচ্চাটাকে নিয়ে আমার বিন্দুমাত্রও আগ্রহ নেই। আমি শুধু চাই তোমাকে নিয়ে যাতে কেউ খারাপ মন্তব্য করতে না পারে। আমি শুধু চাই তুমি সবসময় সুস্থ থাকো, ভালো থাকো। আর আমি সেদিন মিথ্যা বলেছিলাম। এই বাচ্চাটার জন্য আমি তোমাকে ১০ কোটি টাকা দেইনি নাতো তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে তোমার সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলাম বলে দিয়েছি। আমি তোমাকে টাকাগুলো এই জন্যই দিয়েছিলাম যাতে তোমাকে কোনোপ্রকার পরিস্থিতিতেই অন্য কারো মুখাপেক্ষী হতে না হয়। আমি সবসময় তোমার ভালো চাই তোমাকে খুশি দেখতে চাই কারণ…
আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি”
আলভীর কথাগুলো অলি যেন শুনছিলো না, বরং অনুভব করছিলো—একদম ত্বকের নিচ দিয়ে। শার্টের কলার থেকে হাতটা আপনা-আপনিই ছুটে গেলো, চোখে একটা অদ্ভুত বিস্ময়ের ছায়া। সে ধীরে, চুপচাপ নিজের সিটে ফিরে এল। উইন্ডোর দিকে মুখ ঘুরিয়ে, মাথা ঠেকিয়ে নিঃশব্দে কেদে উঠলো। কাঁপা কাঁপা কাঁধগুলো তার কান্নার গভীরতা বোঝাতে লাগলো, যেন সেই কান্নার শব্দ কেবল নিজের ভেতরেই সীমাবদ্ধ। আলভী সেদিকে তাকিয়ে নিজের চুল টেনে ধরলো—তীব্র অনুশোচনায়। সে জানে, বাচ্চাটাকে নিয়ে এমন কথা বলা ঠিক হয়নি। কিন্তু এটাই সত্যি—সে কিছুই অনুভব করে না সেই অনাগত বাচ্চাটার জন্য। আলভী চুপ করে রইলো। বুকের ভেতর এক অজানা ভার। কিছুক্ষণ পর আলভী অলির দিকে এগিয়ে যেতেই অলি তার দিকে মুখ না ঘুরিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
“তারাতাড়ি চলুন, আমি মায়ের কাছে যেতে চাই।”
—
প্রায় ১ঘন্টা পর অলি আর আলভী অলিদের বাড়ির সামনে এসে থামলো। বিকেলের আলো তখনও পুরোপুরি ম্লান হয়নি, গেটের পাশের বোগেনভেলিয়া গাছের ঝোপে লালচে ফুলের সমাহার। গাড়ি থামতেই অলি একদম ব্যাকুল ভঙ্গিতে দরজা খুলে নেমে পড়লো এবং এক দৌড়ে বাড়ির দিকে ছুটে গেল।
আলভী ড্রাইভিং সিটে বসে থেকেই চিন্তিত চোখে অলির দিকেই তাকিয়ে রইল। এই অবস্থায় পড়ে টরে গেলে অলির মারাত্মক ধরনের ক্ষতি হতে পারে। এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে, আলভীও অলির পিছু পিছু দৌড়ে এলো। তারা মেইন ফটক পেরিয়ে বাড়ির মূল দরজার সামনে এসে পৌঁছাতেই অলি হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। দরজায় চোখ পড়তেই তার শরীর কেঁপে উঠলো—তালাবদ্ধ! ভারী তালার একঘেয়ে ঝোলানো দৃশ্য দেখে যেন বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। আলভী অলির পাশে এসে দাড়িয়ে বলল,
“বাড়িতে তো কেউই নেই?”
অলি নিম্নস্বরে বললো,
“হয়তো মা সুস্থ হয়ে গেছে। সে হয়তো শপে গেছে আর বাবাও হয়তো অফিসে আছে সেই জন্যই দরজায় তালা লাগানো”
আলভী ভ্রু কুচকে বলল,
“আচ্ছা তুমি বলেছো তোমাকে নাকি কিডন্যাপ করা হয়েছিল। তাহলে তোমার বাবাও কি একবারও আমাকে এই বিষয়ে জানাতে পারতেন না? মানলাম আমার ফোন বন্ধ কিন্তু সেতো যেতে পারতেন আমাদের বাড়িতে। নয়তো তোমার খালার কাছে অন্তত বিষয়টা জানাতে পারতেন।”
অলি হাসার চেষ্টা করে বলল,
“মাকে নিয়ে হয়তো একটু বেশিই চিন্তায় ছিলেন সেই জন্যই,,,”
“সেই জন্য কি নিজের মেয়েকে ভুলে যাবেন? দ্যাটস নট ফেয়ার।”
অলি ক্ষিপ্ত চোখে তাকাতেই আলভী চুপসে গেল। বাতাসে কিছুক্ষণ স্তব্ধতা নেমে এলো। অলি গলার স্বর নিচু করে বলল,
“আমার বাবা আপনার মতো নয়।”
আলভী একদম থেমে গেল। একটু যেন হকচকিয়েও গেল,
“আমার মতো নয় মানে কি?”
অলি এবার শান্ত গলায়, অথচ শব্দে ব্যথা মিশিয়ে বলল,
“মানে আমার বাবা আমাকে অনেক ভালোবাসেন। আপনার মতো নয়, যার মাঝে নিজের সন্তানকে নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। বাচ্চা ম*রে গেলেও যার কিছুই যাবে আসবে না। আমার বাবুটার ভাগ্য অনেক খারাপ যে আপনার মতো একজন বাবা পেয়েছে।”
কথাগুলো যেন আলভীর শরীর ভেদ করে ভিতরে ঢুকে গেলো। কষ্ট, অপরাধবোধ, আর তীব্র ব্যর্থতার মিশেলে তার মুখ থমথমে হয়ে গেলো। সে বুঝতে পারলো যে অলি তার কথাটা একটু বেশিই সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছে। আলভী কথা ঘোরানোর জন্য বলল,
“এখন কি করবে? শপে যাবে?”
অলি বলল,
“না একটু পরেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে। মা বাবা ফিরেও আসবে আমরা বরং ঘরে ঢুকেই অপেক্ষা করি। আমি ২দিন ধরে গোসল করিনি। গোসল করতে হবে।”
আলভী চোখ তুলে প্রশ্ন করে,
“কিন্তু ঢুকবে কিভাবে? দরজা তো লক করা”
অলি একবার আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“চলুন আমার সাথে”
বলেই অলি বাড়ির পেছনের সাইডে চলে এলো। আলভীও তার পেছনেই আছে। ইতোমধ্যেই গোলাপ ফুলের ঘ্রাণে তার চোখমুখ জ্বলছে।
“উফ এখানে আসলে কেনো? তারাতাড়ি চলো”
অলি কোনো উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গিয়ে একটা ফুলের টব নীচু হয়ে সরিয়ে টবের নিচ থেকে একটা চাবি বের করে আনে। আলভী অবাক হয়ে যায়,
“এখানে চাবি কে রেখেছে?”
অলি চাবিটা নিয়ে দরজার সামনে আসতে আসতে বলল,
“আমাদের ৩ জনের কাছে ৩ টা চাবি থাকে। আর আমার চাবি আমি সবসময় এখানেই রেখে দেই। কারণ নিজের সাথে রাখলে হারিয়ে যায়।”
আলভী এবার বুঝে গেলো ব্যাপারটা।
দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে চারপাশে তাকিয়ে একটু থমকে গেলো অলি। ঘরে ঢোকার পর যেন সময় থেমে গেছে—ঘরের বাতাসে জমে আছে নিস্তব্ধতা। সবকিছু ঠিক আগের জায়গাতেই রয়েছে, যেন এই দুই দিনে কেউ একবারও প্রবেশ করেনি এই বাড়িতে। অলির বুকের ভেতরটা কেমন যেন শূন্য হয়ে গেলো। এক অজানা শঙ্কায় সে কেপে উঠলো।
“কি হয়েছে? দাড়িয়ে পড়লে কেনো?”
অলি না বোধক মাথা নেড়ে নিজের রুমে ঢুকলো। লাইট এখনো জ্বলছে। অলির মনে আছে মায়ের এক্সিডেন্টের কথা শুনে সে লাইট না নিভিয়েই বাবার সাথে বেরিয়ে গিয়েছিলো। অলি সমস্ত ভাবনা সাইডে রেখে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। এখন শাওয়ার নেওয়া জরুরী। অলি যেতেই আলভী অলির রুমে প্রবেশ করে। খাটের উপর তাকাতেই দেখলো অলির ফোনটা খাটের উপরেই পড়ে আছে। সে আনমনেই ফোনটা হাতে তুলে নিলো। অলির ফোনে লক নেই। আলভী খুব সহজেই অলির কন্টাক্ট লিস্ট চেক করলো। সে দেখলো অলি অনেকদিন আগে থেকেই তার ফোনে কল করে যাচ্ছে। নোমানের নম্বর সেভ করা ছিলোনা বিধায় আলভী নোমানের নম্বর চিনতে পারলোনা। কিন্তু নিজের ফোনটা ভেঙ্গে ফেলায় আজ তার আফসোস হচ্ছে। অলি কতোগুলো কল করেছিলো কিন্তু সে ভেবেছে অলি তাকে মনেই করেনি। কিছুক্ষণ যেতেই অলি শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসে। আলভী তড়িঘড়ি করে অলির ফোনটা রেখে দেয়। অলি চুল মুছতে মুছতে বলে,
“আপনি ফোনটা নিজের কাছেই রাখুন। আমি ফোন সামলাতে পারিনা। হারিয়ে টারিয়ে ফেলবো।”
আলভী ফোনটা হাতে নিয়ে অলির সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর ফোনটা অলির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“আব্বু আম্মুকে একবার কল করে দেখো।”
অলি মাথা নেড়ে ফোনটা হাতে নিলো। তারপর বেশ কয়েকবার আসমা বানু আর লিয়াকত হোসাইনের ফোনে কল দিলো কিন্তু তাদের দুজনেরই ফোন বন্ধ বলছে।
“মায়ের ফোন তো ছিনতাইকারীই নিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু বাবার ফোনের কি হয়েছে?”
অলি চিন্তিত হয়ে পরলো। আলভী সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
“হয়তো নেটওয়ার্কে সমস্যা,”
অলি মাথা নেড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়াতেই আলভী জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার ক্ষুধা লাগেনি?”
অলি হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে বলল,
“লেগেছে, দেখি ঘরে খাওয়ার মতো কিছু আছে কিনা।”
অলি রুম থেকে বেরিয়ে কিচেনে আসতেই চিৎকার দিয়ে উঠলো।
চলবে,,,
#১৫_বছর_বয়সী_মা (৩২)
#সোফিয়া_সাফা
বিকেলের নরম আলোয় সূর্যের তেজ যেন একটু একটু করে মিইয়ে এসেছে। আকাশের এক কোণে ছড়িয়ে থাকা মেঘেদের গায়ে লেগে আছে হালকা সোনালি আভা। প্রশস্ত রাস্তায় সুনসান নীরবতা, এই নির্জন বিকেলবেলায়, ছায়া-ছায়া আলো গায়ে মেখে, একটি গাড়ি ছুটে চলেছে শহরের ফাঁকা রাস্তায়। স্টিয়ারিংয়ে আলভীর শক্ত কিন্তু শান্ত হাত। তার দৃষ্টি সামনে, পাশের সিটে অলির নিরুত্তাপ উপস্থিতি। অলি নিঃশব্দে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে, উইন্ডোর কাচের উপর তার কপাল ঠেকানো। আলভী চট করে অলির দিকে তাকিয়ে বলল,
“লাঞ্চ করতে বললাম সেটাও করলে না। মায়ের কাছে যাবার জেদ ধরেছো। বললাম ড্রাইভারের সাথে চলে যাও সেটাও শুনলেনা। কি সমস্যা তোমার?”
অলি কোনো উত্তর দিলো না। পূর্বের ন্যায়েই গাড়ির উইন্ডোতে মাথা ঠেকিয়ে বসে রইলো। তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। আলভী সামনের দিকে দৃষ্টি রেখেই এবার নিচু স্বরে বলল,
“আজকে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিলো। কতোগুলো প্যাশেন্টকে এসে ফিরে যেতে হবে, সেই ধারণা আছে?”
অলি হালকা গলায় বলল,
“আমি জেদ ধরেছিলাম তবে জোর তো করিনি। আপনি আসলেন কেনো?”
এক মুহূর্তের নীরবতা। এরপর আলভী ধীর গলায় উত্তর দিলো,
“আম্মু অসুস্থ, জামাই হিসেবে আমার যাওয়াটা উচিৎ বলে মনে হয়েছে সেই জন্যই এসেছি।”
অলি এবারও আলভীর দিকে না তাকিয়েই বলল,
“রোগী দেখার পরেও যাওয়া যেতো”
আলভী এবার অলির দিকে তাকালো, কিন্তু অলি এখনো জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। যেন এক অদ্ভুত শীতলতা ছড়িয়ে আছে অলির অভিব্যক্তিতে। আলভী হতাশার শ্বাস ফেলে বলল,
“আমার জায়গায় আরেকজন ডক্টর রোগী দেখবে বলে কথা দিয়েছে।”
“বেশ তো, তাহলে রোগীদের ফিরে যেতে হবে কেনো?”
আলভী এবার আরেকটা গভীর শ্বাস ফেলে চোখ ফেরালো রাস্তায়, তারপর উদাহরণ টেনে বললো,
“ধরো তুমি ডেইজি ফুল কিনতে গিয়েছো কিন্তু গিয়ে দেখলে সেখানে গোলাপ ফুল বিক্রি করা হচ্ছে। তখন তুমি কি করবে?”
অলি এবার প্রথমবারের মতো মাথা তুলে আলভীর দিকে তাকালো। চোখেমুখে কোনোরকম রাগ নেই, স্বাভাবিক স্বরেই বললো,
“অবশ্যই আমি গোলাপ ফুলই কিনে নেবো।”
আলভী ভ্রু কুঁচকে অলির দিকে তাকাতেই, অলি একটু হেসে আবারও বললো,
“আমি ডেইজি ফুলের চাইতে গোলাপ ফুল বেশি পছন্দ করি। সেই হিসেবে আমি গোলাপ ফুল পেয়ে আরও বেশিই খুশি হয়ে যাবো।”
আলভী নিজমনেই বলে উঠলো,
“এতো ফুলের মধ্যে গোলাপ ফুলই পছন্দ করতে হলো? যেটাতে আমার এলার্জি? হাহ আমাদের পছন্দ অপছন্দ সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী তাইনা?”
—
গাড়ির ইঞ্জিনের মৃদু গুঞ্জন ছাড়া চারপাশে নিখাদ নীরবতা। যেন শব্দগুলোও একে অপরকে এড়িয়ে যাচ্ছে।
অলি আরো কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে প্রশ্ন ছুড়লো,
“আচ্ছা, আপনারও কি মনে হয় যে বাবুটার বাবা আপনি নন?”
প্রশ্নটা এমনভাবে তেড়ে এলো, যেন কোনো অতর্কিত ঝড় জানালার কাঁচ ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। আলভী একদমই প্রস্তুত ছিলো না এমন কিছু শোনার জন্য। একঝটকায় সে গাড়ি ব্রেক করলো। গাড়িটা থেমে গেল রাস্তার পাশে। সে অলির দিকে তাকাল—চোখে না ছিলো বিস্ময়, না রাগ—একটা শূন্যতা, যেন কোনো অনুভূতির অস্তিত্বই নেই তার ভেতরে।
“আই ডোন্ট কেয়ার, বাচ্চাটার বাবা কে সেটা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।”
কথাগুলো যেন অলির মুখের রঙ পাল্টে দিলো। তার চোখেমুখে ভেসে উঠলো বিস্ময়।
“তার মানে আপনারও সন্দেহ হচ্ছে?”
আলভী এবার স্টেয়ারিং-এ হাত রেখে গম্ভীর গলায় বলল,
“একটা কারণ দেখাও যার জন্য আমার সন্দেহ করা উচিৎ নয়। একটা কারণ দেখাও যার ভিত্তিতে আমি সবাইকে জোর গলায় বলতে পারবো যে হ্যাঁ, ওটা আমারই সন্তান।”
অলি বহু চেষ্টা করেও এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। তার চোখের কোনা ভিজে উঠলো। দ্রুত হাতে চোখ মুছে সে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
আলভী নিস্তরঙ্গ কণ্ঠে বলে উঠল,
“আমি জানি তিশার মেহেন্দির রাতে আমাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিলো। কিন্তু বিশ্বাস করো আমার সেই রাতের কথা কিছুই মনে নেই।”
অলি কান্না আটকে আলভীকে বললো,
“তাহলে আপনি জানলেন কিভাবে যে আমাদের মধ্যে সেই রাতে কিছু হয়েছিলো?”
আলভী আড়চোখে অলির দিকে তাকিয়ে বলল,
“বিছানায় র*ক্ত লেগে ছিলো। তাছাড়া আমার শারীরিক কন্ডিশন দেখেই আমি উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম”
“বাহঃ তার মানে আপনার হয়তো এটাও মনে নেই যে সেইরাতে কে আপনার সাথে ছিলো?”
আলভী একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও না বোধক মাথা নাড়ায়। অলির এবার ভীষণ খারাপ লাগছে,
“আপনি তাহলে কিভাবে বুঝলেন যে আমিই আপনার সাথে ছিলাম?”
“তুমি আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছিলে। তাছাড়া আমি তোমার নূপুর পেয়েছিলাম। প্রথমে আমি সেসব থেকেই ধরে নিয়েছিলাম। তারপর রিফাতের ম্যাসেজ আর তোমার আচরণ দেখেই আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম যে তুমিই আমার সাথে ছিলে”
অলি আলভীর দিকে এগিয়ে এসে বললো,
“তাহলে আপনি নিশ্চিত হবার পরেও কেনো সন্দেহ করছেন যে এটা আপনার বাচ্চা নয়?”
আলভী কিছুক্ষণ অলির দিকে তাকিয়ে থেকে একপ্রকার হতাশ গলায় বলল,
“কাম অন অলি, বাচ্চা হওয়ার প্রক্রিয়া এতো সহজ নয়। আর তাছাড়া আমি বললাম তো, রাতের ঘটনা আমার কিছুই মনে নেই। আচ্ছা, তোমার তো সব মনে আছে তাইনা? তুমি কি আমাকে বলতে পারবে? তাহলে আমি বুঝতে পারবো।”
এই কথাগুলো শুনে অলি যেন থমকে গেলো। চোখজোড়াও বিস্ময়ে বড় হয়ে এলো। কিছু সেকেন্ডের নীরবতার পর মৃদু স্বরে বলল,
“আমার বেশি কিছু মনে নেই। শুধু মনে আছে আমি চিৎকার করতে করতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।”
আলভীর কপালে চিন্তার রেখা প্রগাঢ় হয়ে উঠেছে। সে সংযতভাবে জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা বুঝতে পারলাম, কিন্তু জ্ঞান হারানোর পূর্বের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? তুমি আমাকে সেটুকুই বলো।”
অলি একটা শুষ্ক ঢোক গিলে, নিজের সিটে ফিরে এল। তার দৃষ্টি জানালার বাইরে কিন্তু মন যেন বহু দূরে। একটু কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“আ…আমার কিছুই মনে নেই।”
আলভী কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“আমার মনে না থাকলেও আমি বলতে পারি যে আমি হয়তো তোমাকে অনেক গুলো লিপকিস করেছিলাম”
এই কথায় অলির গাল গরম হয়ে উঠলো। সে ভীষণ লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো। কিন্তু আলভী থামলো না, একটু হেসে বলল,
“নিশ্চয়ই ভাবছো আমি কিভাবে জানলাম? আরে এতটুকু বোঝার মতো কমন সেন্স সবারই থাকে। তোমার ঠোঁট দেখেই তো আমি বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমার ঠোঁটের কি হয়েছিলো সেটা আমি এখনো বুঝতে পারছিনা। সাম হাউ তুমি আমার ঠোঁটে বাইট করোনি তো?”
অলি নিজের ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ বসে থেকে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে ওঠে,
“হ্যাঁ করেছিলাম। আমার ইচ্ছা করছিলো আপনাকে মে*রে ফেলতে কিন্তু আপনি সত্যিই অনেক শক্তিশালী। আপনার ভেতরে সেদিন একটা পশু ভর করেছিলো। আপ…আপনি আমাকে খুব বাজে ভাবে স্পর্শ করেছিলেন। সেদিনের ঘটনা মনে পড়লে আমার আজও ইচ্ছা করে আপনাকে মে*রে ফেলতে। দয়া করে আর কক্ষনো সেইসব কথা জিজ্ঞেস করবেন না। আমি সেইরাত টাকে ঘৃণা করি।”
অলি একনাগাড়ে কথাগুলো বলে চুপ হয়ে গেল। কিন্তু অলির কথাগুলো শুনে আলভীর হৃৎস্পন্দন কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেলো। সে অনুভব করলো তার গলা শুকিয়ে আসছে। চোখ নামিয়ে নিলো সে—কারণ সত্যি বলতে তো সেও সেই রাতটাকে ঘৃণা করেন।
চুপচাপ ইঞ্জিন চালু করলো আলভী। গাড়িটা আবার চলতে শুরু করলো। নিস্তব্ধতার মাঝেই দীর্ঘ সময় কেটে গেল। তারপর আচমকাই আলভী বলে উঠলো,
“আমার সাথে বিয়ে হবার আগে তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড ছিলো?”
অলি জানালার দিকেই তাকিয়ে রইলো। উত্তর দিলো না। আলভীর প্রশ্ন তাকে কষ্ট দিচ্ছে, বিরক্তও করছে।
আলভী এবার মৃদু স্বরে বলল,
“চুপ করে থাকলে আমি হ্যাঁ ধরে নেবো।”
অলি বিস্ময়ে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“নাহ ছিলোনা, আমার বয়সই বা কত? আমি এতটুকু বয়সে বয়ফ্রেন্ড কোথায় পাবো?”
“খুব ভালো। তো নো-ম্যানকে লাইক করো নাকি?”
“নাহ আমি তাকে লাইক করিনা। সে তো রিফাতের লোক, আমি কেনো তাকে লাইক করবো?”
“তাহলে তখন ভালো বলছিলে কেনো?”
“সে ছিলো বলেই আমি এখনো বেচে আছি। সে অবশ্যই ভালো লোক। তাই বলেই কি আমি তাকে পছন্দ করবো?”
আলভীর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। মনের ভেতর জমে থাকা সব দ্বন্দ্ব যেন আরও জট পাকাতে শুরু করলো। অথচ সেই সময়েই অলি শান্ত গলায় বলে উঠলো,
“আপনার যখন সন্দেহ হচ্ছে যে আপনি এই বাচ্চার বাবা নন, তাহলে আপনি কেনো আমাকে বিয়ে করেছিলেন? আর অতো গুলো টাকাই বা কেনো দিয়েছিলেন?”
“বিয়ের আগে আমার এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহই ছিলোনা। আর সত্যি বলতে এই সন্দেহ তোমার বিহেভিয়ারের কারণেই জন্মেছে।”
শব্দগুলো যেন অলির বুকে ঢিলের মতো আছড়ে পড়লো। সে জানে না ঠিক কেন, কিন্তু এবার তার ভেতরের রাগ, ক্ষোভ সব একসাথে জ্বলে উঠলো।
“আপনি ও যদি আমার চরিত্র নিয়ে আজেবাজে ধারণা করেন তাহলে আমি অবশ্যই আপনাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবো। আপনার ফ্যামিলি ইতোমধ্যেই আমাকে অনেক কিছু বলে ফেলেছে। আমি সব সহ্য করে নিয়েছি। কিন্তু আপনি আমাকে নিয়ে তিল পরিমাণ খারাপ মন্তব্য করলে আমি আর ফিরে যাবোনা আপনার কাছে”
মুহূর্তেই ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই একহাতে অলিকে একটানে নিজের দিকে টেনে নিলো আলভী। তার চোখ দুটো জ্বলছে—আলভী আরেক হাতে অলির ঘাড় চেপে ধরে বলল,
“আমি তোমাকে আর কোথাও যেতে দিচ্ছিনা। তখন ড্রাইভারের সাথে আসতে কেনো বলেছিলাম জানো? জানোনা, তোমার প্রতি আমার অনেক অভিমান আছে অভিযোগ আছে। আমি বারবার আশা করি যে তুমি আমার অভিমান বুঝবে। নিজে থেকেই আমার কাছে আসবে। কিন্তু তুমি সেটা কখনোই করোনা। তুমি কখনোই আমাকে বোঝোনা। আমি তোমার উপর ভীষণ রেগে আছি। আর সেই রাগের কথাও আমাকেই মুখ ফুটে বলতে হচ্ছে। তুমি কি বুঝতে পারছো আমি কতোটা অসহায়? পারছোনা, এমনকি তুমি আমাকে বুঝতেও চাইছোনা।”
আলভীর কণ্ঠে এতটা তীব্র অনুভূতির ঘনঘটা শুনে অলি কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলো। কিছুক্ষণ যেতেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“আমি আর কিছু না বুঝলেও এটা বুঝে গেছি যে আপনি আমার বাবুকে নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন। আর এটাই আপনাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। আপনার কাছেও যদি আমাকে প্রমাণ দিতে হয়। তাহলে সেটা আমার জন্য অপমানজনক আমার কাছে মৃত্যুসম”
অলির কথা শুনে আলভী অবাক হয়ে যায়। অলি প্রায়ই একদম প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের মতোই কথা বলে কিন্তু আজকে এটা অলি কিভাবে বলল? অলি আলভীর শার্টের কলার চেপে ধরে বলল,
“একটা কথা মনে রাখবেন যেদিন আমাকে এই বিষয়ে প্রমাণ দিতে হবে সেদিনই আমাদের শেষ দেখা হবে।”
আলভী একবার নিজের কলারের দিকে তাকিয়ে আবারও অলির দিকে তাকালো। তারপর নির্লিপ্ত সুরে বলল,
“আমাদের শেষ দেখা একমাত্র সেদিন হবে যেদিন আমাদের মধ্যের একজনের মৃ*ত্যু হবে। তার আগ পর্যন্ত আমাদের দেখা হতেই থাকবে মিসেস অলি তাসনীম মির্জা।”
এই মুহূর্তে অলির রাগ যেন বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। উত্তেজিত স্বরে সে বলে উঠলো,
“আপনি কেনো বিশ্বাস করছেন না যে বাচ্চাটা আপনার?”
আলভী হাস্কিস্বরে বলতে লাগল,
“আই ডোন্ট কেয়ার। সত্যি বলতে বাচ্চাটাকে নিয়ে আমার বিন্দুমাত্রও আগ্রহ নেই। আমি শুধু চাই তোমাকে নিয়ে যাতে কেউ খারাপ মন্তব্য করতে না পারে। আমি শুধু চাই তুমি সবসময় সুস্থ থাকো, ভালো থাকো। আর আমি সেদিন মিথ্যা বলেছিলাম। এই বাচ্চাটার জন্য আমি তোমাকে ১০ কোটি টাকা দেইনি নাতো তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে তোমার সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলাম বলে দিয়েছি। আমি তোমাকে টাকাগুলো এই জন্যই দিয়েছিলাম যাতে তোমাকে কোনোপ্রকার পরিস্থিতিতেই অন্য কারো মুখাপেক্ষী হতে না হয়। আমি সবসময় তোমার ভালো চাই তোমাকে খুশি দেখতে চাই কারণ…
আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি”
আলভীর কথাগুলো অলি যেন শুনছিলো না, বরং অনুভব করছিলো—একদম ত্বকের নিচ দিয়ে। শার্টের কলার থেকে হাতটা আপনা-আপনিই ছুটে গেলো, চোখে একটা অদ্ভুত বিস্ময়ের ছায়া। সে ধীরে, চুপচাপ নিজের সিটে ফিরে এল। উইন্ডোর দিকে মুখ ঘুরিয়ে, মাথা ঠেকিয়ে নিঃশব্দে কেদে উঠলো। কাঁপা কাঁপা কাঁধগুলো তার কান্নার গভীরতা বোঝাতে লাগলো, যেন সেই কান্নার শব্দ কেবল নিজের ভেতরেই সীমাবদ্ধ। আলভী সেদিকে তাকিয়ে নিজের চুল টেনে ধরলো—তীব্র অনুশোচনায়। সে জানে, বাচ্চাটাকে নিয়ে এমন কথা বলা ঠিক হয়নি। কিন্তু এটাই সত্যি—সে কিছুই অনুভব করে না সেই অনাগত বাচ্চাটার জন্য। আলভী চুপ করে রইলো। বুকের ভেতর এক অজানা ভার। কিছুক্ষণ পর আলভী অলির দিকে এগিয়ে যেতেই অলি তার দিকে মুখ না ঘুরিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
“তারাতাড়ি চলুন, আমি মায়ের কাছে যেতে চাই।”
—
প্রায় ১ঘন্টা পর অলি আর আলভী অলিদের বাড়ির সামনে এসে থামলো। বিকেলের আলো তখনও পুরোপুরি ম্লান হয়নি, গেটের পাশের বোগেনভেলিয়া গাছের ঝোপে লালচে ফুলের সমাহার। গাড়ি থামতেই অলি একদম ব্যাকুল ভঙ্গিতে দরজা খুলে নেমে পড়লো এবং এক দৌড়ে বাড়ির দিকে ছুটে গেল।
আলভী ড্রাইভিং সিটে বসে থেকেই চিন্তিত চোখে অলির দিকেই তাকিয়ে রইল। এই অবস্থায় পড়ে টরে গেলে অলির মারাত্মক ধরনের ক্ষতি হতে পারে। এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে, আলভীও অলির পিছু পিছু দৌড়ে এলো। তারা মেইন ফটক পেরিয়ে বাড়ির মূল দরজার সামনে এসে পৌঁছাতেই অলি হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। দরজায় চোখ পড়তেই তার শরীর কেঁপে উঠলো—তালাবদ্ধ! ভারী তালার একঘেয়ে ঝোলানো দৃশ্য দেখে যেন বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। আলভী অলির পাশে এসে দাড়িয়ে বলল,
“বাড়িতে তো কেউই নেই?”
অলি নিম্নস্বরে বললো,
“হয়তো মা সুস্থ হয়ে গেছে। সে হয়তো শপে গেছে আর বাবাও হয়তো অফিসে আছে সেই জন্যই দরজায় তালা লাগানো”
আলভী ভ্রু কুচকে বলল,
“আচ্ছা তুমি বলেছো তোমাকে নাকি কিডন্যাপ করা হয়েছিল। তাহলে তোমার বাবাও কি একবারও আমাকে এই বিষয়ে জানাতে পারতেন না? মানলাম আমার ফোন বন্ধ কিন্তু সেতো যেতে পারতেন আমাদের বাড়িতে। নয়তো তোমার খালার কাছে অন্তত বিষয়টা জানাতে পারতেন।”
অলি হাসার চেষ্টা করে বলল,
“মাকে নিয়ে হয়তো একটু বেশিই চিন্তায় ছিলেন সেই জন্যই,,,”
“সেই জন্য কি নিজের মেয়েকে ভুলে যাবেন? দ্যাটস নট ফেয়ার।”
অলি ক্ষিপ্ত চোখে তাকাতেই আলভী চুপসে গেল। বাতাসে কিছুক্ষণ স্তব্ধতা নেমে এলো। অলি গলার স্বর নিচু করে বলল,
“আমার বাবা আপনার মতো নয়।”
আলভী একদম থেমে গেল। একটু যেন হকচকিয়েও গেল,
“আমার মতো নয় মানে কি?”
অলি এবার শান্ত গলায়, অথচ শব্দে ব্যথা মিশিয়ে বলল,
“মানে আমার বাবা আমাকে অনেক ভালোবাসেন। আপনার মতো নয়, যার মাঝে নিজের সন্তানকে নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। বাচ্চা ম*রে গেলেও যার কিছুই যাবে আসবে না। আমার বাবুটার ভাগ্য অনেক খারাপ যে আপনার মতো একজন বাবা পেয়েছে।”
কথাগুলো যেন আলভীর শরীর ভেদ করে ভিতরে ঢুকে গেলো। কষ্ট, অপরাধবোধ, আর তীব্র ব্যর্থতার মিশেলে তার মুখ থমথমে হয়ে গেলো। সে বুঝতে পারলো যে অলি তার কথাটা একটু বেশিই সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছে। আলভী কথা ঘোরানোর জন্য বলল,
“এখন কি করবে? শপে যাবে?”
অলি বলল,
“না একটু পরেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে। মা বাবা ফিরেও আসবে আমরা বরং ঘরে ঢুকেই অপেক্ষা করি। আমি ২দিন ধরে গোসল করিনি। গোসল করতে হবে।”
আলভী চোখ তুলে প্রশ্ন করে,
“কিন্তু ঢুকবে কিভাবে? দরজা তো লক করা”
অলি একবার আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“চলুন আমার সাথে”
বলেই অলি বাড়ির পেছনের সাইডে চলে এলো। আলভীও তার পেছনেই আছে। ইতোমধ্যেই গোলাপ ফুলের ঘ্রাণে তার চোখমুখ জ্বলছে।
“উফ এখানে আসলে কেনো? তারাতাড়ি চলো”
অলি কোনো উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গিয়ে একটা ফুলের টব নীচু হয়ে সরিয়ে টবের নিচ থেকে একটা চাবি বের করে আনে। আলভী অবাক হয়ে যায়,
“এখানে চাবি কে রেখেছে?”
অলি চাবিটা নিয়ে দরজার সামনে আসতে আসতে বলল,
“আমাদের ৩ জনের কাছে ৩ টা চাবি থাকে। আর আমার চাবি আমি সবসময় এখানেই রেখে দেই। কারণ নিজের সাথে রাখলে হারিয়ে যায়।”
আলভী এবার বুঝে গেলো ব্যাপারটা।
দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে চারপাশে তাকিয়ে একটু থমকে গেলো অলি। ঘরে ঢোকার পর যেন সময় থেমে গেছে—ঘরের বাতাসে জমে আছে নিস্তব্ধতা। সবকিছু ঠিক আগের জায়গাতেই রয়েছে, যেন এই দুই দিনে কেউ একবারও প্রবেশ করেনি এই বাড়িতে। অলির বুকের ভেতরটা কেমন যেন শূন্য হয়ে গেলো। এক অজানা শঙ্কায় সে কেপে উঠলো।
“কি হয়েছে? দাড়িয়ে পড়লে কেনো?”
অলি না বোধক মাথা নেড়ে নিজের রুমে ঢুকলো। লাইট এখনো জ্বলছে। অলির মনে আছে মায়ের এক্সিডেন্টের কথা শুনে সে লাইট না নিভিয়েই বাবার সাথে বেরিয়ে গিয়েছিলো। অলি সমস্ত ভাবনা সাইডে রেখে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। এখন শাওয়ার নেওয়া জরুরী। অলি যেতেই আলভী অলির রুমে প্রবেশ করে। খাটের উপর তাকাতেই দেখলো অলির ফোনটা খাটের উপরেই পড়ে আছে। সে আনমনেই ফোনটা হাতে তুলে নিলো। অলির ফোনে লক নেই। আলভী খুব সহজেই অলির কন্টাক্ট লিস্ট চেক করলো। সে দেখলো অলি অনেকদিন আগে থেকেই তার ফোনে কল করে যাচ্ছে। নোমানের নম্বর সেভ করা ছিলোনা বিধায় আলভী নোমানের নম্বর চিনতে পারলোনা। কিন্তু নিজের ফোনটা ভেঙ্গে ফেলায় আজ তার আফসোস হচ্ছে। অলি কতোগুলো কল করেছিলো কিন্তু সে ভেবেছে অলি তাকে মনেই করেনি। কিছুক্ষণ যেতেই অলি শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসে। আলভী তড়িঘড়ি করে অলির ফোনটা রেখে দেয়। অলি চুল মুছতে মুছতে বলে,
“আপনি ফোনটা নিজের কাছেই রাখুন। আমি ফোন সামলাতে পারিনা। হারিয়ে টারিয়ে ফেলবো।”
আলভী ফোনটা হাতে নিয়ে অলির সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর ফোনটা অলির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“আব্বু আম্মুকে একবার কল করে দেখো।”
অলি মাথা নেড়ে ফোনটা হাতে নিলো। তারপর বেশ কয়েকবার আসমা বানু আর লিয়াকত হোসাইনের ফোনে কল দিলো কিন্তু তাদের দুজনেরই ফোন বন্ধ বলছে।
“মায়ের ফোন তো ছিনতাইকারীই নিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু বাবার ফোনের কি হয়েছে?”
অলি চিন্তিত হয়ে পরলো। আলভী সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
“হয়তো নেটওয়ার্কে সমস্যা,”
অলি মাথা নেড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়াতেই আলভী জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার ক্ষুধা লাগেনি?”
অলি হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে বলল,
“লেগেছে, দেখি ঘরে খাওয়ার মতো কিছু আছে কিনা।”
অলি রুম থেকে বেরিয়ে কিচেনে আসতেই চিৎকার দিয়ে উঠলো।
চলবে,,,
#১৫_বছর_বয়সী_মা (৩৩)
#সোফিয়া_সাফা
অলির চিৎকারে আলভী একপ্রকার দৌড়ে কিচেনে চলে আসে।
“কি হয়েছে?”
আলভী অলিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগল,
“কি হয়েছে? ব্যাথা পেয়েছো? কোথায় লেগেছে?”
অলি হাত দিয়ে ইশারা করলো টেবিলের উপর। আলভী সেদিকে তাকিয়ে দেখলো টেবিলের উপর একটা বিড়ালের বাচ্চা পড়ে আছে। অলি কেদে উঠলো,
“বিড়ালটার কি হয়েছে?”
আলভী অলির চেহারা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,
“আমি দেখছি। তুমি কান্না করছো কেনো? বিড়ালটা হয়তো ঘুমিয়ে আছে।”
আলভী এগিয়ে গেলো টেবিলের দিকে। কিন্তু কাছে আসতেই দেখলো বিড়ালটা থেকে দুর্গন্ধ আসছে। তাছাড়া বিড়ালের চারপাশে গিজগিজ করছে পিপড়ের দল। আলভী বুঝতে পারলো বিড়ালটা মা*রা গেছে। আলভী দ্রুত পায়ে অলির কাছে ফিরে এলো। অলি বলে উঠলো,
“বিড়ালটার কি হয়েছে? মা বিড়ালটাকে অনেক ভালোবাসতো। যদিও আমি পছন্দ করতাম না। কিন্তু বিড়ালটা ওভাবে পড়ে আছে কেনো? বিড়ালটা কি অসুস্থ? আপনি তো ডাক্তার, আপনি বিড়ালটার চিকিৎসা করুন না।”
আলভী কিভাবে বলবে বুঝতে পারছেনা। সে অলির মুখটা দুহাতের আজলায় নিয়ে বললো,
“আমি আম্মুর জন্য আরেকটা বিড়াল এনে দেবো। তুমি কান্না করোনা।”
অলি আরও জোরে কেদে উঠলো,
“বিড়ালটার কি হয়েছে?”
আলভী কোমল কন্ঠে বলল,
“আল্লাহর কাছে চলে গেছে”
অলি শব্দ করে কেদে উঠতেই আলভী অলিকে জড়িয়ে ধরলো।
“আরে কাদছো কেনো? আল্লাহর জিনিস আল্লাহ নিয়ে গেছেন। তাছাড়া তুমি তো বিড়ালটাকে পছন্দ করতেনা তাইনা?”
অলি ফোপাঁতে ফোপাঁতে বলে,
“মা জানতে পারলে অনেক কষ্ট পাবেন আর সেইজন্যই আমারও কষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া বিড়ালটাকে আমি একটু একটু পছন্দ করতে শুরু করেছিলাম। আমি যখন বাড়িতে একা থাকতাম তখন জানালার কাছে এসে ম্যাও ম্যাও করতো। আমি বিরক্ত হয়ে তাড়িয়ে দিলেও কিছুক্ষণ পর ফিরে আসতো।”
অলির বলা কথাগুলো যেন আলভীর কানে এসে থেমে যাচ্ছে। সে শুনতে পাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তার দৃষ্টি বিড়ালের দিকেই আটকে আছে। সে বিড়ালটাকে দেখেই বুঝে গেছে যে না খেয়ে থাকার কারণেই বিড়ালটা মা*রা গেছে। তার মানে গত ২ দিন ধরে এই বাড়িতে কেউ আসেনি। বিড়ালের বাচ্চাটা কোনোভাবে বাড়িতেই আটকা পড়ে গিয়েছিল। আলভী অলিকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
“আচ্ছা আম্মুকে কোন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিলো?”
অলি চোখ মুছে হাসপাতালের নাম বলতেই আলভী বলল,
“আমার মনে হচ্ছে আমাদের সেখানে গিয়ে একবার দেখা উচিৎ। আর তোমার কথামতো তোমাকেও তো সেখান থেকেই কিডন্যাপ করা হয়েছিলো?”
অলি হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ায়। আলভী বলে,
“হাসপাতালের সব জায়গাতেই সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। সেখান থেকে কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলেও যেতে পারে। চলো তারাতাড়ি”
অলি মাথা নেড়ে নিজের রুমে ফিরে এলো। একটা বোরকা পড়ে আর মাথায় হিজাব বেধে রেডি হয়ে নিলো। এরই মাঝে আলভী এসে বলল,
“আব্বু আম্মুর আইডি কার্ড কোথায় আছে জানো?”
অলি ভ্রু কুচকে তাকাতেই আলভী বলল,
“আমি বলতে চাইছি। সেখানে নাম বললেই তো হবেনা। অতোগুলো লোকের মাঝে আব্বু আম্মুকে খুঁজতে সমস্যা হতে পারে। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই অপরিচিত কাউকে প্যাশেন্টের ব্যাপারে ইনফরমেশন দেওয়া হয়না। তাই আইডি কার্ড থাকলে সেই ক্ষেত্রে সুবিধা হবে।”
“বাবা মা এখনো হসপিটালে কি করছে? আমার তো মনে হয় তারা অফিসে আর শপেই আছে”
আলভী কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“আমার মনে হচ্ছে আম্মু এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি সেই জন্য আব্বু আম্মুকে নিয়ে হসপিটালেই আছেন। তুমি এতো ভেবোনা। আর তাদের আইডি কার্ড কোথায় আছে জানা থাকলে সাথে করে নিয়ে নেও।”
অলি একটু ঘাবড়ে গেলেও আলভীর কথামতো বাবা মায়ের রুম থেকে তাদের আইডি কার্ড বের করে নিলো। তারপর দরজায় তালা ঝুলিয়ে আলভী আর অলি হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।
–—
৩০ মিনিটের মধ্যে গাড়ি এসে থামে হাসপাতালের সামনে। এখন মাগরিবের সময়। আকাশের রঙ নরম আভায় রাঙা, চারদিক থেকে ভেসে আসছে আজানের পবিত্র ধ্বনি। বাতাসে মিশে আছে একরকম নির্জনতা, আলভী আর অলি গাড়ি থেকে নেমে ধীর পায়ে হাসপাতালের মূল ফটকের দিকে এগিয়ে যায়। হসপিটালের ভেতরে ঢুকে একজায়গায় আসতেই অলি বলে ওঠে,
“এই জায়গা থেকেই আমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিলো।”
অলির কণ্ঠে জমে থাকা ভয়, কান্না আর বিস্ময়ের রেশ। আলভী থমকে দাঁড়িয়ে যায়। চারপাশে তাকিয়ে দেখে দেয়ালের কোণে কোণে বসানো সিসিটিভি ক্যামেরা। এক মুহূর্তের জন্য তার দৃষ্টি কঠিন হয়ে ওঠে। তবে এখন সবচেয়ে জরুরি হলো আসমা বানু আর লিয়াকত হোসাইনকে খুঁজে বের করা।
আলভী দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় কাউন্টারের দিকে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রিসেপশনিস্টকে জিজ্ঞেস করে—
আসমা বানু আর লিয়াকত হোসাইনের কথা। রিসেপশনিস্ট যেন কিছুটা থমকে যায়। বিস্ময়ের দৃষ্টি মেলে একবার আলভীর দিকে তাকিয়ে তারপর অলির দিকে তাকায়।
“আপনারা ওনাদের কি হন?”
আলভী বলল,
“ওর নাম অলি, ও তাদের মেয়ে। আর আমি আলভী তাসনীম মির্জা অলির হাজব্যান্ড।”
রিসেপশনিস্ট একবার অলির দিকে তাকিয়ে আবারও আলভীর দিকে তাকায়,
“আমি আপনাকে চিনি। আপনি কি কার্ডিওলজিস্ট তাসনীম মির্জা?”
আলভী মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো,
“আপনি কাইন্ডলি যদি বলতেন যে ওনারা এখানে আছেন কিনা।”
রিসেপশনিস্ট আলভীকে ইশারায় কিছু বলতেই আলভী থমকে যায়। সাথে সাথেই আলভীর চোখেমুখে অদ্ভুত একধরনের বদল ঘটে। যেন মুহূর্তেই তার চোখের ভাষা বদলে গেছে—সাবধানতা আর বিস্ময়ের ছায়া স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এদিকে অলি কিছুই বুঝতে পারছেনা। ব্যাকুল হয়ে বলে ওঠে—
“আমার মনে হচ্ছে মা বাবা এখানে নেই আমাদের আগে শপে গিয়ে দেখা উচিৎ ছিলো”
আলভী হঠাৎ করেই অলির বাহু ধরে বলল,
“অলি তোমার কিছু খেয়ে নেওয়া উচিৎ তুমি দুপুরে কিছুই খাওনি”
অলি বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে,
“আরে আমার বাবা মাকে খুঁজে পাচ্ছিনা। আর আপনি আমাকে খেতে বলছেন?”
আলভী অলিকে টেনে অন্যদিকে নিয়ে গিয়ে বলল,
“আমরা তাদের খুব শীগ্রই পেয়ে যাবো। তুমি আগে কিছু খেয়ে নেও।”
কথাগুলো বলতে বলতেই আলভী অলিকে টেনে বাইরে নিয়ে আসলো। তারপর পকেট থেকে অলির ফোনটা বের করে দিহানকে ইমেইল পাঠালো। দিহানের ফোন নম্বর আলভীর মুখস্ত নেই। এতোদিন দিহানের সাথে ইমেইলের মাধ্যমেই কথাবার্তা হয়েছিলো। আলভীর কাজকর্মে অলি খানিকটা বিরক্ত হয়ে গেছে।
“আপনি আজব বিহেভ কেনো করছেন? আর ওই মেয়েটা ইশারা করে কি এমন বলেছে যার জন্য আপনি আমাকে এভাবে টেনে নিয়ে এলেন?”
আলভীর কিছুক্ষণ অলির দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করেই অলিকে জড়িয়ে ধরলো। অলি আলভীকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
“আপনি কেনো এমন করছেন? উনি ইশারায় কি বলেছে?”
আলভী অলিকে ছেড়ে দিয়ে শান্তকন্ঠে বলল,
“তেমন কিছুই বলেনি। সেই ব্যাপার টা বাদ দিয়ে চলো কিছু খেয়ে নেই। আমিও কিন্তু না খেয়েই আছি।”
অলি আর না করতে পারলোনা। আলভী অলিকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে চলে গেলো।
“কি খাবে?”
অলি কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলল,
“আপনার হয়তো বেশিই ক্ষুধা লেগেছে আপনি যা খাবেন তাই অর্ডার করুন। আপাতত আমি কিছুই খেতে পারবোনা। মা বাবাকে না দেখা অব্ধি গলা দিয়ে খাবার নামবেনা।”
আলভী বেশ কিছুক্ষণ অলির দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ অলির হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়। অলি অবাক চোখে আলভীর দিকে তাকায়। আলভী মাথা নিচু করে বলে,
“আমি জানি আমার জন্য তোমাকে অনেক বিপদে পড়তে হয়েছে। আমার জন্য তোমার জীবন শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেছে। একটা কথা সবসময় মনে রাখবে আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। সব রকম পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলে নেবে আমার জন্য না হলেও নিজের বাচ্চাটার জন্য। আমি জানি শুধুমাত্র বাচ্চাটার জন্যই তুমি আমাকে বিয়ে করেছিলে। নয়তো তুমি ম*রে গেলেও আমাকে বিয়ে করতেনা। সেই থেকেই আমি বুঝতে পারি যে বাচ্চাটাকে তুমি কতোটা ভালোবাসো। আচ্ছা তুমি বাচ্চাটার জন্য নিজেকে সামলে নিতে পারবে তো? দেখো বেশি স্ট্রেস নিলে কিন্তু মিসক্যারেজ হয়ে যাবে।”
অলি ভয় পেয়ে গেলো,
“আপনি আজেবাজে কথা বলবেন না একদম। বাবুটা আমার প্রাণ। ওর কিছু হয়ে গেলে আমিও মা*রা যাবো। আপনার তো ওর জন্য টান নেই। সেই জন্যই এইসব কথা বলতে পারলেন। আচ্ছা আপনি দ্বিতীয় বিয়ে করলে আপনার সব সম্পত্তির মালিক আমার বাবু হবে বলেই কি আপনি ওকে অপছন্দ করেন?”
আলভী অবাক চোখে অলির দিকে তাকিয়ে বললো,
“এটা কেমন কথা বললে? আর আমি বাচ্চাটাকে অপছন্দ করি সেটাই বা কখন বললাম? কাম অন অলি বাচ্চাটার জন্যই তোমার পরিস্থিতি আজকে এতো খারাপ। রিফাত নিশ্চয়ই বাচ্চাটাকে মে*রে ফেলার জন্যই তোমার পেছনে লেগেছে। আমার তোমাকে নিয়ে ভয় হচ্ছে। আর সত্যি বলতে বাচ্চাটা না থাকলে তুমি আমাকে বিয়েও করতেনা। সেটাই তোমার জন্য ভালো হতো। আমি তোমাকে প্রটেক্ট করতে পারছিনা। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার কি হবে? তুমি বুঝতেই পারছোনা”
আলভীর কথাগুলো শুনে অলি থমকে গেলো। সে বেশির ভাগ সময়েই আলভীকে বুঝে উঠতে পারেনা। অলি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“আপনি শুধু আমার পাশে থাকুন। আমাদের কিছুই হবেনা”
আলভী মাথা নেড়ে খাবার অর্ডার করলো। খাবার দিয়ে ওয়েটার চলে যেতে নিলে আলভী ওয়েটারকে ডাক দিলো। তারপর তাদের জন্য দিয়ে যাওয়া খাবার গুলো থেকে কিছুটা খাবার অন্য প্লেটে তুলে ওয়েটারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“আপনি আগে টেস্ট করুন”
আলভীর কথাটা শুনে ওয়েটারের সাথে সাথে অলিও চমকে তাকালো আলভীর দিকে।
“স্যার আমি কিভাবে খেতে পারি?”
আলভী গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আপনি খেতে না পারলে আমরাও খেতে পারবোনা। নিয়ে যান এগুলো”
ওয়েটার দ্রুত প্লেটটা উঠিয়ে খাবারটুকু খেয়ে নিলো,
“আপনি এখানে কিছুক্ষণ বসুন।”
ওয়েটার মনে মনে আলভীকে পা*গল ভেবে নিলো। কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পরেই আলভীর সন্দেহ দূর হয়ে যায়। ওয়েটারকে বলে,
“আপনি যান এখন”
ওয়েটার চলে যেতেই আলভী অলির দিকে খাবার এগিয়ে দেয়। অলি ভ্রু কুচকে আলভীর দিকে তাকায়।
“আপনি ওয়েটারকে খেতে বললেন কেনো? এরকম টা কে করে?”
“কেউ করেনা, তবে আমাদেরকে এখন থেকে করতে হবে। আমি কালকেই পয়জন ডিটেকটিভ ডিভাইস আনবো। তার আগে তুমি কারো দেওয়া কোনোকিছুই খাবেনা ওকে?”
“পয়জন?”
অলি বিরবির করে বললো। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো আলভী ঠিকই বলেছে। খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই আলভী অলির হাত ধরে অলিকে টেনে তুললো,
“চলো আমরা এখন আম্মুর শপে যাবো আম্মুকে খুঁজতে। তুমি কিন্তু একদম চিন্তা করবেনা বুঝলে। আমি তো আছি তাইনা? আমরা দুজন মিলে তাদের ঠিক খুঁজে বের করে ফেললো”
অলি হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে আলভীর সাথে গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগে আলভী পুনরায় দিহানকে মেইল পাঠায়,
—হসপিটালে গিয়ে রিসেপশনিস্ট এর সাথে ভালো করে কথা বলে দেখ। পুরোটা শোনার পর আমাকে সাথে সাথেই মেইল করবি। ঠিক আছে?
দিহান ছোট্ট করে লিখলো,
—আরও একঘন্টা লাগবে, আমি কেবল অর্ধেক রাস্তাই এসেছি।
আলভী গাড়ি স্টার্ট দিতেই অলি বললো,
“ফোনটা একটু দিবেন?”
আলভী বিনাবাক্যেই ফোনটা অলির দিকে এগিয়ে দিলো। অলি নোমানের নম্বরে ডায়াল করতে চাইলো কিন্তু পরক্ষণেই আলভীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“নোমান ভাইয়া আমাকে সেখান থেকে বের করার বিনিময়ে আমি তাকে ১০ লক্ষ টাকা দেবো বলেছি। তার নানু অসুস্থ চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা লাগবে। সেই টাকা ম্যানেজ করার জন্যই সে রিফাতের হয়ে আমাকে কিডন্যাপ করেছিলো।”
আলভী একবার অলির দিকে তাকিয়ে পুনরায় সামনের দিকে তাকালো,
“ওকে আম্মুর শপের সামনে আসতে বলো। টাকা দিয়ে দেবো।”
আলভীকে বোঝাতে পেরে অলি একটা শ্বাস ফেললো তারপর নোমানকে কল দিলো। ২বার রিং হতেই নোমান কলটা রিসিভ করে। অলি একবার আলভীর দিকে তাকিয়ে কলটা লাউড স্পিকারে দেয়,
“হ্যালো, অলি তুমি কোথায় আছো? তুমি জানোনা তোমাকে না পেয়ে বস আমাকে হুমকি দিচ্ছে যে আমার নানুকে নাকি মে*রে ফেলবে। প্লিজ অলি তুমি ফিরে এসো।”
কথাটা শুনে আলভী অলির হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বললো,
“অলি ফিরে যাবেনা। আর আপনিও চিন্তা করবেন না। আপনার নানুর লোকেশন সেন্ড করুন আমি তার ব্যাবস্থা করছি। আপনার বস এই জনমে আর আপনার নানুকে খুঁজে পাবেনা।”
আলভীর কন্ঠ শুনে প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও নোমান বললো,
“ভাই আমার নানু কুর্মিটোলা হাসপাতালে আছে তবে বস হয়তো তার উপরে নজর রেখেছে। আপনি কিভাবে আমার নানুকে বাচাবেন?”
আলভী গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“সেটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবেনা। আপনি শুধু নিজেকে সেইফ রাখুন আর আপনার নানুর নাম পরিচয় টা ম্যাসেজ করে পাঠিয়ে দিন। আর হ্যাঁ নিজের খেয়াল রাখবেন”
আলভী কল কেটে দিয়ে একটা নির্জন জায়গায় গাড়িটা থামালো তারপর অলির দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমাকে একটু সবটা খুলে বলোতো, তুমি জানলে কিভাবে যে নোমানের বস রিফাত?”
অলি কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“আমি তার কন্ঠ শুনেই ধরে ফেলেছিলাম যে সেটা রিফাত। কারণ তিশা আপুর মেহেন্দির রাতে তার সাথে আমার কথা হয়েছিলো। সে আমাকে মায়ের কাছে দিয়ে আসবে বলে আপনার রুমে নিয়ে গিয়ে আমাকে আটকে দিয়েছিলো।”
“সেটা নাহয় বুঝলাম কিন্তু ও কেনো এমন করছে সেই ব্যপারে কিছু বলেছে?”
অলি কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“সে ঠিক কি বলেছে আমি পুরোটা বলতে পারবোনা৷ কারণ তাকে আমি সামনা-সামনি দেখিনি সে ফোনেই আমাকে বলেছিলো যে সে নাকি আপনার কোনো ক্ষতিই করবেনা। কারণ আপনাকে নাকি তাদের প্রয়োজন। সে চাইছিলো আমি যেনো ডিভোর্স পেপারে সাইন করে বাচ্চাটাকে এবো*রশন করে ফেলি।”
অলির কথাগুলো শুনে আলভীর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো,
“রিফাতকে আমি নিজের হাতে মা*রবো। রিফাত তোর কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেছে।”
অলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে ওঠে,
“এই সবের পেছনে শুধু রিফাত নয়। আরো একজন আছে। আমি তাকে চিনতে পারিনি।”
আলভী অবাক চোখে অলির দিকে তাকায়,
“আরেকজন ছিলো মানে?”
অলি একটা শুষ্ক ঢোক গিলে বলল,
“আমি ডিভোর্স পেপারে সাইন করতে না চাইলে রিফাত আমাকে মে*রে ফেলার অর্ডার দেয়। কিন্তু সেই লোকটা রিফাতের থেকে ফোন নিয়ে গিয়ে রিফাতকে বলে যে—আমি ডিভোর্স পেপারে সাইন না করা পর্যন্ত যেনো আমাকে না মা*রে। আমি সাইন না করলে নাকি আপনি কখনোই দ্বিতীয় বিয়ে করবেন না।”
অলির কথা শুনে আলভী একটা শ্বাস ফেলে বলল,
“এসব কেমন কথা? আমি দ্বিতীয় বিয়ে করলে সেই লোকটার লাভ কি?”
“সেটা তো জানিনা কিন্তু সেই লোকের কন্ঠটাও আমার পরিচিত লেগেছিলো। আমার মনে হচ্ছে লোকটা আমাদের পরিচিতই।”
আলভী কিছুকক্ষণ ভেবে বললো,
“রিফাত কি বুঝতে পেরেছিলো যে তুমি ওকে চিনেছো? বা রিফাত কি তোমাকে নিজের নাম বলেছিলো?”
অলি না বোধক মাথা নেড়ে বলল,
“মা বলতো যদি বাড়িতে ডাকাত আসে তাদেরকে চিনতে পারলেও সেটা প্রকাশ করতে হয়না। তাহলে নাকি ডাকাত রেগে গিয়ে খু*ন করেও ফেলতে পারে। আমি সেই জন্যই রিফাতকে চিনতে পেরেও সেটা কাউকে বুঝতে দেইনি এমনকি নোমান ভাইয়াকেও এই ব্যপারে কিছুই বলিনি”
“বাহঃ অনেক ভালো করেছো। আম্মু ঠিক কথাই বলেছে, তুমি রিফাতকে চিনতে পেরেছো সেটা ও বুঝতে পারলে…
আলভী কথাটা শেষ না করেই অলির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“ওরা তোমাকে অনেক মার*ধর করেছে তাইনা?”
অলি মৃদু হেসে বললো,
“বেশি না শুধু গুনে গুনে ৩০-৩৫ টার মতো থাপ্পড় মে*রেছিলো”
অলির কথাটা শুনে আলভীর বুকটা ধ্বক করে উঠলো। স্টেয়ারিং এর উপরে থাকা হাতটা শক্ত হয়ে গেলো, নিজের উপরেই নিজের রাগ হচ্ছে। আলভী অলির দিকে তাকিয়ে বলল,
“স্যরি অলি, আমার বিহেভিয়ারের জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিও”
অলি বাইরের দিকে তাকিয়ে শান্তকন্ঠে বললো,
“স্যরি বলছেন কেনো? আপনার জায়গায় আমি থাকলে আমি আরও বেশি প্রতিক্রিয়া করতাম। আপনি তাও আমাকে বাচিয়ে রেখেছেন কিন্তু আমি হলে অন্য কারো সাথে দেখা মাত্রই আপনাকে খু*ন করে ফেলতাম। আমি যদি জানতাম আপনি সেখানে লুকিয়ে আছেন আমি কখনোই এতো ভালো এক্টিং করতে পারতাম না। আমি এখনো ভেবে পাইনা যে নোমান ভাইয়াকে আই লাভ ইউ বলতে দেখেও আপনি আমাকে জীবিত রেখে চলে আসলেন কিভাবে?”
আলভী অলির দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি কিভাবে তোমাকে কিছু বলতাম? আমি যেখানে নিজেই তোমার কাছে অপরাধী সেখানে তোমার অপরাধের জন্য কিভাবে শাস্তি দেবো আমি? তুমি ভালোবেসে আমাকে বিয়ে করোনি শুধুমাত্র বাচ্চাটার জন্যই বিয়ে করেছিলে সেটা জানার পরেও কিভাবে তোমাকে নিজের কাছে আটকে রাখতাম? আমি যে সবসময় তোমাকে সুখী দেখতে চাই। তাতে তুমি যদি অন্য কারো সাথে সুখী থাকো সেটাও চলবে”
অলি আলভীর দিকে না তাকিয়েই বললো,
“আমার সুখ তো আমার বাবু আর তার বাবার মাঝে আছে। আমি হয়তো আপনাকে ভালোবাসি না তবে আপনি তো আমাকে ভালোবাসেন। আপনি চাইলে আমি আপনার সাথেই সুখে থাকবো তবে সেটার জন্য আপনাকে আমার বাবুর বাবা হতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে যে সে আপনার সন্তান। একজন বাবার মতোই ভালোবাসতে হবে। তবে সেই জন্য আমি প্রমাণ দিতে পারবোনা যে সে আপনার সন্তান। কারণ সেটা আমার আর আমার বাবু দুজনের জন্যই লজ্জাজনক।”
আলভী ভ্রু কুচকে বলে উঠল,
“তুমি এভাবে কথা কিভাবে বলো? তোমার বয়স তো ১৫ বছর কিন্তু মাত্রই মনে হলো তোমার বয়স ২৫ বছর”
অলি একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,
“আমি জানিনা তবে আমার পরিস্থিতিটাই এরকম যে আমি ২৫ বছরের নারীদের মতো সবকিছু অনুভব করতে পারছি। হয়তো পরিস্থিতিই আমাকে এইসব কথাগুলো শিখিয়ে দিচ্ছে। তবে আপনি মূল কথা থেকে সরে যাচ্ছেন”
আলভী হঠাৎ করেই অলিকে নিজের কাছে টেনে নিলো। অলির মুখটা উঁচু করে অলির চোখের দিকে তাকালো। অলি চোখ সরিয়ে নিতে চাইলে আলভী বিরক্তি সূচক শব্দ উচ্চারণ করে বললো,
“আমার দিকে তাকাও একটা প্রশ্ন করবো”
অলি আলভীর দিকে তাকাতেই আলভী বলল,
“আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো যে বাচ্চাটার বাবা আমিই। তাহলেই আমি বিশ্বাস করে নেবো। আর কোনো প্রমানের দরকার নেই”
অলি একটা শুষ্ক ঢোক গিলে আলভীর চোখে চোখ রেখেই বললো,
“আমার গর্ভে থাকা বাবুর বাবা আপনিই”
অলির কথাটা শোনামাত্রই আলভী আচমকাই অলির কপালে নিজের ঠোঁট ছোয়ালো। আলভীর স্পর্শে অলি মারাত্মক ভাবে কেপে উঠলো। সে অটোমেটিক ধাক্কা দিয়ে আলভীকে নিজের থেকে সরিয়ে দিলো। আলভীর কিছুটা খারাপ লাগলেও সে রিয়েক্ট করলোনা।
“মাঝে মাঝে বাবুর পাশাপাশি বাবুর বাবাকে নিয়েও একটু ভেবো। সারাজীবন এভাবেই ধাক্কা দেওয়ার প্ল্যান করলে কিন্তু বাবুর বাবার আয়ু কমে যাবে।”
অলি না চাইতেও লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যায়। সে কি করবে? আলভীর স্পর্শে সে ভয় পায়। ভীষণ ভয় পায়।
চলবে,,,
শব্দসংখ্যা- ২৫০০+