#১৫_বছর_বয়সী_মা (৪৯)
#সোফিয়া_সাফা
সাত সকালে শাহানাজ বেগমকে নিজের কক্ষে দেখে একপ্রকার চমকেই উঠলেন দাদুমনি, বলতে গেলে শাহানাজ বেগম ভুল করেও তার রুমে আসেন না। দাদুমনির জন্য দুজন কেয়ার টেকার রাখা আছে তারাই মূলত তার দেখাশোনা করে। রূপসা আর রুনা খাতুন চলে যাওয়ার পর থেকে তার রুমে কেউই ততটা আসেনি। তবে গত কয়েকদিন ধরে অলি নিয়ম করে তার রুমে এসে তার সাথে গল্পগুজব করে যায়। তাছাড়া নূরনাহার আর ঊর্মিলাসহ বাকিদের আনাগোনা খুবই সীমিত। শাহানাজ বেগম শাশুড়ির পাশে গিয়ে বসতেই তার শাশুড়ি বলে উঠলেন,
“আরে বড় বৌমা, তুমি আমার রুমে? কি মনে করে?”
শাহানাজ বেগম হাল্কা গলায় বললেন,
“এভাবে বলছেন কেনো মা? আমার কি এখানে আসা বারণ?”
“না না বারণ কেনো হতে যাবে? তুমি সচরাচর আসোনা তো তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
শাহানাজ বেগম একটা শ্বাস ফেলে বললেন,
“এখন থেকে আমি রোজ আসবো মা।”
তার ফ্যাকাশে মুখটা দেখে দাদুমনি চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
“তোমার কি হয়েছে বৌমা?”
শাহানাজ বেগম বেখেয়ালি হয়ে বললেন, “শিক্ষা হয়েছে মা। আমার শিক্ষা হয়েছে। একটা হাটুর বয়সী মেয়ে আমাকে শিক্ষা দিয়ে দিয়েছে।”
দাদুমনি হয়তো তার কথা বুঝলেন তাই আর কথা বাড়ালেন না।
দেখতে দেখতে আরও ৪৫ দিন কেটে গেলো। সেদিনের পর থেকে অলি আর শাহানাজ বেগমের মাঝেকার সম্পর্কে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। শাহানাজ বেগম বুঝেছেন যে অলি অভিজাত বংশের মেয়ে না হলেও মনের দিক থেকে অনেক সমৃদ্ধ। তাছাড়া রূপসা মা হবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। কোনো মাই চাইবেনা একটা বন্ধ্যা মেয়েকে ছেলের বউ করে আনতে। তাছাড়া সে এটাও বুঝে গেছেন যে তার ছেলে রূপসাকে এই জন্মে আর মেনে নেবেনা। বিকেলের দিকে নূরনাহার জোর করে ঊর্মিলার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছিলেন। পাশেই অলি বসে আছে, তার কপালে চিন্তার ভাজ স্পষ্ট। এরই মাঝে শাহানাজ বেগম এসে বললেন,
“মাথায় তেল দিয়েছো?”
অলি না বোধক মাথা নাড়লো। তখনই তাকে চমকে দিয়ে শাহানাজ বেগম নূরনাহারের উদ্দেশ্যে বললেন,
“ঊর্মিলাকে দেয়া হলেও ওর মাথাতেও তেল দিয়ে দিও।”
নূরনাহার মাথা নাড়লেন। এরই মাঝে আলভী ড্রইংরুমে এসে অলির পাশে বসলো। কিছুক্ষণ আগেই সে হসপিটাল থেকে এসেছে। তাকে দেখে অলি বলে উঠলো,
“শুনুন না।”
আলভী ভ্রু কুচকে অলির দিকে তাকায়। অলি একটা শ্বাস ফেলে বলল,
“৩ মাস পর আমাদের এসএসসি পরীক্ষা। ফরম পূরণ করতে হবে।”
আলভী মাথা নেড়ে সায় জানালো।
“কবে যেতে হবে বলো। আমি গিয়ে করে আসবো।”
অলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলো,
“ওখানে তো আমাকে সাইন করতে হবে।”
আলভী চিন্তিত কন্ঠে বলল, “কিন্তু তুমি এই অবস্থায় কিভাবে যাবে?”
অলির গালজোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। সে মূলত এটা নিয়েই চিন্তায় আছে।
“আমি এই অবস্থায় স্কুলে গেলে সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে তাইনা?”
অলির কথা শুনে আলভীর অনূভুতিশূন্য চেহারায় হতাশা ধরা পড়লো। নিম্ন কন্ঠে বলল,
“আমি বুঝতে পারছি এই অবস্থায় স্কুলে যেতে তুমি সংকোচবোধ করছো। আর এই রকম পরিস্থিতিতে তোমাকে যেনো না পরতে হয় সেই জন্যই আমি…
আলভী দেখলো অলি তার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। তাই বাকি কথাটুকু আলভী মনে মনেই বললো,
“তোমাকে এবোরশন করে ফেলতে বলেছিলাম।”
অলি ভ্রু নাচিয়ে বলল, “কি হলো? অর্ধেক কথা বললেন কেনো?”
“দেখো অলি এই অবস্থায় তুমি কিভাবে জার্নি করবে? সেটা ভেবেই আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম যে তুমি কিভাবে যাবে। আমি তোমার লজ্জার কথা চিন্তা করে প্রশ্ন টা করিনি। মা হওয়াটা লজ্জার নয় অলি।”
অলি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো।
“আমার লজ্জা করছে কারণ আমি আমার ফ্রেন্ডদেরকে সবসময় বলে বেড়াতাম যে আমি কখনো বিয়েই করবোনা। আর সেই জন্যই…
অলি আর কিছু বলতে পারলোনা। আলভী তার পরিস্থিতি বুঝতে পেরে উঠে গেলো। নূরনাহার ঊর্মিলার মাথায় তেল দেয়া শেষে অলির মাথাতেও তেল দিয়ে দিলেন।
পরের দিন সকাল ৯ টা নাগাদ অলি আর আলভী অলির স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে। অলি একদম বোরকা হিজাব আর মাক্স দিয়ে পুরো শরীর ঢেকে নিয়েছে। এতো ঢিলা বোরকা পড়েছে যে প্রায় বোঝাই যাচ্ছেনা যে সে সাড়ে আট মাসের প্রেগন্যান্ট। যখন তখন তার ডেলিভারি হয়ে যেতে পারে। আলভী না চাইতেও বারবার অলির দিকে তাকাচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে অনেক অশান্তিতে আছে। আলভী বার কয়েক ফোনটা বের করে কিছু একটা দেখছে। অলি বসে বসে বোর হচ্ছিলো তাই সে নিজের ফোনটা বের করতেই আলভী ফট করে বলে ওঠে,
“অলি তোমার ফোনটা দেওতো।”
অলি বলে উঠলো, “গাড়ি চালানোর সময় ফোন চাপতে হয়না।”
আলভী হতাশায় নিজের চুল খামচে ধরলো। তাকে এভাবে রিয়্যাক্ট করতে দেখে অলি নিজের ফোনটা তার দিকে এগিয়ে দেয়। আলভী ফোনটা নিয়ে নিঃশব্দে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে নিলো। অলি তো হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো। আলভীর মাথা টাথা নষ্ট হয়ে গেলো নাকি? অলি মুখটাকে গোমড়া করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।
দুপুর ২ টা নাগাদ স্কুলের সব কাজ মিটিয়ে তারা দুজন স্কুল থেকে বেরিয়ে এলো। অলির বান্ধবী শায়লার সাথেও অলির দেখা হয়েছে। মেয়েটা নিজের ভাইয়ের কথা বলে অলির সাথে অনেক কান্নাকাটি করেছে। যদিও ফোনের মাধ্যমে তাদের যোগাযোগ আছে কিন্তু সামনা-সামনি তো অনেক দিন পর দেখা হলো তাছাড়া আলভীকে অলির হাজব্যান্ড রূপে দেখে শায়লা আরও বেশি অবাক হয়েছে। সে আলভীকে নিজের ভাইয়ের বন্ধু হিসেবে আগে থেকেই চেনে। আলভী বেশ কয়েকবার রিফাতের সাথে তাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলো। অলি লক্ষ্য করেছে সে যেটুকু সময় স্কুলে ছিলো পুরোটা সময় আলভী অস্বাভাবিক আচরণ করেছে। এই যেমন সে কারো সাথে কথা বলতে গেলে আলভী এসে বা হাত ঢুকিয়ে দিয়ে আবোলতাবোল বলেছে নয়তো তাকে টেনে নিয়ে চলে এসেছে। এতে অবশ্য অলি বেশ বিরক্ত হয়েছে।
আলভী গাড়ি স্টার্ট দিতেই অলি বলল,
“এতোদূর এসেছি। বাবা মাকে না দেখেই চলে যাবো?”
আলভী বিনাবাক্যে গাড়িটা অলিদের বাড়ির দিকে ঘুরিয়ে নিলো। মাস খানেক আগেই অলি বাড়িওয়ালার পুরো টাকা পরিশোধ করে দিয়েছে। এখন বাড়িটা পুরোপুরি ভাবেই ওদের। যদিও পুরো টাকাটাই আলভী পরিশোধ করে দিয়েছে। সে নিজের টাকার থেকে দিতে চাইলেও আলভী দিতে দেয়নি। বাড়ির সামনে আসতেই অলির চোখ পড়লো বোগেনভিলিয়া গাছের পাতার আড়ালে থাকা বাড়ির মূল ফটকের উপর যেটা সে নিজ হাতে লাগিয়েছিলো। মূল ফটকে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আলো বিলাস। অলি ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো বাবা মায়ের কবরের দিকে। সে লোকমুখে শুনেছে কবরের পাশে মেয়েদের যেতে হয়না। সেই হিসেবে সে দূরত্ব বজায় রেখেই দাড়ালো। আলভীর উদ্দেশ্যে বললো।
“আপনি কি একটু কষ্ট করে অজু করে এসে মা বাবার কবরটা জিয়ারত করবেন?”
কথাটা শুনে আলভী শান্তচোখে তার দিকে তাকায়। অলি চোখ সরিয়ে বললো,
“আলো বড় না হওয়া অবধি আপনিই কষ্ট করে জিয়ারত করুন না। আলো বড় হয়ে গেলে আপনাকে আর করতে বলবোনা।”
এবারের কথাটা আলভীর ভালো লাগলোনা। এটা আবার কেমন কথা? আর এতে কষ্টের কি আছে? সে কি মেয়ে জামাই হিসেবে তাদের কবর জিয়ারত করতে পারবেনা?
“এরকম কথা কক্ষনো বলবেনা অলি। তাদেরকে আমি আব্বু আম্মু বলে ডেকেছি আর তাছাড়া তারা আমার স্ত্রীকে জন্ম দিয়েছেন এতো বড় করেছেন। যতটা কষ্ট করে আমার বাবা মা আমাকে বড় করেছেন ততটা কষ্ট করে তোমাকেও ওনারা বড় করেছেন। তুমি যদি এতো খারাপ ব্যাবহার পেয়েও আমার মায়ের সেবা করতে পারো আমি কি এতটুকু করতে পারবোনা? এই চিনলে আমাকে?”
অলির চোখজোড়া ছলছল করে উঠলো। অজানা প্রশান্তিতে তার মন ছেয়ে গেছে। আলভী বাইরে লাগানো কল থেকে অজু করে নিলো। এই বাড়ি আর বাগানের দেখাশোনা করার জন্য আলভী কেয়ার টেকার রেখেছে। সেই জন্য বাগানসহ বাড়িটা আগের মতোই আছে। আলভী কবর জিয়ারত শেষে অলিকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। তারপর বলল,
“বাড়িতে যাওয়ার আগে তোমার চেক-আপ করিয়ে যাবো ভাবছি।”
“লাস্ট চেক-আপ করানোর তো একসপ্তাহও হয়নি। আবার কেনো?”
আলভী থতমত খেয়ে গেলো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে পরীক্ষায় নকল করতে গিয়ে সে ধরা পড়ে গেছে। অলি সরু চোখে আলভীর দিকে তাকাতেই আলভী একটা শুষ্ক ঢোক গিলে বলল,
“তোমার এন্টেরিওর প্লাসেন্টা প্রেগ্ন্যাসি তাই চেক-আপের উপরেই থাকতে হবে বুঝলে?”
কথাটা বলে আলভী বোকা বনে গেলো। মনে মনে নিজেকেই গালি দিলো। অলি কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলে উঠলো,
“আপনি বলেছিলেন চিন্তার কিছুই নেই তাহলে এখন এভাবে বলছেন কেনো? বলুন না সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো?”
আলভীর গলা শুকিয়ে এলো, সে একটা ঢোক গিলে হাসার চেষ্টা করে বলল,
“হুম ট্রাস্ট মি। সবকিছু ঠিকঠাক আছে হানিবি।”
আলভী গাড়ি স্টার্ট দিলো কিন্তু অলির মুখটা মলিন হয়ে গেছে। এমনিতেই সে ডেলিভারি নিয়ে চিন্তায় আছে। শুনেছে বাচ্চা হওয়ার সময় নাকি অসহনীয় যন্ত্রণা হয়। তার মাঝে আলভীর এমন অস্বাভাবিক বিহেভিয়ার তাকে আরোও ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। আলভী অলির বিষয়টা বুঝতে পারলো এই জন্যই সে অলিকে কোনো বিষয় জানাতে চায়না। মেয়েটা অল্পতেই চিন্তায় পড়ে যায়।
***
অলি বেডের উপর শুয়ে আছে একজন অভিজ্ঞ ফিমেল রেডিওলজিস্ট তার আল্ট্রাসাউন্ড করছেন আলভী পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। সেও সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। চেক-আপ শেষে রেডিওলজিস্ট বললেন,
“চিন্তার কিছু নেই স্যার। বাচ্চা ঠিকঠাকই আছে। পজিশন সেইফ আছে। মাথাও নিচের দিকেই আছে।”
কথাগুলো শুনেও যেন আলভী নিশ্চিন্ত হতে পারলোনা। চেক-আপ শেষে আলভী অলিকে নিয়ে করিডরে এসে বসলো।
“দেখলে? বললাম তো চিন্তার কিছুই নেই।”
অলি একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল,
“হুম তা বুঝলাম কিন্তু আপনাকে এতো চিন্তিত দেখাচ্ছে কেনো সেটাই বুঝতে পারছিনা।”
আলভী কিছু বলতে যাবে তার আগেই দিহান এসে হাজির হলো। সে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে, অলি বুঝতে পারলো তার হাতে কিছু আছে যেটা সে পেছনে আড়াল করে রেখেছে। অলি দেখার চেষ্টা করতে যাবে তখনই আলভী তার মুখটা হাতের আঁজলায় নিয়ে হিসহিসিয়ে বলল,
“তুমি কতোক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারবে হানিবি?”
অলির কপালে বিরক্তির ভাজ পড়লো। আলভী কেনো এমন আচরণ করছে সে বুঝে উঠতে পারছেনা।
“কি হলো বলো?”
অলি বিরসকন্ঠে বলল,
“জানিনা।”
অলি আলভীর হাত সরিয়ে দিতে চাইলেও আলভী শক্ত করে তার মুখ ধরে রেখে আকুতি করে বলল,
“দুটো মিনিট আমার দিকে তাকিয়ে থাকো প্লিজ।”
আলভীর কন্ঠের ব্যাকুলতায় অলি বাধ্য হয়েই আলভীর চোখে চোখ রাখলো। মুহূর্তেই যেন সময় থেমে গেলো। আলভী আলগোছে অলির বাম হাতটা দিহানের দিকে এগিয়ে দিতেই, দিহান আড়াল করে রাখা হাতটা সামনে আনলো। তার হাতে দুটো সিরিঞ্জ ছিলো, সে অলির হাতটা ধরে ভীষণ সুক্ষ্ম ভাবে অলির হাত থেকে ব্লাড স্যাম্পল কালেক্ট করতে লাগলো। কিন্তু অলির মাঝে কোনো প্রকার ভাবাবেগ হলোনা। সে ধ্যান জ্ঞান সব হারিয়ে আলভীর চোখের মাঝেই যেন হারিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পেরিয়ে যেতেই দিহান নিজের কাজ শেষ করে চলে গেলো।
কিন্তু অলি এখনো আলভীর দিকেই তাকিয়ে আছে আর আলভীও তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আলভী ডান হাত দিয়ে অলির হাতের যেখান থেকে ব্লাড নেয়া হয়েছে সেখানে তুলো চেপে রেখেছে। হঠাৎ করেই আলভীর ফোনটা বেজে ওঠে। আলভী একটা শ্বাস ফেলে অলিকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। এদিকে অলির চোখজোড়া এখনো উদ্ভ্রান্তের ন্যায় আলভীকে অনুসরণ করছে। এরই মাঝে সে নিজের হাতে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলো। সে হাতটা সামনে এনে দেখলো হাতে তুলো লাগানো। অলি ক্যালকুলেশন করতে যাবে তার আগেই আলভী ফিরে এসে বলে,
“চলো হানিবি, বাড়িতে ফিরে যাই।”
অলি মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় মাথা নেড়ে উঠে দাড়ালো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে আলভী চোখ দিয়ে তাকে সম্মোহন করে ফেলেছে। আলভী কিছুটা দূর এগিয়ে গিয়ে আবারও ফিরে এলো তারপর অলির কাধে হাত রেখে তাকে হাটতে সাহায্য করতে লাগলো।
পুরুটা রাস্তা নির্বিঘ্নেই কেটেছে। বাড়িতে ফিরে অলি জামাকাপড় পাল্টে মাগরিবের নামাজ আদায় করে বই নিয়ে পড়তে বসলো৷ স্যার ম্যাডাম অবশ্য জানে যে তার বিয়ে হয়ে গেছে। অলির মা বাবার জানাযাতে তাদের স্কুলের স্যারেরা এসেছিলেন। সেই জন্য আজকে এতোমাস পর স্কুলে গেলেও তাকে স্যার ম্যাডামেরা খুব একটা কিছু জিজ্ঞেস করেনি। আর যাও দু একটা প্রশ্ন করেছে আলভী আগ বাড়িয়ে উত্তর দিয়ে দিয়েছে।
অলি ইংরেজি পড়ছিলো এমন সময় হঠাৎ করেই তার মনে পড়লো আগামী কাল তার জন্মদিন। হ্যাঁ আগামী কালকে তার ১৬ বছর পূর্ণ হবে। ভাবতেই তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। কতো তাড়াতাড়ি একটা বছর কেটে গেলো। সে কি গত বছর দুঃস্বপ্নেও ভেবেছিলো যে এই এক বছরে তার সাথে এতো কিছু হয়ে যাবে?
“যদি আমি জানতাম এই বছরের জন্মদিন টা উদযাপন করার জন্য আমার বাবা মা থাকবেনা তাহলে গত বছর তাদের দেয়া বোরিং বইগুলো পেয়েও অনেক অনেক খুশি হয়ে যেতাম। আর তাদেরকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ বলতাম। আচ্ছা মা বাবা তোমরা গতবছর বললেনা তো যে আমাকে শেষ জন্মদিনের গিফট হিসেবে বইগুলো দিয়েছো? কেনো বললেনা? তাহলে কি আমি বইগুলো পেয়ে মন খারাপ করতাম বলো?”
অলি ঠোঁট চেপে কেদে উঠতেই সে বেবির কিক অনুভব করলো। ফলস্বরূপ তার কান্না থেমে গেলো। সে চোখ মুছে পেটের উপর হাত রেখে বলল,
“আমার মা বাবা তোকে দেখে যেতে পারলোনা রে। আমার খুব কষ্ট হয় জানিস? মা বাবা কি আর কয়টা দিন থেকে যেতে পারতোনা? কিভাবে তোকে না দেখেই চলে গেলো? তুইও আমার মায়ের সুন্দর মুখটা দেখার সুযোগ পেলিনা। আমার মা দেখতে অনেক সুন্দর ছিলো রে। বাবা তো সবসময় মায়ের প্রশংসা করতো। সব থেকে বেশি প্রশংসা করতো মায়ের হাতের রান্না খেয়ে। তুই আমার মায়ের হাতের সেই সুস্বাদু রান্না খাওয়ার সুযোগটুকুও পেলিনা আলো। আহ কতোদিন হলো রে মায়ের হাতের রান্না খাইনা। কতদিন হলো মায়ের সুন্দর মুখটা দেখে দিন শুরু করিনা। কতদিন হলো বাবার হাত ধরে ঘুরতে যাওয়ার বায়না করিনা। তারা আর কোনোদিন ফিরে আসবেনা ভাবতেই খুব কষ্ট লাগে জানিস। বুকটা ফেটে যায়। মা বাবার সাথে আমার আর কখনো দেখা হবেনা। অনেক কষ্ট হচ্ছে।”
অলি হু হু করে কেদে উঠলো। ইদানীং বাবা মায়ের কথা খুব করে মনে পড়ে। একটা বার তাদের জড়িয়ে ধরার সাধ জাগে। কিন্তু এই সাধ যে আর পূরণ হবার নয়। অলি চারদিকে তাকিয়ে দেখলো সে পুরো রুমে একা আছে। আলভী কোথায় গেছে সে জানেনা। হসপিটাল থেকে এসে ফ্রেশ না হয়েই বেরিয়ে গিয়েছিলো। এবার আলভীর প্রতি অলির অভিমান জন্মাতে শুরু করেছে।
অলি অভিমান নিয়েই পড়ায় মনোযোগ দিলো একনাগাড়ে ২ ঘন্টা যাবত পড়াশোনা করেছে সে। এই পর্যায়ে এসে তার চোখদুটো লেগে আসছে। অলি বুঝতেই পারলোনা যে কখন সে বালিশে হেলান দেওয়া অবস্থাতেই ঘুমিয়ে গেলো।
রাত ১০ টা, ইয়াদ আলভীর রুমের সামনে দিয়েই যাচ্ছিলো। দরজা খোলা থাকায় ইয়াদ বাইরে থেকেই দেখতে পেলো যে অলি বসা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে গেছে। ইয়াদ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ধীরপায়ে রুমে ঢুকলো খাটের সামনে এসে মনে মনেই আওড়ালো,
“আই থিংক বেবিটার কষ্ট হচ্ছে।”
বলেই ইয়াদ আলতো হাতে বইটা সরিয়ে অলিকে ভালো করে খাটে শুইয়ে দিলো তারপর আবারও মনে মনেই বলল,
“আর কয়টা দিন বেবির সাথে কাটিয়ে নেও।”
ইয়াদ একটা বাকা হাসি দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আর অলিও আরাম পেয়ে আরও গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।
চলবে,,,
#১৫_বছর_বয়সী_মা (৫০)
#সোফিয়া_সাফা
কিছুক্ষণ যেতেই অলির ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে হাই তুলে বালিশ থেকে মাথা তুলতেই অবাক হয়ে গেলো। সে তো বসা অবস্থাতেই বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো তাহলে বইটা খাটের অন্যপ্রান্তে গেলো কিভাবে? আর সে বালিশেই বা মাথা রাখলো কখন? ভাবনার মাঝেই ওয়াশরুম থেকে শব্দ ভেসে আসে। অলি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে এখন সাড়ে ১০ টা বাজে। এরই মাঝে আলভী ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। তাকে আসতে দেখেও অলি না দেখার ভান করে ধীরপায়ে খাট থেকে নেমে বইগুলো গুছিয়ে রাখতে লাগলো। আলভী একটা টি শার্ট গায়ে জড়িয়ে অলিকে জিজ্ঞেস করলো,
“ডিনার করেছো?”
অলি শুনলোই না যেন। আলভী একটা শ্বাস ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর দু প্লেট খাবার নিয়ে রুমে এলো। অলি ততক্ষণে বিছানা রেডি করে ফেলেছে। শুধু বালিশ গুলো গুছিয়ে রাখা বাকি। আলভী খাবার গুলো টেবিলের উপর রেখে অলিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তার হাতে থাকা বালিশটা খাটে ছুড়ে রাখলো।
“দেখো হানিবি। তোমাকে এসব করতে হবেনা। আমি খাট গুছিয়ে দেবো তুমি খাবার খেয়ে নেও।”
অলি আলভীর হাত সরিয়ে দিয়ে পুনরায় বালিশটা হাতে তুলে নিলো। আলভী বুঝতে পারলো অলি ভীষণ রেগে আছে। আলভী চলে যেতে নেবে কিন্তু তার আগেই অলির মাথা ঘুরে গেলো। সে নিজেকে সামলাতে না পেরে একহাতে আলভীর টিশার্ট খামচে ধরলো। আলভী দ্রুত গতিতে অলিকে সামলে নিয়েছে কিন্তু অলির শরীর ভালো বলে মনে হচ্ছেনা।
“কি হয়েছে হানিবি? আর ইউ ফিলিং উইক?”
অলি মুখে কিছুই বললোনা শুধু হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো। আলভী অলির মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে আস্তে আস্তে খাটে বসিয়ে দিলো। অলি জানেনা তার কি হয়েছে কিন্তু হাসপাতাল থেকে ফেরার পর থেকেই তার শরীর টা দূর্বল লাগছে। আলভী ব্যাপারটা বুঝতে পেরে পানির গ্লাসটা অলির ঠোঁটে ছোয়ালো,
“পানি খাও একটু।”
অলি নিভু নিভু চোখে কিছুটা পানি খেয়ে নিলো। অলিকে এতোটা দূর্বল হয়ে যেতে দেখে আলভীর অনেক খারাপ লাগছে। সে জানে অতোগুলো রক্ত নেয়ার কারণেই অলির এই অবস্থা। এমনিতেই অলির বয়স কম তার উপর কতোগুলো রক্ত নিয়েছে। আলভীর ইচ্ছা করছে দেয়ালে মাথা ঠুকতে। সে অলিকে বালিশে হেলান দিয়ে বসিয়ে রেখে খাবারের প্লেটটা নিয়ে এলো। কিছুটা ভাত অলির সামনে নিতেই অলি মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
“বিকেল থেকে যেখানে ছিলেন সেখানে গিয়েই থাকুন। এসেছেন কেনো? আসার কোনো দরকার ছিলোনা তো।”
অলির বলার অর্ধেক কথা আলভী বুঝতেই পারলোনা। কারণ কথাগুলো জড়িয়ে আসছে। অলির অবস্থা দেখে আলভীর বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো,
“স্যরি বউজান, আমার ভুল হয়ে গেছে। আর করবোনা এমন। খেয়ে নেও প্লিজ।”
অলির খেতে ইচ্ছা করছেনা কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে,
“খাবোনা।”
আলভী হার মানলোনা, এই অবস্থায় না খেয়ে থাকলে অলির শরীর আরও দূর্বল হয়ে যাবে।
“আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে।”
অলি আলভীর দিকে তাকাতেই আলভী অসহায় কন্ঠে বলল,
“খেয়ে নেও প্লিজ নইলে তোমার শরীর আরও দূর্বল হয়ে যাবে।”
“আপনার ক্ষুধা লেগেছে আপনিই খান গিয়ে।”
এবারের কথাটা আলভী বুঝতে সক্ষম হলো।
“তুমি না খেলে আমিও খাবোনা। এখন খাবোনা, সকালেও খাবোনা, আর কক্ষনো খাবোনা।”
কথাটা শুনে অলি ছোট্ট করে হা করলো। তর্ক করার মতো শক্তি তার শরীরে নেই। আলভী অলিকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নিলো।
সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই অলি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলো এখন ১০ টার মতো বাজে। অলি বেশ বিরক্ত হলো, সে আজকে নামাজ আদায় করতেও পারেনি। এতোটা গভীর ঘুম তার কখনোই হয়না। অলি আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো আলভী রুমে নেই। এমন সময় দুজন সার্ভেন্ট খাবার নিয়ে এলো। খাবার গুলো দেখে অলি থতমত খেয়ে গেলো। এতগুলো খাবার? অলি উঠে ফ্রেশ হয়ে টেবিলে বসলো। একজন সার্ভেন্ট ফল কেটে দিচ্ছে আরেকজন পাউরুটিতে মাখন লাগিয়ে দিচ্ছে।
“এতো খাবার কেনো এনেছেন? কে খাবে এতো খাবার?”
একজন সার্ভেন্ট উত্তর দিলো,
“স্যারের কথামতোই খাবার এনেছি ম্যাম। স্যার বলেছে আপনাকে ভালো ভালো খাবার খাওয়াতে স্পেশালি ফল।”
অলি একটা শ্বাস ফেলে বলল, “আপনাদের স্যার কোথায় গেছেন?”
“জানিনা। কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেছেন। মনে হয় অফিসে গেছেন।”
আরেকজন সার্ভেন্ট বলল, “আমার মনে হয় হসপিটালে গেছেন। আমি তার হাতে সাদা এপ্রোন দেখেছিলাম।”
অলি পাউরুটিতে একটা কামড় দিতেই তার ফোন বেজে ওঠে। একজন সার্ভেন্ট ফোনটা এনে অলির হাতে দেয়। অলি জানেনা কেনো কিন্তু আলভীর উপর রাগ উঠছে। আলভী কেমন যেনো হয়ে গেছে, তাকে না বলেই এদিক সেদিক চলে যাচ্ছে। তার উপর আজকে তার জন্মদিন কিন্তু আলভীর সেদিকে খেয়ালও নেই। অলি কলটা রিসিভ করে কানের কাছে ধরলো। আলভী অপরপাশ থেকে বলল,
“ঘুম ভেঙ্গেছে?”
অলি নিম্নস্বরে বলল, “হু।”
“ব্রেকফাস্ট করেছো?”
“হু।”
ফোনের দুপ্রান্তেই নীরবতা নেমে এলো। কিছুক্ষণ পর অলি জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি খেয়েছেন?”
“না, এখন খাবো।”
“আচ্ছা খান তাহলে, রাখছি।”
“কেনো?”
“ব্রেকফাস্ট করুন।”
অলি কল কেটে দিলো। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে, সে চোখজোড়া মুছে খাবার খেতে লাগলো। এদিকে আলভী একবার সামনে রাখা খাবার গুলোর দিকে তাকিয়ে একজন স্টাফকে ডাক দিলো,
“খাবার গুলো নিয়ে যাও।”
স্টাফ দেখলো আলভী খাবারে হাতও দেয়নি। তবুও আলভীকে প্রশ্ন করার সাহস তার নেই তাই আলভীর কথামতো খাবারগুলো নিয়ে চলে গেলো। আলভী বসা থেকে উঠে এপ্রোন টা হাতে নিলো। তারপর অফিস থেকে বেরিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে হাটা ধরলো।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে, অলি ব্যালকনিতে হাটুতে মুখ গুজে বসে আছে। চোখের কোণা থেকে নোনাজল অবাধে গড়িয়ে পড়ছে। আজকের মতো একটা দিনে তার পাশে কেউ নেই। সে এই বদ্ধ রুমে ম*রে গেলে কেউ জানতেও পারবেনা। পাশে রাখা ফোনটা একাধারে বেজে চলেছে। অলি রিসিভ করার প্রয়োজন টুকুও বোধ করলোনা।
বিকেল পাচটার দিকে আলভী রুমে প্রবেশ করে।
“অলিইইই”
আলভী পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে দেখলো অলি রুমে নেই। সে ওয়াশরুমে খুঁজে ব্যালকনিতে এসে দেখলো অলি হাটুতে মুখ গুজে বসে থাকা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে গেছে। আলভী থেমে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আলগোছে অলিকে কোলে তুলে নিলো। অলি ঘুমের মাঝেই হিচকি তুললো। আলভী লক্ষ্য করে দেখলো অলির চোখের পাপড়ি গুলো ভেজা। আলভীর বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সে কিভাবে বোঝাবে কেনো সে অলির থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তার মাঝে যে অলির সামনে দাড়ানোর সাহসটুকুও নেই। সে যে খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছে। অলি ঘুমের মাঝেই আলভীর গলা জড়িয়ে ধরে আলভীর ঘাড়ের ভাজে মুখ গুজলো। এরকম করায় আলভী জমে গেলো। সে সেভাবেই দাঁড়িয়ে পড়লো। পাজোড়াও জমে গেছে, নড়াচড়ার ক্ষমতাটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছে। প্রায় ১৭ মিনিট পর অলির ঘুম হাল্কা হয়ে এলো। একটা সুপরিচিত ঘ্রাণ নাকে আসতেই সে পিটপিট চোখে তাকায়। চোখ খুলতেই আলভীর ঘাড়ে থাকা তিলটা নজরে এলো। অলি বুঝতে পারলো সে আলভীর কোলে আছে তাই সে দ্রুত নেমে যেতে চাইলো আলভীও তাকে নামিয়ে দিলো। অলি চোখ মুছে কড়া গলায় বলল,
“আপনি আমাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেনো?”
আলভী জবাব না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করলো,
“তুমি আমার কল রিসিভ করছিলে না কেনো? আমাকে চিন্তা দিয়ে মে*রে ফেলতে চাইছো নাকি?”
অলি অবাক চোখে আলভীর দিকে তাকায়,
“আপনার আমার জন্য চিন্তাও হয়?”
আলভী উত্তর দিলোনা, ওভার কোটটা খুলে বিছানার উপর ছুড়ে মারলো। তারপর এক এক করে পকেট থেকে ফোন, মানিব্যাগ আর হাত থেকে ঘড়িটা খুলেও খাটের উপর ছুড়ে মারলো। অলি একভাবে দাঁড়িয়ে রইলো,
“বলুন, আমার জন্য আপনার চিন্তা হয়?”
আলভী হঠাৎ করে অলিকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলে,
“তুমি জানোনা? আমার চিন্তা হয় কি নাহয়? কেনো এমন প্রশ্ন করছো?”
অলি নিম্নস্বরে বলল, “আমি না, আপনি অস্বাভাবিক আচরণ করছেন। কেনো করছেন? আপনার কি আমাকে ভালো লাগছেনা? ভালো না লাগলে বলে দিন তবুও অবহেলা করবেন না।”
আলভী অলিকে নিজের আরও কাছে টেনে নিয়ে হিসহিসিয়ে বলল, “আমি তোমাকে অবহেলা করছিনা হানিবি। তুমি ভুল বুঝছো।”
অলির চোখে পানি জমলো, আলভী ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“কি হয়েছে তোমার? কেনো কান্না করছো? আমার জানামতে তো সবকিছু ঠিকঠাকই আছে। চিন্তা করার মতোও তো কিছুই নেই। তাহলে তোমার মন খারাপ কেনো?”
অলি অন্যদিকে তাকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“ছাড়ুন আমাকে।”
আলভী আর শক্ত করে অলির কোমড় চেপে ধরলো।
“বলো আগে কি হয়েছে। তারপর ছেড়ে দেবো।”
অলি আলভীকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে করতেই কেদে উঠলো। আলভী বুঝে উঠতে পারছেনা যে অলির ঠিক কি হয়েছে। কিন্তু এবার সে বেশ চিন্তায় পড়ে গেছে। অলি কি সেই ব্যাপারটা কোনোভাবে জেনে গিয়ে এভাবে রিয়্যাক্ট করছে? কিন্তু সেটা জানবেই বা কিভাবে? না, না তাকে যেভাবেই হোক জানতে হবে যে অলির কি হয়েছে। আলভী ভাবনা চিন্তা করে অলিকে কোলে তুলে নিলো তারপর খাটে বসিয়ে তার হাতজোড়া একহাতে চেপে ধরে হাস্কিস্বরে বলল,
“কি হয়েছে তাড়াতাড়ি বলো, নইলে…
অলির ঠোঁটের দিকে ইশারা করে বলল,
“কথা বলার মতো অবস্থাতে রাখবোনা।”
অলি একটা ঢোক গিলে মিনমিনিয়ে বলল,
“কিছু হয়নি, আপনি আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন সেই জন্যই আমি রেগে আছি।”
আলভীর বিশ্বাস হলোনা। সে অলির হাতটা তার পেটের উপর রেখে বলল,
“এবার বলো। কল রিসিভ করছিলে না কেনো?”
অলি হাতটা সরিয়ে নিতে চাইলেও আলভী সরাতে দেয়না।
“ইউ হ্যাভ ফাইভ সেকেন্ডস তাড়াতাড়ি বলো। না বললেও সমস্যা নেই। উল্টো তুমি না বললে আমি দিশেহারা হয়ে তোমাকে কিস করে বসবো।”
অলি এবার না পেরে বলেই উঠলো,
“আপনি খুব খারাপ, ভীষণ খারাপ। আমার জন্মদিন কবে সেটাও জানেন না। আবার এসেছেন জোর জবরদস্তি করে আমার মুখ থেকেই সেটা বের করতে। কেউ কি বলে যে আজকে আমার জন্মদিন আমাকে উইশ করুন? বলে…না। আমিও বলতাম না। আমার এতো শখ নেই বলে কয়ে উইশ নেয়ার।”
অলি ঠোঁট চেপে কেদে উঠলো, “আজকে আমার বাবা মা থাকলে আমার দিনটা এতো খারাপ যেতোনা। আর কেউ উইশ না করলেও তারা আমাকে উইশ করতো। ঘুরতে নিয়ে যেতো। বোরিং বই গিফট করলেও, করতো…তো। আপনি শুধু মুখেই বলেন যে আমাকে ভালোবাসেন, আমাকে নিয়ে চিন্তা করেন কিন্তু আদৌ সেটা সত্যি নয়। হাহ আপনি যে আমাকে এতো কষ্ট দিচ্ছেন না। একদিন দেখবেন আমি ঠিক রাগ করে বাবা মায়ের কাছে চলে গেছি…সেদিন কেদেও আর আমাকে পাবেন না।”
অলি কথাগুলো বলে হু হু করে কাদছে। এদিকে তার কথাগুলো শুনে আলভীর চোখদুটো রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। ইচ্ছা করছে সবকিছু ভেঙ্গেচুরে তছনছ করে ফেলতে। মাথার মধ্যে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। আলভী রাগের বশে অলির ঘাড় চেপে ধরলো। ঘটনার আকস্মিকতায় অলির মাথা থেকে ওড়নাটা খুলে পড়ে গেলো। অলি একহাতে ওড়নাটা সামলাতে চাইলে আলভী ওড়নাটা খুলে দূরে ছুড়ে ফেলে দেয়। অলির কান্নার মাত্রা আরও বেড়ে গেলো। সে দুহাতে বুক ঢেকে কাপা কাপা কন্ঠে বলল,
“কি করছেন আপনি এসব?”
আলভী বসা থেকে দাঁড়িয়ে অলিকেও টেনে তুললো। অলির চুলগুলো বাধনহারা হয়ে পিঠের উপর ছড়িয়ে পড়েছে। আলভী আরও সুবিধা করে অলির চুলের ভাজে হাত ঢুকিয়ে তাকে নিজের দিকে টেনে নেয়। অলি লক্ষ্য করলো আলভীর চোখ দিয়ে যেন অগ্নি ঝরছে।
“কি বললি তুই? বাবা মায়ের কাছে চলে যাবি? আমাকে ছেড়ে চলে যাবি?”
“আহ, আহ ছাড়ুন আমার চুল ছিড়ে যাবে। ব্যাথা পাচ্ছি আমি।”
অলির কান্নার শব্দে আলভী রেগেমেগে অলির চুল ছেড়ে দিলো। তারপর দিক দিশা হারিয়ে দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেলো। অলি ফ্লোরে পড়ে থাকা ওড়না টা তুলে গলায় জড়িয়ে নিলো। তখনই একটা বিকট আওয়াজ তার কানে এলো অলি তাকিয়ে দেখে আলভী দেয়ালে ঘুষি মারছে। অলি দ্রুতপায়ে এগিয়ে গিয়ে আলভীর হাত ধরে ফেলে। আলভী অলিকে ধাক্কা দিতে গিয়েও নিজেকে সংযত করে নেয়।
“আপনি কি পাগল হয়ে গেলেন নাকি?”
আলভী নিরুত্তর, তার ভালো লাগছেনা কিছু। অলি আলভীর হাতটা সামনে এনে দেখলো হাতের আঙুলের গাট থেতলে গেছে। র*ক্ত বেরোবে বেরোবে ভাব। আলভী এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। আলতো হাতে অলিকে সরিয়ে দিয়ে মানিব্যাগ টা পকেটে গুজে বেরিয়ে যেতেই নেবে তার আগেই অলি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। হাত জোর করে বলে,
“স্যরি, আমার ভুল হয়েছে। আপনি প্লিজ এভাবে রেগেমেগে চলে যাবেন না। আমি আর…এগুলো বলবোনা।”
আলভী অলির দিকে না তাকিয়েই তাকে সামনে থেকে সরিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। অলি এবার খুব কষ্ট পেলো। সে খাটের উপর বসে চিল্লিয়ে বলতে লাগলো,
“হুহ আমি চলেই যাবো, থাকবোনা। আমি রাগ করেছি। আর আপনি রাগ না ভাঙ্গিয়ে উল্টো আমাকে মে*রেছেন। তারপর তেজ দেখিয়ে চলে গেছেন। আপনি খুব খারাপ। আমি আপনাকে একটুও ভালোবাসি না।”
কথাগুলো বলতে বলতেই অলির হিচকি উঠে গেলো। যেদিন তার বাবা মা চলে গিয়েছিলো সেদিনই লাস্ট এভাবে কেদেছে সে। আজকে আবারও এভাবে কাদছে, আলভী কি পারতোনা তাকে বুকে টেনে নিয়ে রাগ ভাঙ্গাতে? পারতোনা একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জন্মদিন না জানার জন্য স্যরি বলতে?
“পারতোনা, পারতোনা। কিচ্ছু পারেনা সে, মিথ্যা বলে যে আমাকে ভালোবাসে। হুহ মিথ্যুক একটা,”
অলি কাদতে কাদতেই বালিশে মুখ গুজলো,
“অবশ্য আমাকে সে কেনোই বা ভালোবাসবে? আমার কি যোগ্যতা আছে তার ভালোবাসা পাওয়ার? তার জন্য রূপসা আপুই পার্ফেক্ট ছিলো। আমি শুধুমাত্র একটা ভুল ছিলাম যেটাকে সে ঠিক করার চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি। আমার মন রক্ষার্থে সবসময় বলে যে আমাকে ভালোবাসে কিন্তু একটা মানুষ কয়দিন অভিনয় করতে পারে? সেও হয়তো আর পারছেনা ভালোবাসার অভিনয় করতে।”
রাত্রী নয়টা,
আলভী গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে সিগারেট ফুকছে। তার পাশেই দিহান গুরুগম্ভীর রূপে দাঁড়িয়ে আছে,
“তুই কি বলতো? ভাবী প্রেগন্যান্ট, এই অবস্থায় তার মুড সুইং হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু তো নয়। এই সময় এগুলো স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু তোর অবস্থা দেখে তো মনে হচ্ছে বাচ্চা ভাবীর পেটে না তোর পেটে আছে।”
কথাটা শুনে আলভী জ্বলন্ত চোখে দিহানের দিকে তাকিয়ে দাত কটমট করে বলে,
“মানলাম ওর মুড সুইং হয়েছে। তাই বলে আমাকে যা নয় তাই বলবে? জানে যে ওর চোখের পানি আমি সহ্য করতে পারিনা। আমি দিশেহারা হয়ে যাই। তারপরও কাদতে কাদতে একদম হিচকি তুলে ফেলবে। ও মনে হয় সত্যিই আমাকে বাচতে দেবেনা।”
“কিন্তু তুই কি সত্যিই ভাবীর জন্মদিনের ব্যাপারটা সম্পর্কে অবগত ছিলি না?”
আলভী দু আঙুল দ্বারা কপাল চেপে ধরে বলল,
“আরে ইয়ার আমি জানতাম। দুদিন আগেও আমার মনে ছিলো কিন্তু তুই তো জানিসই কালকে কি হয়েছে। তারপর আমি সব ভুলে গেছি।”
দিহান আলভীর কাধে হাত রেখে বলল,
“দেখ এভি, ভাবীর বাবা মা নেই। বলতে গেলে তুই ছাড়া তার আর কেউ নেই। কিন্তু তার পরিস্থিতি তুইও যদি না বুঝিস তাহলে সে কার কাছে যাবে বল। আমি জানি যে তুই নিজেও ঝামেলার মধ্যে আছিস কিন্তু সেসবের জন্য তো ভাবী দায়ী নয়। বেশির ভাগটাই তুই দায়ী। ভাবী পুরোপুরি ভাবেই তোর উপর নির্ভরশীল। কিন্তু তুই যদি তার ভার সামলাতে না পারিস তাহলে তোরা দুজনই ভেঙ্গে পড়বি। বোঝার চেষ্টা কর।”
আলভী সিগারেটের অবশিষ্ট অংশটা ফেলে দিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল,
“ও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে বলেছে। তাও আবার নাকি বাবা মায়ের কাছে চলে যাবে। এটা ও কিভাবে এতো সহজে বলে ফেললো? তুই ভাবতে পারছিস এই কথাটা শুনে আমার তখন কেমন লেগেছে? শুধুমাত্র প্রেগন্যান্ট বলে বেচে গেছে নইলে আজকে ওকে মে*রে নিজেও ম*রে যেতাম।”
দিহান বিরক্তসূচক শব্দ উচ্চারণ করে বলল,
“তুই যা করেছিস তা কি কম করেছিস? ভাবীর আজকে জন্মদিন, আর আজকেও তুই সারাদিন অফিস আর হসপিটালে কাটিয়েছিস। তারপর বাড়িতে গিয়ে তার উপর রাগ ঝেড়ে এসেছিস।”
আলভী নিজের হাতটা দেখিয়ে বলল,
“আমি নিজের উপর রাগ ঝেড়েছি ওকে কিছুই বলিনি।”
“কিছু না বললেই কি সমাধান হয়ে যাবে? তোর অবশ্যই স্যরি বলা উচিৎ ছিলো। ভাবী কান্না করছিলো আর তুই রাগ দেখিয়ে তাকে ওই অবস্থাতেই ফেলে চলে এলি। আচ্ছা তুই এতো দায়িত্বজ্ঞানহীন কিভাবে হলি? তুই তো এমন ছিলিনা।”
আলভী ভ্রুক্ষেপ করলোনা। দিহান কিছুক্ষণ চুপ থেকে হাতঘড়িতে চোখ বুলিয়ে বললো,
“এখনো সময় আছে। ভাবীর কাছে গিয়ে স্যরি বলে ব্যপারটা মিটমাট করে নে। এই অবস্থায় ভাবীকে এতো প্রেশার দিসনা এভি। তারপর কিন্তু কেদেও কূল কিনারা পাবিনা।”
আলভী থেমে গেলো সদ্য জ্বালানো সিগারেট টা পা দিয়ে পিষে ফেললো।
***
কারো উষ্ণ আলিঙ্গনে অলির ঘুমঘুম ভাবটা কেটে যায়। কিছুটা ভয় পেয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে বসতেই দেখলো আলভী ভ্রু কুচকে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
“এদিকে এসো।”
“আপনি কখন এলেন?”
অলির কথা শুনে আলভীর কপালে বিরক্তির ভাজ পড়লো। কিন্তু অলির ফোলা ফোলা চোখজোড়া দেখে তার কলিজা শুকিয়ে গেলো। সে উঠে বসে আলতো হাতে অলিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“রাগ করেছো ভালো কথা কান্না করেছো কেনো? তুমি জানোনা তোমার চোখে পানি দেখলে আমার মাথা ঠিক থাকেনা?”
অলি ছোটার চেষ্টা করে বলল, “ছাড়ুন, সিগারেট খেয়েছেন আপনি?”
আলভীর মেজাজ খারাপ হলো। রোমান্টিক মুডের ১২ টা বাজিয়ে দিয়েছে এই ষোড়শী নারী। সে অলিকে ছেড়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। অলি উঠে বিছানা ঝাড়তে লাগলো। আলভী ফ্রেশ হয়ে এসে অলিকে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল,
“এবার দেখো স্মেল আসছে?”
অলি রাগে ফুসতে লাগলো, “আপনি বলেছিলেন সিগারেট খাবেন না আর।”
“বাহঃ এটা মনে রেখেছো আর কন্ডিশনের কথা মনে রাখলেনা?”
অলি সরু চোখে তাকাতেই আলভী বলল,
“বলেছিলাম নিয়ম করে চুমু খেতে দিলে আর এগুলো খাবোনা। কিন্তু তোমাকে লাস্ট কবে চুমু খেয়েছি আমার মনে পড়ছেনা।”
কথাটা শুনে অলি লজ্জা পেলো। আলভী ফট করেই অলিকে খাটে বসিয়ে দিলো। তারপর নিজে অলির সামনে ফ্লোরে বসে অলির পা ধরতেই যাবে কিন্তু তার আগেই অলি চিল্লিয়ে ওঠে,
“এএএই কি করেন এগুলো?”
আলভী মৃদু হেসে জোর করে অলির ডান পা টা নিজের উরুর উপর রাখলো,
“তোমার এইপায়ে নূপুর ছিলো সেটা কি করেছো?”
অলি প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পেরে বলে ওঠে,
“বাম পায়ের টা হারিয়ে ফেলেছিলাম তাই এটাও খুলে রেখেছি।”
“আছে তোমার কাছে?”
অলি উপর নিচ মাথা নাড়লো।
“কোথায় আছে? নিয়ে এসো যাও।”
অলি কিছুক্ষণ অবাক চোখে আলভীর দিকে তাকিয়ে থেকে আলমারির দিকে এগিয়ে গেলো। আলভী কি সত্যিই পাগল হয়ে গেলো নাকি সেটা ভেবেই সে হয়রান। আলমারির পুরোটাই মূলত অলির আর আলোর কাপড়চোপড় দিয়ে ভরা। আলভীর কাপড়চোপড় সব কাভার্ডে রাখা। যদিও আলমারির একটা অংশে তার ইম্পর্ট্যান্ট কাগজপত্র রাখা আছে। অলি নূপুর টা বের করে আলভীর সামনে ধরতেই আলভী সেটা খপ করে নিয়ে নেয়। অলি হকচকিয়ে যেতেই আলভী পুনরায় তাকে খাটে বসিয়ে দেয়। এবার দুটো পা-ই নিজের কোলের উপর নিয়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। আলভীর স্পর্শে অলি ক্ষনে ক্ষনে কেপে উঠছে। আলভী হাল্কা হেসে প্যান্টের পকেট থেকে একজোড়া সোনালী রঙা নূপুর বের করে অলির পায়ে পড়িয়ে দিতে লাগলো। অলির চোখ দুটো আপনা-আপনি বড়বড় হয়ে গেলো। আলভী নূপুর টা পড়িয়ে দিয়ে অলির পায়ে চুমু খেলো। অলির এবার নাজেহাল অবস্থা। আলভী দুটো পায়েই নূপুর পড়িয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো তারপর ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে বলল,
“এগুলো তোমার জন্মদিনের উপহার। আর স্যরি জন্মদিন ভুলে যাওয়ার জন্য।”
আলভী দেখলো অলি একদম মূর্তির মতো বসে আছে। এতো বেশি সারপ্রাইজড হয়েছে যে মুখটাও অটোমেটিক হা হয়ে গেছে। আলভী ধপ করে অলির পাশে বসে পড়লো,
“তোমার আগের নূপুর টা আমি দিচ্ছিনা। আর শোনো তোমার বাম পায়ের নূপুর টাও আমার কাছেই ছিলো। সেগুলো আমার কাছেই থাকবে বুঝলে?”
অলি একভাবেই বসে রইলো। আলভী তার গালে টোকা দিয়ে বলল,
“একটু হেটে দেখাও তো।”
অলির হুশ এলো সে একটা শুষ্ক ঢোক গিলে উঠে দাড়ালো। একপা এগোতেই নূপুর জোড়া ঝনঝন শব্দ তুললো। অলি অবাক চোখে আলভীর দিকে ঘুরে তাকাতেই দেখলো আলভী একদৃষ্টিতে তার পায়ের দিকেই তাকিয়ে আছে।
“এগুলোতে তো শব্দ হয়।”
আলভী আনমনেই বলল, “হুম”
“কিন্তু শব্দযুক্ত নূপুর পড়তে হয়না।”
আলভী বালিশ টা টেনে কোলে নিয়ে বলে,
“আমার সামনে কোনো কিছুই নিষিদ্ধ নয়। তাছাড়া আমার রুম সাউন্ডপ্রুফ এই শব্দ শুধু আমিই শুনতে পাবো। বাইরে যাবেনা। বাইরে কোথাও যাওয়ার আগে খুলে রাখবে।”
অলি হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো।
“হাটো।”
অলির বুকের ভেতর ধুকপুক ধুকপুক করছে। সে আবারও হাটতে লাগলো। এদিকে নূপুরের রিনিঝিনি শব্দে আলভী যেন অন্য জগতে হারিয়ে গেছে। অনেক আগে থেকেই সে ভেবে রেখেছিলো অলিকে সে নূপুর পড়িয়ে সেই শব্দ উপভোগ করবে। হঠাৎ করে তার কিছু মনে পড়তেই সে উঠে দাড়ালো। তাকে উঠতে দেখে অলিও হাটা থামিয়ে দিলো। আলভী সোজা ব্যালকনিতে চলে গেলো। অলি ভ্রু কুচকে তার যাওয়ার পানে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আলভী একটা গোলাপ ফুলের তোড়া নিয়ে বেরিয়ে এলো। তার নাকমুখ কুচকে গেছে। একপ্রকার তারাহুরো করেই বলল,
“এটা নেও কুইক।”
অলি আলভীর কথামতো ফুলের তোড়াটা হাতে নিতেই আলভী ওয়াশরুমে চলে গেলো। এদিকে গোলাপ ফুল দেখে অলির চোখ চকচক করে উঠলো। গতকাল বাড়িতে গিয়েছিলো সে কিন্তু ফুল গাছ থেকে ফুল ছিড়তে তার ভালো লাগেনা তাই সে ফুলে হাত দেয়নি। কিন্তু এখন গোলাপ ফুলগুলো দেখে সে ভীষণ খুশি হয়েছে, অলি ফুলগুলো নাকের সামনে এনে ঘ্রাণ নিতে লাগলো কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই তার হাত মুখ চুলকাতে লাগলো।
আলভী ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে যা দেখলো তা দেখার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা…
চলবে,,,
শব্দসংখ্যা- ২৯৫০+
#১৫_বছর_বয়সী_মা (৫১)
#সোফিয়া_সাফা
{রহস্যের অন্তরালে}
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে অলির অবস্থা দেখে আলভী স্তব্ধ হয়ে গেলো। অলির চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে। চোখ মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। আলভী দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো,
“কি হয়েছে তোমার, এই অবস্থা হলো কিভাবে?”
অলি ডান হাত দিয়ে বাম হাত চুলকাতে চুলকাতে বলল,
“জানিনা কি হয়েছে। কিন্তু জ্বলে যাচ্ছে।”
আলভী অলির বাম হাত থেকে ফুলের তোড়াটা নিয়ে রুমের কোণায় থাকা ডাস্টবিনে ফেলে দিলো। এদিকে অলির এবার হাচিও আসছে,
“গোলাপ ফুলে তো আমার এলার্জি তোমার এই অবস্থা হলো কেনো?”
আলভীর কথা শুনে অলি চোখজোড়া মুছে বলল,
“আমি কিভাবে বলবো? আপনার সাথে থাকতে থাকতে বোধহয় আমার সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে।”
আলভী অলিকে উপর নিচ পরখ করে দেখতে লাগলো। তারপর একটা শ্বাস ফেলে বলল,
“তোমার আগে কখনো এমনটা হয়েছে?”
অলি নাবোধক মাথা নাড়তে গিয়েও কিছু একটা মনে করে থেমে যায়।
“এর আগে একবার হয়েছিলো যখন আমি পরীক্ষার জন্য বাড়িতে গিয়েছিলাম তখন আমি আজকের মতোই ফুলের ঘ্রাণ নিতে গিয়েছিলাম, তারপর এমনটাই হয়েছিলো। আমি তখন ভেবেছিলাম হয়তো ধুতরা পাতা লেগেছে কিন্তু আজকে কি হলো?”
“তার মানে প্রেগন্যান্ট হওয়ার আগে এমনটা কখনো হয়নি তাইনা।”
অলির খানিকটা রাগ উঠলো সে হাত মুখ চুলকাতে চুলকাতে অস্থির আর আলভী এসব কি প্রশ্ন করছে,
“আগে কিছু করুন। আমার শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।”
আলভী ঘাবড়ে গেলো সে অলিকে ওয়াশরুমে নিয়ে বেসিনের সামনে দাড় করালো। কল ছেড়ে দিয়ে বলল,
“চোখেমুখে পানি দেও আরাম লাগবে।”
অলি চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিলো তারপর হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে এলো। আলভী দেখলো অলির চোখমুখ আরো বেশি ফুলে যাচ্ছে। সে কি করবে দিশা পাচ্ছেনা। অলির তো তার থেকেও বেশি রিয়েকশন হচ্ছে। ভাগ্যিস গতকাল অলি ফুলের বাগান থেকে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো নইলে কি হতো আলভী আর ভাবতে পারছেনা। অলি এগিয়ে এসে বলল,
“আপনারও তো গোলাপে এলার্জি হয়। তখন আপনি যেই মেডিসিন খান সেটা আমাকে দিন তারাতাড়ি। অনেক কষ্ট হচ্ছে আমার।”
আলভী মেডিসিন আনতে গেলেও মেডিসিন টা হাতে নিয়ে থেমে যায়,
“অলি তুমি হুট করেই এসব ওষুধ খেতে পারবেনা। কারণ সব অ্যান্টিহিস্টামিন প্রেগন্যান্সিতে সেফ নয়। আমি রিস্ক নিতে পারবোনা।”
“তাহ…লে এখন কি করবো?”
আলভী তাড়াহুড়ো করে বিছানার পাশের ড্রয়ার থেকে স্যালাইন সলিউশন আর এক টুকরো তুলা বের করল। তারপর অলিকে বিছানায় বসিয়ে অলির চোখ মুখ ধীরে ধীরে মুছে দিতে দিতে বলল,
“চোখে এটা দেয়ার পরও যদি না কমে তবে আমি তোমাকে হসপিটালে নিয়ে যাবো। সেখানে সেফ অ্যান্টিহিস্টামিন বা অন্য চিকিৎসা দেওয়া যাবে।”
অলি ম্লান হেসে আলভীর দিকে তাকিয়ে রইলো। লোকটা বরাবরই তার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত প্রোটেক্টটিভ। কিছুক্ষণ যেতেই অলি কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেলো। কিন্তু নিজের অবস্থা দেখে সে ভীষণ হতাশ। গোলাপ তার প্রিয় ফুল, এরকম টা তো আলভীর সাথে দেখা হবার আগে কখনোই হয়নি।
“আমি কি আর গোলাপ ফুলের ঘ্রাণ নিতে পারবোনা? সেগুলো ছুতেও পারবোনা?”
আলভী কিছুক্ষণ ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“দেখো অলি, প্রেগন্যান্সিতে শরীর একটু বেশিই সংবেদনশীল হয়ে যায়। তাই হয়তো তোমার এরকমটা হয়েছে। আই থিংক বেবিটা হয়ে গেলে তুমি আবারও নরমাল হয়ে যাবে।”
“প্রেগন্যান্সিতে সবার সাথেই কি এমনটা হয়?”
“তা হয়না। কিন্তু প্রেগন্যান্ট অবস্থায় এসব ফুল টুল থেকে দূরে থাকাই ভালো।”
“আপনি তাহলে এতোকিছু জেনেও কেনো ফুল এনেছেন, তারউপর আপনারও তো গোলাপে এলার্জি তারপরেও সেটা কিনলেনই বা কেনো?”
আলভী নির্লিপ্ত চোখে অলির দিকে তাকালো, “কারণ আজকে তোমার জন্মদিন ছিলো। আর আমি সেটা ভুলে গেছি। আমি ভাবলাম ফুলগুলো দেখলে তুমি খুশি হয়ে যাবে আর রাগ করে থাকবেনা কিন্তু সবকিছু গুলিয়ে গেলো।”
অলি অবাক চোখে তাকায়, চোখেমুখে এক আকাশ বিস্ময়। লোকটা তাকে খুশি করতে এলার্জি থাকা সত্ত্বেও তার জন্য গোলাপ ফুল কিনে এনেছিলো? অলির চাহনি দেখে আলভী খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো, নিম্নস্বরে বলল,
“তুমি এখনো রেগে আছো?”
অলির কপাল কুচকে এলো। আলভী এবার একটা শুষ্ক ঢোক গিলে বলল,
“দেখো অলি আমার এখানে কোনো দোষ নেই। বেবিটা তোমার পেটে আছে বলেই কিন্তু তোমার এতো এতো মুড সুইং হচ্ছে তার উপর এলার্জির জন্যও ওই বেবিটাই দায়ী আমি একদম নিষ্পাপ।”
অলি ধীরে ধীরে আওড়ালো,
“মুড সুইং?”
“হুম এইযে তুমি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আমার উপর রেগে যাচ্ছো। উদ্ভট কথাবার্তা বলছো, অকারণেই কাদতে কাদতে হিচকি তুলে ফেলছো। এগুলোই তো মুড সুইং।”
অলি জানে মুড সুইংয়ের মানে। কিন্তু সে কোথায় অকারণে কেদেছে?
“শুনুন আমি অকারণেই কাদিনি। আপনি আমাকে অবহেলা করেছেন সেই জন্যই কেদেছি।”
আলভী সরু চোখে তাকিয়ে বলল, “আমি তোমাকে অবহেলা করিনি তুমিই উল্টো পাল্টা ভেবে নিচ্ছো।”
অলি আলতো ভাবে আলভীর হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“ওহ আচ্ছা আমি উল্টো পাল্টা ভেবে নিচ্ছি? তাহলে আপনিই সোজা সাপ্টা ভাবে বলুন। কেনো এড়িয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”
“আমার কাজ ছিলো, বোঝার চেষ্টা করো। তুমি সকালে ঘুমোচ্ছিলে আমি তোমাকে জাগাতে চাইনি। সেই জন্যই না বলে চলে গিয়েছিলাম।”
অলি আর কথা বাড়ালোনা।
“যাও শুয়ে পড়ো গিয়ে,”
অলি মাথা নেড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো, আলভীও লাইট অফ করে অলির পাশে এসে শুয়ে পড়লো। সে ফোন চাপছে, অলি অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ যেতেই আলভী ফোনটা রেখে শুয়ে পড়লো। অলি একটা বড় শ্বাস টেনে আলভীর দিকে ঘুরে গেলো। হঠাৎ এরকম করায় আলভী ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকায়, টেবিল ল্যাম্পের কমলা রঙের আলোয় আলভীর চেহারা দৃশ্যমান হতেই এতোক্ষণ ধরে জমানো সাহসটুকু ছু হয়ে গেলো। অলি একটা ঢোক গিলে অন্যদিকে ঘুরতে গেলেই আলভী তার দিকে খানিকটা ঝুকে যায়,
“কিছু কি বলবে?”
অলির গলা শুকিয়ে আসছে, আলভীকে এতোটা কাছে দেখে তার দম আটকে আসার উপক্রম। বুকের গহীনে থাকা প্রাণপাখীটা যেন এক্ষুনি উড়ে যাবে। তবুও সবটুকু সাহস পুনরায় একত্রিত করে সে হঠাৎই আলভীর ঠোঁটে নিজের দাঁত বসিয়ে দিলো। এক সেকেন্ড হবে কিনা সন্দেহ অলি পুনরায় অন্যদিকে ফিরে কম্ফোর্টার মুড়ো দিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো। ঘটনার আকস্মিকতায় আলভী হতবিহ্বল হয়ে গেলো। অলি যেন তাকে কারেন্টের শকড দিয়েছে। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে তার বেশ কিছুক্ষণ লাগলো। নিজের অধরে আঙুল ঠেকিয়ে তাকিয়ে রইলো অলির পানে। পুরো ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই সে অলির কম্ফোর্টার ধরে টানতে লাগলো,
“এই মেয়ে এই, এটা কি করলে আমার সাথে?”
অলি কম্ফোর্টার আরো শক্ত করে চেপে ধরে রিনরিনে গলায় বলল,
“আমি শুধু ধন্যবাদ দিলাম গিফটের জন্য আর কিছু না। এভাবে ধন্যবাদ দেয়া তো আপনিই শিখিয়েছিলেন ভুলে গেলেন?”
আলভী থমকে গেলো। ওষ্ঠদ্বয় শুকিয়ে আসছে তার। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে আচমকা একটানে কম্ফোর্টার টা তুলে ফেললো। তারপর অলির হাত ধরে টেনে ওঠালো।
“আপনি কি বেশিই ব্যাথা পেয়েছেন? কিন্তু আমি তো আস্তেই দিয়েছি। রাগ করছেন কেনো?”
আলভী একপ্রকার অলিকে টেনেটুনে নিজের কোলে এনে বসালো। অলি নিজের ওড়না ঠিক করতে গেলে আলভী ওড়না টা খুলে দূরে ফেলে দেয়। অলি সাথে সাথেই হাত দিয়ে বুক ঢেকে ফেলে,
“এমন করবেন না। আমি স্যরি বলছি।”
আলভী বাকা হেসে অলির কানের কাছে মুখ নিয়ে হিসহিসিয়ে বলল,
“স্বামীকে স্যরি আর ধন্যবাদ জানানোর পদ্ধতি সেম। তুমি যদি স্যরি আর ধন্যবাদ একসাথে জানাতে চাও তাহলে তোমাকে একটু বেশি কষ্ট তো করতেই হবে। তোমার স্বামীর যে এটুকুতে মন ভরেনা। উল্টো অল্প সল্প আদরে তার অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়।”
অলির ভীষণ লজ্জা লাগছে, আলভী অদ্ভুত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। অলি না পেরে বুক থেকে হাত সরিয়ে আলভীর চোখজোড়া ঢেকে ফেললো। আলভী বিরক্তি সূচক শব্দ উচ্চারণ করে বলল,
“এভাবে আমার হক নষ্ট করছো কেনো? দেখতে দেও আমাকে। স্বামীর হক আদায় করা স্ত্রী হিসেবে তোমার জন্য ফরজ।”
অলি কেপে উঠলো আলভীর মুখ থেকে নির্গত প্রত্যেকটি বাক্য তার লোমকূপেও যেন আলোড়ন তুলছে। সে ঠোঁট চেপে ধরে হাসফাস করতে লাগলো। আলভীর এবার মেজাজ খারাপ হলো। তবুও নিজেকে সামলে বিরসকন্ঠে বলল,
“ছাড়ো আমাকে, ভয় নেই আমি তোমার সাথে জোরাজুরি করবোনা।”
আলভী নিজেই একহাতে অলির হাতজোড়া সরিয়ে দিয়ে আরেক হাতে নিজের চোখজোড়া ঢেকে নিলো,
“আমার চাহনি তোমার কাছে অনেক অসহ্যকর লাগে তাইনা? মাঝে মাঝে মনে হয় আমার চোখদুটো না থাকলেই ভালো হতো। যদি আমি অন্ধ হতাম তাহলে আমি তোমাকে চাইলেও দেখতে পারতাম না। আর তোমার অস্বস্তির কারণও হতাম না।”
আলভী অলির ওড়না আনার উদ্দেশ্যে উঠে যেতে নিলে অলি তার বুকের উপর আছড়ে পড়ে।
“আপনি এভাবে বলছেন কেনো? বিশ্বাস করুন আমার আপনাকে অনেক ভালো লাগে। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। আপনার মতো একজনকে পেয়ে আমি নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করি। তবে আপনি কাছে এলেই আমার শরীর অদ্ভুত আচরণ করে কিন্তু আমার মন আপনাকে ছাড়া কিছুই বোঝেনা। আপনি দূরে গেলে আমার কাছে সবকিছু অর্থহীন লাগে। আপনি কেনো বোঝেন না, আমি পারিনা আপনাকে ছাড়া থাকতে। আমাকে এভাবেই আগলে রাখুন না, ছেড়ে দেবেন না প্লিজ। আমি আপনার বুকের সাথে লেপ্টে থাকতে চাই আপনার শরীরের সবটুকু ঘ্রাণ শুষে নিতে চাই।”
অলি জানেনা সে কি বলছে, সে শুধু আলভীকে নিজের কাছে আটকে রাখতে চায়। সে যদি পারতো আলভীকে নিজের বুকের ভেতর ঢুকিয়ে রাখতো কোথাও যেতে দিতোনা। অলি শক্ত করে আলভীকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ঘাড়ে মুখ গুজে পাগলের মতো চুমু খাচ্ছে। আলভী মন দিয়ে অলির বলা প্রত্যেকটা কথা শুনেছে। সে বুঝে গেছে অলিকে সে জয় করে নিয়েছে। অলির ভালোবাসা সে পেয়ে গেছে। আলভী অলির পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। অলির ঠোঁটের এলোমেলো স্পর্শে সে যেন সুখের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। অলি হাপিয়ে গিয়ে আলভীর বুকের সাথে লেপ্টে রইলো। আলভী অলিকে ধীরে সুস্থে খাটে শুইয়ে দিলো তারপর একটু সরে গিয়ে ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিয়ে আবারও অলির কাছে ফিরে এলো।
“আমি অনেক তৃষ্ণার্থ বউজান। একটু আদর করি কেমন? আমি জানি আমাদের সম্পর্কটা আর দশটা সম্পর্কের মতো হালাল ভাবে শুরু হয়নি। আমি এও জানি বেবিটা না হওয়া পর্যন্ত আমাকে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যেই থাকতে হবে।”
আলভীর কথাগুলো শুনে অলি বরফের মতো গলে যেতে লাগলো। আলভী এবার অলির ঘাড়ের ভাজে মুখ গুজে মাতাল কন্ঠে বলল,
“লিমিট ক্রস করবোনা প্রমিস।”
অলি আর বাধা দিলোনা আলভীকে। নিজের শরীরের বিরুদ্ধে গিয়ে সে মনকে সমর্থন করলো। তার মন যে চায় আলভীর মধ্যে জমে থাকা সবটুকু ভালোবাসা আর আদরের স্বাদ গ্রহণ করতে। আর আলভীও চায় নিজের সবটুকু অলির তরে উজাড় করে দিতে।
***
ভালোবাসা, ভালোলাগা, আদর আর সোহাগের মাঝে চোখের পলকেই ১৫ টা দিন অতিবাহিত হয়ে গেলো। অলি যেন টেরই পেলোনা। এই কটা দিন সে আলভীর ভালোবাসার মাঝেই ডুবে ছিলো।
আজকে মির্জা ভিলাতে এক উৎসব মুখর পরিবেশ। হবে নাই বা কেনো বাড়ির একমাত্র মেয়েকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে আজ। হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন কদিন আগেই ঊর্মিলার ইয়ার ফাইনালের এক্সামে শেষ হয়েছে। দিহান বেচারাও আর অপেক্ষা করতে পারছিলোনা। অবশ্য দিহানের থেকে ঊর্মিলা বিয়ে নিয়ে অনেক বেশিই এক্সাইটেড। আলভী অবশ্য চেয়েছিলো অলির ডেলিভারির পরেই এসব করতে কিন্তু দিহানকে আবার কদিনের জন্য দেশের বাইরে যেতে হবে।
তাই দিহানের ফ্যামিলির সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজকেই মেয়ে দেখতে আসবে আর মেয়ে পছন্দ হলে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে যাবে। যদিও এসব শুধুই ফর্মালিটি, আলভী আগেই সবাইকে দিহান আর ঊর্মিলার ব্যাপারে রাজি করিয়ে ফেলেছে। বলে রাখা ভালো যে দিহান আর ঊর্মিলার সম্পর্কের ব্যাপারে কাউকেই জানানো হয়নি। সবাই জানে দিহান ভালো ছেলে তাই আলভী বোনের জন্য তাকে পছন্দ করেছে।
ঊর্মিলাকে শাড়ি পড়িয়ে রেডি করে দিচ্ছেন নূরনাহার। রূপসা আর তার মাকে দাওয়াত দেয়নি কেউ কারণ এতে আলভীর কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিলো। ইদানীং শাহানাজ বেগমও যেন ছেলের কথা বড্ড মান্য করেন সে হয়তো বুঝে গেছেন ছেলে কিসে ভালো থাকবে। তাছাড়া অলিও ধীরে ধীরে তার প্রিয় বউমা হয়ে উঠেছে অবশ্য এর মুখ্য আর প্রধান কারণ হচ্ছে নাতির জন্ম দেওয়াটা। অলি দেখতে শুনতে সুশ্রী, মনের দিক দিয়েও ভালো। আর কি চাই, টাকা পয়সা কি তার ছেলে কম কামাই করে অলির বাপের টাকাপয়সা থাকলেই বা তাদের কি আহামরি লাভ হতো। শাহানাজ বেগম এসবই ভাবছেন আর কিচেনে রান্নাবান্নার তদারকি করছেন। মেহমান এলো বলে, দাদুমনি একসপ্তাহ যাবত একটু সুস্থ হয়েছেন বেশি হাটাচলা না করতে পারলেও লাঠিতে ভর করে ড্রইংরুমে এসে বসেছেন।
অলির মনেও আনন্দের দোল লেগেছে। কতোদিন পর একটু আনন্দ উদযাপনের সুযোগ পাবে। যদিও আলভী তাকে খুব একটা তিড়িং বিড়িং করতে দেবে বলে মনে হয়না। লোকটা সবসময় গার্ডের মতো তার সামনে পেছনে ঘুরঘুর করে। অলির ন’মাস চলছে, যখন তখন তার লেবার পেইন শুরু হয়ে যেতে পারে। আলভী তাই অলিকে চোখের আড়াল পর্যন্ত হতে দেয়না। অলি ঊর্মিলার রুমে বসে পাস্তা খাচ্ছে আর ঊর্মিলার সাজুগুজু দেখছে। তার অনেক শখ ছিলো শাড়ি পড়ার কিন্তু এই পেট নিয়ে শাড়ি পড়লে তাকে কেমন দেখাবে সেটা ভেবেই আর পড়েনি। ঊর্মিলাকে একটা গোলাপি রঙের জামদানী শাড়ি পড়ানো হয়েছে, দেখতে অপূর্ব লাগছে।
“আপু তোমাকে তো অনেক সুন্দর লাগছে গো।”
অলির কথা শুনে ঊর্মিলা লাজুক হাসলো। এতোক্ষণ এক্সাইটমেন্ট থাকলেও এখন কেমন যেন অদ্ভুত টাইপের ফিলিংস হচ্ছে। এরই মাঝে আলভী দরজায় নক করে অলিকে ডাক দেয়,
“অলিই।”
অলি পাস্তার প্লেট টা রেখে আস্তে করে উঠে দাড়ালো। ওড়না টা ভালো করে টেনে ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। দরজা খুলে উঁকি দিতেই আলভী গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“বেরিয়ে এসো। তোমাকে না বলেছি রুমেই থাকবে। বের হলে কেনো বলোতো?”
অলি রুম থেকে বেরিয়ে এসে গাল ফুলিয়ে বলল,
“আমার রুমে বসে থাকতে ভালো লাগছিলোনা।”
আলভী একটা চাপা শ্বাস ফেললো, “আচ্ছা এসো তাহলে তোমাকে দাদুমনির পাশে বসিয়ে রেখে আসছি। সে যদি একটু বলে কয়ে বোঝাতে পারে।”
অলি মাথা নেড়ে হাটা ধরলো, পথিমধ্যে দেখা হয়ে গেলো ইয়াদের সাথে। ইয়াদ বরাবরের মতোই একটা হাসি উপহার দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।
***
“দিহান ঊর্মিলাকে আংটিটা পড়িয়ে দে।”
মায়ের কথায় সম্মতি জানিয়ে দিহান ঊর্মিলার দিকে হাত এগিয়ে দেয়। ঊর্মিলা মাথা নিচু রেখেই দিহানের হাতের উপর হাত রাখলো। দিহান আংটিটা পড়িয়ে দিয়ে ঊর্মিলার দিকে তাকাতেই ঊর্মিলা সবার অগোচরে দিহানকে চোখ টিপ মারলো। এহেন কান্ডে দিহান হকচকিয়ে গেলো। এদিকে ঊর্মিলার চোখ টিপ দেওয়াটা অলি, আলভী আর ইয়াদ লক্ষ্য করেছে। ইয়াদ আর আলভীর ভ্রু কুচকে গেলেও অলি ফিক করে হেসে উঠলো। দিহান পানি খাওয়ার উদ্দেশ্যে টেবিলের দিকে হাত বাড়াতেই ইয়াদ এগিয়ে এসে তার দিকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। দিহান গ্লাসটা হাতে নিয়ে একবার ইয়াদের দিকে তাকায়। ছেলেটা একদমই ইন্ট্রোভার্ট টাইপের। কখনোই প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেনা। অদ্ভুত,
“তো সামনের মাসেই ওদের বিয়ের ডেট ফিক্সড করি? কি বলেন বেয়াই সাহেব?”
দিহানের বাবার কথার প্রতিউত্তরে উসমান মির্জা সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ অবশ্যই। শুভ কাজ ফেলে রাখতে নেই।”
এভাবেই পাকা কথা হয়ে গেলো। সবাই বিকেলের নাস্তা করে বাড়িতে ফিরে গেলেন। অলিসহ বাড়ির সবাই ড্রইংরুমেই বসে আছে। আলভীও এতোক্ষণ ছিলো কিন্তু একটা ফোন আসাতে সে উপরে চলে গেছে। নূরনাহার আর শাহানাজ বেগম কিচেনে সার্ভেন্টদের গোছগাছের তদারকি করছেন। ইয়াদ টেবিল থেকে একটা নাশপাতির টুকরো মুখে নিয়ে চিবুতে চিবুতে ঊর্মিলার উদ্দেশ্যে বলল,
“কিরে তুই আমাদের মানসম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেললি কেনো হু?”
ঊর্মিলা থতমত খেয়ে গেলো। সে আবার কখন কি করেছে? ইয়াদের কথা শুনে বাকি সবাই অবাক চোখে তাকায়, দাদুমনি বললেন,
“কি বলছো দাদুভাই?”
ইয়াদ তীর্যক হেসে বলল, “তোমার পেয়ারের নাতনি সবার সামনে কি করেছে জানো?”
ঊর্মিলা এবার একটা ঢোক গিলে বলল, “ভাইয়া তুমি কিসব বলছো আমার নামে?”
“কিসব বলছি মানে? তুই সবার সামনে দিহান ভাইকে চোখ টিপ মারলি কেনো গাধী? যদি তার বাবা মা দেখে ফেলতো কি ভাবতেন ওনারা?”
ইয়াদের কথা শুনে দাদুমনি হেসে উঠলেন। অলিও তার সাথে তাল মেলালো। উসমান মির্জা আর ইয়ামিন মির্জা বিব্রতবোধ করে নিজেদের রুমের দিকে পা বাড়ালেন। এদিকে ঊর্মিলা বাবা আর কাকার সামনে ভারী লজ্জা পেয়েছে। তবে তারা চলে যেতেই সে বলে উঠলো,
“ভাইয়া তুমি কি বলোতো দিলে তো বাবা আর কাকার সামনে আমার প্রেস্টিজ পাঞ্চার করে।”
ইয়াদ এগিয়ে গিয়ে ঊর্মিলার মাথায় চাপড় দিয়ে বলল,
“আর তুই যে আমাদের সবার প্রেস্টিজের ফালুদা বানিয়ে তোর শ্বশুর শাশুড়ীর সামনে পরিবেশন করেছিলি তখন?”
ঊর্মিলা এবার না পেরে বলল, “আরে ভাইয়া আমি ইচ্ছা করে করিনি আমার চোখে কি যেন সমস্যা হয়েছিলো তাই ভুল করে তেমনটা হয়ে গিয়েছিল।”
“ও আচ্ছা তাহলে চল তোকে ভাইয়ার কাছে নিয়ে যাই। বিয়ের আগে চোখে সমস্যা হওয়া তো ভালো লক্ষ্মণ নয়”
ঊর্মিলা কাদোকাদো মুখ করে বলল, “ওর কাছে কেনো যাবো?”
“অভিয়াসলি ভাইয়া একজন ডাক্তার সেই জন্য। যখন পিঠের উপর ভাইয়ার হাতের স্পেশাল ডোজ পড়বে তখন তোর চোখের সকল সমস্যারা সুড়সুড় করে পালিয়ে যাবে।”
কথাটা বলে ইয়াদ ঊর্মিলার মাথায় আবারও চাপড় দিলো ঊর্মিলা এবার ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“ভাইয়া প্লিজ, ভুল হয়েছে আমার।”
ইয়াদ এবার হেসে উঠলো, তার সাথে দাদুমনিও হাসছে কিন্তু অলির হাসি মুহুর্তেই থেমে গেলো। কানে বারবার স্পষ্টভাবে বেজে উঠতে লাগলো,
—দেখা যাক তুই কতোক্ষণ টর্চার সহ্য করতে পারিস। পিঠের উপর যখন স্পেশাল ডোজ পড়বে তখন সুড়সুড় করে পেপারে সাইন করে দিবি।
এই একটা কথাই যেন দেয়ালের গায়ে প্রতিধ্বনি হয়ে আবারও ফিরে আসছে। অলির শরীর জমে গেলো, সে কাঠকাঠ চোখে ইয়াদের দিকে তাকাতেই দেখলো ইয়াদ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই ইয়াদ ঠোঁটের কোণে হাসি টানলো। অলির নিশ্বাস থমকে গেলো, গলা শুকিয়ে চৌচির। ইয়াদ তো ঊর্মিলার সাথে আবারো ইয়ার্কি করেই যাচ্ছে কিন্তু অলি তড়িৎ গতিতে বসা থেকে উঠে দাড়ালো। তার পা জোড়া অসম্ভব রকমের কাপছে। মনে হচ্ছে কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে পেছন থেকে টেনে ধরছে। অলি একমূহুর্ত আর অপেক্ষা করলোনা। দ্রুতপায়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো তাকে এভাবে চলে যেতে দেখে ইয়াদ কথা বলা থামিয়ে দিলো। তার চোখ অলিকে পেছন থেকে নিখুঁত ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এরই মাঝে অলি আরেকবার পিছু ফিরে তাকায়। আবারও চোখাচোখি হতেই ইয়াদ হাসি উপহার দিলো। অলি ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে তাকালো আর ভুলেও ইয়াদের দিকে তাকালোনা।
অলি রুমের সামনে এসে হাপাতে লাগলো, মনে হচ্ছে সে মরুভূমির বুকে হারিয়ে গিয়েছিলো মাত্রই একটু পানির দেখা পেয়েছে। সে দরজা খুলে রুমে ঢুকে দেখলো আলভী রুমে নেই। অলি ওড়না দিয়ে কপালের ঘামগুলো মুছে নিলো তারপর বাম হাত দিয়ে কোমড়ের পেছনটা চেপে ধরে এগোতে লাগলো ব্যালকনির দিকে। ব্যালকনির দরজা ফাঁক করে উঁকি দিতেই অলির কানে আলভীর বলা কিছু কথা ভেসে এলো, যেগুলো শুনে তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলো যেন।
চলবে,,,
শব্দসংখ্যা- ২৬০০+