১৫ বছর বয়সী মা পর্ব-৪৬+৪৭+৪৮

0
24

#১৫_বছর_বয়সী_মা (৪৬)
#সোফিয়া_সাফা

দেখতে দেখতে ৯ টা দিন কেটে গেল। আজকে রূপসাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ দেয়া হয়েছে। রূপসার বাবা বললেন,
“রূপ আমরা নিজেদের বাড়িতে ফিরছি।”

রূপসা তার দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলল,
“আমিও বাড়িতে যেতে চাই বাবা। কিন্তু তার আগে আমাকে একবার মির্জা ভিলাতে নিয়ে যাও প্লিজ।”

রহিম আহমেদ মাথা নেড়ে রুনা খাতুন আর রূপসাকে নিয়ে মির্জা ভিলার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।

***

মির্জা ভিলাতে এসে রূপসা সর্বপ্রথম নানুর রুমে গেলো। তার নানু (আলভীর দাদুমনি) গত দেড় মাসের অধিক সময় ধরে শয্যাশায়ী। কথাবার্তা বলতে পারলেও হাটাচলা করতে পারেন না। অলির যে পড়ে গিয়ে হাতপা ভেঙ্গে গেছে সেটাও তিনি জানেন না আর রূপসার যে এতোবড় একটা এক্সিডেন্ট হলো সেটাও তাকে কেউ জানায় নি। অর্থাৎ, বাড়ির ভেতরে যা কিছু হচ্ছে সবকিছুই তার অজানা।
“নানুমনি”

রূপসার ডাকে দাদুমনি চোখ তুলে তাকালেন,
“রূপ তুই? এতোদিন কোথায় ছিলি?”

বলেই দাদুমনি কেদে উঠলেন, রূপসা তার পাশে বসলো। তারপর তার চোখজোড়া মুছে দিয়ে বলল,
“জানোই তো বাবা ফিরে এসেছে। সেই জন্যই আমি মাকে নিয়ে বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম নানুমনি। তোমাকে দেখতেই এসেছি। কিছুক্ষণ পর চলে যাবো।”

“তুই যাস না রূপ। আমার ভালো লাগেনা। কেউ আসেনা আর আমার কাছে। নাতবউ আগে আসতো কিন্তু অনেকদিন হলো সেও আসেনা।”

দাদুমনি অঝোরে কাদতে লাগলেন। এরই মাঝে রুনা খাতুন এলেন,
“তুমি এরকম কোরোনা তো মা। তোমার কি মনে হয়? আমার স্বামী সংসার সব বাদ দিয়ে আমি সারাজীবন এই বাড়িতেই পড়ে থাকবো?”

রূপসা দাদুমনির চোখ মুছে দিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আহা মা, নানুমনির সাথে এভাবে কথা বলছো কেনো?”

“কেনো বলছি মানে? সে তো পারলোনা এভির সাথে তোর বিয়েটা দিতে। উল্টো ওই বাচাল মেয়েটাকে পেয়ে একদম সারাদিন নাতবউ নাতবউ করে মুখে ফেনা তুলে ফেলতো। তাহলে এখন তোকে কেনো থাকতে বলছে? থাকুক না তার নাতবউকে নিয়ে।”

দাদুমনি তীক্ষ্ণ চোখে রুনা খাতুনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি তোকে আগেই বলেছিলাম এভি দাদুভাই রূপকে কখনো বিয়ে করবেনা। কিন্তু তুই আমার কথা শুনিস নি। আমি ইয়াদের জন্য রূপকে পছন্দ করেছিলাম এভির জন্য নয়।”

দাদুমনির কথা শুনে রূপসা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। নিজের চোখজোড়া মুছে বলে,
“ইয়াদকে আমি ভাইয়ের চোখে দেখি নানুমনি। ওকে নিয়ে কক্ষনো এসব বলবেনা।”

দাদুমনি রয়েসয়ে বললেন,
“তুই ইয়াদ দাদুভাইকে যেমন ভাইয়ের চোখে দেখিস ঠিক তেমনি এভি দাদুভাইও তোকে বোনের চোখেই দেখতো রূপ। তোর ভালো এটাতেই হবে যে তুই এভিকে ভুলে গিয়ে ইয়াদ বা এমন কাউকে বিয়ে করে নে যে তোকে ভালোবাসবে। তুই সুখে থাকবি নানুভাই। শুধু শুধু এভির সংসারে অশান্তি করিসনা। তাতে না এভি ভালো থাকতে পারবে আর না তুই ভালো থাকতে পারবি।”

রূপসা মনে মনেই আওড়ালো,
“আমি ভালো থাকতে চাইনা নানুমনি, আমি শুধু এভির সাথে থাকতে চাই।”

রূপসা দরজা পর্যন্ত এসে পেছনে ঘুরে বলল,
“আমি যাচ্ছি নানুমনি। ভালো থেকো।”

কথাটা বলেই রূপসা বেরিয়ে যায়। তবে ড্রইংরুমে আসতেই সে দোতলার দিকে তাকালো। ধীরপায়ে সিড়ি ডিঙিয়ে হলরুপ পেরিয়ে এভির রুমের সামনে এসে দাড়ালো। বার কয়েক নক করতেই সায়মা এসে দরজা খুলে দেয়। অলি আর সায়মা ফোনে একটা মুভি দেখছিলো। আলভী কিছুক্ষণ আগেই বাইরে গেছে। পুরুষ মানুষ কতক্ষণই বা বদ্ধ রুমে থাকতে পারে? তবুও আলভী বলতে গেলে পুরো দিনই অলির সাথে সাথে থাকে।
রূপসাকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অলি চোখ বড়বড় করে রূপসার দিকে তাকায়। হাটার ক্ষমতা থাকলে সে এতক্ষণে উঠে গিয়ে রূপসার গালে দু ঘা লাগিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করতোনা।
“তুমি এখানে কি করছো? কেনো এসেছো? চলে যাও বলছি।”

রূপসা কোনোপ্রকার প্রতিউত্তর না করে দ্রুতপায়ে অলির সামনে এসে বসলো। তাকে নিজের এতো কাছে আসতে দেখে অলি হাত দিয়ে পেট আড়াল করতে লাগলো। সায়মার দিকে তাকিয়ে বলল,
“সায়মা আপু আপনার স্যারকে কল করুন।”

সায়মা মাথা নেড়ে কল করলো। রূপসা বেশকিছুক্ষণ অলির স্ফীত পেটের দিকে তাকিয়ে রইলো। অলির পেট ভালোই দৃশ্যমান হয়েছে। যে কেউ দেখেই বলে দিতে পারবে যে সে প্রেগন্যান্ট। রূপসার চাহনি দেখে না চাইতেও অলির শরীর শিরশির করে ওঠে। সে ভয় পাচ্ছে, অলিকে এভাবে ভয় পেতে দেখে রূপসা একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলল। অলি কিছু বুঝে ওঠার আগেই রূপসা তার বাম পা জড়িয়ে ধরে কান্না জুড়ে দিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় অলি মারাত্মকভাবে ভড়কে গেলো।
“আমাকে ক্ষমা করে দেও বোন। আমি জানি আমি যা করেছি তার কোনো ক্ষমা নেই। তবুও আমি ক্ষমা চাইছি তোমার কাছে।”

এরই মাঝে আলভী হন্তদন্ত হয়ে রুমে প্রবেশ করে। আলভীকে আসতে দেখে রূপসা অলির পা ছেড়ে দিয়ে আলভীর পা জড়িয়ে ধরতেই যাবে কিন্তু তার আগেই আলভী সরে দাঁড়ায়।
“তোর সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি। এতো কিছুর পরেও তুই আমার রুমে এসেছিস? তোকে এতো সাহস কে দিয়েছে?”

রূপসা ফ্লোরে হাটু মুড়ে বসে কাদতে কাদতে বলে উঠল,
“আমাকে ক্ষমা করে দেও ভাইয়া। আমি যা কিছু করেছি ভুল করেছি। আমি আর কখনো তোমাদের সামনেও আসবোনা।”

রূপসার মুখ থেকে ভাইয়া ডাক শুনে আলভী সরু চোখে তাকায়, “নাটক করছিস? আর ভাইয়া বলে কাকে ডাকছিস? তোর মতো নোংরা আর ফালতু মেয়ে আমার বোন হতে পারেনা। তোকে ৫ মিনিট টাইম দিলাম। এক্ষুনি এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা। নইলে আই স’আর আমি তোকে মে*রে ফেলবো।”

রূপসা কিছু বলতে চাইলে আলভী তার চুল টেনে ধরে,
“তোকে এবারের মতো কেনো ছেড়ে দিচ্ছি জানিস? আল্লাহ তোকে ভালো হওয়ার একটা সুযোগ দিয়েছেন। আর আমি সেই সুযোগ টা কেড়ে নিতে চাইনা। তবে আজকের পর আমার বা আমার ওয়াইফের ধারেকাছে এলে কিংবা আমাদের মাঝে ঝামেলা সৃষ্টি করতে চাইলে তোকে আর কোনো সুযোগ দেয়া হবেনা। ইউ হ্যাভ অনলি থ্রি মিনিটস।”

আলভী রূপসাকে দরজার দিকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“গেট লস্ট।”

রূপসা দরজার কাছে এসে নিজেকে সামলে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলো বাড়ির সবাই সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। রূপসা মাথা নিচু করে চোখজোড়া মুছে নিলো। তারপর কোনোদিকে না তাকিয়ে একছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলো।

***

অন্ধকার আচ্ছন্ন রুমটা যেন একটা নিস্তব্ধপুরী। ঘড়ির টুং টাং শব্দ জানান দিচ্ছে এখন মাঝরাত। অলি একদম সোজা হয়ে ঘুমিয়ে আছে, পাশেই আলভী অলির ঘাড়ে মুখ গুজে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। প্রথম প্রথম অসুবিধা হলেও আলভীর এই বদ-অভ্যাসের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে অলি। আলভী অলির ডান পাশে শুয়েছে, পেশিবহুল ডান হাতটা দিয়ে আলতো কোরে অলির কোমড় প্যাচিয়ে রেখেছে। বলতে গেলে সে একদম আয়েস করে ঘুমোচ্ছে। এরই মাঝে অলি ঘুমের মাঝেই হাসফাস করতে লাগলো। অলির খুব কাছে থাকায় মৃদু গোঙানির শব্দে আলভীর ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে লাফ দিয়ে উঠে অলিকে ডাকতে লাগলো।
“অলি… এই অলি?”

আলভী অলির গালে হাত ছুইয়ে দেখলো এসির মাঝেও অলি প্রচন্ড ঘামছে। আলভীর চোখে দিশেহারা আতঙ্ক, এক হাত দিয়ে অলির চুলের ভাজে আলতো হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সে বারবার ডাকতে লাগল, “হানিবি… শোনো, চোখ খোলো…”

ইদানীং প্রায় প্রতি রাতেই এমন হয়। অলি ঘুমের মধ্যে হঠাৎ কেঁপে ওঠে, শ্বাস দ্রুত হয়ে আসে, মনে হয় কোনো দুঃস্বপ্নের গভীরে আটকে আছে। কিন্তু ভোর হলেই সব যেন মিলিয়ে যায়। কি দেখেছিলো, কি দেখে ভয় পেয়েছিলো সেটা আর মনে থাকে না। কিছুক্ষণ পর অস্ফুটস্বরে কি যেন বলতে বলতে অলি হঠাৎই আলভীর শার্ট শক্ত করে খামচে ধরল। তার আঙুলের কাঁপুনি, শ্বাসের অনিয়ম সবই যেন বলে দিচ্ছে, সেই অদৃশ্য দুঃস্বপ্ন আবারও তাকে গ্রাস করেছে।

আলভী এবার একনাগাড়ে অলিকে ডাকতে লাগলো একপর্যায়ে অলির চোখ হালকা কাঁপল, আর ধীরে ধীরে সে জেগে উঠল। কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে আলভীর দিকে তাকিয়ে রইল, যেন এখনও সে ঘুমের ভেতরেই আছে। সেই অবস্থাতেই মৃদু স্বরে বলতে লাগলো,
“আমার জন্য একটা কাজ করতে পারবেন?”

আলভী অলির ঠোঁটের কাছে কান এগিয়ে দিলো,
“হুম বলো।”

অলি গভীর শ্বাস টেনে বলল,
“আমি তো নামাজ আদায় করতে পারবোনা… আপনি তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করে আলোর আর আমার বাবা মায়ের জন্য দোয়া করুন না, প্লিজ।”

কয়েক মুহূর্তের জন্য আলভী স্থির চোখে অলির দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর ধীরে মাথা নেড়ে বলল,
“আমি অবশ্যই করব।”

আলভীর কণ্ঠের দৃঢ়তা যেন অলির ভেতরের সব ভয় সাময়িকভাবে ধুয়ে দিল। তার ঠোঁটের কোণে এক টুকরো ক্লান্তি মিশ্রিত হাসি ফুটে উঠল,
আলভী বেডসাইড ল্যাম্প জ্বালিয়ে অলিকে ভালো করে শুইয়ে দিয়ে অজু করার উদ্দেশ্যে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
এই রাতে অলির কথামতো আলভী নামাজ আদায় করে সকলের জন্য দোয়া করলো।

***

সময় প্রবাহমান, সময়ের বটবৃক্ষ থেকে ইতোমধ্যে ৪৫ টা দিনের পাতা ঝড়ে গেছে।
আজকের সকালটা আলতো রোদে ভরা। জানালার কাঁচ দিয়ে ঢোকা সূক্ষ্ম আলোয় আলভীর কক্ষ ঝলমল করছে। অলির হাত পা দীর্ঘ দুই মাস প্লাস্টার দ্বারা ঢাকা থাকার পরে অবশেষে মুক্তির অপেক্ষায়।
আলভী অলির পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে একধরনের উদ্বেগ, অলির হাত পায়ের প্লাস্টার খোলা হবে আজকে সেই সুবাদেই দিহান, মির্জা ভিলাতে এসেছে। গত দেড় মাস বেশ নির্বিঘ্নে কেটেছে। রূপসা আর রুনা খাতুন না থাকায় বাড়ির পরিবেশ পুরোপুরি শান্ত। যদিও রূপসা চলে যাওয়ার পরেও আলভী কাজকর্ম বাদ দিয়ে পুরোটা সময় অলির পাশেই ছিলো। এই দেড়-দুমাস আলভী অলির এতোটা খেয়াল রেখেছে যে অলি বর্তমানে আলভীকে চোখে হারায়। সে একপলক চোখের আড়াল হলেই যেন অলির গলা শুকিয়ে আসে, শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়।

“ভাবী, আজকে কাস্ট গুলো খোলা হবে। নিশ্চয়ই খুব নার্ভাস লাগছে?”

দিহানের কথা শুনে অলি তার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে জানাল,
“হ্যাঁ একটু, কিন্তু অনেকদিন পর মুক্তি পাবো, ভেবেই আনন্দ লাগছে।”

সায়মা এগিয়ে এসে মেশিনটি সাবধানে প্লাস্টারের উপর ধরল, আলতো করে ছেদ করতে শুরু করল। প্লাস্টার ভাঙার শব্দে অলি প্রথমে কিছুটা ভয় পেলেও আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে যায়। বেশ কয়েক মিনিটের চেষ্টায় সায়মা অলির হাত পায়ের প্লাস্টার পুরোপুরি খুলে ফেলতে সক্ষম হলো। অলি নিজের হাত পায়ের দিকে তাকিয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। এতদিন প্লাস্টারের নিচে চাপা পড়ে থাকা ত্বকে ভাজ পড়ে গেছে আর ফ্যাকাশে হয়ে আছে। কিন্তু সেসবের মাঝেও অলির ভীষণ হাল্কা হাল্কা লাগছে। অলি আনমনেই বিড়বিড় করে উঠলো,
“আমি হাঁটতে পারব!”

আলভী অলির কাধে হাত রেখে বলল,
“হুম তোমার হাত পায়ের ফ্রাকচার পুরোপুরি ঠিক হয়ে গেছে। এখন চাইলেই তুমি হাটতে পারবে। কিন্তু পায়ের উপর বেশি প্রেশার দেয়া যাবেনা।”

তার কথার মাঝেই ঊর্মিলা দিহানের জন্য চা নাস্তা নিয়ে এলো। ঊর্মিলাকে এসব নিয়ে আসতে দেখে আলভী বলল,
“তুই আবার এতো কাজের কবে থেকে হলি?”

ঊর্মিলা মৃদু হেসে বলল, “ভাবীকে দেখতে এমনিতেই আসতাম, ভাবলাম এগুলোও নিয়ে আসি।”

“ভার্সিটি বন্ধ আজকে?”

ঊর্মিলা মনে মনে ভারী বিরক্ত হলো। সে দিহানের দিকে চা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আজকে থেকে ইয়াদ ভাইয়াদের পরীক্ষা। সেই জন্যই বন্ধ দিয়েছে।”

কথাটা শুনে আলভী চমকে তাকালো,
“ইয়াদের পরীক্ষা? কই ও তো আমাকে কিছুই বললোনা। ও পরীক্ষার মধ্যে একা হাতে অফিস সামলাবে কিভাবে?”

ঊর্মিলা একটা শ্বাস ফেলে বলল,
“তোকে বললেও কি হতো ভাইয়া? তুই কি ভাবীকে রেখে যেতে পারবি? পারবিনা তো। সেই জন্যই হয়তো ইয়াদ ভাইয়া শুধু শুধু তোকে টেনশন দিতে চায়নি।”

তাদের কথার মাঝেই অলি আলভীর শার্টের কোণা ধরে টানতে লাগলো। সে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের পায়ে দাড়াতে চায়। আলভী বিরক্ত হয়ে অলির দিকে তাকাতেই অলি শার্ট ছেড়ে দেয়, আলভী ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আলতো হাতে অলির বাম বাহু ধরে তাকে ওঠাতে লাগলো। ফ্লোরে পা রাখতেই অলির সারা শরীর ঝংকার তুলল কিন্তু পরক্ষণেই আলভীর সহানুভূতিশীল তদারকি এবং সায়মার সহায়তায় অলির পা আবার স্বাভাবিকভাবে ভার বহন করতে পারছে।
যদিও এই প্রথম অলির মনে হচ্ছে তার পেটের ওজন বেড়ে গেছে। মূলত এই বাড়তি ওজন সামলাতে গিয়েই সে হিমশিম খাচ্ছে। অলি সাথে সাথেই ডান হাতটা দিয়ে বাড়ন্ত পেট আগলে ধরলো। অলিকে এই অবস্থায় দেখে আলভী যেন চোখই সরাতে পারছেনা। অলি যেন এই কয়েকদিনে বড় হয়ে গেছে। আলভীকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অলি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলো ওড়না ঠিকঠাকই আছে। তবুও সে ওড়নাটা টেনে পেট ঢাকার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলো।
একদিকে দিহান আর ঊর্মিলা গল্প করছে, আরেকদিকে অলি আর আলভী যেন অন্য দুনিয়ায় বিচরণ করছে। আলভী এক দৃষ্টিতে অলির দিকে তাকিয়ে আছে আর অলির দৃষ্টি ফ্লোরে নিবদ্ধ, তাদের এই অবস্থা দেখে সায়মা খুক খুক করে কেশে উঠলো। মুহুর্তেই আলভীর হুশ এলো সে চোখ সরিয়ে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। আলভী অলির হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল,
“দেখো একা হাটতে অসুবিধা হচ্ছে কিনা।”

অলি প্রথমে কিছুটা টালমাটাল হয়ে গেলেও খুব একটা সমস্যা হলোনা। অলির চোখে মুখে খুশির জোয়ার, তার ইচ্ছা করছে পুরো বাড়ি হেটে বেড়াতে। দিহান আরও কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে নিজের কাজে চলে গেলো।

বিকেলের সময়, সায়মা কতগুলো ফল কেটে অলির সামনে ধরতেই অলি ফিসফিসফিসিয়ে বলল,
“সায়মা আপু আমি এগুলো খাবোনা। আমি আচার খাবো।”

সায়মা একটা ঢোক গিলে পাশে তাকিয়ে দেখলো আলভী ব্যালকনিতে গিয়ে ফোনে কথা বলছে। সে একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল,
“এখন না, তোমাকে লুকিয়ে আচার সাপ্লাইয়ের ব্যাপারটা স্যার জানতে পারলে আমাকে কাজ থেকে বের করে দেবেন।”

অলি ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “ঊর্মি আপু একদম ঠিক বলে উনি একটা লাটসাহেব, সবসময় আমি যা করতে চাইবো সেটাতেই এসে নাক গলাবে।”

অলি কথা বলাতে এতোটাই ব্যস্ত ছিলো যে আলভী যে কখন তার পেছনে এসে দাড়িয়েছে সেটা সে বুঝতেও পারলোনা। সায়মা চোখ দিয়ে ইশারা করলেও অলি খেয়াল করলোনা,
“সায়মা, যান এখন।”

আলভীর ঠান্ডা কন্ঠ শুনে অলি ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখলো আলভী একহাত প্যান্টের পকেটে গুজে দাঁড়িয়ে আছে আরেক হাতে ফোন স্ক্রোল করছে। সায়মা উঠে যেতে নিলে অলি তার ওড়না টেনে ধরে। আলভী বিরক্তি সূচক শব্দ উচ্চারণ করে ফের বলল,
“কয়বার বলতে হবে?”

সায়মা অলির থেকে নিজের ওড়না ছাড়িয়ে দ্রুতপায়ে রুম ত্যাগ করলো। অলিও তার পিছুপিছু উঠে চলে যেতে নিলে আলভী তার হাতের কব্জি টেনে ধরে৷ অলি তার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
“আমি দাদুমনির কাছে যাবো। কতোদিন হলো তাকে দেখিনা।”

অলি কথাটা শেষ করার সাথে সাথেই আলভী তাকে টেনে খাটের উপর বসিয়ে নিজে ফ্লোরে হাটু মুড়ে বসে বলল,
“ফ্রুটস গুলো খেয়ে তারপর যাও।”

অলি চোখমুখ কুচকে ফেললো, “এখন না প্লিজ কিছুক্ষণ আগেই লাঞ্চ করেছি।”

“না খেলে যেতে দিচ্ছিনা।”

বাধ্য হয়েই অলি ফলগুলো খেতে লাগলো, এরই মাঝে আলভী বলে ওঠে,
“আচ্ছা আমি কি সত্যিই তোমার কাজে সবসময় নাক গলাই?”

কথাটা শুনে অলির গলায় ফলের টুকরো আটকে গেলো। আলভী একটা শ্বাস ফেলে অলির দিকে পানি এগিয়ে দিলো। অলি পানিটুকু খেয়ে মুখ মুছে নিলো,
“ভাবছি এখন তো তুমি হাটাচলা করতেই পারো। আমার বোধহয় এবার অফিস আর হসপিটালের কাজকর্মে নাক গলানো উচিৎ তাইনা?”

আলভী অদ্ভুত চোখে অলির দিকে তাকাতেই অলি একটা ঢোক গিলল,
“আপনার ইচ্ছা। আমি কি বলবো?”

আলভী হয়তো এই কথায় রাগ করলো। সে উঠে যেতে নিলে অলি বলে ওঠে,
“কোথায় যাচ্ছেন?”

“অফিসে যাবো।”

অলির এবার খারাপ লাগতে শুরু করলো। আলভীর সঙ্গ তার অভ্যাসে পরিনত হয়েছে,
“এখনই যাবেন?”

“হু।”

অলি উঠে আলভীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু আলভী তার দিকে ফিরেও তাকালো না। আলভী কাভার্ডের দিকে যেতে নিলে অলিও তার পিছুপিছু গেলো। আলভীকে রেডি হতে দেখে এবার অলি বলেই ফেলল,
“যাবেন না প্লিজ।”

অলির কথায় আলভীর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে, তবুও অলির দিকে না তাকিয়েই বলে,
“কেনো?”

“আমার ভালো লাগবেনা।”

“সায়মা আছেই তো। তাছাড়া তুমি তো দাদুমনির কাছে যেতে নিচ্ছিলে, যাও সেখানে।”

অলির এবার ভীষণ কান্না পেলো৷ লোকটা বুঝেও না বোঝার ভান করছে নাকি? অলি নাক টেনে বলল,
“আপনি যাবেন না প্লিজ।”

“কিন্তু কেনো?”

অলি মিনমিনিয়ে বলে উঠলো,
“আমি… আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবোনা।”

অলির কথাটা শুনে আলভী থমকে গেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে অলির দিকে তাকাতেই তার চোখজোড়া আবারও অলির পেটের উপর গিয়ে আটকে গেলো। নার্ভাসনেসের ঠেলায় অলি হাত কচলাচ্ছে। চোখ দুটোও ফ্লোরে নিবদ্ধ। আলভীর থেকে প্রতিউত্তর না পেয়ে অলি আলভীর দিকে তাকায়। আলভীর চাহনি লক্ষ্য করতেই সে খানিকটা আনকম্ফোর্টেবল ফিল করতে লাগলো। আলভী কেনো তার পেটের দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে সেটাই সে বুঝে উঠতে পারছেনা।
“তুমি বেবির নড়াচড়া অনুভব করো?”

আলভীর কথায় অলি বোকাচোখে তার দিকে তাকালো। পরক্ষনেই না বোধক মাথা নেড়ে বলল,
“অনেকদিন আগে একবার করেছিলাম।”

“তোমার তো ২৮ সপ্তাহ চলছে তাইনা?”

অলি কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা করে বলল,
“সাড়ে ছয় মাস।”

চলবে,,,

#১৫_বছর_বয়সী_মা (৪৭)
#সোফিয়া_সাফা

আলভী কিছুক্ষণ অলির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“তো? ২৮ সপ্তাহ আর সাড়ে ছয় মাস কি একসমান নয়?”

অলি ভ্রু কুচকে তাকালো। আলভী ঠিকই বলেছে,
“আই থিংক আমাদের একবার হসপিটালে যেতে হবে।”

“কেনো? হসপিটালে যাবো কেনো?”

“তুমি বেবির নড়াচড়া অনুভব করছোনা। তোমার কি মনে হয়, ২৮ সপ্তাহে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার?”

অলি কথাটা বুঝতে পারলোনা।
“স্বাভাবিক ব্যাপার নয় মানে?”

আলভী হয়তো অলিকে কিছু বলতে চাইলো কিন্তু অলির চেহারাটা দেখে সে আর বলে উঠতে পারলোনা। সে জানে এই কথাটা অলিকে বললে, অলি অনেক চিন্তায় পড়ে যাবে।
“কিছুনা, রেডি হয়ে নেও।”

***

ঘড়ির কাটা জানান দিচ্ছে এখন সময় ৬ টা। অলিকে নিয়ে আলভী হসপিটালে এসে পৌছেছে। তারা করিডর দিয়ে হেটে যাচ্ছিলো তখনই অলি বলে ওঠে,
“একটা বিষয় জানানোর ছিলো,”

“হুম বলো।”

বেশ কিছুক্ষণ পেরিয়ে গেলো, কিন্তু অলি কথাটা বলে উঠতেই পারছেনা। আলভী ফোন চাপছিলো, সে এবার ফোনটা পকেটে রেখে অলির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো, অলি তার থেকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে। আলভী পিছিয়ে এসে দেখলো অলি ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে হাত কচলাচ্ছে, আলভী একটা শ্বাস ফেলল,
“এরকম করছো কেনো? যা বলতে চাইছো বলে ফেলো।”

অলি আলভীর শার্টের বাটনের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো,
“আসলে আমার সব জামাকাপড় টাইট হয়ে গেছে…

আলভী ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নিজের উপরেই খানিকটা বিরক্ত হলো। তার এই বিষয়ে খেয়াল রাখা উচিৎ ছিলো।
“আ…এখান থেকে বেরিয়ে আমরা শপিং করতে যাবো।”

অলি মাথা নিচু রেখেই ডান দিকে ঘাড় কাত করলো। অলির এই ব্যাপার গুলো আলভীর কাছে অনেক কিউট লাগে। ইচ্ছা করে আদূরে ভঙ্গিতে গাল টেনে দিতে। আলভী এবার অলির হাত ধরে হাটতে লাগলো। কিছুদূর যেতেই অলি আবারও বলে ওঠে,
“আল্ট্রাসনোগ্রাম কে করবে?”

“চিন্তা কোরোনা, একজন ফিমেল রেডিওলজিস্ট করবে।”

অলি দাঁড়িয়ে পড়লো, আলভী কিছু বুঝে ওঠার আগেই অলি বলে উঠলো,
“আমি চাই আজকের আল্ট্রাসনোগ্রাম টা আপনিই করুন।”

আলভীর চোখজোড়া বিস্ময়ে বড়বড় হয়ে গেলো। অলি নিজে থেকেই তাকে আল্ট্রাসাউন্ড করতে বলছে?
“আর ইউ সিওর?”

অলি হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো। ফলস্বরূপ আলভীর ঠোঁটের কোণে সুক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠলো। আলভী পুনরায় অলির হাত ধরে সনোগ্রাফি রুমে নিয়ে এলো। অলিকে বেডে বসিয়ে দিয়ে আলভী স্ক্রিটের সামনে বসলো। অলি একটা শ্বাস ফেলে বিনাবাক্যে বোরকা টা বুক পর্যন্ত তুললো। তারপর কাপা কাপা হাতে টপস সরাতেই ফর্সা পেট উন্মুক্ত হয়ে গেলো। আলভী প্রোবটা হাতে নিয়ে অলির দিকে তাকাতেই দেখলো অলি চোখমুখ খিচে বন্ধ করে রেখেছে। আলভী অলির দিকে খানিকটা ঝুকে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার অস্বস্তি লাগলে আমি চলে যাচ্ছি।”

অলি ফট করে চোখ খুলে না বোধক মাথা নাড়ে। আলভী মৃদু হেসে অলির পেটের দিকে তাকালো। তারপর একটা শুষ্ক ঢোক গিলে প্রোবটা নামিয়ে রেখে জেলের বোতল খুলল।
“জেলটা একটু ঠান্ডা লাগবে,”

বলেই পেটের ওপর পাতলা করে জেল মাখিয়ে দিয়ে প্রোবটাতেও জেল মেখে নিলো। রুমের লাইটের আলো ডিম করে দিয়ে স্ক্রিনের আলোটা বাড়িয়ে দিলো।
প্রোব ছোঁয়াতেই স্ক্রিনে দানা-দানা ছায়া পরিষ্কার হয়ে গোল মাথার আউটলাইন দেখা দিল। আলভী গলার স্বর নামিয়ে অলির দিকে তাকায়,
“স্ক্রিনে দেখো…এটা মাথা। এই যে সরু সরু দাগ দেখছো এটা মেরুদণ্ড।”

সে প্রোবটা অন্যদিকে ঘোরাতেই স্পন্দন ধরা পড়ল। আলভী ডপলার চালু করতেই ঘরটা টুং-টুং শব্দে ভরে উঠল। আলভী একদৃষ্টে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
“এটাই ওর হার্টবিট। রেটটা প্রায় একশো চল্লিশের আশেপাশে, যার মানে নরমাল আছে,”

অলি অন্যমনস্ক হয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইলো।
“আচ্ছা ও নড়ছেনা কেনো…”
অলির কন্ঠস্বর আটকে আসছে। চোখের কোণেও পানি জমেছে।

আলভী প্রোবটা একটু উপরে টেনে নিয়ে ডানে বামে ঘুরিয়ে নিল। স্ক্রিনে শিশুটির হাত হালকা ভাঁজ হয়ে খুলে গেল, পায়ের দিক থেকেও ক্ষীণ নড়াচড়া পরিলক্ষিত হলো। আলভী স্ক্রিনে আঙুল রেখে বলল,
“মুভমেন্ট আছে, এই দেখো এখনই হাত পা নাড়ল,”

অলি মুখটা ছোটো করে বলল, “কই? আমি তো কিছুই অনুভব করিনি।”

আলভী আরও কিছু বিষয় পর্যবেক্ষণ করে বলতে শুরু করলো,
“তোমার প্লাসেন্টা সামনে দিকে, যাকে ‘অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টা’ বলা হয়। বেবি নড়লে ধাক্কাগুলো আগে প্লাসেন্টাতেই লাগে, প্লাসেন্টা অনেকটা কুশনের মতো ধাক্কাগুলোকে শুষে নেয়। তাই তুমি কম টের পাচ্ছো। এটা কমন, চিন্তার কিছু নেই।”

আলভী এবার স্ক্রিনে ছোট ছোট ক্যালিপার বসিয়ে মাপগুলো নিতে লাগলো। মাথার ব্যাস, পেটের ঘের, উরুর হাড়ের লম্বা। সবশেষে সে শান্ত গলায় বলল,
“গ্রোথ এজ ঠিকই আছে, আঠাশ সপ্তাহের সাথে প্রায় মিলছে,”

প্রোব নিচের দিকে নামিয়ে আবারও বলল,
“ফ্লুইডও ভালো আছে। এই যে…এটা পজিশন। চিন্তার কিছু নেই এই বয়সেও পজিশন পাল্টায়, শেষের দিকে মাথা নিচের দিকে চলে আসবে।”

অলি এতোকিছু না বুঝলেও নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সায় জানালো। তার কপালের টানটান ভাবটা একটু নরম হয়েছে। আলভী কতগুলো টিস্যু দিয়ে জেল মুছিয়ে দিতে দিতে বলল,
“তুমি হয়তো সবসময় নড়াচড়া টের পাবে না। বিশেষ করে বসা অবস্থায় বা হাঁটাচলা করলে। তবে রাতে পাশ ফিরে শুয়ে শান্ত হয়ে থাকলে টের পাওয়ার চান্স আছে।”

আলভী শেষ বারের মতো আরও একবার স্ক্রিনে চোখ বুলালো। ছোট্ট ইমেজটা স্পষ্ট, নাক-ঠোঁটের রেখা, বুকের ভেতর অনবরত ধকধক। আলভী মনে মনে আওড়ালো,
“হার্টবিট স্টেবল, মুভমেন্ট প্রেজেন্ট, প্লাসেন্টা অ্যান্টেরিয়র, সব ঠিক আছে”

“থ্যাঙ্ক ইউ, আমাকে এতো ভালোভাবে বুঝিয়ে বলার জন্য”

অলির মিনমিনিয়ে বলা কথাটা শুনে আলভী ভ্রু কুচকে তাকালো। রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে বলল,
“ধন্যবাদ দিচ্ছো কেনো? শোনো তোমার কাছ থেকে ধন্যবাদ পাওয়ার জন্য আমি কিছুই করিনি। অন্য কেউ এসে সারাদিন ধন্যবাদ দিলেও আমি কোনো প্রেগন্যান্ট মহিলার আল্ট্রাসাউন্ড করতাম না।”

অলি টপস আর বোরকা ঠিকঠাক করে উঠে বসলো।
“এভাবে বলছেন কেনো? আগেরবার করতে চেয়েছিলেন বলেই তো আমি এবার আপনাকেই করতে বললাম।”

আলভী একটা শ্বাস ফেলে বলল,
“তুমি ভাবতেও পারছোনা যে তুমি যখন বললে বেবির নড়াচড়া ফিল করতে পারোনা তখন আমি কতোটা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। তাও তুমি যে আমাকে আল্ট্রাসাউন্ড করতে দিলে সেই জন্য তুমি অবশ্যই একটা থ্যাংকস ডিজার্ভ করো। নিজের চোখে না দেখলে আমি কিছুতেই চিন্তামুক্ত হতে পারতাম না।”

অলি অবিশ্বাসী চোখে আলভীর দিকে তাকায়,
“বেবির নড়াচড়া অনুভব না করাটা যে চিন্তার বিষয় সেটা আপনি তখন কেনো বললেন না?”

“বললে কি হতো? তুমিই তো বেবিটাকে প্রেশারে রাখো। সেই জন্যই বেবিটা এতো কম এক্টিভ। আমি যদি তখন বলে দিতাম তাহলে তুমি আরও চিন্তা করতে আর তোমার সব প্রেশার গুলো গিয়ে পড়তো বেবিটার উপর।”

অলি মুখটা কাচুমাচু করে ফেললো।

***

রাতের আধারে প্রকৃতি নিমজ্জিত হয়েছে। তবুও কৃত্রিম আলোয় শপিং মলটা ঝলমল করছে। এখন যে রাত্রিবেলা সেটা বোঝার জো নেই। আলভী অলিকে নিয়ে একটা দোকানে এসে বসলো,
“তোমার যা যা লাগে নিয়ে নেও।”

অলি পুরো দোকানে একবার চোখ বুলালো। দোকানের সিলিংয়ে লাগানো হরেক রকম লাইটের আলোয় তার চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে। সে তিশার বিয়ে উপলক্ষে একবার বাবা মায়ের সাথে এই শপিং মলে এসেছিলো। ভাবতেই তার চোখজোড়া চিকচিক করে উঠলো। আলভী সেটা লক্ষ্য করে সাবধানতা সহিত বলল,
“বেশি সময় নেই অলি। তারাতাড়ি করো।”

অলি আড়ালে চোখদুটো মুছে শান্তকন্ঠে বলল,
“কিছু টপস আর স্কার্ট দেখান ফ্রি সাইজের।”

দোকানি একবার অলির দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলো তার জন্য কেমন স্টাইলের জামাকাপড় পার্ফেক্ট হবে। এই অবস্থায় ঢিলেঢালা পোশাকই পরিধান করা উচিৎ। সেই হিসেবেই সে বেশ অনেকগুলো জামা কাপড়ের কালেকশন বের করে দিলো। এত এত কালেকশন দেখে অলি বিড়ম্বনায় পড়ে গেলো। নিজে থেকে কোনো কিছু কেনার অভ্যাস তার নেই। এই পর্যায়ে এসে মায়ের জন্য মনটা খুব পুড়ছে। মা বরাবরই তার জন্য জামাকাপড় পছন্দ করে দিতেন। লোকে বলে কেউ মা*রা গেলে তার জন্য কোনোকিছুই নাকি থেমে থাকেনা।
কিন্তু অলির মতো অনাথ ছেলেমেয়েরা বোঝে মা বাবা ছাড়া জীবন কতোটা দুর্বিষহ। কতটা অন্ধকার আচ্ছন্ন। অলির যেই সময়ে মাকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেই সময়েই তার মা বাবা দুজনেই তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। অলি ঠোঁট চেপে কান্না গুলো গিলে ফেলতে চাইলো কিন্তু ব্যার্থ হলো। আলভী কি করবে বুঝে উঠতে পারলোনা। শপকিপার দুজনও অলির কান্না দেখে হকচকিয়ে গেছেন। আলভী একটা শ্বাস ফেলে অলিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“আহা কাদছো কেনো? কি হয়েছে? আমাকে বলো।”

অলি মাথা নিচু করে বলল,
“মা…বাবার কথা মনে পড়ছে। মা বাবাই সবসময় আমার জন্য জামাকাপড় পছন্দ করে দিতেন। আমি কখনো নিজে পছন্দ করতে পারিনি।”

“প্লিজ কান্না কোরোনা।”

অলি ফুপিয়ে উঠতেই আলভী বলে ওঠে,
“আমি তোমার জন্য পছন্দ করে দিচ্ছি।”

আলভী অলির চোখদুটো মুছে দিয়ে কাপড় সিলেক্ট করতে লাগলো। প্রায় ৩৫ সেটের মতো ড্রেস সিলেক্ট করে সে থামলো। আলভীর কান্ড দেখে অলি কান্না ভুলে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে,
“আপনি এতোগুলো কেনো সিলেক্ট করলেন? একবারে কেউ এতো গুলো কাপড় কেনে?”

আলভী অলির দিকে তাকিয়ে বলল,
“কমাতে পারবোনা। সিলেক্ট কৃত সবগুলোই পছন্দ হয়েছে। তবে তুমি চাইলে আরও সিলেক্ট করতে পারি। করবো?”

অলি নাবোধক মাথা নাড়লো। সবগুলো কাপড় প্যাক করে বিল মিটিয়ে তারা বের হয়ে গেলো। কিছুদূর আসতেই অলি একটা দোকানের সামনে এসে থেমে যায়। আলভী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়,
“কি হলো? আর কিছু লাগবে?”

অলি মাথা নেড়ে আঙুল দিয়ে একটা দোকানের দিকে ইশারা করতেই আলভী থমকে গেলো।
“ওটা তো বেবিস কর্ণার।”

অলি বাম হাতটা পেটের উপরে রেখে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। আলভী তার দিকে অনেকটা ঝুকে গিয়ে বলল,
“পরেরবার থেকে কিছু লাগলে ফ্লোরের দিকে নয় আমার দিকে তাকাবে। কারণ ফ্লোরের দিকে তাকালে আমার হিংসে হয়। মনে হয়—তুমি আমার হক নষ্ট করছো।”

আলভীর সোজাসাপ্টা কথা শুনে অলির গালজোড়ায় রক্তিম আভা ফুটে উঠলো। আলভীর দুহাত শপিং ব্যাগে ভর্তি। সে নিজের বাম বাহু অলির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
“প্রয়োজন ছাড়া তো ভালোই আমার শার্ট ধরে টানাটানি করতে পারো। এখন যখন দেখছো হাত ভরা থাকায় তোমার হাত ধরতে পারছিনা। তখন নিজে থেকেও তো হাতটা ধরতে পারো নাকি?”

অলি হকচকিয়ে আলভীর দিকে তাকাতেই আলভী ইশারায় নিজের বাহু ধরতে বললো। অলি একটা ঢোক গিলে আলতো হাতে আলভীর বাহু আঁকড়ে ধরলো। আলভী এবার অলিকে নিয়ে বেবিস কর্ণারে এলো ঠিকই কিন্তু অলির মনোভাব বুঝে উঠতে পারলোনা।
চারদিকে সাজিয়ে রাখা বাচ্চাদের জিনিসপত্র দেখে অলির চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো। তার ইচ্ছা করছে এখানে থাকা সবকিছু কিনে নিয়ে যেতে। কতো কিউট সবকিছু আহা! অলি ছেলে বাবুদের কর্ণারে এসে জামাকাপড় দেখতে লাগলো। সেখান থেকে কয়েকটা জামাকাপড় আর একজোড়া জুতো তার খুব পছন্দ হলো। সেই সাথে সে বেশ কিছু খেলনাও পছন্দ করলো। আলভী মনে মনেই আওড়ালো,
“এখন তো দিব্যি সিলেক্ট করতে পারছে। তখন নিজের জন্য তো কিছুই সিলেক্ট করতে পারছিলোনা। ডাম্ব গার্ল।”

শপিং বেশি হয়ে যাওয়াতে আলভী একটা ট্রলি এনে সবগুলো শপিং ব্যাগ সেটার মধ্যে নিলো। কিন্তু অলির এখনো শপিং করা হয়নি। এই সুযোগে বাচ্চাদের জন্য প্রয়োজনীয় a-z সবকিছুই সে কিনে নিচ্ছে। আলভী হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো এখন দশটা ছয় বাজে। শপিং শেষে অলি ক্লান্ত হয়ে আলভীর সামনে এসে দাঁড়ায়। আলভী ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে বলে,
“শেষ?”

অলি মিষ্টি হেসে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে।
“ওকে চলো তাহলে।”

আলভী স্লিপ নিয়ে বিল মিটিয়ে দোকান থেকে বের হতেই অলি পেছন থেকে বলে ওঠে,
“এই যাহ, আমার আর আলোর জন্য কতোকিছু কিনলাম কিন্তু আপনার জন্য তো কিছুই কিনলাম না।”

আলভী এবার কিছুটা বিরক্ত হলো,
“অলি…আমার কিছুই লাগবেনা। তোমাদের জন্য শপিং করতেই তো এসেছিলাম। প্লিজ চলো আ’ম হাংরি।”

অলি বুঝতে পারলো আলভী এতোক্ষণ যাবত অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে গেছে। তাই সে কথা না বাড়িয়ে আলভীর পিছু পিছু হাটতে লাগলো। আলভী শপিং ব্যাগগুলো সব গাড়ির ব্যাক সিটে রেখে দরজা বাইরে থেকে লক করে দিলো। তারপর অলির উদ্দেশ্যে বলল,
“প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে চলো কিছু খেয়ে নেই।”

আলভী অলিকে নিয়ে ডিনার করার জন্য রেস্টুরেন্টে এলো। খাওয়ার একপর্যায়ে অলি বলে ওঠে,
“আমাদেরকে এতোকিছু কিনে দেওয়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।”

আলভী কয়েক সেকেন্ড অলির দিকে তাকিয়ে থেকে বিরবির করে বলল,
“ধন্যবাদ জানিয়ে ধন্য করেছে আমাকে। এখন এই ধন্যবাদ ধুয়ে ধুয়ে পানি খাবো আমি।”

অলি কথাটা পুরোপুরি শুনতে পায়নি সে ভ্রু কুচকে বলল,
“কিছু কি বললেন?”

আলভী মেকি হেসে বলতে লাগলো, “বলেছি ধন্যবাদ জানিয়ে আমাকে ধন্য করেছেন এবার চুপচাপ খাবার গুলো খেয়ে আমাকে উদ্ধার করুন মাই লর্ড।”

আলভীর কথা বলার ধরন শুনে অলি মুখ চেপে হেসে উঠলো। আলভী একটা শ্বাস ফেলে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। খাওয়া দাওয়া শেষে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।

বাড়িতে এসে বোরকা খুলে ফ্রেশ হয়ে এশারের নামাজ আদায় করে নিলো অলি। তারপর আলমারি খুলে একসাইড খালি করে সেখানে বাচ্চার জন্য আনা সব কাপড়চোপড় গুছিয়ে রাখতে লাগলো। আলভী ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো অলি বাচ্চার জন্য আনা দোলনা টা রুমের এককোনায় গুছিয়ে রাখছে। আলভী একটা শ্বাস ফেলে বেডের উপর বসলো। অলি সবকিছু গুছিয়ে রেখে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়াতে লাগলো। আলভী অনেক দিন পর অলিকে নিজের চুল নিজেকে আচড়াতে দেখছে। আলভী উঠে গিয়ে অলিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। অলির সারা শরীর শিরশির করে উঠলো। আলভী অলির গলা থেকে ওড়না টা সরিয়ে ঘাড়ে মুখ গুজে দিলো।
“ক…কি করছেন?”

আলভী অলিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
“বউকে আদর করছি কিন্তু বউ কি এটাও বুঝতে পারছেনা?”

অলি ঠোঁট কামড়ে স্কার্টের একপাশ খামচে ধরলো। আলভী অলির থুতনি উঁচু করে বলল,
“বউ কি স্বামীকে কিভাবে ধন্যবাদ জানাতে হয় সেটাও জানেনা?”

অলি লজ্জাবতী গাছের পাতার ন্যায়ে নুইয়ে গেলো। আলভী অলির মুখটা দু হাতের আঁজলায় নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“বউকে সবকিছুই শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে দেখছি।”

আলভী অলিকে চুমু খেতে গেলে অলি মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আলভীও হাল না ছেড়ে অলির গলায় মুখ ডুবিয়ে আলতো চুমু খেতে লাগলো। অলি দিশেহারা হয়ে আলভীর পিঠের শার্ট খামচে ধরলো। ফলস্বরূপ আলভী অলির চুলের মাঝে আঙুল গলিয়ে দিয়ে তার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। অলি আলভীর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে নিজের ঠোঁটজোড়া মুখের ভেতরে লুকিয়ে নিলো। এতে করে আলভী হাসফাস করে উঠলো কয়েকটা শুষ্ক ঢোক গিলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলো কিন্তু পারলোনা। ক্রমশই তার ধৈর্য্যের বাধ ভেঙ্গে যাচ্ছে। একপর্যায়ে সে না পেরে অলির গালজোড়া চেপে ধরলো। অলি ব্যাথায় ককিয়ে উঠতেই আলভী অলির অধর জোড়া নিজের আয়ত্তে নিয়ে নেয়। আলভীর কপালে বিরক্তির ভাজ পড়েছে। সে আক্রোশ মেটাতে অলির ঠোঁট কামড়াতে লাগলো। অলি ছটফট করে আলভীকে সরিয়ে দিতে চাইলো কিন্তু পারলোনা। উল্টো ক্ষিপ্ত আলভী আরও বেশি হিংস্র উঠলো।
বেশ অনেকক্ষণ পর,
আলভী পরিতুষ্ট হয়ে অলির ঠোঁট জোড়া ছেড়ে দেয়। অলি নিজের ঠোঁট জোড়া যেন অনুভবই করতে পারছেনা। মনে হচ্ছে তার ঠোঁট জোড়া কেউ শরীর থেকে আলাদা করে ফেলেছে। আলভী অলির ঠোঁটের দিকে তাকাতেই থমকে গেলো,
“শিট”

অলির চোখের কোণে পানি জমেছে। সে নিজের ঠোঁটে হাত দিতে গেলে আলভী আটকে দিয়ে বলে,
“স…স্যরি হা…নিবি।”

আলভীর হাতের বাধন আলগা হতেই অলি আয়নার দিকে তাকায়। নিজের র*ক্তাক্ত ঠোঁটজোড়া পরিলক্ষিত হতেই অলি আঁতকে ওঠে, আলভী হতাশায় নিজের চুল টানতে লাগলো। কিছুক্ষণ আগে সে নিজের মধ্যেই ছিলোনা যেন। অলি একটা টিস্যু নিয়ে ঠোঁটের র*ক্ত গুলো মুছে নিলো।
“স্যরি হানিবি। আমি ইচ্ছা করে…

অলি পুনরায় চিরুনী টা হাতে নিয়ে আলভীর দিকে না তাকিয়েই বলল,
“আপনি এরকম টা করে কি মজা পান আমি বুঝিনা। অদ্ভুত মানুষ আপনি।”

আলভী এক্সপ্লেইন করার মতো ভাষা খুঁজে পেলোনা। শুধু বিড়বিড় করে বলল,
“ফিলিংস গুলো ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।”

***

দু’সপ্তাহ কেটে গেছে। সূর্যের আলো জানালার ফাঁক গলে নরম ছায়া ফেলেছে রুমের ফ্লোরে। অলি এখন সাত মাসের গর্ভবতী। শরীরের ভার ও ক্লান্তি নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠলেও, নিজের ভেতরে থাকা ছোট্ট প্রাণের অস্তিত্বটার জন্য দিনগুলো সহ্য করে যাচ্ছে। অলি সারাটা দিন নিজের রুমেই কাটিয়েছে। কখনও জানালার পাশে বসে বাবা মায়ের কথা ভেবে নিঃশ্বাস ফেলেছে, কখনও বা বিছানায় হেলান দিয়ে ইউটিউবের ফিডে স্ক্রোল করেছে। শরীর আগের তুলনায় ভারী হয়ে এসেছে, সাত মাসের পেট নিয়ে আগের মতো আর স্বাচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারেনা। আজকে বাড়িতে, সে, দাদুমনি আর শাহানাজ বেগম ছাড়া কেউ নেই। আলভী খুব সকালেই একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এটেন্ড করতে বাকিদের সাথে অফিসে গেছে। নূরনাহার বোনের অসুস্থতার কথা শুনে ২ দিন আগেই বোনের বাড়িতে ছুটে গেছেন। ঊর্মিলা এখনো ভার্সিটি থেকে ফেরেনি।

বিকেলের দিকে একটু হাঁটার উদ্দেশ্যে ধীরপায়ে সিড়ি ডিঙিয়ে ড্রইংরুমে আসতেই অলি থমকে দাঁড়াল। শাহানাজ বেগম সোফায় বসে আছেন, মাথা হেলানো, চোখ আধবোজা। যেন ঝিমুচ্ছেন। তার ঠোঁটের ফাঁক থেকে অদ্ভুত গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে। অলি কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে এগিয়ে গেল। শাশুড়ির সঙ্গে তার সম্পর্ক কোনো কালেই সহজ ছিল না। তবুও শাশুড়িকে এই অবস্থায় দেখে তার মনের ভেতরে অজানা দুশ্চিন্তারা খচখচ করতে লাগল। অলি একটু সাহস সঞ্চয় করে হাত বাড়াল শাহানাজ বেগমের দিকে।
কপালে হাত রাখতেই অলি আঁতকে উঠল। শরীরের তাপমাত্রা বেশ গরম। অলি তৎক্ষণাৎ বুঝে যায় জ্বর এসেছে।
এক মুহূর্তের জন্য অলি দোটানায় পড়ল। সেবা করবে, না কি তার আচরণের কথা মনে করে দূরে সরে যাবে? অলির মনে পড়ে যায় তার বাবা মায়ের সাথে করা শাহানাজ বেগমের খারাপ ব্যবহারের কথা। অলি সেগুলো মনে করে এড়িয়ে যেতে চাইলো কিন্তু তার ভেতরে জন্ম নেয়া সুপ্ত মাতৃত্ববোধ তাকে এড়িয়ে যেতে দিলোনা। ধীরে ধীরে সে শাহানাজ বেগমের পাশে বসল। কণ্ঠে অচেনা কোমলতা ফুটিয়ে বলল,
“আম্মা, আপনি ঠিক আছেন তো?”

কোনো উত্তর এল না। অলি বুঝতে পারলো সে উত্তর দেয়ার মতো অবস্থায় নেই। অলি উঠে সোজা কিচেনে এসে দেখে সেখানে কেউ নেই। সার্ভেন্টরা এই সময়টাতে সাধারণত বিশ্রাম নেয় কারণ রাত নামতেই তারা ডিনার রেডি করার প্রস্তুতি নেবে। অলি একটা শ্বাস ফেলে এক গ্লাস কুসুম গরম পানি নিয়ে আবারও শাশুড়ির নিকট চলে এলো। আলতো করে শাহানাজ বেগমকে জাগিয়ে পানি খাওয়ালো। তারপর তোয়ালে ভিজিয়ে এনে কপালে জলপট্টি দিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পরপরই তোয়ালেটা পানি দিয়ে ভিজিয়ে এনে বদলে দিল।
মুহূর্ত কয়েক পর শাহানাজ বেগম আধখোলা চোখে অলিকে দেখে নিলেন। হয়তো অবাক হয়েছিলেন, যেই মেয়েকে তিনি কখনোই মন থেকে গ্রহণ করেননি, সব সময় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য আর তিরস্কার করে গেছেন সেই মেয়েই আজ তার পাশে বসে সেবা করছে। সে হয়তো কিছু বলতে চাইলো কিন্তু ক্লান্ত শরীর তাকে কিছু বলার সুযোগ দিলোনা।
অলি পাশে বসে রইল। বারবার নিজের হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে দিল। ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আম্মা, দুপুরে কিছু খেয়েছিলেন?”

শাহানাজ বেগম না বোধক মাথা নাড়লেন। অলি ধীরপায়ে আবারও কিচেনে এলো। কিন্তু সে তো রান্নাবান্নার কিছুই জানেনা। সে হাতে থাকা ফোনটায় একটা ভিডিও অন করলো তারপর সেটা ফলো করেই চিকেন স্যুপ বানানোর চেষ্টা করতে লাগলো। পেট বড় হয়ে আসায় কাজ করা সহজ ছিলোনা, তবুও যতটুকু সম্ভব ধৈর্য্য ধরে করলো সবটা।
অলি বেশ কয়েকবার আলভীকে কল করে খবরটা জানাতে চেয়েছে কিন্তু আলভী হয়তো ব্যস্ত আছে সেই জন্য কল রিসিভ করেনি। অলি একটা বাটিতে স্যুপটুকু ঢেলে শাহানাজ বেগমের সামনে এসে বসলো। তারপর আস্তেধীরে খাওয়ানোর চেষ্টা করল। শাহানাজ বেগম দুর্বলভাবে কয়েক চুমুক খেলেন।
সকাল থেকেই শাহানাজ বেগমের শরীর খারাপ লাগছিলো। সে লাঞ্চ করার উদ্দেশ্যে কিচেনের দিকে যেতেই তার শরীর একদম ভেঙ্গে পড়ে। শরীর টা এতোটাই দূর্বল লাগছিলো যে সিড়ি বেয়ে নিজের রুমে যাওয়ার সাহসটুকুও করেননি।
অলি পাশে বসে মনে মনে ভাবলো মানুষ যতই বিরাগ পোষণ করুক না কেন, একজন আদর্শ মানুষ কখনো কারো দূর্বলতার সুযোগ নেয়না। তাছাড়া সে তার ছেলের বউ। সেই হিসেবে শাশুড়ি যেমনই হোকনা কেনো তার সেবা করা অলির দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

চলবে,,,

শব্দসংখ্যা- ২৭৫০+

#১৫_বছর_বয়সী_মা (৪৮)
#সোফিয়া_সাফা

মিটিং শেষে ফোনটা হাতে নিতেই আলভী দেখলো অলি তাকে অনেক গুলো কল দিয়েছিলো। আলভী সাথে সাথেই অলিকে কলব্যাক করলো,
ফোন টা বেজে উঠতেই অলি স্যুপের বাটিটা রেখে ফোনটা হাতে নিলো।
“হ্যালো অলি,”

“হুম হ্যালো।”

“স্যরি আসলে আমি মিটিংয়ে ছিলাম সেই জন্য কল রিসিভ করতে পারিনি। তুমি ঠিক আছো তো?”

অলি একটা শ্বাস ফেলে বলল, “আমি ঠিকই আছি। কিন্তু আম্মা ঠিক নেই, তার অনেক জ্বর এসেছে। বাড়িতে তো আমি ছাড়া আর কেউই নেই। আমি একা কি করবো বুঝতে পারছিনা।”

কথাটা শুনে আলভী চিন্তিত কন্ঠে বলল,
“মা এখন কেমন আছে?”

“জ্বরে কাবু হয়ে গেছেন। ঠিকমতো কথাও বলতে পারছেন না। আপনি তারাতাড়ি চলে আসুন না।”

আলভী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো এখন ৫টা ২১ বাজে।
“আ…অলি আমাকে তো এক্ষুনি আরও একটা মিটিং এটেন্ড করতে হবে। তুমি একটু মায়ের কাছে থাকো আমি মিটিং টা এটেন্ড করে যতদ্রুত সম্ভব বাড়িতে আসছি। আর নয়তো বাবাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

কথাটা শুনে অলি শক্ত গলায় বলল,
“আজব কথা বললেন, আপনি ডাক্তার হয়েছেন কি করতে, হ্যাঁ? আর কেমন ছেলেই বা আপনি? মা অসুস্থ শুনেও কাজের বাহানা দিচ্ছেন? একটা মিটিং এটেন্ড না করলে কি আপনি ভিখারি হয়ে যাবেন? হাহ, যখন মা থাকবেনা তখন বুঝবেন।”

কথাটা বলেই অলি রেগেমেগে কল কেটে দিলো। তারপর পেটের উপর হাত রেখে বিরবির করে বলল,
“তুইও কি বাপের মতো মাকে অবহেলা করবি আলো?”

শাহানাজ বেগম জ্বরের ঘোরে থাকলেও আলভীকে বলা অলির প্রত্যেকটা কথা শুনেছেন। কথাগুলো শুনে তার চোখের কোণে জল জমেছে। তাকে কাদতে দেখে অলি বিচলিত হয়ে পড়লো,
“আম্মা আপনার কি বেশিই খারাপ লাগছে?”

শাহানাজ বেগম অন্যদিকে তাকিয়ে চোখের পানি আড়াল করতে চাইলেন। অলি কি করবে বুঝতে পারছেনা। সে বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে বলল,
“আপনি একটু সহ্য করুন আমি বাইরে গিয়ে দেখি ট্যাক্সি পাই কিনা। কাউকে লাগবেনা আমি আপনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। আপনি চিন্তা করবেন না কেমন?”

অলি দ্রুতপায়ে দরজা পর্যন্ত আসতেই ঊর্মিলা বাড়িতে প্রবেশ করে। উর্মিলাকে দেখে অলি খানিকটা স্বস্তি পেলো। এদিকে অলিকে এভাবে দিকবিদিকশুন্য হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে ঊর্মিলা ঘাবড়ে গেলো,
“কি হয়েছে ভাবী? এতো তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাচ্ছো? এই অবস্থায় কেউ এভাবে দৌড়ায়?”

অলির চোখজোড়া ছলছল করে উঠলো সে ঊর্মিলার হাত ধরে বলল, “আপু আম্মা অনেক অসুস্থ, ওনাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে। আমি ট্যাক্সি আনতে যাচ্ছিলাম। তুমিও চলোনা আমার সাথে।”

“আরে ভাবী আস্তে আস্তে…এতোটা উত্তেজিত হয়োনা। মায়ের কি হয়েছে? চলো আমি দেখছি।”

অলি মাথা নেড়ে ঊর্মিলাকে নিয়ে শাহানাজ বেগমের কাছে আসলো। ঊর্মিলা একটা থার্মোমিটার এনে মায়ের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করে দেখলো ১০২ ফারেনহাইট এর কাছাকাছি। ঊর্মিলা থার্মোমিটার টা টেবিলের উপর রেখে অলির উদ্দেশ্যে বলল,
“তুমি চিন্তা কোরোনা ভাবী। আমি মাকে জ্বরের ওষুধ খাইয়ে দিচ্ছি।”

কথাটা বলেই ঊর্মিলা উপরের রুমে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর একটা ট্যাবলেট নিয়ে ফিরে এলো। মায়ের পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো,
“মা কিছু খেয়েছিলে?”

অলি বলল, “হ্যাঁ আমি আম্মাকে স্যুপ বানিয়ে খাইয়ে দিয়েছিলাম।”

কথাটা শুনে ঊর্মিলা অবাক চোখে অলির দিকে তাকায়,
“ভাবী তুমি এই অবস্থায় কিচেনে গিয়েছিলে?”

অলি মাথা নিচু করে নিলো, ঊর্মিলা ফের বলে উঠলো,
“এই কথাটা ভাইয়া জানতে পারলে…

উর্মিলা পুরো কথাটা শেষ করার আগেই দেখলো আলভী হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করছে তার সাথে উসমান মির্জাও আছে। তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অলিও ঘাড় ঘুরিয়ে পেছেনে তাকাতেই থমকে গেলো। আলভী অলির সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাপাতে লাগলো,
“এই মেয়ে কল ধরছিলে না কেনো?”

অলি একটা ঢোক গিলে শাহানাজ বেগমের পাশে গিয়ে বসে পড়লো। আলভী একটা বিরক্তির শ্বাস ফেলে শাহানাজ বেগমের দিকে এগিয়ে গেলো। তারপর আবারও তাপমাত্রা পরীক্ষা করে ঊর্মিলার দিকে তাকিয়ে বলল,
“যা একজন সার্ভেন্টকে ডেকে মায়ের জন্য ফলের জুস বানিয়ে আনতে বল। তারপর মায়ের রুম থেকে প্যারাসিটামল নিয়ে আয়।”

ঊর্মিলা হাল্কা হেসে হাতে থাকা ট্যাবলেট টা আলভীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “তুই বলার আগেই আমি এনেছিলাম ব্রো। দেখলি আমি মেডিক্যাল স্টুডেন্ট না হলেও ডাক্তারি জানি।”

আলভী বিরক্তি সূচক শব্দ উচ্চারণ করে ঊর্মিলার হাত থেকে ট্যাবলেট টা নিয়ে শাহানাজ বেগমকে খাইয়ে দিলো। ঊর্মিলা বলল,
“ভাইয়া মাকে তার রুমে নিয়ে যাওয়া উচিৎ।”

আলভী সম্মতি জানিয়ে শাহানাজ বেগমের হাত ধরে তাকে উঠালো তারপর সে আর উসমান মির্জা মিলে শাহানাজ বেগমকে তার রুমে এনে শুইয়ে দিলো। অলিও তাদের পিছুপিছু এসেছে। এরই মাঝে ঊর্মিলা একগ্লাস ফলের জুস নিয়ে এলো। অলি গিয়ে একটা কাপড় ভিজিয়ে এনে শাহানাজ বেগমের কপালে দিয়ে দিলো। আলভী শান্তচোখে কিছুক্ষণ অলির দিকে চেয়ে থেকে একটা চাপা শ্বাস ফেলল। আলভী রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নিলো। ভীষণ বিরক্ত লাগছে তার। আজকের মিটিং টা অনেক বেশিই ইমপোর্ট্যান্ট ছিলো। কিন্তু অলির সাথে না পেরে সে সবকাজ ইয়াদ আর ইয়ামিন মির্জার উপর চাপিয়ে দিয়ে চলে এসেছে।

রাত্রি ১১ টা বাজে, অলি এখনো শাহানাজ বেগমের পাশেই বসে আছে। আলভী তাপমাত্রা চেক করে বলল,
“জ্বর ছেড়ে দিয়েছে। আপাতত চিন্তার কিছুই নেই।”

শাহানাজ বেগম চোখ মেলে অলিকে বসে থাকতে দেখে একটা দ্বীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ঊর্মিলা একটু পরপর এসে দেখে গেলেও এই মেয়েটা একমুহূর্তের জন্যও তার পাশ থেকে নড়েনি। আলভী এবার না পেরে বলল,
“অলি মা বাবা ঘুমাবে, এবার অন্তত চলো।”

উসমান মির্জা বললেন,
“আহ এভাবে বলছিস কেনো? থাকুক না ও।”

আলভী দাতে দাত চেপে বলল, “ও এখনো ডিনার করেনি বাবা।”

আলভীর কথা বুঝতে পেরে উসমান মির্জা বললেন,
“অলি যাও তুমি, তোমার শাশুড়ি আম্মার শরীর এখন বেশ ভালোই আছে। আর আমি তো আছিই চিন্তা কোরোনা। ডিনার করে শুয়ে পড়ো।”

আলভী অলির হাত ধরে টেনে তুললো। অলি না পেরে আলভী সাথে চলে যেতে লাগলো। কিন্তু দরজা অবধি গিয়ে সে পেছনে ঘুরে বলল,
“আব্বা যেকোনো প্রয়োজনে আমাদেরকে ডাক দেবেন কেমন? আর আম্মার দিকে খেয়াল রাখবেন।”

অলির মুখ থেকে প্রথমবারের মতো আব্বা ডাক শুনে উসমান মির্জা আনমনেই খুশি হলেন। অলিকে আশ্বাস দিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ বউমা রাখবো।”

অলি থমকে গেলো তার সাথে আলভীও। আলভী চমকিত নয়নে উসমান মির্জার দিকে তাকাতেই উসমান মির্জা মৃদু হাসলেন। আলভী কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে অলিকে নিয়ে চলে গেলো।

রুমে আসতেই আলভী বলে উঠলো,
“তুমি এরকম বিহেভ কেনো করছিলে হুম? মা তোমার সাথে কেমন বিহেভ করে সেসব ভুলে গেছো?”

অলি আলভীর চোখে চোখ রেখে বলল, “ভুলে যাইনি। আমি শুধু দায়িত্ব পালন করছি।”

আলভীর ভ্রু কুচকে গেলো।
“দায়িত্ব?”

অলি অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, “সে আমার স্বামীকে ১০ মাস পেটে রেখেছেন। এতোবড় করেছেন। তাই ছেলের বউ হিসেবে আমি শুধু দায়িত্ব পালন করছি।”

আলভী তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “কিন্তু তোমাকে তো সে পুত্রবধূ হিসেবেই মানেন না।”

“সে না মানুক, আমি তাকে নিজের শাশুড়ি হিসেবে মানি। আর সে না মানলেও আমিই তার একমাত্র পুত্রবধূ। এটা কি সে অস্বীকার করতে পারবেন?”

আলভী বলার মতো কিছুই খুঁজে পেলোনা। আর সত্যি বলতে আলভীও চায়না মায়ের সাথে অলি তেমন ব্যবহার করুক যেমনটা তার মা অলির সাথে করেছেন।

আলভী রুম থেকে বেরিয়ে গেলো তারপর খাবার নিয়ে আবারও রুমে এলো।
“খাবারগুলো খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”

অলি মাথা নেড়ে হাত ধুতে ওয়াশরুমে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে খাবারের প্লেটটা হাতে নিয়ে খেতে লাগলো। আলভী ল্যাপটপে কিছু কাজ করছিলো। আজকে কতোদিন পর অফিসে গিয়েছিল কিন্তু সম্পূর্ণ কাজ শেষ করে আসতে পারেনি। অলি খাওয়া শেষ করে এশারের নামাজ আদায় করে নিলো। তারপর আলভীর পাশে এসে বসলো। আলভী সিরিয়াস ভঙ্গিমায় বসে বসে কাজ করছে। অলি গলা পরিষ্কার করে বলল,
“তখন ওভাবে কথা বলার জন্য স্যরি। আসলে আমার মাথা ঠিক ছিলোনা।”

আলভী হঠাৎ করেই অলির কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“বউকে শিখিয়েছিলাম যে কিভাবে ধন্যবাদ দিতে হয়। এবার দেখছি স্যরি বলতেও শিখিয়ে দিতে…

আলভীকে আর কিছু বলতে না দিয়ে অলি তার মুখ চেপে ধরলো,
“আপনি আমাকে কামড়াতে আসলে আমি কিন্তু এবার আপনার দাত ভেঙ্গে ফেলবো বলে দিলাম।”

আলভীর কপালে ভাজ পড়লো। সে অলির হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“ওটাকে কামড়ানো বলেনা হানিবি। ওটাকে লিপকিস বলে।”

অলি ছটফট করতে লাগলো আলভী বিরক্ত হয়ে অলিকে ছেড়ে দেয়।
“কিস করতে না দিলে বিরক্ত কোরোনা তো। এমনি অনেক কাজ জমে গেছে।”

অলি আর আলভীকে না ঘাটিয়ে মাথার ওড়না টা সরিয়ে চুলগুলো উঁচু করে খোপা করে নিলো। সেদিনের পর থেকে সে আর আলভীর সামনে চুল আঁচড়ায় না। রাতে চুলগুলো হাত খোপা করেই শুয়ে পড়ে। বিছানায় গা এলিয়ে দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই অলি ঘুমিয়ে যায়। আলভী অলির দিকে তাকিয়ে একটা শ্বাস ফেলে পুনরায় নিজের কাজে মনোযোগ দেয়। প্রায় ঘন্টা খানেক পেরিয়ে যেতেই হঠাৎ অলির ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে ঘুমের মাঝেই বেবির নড়াচড়া অনুভব করেছে। অলি একভাবেই শুয়ে আছে, এরই মাঝে সে আবারও বেবির কিক অনুভব করলো। অলি খুশিতে কেদে উঠলো। কান্নার শব্দে আলভী তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বিচলিত কন্ঠে শুধালো, “ক…কি হয়েছে বউজান?”

আলভীর আদুরে ডাকে অলি আরো গলে গেলো যেন। সে হঠাৎ করেই আলভীর ডান হাতটা টেনে পেটের বাম পাশে রাখলো। কিছু একটা অনুভব করতেই আলভীর বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। সেই সাথে তার পুরো শরীর ঝংকার তুললো। গলাটাও শুকিয়ে আসছে বোধহয়। আলভী কয়েকটা ঢোক গিলে আলগোছে হাতটা সরিয়ে নিলো। এদিকে অলি তো খুশিতে দিশেহারা।
“এই প্রথম, এই প্রথম আমি পুরোপুরি ভাবে ওকে ফিল করেছি। আহ আল্লাহর নিকট অনেক অনেক শুকরিয়া।”

অলি খুশি মনে আলভীর দিকে তাকিয়ে দেখলো সে কোনো একটা ভাবনায় গভীর ভাবে ডুবে আছে, যেন সে অন্য কোনো জগতে বিচরণ করছে। অলি খুশির চোটে আলভীকে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলল,
“আপনিও অনুভব করেছেন তাইনা? করেছেন না?”

আলভী ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বলল, “হুম”

অলি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো এখন রাত ১ টা অলি ধীরপায়ে খাট থেকে নেমে অজু করার উদ্দেশ্যে ওয়াশরুমে চলে গেলো তারপর রুমে এসে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করে নিলো।

রাত্রী তিনটা,

অলি গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। কিন্তু আলভী ঘুমাতে পারেনি। সে শোয়া থেকে উঠে বসলো তারপর খাট থেকে নেমে অলির সামনে এসে মেঝেতে বসে পড়লো। কিছুক্ষণ সেভাবে বসে থেকে হঠাৎ করেই সাবধানতা সহিত আবারও অলির পেটের বাম সাইডে হাত রাখলো। তার বুকের ভেতর ধুকপুক ধুকপুক করছে। হাতটা রাখার সাথে সাথেই সে ভাগ্যক্রমে আবারও বেবির কিক অনুভব করলো। তার এবার মনে হলো সে যেন বিদ্যুতের সংস্পর্শে এসেছে। তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেন বিদ্যুৎ প্রবেশ করেছে। আলভী সাথে সাথেই হাতটা সরিয়ে নিয়েছে। সে বুঝতে পারছেনা যে হঠাৎ করে তার কি হলো কিন্তু সে অদ্ভুত কিছু ফিল করছে। এমন কিছু যেটা সে এর আগে কখনো ফিল করেনি। এতোদিন যাবত বেবিটার প্রতি তার কোনো ফিলিংস ছিলোনা। তার কাছে বেবিটা হচ্ছে একটা মহাপাপ। একটা পাপের ফল এই বেবিটা। আর সেই পাপের ফল অলিকে ভোগ করতে হচ্ছে। এই বেবিটার জন্যই অলির লাইফ হেল হয়ে গেছে। এত অল্প বয়সে এতোকিছুর সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সে এতকিছুর পরেও বেবিটাকে কিভাবে স্বাভাবিক ভাবে নেবে? আলভী ভীষণ কষ্ট অনুভব করছে। সে জানেনা কেনো কিন্তু এই বেবিটা একটা কাটার ন্যায়েই তার গলায় আটকে আছে যেনো। সে না গিলতে পারছে আর না উপড়ে ফেলতে পারছে। আলভী বসা থেকে উঠে দাড়ালো তারপর নিঃশব্দে রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো।

কিন্তু বিস্ময়ে ভরা একজোড়া চোখ পেছনে রেখে গেলো। এবারও বেবির কিক অনুভব করে অলির ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিলো। কিন্তু সে আলভীকে নিজের সামনে বসে থাকতে দেখে এতোটাই বিস্মিত হয়েছিলো যে কোনো প্রতিক্রিয়াই করতে পারেনি। অলি আলভীকে হাসফাস করতে দেখেছে। সে জানে এমন কিছু আছে যেটা আলভীকে স্বস্তি দিচ্ছেনা। আর আলভী প্রথম থেকেই সেই ব্যাপারটা ধামাচাপা দিয়ে রাখতে চাইছে। অলি শোয়া থেকে উঠে বসলো। তারপর পেটের উপর হাত রেখে মনেমনেই বলল,
“আলো…তোর প্রতি তোর বাবার কোনো অনুভূতি নেই রে। যেদিন আমি প্রথম তোর অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত হয়েছিলাম সেদিনই আমার মাঝে মাতৃত্ব জন্মেছিলো। কিন্তু তোর বাবার মাঝে এখন পর্যন্ত কেনো পিতৃত্ব জন্মালো না রে?”

চলবে,