১৫ বছর বয়সী মা পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0
25

#১৫_বছর_বয়সী_মা (৩৭)
#সোফিয়া_সাফা

মুখের উপর এভাবে দরজা লাগিয়ে দেয়ায় রূপসা ভীষণ রেগে যায়। সেই সাথে তার খারাপও লাগছে। অলি এখন থেকে আলভীর রুমে থাকবে ভাবতেই হাত পা কাপছে। রূপসা কফির মগটা নিয়েই নিজের রুমে ফিরে আসে। কান্না পাচ্ছে, কফির মগটা টেবিলের উপর রেখে সে ডুকরে কেদে উঠলো,
“আর পারছিনা সহ্য করতে”

“রূপাপু ইয়াদ ভাইয়া অপেক্ষা করছে। তারাতাড়ি চলো, নইলে ভাইয়া কিন্তু আমাদেরকে রেখেই চলে যাবে”

ঊর্মিলার কথায় রূপসা চোখজোড়া মুছে ব্যাগটা কাধে তুলে নিলো। ফোনটা হাতে নিতেই তার ফোনে একটা ছোট্ট ম্যাসেজ আসে। রূপসা ম্যাসেজটা ওপেন করলো,
—মাঝে মাঝে একটু ধৈর্য্য রাখতে হয়। নইলে পরিস্থিতি আরও বেশি হাতের বাইরে চলে যায়। তোমাকে বিয়ে করতে এভিকে বাধ্য করাই যায়। তাতে কি হবে? তুমি কি পারবে ওর সাথে শান্তিতে সংসার করতে? পারবেনা। সেরকম করলে এভি তোমাকে ঘৃণা করবে। তার চেয়ে আরও কয়েকটা দিন ধৈর্য্য ধরো। আপাতত অলির সাথে বা আলভীর সাথে ভালো ব্যবহার করো যেনো তোমাকে কোনোভাবেই কেউ সন্দেহ না করে।

ম্যাসেজটা দেখে রূপসা মুখ বাকায়। সে জানেনা লোকটা কি করতে চাইছে। কিন্তু সে সত্যিই আর সহ্য করতে পারছেনা। রূপসা সব ভাবনা সাইডে রেখে ঊর্মিলার দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসলো তারপর ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো।
,

আলভী ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল সেট করছে। অলি সেই তখন থেকেই চুপচাপ বিছানার এককোনায় বসে আছে। তখন অলির চিৎকার দেওয়ার কারণ টা আলভী এখন অবধি বুঝে উঠতে পারেনি।
“আমি যাওয়ার সময় খাবার পাঠিয়ে দেবো। খেয়ে নিও”

অলি কোনো উত্তর দিলোনা। আলভী একটা শ্বাস ফেলে অলির দিকে এগিয়ে যায়,
“কি হলো? কিছু বলছোনা কেনো?”

অলি একবার আলভীকে পা হতে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করলো। আলভী একদম স্যুট-কোট পড়ে অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে গেছে। অলি বিরবির করে বলল,
“সব দেখে নিয়েছে হয়তো”

অলির কথাগুলো আলভী শুনতে পেয়েছে। তবে বুঝতে পারেনি,
“সব দেখে নিয়েছে মানে কি?”

অলি একটা বিরক্তি সূচক শব্দ উচ্চারণ করে বলল,
“আমি না থাকলে আপনার সবকিছুই আজকে রূপসা আপু দেখে নিতো।”

আলভী সরু চোখে অলির দিকে তাকায়,
“তখন রূপ এসেছিলো? কেনো এসেছিলো?”

“রূপ বলছেন কেনো? আপু বলুন”

অলির কথা শুনে আলভীর মেজাজ খারাপ হলেও শান্তকন্ঠে বলল,
“ও আমার থেকে ৫ বছরের ছোটো ওকে আপু ডাকতে যাবো কোন দুঃখে?”

অলি চোখ পাকিয়ে বলল,
“উনি আপনার ছোটো হলে, আপনাকে নাম ধরে ডাকছিলো কেনো?”

“নাম ধরে ডেকেছে কারণ ও একটা বেয়াদব।”

“উনি বেয়াদব নয়। আমার মনে হয় উনি আপনার মুখ থেকে আপু ডাক শুনতে চায়। সেই জন্যই আপনি আজকে থেকে ওনাকে আপু বলেই ডাকবেন”

আলভী আড়চোখে অলির দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে উচ্চারণ করলো,
“নো ওয়ে”

“আপনি হয় ওনাকে আপু বলে ডাকবেন আর নয়তো আমি আজকে থেকে আপনাকে ভাইয়া বলে ডাকবো”

অলির কথা শুনে আলভী চোখ বড়বড় করে অলির দিকে তাকায়। এদিকে অলির চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে অলি ভীষণ রেগে আছে। রাগে নাকের ডগাটা পর্যন্ত লাল হয়ে গেছে। ঠোঁট জোড়াও তিরতির করে কাপছে। আলভী মৃদু স্বরে বলল,
“তুমি একবার আমাকে ভাইয়া ডেকেই দেখোনা।”

অলি রাগে ফুসতে ফুসতে বলে,
“ডাকলে কি করবেন আপনি?”

“যেটা একজন স্বামীর করা উচিৎ সেটাই করবো। আর সেটা করার পর তুমি হয়তো ‘ভাইয়া’ নামক শব্দটাই ভুলে যাবে”

আলভী কথাগুলো হুমকির স্বরেই বলেছে। আলভীর কথা শুনে অলির রাগ মূহুর্তেই পানি হয়ে যায়। সে একটা শুষ্ক ঢোক গিলে অন্যদিকে তাকায়,
“তুমি চাইলে আমি এখনই তোমাকে সেটার ট্রেইলার বা টিজার দেখাতে পারি, দেখতে চাও?”

অলি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“আপনার হয়তো দেরি হয়ে যাচ্ছে। আপনার অফিসে যাওয়া উচিৎ”

কথাটা বলার সাথে সাথেই আলভী ধপ করে অলির পাশেই বসে পড়ে। অলি রিয়েক্ট করার আগেই আলভী অলির চুলে হাত ডুবিয়ে অলিকে নিজের কাছে টেনে নেয়,
“আমি চাই তুমি আমাকে একবার ভাইয়া বলে ডেকে আমাকে ভীষণ ভাবে রাগিয়ে দেও। তারপর আমি তোমাকে সেটার জন্য শাস্তি দেওয়ার সুযোগ পেয়ে যাই। দয়া করে একবার ডাকো”

আলভীর কথাগুলো শুনে অলির শরীর অবশ হয়ে এলো। সে ঠোঁট চেপে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। অলিকে লজ্জা পেতে দেখে আলভী আরও ডেস্পারেট হয়ে যায়। সে যেই না নিজের শুষ্ক ঠোঁট দ্বারা অলির ভেজা ঠোঁটে চুমু দিতে যাবে ঠিক তখনই অলি ডান দিকে ঘুরে যায়। যার ফলে চুমুটা গিয়ে অলির বাম গালে পড়ে। আলভী হতাশ হয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। কিছুক্ষণ পর অলিকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। এদিকে অলির ইচ্ছা করছে এই মূহুর্তে এখান থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতে। আলভী রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে অলি রিনরিনে গলায় বলে ওঠে,
“তারাতাড়ি ফিরবেন। আমার একা একা ভালো লাগবেনা। তাছাড়া আপনার কাছে তো ফোনও নেই”

আলভী একটা শ্বাস ফেলে অলির দিকে তাকায়,
“ফোন কিনবো ভাবছি তবে যদি তুমি চাও তবেই কিনবো”

আলভীর কথার মানে অলি বুঝে উঠতে পারলোনা।
“অবশ্যই আমি চাই আপনি ফোন কিনে নিন। নয়তো আমার দরকার হলে আমি আপনাকে কল করবো কিভাবে?”

আলভী অলির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি সত্যিই চাও?”

“আজব মিথ্যা বলবো কেনো?”

আলভী ২পা এগিয়ে এসে বলে,
“তুমি জানো আমি কেনো ফোন কিনি নি?”

অলি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়,
“আমি কিভাবে জানবো?”

“আমার মন মেজাজ প্রায় সময়েই খারাপ হয়ে যায় আর তেমনটা হলে আমি সর্বপ্রথম ফোনটাই আছাড় মা*রি। বলতে পারো এটা আমার বদ-অভ্যাস। আর ইদানীং আমার মন মেজাজ একটু বেশিই খারাপ থাকে। এই যে একটু আগে তুমি যেটা করলে আমি তো আর তোমাকে তুলে আছাড় মা*রতে পারবোনা কিন্তু ফোনটা থাকলে এতক্ষণে…..

“আমি কি করেছি? আপনিই তো আমার গালে চুমু দিলেন। আমার দোষ কি?”

“তুমি ছটফট করছিলে কেনো? যেদিন তুমি এই ছটফট করা বন্ধ করবে সেদিনই আমি ফোন কিনবো। কারণ তার আগে বেশিরভাগ সময়েই আমার মন মেজাজ খারাপ থাকবে।”

অলি অবাক চোখে আলভীর দিকে তাকায়,
“আমি ছটফট করবোনা তো কি করবো? আপনি ওভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন কেনো? আর আমার গালে চুমু দিলেনই বা কেনো? আপনি আমার থেকে দুরত্ব বজায় রাখলে কি আমি কখনো ছটফট করি?”

আলভীর মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কানজোড়া দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে,
“তোমার দিকে তাকাবো নাতো কি অন্য মেয়ের দিকে তাকাবো? আমি অন্য মেয়ের দিকে তাকালে তোমার অনেক ভালো লাগবে তাইনা? আর লিসেন আমি তোমার ‘গালে’ কিস করতে চাইনি। আমি তো…

আলভী আর কিছুই বলতে পারলোনা। অলি অদ্ভুত চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
“আপনি কি সেই রাতের মতো উল্টো পাল্টা কিছু খেয়েছেন নাকি?”

“কোনরাতের মতো?”

“তিশা আপুর মেহেন্দির রাতের মতো?”

অলির কথা শুনে আলভী নিজের চুল খামচে ধরলো।
“নাহ আমি কিছুই খাইনি। আর খেয়ে থাকলেও তোমার কাছে আর যাবোনা। সেই ব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্ত থাকো”

অলি বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায় আলভীর দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“তাহলে কোথায় যাবেন?”

“যেখানেই যাইনা কেনো, তাতে তোমার কি? তোমার কাছে না গেলেই তো হলো। আর আমি সেদিনও তোমার কাছে যাইনি। তুমি নিজে থেকেই আমার রুমে এসে আটকে পরেছিলে।”

আলভীর কথা গুলো শুনে অলি স্তব্ধ হয়ে যায়। আলভীও আর কিছু না বলেই ধুপধাপ পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
,

বিকেলের দিকে সূর্যের আলো মলিন হয়ে এসেছে। অলি ব্যালকনিতে থাকা চেয়ারের উপর বসে বাবা মায়ের কথা মনে করে কাদতে কাদতেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলো। হঠাৎ করে সে ঘুমের ঘোরেই অদ্ভুত কিছু অনুভব করে ধরফরিয়ে উঠে বসে। অলি মাথা চেপে ধরে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। কিছুক্ষণ যেতেই সে একটু স্বাভাবিক হয়। অলি কাপা কাপা হাতটা নিজের পেটের উপর রাখতেই তার চোখ দুটো চিকচিক করে উঠলো। সে ঘুমের মাঝেই পেটের মধ্যে সূক্ষ্ম নড়াচড়া অনুভব করেছে। অলি বেশ কিছুক্ষণ সেভাবেই বসে থেকে রুমে ছুটে এলো। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে পেটের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু তার পেট ততোটাও দৃশ্যমান নয়। তাকে প্রথমবার দেখলে কেউ বুঝতেই পারবেনা যে সে প্রেগন্যান্ট। অলি পুনরায় পেটের উপর হাত রেখে বলল,
“আজ প্রথমবারের মতো তোর অস্তিত্ব অনুভব করলাম। প্রথমবার মনে হলো তুই সত্যিই আমার মাঝে আছিস। আমি তোর জন্য একটা নাম ঠিক করেছি। শুনবি?”

অলি হাল্কা হাসলো তার চোখে পানি কিন্তু ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা।
“আ…লো। তুই আমার আলো।”

অলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“আমি জানিনা তুই ছেলে নাকি মেয়ে। কিন্তু আমি তোকে আলো বলেই ডাকবো বুঝলি? তবে তুই যদি ছেলে হোস তাহলে তোর ভালো নাম হবে আরিশ। আর যদি তুই মেয়ে হোস তাহলে তোর ভালো নাম হবে আরশি।”

অলির ভাবনার মাঝেই দরজায় কেউ নক করলো। অলি আয়নায় থাকা নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে রইলো। দরজা খুলবে নাকি খুলবেনা সেটাই ভাবছে। অলি পা টিপেটিপে দরজা খানিকটা খুলে বাইরে উঁকি দিতেই দেখলো ঊর্মিলা আর রূপসা দাঁড়িয়ে আছে। ঊর্মিলাকে দেখে অলি দরজা খুলে দিয়ে সাইড হয়ে দাড়ালো। ঊর্মিলার সাথে রূপসাও রুমের ভেতরে চলে এলো। অলি ভালো করে তাকিয়ে দেখলো ঊর্মিলার হাতে একটা আচারের বাটি,
“অলি এদিকে এসো। দেখো তোমার জন্য কি এনেছি”

আচার দেখে অলি বড় বড় পা ফেলে ঊর্মিলার পাশে গিয়ে বসলো। ঊর্মিলা হাতে থাকা বাটিটা অলির কোলের উপর রেখে বললো,
“আমের আচার, ফুপি বানিয়েছে। খেয়ে দেখো অনেক মজা।”

আচার দেখে অলির জিভে জল চলে এলো। এমনিতেই সে টক আর ঝাল খেতে অনেক ভালোবাসে। তার উপর এখন যেনো আরও বেশিই খেতে ইচ্ছা করছে। তবে ফুপি বানিয়েছে শুনে অলি কিছুটা দমে যায়।
“এগুলো ফুপিমণি বানিয়েছেন?”

ঊর্মিলা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে। অলি কয়েকটা ঢোক গিলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলল। ঊর্মিলা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
“খাচ্ছোনা কেনো? আমি আরও ভাবলাম আচার দেখে তুমি হামলে পড়বে।”

“না আপি আসলে আমার শরীর টা ভালো নেই। তোমার ভাই আমাকে ভাত পানি ছাড়া অন্য কিছু খেতে নিষেধ করেছে।”

“বাহঃ তুমি তো দেখছি এভির কথা অনেক মানো। তো এভিই কি তোমাকে সারাদিন দরজা আটকে বসে থাকতে বলেছে?”

রূপসার কথা শুনে অলি চোখ কটমট করে রূপসার দিকে তাকায় তারপর হঠাৎ করেই মেকি হেসে বলে।
“কি যে বলোনা রূপসা। আসলে আমি একটু বেশিই সুন্দরী তো সেই জন্যই হয়তো লোকে আমার উপর অনেক বেশিই নজর দেয়। সেই জন্যই তো আমি নিজে থেকেই ঘরবন্দী হয়ে আছি।”

অলির কথা শুনে রূপসা বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়,
“অলি, তোমার এতো বড় সাহস তুমি আমাকে নাম ধরে সম্মোধন করলে?”

অলি উত্তর না দিয়ে বাকা হাসলো। ঊর্মিলাও কপাল কুচকে বলল,
“অলি তুমি রূপাপু কে নাম ধরে বললে কেনো? ও তোমার থেকে বয়সে অনেক বড়।”

“ঊর্মি আপু। সে বারবার তোমার ভাইয়ের নাম ধরে ডাকছে সেটা তুমি শুনতে পাচ্ছোনা? তোমার ভাই কি তার ছোটো?”

অলির কথা শুনে ঊর্মিলা রূপসার দিকে তাকিয়ে বলে,
“হ্যাঁ আমিও এটা লক্ষ্য করেছি। রূপাপু তুমি কেনো ভাইয়ার নাম ধরে ডাকো? আগে তো এরকম করতেনা।”

রূপসার অনেক রাগ উঠলেও নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই বলে,
“শোনো ঊর্মি এভি আমার আপন ভাই নয়। তাছাড়া এটা তুমি জানতে নিশ্চয়ই যে তার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। সেই ক্ষেত্রে তাকে ভাই বলে ডাকাটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়”

“তুমি ঠিক কি বলতে চাইছো?”

অলির কথা শুনে রূপসা আবারও বলে ওঠে,
“আমি বলতে চাইছি যে খুব শীঘ্রই এভি তোমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেবে। তারপর আমিই এভির বউ হবো।”

রূপসার কথা শুনে অলি হেসে উঠলো,
“এই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। আমি ম*রে গেলেও আমার স্বামী তোমাকে বিয়ে করবেনা।”

রূপসা কিছু বলতে চাইলে ঊর্মিলা তাকে থামিয়ে বলে,
“আপু চুপ করো প্লিজ।”

রূপসা বলে ওঠে,
“ঊর্মি আমি বুঝতেই পারছিনা যে এতোকিছু জানার পরেও তুমি কি করে এই মেয়েটাকে সাপোর্ট করতে পারো?”

ঊর্মিলা একবার অলির দিকে তাকায় তারপর বলে,
“আমি শুধু জানি ভাইয়া অলিকে ভালোবাসে। তাই সেসব নিয়ে যদি তার কোনো প্রবলেম না থাকে। আমার প্রবলেম কেনো হবে? আমি শুধু চাই আমার ভাই ভালো থাকুক।”

রূপসা ঊর্মিলার কথায় আরও রেগে যায়। হনহন করে বেরিয়ে যেতে নিলে অলি পেছন থেকে বলে ওঠে,
“আমার স্বামীকে আর একবারও নাম ধরে ডাকবেনা। আর নাতো আমাকে ডাকবে। সে তোমার ভাই হয় তাই ভাইয়া বলেই ডাকবে আর আমাকেও আজকের পর থেকে ভাবী বলে ডাকতে শেখো”

“ডাকবোনা কি করবে তুমি?”

“বেশি কিছুনা তুমি না ডাকলে আমার স্বামী তোমাকে আপু বলে ডাকবে। আর আমি তোমাকে নাম ধরে ডাকবো।”

অলির কথা শুনে রূপসা রেগেমেগে অলির দিকে তেড়ে আসলো। অলির গায়ে হাত তুলতে যাবে তখনই অলি বলে ওঠে,
“তোমার এভি ভাই রুমে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছে। তোমার সব কর্মকান্ডই সে হয়তো বসে বসে দেখছে। আমার গায়ে হাত তোলার মতো ভুল ভুলেও কোরোনা। তাহলে কিন্তু তোমার হাত আর হাতের জায়গায় থাকবেনা।”

অলির কথা শুনে রূপসা মুখ ঝামটা মে*রে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। এদিকে অলির এরকম রূপ দেখে ঊর্মিলা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
“অলি তুমি আপুকে এগুলো কি বললে?”

অলি একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
“আপু আমার মনে হয় তোমাকে ভাবী বলে ডাকতে বারণ করাটা আমার ভুল ছিলো। বাড়ির সবাই ভুলেই গেছে যে আমি এই বাড়ির বউ হই। তাই আমি চাই তুমিও এখন থেকে আমাকে ভাবী বলেই ডাকো।”

ঊর্মিলা মলিন হেসে বলে,
“যাক ভাবী, দেরীতে হলেও যে নিজের জায়গা ধরে রাখতে শিখেছো সেটাই অনেক।”

ঊর্মিলা চলে যেতে নিলে অলি বলে ওঠে,
“আর একটু থাকোনা আপু। আমার একা একা ভালো লাগেনা। দম বন্ধ হয়ে আসে।”

ঊর্মিলা হাল্কা হেসে পুনরায় বিছানায় বসলো। মাগরিবের ওয়াক্ত পর্যন্ত ঊর্মিলা অলির সাথেই থাকলো। অলির মা বাবার মৃত্যু কিভাবে হয়েছে এসব নিয়েই ঊর্মিলা প্রশ্ন করেছে আর অলিও উত্তর দিয়েছে এর বাইরে বেশি কিছুই অলি ঊর্মিলাকে জানায় নি। ঊর্মিলা চলে যেতে নিলে অলি পিছু ডেকে বলে,
“আপু আচারের বাটিটা নিয়ে যাও। এটা দেখলে আমার খেতে ইচ্ছে করবে।”

ঊর্মিলা ঘুরে এসে বলে,
“তাহলে খাওনা একটু। শুনেছি এই সময় কিছু খেতে ইচ্ছে করলে না খেয়ে থাকতে হয়না।”

অলি বাটিটা ঊর্মিলার হাতে দিয়ে বলল,
“তোমার ভাইকে তো চেনোই যদি জানতে পারে…

“আরে কিভাবে জানবে? আমি ভাইয়াকে বলবোনা। তুমি একটু খাও”

অলির মন চাইছে খেতে কিন্তু মস্তিষ্ক বারণ করছে। অলি নিজেকে সামলে বলে,
“না আপু আমি খাবোনা। নামাজের সময় হয়ে গেছে। নামাজ পড়তে হবে।”

কথাটা বলেই অলি ওয়াশরুমে চলে যায়। ঊর্মিলাও একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

–—

আলভী একটা সিক্রেট কাজে এসেছে। তার সামনেই ৭-৮ জন গম্ভীর টাইপের লোক বসে আছে। মূলত লোকগুলো হচ্ছে গোয়েন্দা আর পুলিশের লোক।
“সবই তো শুনলেন। এবার যত তারাতাড়ি সম্ভব এর পেছনে যে আছে তাকে খুঁজে বের করুন”

গোয়েন্দা টিমের একজন বলল,
“মিস্টার মির্জা আপনি কি সিওর যে এর সাথে আপনার বন্ধু রিফাত যুক্ত আছেন?”

“ইয়েস আ’ম ড্যাম সিওর। তবে রিফাতের সাথে আরও একাধিক লোক যুক্ত থাকতে পারে।”

পুলিশের টিমের একজন বলল,
“স্যার আপনি একদম নিশ্চিন্তে থাকুন মাত্র একসপ্তাহের মধ্যেই আমরা কালপ্রিটকে খুঁজে বের করবো।”

আলভী আরও কিছুক্ষণ কথা বলে বাইরে বেরিয়ে আসে। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে এখন রাত ন’টা। আলভী গাড়িতে উঠে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। ৩০ মিনিটের মধ্যে সে বাড়িতেও ফিরে আসে।

রুমের সামনে এসে কয়েকবার নক করার পরেও অলি দরজা খোলেনা।
“অলি, দরজা খোলো।”

আলভী কিছু সময় দাঁড়িয়ে থেকে আবারও নক করতেই যাবে তার আগেই দরজা খুলে যায়। আলভী একরাশ ক্লান্তি নিয়ে রুমে ঢুকলো তারপর হাতে থাকা ওভারকোটটা সোফার উপর ফেলে দিয়ে কাভার্ডের দিকে এগিয়ে যায়। অলি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। রাত ১০ টা পর্যন্ত আলভী বাইরে থেকে কি করেছে সেটা ভেবেই কুল কিনারা পাচ্ছেনা। অলিকে চুপচাপ থাকতে দেখে আলভী একটু অবাক হলেও মুখে কিছুই বললোনা। সে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসেও দেখে অলি সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে,
“ডিনার করেছো?”

অলি কিছুই বললোনা। আলভী একটা শ্বাস ফেলে অলির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়,
“কি হলো? চুপ করে আছো কেনো?”

“কোথায় ছিলেন আপনি? আমি রুমে একা আছি সেটা জেনেও কিভাবে সারাটাদিন নিশ্চিন্তে থাকতে পারলেন?”

আলভী স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে,
“অফিসে গিয়েছিলাম সেখান থেকে নোমানের নানুকে দেখতে গিয়েছিলাম তারপর হসপিটালে গিয়েছিলাম পেশেন্ট দেখতে সেখান থেকে বেরিয়ে পুলিশের কাছে আর ডিটেকটিভের কাছে গিয়েছিলাম।”

আলভীর কথা শুনে অলি আর রেগে থাকতে পারলোনা। সে বুঝতে পারলো যে সারাদিন আলভী অনেক পরিশ্রম করেছে।
“দুপুরে খেয়েছিলেন?”

আলভী হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে,
“তুমি খেয়েছিলে?”

“হুম আপনি যেই দুজন সার্ভেন্টকে বলে গিয়েছিলেন তারা খাবার দিয়ে গিয়েছিলো।”

“গুড, চলো তাহলে ডিনার করে আসি।”

আলভী অলিকে নিয়ে ডিনার করতে নিচে এলো। বাড়ির সবাই আগেই ডিনার করে নিয়েছে। এখন শুধু আলভী আর অলিই বাকি আছে। আলভী অলিকে নিয়ে ডিনার করে রুমে ফিরে এলো।
রাত্রী এগারোটা, আলভী আর অলি শুয়ে ছিলো। আলভী হঠাৎ প্রশ্ন করলো।
“তুমি সারাদিন রুমেই ছিলে?”

“হুম”

“কেউ তোমাকে ডাকতে আসেনি?”

“হুম এসেছিলো। ঊর্মি আপু আর রূপসা আপু এসেছিলো।”

“তাই? কিছু বলেছে?”

“আরে রূপসা আপু এখনো আপনাকে বিয়ে করবে বলে স্বপ্ন দেখছে।”

অলির কথা শুনে আলভী ভ্রু কুচকে অলির দিকে তাকায়। অন্ধকারে অলির মুখ দেখা যাচ্ছিলোনা,
“তুমি এসব নিয়ে ওর সাথে তর্ক করেছো নাকি?”

“হুম করবোনা তো কি করবো? আমি বললাম আপনাকে যেনো ভাইয়া বলে ডাকে কিন্তু না সে নাকি নাম ধরেই ডাকবে”

অলির কথা বলার ধরন শুনে আলভী অজান্তেই হেসে ওঠে, তবুও নিজের হাসি আটকে বলে,
“তাই নাকি? তারপর তুমি কি বললে?”

“আমি বললাম সে যদি আপনাকে ভাইয়া বলে না ডাকে তাহলে আপনিই তাকে আপু বলে ডাকবেন”

“কিহ! তুমি এসব বলেছো?”

“হ্যাঁ বলেছি। তো কি হয়েছে? শুনুন আপনি কালকে থেকে ওনাকে আপু বলেই ডাকবেন”

আলভী হঠাৎ একহাতে অলিকে নিজের কাছে টেনে এনে জিজ্ঞেস করলো,
“ওকে আপু বললে আমাকে কি দেবে শুনি?”

অলি অবাক চোখে আলভীর দিকে তাকায়। আলভীর চেহারা দেখা না গেলেও আলভীর উত্তপ্ত শ্বাস প্রশ্বাস সে অনুভব করতে পারছে। অলি আনমনেই আলভীর থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো,
“আ…আমার কাছে আপনাকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই।”

আলভী হঠাৎ করেই অলিকে বিছানার সাথে চেপে ধরে তার উপর উঠে যায়। ফিসফিসিয়ে বলে,
“আছে,”

আলভী থামলো। তারপর অলির কানের কাছে মুখ নিয়ে হাস্কিস্বরে বলল,
“তোমার ঠোঁট জোড়া একবারের জন্য আমাকে দেও—বিনিময়ে আমি ওকে একশোবার আপু বলে ডাকবো”

আলভীর কথাগুলো শুনে অলির হাত পা জমে গেলো। সে হাত পা নাড়াতে চাইলেও নাড়াতে পারলোনা কারণ আলভী তার দু হাতই চেপে ধরে রেখেছে।

চলবে,,,

শব্দসংখ্যা- ২৬০০+

#১৫_বছর_বয়সী_মা (৩৮)
#সোফিয়া_সাফা

(বোনাস পর্ব)
সতর্কতা:— রোমান্টিক!

“আ…আপনি কি আমাকে কা…মড়াতে চাইছেন?”

অলির কণ্ঠ কাঁপছে। ঠোঁটজোড়া শুকিয়ে কাঠ, বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে অজানা উত্তেজনায়। সে বহু কষ্টে এটুকুই উচ্চারণ করতে সক্ষম হয়েছে। এদিকে অলির কথা শুনে আলভী একটা শ্বাস ফেলে অলিকে ছেড়ে দিলো। ছাড়া পেয়ে অলি একটা লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে ধাতস্থ করলো। আলভী অন্যদিকে ঘুরে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। অলি আড়চোখে একবার আলভীর পিঠের দিকে তাকায়।
“কামড়াতে না দিলে আপনি রূপসা আপুকে ‘আপু’ বলে ডাকবেন না?”

আলভী কোনো উত্তর দিল না। তার এই নীরবতা অলি সহ্য করতে পারল না। সে ধীরে ধীরে আলভীর দিকে এগিয়ে গিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“কি হলো? শুনতে পাচ্ছেন না”

আলভী বিরক্তি ভরা চোখে অলির দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলল,
“মেজাজ খারাপ কোরোনা তো। চুপচাপ ঘুমাও। মুডটাই নষ্ট করে দিয়েছো।”

কথাগুলো শুনে আরও বেশি বিভ্রান্ত হলো অলি। সে কি এমন করেছে? অলি পুনরায় নিজের স্থানে এসে শুয়ে পড়লো। বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হবার পরেও সে ঘুমাতে পারলোনা। এদিকে আলভী একভাবেই শুয়ে আছে। অলি বুঝতে পারলোনা সে আদৌ ঘুমিয়েছে কিনা। সে একটু দ্বিধা নিয়েই নিজের তর্জনী আঙুল দিয়ে আলভীর পিঠে দুটো আলতো টোকা দিল। মূহুর্তেই আলভী ঝড়ের বেগে অলির দিকে ঘুরে গিয়ে তার হাত সরিয়ে দিলো। রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“বিরক্ত করছো কেনো? ঘুমাতে বলেছিনা?”

অলি একটু চমকে গিয়ে শুষ্ক গলায় বলল,
“আপনি কি রাগ করেছেন?”

আলভী এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নরম স্বরে বলল,
“আমার রাগ সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই নেই। আমি রাগ করলে তোমাকে ঠাটিয়ে দুটো চড় মে*রে দিতাম।”

আলভীর কথা শুনে অলি ঘাবড়ে গেলো।
“তার মানে আপনি রেগে নেই?”

“না”

অলি চুপ করে রইলো বেশ কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভেঙ্গে আলভী বলল,
“তুমি কাকে কি বলতে হবে সেসব তো ভালোই বোঝো কিন্তু স্বামীর সাথে কেমন আচরণ করতে হবে সেসব বোঝোনা। এই ব্যপারটা আমার অনেক খারাপ লাগে।”

কথাটা শুনে অলি ফ্যালফ্যাল চোখে আলভীর দিকে তাকিয়ে রইলো যদিওবা সে আলভীর চেহারা দেখতে পাচ্ছেনা তবুও তার মনে হচ্ছে আলভীর মন ভালো নেই। অলি অভিমানী কন্ঠে বলল,
“আমি কোনটা বুঝতে পারিনি? আমি কি আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি? আচ্ছা ঠিক আছে রূপসা আপুকে আর ‘আপু’ বলে ডাকতে বলবোনা।”

আলভীর ভীষণ খারাপ লাগলো সে কিভাবে অলিকে বোঝাবে সে অলির ব্যবহারে অনেক কষ্ট পায়। আলভী কাছে গেলেই অলি অদ্ভুত বিহেভ করে আর এটাই তাকে অনেক কষ্ট দেয়। অলি ছটফট করলে আলভীর মনে হয় সে অলিকে আবারও ধ/র্ষ/ণ করছে। সে অবশ্যই অলির সাথে জোরাজুরি করতে চায়না। কিন্তু এই অলি কবে বড় হবে আর কবে নিজে থেকেই তার কাছে আসবে? ততদিন সে কিভাবে নিজেকে সামলে রাখবে? আলভীকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে অলি চিন্তিত কন্ঠে শুধায়,
“আপনার কি শরীর খারাপ?”

আলভী স্বাভাবিক স্বরেই বলে,
“না তবে মন অবশ্যই খারাপ।”

অলি ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে আপনার?”

“দেখো অলি আমি অনেক টায়ার্ড ঘুমাতে দেও আমাকে।”

অলি চুপ হয়ে যায়। আর আলভীও অন্যদিকে ফিরে চোখ বুজলো।
অন্ধকার আচ্ছন্ন রুমটা নিঃস্তব্ধ, শুধুই শোনা যাচ্ছে দেয়ালে ঝোলানো ঘড়ির টিকটিক শব্দ। জানালার ওপারে কঠিন অন্ধকারে ঘুমিয়ে পড়েছে শহর। বাতাসে মিশে আছে একরাশ গা ছমছমে নিস্তব্ধতা। এমন সময়েই অলির নরম কণ্ঠ ভেসে এলো—
“আপনি কি কষ্ট পেয়েছেন?”

আচমকা অলির প্রশ্নে আলভী ফট করে চোখ মেলে তাকায়। অলি আলভীর মাথায় হাত রাখলো। আলভী অলির দিকে ঘুরে গিয়ে চাপা কণ্ঠে বলল,
“হুম কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু তুমি কি বুঝতে পারছো যে আমি কেনো কষ্ট পেয়েছি?”

অলি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মাথা নিচু করে রয়েসয়ে বলল,
“আমি বুঝতে পারছিনা। কিন্তু আপনি বলুন কি করলে আপনার কষ্ট কমে যাবে আমি সেটাই করবো।”

আলভীর ঠোঁটের কোণে একটা ম্লান হাসি ফুটে উঠলো। সে ভারী কন্ঠে বলে ওঠে,
“আমাকে আদর করো। তাহলেই আমার কষ্ট কমে যাবে”

অলি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। চোখে মুখে তীব্র লজ্জা, অস্বস্তি আর সংকোচ ফুটে উঠলো। তবুও আলভীর মন রক্ষার্থে সব দ্বিধা উপেক্ষা করে আলভীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। আলভী চোখ বুজে অনুভব করল স্পর্শটুকু। অলির সেই কোমল স্পর্শে আলভীর চোখেমুখে প্রশান্তির রেখা ফুটে ওঠে।
“স্বামীকে এভাবে আদর করে?” —আলভীর কণ্ঠে একরাশ অভিমান।

অলি অসহায় কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“তাহলে কিভাবে করে?”

আলভী নিজের কপালের মাঝ বরাবর আঙুল ঠেকিয়ে বললো।
“এখানে কিস করো।”

অলি হকচকিয়ে গেলো। গলা শুকিয়ে এলো। তবুও সাহস সঞ্চয় করে আলভীর কপালে নিজের নরম ঠোঁটদ্বয় ছোয়ালো। এটুকুতেই আলভীর মন ভালো হয়ে যায়। তবুও কথায় আছেনা বসতে পেলে শুতে চায়। ঠিক তেমনটাই হলো। আলভী এবার নিজের গালে আঙুল ঠেকিয়ে বলল,
“এবার এখানে করো”

অলির নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। ভেতরটা কাঁপছে। ভিতরে স্নায়ুর টান টান অবস্থা। এমনটা আগে কখনো হয়নি। যেন কোনো দুঃসাহসিক অভিযানে নেমেছে। আলভীর গম্ভীর, তীক্ষ্ণ উপস্থিতি যেন ওর অগ্নি পরীক্ষা নিচ্ছে। তার সংকোচ স্পষ্ট বুঝতে পেরে আলভী মৃদু হেসে বলল,
“থাক, করতে ভালো না লাগলে—করতে হবেনা।”

কিন্তু অলি মাথা নেড়ে সাহস জুগিয়ে এগিয়ে এসে, আলভীকে কিস করতে যাবে ঠিক তখনই আলভী ঘুরে তাকায় তার দিকে, ফলস্বরূপ অলি অজান্তেই আলভীর ঠোঁটে চুমু দিয়ে বসলো। অলি অপ্রস্তুত হয়ে তড়িৎ গতিতে সরে যেতে নেবে কিন্তু তার আগেই আলভী একহাতে অলির ঘাড় চেপে ধরে। অলি বেচারি কি আর করবে? আলভী শক্তপোক্ত ভাবে নিজের ঠোঁটের সাথে অলির ঠোঁট চেপে ধরে রেখেছে।
যেন হঠাৎ কোনো দুরন্ত ঝড় এসে অলিকে ঘিরে ফেলেছে। পালানোর পথ নেই। আলভীর স্পর্শে, চাপে, ঠোঁটের ছোঁয়ায় অলির শরীর জমে আসে। অলি শ্বাস নেয়ার জন্য মুখ খুলতেই আলভী অলির নিচের ঠোঁট—দাত দিয়ে চেপে ধরে। অলি ছোটার জন্য ছটফট করতে লাগলো কিন্তু তাতে যেন আগুনে ঘি পড়ে। আলভী আরও প্রবল হয়ে অলির ঠোঁটে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে লাগলো।

আলভী চুমুরত অবস্থাতেই অলিকে নিজের নিচে টেনে নেয়। অলির দুহাত নিজের একহাত দিয়ে চেপে ধরে আরেক হাতে অলির ঘাড় চেপে ধরে। প্রায় ১৩ মিনিট পর আলভী অলির ঠোঁট জোড়া ছেড়ে দেয়। অলির চোখে জল, ঠোঁট লাল হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে অক্সিজেনহীন কোনো ভিন্ন গ্রহে ছিলো এতক্ষণ। মাত্রই পৃথিবীতে ফিরে এলো। অলি হাঁপাচ্ছে। কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে শ্বাস নিচ্ছে একটানা। ২ মিনিট পর অলি কিছুটা স্বাভাবিক হলো। আলভী এখনো অলির হাতজোড়া ধরে রেখেছে। অলি নিজের হাত ছাড়াতে চাইলে আলভী ব্যাকুল কন্ঠে বলে ওঠে,
“স্যরি হানিবি। আর একবার প্লিজ। এবার ব্যাথা দেবোনা প্রমিস”

অলি কিছু বলতে যাবে তার আগেই আলভী পুনরায় অলির অধরজোড়া আঁকড়ে ধরে। অলির বলতে না পারা কথাগুলো গোঙানির রূপে রুমের চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। এবারের চুমুটা ছিলো ভীষণ সফট। তীব্রতার বদলে ভালোবাসায় ভরপুর। আলভী ধৈর্য্য সহকারে অলির ঠোঁটের মাঝে বিচরণ করছে। অলি একসময় ক্লান্ত হয়ে হার মেনে—নিজেকে আলভীর নিকট শপে দেয়। এরকম ভাবে আলভী কতোক্ষন যাবত অলির ঠোঁটের মাঝে ডুবে ছিলো তার ইয়ত্তা নেই।

চলবে,,,

#১৫_বছর_বয়সী_মা (৩৯)
#সোফিয়া_সাফা

ঘড়ির কাটা রাত ৩ টা ছুইছুই। আলভী নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। অলির চোখে ঘুম নেই সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। যদিও অন্ধকার রুমে কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। অলি লক্ষ্য করেছে এই কয়দিন সে আলভীর পাশে ঘুমালেও আলভী নাক ডাকেনি। তবে আজকে কি হলো? অলি একটা শ্বাস ফেলে ঘুমোতে চাইলো কিন্তু ঘুম যেন তার সাথে লুকোচুরি খেলছে। বারবার আলভীর চুম্বনের কথাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তার আজকে একটুও খারাপ লাগেনি। উল্টো আলভীর প্রতিটি স্পর্শ তার শরীরে অদ্ভুত এক শিহরণ ছড়িয়ে দিয়েছে। যার প্রভাবে তার চোখে ঘুমও ধরা দিচ্ছেনা।
“এটাকেই কি স্বামীর আদর বলে”

ভাবনাটা মাথায় আসতেই অলি দুহাতে মুখ ঢেকে নিলো। লজ্জায় তার গাল পুড়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ যেতেই অলি আলভীর দিকে এগিয়ে যায়। একহাতে আলভীকে জড়িয়ে ধরে তার পিঠে মুখ গুজে চোখ বন্ধ করে নেয়।

সকাল আটটা। সূর্য সদ্য মাথা তুলেছে। জানালার কাঁচে হালকা গরম ভাব, রোদ সরাসরি ভেতরে না ঢুকলেও পর্দার ফাঁক গলে একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ছে। আলভীর রুমে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা—ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দটাও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
“আজকে নোমানের নানুর অপারেশন হবে।”

আলভী হাতঘড়ি পড়তে পড়তে অলির উদ্দেশ্যে কথাটা বললো। কিন্তু বিনিময়ে অলির থেকে কোনো রেসপন্স পেলোনা। সে ভ্রু কুচকে অলির দিকে তাকায়। অলি ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলো। কিন্তু অলিকে দেখে মনে হচ্ছে সে অন্য কোনো ভাবনায় ডুবে আছে। আলভী অলির দিকে এগিয়ে গিয়ে অলির পিঠ বরাবর টোকা দিতেই অলি ধরফরিয়ে উঠলো। হাতে থাকা চিরুনী টাও ফ্লোরে ছিটকে পড়লো। অলি থতমত খেয়ে আলভীর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আলভী অলির মুখ বরাবর ঝুকে গিয়ে বলল,
“রাতের ঘটনা ভুলতেই পারছোনা দেখছি, ব্যাপার কি?”

আলভীর কথা শুনে অলি লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে ঠোঁট চেপে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাকে এভাবে লজ্জা পেতে দেখে আলভী নিজের ঘাড় চুলকে বলল,
“তুমি কিন্তু আমাকে সি*ডিউস করছো। আমি আবার বাইট করতে শুরু করলে আমাকে কিন্তু আটকাতে পারবেনা।”

এই কথা শুনে অলি ড্রেসিং টেবিলের দিকে ঘুরে গিয়ে বললো,
“নোমান ভাইয়ার নানুর কি অবস্থা এখন?”

আলভী একটা শ্বাস ফেলে বলল,
“হু, সেটাই বলছিলাম। আজকে ওনার হার্টের অপারেশন করা হবে”

অলি চমকে তাকালো আলভীর দিকে,
“আপনি করবেন?”

আলভী প্যান্টের পকেটে হাত রেখে বলল,
“হুম। আফটার অল নোমান আমার হানিবিকে পালাতে সাহায্য করেছে। তার প্রতিদান স্বরুপ আমি এটুকু তো করতেই পারি তাইনা?”

আলভী হাসছে। অলি সরু চোখে আলভীর দিকে তাকিয়ে রইলো। এর আগে সে আলভীকে এভাবে হাসতে কখনোই দেখেনি। আর সত্যি বলতে আলভীকে হাসতে দেখে অলিরও খুব ভালো লাগছে।
“বাহঃ আপনার মন আজকে বেশ ভালো দেখছি।”

আলভী হুট করেই অলিকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো,
“বউয়ের আদর পেয়েছি তো সেই জন্যই ফুরফুরে লাগছে।”

অলি নিজেও হেসে উঠলো। বাবা মাকে হারানোর পর এই প্রথম সে একটু মন থেকে হেসেছে।
“আমাকে নিয়ে যাবেন?”

আলভী অলির চুলে মুখ গুজে চাপা স্বরে বলে,
“কোথায়?”

“নোমান ভাইয়ার নানুকে দেখবো। আপনার সাথে যেতে চাইছি নিয়ে যাবেন?”

আলভী অলিকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
“না অলি। আমি অপারেশনের সময় ব্যস্ত থাকবো। তখন তুমি একা-একা কি করবে?”

অলি ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“বাড়িতেও তো একা-একা থাকতে হয়। তার চেয়ে আপনার সাথে যাওয়াটাই ভালো। অপারেশনের পর আমরা ঘুরতে যাবো। প্লিজ”

আলভী আর না করতে পারলোনা। এভাবে বলার পরেও কি সে না করতে পারে?
“ওকে ডান। তার আগে ব্রেকফাস্ট করে নেই চলো”

আলভী রুমের দরজা খুলেই রূপসাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হকচকিয়ে যায়। রূপসা হাতে থাকা কফির মগটা আলভীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“আগে তো কফি ছাড়া চলতোই না। এখন তো কফি নিয়ে এলোও তোমাকে পাওয়া যায়না।”

রূপসার কন্ঠ শুনে অলি মাথায় কাপড় টেনে দরজার দিকে এগিয়ে আসে। আলভী রূপসার হাত থেকে কফির মগটা নিতে যাবে তার আগেই অলি এগিয়ে এসে মগটা নিয়ে নেয়। এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে কফির কাপে একটা চুমুক দিয়ে নাক মুখ কুচকে ফেলে। আলভী আর রূপসা দুজনেই হতবাক হয়ে অলির দিকে তাকায়। অলি মুখের কফিটুকু আবার কাপে ফেলে দিয়ে বলে ওঠে,
“ছিহ, এটা কি বানিয়েছো রূপসা? ওয়াক”

অলির কথাশুনে রূপসা রেগেমেগে অলির হাত থেকে কফির মগটা ছিনিয়ে নেয়, বাজখাঁই কন্ঠে বলে ওঠে,
“এই বেয়াদব মেয়ে, তোমাকে একবার বলেছিনা যে নাম ধরে ডাকবেনা।”

অলি চোখ মুখ শক্ত করে বলল,
“আমাকে ভাবী বলে ডাকো। তারপরেই আপু বলে ডাকবো”

রূপসা মুখ বাকায়, “তোমার মুখ থেকে আপু ডাক শোনার জন্য আমি উতলা হয়ে যাইনি। তুমি যদি আমার সাথে কথা বলতে না আসো তাহলেই আমি খুশি।”

অলি একটা শ্বাস ফেলে বলল, “আচ্ছা আমাকে ভাবী বলতে হবেনা। তুমি অন্তত ওনাকে একবার ভাই বলে ডাকো।”

রূপসা অগ্নিঝরা চোখে অলির দিকে তাকাতেই আলভী বলে ওঠে, “রূপ তোর বিহেভিয়ার অনেক খারাপ হয়ে গেছে। আমি কিন্তু তোকে ফাস্ট আর লাস্ট বারের মতো ওয়ার্ন করছি অলির সাথে এভাবে কথা বলবিনা।”

আলভীর কন্ঠে এমন কিছু ছিলো যা রূপসাকে ভীষণ ভাবে আহত করলো।
“তুমি শুধু আমার বিহেভিয়ারই দেখলে? ওর বিহেভিয়ার দেখলেনা? ও আমার সাথে কিভাবে কথা বলল সেটা দেখলেনা?”

“ও তো তোকে ঠিক কথাই বলেছে। তুই একটা কাজ কর। আমাকে ভাই বলে ডাকতে তোর সমস্যা হলে তুই আমার চোখের সামনেই আসিস না।”

কথাটা শুনে রূপসা অভিমানী চোখে আলভীর দিকে তাকিয়ে হাতে থাকা কফির মগটা শক্ত করে চেপে ধরে,
“হাহ আমি না আসলে তুমি সামান্য কফি টুকুও খেতে পারবেনা বুঝলে। তোমার এই অকালপক্ব বউ তো শুধু চটাং চটাং করে কথা বলতেই জানে। আর কি জানে সে? এই সাদা চামড়া টা ছাড়া ওর মাঝে আর আছে টাই বা কি? তাও এই সাদা চামড়াটা আছে বলেই ছেলেদের ভেঙ্গে খেতে পারে নইলে তো ভিক্ষাও জুটতো…..

ঠাসসসসস

রূপসা নিজের কথা শেষ করার আগেই আলভীর শক্তপোক্ত হাত তার গাল স্পর্শ করে। থাপ্পড়ের তীব্রতায় হাতে থাকা কফির মগটা ফ্লোরে পড়ে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়।
ড্রইংরুমে বসে যারা ব্রেকফাস্ট করছিলো তারা সবাই ছুটে আসে ঘটনাস্থলে। রাগে আলভীর শরীর কাপছে। রূপসার সাহস দেখে সে অবাক হলো।
তার সামনে দাঁড়িয়ে অলিকে নিয়ে এগুলো বলতে রূপসার বুক কাপলোনা? অলি ঠোঁট চেপে কেদে উঠলো। অলির চাপা কান্নার শব্দে আলভী আরও বেশি রেগে যায়। সে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে রূপসার চুল টেনে ধরে।
অলি এরকম ঘটনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা। সে দ্রুত এগিয়ে এসে আলভীর হাত থেকে রূপসাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো।
আলভী হিংস্র সিংহের ন্যায় গর্জে উঠে একহাতে অলিকে সরিয়ে দেয়। অলি আবারও গিয়ে রূপসাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই আলভী রূপসাকে ধাক্কা দিয়ে বসে।
রূপসা ছিটকে গিয়ে দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেতে যাবে ঠিক সেই সময়েই কেউ একজন এগিয়ে এসে রূপসাকে নিজের দিকে টেনে নেয়। রূপসা লোকটার চেহারা না দেখেই লোকটাকে জড়িয়ে ধরে কেদে ওঠে।
আলভী পুনরায় রূপসার দিকে এগিয়ে যেতে নিলে অলি আলভীর পা জড়িয়ে ধরলো। আলভীর রাগ মূহুর্তেই হাওয়া হয়ে যায়। সে তড়িৎ গতিতে অলিকে উঠিয়ে বুকে টেনে নিলো।
বাড়ির বাকিরা এরূপ ঘটনায় হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। রূপসা কিছুটা স্বাভাবিক হতেই লোকটাকে ছেড়ে লোকটার মুখের দিকে তাকায়। লোকটা ছিলো ইয়াদ।
ইয়াদের দৃষ্টি অনূভুতিশূন্য। এরই মাঝে রুনা খাতুন এগিয়ে এসে রূপসাকে জড়িয়ে ধরে।
“এভি তুমি আমার মেয়ের গায়ে হাত তুললে? যেই মেয়ের গায়ে আমি মা হয়ে কক্ষনো হাত তুলিনি তুমি আমার সেই মেয়েকে মা*রলে?”

আলভী কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলে উঠলো,
“আমি যে আপনার মেয়েকে বাচিয়ে রেখেছি সেই জন্য কৃতজ্ঞ থাকুক। ওর জায়গায় অন্য কেউ হলে আমি খু*ন করে ফেলতাম”

শাহানাজ বেগমসহ বাকি সবাই আলভীর ব্যবহারে বিস্মিত হলো। উসমান মির্জা ধমকের স্বরে বললেন,
“এভি তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো।”

“আমি বাড়াবাড়ি করিনি বাবা। অলির স্বামী হিসেবে আমার উচিৎ ছিলো ওর জবান বন্ধ করে দেয়া।”

ইয়ামিন মির্জা বললেন,
“রূপ কি এমন অন্যায় করেছে যার জন্য তুমি এভাবে বলছো?”

আলভীর শরীর কাপছে। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টায় সে নিজের চুল খামচে ধরলো। তারপর হাসফাস করতে করতেই বলল,
“ও যে কি করেছে আমি সেটা ভাষায় ব্যক্ত করতে পারবোনা। আমি অনেক সহ্য করেছি কিন্তু আর নয়। তোমরা যদি আমার স্ত্রীকে সম্মান দিতে না পারো তাহলে আমি এইমুহূর্তে ওকে নিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। এমনকি এই মির্জা বংশের সাথে আমার সমস্ত সম্পর্ক আমি ছিন্ন করবো।”

অলি তখনও আলভীর বুকের সাথেই লেপ্টে ছিলো। আলভীর কথা শুনে সে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। তার মনে হচ্ছে সবকিছু তার জন্যই হচ্ছে।
এদিকে আলভীর কথা শুনে শাহানাজ বেগম ভড়কে গেলেন। একটা মাত্র ছেলে তার। যদি সত্যি সত্যিই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় তাহলে তো সে ছেলের শোকে শোকেই ম*রে যাবেন। ছেলের রাগ সম্পর্কে তার ধারণা আছে। এর আগেও তো আলভী চলে গিয়েছিলো। আর সত্যি তো এটাই যে অলির জন্যই আলভী ফিরে এসেছে। সবাইকে চুপচাপ থাকতে দেখে রুনা খাতুন বললেন,
“ভাই, ভাবী তোমরা যদি এর বিহিত না করো তাহলে আমি আর থাকবোনা এই বাড়িতে। আমার মেয়েকে নিয়ে আমি আজই চলে যাবো।”

শাহানাজ বেগম দোটানায় পড়লেন। সে রুনা খাতুনকে বোঝানোর চেষ্টা করে বললেন,
“রুনা জানোই তো এভির রাগ উঠলে মাথা ঠিক থাকেনা। তোমরা একটু বোঝার চেষ্টা করো।”

“আমি নাহয় বুঝলাম ভাবী কিন্তু রূপের বাবা যদি একবার এই বিষয়ে জানতে পারে। তাহলে ভেবে দেখেছো কি হবে? এমনিতেই আমরা তার অ-মতে গিয়ে এই বাড়িতে থাকছি।”

শাহানাজ বেগম চুপ হয়ে গেলেন। আপাতত তার কাছে ছেলের দোষ লুকোনোর মতো অজুহাত নেই। এরই মাঝে সবাইকে অবাক করে দিয়ে আলভী অলিকে রুমের ভেতরে নিয়ে, ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিলো।
পুরোটা সময় ঊর্মিলা আর ইয়াদ চুপচাপ ছিলো। বড়দের মাঝে তাদের কথা বলা মানায় না। মূলত সেই জন্যই ঊর্মিলা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
নইলে সেও সবাইকে বলে দিতো যে রূপসা তার ভাইয়ের সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করতে চাইছে। আগে রূপসাকে যেটুকু ভালো লাগতো কিন্তু কালকের ঘটনার পর রূপসাকে দেখলেই তার রাগ উঠছে।
“কেনো রে ভাই? দুনিয়াতে কি ছেলের অকাল পড়েছে? তুই কেনো আমার লাটসাহেব ভাইটার পেছনেই ছ্যাচড়ার মতো পড়ে আছিস? ভালোই হয়েছে ভাইয়া আজকে তোকে চুড়ানি দিয়েছে। এখন যদি একটু বুদ্ধি জাগ্রত হয়।”

রুনা খাতুন রূপসাকে নিয়ে রূপসার রুমের দিকে চলে যায়। তারপর এক এক করে বাকি সবাইও চলে গেলো। ঊর্মিলা ইয়াদের দিকে তাকিয়ে দেখলো ইয়াদ একভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। ঊর্মিলা ভ্রু কুচকে ইয়াদের সামনে গিয়ে হাত নাড়ায়,
“এই ভাইয়া, এই।”

ঊর্মিলার ডাকে ইয়াদ যেন হুশ ফিরে পেলো। এদিকে ইয়াদের চোখমুখের অবস্থা দেখে ঊর্মিলা আঁতকে ওঠে। ইয়াদের চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। পুরো চেহারা কেমন যেন থমথম করছে। ইয়াদ ঊর্মিলার দিকে গম্ভীর চাহনি নিক্ষেপ করতেই ঊর্মিলা একটা শুষ্ক ঢোক গিললো,
“ভা…ইয়া? আর ইউ ওকে?”

ইয়াদ মূহুর্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে বললো,
“ইয়াহ আ’ম ওকে”

ঊর্মিলা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল,
“আহ, আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। একটু আগে তোমাকে একদম এভি ভাইয়ের মতোই দেখাচ্ছিলো।”

কথাটা শুনে ইয়াদ ঊর্মিলার মাথায় চাপড় মেড়ে বললো,
“মোটেই না। আমি ভাইয়ার মতো নই।”

“হ্যাঁ আমি জানি ইয়াদ ভাই। কিন্তু তোমরা কথায় কথায় আমার মাথায় চাপড় মা*রো কেনো?”

ইয়াদ হেসেই বলল,
“তোর মাথায় কতটুকু গোবর আছে সেটাই পরীক্ষা করি বুঝলি?”

“কিহ!”

“হুম, দেখ তুই যদি ব্যথা পাস তার মানে তোর মাথা ভর্তি গোবর আছে। আর যদি ব্যথা না পাস তাহলে মনে করবি তোর মাথার গোবর শুকিয়ে গিয়ে বুদ্ধিতে রূপান্তরিত হচ্ছে।”

ইয়াদের কথা শুনে ঊর্মিলা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো। সে বুঝতে পারছেনা ইয়াদ উল্টো পাল্টা বলছে নাকি সে উল্টো পাল্টা শুনছে।
“তো এবার বল, ব্যথা পেয়েছিস?”

ঊর্মিলা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়তে গিয়েও নাবোধক মাথা নাড়লো। ইয়াদ হাসতে হাসতেই নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। ইয়াদ কিছুদূর যেতেই ঊর্মিলা পেছন থেকে বলল,
“ভাইয়া তুমি রেডি হয়ে আমাকে কল দিও। আবার আমাকে রেখেই চলে যেওনা।”

ইয়াদ একবার পেছনে ঘুরে ঊর্মিলার উদ্দেশ্যে বলল,
“আজকে আমি ভার্সিটিতে যাবোনা। তুই ড্রাইভারের সাথে চলে যা।”

ঊর্মিলাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ইয়াদ ঠাস করে নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে দিলো। ঊর্মিলা থতমত খেয়ে গেলো।
“ধ্যাৎ আমি একা ভার্সিটিতে গিয়ে কি করবো? দেখি আমার হাড় মড়মড় সাহেব কি করছেন।”

কথাটা ভেবেই ঊর্মিলা দিহানের নম্বরে কল দিলো। দিহান কলটা রিসিভ করতেই ঊর্মিলা বললো,
“সাহেব আমার আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট দরকার। ফ্রী আছেন?”

দিহান মুচকি হেসে বললো,
“অবশ্যই রাগিনী। আমি আপনার জন্য সবসময় ফ্রী কিন্তু আপনার কি আজকে ভার্সিটি নেই?”

“না, আজকে ভার্সিটি ক্যান্সেল।”

দিহান শাসনের ভঙ্গিতে বলল,
“ঊর্মি ভার্সিটি ফাঁকি দেয়া কিন্তু অনেক বড় ব্যাড হ্যাবিটস।”

“উফস আমার আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট প্রয়োজন আপনি আসবেন কিনা বলুন নইলে আমি অন্য ডাক্তারের কাছে যাবো। আমাদের দেশে ডাক্তারের অকাল পড়েনি হুহ,,,

দিহান একটা শ্বাস ফেলে বলল,
“ব্ল্যাকমেইল করতে হবেনা চলে এসো। আমি তোমার রোগের ট্রিটমেন্ট করে দেবো।”

ঊর্মিলা খুশিমনে কল কেটে দিয়ে রেডি হতে চলে গেলো।

এদিকে অলি হাতমুখ ধুয়ে এসে বোরকা পড়তে লাগলো। আলভী একমনে অলির ফোন চাপছে আর নিজের চুল টানছে। অলি বুঝতে পারলো যে আলভীর মন মেজাজ ঠিক নেই। অলি কিছুক্ষণ আয়নার দিকে তাকিয়ে থেকে ধীরপায়ে আলভীর দিকে এগিয়ে গেলো। আলভী কিছু বুঝে ওঠার আগেই অলি আচমকা আলভীর গলা জড়িয়ে ধরে আলভীর উরুর উপর বসে পড়লো। আলভী ভ্রু কুচকে অলির দিকে তাকায়। অলি ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
“আলো আপনার কোলে উঠতে চাইলো সেই জন্যই এসেছি। আমি নিজে থেকে আসিনি কিন্তু।”

আলভী অবাক চোখে অলির দিকে তাকায়। অলি বোরকা পড়েছে আর হিজাব টা গলায় প্যাচানো। চুলগুলো উঁচু করে খোপা করা।
“আলো কে?”

অলি আলভীর হাতটা নিজের পেটের উপর রেখে বলল,
“বাবুর নাম আলো রেখেছি।”

আলভী একটা শ্বাস ফেলে অলির দিকে তাকায়। এখন তাকে কিছুটা স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। সে হঠাৎই বলে ওঠে,
“আলো তো মেয়েদের নাম। তোমার তো ছেলে হবে।”

কথাটা শোনার জন্য অলি মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা।
“আপনি কি করে জানলেন যে আমার ছেলে হবে?”

“যেদিন তোমার ব্লিডিং হচ্ছিলো সেদিনের রিপোর্ট দেখেই আমি সিওর হয়েছি যে তোমার ছেলে হবে।”

অলির কপাল কুচকে গেলো,
“আপনি আমাকে আগে বলেননি কেনো?”

“বলার মতো পরিস্থিতি ছিলোনা। তাছাড়া ছেলে নাকি মেয়ে সেটা জানাটা তেমন বড় কোনো বিষয় নয়। ছেলে যে সুস্থ আছে সেটাই তোমার সৌভাগ্য।”

অলি নিশ্চুপ হয়ে গেলো। আলভী বলল,
“আলো নামটা ভালো ছিলো। কিন্তু নামে একটা মেয়েলি ব্যাপার আছে।”

“আলো বলে আমি ডাকবো।”

আলভী ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“তাহলে আমি কি বলে ডাকবো?”

অলি নিম্নস্বরে বললো,
“আমি নাম ভেবেই রেখেছিলাম। যেহেতু ও ছেলে। সেহেতু ওর নাম হবে আফরান আরিশ।”

“তুমি তো ভালোই এডভান্স নামও একদম ঠিক করে রেখেছিলে?”

অলি হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে। হঠাৎ করে অলি অনুভব করলো আলভী ধীরে ধীরে তাকে নিজের আরও কাছে টেনে নিচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই অলি উঠে যেতে নেয়। তার আগেই আলভী ভারী কন্ঠে বলে ওঠে,
“আমার কোলে বসার জন্য ট্যাক্স কি তোমার ছেলে দেবে নাকি তুমি দেবে?”

চলবে,,,

শব্দসংখ্যা- ২১০০+