১৫ বছর বয়সী মা পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0
24

#১৫_বছর_বয়সী_মা (৩৪)
#সোফিয়া_সাফা

🔺 **সতর্কীকরণ:** এই পর্বে আবেগপ্রবণ ও মানসিকভাবে নাড়া দিতে পারে—এমন কিছু দৃশ্য রয়েছে। দয়া করে নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে নিন।

ঘড়ির কাটায় রাত ৮টা ছুইছুই অলি আর আলভী অলির মায়ের শপের সামনে এসে নামলো। কিন্তু এখানে এসে খুব একটা লাভ হলোনা। কারণ শপটা বন্ধ। আলভী অলির পাশে গিয়ে দাড়ালো,
“আম্মুর সাথে একটা মহিলাও তো এখানে কাজ করে তাইনা? তার নম্বর আছে তোমার কাছে?”

অলি নাবোধক মাথা নাড়ে, কেনো যেন এবার অলির ভীষণ কান্না পাচ্ছে। অলি নিজের কান্না আটকে রাখতে পারলোনা।
“আ… আমার মা বাবা কোথায় গেলো?”

অলির গাল বেয়ে পানির ধারা গড়িয়ে পড়লো। আলভী অলিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টানোর উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলো,
“অলি তোমাকে যখন কিডন্যাপ করা হয়েছিলো তখন তোমার সাথে কি কেউ ছিলোনা? তুমি কি চিৎকার করোনি?”

অলি কান্নার মাঝেই বলে উঠলো,
“না আমি চিৎকার করার মতো অবস্থাতেই ছিলাম না। মায়ের এক্সিডেন্টের বিবরণ শুনেই আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম।”

অলির কথা শুনে আলভীর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। সে বুঝে উঠতেই পারছেনা যে অলিকে সে কিভাবে সামলাবে। আলভী একটা শ্বাস ফেলে অলির চোখজোড়া মুছে দিলো,
“বললাম তো স্ট্রেস নিওনা। তুমি কি বুঝতে পারছোনা? তোমার শরীরের কন্ডিশন আগে থেকেই খারাপ। প্লিজ কান্না কোরোনা।”

আলভীর কথা শুনে অলির কান্নার মাত্রা আরও বেড়ে যায়। নিজের কান্না লুকানোর চেষ্টায় সে অজান্তেই আলভীকে জড়িয়ে ধরে। এরকম ঘটনার জন্য আলভী মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা। সে নিজের জায়গাতেই জমে গেলো। কিছুক্ষণ যেতেই দুহাতে অলিকে বুকের মাঝে আকড়ে ধরলো। অলি প্রথমে অনিচ্ছাকৃত ভাবে আলভীকে জড়িয়ে ধরলেও কিছু মূহুর্ত যেতেই সে আলভীর বুকের মাঝে অদ্ভুত একধরনের শান্তি খুঁজে পায়। এর আগেও আলভী অলিকে জড়িয়ে ধরেছিলো কিন্তু অলি সেইসময় বেখেয়ালি ছিলো। তবে এখন অলি সম্পূর্ণ খেয়ালেই আছে। অলি ঠোঁট চেপে নিম্নস্বরে বলে উঠলো,
“আপনি আমার বাবা মাকে খুজে দিন প্লিজ। যেখান থেকে পারেন খুঁজে এনে দিন।”

আলভী আচমকাই অলিকে কোলে তুলে নিলো। তারপর গাড়িতে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলো। গাড়ি স্টার্ট দিতেই অলি এগিয়ে আসে আলভীর দিকে। বিনাবাক্যেই সে আলভীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। আলভীর কোমড় জড়িয়ে ধরে আলভীর কোলেই মুখ গোজে। আলভী বুঝতে পারে অলির মন ভীষণ খারাপ। সে অলির কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। কিছুক্ষণ যেতেই অলি মুখ তুলে আলভীর দিকে তাকায়,
“আপনি নিশ্চয়ই অনেক বিরক্ত হচ্ছেন তাইনা? আমি জানি আপনি কান্নার আওয়াজ পছন্দ করেননা। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি নিজেকে থামানোর চেষ্টা করছি কিন্তু পারছিনা। আমার বাবা মা কোথায় গেলো? আমি কোথায় খুজবো তাদের? আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।”

আলভী একদৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করেই সে নিজের বাম হাতটা স্টেয়ারিং এর উপর রেখে ডান হাতটা অলির মাথায় রেখে বলে উঠলো,
“মাঝে মাঝে কাদতে হয় অলি৷ আমি তোমাকে কাদতে বারণ করতাম না তবে তুমি তো জানোই যে তুমি প্রেগন্যান্ট। এই অবস্থায় কান্নাকাটি করলে কি হতে পারে সেটাও তুমি জানো। আর সত্যি বলতে আমি সেই জন্যই চিন্তিত।”

অলি পুনরায় আলভীর কোমড় জড়িয়ে ধরে মুখ গুজলো এই মূহুর্তে আলভীই তার একমাত্র সেইফ এন্ড কম্ফোর্ট প্লেস। ১৫ মিনিট পর আলভী গাড়িটাকে অলিদের বাড়ির সামনে থামায়।
“অলি উঠো”

আলভীর ডাকে অলি মুখ তুললো। তারপর ধীরপায়ে গাড়ি থেকে নেমে এলো। অলির শরীর চলছেনা, মনে হচ্ছে শরীরের সবটুকু শক্তি কেউ নিংড়ে নিয়েছে। আলভী গাড়িটা পার্ক করে অলিকে নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলো। আলভী নিজেও ক্লান্ত। অলি রুমে এসে কাপড় চেইঞ্জ করে আলভীর দিকে তাকালো। আলভী ফোনে কাউকে মেইল করতে ব্যস্ত। অলি একটা শ্বাস ফেলে বাবা মায়ের রুমে এলো। তারপর সেখান থেকে লিয়াকত হোসাইনের একটা পাঞ্জাবি আর পায়জামা বের করে নিজের রুমে এসে আলভীর দিকে এগিয়ে দিলো। কাপড়গুলো দেখে আলভী অলির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়,
“আপনি এগুলো পড়ে নিন। স্যুট-কোট পড়ে আর কতোক্ষণ থাকবেন?”

আলভী মাথা নেড়ে অলির হাত থেকে কাপড়গুলো নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। ১০ মিনিট যেতেই আলভী ওয়াশরুম থেকে বের হলো। আলভী বের হতেই অলি তার দিকে একটা তোয়ালে এগিয়ে দিলো। আলভী কিছু সময় অলির দিকে তাকিয়ে থেকে তোয়ালে টা নিয়ে নিজের মুখ মুছতে লাগলো,
“বলছিলাম কি বিড়ালের বাচ্চাটাকে সরাতে হতো”

“হু”

“আপনি একটু সরিয়ে দেবেন?”

আলভী অলির দিকে তাকাতেই অলি হকচকিয়ে বলে ওঠে,
“আসলে আমি… আমার মানে… আমার ভয় ক…

“কুল ডাউন আমি সরিয়ে দেবো চিন্তা কোরোনা। এটা কোনো বড় ব্যপার নয়।”

আলভীর কথায় অলি ঠোঁট চেপে মাথা নিচু করে নিলো। সে তো ভুলেই গেছে আলভী ডক্টর, ম*রা বস্তু দেখার অভ্যাস আছে তার। আলভী তোয়ালেটা খাটের উপর রেখে অলির উদ্দেশ্যে বলল,
“চলো, ওটাকে কব*র দিয়ে আসি।”

আলভী এগিয়ে গেলো, অলিও তার পিছুপিছু যেতে লাগলো। অলি বাগানের সাইডের লাইট অন করে আলভীর উদ্দেশ্যে বলল,
“ওটাকে নিয়ে বাগানের সাইডে চলুন।”

আলভী মাথা নেড়ে বেলচা হাতে এগিয়ে গেলো কিচেনের দিকে। অলিও দুরত্ব বজায় রেখেই আলভীকে সাহায্য করতে লাগলো।

–—

ছোট্ট ক*বরটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অলি। এদিকে গোলাপ ফুলের ঘ্রাণে আলভীর অবস্থা খারাপ। অলি আলভীর দিকে তাকাতেই থমকে যায়।
“একি কি হয়েছে আপনার? আপনি কাদছেন কেনো?”

আলভীর চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। সেই সাথে সমস্ত মুখমণ্ডল রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। আলভী হাত চুলকাতে চুলকাতে বললো,
“গোলাপ ফুলে আমার একটু এলার্জি আছে। তুমি চিন্তা কোরোনা আমি ঠিক আছি”

আলভীর কথা শোনামাত্রই অলি স্তব্ধ হয়ে যায়। এই আলভীর মাথার তার কি ছিড়ে গেছে? সমস্যা হলে এতক্ষণ চুপচাপ সহ্য করছিলো কেনো? বিনা দ্বিধায় আচমকাই আলভীর হাত ধরে ফেললো অলি। আলভী বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। কিছু বোঝার আগেই অলি তার হাত ধরে টানতে শুরু করলো। কিন্তু আলভীর মতো উচ্চতা আর গড়নের একজন পুরুষকে কি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে টেনে নিয়ে যাওয়া যায়? তাও আবার অলির পক্ষে সেটা একদম অসম্ভব,
অলি একপলক তার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আরে এখনো দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? চলুন, আজব তো আপনি। আপনার কষ্ট হচ্ছিলো তারপরও কেনো দাঁড়িয়ে ছিলেন এতোক্ষণ? এখনো দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?”

অলির তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ধ্যান ভাঙলো আলভীর। নিঃশব্দে ওর পিছু পিছুই হাঁটা ধরলো। অলি কিচেনে এসে সবকিছু পরিষ্কার করতে নিলে আলভী বাধা দিয়ে বলে,
“তোমার শরীর ভালো নেই। এসব রাখো”

অলি মৃদু স্বরে বলে,
“ঘর অগোছালো থাকলে আমার শরীর আরও খারাপ লাগবে।”

আলভী একটা চেয়ার টেনে অলিকে সেখানে বসিয়ে দিয়ে বললো,
“আমি গুছিয়ে রাখছি।”

“আরে আপনি কিভাবে গোছাবেন? আপনার শরীর টাও তো ভালো নেই। চোখ মুখের কি অবস্থা হয়েছে।”

“আমি ঠিক আছি। তুমি চিন্তা কোরোনা।”

আলভী গোছাতে শুরু করলে অলি এসে তাকে আটকায়,
“এগুলো রাখুন। কাউকেই গোছাতে হবেনা।”

আলভী বলল,
“আমি পারবো। তুমি চুপচাপ বসো”

ঘড়ির কাটা এখন দশটার ঘড়ে। আলভী সবকিছু গুছিয়ে অলির উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলো,
“দেখো সব ঠিকঠাক আছে?”

অলি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো।
“অনেক কাজ করেছেন এখন গিয়ে শুয়ে পড়ুন। কালকে কিন্তু বাবা মাকে খুঁজে বের করতেই হবে।”

আলভী অলির মুখ বরাবর ঝুকে বললো,
“তুমি চিন্তা কোরোনা কালকে দরকার হলে পুলিশের কাছে যাবো”

অলি আলভীকে নিয়ে নিজের রুমে এলো। আলভী অলির উদ্দেশ্যে বললো,
“তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আমি এখানেই আছি। তুমি ঘুমিয়ে গেলে আমি পাশের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়বো।”

অলি মাথা নেড়ে শুয়ে পড়লো। আলভীও অলির পাশে গিয়ে বসলো। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেলেও অলি ঘুমাতে পারেনা।
“তুমি ঘুমাচ্ছোনা কেনো?”

অলি আলভীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি ঘুমালেই আপনি চলে যাবেন। সেটা ভেবেই আমি ঘুমাতে পারছিনা।”

আলভী অবাক চোখে অলির দিকে তাকায়,
“তুমি চাইছো আমি এখানে থাকি?”

অলি ঠোঁট চেপে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে। আলভী একটা শ্বাস ফেলে বলে,
“আচ্ছা আমি যাবোনা। এখানেই বসে থাকবো তুমি ঘুমাও।”

অলি শোয়া থেকে উঠে বসে বলল,
“আমার খাটটা ততোটা বড় নয়। কিন্তু ২জন শোয়া যায়। মা প্রায়ই আমার সাথে ঘুমাতেন। আপনিও আমার পাশেই শুয়ে পড়ুন।”

অলির কথা শুনে আলভী চমকিত নয়নে অলির দিকে তাকায়, যেই মেয়েটা তার সাথে ঘুমানোর ভয়ে রূপসার রুমে গিয়ে লুকিয়ে ছিলো। সেই মেয়েটাই আজকে নিজে থেকে তার পাশে ঘুমাতে চাইছে?
“কি হলো? আপনার প্রবলেম হবে?”

আলভী নাবোধক মাথা নাড়ে।
“আমার সমস্যা নেই।”

“আচ্ছা তাহলে কষ্ট করে লাইট টা অফ করে দিয়ে এসে শুয়ে পড়ুন।”

আলভী মাথা নেড়ে লাইট অফ করে দিয়ে অলির পাশেই শুয়ে পড়লো। বেশ কিছুক্ষণ পর অলি মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
“আমি আপনাকে জড়িয়ে ধরবো?”

অলির ফিসফিসিয়ে বলা কথাটায় আলভীর শরীর অসাড় হয়ে এলো। সে জবাব না দিয়ে নিজে থেকেই অলিকে টেনে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। অলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি এই সময়টার জন্য কতোটা অপেক্ষা করে ছিলাম তুমি কল্পনাও করতে পারবেনা হানিবি।”

আলভীর গম্ভীর কন্ঠ শুনে অলির গলা শুকিয়ে এলো। সেই সাথে আলভীর মুখ থেকে হানিবি ডাকটা শুনে প্রথমবারের মতো ভালোলাগা কাজ করলো। অলির হার্টবিটের রেট অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেছে। আলভীর স্পর্শ তার দেহ এবং মনে এক অস্বাভাবিক শিহরণ ছড়িয়ে দিয়েছে। সে ভীষণ ভীত তবে এটা আলভীকে হারিয়ে ফেলার ভয়। সে কোনো মূল্যই আলভীর এই স্পর্শের ভাগ কাউকে দিতে পারবেনা। আলভীর এই হাতের স্পর্শ শুধুমাত্র তার অধিকার। অলি আলভীর বুকের সাথে নিজেকে আরও জড়িয়ে নিলো।
রাত্রী ১২ টা

অলি ঘুমাচ্ছে। তার নিঃশ্বাস ভারী, যেন ঘুমের গভীরে তলিয়ে আছে। অথচ আলভীর চোখে একফোঁটা ঘুম নেই। সে হঠাৎ করেই বালিশের নিচ থেকে ফোনটা হাতে তুলে নিলো। দিহান ইমেইলে নিজের নম্বর দিয়েছিলো। আলভী সরাসরি দিহানকে কল দিলো। দিহান রিসিভ করতেই, আলভী খুব সন্তর্পণে অলির থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে দাড়ালো।
“হ্যালো এভি। আমি অনেকক্ষণ যাবত বাইরে অপেক্ষা করছি। দরজা খোল, বাইরে অনেক মশা”

আলভী এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। দরজা খুলে দিতেই দিহান ভেতরে প্রবেশ করে। তারা দুজনেই ড্রইংরুমে এসে বসে। চারপাশটা নিস্তব্ধ, ঘরের বাতাস পর্যন্ত ভারী। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর দিহান প্রথম মুখ খোলে।
“ভাবীকে ব্যাপারটা জানিয়ে দেওয়া উচিৎ এভি।”

আলভীর চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। চোখ লালচে। তবুও গলার স্বর নিচু রেখে বলল,
“অলি এই ব্যাপারে জানতে পারলে আমি অলিকে সামলাতে পারবোনা দিহান। কিছুতেই অলিকে এই ব্যপারে জানানো যাবেনা।”

দিহান মাথা নিচু করে হালকা শ্বাস ফেলে।
“তাই বলে কি শেষবারের মতো বাবা মাকে দেখতেও দিবিনা?”

আলভী দুই হাতে মাথা চেপে ধরে। এতক্ষণ ধরে নিজেকে আটকে রেখেছিলো কিন্তু ভেতরের কষ্টটাকে যেন এখন আর দমাতে পারছে না। মনের ভেতরে একটা হাহাকার জমে আছে। দিহান পাশে বসে আলভীর কাঁধে হাত রাখে।
“তুই এরকম করলে কীভাবে হবে বল? ভাবীকে তো তোকেই সামলাতে হবে, তাই না?”

আলভী কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে একটু শক্ত করে নেয়।
“সকাল হতেই আমি অলিকে নিয়ে বাইরে চলে যাবো। সেই সুযোগে তুই আমার আর অলির ফ্যামিলিকে কল দিয়ে আব্বু আর আম্মুর বিষয়টা জানাবি। সবার আগে আমার মামী—মানে অলির খালাকে।”

দিহান চুপচাপ মাথা নেড়ে সায় দিল। আলভীর চোখ দুটো কেমন যেন জ্বলজ্বল করছিলো। দৃষ্টি স্থির রাখতে পারছিল না।
“এসব কিভাবে হয়ে গেলো দিহান? আমি নিজেই তো মেনে নিতে পারছি না… আমার অলি কিভাবে মেনে নেবে?”

দিহান একটুখানি নিঃশ্বাস ফেলে রয়েসয়ে বলল,
“সেখানে আমি এই বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, আন্টির মারাত্মক এ*ক্সিডেন্ট হয়েছিলো। অপারেশন চলাকালীনই… উনি মা*রা যান। আর ভাবীকেও হয়তো সেই সময়েই কিডন্যাপ করা হয়েছিলো। এতো কিছু একসাথে ঘটে যাওয়াতে আঙ্কেলের… হার্ট অ্যাটাক হয়েছিলো।”

“নাহ…!”

আচমকা তীক্ষ্ণ চিৎকারে ঘরের শ্বাসরুদ্ধ নীরবতা বিদীর্ণ হয়ে গেলো। আলভী আর দিহান দুজনেই ঝাঁকুনি খেয়ে রুমের দরজার দিকে তাকালো।
অলি…
দাঁড়িয়ে আছে। দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা অন্ধকারে তার মুখটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু চোখের ভেতরের আতঙ্কটা দূর থেকেই ধরা পড়ছে। অলি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। ওড়নাটা কাধ থেকে নামতে নামতে হাত থেকে ফ্লোরে ঝুলে পড়েছে—অলির খেয়ালও নেই। গলার স্বর কাঁপছে। বুকের ভেতরটা যেন কেউ পিষে ধরেছে। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।
“উনি… উনি এসব কী বললেন?”

আলভী এগিয়ে এসে অলিকে সামলানোর চেষ্টা করলো। দিহান দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। অলি এক ঝটকায় আলভীর হাত সরিয়ে দিয়ে হাসফাস করতে করতে বলে উঠলো,
“না… না, উনি একটু আগে ইয়ার্কি করেছেন, তাই না? আরে আমাদের বাইরে শপিং করতে যাওয়ার কথা ছিলো। আমি মাকে কাপড় কিনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। মা… কিভাবে এভাবে চলে যেতে পারে? বাবা… আমি তো তাকে এখন পর্যন্ত বলতেই পারলাম না যে আমি তাকে কতোটা ভালোবাসি। আমি মাকেও বলতে পারলাম না যে তারা আমার কাছে কতোটা প্রিয়।”

অলি হু হু করে কেদে উঠলো। আলভী অলিকে একটানে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। অলি আলভীর বুকের মাঝেই মুখ গুজে বলে উঠলো,
“আমি কি এতিম হয়ে গেলাম?… আমার কি আর কেউ রইলোনা? আপনি আমার মা বাবাকে একবার এনে দিন না প্লিজ আমি শুধু মাত্র একবার তাদেরকে জড়িয়ে ধরে বলতে চাই তারা পৃথিবীর সবচাইতে শ্রেষ্ঠ বাবা মা। আমি বলতে চাই আমি তাদেরকে সবচাইতে বেশি ভালোবাসি।…”

আলভীর বুকটা ধরে আসছে। সে মুখে কিছু বলতে পারছে না। তার চোখের নিচেও পানি জমেছে। অলি আলভীকে ছেড়ে দুপা পিছিয়ে গেলো। হাত দিয়ে নিজের চুল টানতে লাগলো, বুক চাপড়ে বলতে শুরু করলো,
“মাহহহহহ, বাবাহহহহহ প্লিজ ফিরে এসো। ফিরে এসো মাহহহ তোমার ছোট্ট পরীর খুব কষ্ট হচ্ছে। বাবাহহহ আম্মুকে এভাবে কষ্ট দিতে নেই। আমি পারবোনা তোমাদের ছাড়া থাকতে। ফিরে এসো।।।। আল্লাহহহহ আমার মা বাবাকে নিওনা ফিরিয়ে দেও আল্লাহ। আমি পারবোনা থাকতে। মা তুমি তো বলেছিলে তোমরা থাকবে আমার পাশে। তাহলে কিভাবে চলে গেলে কিভাবে চলে গেলে?…!”

অলির প্রত্যেকটা চিৎকার আলভীর বুকে ছু*রির ন্যায়ে বিধে যাচ্ছিলো। আলভীর বুকটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। আলভী আর সহ্য করতে না পেরে পুনরায় অলিকে আকড়ে ধরে জোর করে বুকের সাথে চেপে ধরলো,
“কলিজা শান্ত হ প্লিজ, প্লিজ শান্ত হ। তুই এরকম করলে আমাকেও হারিয়ে ফেলবি তুই। আমি তোর কান্না সহ্য করতে পারছিনা”

চলবে,,,

শব্দসংখ্যা- ২০০০+

#১৫_বছর_বয়সী_মা (৩৫)
#সোফিয়া_সাফা

ঘর জুড়ে থমথমে নিস্তব্ধতা। আলো ফুটেছে অনেক আগেই, কিন্তু এই বাড়ির গায়ে যেন এখনো আঁধারের জাল। সাদা পর্দা ভেদ করে হালকা রোদের রেখা বিছানার ওপরে এসে পড়েছে, তবু কোনো উষ্ণতা নেই আলোয়। বিছানায় নিথর হয়ে পড়ে আছে অলি। তার চোখের পাতাগুলো শান্ত, নিঃশ্বাসটাও কেমন যেন হালকা, দেখে মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে আছে। অথচ এই ঘুম ঘুম নয়। গতরাতে কাদতে কাদতে চেতনা হারিয়ে ফেলেছিলো সে। আলভী বিছানার এককোণায় বসে আছে, চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। সারারাত একফোঁটা ঘুমায়নি সে। চোখের নিচে কালো দাগ, চুলগুলো এলোমেলো, আর মুখে দুশ্চিন্তার রেখা। মাঝেমাঝে সে অলির দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে কিছু বলতে চেয়েও চুপ হয়ে যাচ্ছে। বাইরে থেকে কোলাহলের শব্দ ভেসে আসছে সম্ভবত আত্মীয়স্বজনরা আসতে শুরু করেছে। সেই সাথে আলভী দিহানকে দিয়ে লোকজন ভাড়া করে এনেছে অন্তিম কাজের প্রস্তুতির জন্য। এরই মাঝে অলি একটু নড়ে ওঠে। চোখ দুটো একটুখানি খুলে আবার বন্ধ করে নেয়। কিন্তু মুহূর্তখানেক পরেই সে উঠে বসে, যেন ভয়ংকর কোনো দুঃস্বপ্ন তাকে টেনে তুলেছে।
“মাহহহ… বাবাহহহ…” অলির কন্ঠস্বর কাঁপছে। মুহূর্তেই চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো।

আলভী তড়িৎ গতিতে অলির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে অলির কাঁধে হাত রাখে।
“অলি… একটু পানি খাবে?”

অলি থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলে ওঠে,
“নাহ… সবকিছু দুঃস্বপ্ন ছিলো তাইনা? আমার মা… বাবার কিচ্ছু হয়নি। বলুন না,”

অলি বসা থেকে খাটের বাইরে পা রাখতেই তার মাথা ঘুরে যায়। আলভী অলিকে সামলে নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে। আলভীর চোখ ভিজে ওঠে। গলায় কষ্ট আটকে আছে। তবুও অলির মাথায় হাত রেখে বলে,
“আব্বু আম্মু চিরদিনের মতো আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন অলি। একদিন আমাদের সবাইকেই যেতে হবে। তারা একটু আগে গেছেন—আর আমরা একটু পরে যাবো। এটাই ব্যবধান। তুমি প্লিজ এভাবে ভেঙ্গে পরোনা। তুমি যদি এরকম করো তাহলে আব্বু আম্মুর রূহ অনেক কষ্ট পাবে।”

আলভীর বাকি কোনো কথাই অলি শুনতে পেলোনা। শুধু বাবা মা চলে গেছেন সেটুকু শুনেই অলি ডুকরে কেদে উঠল। আলভীকে সরিয়ে দিয়ে একহাতে নিজের বুক চাপড়াতে লাগলো,
“আমি মানি না। আমি মানি না। আমার মা বাবাকে এনে দিন। আমার মা বাবাকে এনে দিন। আমি তাদেরকে ছাড়া থাকতে পারবোনা। আমি পারবোনা থাকতে।”

অলি মুহূর্তেই দরজার দিকে ছুটে গেলো। চিৎকার করে ডাকতে লাগলো,
“মাহহ বাবাহহ। কোথায় তোমরা। আমাকে নিয়ে যাও প্লিজ। প্লিজ আমাকে রেখে যেওনা। আল্লাহ আমার বাবা মাকে ফিরিয়ে দিন”

অলির কান্নার শব্দে অলির খালা আমেনা খাতুন ছুটে এলেন, সে কিছুক্ষণ আগেই এসেছেন। তার সাথে ইশা, তিশা, সামিরা আর সামিরও আছে। বলতে গেলে এরকম ঘটনা শুনে তাদের বাড়ির সবাই-ই ছুটে এসেছেন। অলি আবারও সেন্সলেস হয়ে যেতে নিলে আলভী কোনমতে অলিকে আকড়ে ধরে। আমেনা খাতুন অলির অবস্থা দেখে হু হু করে কেদে উঠলেন,
“এসব কীভাবে হয়ে গেলো। আল্লাহ কেনো এরকম টা করলেন। আমার বোনটা আমাদেরকে কিছু না বলেই এভাবে চলে গেলো। এখন অলিকে আমরা কিভাবে সামলাবো।”

আলভী অলিকে কোলে করে পুনরায় খাটে শোয়াতেই লক্ষ্য করলো অলির ব্লিডিং হচ্ছে। এরকম দৃশ্য দেখার জন্য আলভী মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা। আলভী নিজের দুহাত সামনে এনে বেশ কিছুক্ষণ র*ক্ত গুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ করেই আলভী চিৎকার দিয়ে ওঠে,
“অলিইইই,”

আমেনা খাতুন কি করবেন ভেবে পেলেন না। সে আলভীর কাধে হাত রেখে বললেন।
“বাবা তুমি তারাতাড়ি অলিকে হসপিটালে নিয়ে যাও। আমরা এইদিকটা সামলে নেবো। দেরি করোনা তাহলে হয়তো ওর মিসক্যারেজ হয়ে যাবে।”

মিসক্যারেজের কথাটা শুনে আলভীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। তেমন কিছু হলে অলিকেও সে বাচাতে পারবেনা। আর নাতো নিজেও বাচতে পারবে। আলভী আশেপাশে তাকিয়ে দিহানকে খুজলো কিন্তু দিহান তো আসমা বানু আর লিয়াকত হোসাইনের লা*শ আনতে গেছে। এরই মাঝে সামির এগিয়ে এসে বললো,
“এভি ভাইয়া চলো আমিও যাচ্ছি তোমার সাথে।”

আলভী মাথা নেড়ে অলিকে কোলে তুলে নিলো। অলিকে নিয়ে দরজা অবধি আসতেই বাড়ির মূল ফটক থেকে গাড়ির শব্দ ভেসে আসে। আলভীর পরিবার এসে পৌঁছেছে।
প্রথমেই নামলেন আলভীর বাবা উসমান মির্জা গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, কপালে চিন্তার ভাঁজ। তার সঙ্গে শাহানাজ বেগম, মুখে স্পষ্ট অস্বস্তি আর বিরক্তির ছাপ। তাদের পেছনে নামলো ঊর্মিলা। তাদের পেছনের গাড়ি থেকে নামলেন রূপসা, ইয়াদ, নূরনাহার আর রুনা খাতুন তাদের সাথে রূপসার বাবা রহিম আহমেদও আছেন। সে আজকেই বিডিতে ব্যাক করেছিলেন। সবাই আসবে শুনে সেও তাদের সাথেই এসেছেন। অলির এরকম অবস্থা দেখে ঊর্মিলা একপ্রকার দৌড়ে আসলো।
“ভাইয়া অলির কি হয়েছে?”

আলভী উত্তর দিলোনা। সামির পেছন থেকে বলল,
“অলির ব্লি*ডিং হচ্ছে। ভাইয়া ওকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছে।”

কথাটা শুনে ঊর্মিলাও তাদের সাথে পা মেলালো। সেও যাবে অলির সাথে।

––

হাসপাতালের করিডোরটা থমথমে। সাদা আলোয় ঝকঝকে করিডোরে অলির নিথর দেহটা নিয়ে ছুটে যাচ্ছে আলভী। তার চোখে একধরনের আতঙ্ক আর অসহায়তা। পেছনে দৌড়ে আসছে সামির আর ঊর্মিলা।
“সিস্টার! ডাক্তার কোথায়? ইমার্জেন্সি প্লিজ!”, সামির কাউন্টারের দিকে গিয়ে চিৎকার করে উঠলো।

সঙ্গে সঙ্গে নার্স ওয়ার্ডবয় স্ট্রেচার নিয়ে এলো। অলিকে কোল থেমে নামিয়ে স্ট্রেচারে তুলে দিলো আলভী।
“ও প্রায় চার মাসের প্রেগন্যান্ট, vaginal bleeding হচ্ছে। প্লিজ, তারাতাড়ি ওকে অবজারভেশনে নিন” আলভীর গলা কাঁপছে।

ডিউটি ডাক্তার, একজন মহিলা গাইনোকোলজিস্ট, এসে চোখ রাখলেন অলির উপর। দ্রুত ওটিতে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে।
“আমি একজন কার্ডিওলজিস্ট আমিও ওর সাথে যেতে চাইছি”

আলভীর কন্ঠস্বর অনবরত কাপছে, ডাক্তার শান্তস্বরে বললেন,
“আপনাকে মানসিকভাবে বিপদগ্রস্ত দেখাচ্ছে। আপনি বরং এখানে বসেই অপেক্ষা করুন। আমরা ওনাকে স্ট্যাবিলাইজ করছি, আপনি চিন্তা করবেন না,”

আলভী পেছনে সরে এসে দেয়ালে হেলে পড়লো। একটা দীর্ঘ শ্বাস বের হলো তার বুক থেকে। দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“হে আল্লাহ, শুধু ওকে আর বাচ্চাটাকে ঠিক রেখো। আমি ওদেরকে হারিয়ে বাচতে পারবোনা।”

ঊর্মিলা এসে আলভীর পাশে দাড়ালো। ওর চোখেও পানি।
“ভাইয়া, তুই কাঁদছিস?”

“না… আমি কাঁদছি না ঊর্মি, শুধু দোয়া করছি…” বলেই আলভী একহাতে চোখের জল মুছে নিলো।
,

প্রায় আধাঘণ্টা কেটে গেলেও সময় যেন থেমে গেছে। প্রতিটি মিনিট যেন ঘণ্টার সমান। ডাক্তার ওটির দরজা খুলে বের হয়ে এলেন। মুখে এক ধরনের স্বস্তির ছাপ।
“আপনারা চিন্তা করবেন না। পেশেন্ট এখন স্থিতিশীল। বাচ্চারও কোনো ক্ষতি হয়নি।”

আলভী যেন কয়েক মুহূর্ত বুঝতেই পারলো না কথাটা। তারপর হঠাৎ হাঁপ ছেড়ে বাঁচার মতো শ্বাস নিলো সে। আলভী কম্পিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“অলির জ্ঞান ফিরেছে?”

“না, এখনো সেডেটেড। বিশ্রামে আছেন। কিন্তু ভয়ের কিছু নেই। আমরা ওকে অবজারভেশনে রাখবো। এই অবস্থায় মানসিক চাপ ওনার জন্য খুবই বিপজ্জনক।”

আলভী মৃদুস্বরে বলল,
“আমি কি ওর পাশে গিয়ে বসতে পারি?”

“পারবেন, তবে শান্ত থাকবেন।”
,

আলভী ধীর পায়ে ওয়ার্ডে ঢুকে অলির পাশে গিয়ে বসলো। অলির মুখে অক্সিজেন মাস্ক, হাতের শিরায় ক্যানুলা লাগানো, বুকটা ধীরে ধীরে উঠছে-নামছে। কিন্তু এতসবের মধ্যেও অলির মুখটা অদ্ভুত রকমের শান্ত। আলভী ধীরে ধীরে অলির কপালে হাত রাখে।
“আমি জানি তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু অলি আমি তোমাকে বলতে চাই যে তুমি একা নও। আমি আছি তো তোমার পাশে। সেই কথাটুকু বলার সুযোগটাও দিচ্ছোনা আমাকে। আচ্ছা অলি আমার কথা বাদই দিলাম। তুমি কি পারবেনা বাচ্চাটার কথা ভেবে নিজেকে একটু শক্ত করতে?”

আলভী ধীরে ধীরে অলির ডান হাতটা মুঠোয় নিয়ে একটা চুমু খেলো।
“প্লিজ অলি একটু শক্ত হও। আমি থাকবো তোমার পাশে প্রমিস। তুমি একা নও। একটু বিশ্বাস করো আমাকে।”

––

দুই ঘণ্টা পর অলি চোখ একটু একটু করে খুললো। তার দৃষ্টি ঘোলাটে,
“ম… মাহ…” তার ঠোঁট নড়ে উঠলো।

আলভী কান্না চেপে রেখে মৃদু স্বরে বলে,
“আমি আছি, এখানেই আছি অলি,”

অলি চোখ বন্ধ করে আবারও খুলল। তারপর আলভীর থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে পেটের উপর রেখে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আমা… আমার… বাবুটা?”

“আপাতত ভালো আছে। কিন্তু তোমার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছেনা যে বেবিটা বেশিক্ষণ ভালো থাকবে”

অলি চোখ বুজে ফেলে। একফোঁটা জল চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ যেতেই অলি ডান হাত দিয়ে নিজের অক্সিজেন মাক্সটা সরিয়ে ফেলে। আলভী বাধা দিতে চাইলে অলি ফিসফিসিয়ে বলে,
“শেষ বারের মতো… বাবা মাকে দেখতে চাই। প্লিজ আপনি আমাকে… তাদের কাছে নিয়ে যান”

আলভী অলির মাথায় হাত বুলিয়ে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে, আলভী অলিকে নিয়ে সেই হসপিটালেই এসেছে যেখানে আসমা বানুকে আনা হয়েছিলো। কিছুক্ষণ আগেই দিহানের সাথে আলভী দেখা করে এসেছে। গত তিন দিন ধরে তাদের লা*শ দুটো মর্গের ফ্রিজারে রাখা ছিলো। আইনি ঝামেলা মিটিয়ে দিহান ঘন্টাখানেক পূর্বেই অলির বাবা মায়ের লাশ নিয়ে গেছে। এদিকে বাড়ির উঠোনে আসমা বানু আর লিয়াকত হোসাইনের দেহ এসে পৌঁছায়। কাফনের কাপড় মোড়ানো দুটো নিথর দেহ উঠানে রাখা হয়েছে। আত্মীয়স্বজনদের কান্নায় বাড়ি এখন শোকের সমুদ্র।
,

বাবা মায়ের লাশের সামনে বসে আছে অলি। অলির অপেক্ষাতেই এতোক্ষণ যাবত সবাই বসে ছিলো। আলভী অলির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অলি একদৃষ্টিতে মা বাবার ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। বুকটা ফেটে যাচ্ছে অসহ্য যন্ত্রণায়। তবে তার গলা দিয়ে এখন আর কান্না বের হচ্ছেনা। যেন কান্না গুলোকে সে গলাতেই দাফন করে দিচ্ছে। আলভী অলির কাধে হাত রেখে বলল,
“কলিজা রে ওঠ প্লিজ। আব্বু আম্মুকে যেতে দে৷ ৩দিন ধরে তারা অনেক কষ্ট পেয়েছে আর কষ্ট দিসনা তাদের।”

অলি একবিন্দু নড়লোনা। সামির, দিহান আর ইয়াদ আলভীর পাশে এসে দাঁড়ালো। দিহান জিজ্ঞেস করলো,
“এটা তো অলিদের ভাড়া বাড়ি তাইনা? আন্টি আর আংকেল কে কোথায় দাফন করা হবে?”

আলভী কিছু বলতে যাবে তার আগেই অলি বলে ওঠে,
“এটা আমাদেরই বাড়ি। বাবা কিস্তিতে এই বাড়ির মূল্য পরিশোধ করছিলেন। আর বাকি টাকাগুলো ভবিষ্যতে আমি পরিশোধ করে দেবো। আপনারা আমার বাবা মাকে বাগানের পাশে শুইয়ে দিন। মা বাবা খুব ভালোবাসে জায়গাটা। প্রায়ই সকালে আর সন্ধ্যার আগে ফুলের গাছ গুলোতে পানি দিতেন। আমি চাইনা তাদেরকে এই বাড়ি থেকে বের করতে”

কথাগুলো বলতে বলতেই অলির গলা ধরে এলো। এর অনেকক্ষণ পরেও অলি বাবা মাকে ছেড়ে উঠে দাড়াতে রাজি হলোনা।
“ভাইয়া ভাবীকে নিয়ে যাও এখান থেকে। নইলে তার শরীর আবারও খারাপ করবে”

ইয়াদের কথা শুনে আলভী অলিকে টেনে তুললো। অলি প্রথমে উঠতে না চাইলেও আলভীর সাথে পেরে উঠলোনা। জোরাজুরি করার কারণে অলির শরীর ছেড়ে দিলো। ওড়নাটাও কাধ থেকে নিচে ঝুলে পড়লো। আলভী এবার একটু রেগে যায়। সে ওড়নাটা তুলে অলির মাথা সহ বুকের অংশ প্যাচিয়ে দেয়। অলি ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। আলভীর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর প্রচেষ্টায় সে ব্যার্থ হয়। আলভী আষ্টেপৃষ্টে অলিকে জড়িয়ে ধরে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যায়। অলির গলায় কান্না দলা পাকিয়ে আটকে আছে। যার জন্য মুখ ফুটে বলতেও পারছেনা,
“বাবা মায়ের কাছে আর একটু থাকতে দিন।”
আলভী অবশ্য অলির না বলা কথাগুলোও বুঝতে পেরেছে কিন্তু এখানে থাকলে অলির উপর আরও প্রেশার পড়বে। কোনো সন্তানই চোখের সামনে বাবা মায়ের লা*শ সহ্য করতে পারেনা। আলভী অলির রুমে এসে অলিকে বুকের সাথে চেপে ধরে বসে আছে। অলিও পাথরের মূর্তির ন্যায়ে একদৃষ্টিতে আলভীর পরনের পাঞ্জাবীর কারুকাজের দিকে তাকিয়ে আছে।

বাড়ির বাগানের পাশে প্রস্তুত করা হচ্ছে দাফনের জায়গা। ছোট ছোট গাছ, ফুলের গন্ধমাখা পরিবেশের মাঝে সেই স্থানটা যেন শান্তির আশ্রয় হয়ে উঠছে।
উসমান মির্জা দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে অপ্রকাশিত অভিব্যক্তি। তাঁর স্ত্রী শাহানাজ বেগম আর সেই বাড়ির প্রত্যেকে পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। দাদুমনি বাদে বাড়ির সবাই-ই এসেছেন। রহিম আহমেদ দুঃসংবাদ শুনে এলেও তার মূল উদ্দেশ্য ছিলো অলিদের বাড়িটা দেখে যাওয়া। সেও দেখতে চেয়েছে যে কোন ফ্যামিলির মেয়ের জন্য আলভী তাসনীম মির্জা তার মেয়ে রূপসাকে রিজেক্ট করেছিলো। তবে চারপাশের এই মধ্যবিত্ত আবহ, কান্না আর কষ্ট সবই যেন মূল্যহীন লাগছে তার কাছে।

শাহানাজ বেগম নিজেও বাড়িতে চলে যেতে চাইছেন। সে অবশ্য এই দুঃসময়ে এসেছেন সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে। আর আলভীর ভয়ে। সে নিজের ছেলেকে চেনেন, তারা এখানে না এলে আলভী তুলকালাম করে ফেলতো। নূরনাহার শাহানাজ বেগমের পাশে এসে দাড়ালেন,
“ভাবী সেদিন তুমি তাদের সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছিলে। তোমার নিশ্চয়ই সেই জন্য আফসোস হচ্ছে তাইনা? আমার না অনেক আফসোস হচ্ছে। তুমিই বলো এরকম টা হবে কেউ কখনো ভেবেছি? বউমার অবস্থা দেখে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমি গিয়েছিলাম ওর কাছে কিন্তু দেখলাম এভি বাবা আছে ওর কাছে, সেই জন্যই আর যাইনি। তোমার একবার বউমার কাছে যাওয়া উচিৎ ভাবী।”

শাহানাজ বেগম একটু বিরক্ত বোধ করলেও মুখে বললেন।
“তুমিই বরং যাও নূরনাহার। আমি এখানে এসেছি সেটাই তো অনেক। আর সেদিন আমি ভুল কিছু বলেছিলাম বলে মনে হয়না। তাদের মেয়েকে তারা সঠিক শিক্ষা দিতে পারেননি। এটা তাদের ব্যর্থতা। আমাদের সাথে তাদের কোনো শত্রুতা ছিলোনা কোনো কালেই। যদিও তাদের দুজনের মৃত্যুটা কারোরই কাম্য ছিলোনা। সত্যিই ঘটনাটা অত্যন্ত মর্মান্তিক। আমিও অনেক মর্মাহত কিন্তু তাদের মেয়ে যেভাবে আমার ছেলেকে ফাসিয়েছে, যেভাবে আমার ছেলেকে অন্ধ বানিয়ে রেখেছে আমি সত্যিই আর মেনে নিতে পারছিনা।”

শাহানাজ বেগমের বিষাক্ত কথাগুলো শুনে নূরনাহার ভীষণ ব্যথিত হলেন। এই পর্যায়েও তার এরূপ ব্যবহার সে মেনে নিতে পারলেন না।

বিকেলের আলো গোধূলির সোনালি ছায়ায় রূপ নিলো। বাড়ির উঠোনে তখনো কয়েকজন আত্মীয় স্বজন বসে আছে, কেউ কেউ বিদায় নিচ্ছেন। কবরের পাশে দুটো সাদা টিলা পড়ে আছে, সদ্য মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে। গন্ধ ছড়াচ্ছে ফুল, পানিতে ভিজে থাকা মাটি।
এই সময়েই শাহানাজ বেগম, ঊর্মিলা, রূপসা, ইয়াদ, নূরনাহার, রহিম আহমেদসহ অন্য আত্মীয়রা একে একে বিদায় নিচ্ছে। এই বাড়ির বিষাদময়তা যেন সবারই শ্বাস রুদ্ধ করে দিচ্ছে,
“ভাইয়া অলির খেয়াল রাখিস। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অলিকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসিস। এখানে থাকলে ভাবী স্বাভাবিক হতে পারবেনা” আলভীর উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে ঊর্মিলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়িতে উঠে যায়। আলভী মাথা নেড়ে তাদের বিদায় জানিয়ে বাড়ির ভেতরে ফিরে আসে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নামল।
বাড়িতে এখন শুধু অলি, আলভী, এবং অলির খালা আমেনা খাতুন তার দুই মেয়ে ইশা ও তিশা আছে। আলভীর পরিবার চলে যাওয়ায় বাড়ির ভেতরের পরিবেশ আরও নিঃসঙ্গ, আরও নীরব হয়ে উঠলো। অলিদের বাড়িতে দুটি রুম। একটায় অলি ও আলভী, আরেকটায় আমেনা খাতুন ও তার মেয়েরা থাকবেন।

রাতের খাওয়া দাওয়ার পর আলভী বলল,
“মামী, আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি অলির পাশে আছি,”

“আচ্ছা বাবা, আমরাও নামাজ পড়ে বিশ্রাম নিচ্ছি। ওকে নজরে রেখো।”

অলির দেহ নিথর, একটা বালিশে হেলান দিয়ে মূর্তির ন্যায়ে বসে আছে। আলভী শত চেষ্টা করেও অলিকে খাওয়াতে পারেনি। সে একটা শ্বাস ফেলে লাইট নিভিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে অলির পাশে এসে শুয়ে পড়লো। অলি তবুও নিস্তব্ধ। আলভী আলতো হাতে অলিকে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। ফিসফিসিয়ে বলে,
“কলিজা রে, একটু বোঝার চেষ্টা কর। আমি জানি তোর অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এমন করলে তো তুই নিজেও ম*রে যাবি। কেনো বুঝতে পারছিস না?”

অলি হঠাৎ করেই বলে ওঠে,
“মা এক্সিডেন্টে মা*রা গেলেও বাবার মৃ*ত্যুর জন্য আমিই দায়ী। আমি যদি তখন তার পাশে থাকতাম তাহলে হয়তো বাবা ধাক্কাটা সামলিয়ে উঠতে পারতেন”

“এভাবে নিজেকে দোষ দিওনা। তোমার কোনো দোষ নেই।”
অলি আর কোনো কথা বললোনা। আলভীর বুকেই ঘাপটি মে*রে রইলো।
,

রাত প্রায় তিনটা বাজে। চারদিকে নিঃসীম নীরবতা। হঠাৎ আলভীর ঘুম ভেঙে যায়, অন্ধকারের মাঝেই হাতরে দেখে বিছানার আরেকপাশ খালি। অলি নেই। গতরাতে না ঘুমানোর কারণে আলভীর চোখ লেগে গিয়েছিলো। আলভী তড়িঘড়ি করে উঠে দাড়ালো,
“অলি? অলি কোথায়?” আলভী অলিকে খুঁজতে খুঁজতে বাগানের সাইডে আসে। সে হসপিটাল থেকে ফেরার সময় এলার্জির ওষুধ এনেছিলো। যার জন্য সে একটু বেটার ফিল করছে। নইলে এতোক্ষণে তাকে নিয়েও হসপিটালে ছুটতে হতো। কঠিন আঁধারের মাঝে বাগানের পাশে বসে থাকা অলিকে নজরে এলো—সেদিক থেকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে।
আলভী এগিয়ে গিয়ে দেখে অলি মাটিতে বসে আছে। বাবার কবরের পাশে মাথা গুঁজে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে।
“মা… বাবা… আমাকেও নিয়ে যাও… আমি আর পারছি না…”

আলভীর পাজোড়া থেমে গেলো,
“তোমরা কিভাবে আমাকে ফেলে গেলে? একটিবারও ভাবলে না আমার কথা? আমিও যেতে চাই… আমাকেও সঙ্গে নাও… আমি পারছিনা। খুব কষ্ট হচ্ছে!”

অলি কবরের মাটি জড়িয়ে ধরে, যেন ঠান্ডা সেই মাটির মধ্যেই খুঁজে পাচ্ছে একটু উষ্ণতা। তার ওড়না পড়ে গেছে একপাশে, চুলগুলো এলোমেলো, মুখভর্তি কাদামাটি আর অশ্রু। আলভী একটু দূরে দাঁড়িয়ে সব দেখছে, কিন্তু এই অবস্থায় কিছু বলার শক্তি নেই তার। সে জানে, এই শোক, এই কান্নার ভাগ সে চাইলেও নিতে পারবে না। আলভী ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে অলির পাশে বসলো। অলির উদ্দেশ্যে বলল,
“কলিজা রে, এই অবস্থায় তোকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমার জানা নেই। শুধু এতটুকুই জেনে রাখ তুই চলে গেলে আমার অবস্থাও তোর মতোই হবে। তাই তুই যদি চলে যেতেই চাস, আমাকে রেখে যাসনা। আমাকেও তোর সাথে নিয়ে যাবি কেমন?”

অলি কোনো উত্তর দেয় না, শুধু কাঁদে। হঠাৎ করেই সে আলভীর দিকে ঘুরে তাকিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরলো। আলভীও আর অপেক্ষা না করে অলিকে কোলে তুলে ঘরের দিকে পা বাড়ায়।

চলবে,,,

#১৫_বছর_বয়সী_মা (৩৬)
#সোফিয়া_সাফা

ভোরের আলো ফুটেছে কিছুক্ষণ আগেই। হুট করেই অলির ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে পাশ ফিরে দেখে আলভী তার পাশে নেই। অলি পুনরায় চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়। কিছু সময় যেতেই সে ক্লান্ত শরীর টা নিয়ে উঠে বসে। মাথাটা ভারী ভারী লাগছে। অলি বিছানা থেকে নেমে জানালার পর্দাটা সরিয়ে দেখলো বাইরের প্রকৃতি এখনো অন্ধকার আচ্ছন্ন। অলি বুঝতে পারলো কিছুক্ষণ আগেই ফজরের আজান দিয়েছে। অলি নিজের রুম থেকে বেরিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর অজু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ আদায় করতে লাগলো। তার উচিৎ নামাজ পড়ে বাবা মায়ের জন্য দোয়া করা। কান্নাকাটি করে আর কি হবে? তার বাবা মা তো আর ফিরে আসবেনা। অলি নামাজ আদায় করে বেশ অনেকক্ষণ বাবা মায়ের জন্য দোয়া দুরুদ পড়লো। এরপর হঠাৎ করে আলভীর কথা মনে পড়লো।
“উনি এতো সকালে গেলেন কোথায়?”

অলি নিজের চোখজোড়া মুছে জায়নামাজ গুছিয়ে রাখলো তারপর ওড়নাটা আরো ভালো করে মাথায় প্যাচিয়ে রুম থেকে বের হলো। আমেনা খাতুন জায়নামাজে বসে গুনগুনিয়ে কান্না করছেন। অলি একটা শ্বাস ফেলে আলভীকে খুজতে লাগলো। কিন্তু আলভী ঘরে নেই। অলি কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা করে ঘর থেকে বেরিয়ে বাগানের সাইডে এলো। সে অবশ্য আশা করেনি যে আলভী এখানে থাকবে। একে তো ফুলে আলভীর এলার্জি তবুও অলি আনমনেই এখানে এসেছে। অলি বাগানের দিকে আসতেই থমকে গেলো। আলভী অলির বাবা মায়ের কবরের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। অলি কিছুটা এগিয়ে যেতেই আলভীর কথা শুনতে পায়,
“আম্মু আমাকে ক্ষমা করবেন। সেদিন আপনার সাথে আমি অনেক খারাপ বিহেভ করেছিলাম। আমি জানি আমার ব্যাবহারে আপনি অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন। আমার দূর্ভাগ্য যে আমি আপনার সামনে গিয়ে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ টুকুও পেলাম না। আফসোস থেকেই গেলো।”

আলভী একটু থামলো। তারপর আবারও বলতে লাগলো,
“অলি আপনাদেরকে অনেক ভালোবাসে। আমি বুঝতেই পারছিনা ওকে কিভাবে সামলাবো।”

আলভী একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল,
“ও আমাকেও যদি একটু ভালোবাসতো তাহলে হয়তো সামলাতে পারতাম কিন্তু…

কাধের উপর ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে আলভী হকচকিয়ে পেছনে ফিরে তাকায়।
“অভিযোগ করছেন আমার নামে?”

অলির ফ্যাকাশে মুখটা দেখে আলভীর বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। অলি ভ্রু কুচকে তার দিকেই তাকিয়ে আছে,
“অভিযোগ করছেন কেনো?”

আলভী একটা চাপা শ্বাস ফেলে বলল,
“আমি অভিযোগ করছিনা অলি। তুমি কালকে সারাটাদিন না খেয়ে আছো। তুমি এটাও ভুলে গেছো যে তুমি প্রেগন্যান্ট।”

অলি বুকের উপর হাত বেধে বলল,
“আমি নাহয় ভুলে গেছি কিন্তু আপনার যে ফুলে এলার্জি আছে সেটাও কি আপনি ভুলে গেছেন? কেনো এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছেন?”

আলভী আড়চোখে অলির দিকে তাকায়।
“আমি মেডিসিন খেয়েছি। আমার সমস্যা হচ্ছেনা।”

অলি আলভীর হাত ধরে বলল,
“ভেতরে চলুন”

আলভী মাথা নেড়ে অলির সাথে ঘরে ফিরে এলো। ৭ টা নাগাদ আলভী বাইরে বেরিয়ে যায় তারপর হোটেল থেকে খাবার নিয়ে আসে। এই অবস্থায় রান্না বান্না করার মতো কারোরই মন মানসিকতা নেই। ৮ টার দিকে সবাই খেতে বসলো। আমেনা খাতুন নিজহাতে অলিকে খাইয়ে দিচ্ছে। খাওয়ার মাঝেই আলভী বলল,
“মামী আপনি কি আগামী একসপ্তাহ আমাদের সাথে থাকতে পারবেন?”

আলভীর কথা শুনে আমেনা খাতুন বললেন,
“থাকতে হলে অবশ্যই থাকবো।”

ইশা মুখের খাবারটুকু গিলে বলল,
“কেনো ভাইয়া? তোমরা কি একসপ্তাহ এখানেই থাকবে নাকি?”

“হুম অলির পাসপোর্ট তৈরি করতেই ২-৩ দিন লাগবে। তারপর ভিসা অ্যাপ্লাই করবো, সাধারণত ৩-৫ দিনে হয়ে যাবে। মোট ৭ দিনেই সব প্রসেস শেষ করার চেষ্টা করবো।”

অলির পাসপোর্টের কথা শুনে ইশা, তিশাসহ আমেনা খাতুনও চমকে গেলেন। তিশা বলল,
“কি বলছো ভাইয়া? অলির পাসপোর্ট, ভিসা মানে কি?”

“হ্যাঁ আমি একসপ্তাহের মধ্যেই অলিকে নিয়ে দেশ ত্যাগ করবো। আর শোনো কথাটা আমি তোমাদের ৩ জনকে জানালাম। এর বাইরে কেউ যেন জানতে না পারে।”

ইশা জিজ্ঞেস করলো,
“কিন্তু তুমি অলিকে নিয়ে কোথায় যাবে?”

“আমি ওকে নিয়ে কোথায় যাবো সেটা আমি কাউকেই বলবোনা।”

কথাটা বলে আলভী একবার অলির দিকে তাকায়। অলির মাঝে কোনো ভাবাবেগ নেই। সে একদৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে।
কেটে যায় ৩ দিন। এই ৩ দিন আলভী অলির সাথেই ছিলো অফিস বা হসপিটালেও যায়নি। অলি আসরের নামাজ আদায় করে জায়নামাজ ভাজ করছিলো তখনই আলভী এসে বলে,
“নোমানের নানুকে সেফ জায়গায় সরিয়ে নেয়া হয়েছে।”

অলি আলভীর দিকে তাকায় কিন্তু মুখে কিছুই বলেনা। আলভী অলির দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“তোমার বার্থ সার্টিফিকেট টা দেও তো।”

অলি ছোট্ট করে জিজ্ঞেস করে,
“কেনো?”

“তোমার পাসপোর্ট করাতে লাগবে”

অলি কিছুক্ষণ আলভীর দিকে তাকিয়ে থেকে শান্তকন্ঠে বলল,
“আপনার কি মনে হয় দেশ ত্যাগ করলেই আমরা সেফ থাকবো?”

আলভী ভ্রু কুচকে বলল,
“দেখো অলি আমাদের যতদ্রুত সম্ভব এখান থেকে চলে যাওয়া উচিৎ। আমি সত্যিই আর রিস্ক নিতে চাইনা। জার্মানিতে আমাদের কোম্পানির ব্রাঞ্চ আছে আমরা সেখানেই যাবো।”

অলি কোনো প্রকার ভণিতা ছাড়াই বলল,
“আমি এখান থেকে যাবোনা। যতক্ষণ না পর্যন্ত দোষীদের শাস্তি দিতে পারছি, আমি কোত্থাও যাবোনা”

কথাগুলো বলেই অলি রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে আলভী অলির হাত ধরে ফেলে,
“অলি তুমি কেনো বুঝতে পারছোনা?”

“আমি কোনটা বুঝতে পারছিনা? আমি তো বুঝতেই পারছি আপনার মাঝে রিফাতকে খুঁজে বের করার কোনো ইচ্ছাই নেই। আপনি চান না তাদেরকে শাস্তি দিতে যাদের জন্য আমি শেষ সময়টাতেও আমার মায়ের পাশে থাকতে পারিনি। যাদের জন্য আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। আপনি আমাকে বলছেন তাদেরকে শাস্তি না দিয়েই পালিয়ে যেতে? আপনি পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কিভাবে নিতে পারেন?”

অলির কথাগুলো শুনে আলভী বিস্ফোরিত নয়নে অলির দিকেই তাকিয়ে রইলো। অলি নিজের হাত ছাড়িয়ে বলল,
“আপনি তাদেরকে এতোই ভয় পেলে একাই চলে যান। আমি যাচ্ছিনা আপনার সাথে। অনেক হিসেব নিকেশ বাকি আছে।”

আলভীর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। সে রিফাতকে ভয় পাচ্ছেনা সে ভয় পাচ্ছে অলির পরিস্থিতিকে।
“অলি তুমি বেবিটার কথাও ভাববে না? রিফাত যদি কোনো ভাবে তোমার ক্ষতি করতে সক্ষম হয়ে যায় তখন? সব চাইতে ঝুকিতে কিন্তু বেবিটাই আছে”

“আমি ওকে সামলে রাখতে পারবো। মা বলতো মা-ই নাকি সন্তানদের সবচাইতে বড় রক্ষক। আমিও আমার সন্তানের রক্ষক হবো। বেবিটা আমার দূর্বলতা নয়। ওকে আমার দূর্বলতা ভাববেন না। ও আমার শক্তি, আমি শুধু ওর জন্যই বেচে আছি।”

আলভী ফোস করে একটা শ্বাস ফেলল,
“তার মানে তুমি দেশের বাইরে যাবেনা?”

“নাহ”

আলভী এবার ভীষণ বিরক্ত হলো,
“তাহলে কোথায় থাকবে তুমি? এই বাড়িতে থাকবে? দেখো আমি কিন্তু পারবোনা সব কাজ কাম বাদ দিয়ে তোমাকে গার্ড করতে”

কথাটা শুনে অলি রাগী চোখে আলভীর দিকে তাকায়। আলভী না চাইতেও কিছুটা ঘাবড়ে গেলো। সে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো,
“আপনাকে তো বলিনি আমাকে গার্ড করতে। আপনি আমাকে গার্ড করছেন কেনো সেটাই তো বুঝতে পারছিনা। আর সত্যি বলতে আপনার জন্যই আমি আর বেবি বিপদে আছি। ওই রিফাত তো আপনাকে কিছুই করবেনা। কারণ আপনাকে সে দ্বিতীয় বিয়ে করাবে। আমাকে বিয়ে করার সময় তাকে দাওয়াত দেননি হয়তো সেটা নিয়েই তার মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে। সেই জন্যই হয়তো আপনাকে আবারও বিয়ে করাতে চাইছে।”

অলির কথা শুনে আলভী অবাক চোখে অলির দিকে তাকায়। রাগে অলির শরীর রীতিমতো কাপছে।
“তুমি ঠিক কি বলতে চাইছো? তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি দ্বিতীয় বিয়ে না করে ভুল করে ফেলছি। আমার কি দ্বিতীয় বিয়ে করে নেওয়া উচিৎ? তাহলে কি তুমি আর বেবি বিপদমুক্ত হয়ে যাবে?”

কথাটা শুনে অলি রাগে লাল হয়ে যায়। দাতে দাত চেপে বলে,
“হুম যান। বিয়ে করুন গিয়ে। এক্ষুনি বের হোন আমাদের বাড়ি থেকে। আর এবার বিয়ে করলে ওই রিফাতের বাচ্চাকেই আগে দাওয়াত দেবেন।”

কথাটা বলেই অলি আলভীকে ধাক্কাতে লাগলো। কিন্তু আলভীকে একটুও নাড়াতে পারলোনা। কিছুক্ষণ যেতেই অলি বুঝতে পারলো এই খাম্বাকে সে সরাতে পারবেনা। এতে করে অলির রাগ আরও বেশিই বেড়ে যায়। সে ফ্লোরে বসে পড়লো।
“মাহহহ বাবাহহহ কোথায় তোমরা?”

কথাটা বলেই অলি কান্না করতে লাগলো। এতোক্ষণ রেগেমেগে স্ট্যাচু হয়ে দাড়িয়ে থাকলেও। এবার অলির কান্নায় আলভী মাথা নিচু করে অলির দিকে তাকায়। অলি খাটের সাথে মুখ ঠেকিয়ে কান্না করছে। কান্নার তোড়ে ছোট্ট শরীর টাও ক্ষণে ক্ষণে কেপে উঠছে। আলভী চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকায়। সে বুঝে উঠতেই পারছেনা যে এই মেয়েকে সে কিভাবে সামলাবে। ৪ মাসের প্রেগন্যান্সিতেই এতো মুড সুইং। এর পরে যে কি হবে আল্লাহ জানেন। আলভী একহাতে অলিকে টেনে কোলে তুলে নিলো। অলি নামার চেষ্টায় ছটফট করছে কিন্তু নামতে পারছেনা।
“কাদছো কেনো বলবে?”

“আপনি খুব খারাপ”

আলভী একটা শ্বাস ফেলে অলিকে খাটে বসিয়ে দিয়ে বললো,
“তুমি কি এখানেই থাকতে চাইছো?”

অলি না বোধক মাথা নাড়ায়,
“আমি আপনাদের বাড়িতে যেতে চাই। আমি সেখানেই থাকবো”

অলির কথা যেন আলভী কিছুতেই মেনে নিতে পারলোনা,
“তুমি পাগল হয়ে গেছো?”

অলি নিজের চোখজোড়া মুছে বলল,
“আমি বলেছিলাম না যে রিফাতের সাথে আরও একজন আছে?”

আলভী হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে,
“আমি সিওর যে সেই লোকটা আপনার ফ্যামিলির কেউই ছিলো। বা আপনার ফ্যামিলির কেউই সেই লোকটাকে দিয়ে কাজ করাচ্ছে”

কথাটা শুনে আলভী হতবাক হয়ে যায়।
“এসব তুমি কি বলছো? মানলাম আমার ফ্যামিলির অনেকেই তোমাকে দেখতে পারেনা তাই বলে আমাকে দ্বিতীয় বিয়ে করানোর জন্য তোমাকে বা বেবিকে মে*রে ফেলতে চাইবে এই ভাবনাটা একটু বেশি বেশিই হয়ে গেলোনা?”

অলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“রিফাত আমাকে যেই ডিভোর্স কাগজে সাইন করতে বলেছিলো সেই ডিভোর্স কাগজটা আপনাদের বাড়ি থেকেই পাঠানো হয়েছিলো”

“হোয়াট?”

অলি উপরনিচ মাথা নেড়ে বলল,
“হুম, নোমান ভাইয়া কাগজটা আপনাদের বাড়ির দাড়োয়ানের থেকেই নিয়েছিলো। আমি নিশ্চিত ওই বাড়িতেই আসল রহস্য লুকিয়ে আছে। আমি যদি এভাবে তাদের ভয়ে পালিয়ে যাই তাহলে তো তারা জিতেই যাবে। তাছাড়া শত্রু যেহেতু আপনজনের মধ্যেই আছে সেহেতু আমি চাঁন্দে চলে গেলেও সেফ থাকতে পারবোনা। তারা আমাকে মা*রার চেষ্টা করেই যাবে। তার চেয়ে আমাদের উচিৎ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শত্রুকে খুঁজে বের করা”

আলভী কি বলবে ভেবে পেলোনা। অলি আবারও বলে উঠলো,
“আচ্ছা আপনি এটা একবারও ভেবেছেন? বাবা মা মা*রা যাওয়ার পরেও হসপিটালের কেউ তাদের আত্মীয়দের খুঁজে বের করার চেষ্টা করেনি কেনো? বাবার সাথে তো ফোন ছিলো। সেই ফোনটাই বা গেলো কোথায়? রাবেয়া আন্টিই বা এভাবে হাওয়া হয়ে গেলো কেনো? একবারও ভেবে দেখেছেন?”

অলির কথাগুলো আলভী আরও আগেই ভেবেছে, তার মনেও এসব নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে কিন্তু সে শুধু অলি আর বেবিকে সুরক্ষিত রাখার ব্যাপারেই বেশি ফোকাস করতে চেয়েছে।
“আমি এখনো মানতে পারছিনা যে এসবের পেছনে আমার বাড়ির কেউ থাকতে পারে।”

“কিন্তু আমি নিশ্চিত এই ব্যাপারে।”

“তাহলে কি তুমি ওই বাড়িতেই ফিরে যেতে চাইছো?”

অলি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে,
“আমিও দেখতে চাই যে এসবের পেছনে কে আছে।”

অলিকে এভাবে শক্ত হতে দেখে আলভীর ভালো লাগলো। সে অবশ্য অলিকে নিয়ে অনেক চিন্তায় ছিলো সেই জন্যই দেশ ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু এখন সেও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খুঁজে বের করবে যে এসবের পেছনে রিফাতের সাথে সাথে আর কে কে আছে।
“আচ্ছা তাহলে ব্যাগ প্যাক করে নেও। আগামী কালকেই আমরা বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি।”

–—

আলভীর সাথে অলিকে বাড়ির চৌকাঠে পা রাখতে দেখে শাহানাজ বেগম মুখ বাকিয়ে এগিয়ে এলেন। ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,
“বাবাহ তুই এই মেয়েটাকে ঘাড় থেকে আর নামাতেই পারলিনা?”

“ভালো করে তাকিয়ে দেখো মা। ও আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, আমার ঘাড়ে চড়ে নেই। তোমার কি দৃষ্টি শক্তিতে সমস্যা হয়েছে? দেখো সমস্যা হলে বলো। আমি চাইনা তুমি নাতি নাতনির মুখ দেখার আগেই অন্ধ হয়ে যাও।”

ছেলের মুখ থেকে এই সমস্ত কথা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না শাহানাজ বেগম। আলভীর কথাগুলো শুনে রুনা খাতুন বললেন,
“এভি বাবা তুমি মায়ের সাথে এভাবে কথা বলছো কেনো? তুমি হয়তো শ্বশুর শাশুড়ীর শোকে বউয়ের সব অপকর্ম ভুলে গিয়েছো। তাই বলে কি আমরা বাড়ির সবাইও ভুলে গেছি?”

রুনা খাতুনের কথা শুনে অলি তার দিকে শান্ত চাহনি নিক্ষেপ করলো। সে ফিরেই এসেছে এদের ইটের জবাব পাথর দিয়ে দিতে।
“ফুপিমণি, আপনি আমার কোন অপকর্মের কথা বলতে চাইছেন? আমি বুঝতে পারলাম না।”

অলির মুখ থেকে প্রথমবারের মতো কথাটা শুনে রুনা খাতুন ভীষণ চটে গেলেন। অলি আবারও বলে ওঠে,
“আপনার হয়তো আমার অপকর্মের কথা মনে করতে একটু সময় লাগবে? আচ্ছা আপনি সময় নিন না। আমি তো এই বাড়িতেই আছি। আপনার যখন মনে পড়বে তখন আমাদের সবাইকে ডাক দিবেন আমরা সবাই আপনার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবো কেমন? এখন আমি অনেক ক্লান্ত, সরুন দেখি”

কথাটা বলেই রুনা খাতুনকে পাশ কাটিয়ে অলি চলে গেলো। এদিকে আলভী থাকায় অলিকে কেউ বেশি কিছু বলতেও পারলোনা। আলভী আড়চোখে একবার উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে অলির পিছুপিছু চলে যায়।
নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে আলভী অলির উদ্দেশ্যে বলে,
“আলাদা রুমে থাকবে নাকি? থাকতে চাইলে থাকতে পারো। আমার কোনো প্রবলেম নেই”

আলভীর কথা শুনে অলি চোখ কটমট করে তাকায়। আলভী এভাবে তাকানোর কারণ টা খুঁজে না পেয়ে বলে,
“এভাবে তাকাচ্ছো কেনো? আমি তো…

“আপনি তো কি হুম? ওহ বুঝেছি আমি থাকলে ওসব আজেবাজে জিনিস গিলতে পারবেন না তাই আমাকে অন্য রুমে থাকতে বলছেন তাইনা?”

“মানে? কিসব আজেবাজে জিনিসের কথা বলছো?”

“ওইযে হারাম জিনিস গুলো। যেগুলো খেলে নে*শা হয়।”

অলির কথা বলার ধরন দেখে আলভী সরু চোখে অলির দিকে তাকায়। মেয়েটার মেজাজ ইদানীং একদম নাকের ডগায় থাকে।
“এভাবে না বললেও পারতে।”

“হারাম জিনিসকে হারাম বলেছি। এর থেকে ভালো করে আবার কিভাবে বলবো?”

আলভীর মুখটা চুপসে গেলো,
“আমি ওসব খাইনা”

“মিথ্যাবাদী”

আলভী অলির দিকে তাকিয়ে বলল,
“এভাবে কথা বলবেনা।”

“একশোবার বলবো। কি করবেন?”

আলভী একটা চাপা শ্বাস ফেলল,
“কিছুই করবোনা।”

আলভী নিজের রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। তার পিছুপিছু অলিও ঢুকলো। আলভী ব্যাগপত্র খাটের উপরে রেখে কাভার্ডের দিকে যেতে যেতেই বলল,
“ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিও। আমাকে একটু অফিসেও যেতে হবে”

অলি ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হিজাবের পিন খুলতে খুলতে বলল,
“আসবেন কখন?”

আলভী কাভার্ড থেকে টাওয়াল বের করে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,
“আজকে আসতে দেরি হবে। অনেক কাজ জমে আছে।”

আলভী ওয়াশরুমে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর দরজায় কেউ কড়া নাড়লো। অলি বোরকা টা ঝুড়ির মধ্যে রেখে মাথায় ওড়না টেনে ধীরপায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দরজা খুলে রূপসাকে কফির মগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অলি খানিকটা থমকে যায়। এদিকে অলিকে আলভীর রুমে দেখে রূপসা বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো। আনমনেই বলে উঠলো,
“তুমি এই রুমে?”

অলি ভ্রু কুচকে বলল,
“হু, আমি এখানে। কেনো?”

“এভি কোথায়?”

রূপসার কথা শুনে অলি দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রূপসাকে উপরনিচ পরখ করে বললো,
“আপু আপনি যে বয়সে আমার স্বামীর থেকে বড় হন সেটা আমি আজকে জানলাম।”

অলির কথা শুনে ভীষণ অবাক হয়ে যায় রূপসা।
“এই মেয়ে, কি বললে তুমি?”

“ভুল কিছু বললাম নাকি? এইযে আপনি আমার স্বামীর নাম ধরে ডাকছেন। এর মানে নিশ্চয়ই আপনি আমার স্বামীর থেকে বড় হন তাইনা?”

রূপসা কিছু বলতে যাবে এরই মাঝে আলভী ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। আলভীর পরণে শুধু মাত্র একটা টাওয়াল। অলি আলভীকে খেয়াল না করলেও রূপসা আলভীকে খেয়াল করেছে। রূপসাকে একভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অলি তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আলভীর দিকে তাকাতেই থমকে যায়।
“আহহহ”

অলির চিৎকারে আলভী দরজার দিকে তাকায়। রূপসাও ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। রূপসা কিছু বুঝে ওঠার আগেই অলি ধাম করে দরজা টা লাগিয়ে দেয়।

চলবে,,,

শব্দসংখ্যা- ২১৫০+