#১৫_বছর_বয়সী_মা (৫৫)
#সোফিয়া_সাফা
আরিশের কান্নার শব্দে আলভীর মাথায় ধপ করে জ্বলে ওঠা আগুন নিমিষেই নিভে যায়। অলি সাথে সাথেই আরিশের মুখে খাবার গুজে তাকে শান্ত করে ফেলে। তারপর আলভীর উদ্দেশ্যে নিম্নস্বরে বলে,
“আমি আপনার সাথে বাজে বিহেভ করতে চাইনা। আমাকে কিছুসময় নিজের মতো থাকতে দিন।”
“তুমি নিজের মতো থাকতে চাইলে থাকতেই পারো। কিন্তু সারাদিন না খেয়ে থাকাটা একটু বেশি বেশিই হয়ে যাচ্ছেনা?”
“আমার ক্ষিধে লাগেনি, সকালে খেয়ে নেবো।”
আলভী উঠে চলে যেতে নিলে অলি তার হাত ধরে ফেলে।
“শুয়ে পড়ুন।”
কথাটা শুনে আলভী ভ্রু কুচকে অলির দিকে তাকায়, অলি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে, সেই জন্যই বলেছি।”
আলভী ফোনটা হাতে নিয়ে একজন সার্ভেন্টকে কল দিলো। সার্ভেন্ট এসে কাচগুলো পরিষ্কার করে চলে যেতেই আলভী লাইট অফ করে দিয়ে খাটের উপর শুয়ে পড়ে। আরিশ ঘুমিয়ে গেছে, অলি তাকে ডান পাশে শুইয়ে দিয়ে আলভীর দিকে ঘুরে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। অলির আলিঙ্গনে আলভী হকচকিয়ে গেলো। একটু আগেই কেমন রূঢ় বিহেভ করলো আর এখন আবার জড়িয়ে ধরছে? কি ব্যাপার? আলভী বেশি কিছু ভাবতে পারলোনা তার আগেই অলি বলল,
“আপনার ঘুম আসছেনা?”
আলভী নিশ্চুপ রইলো। মনে মনেই বলল,
“আমার মান-অভিমান, যন্ত্রণা কিংবা ভালোবাসার ভাষা বোঝার ক্ষমতা তোমার হয়নি অলি।”
অলি দ্বিধা নিয়ে আলভীর মাথায় হাত রাখলো। এটুকু স্পর্শেই আলভী চোখজোড়া বন্ধ করে নিলো। অলি ধীরে সুস্থে আলভীর মাথায় ভালোবাসা সহিত হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো,
অলির কোমল ছোয়ায় কিছুক্ষণের মধ্যেই আলভীর চোখজোড়া লেগে যায়। অলি যেন এই সুযোগটারই অপেক্ষায় ছিলো। সে ধীরেসুস্থে উঠে বসলো তারপর আরিশকে কোলে তুলে খাট থেমে নেমে দাড়ালো।
দরজার কাছে এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো অলি। আবার ফিরে গিয়ে টেবিল থেকে আলভীর ফোন আর নিজের ফোন হাতে তুলে নিলো। শেষবারের মতো চোখ রাখলো আলভীর ঘুমন্ত মুখে। বুকের গভীরে কেমন যেন চিনচিন করে উঠলো, কিন্তু মুখে কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ পেলোনা। দরজা খুলে বাইরে পা রাখলো। নিঃশব্দে দরজাটা বাইরে থেকে লক করে দিয়ে ফোনদুটো পাশের ফুলের টবের উপর রেখে গেলো, যেন আলভী পরে খুঁজে পায়।
অনেক আগেই চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলো অলি। সেই জন্য দরকারি কিছু জিনিস আর কাগজপত্র গোপনে ব্যাগে গুছিয়ে বাগানে ফেলে দিয়েছিলো। কিন্তু আলভীর জন্য দেরি হয়ে গেলো। যার জন্য এখন এই মাঝ রাতেই তাকে আশ্রয় খুঁজতে হবে।
বাগানে এসে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ব্যাগটা খুঁজতে লাগলো অলি। ঝোপঝাড়ের মধ্যে ফেলে দেওয়া ব্যাগটা খুঁজে পেতেই হালকা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ঠিক তখনই কান খাড়া হয়ে উঠলো, কারো কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। অলি একদম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। কোলে আরিশ নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে, ছোট্ট বুকটা ধীর লয়ে ওঠানামা করছে। অলি একবার চারপাশে তাকালো, তারপর গভীর নিঃশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে কণ্ঠস্বরের উৎসের দিকে এগোতে শুরু করলো। যত এগোল, ততই কথাগুলো স্পষ্ট হতে লাগলো,
—বাচ্চাটা দুনিয়াতে এসে গেছে। এবার আর ওই মেয়েটাকে আমাদের প্রয়োজন নেই। যেকোনো উপায়ে মেয়েটাকে মে*রেই ফেলবো।
অলি নীরব দর্শকের মতো গাছের পেছনে লুকিয়ে কথাগুলো শুনতে লাগলো। ছায়ামানবটি হাসতে হাসতেই বলল,
—দুপুরে এভি ছিলোনা সেই সুযোগে ওর খাবারে পয়জন মিশিয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু মেয়েটা বোধহয় খাবার গুলো খায়নি। হাহ ওর গুড লাক কতোদিন ওকে বাচিয়ে রাখতে পারে আমিও দেখে নেবো।
লোকটার কথা শুনে অলির সারা শরীর কেপে উঠলো। শ্বাস প্রশ্বাসের গতিও বেড়ে গেলো। লোকটা কল কেটে দিয়ে সামনে তাকাতেই বাগানে লাগানো লাইটের আলোয় অলি পুরোপুরি ভাবে লোকটার চেহারা দেখতে পায়। লোকটা হচ্ছে ‘ইয়াদ’। ইয়াদও অলির দিকে তাকাতেই নেবে কিন্তু তার আগেই ফোনটা আবারও বেজে ওঠে। ইয়াদ একটা শ্বাস ফেলে কলটা রিসিভ করে,
—ফোন দিচ্ছিস কেনো? তোর কি মনে হয়, এভির সর্বনাশ করার পরিকল্পনা করা ছাড়া আমার আর কোনো কাজ নেই?
ইয়াদ থামলো,
—একদম কান্নাকাটি করবিনা। তোর কান্নার শব্দগুলো একদম বিরক্তিকর। মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।
ফোনের অপাশ থেকে কিছু হয়তো বলল, যা শুনে ইয়াদ আবারও থেমে গেলো। তারপর বলতে লাগলো,
—লজ্জা করছেনা? যে তোর এতোবড় সর্বনাশ করলো তার জন্য হাউমাউ করে কান্না করতে? ও তোর থেকে মা হওয়ার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। বুঝিস এটার মানে? একটা মেয়ের মাঝে যদি মা হওয়ার ক্ষমতাটাই না থাকে তাহলে তার জীবন মূল্যহীন হয়ে যায়। শোন ফার্দার কল করে কান্নাকাটি করবিনা। তুই এভির বাচ্চার মা হতে চাস সেই জন্যই কিন্তু বাচ্চাটার কোনো ক্ষতি করিনি। নইলে এতোদিনে তুই এভির বউ হয়ে যেতে পারতি। মা আর বউ একসাথে হতে চাইলে তো একটু বেশিই ধৈর্য্য ধরতে হবে রূপ।
অলি গাছের আড়ালে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যেন শরীরটা ভারী পাথরে পরিণত হয়েছে। আর কোনো সন্দেহের অবকাশ রইলো না। এসবের নেপথ্যে ইয়াদই আছে। ফুপাতো বোনের স্বার্থ রক্ষার জন্যই সে এমন নির্মম ফাঁদ পেতেছে, এমনকি অলিকে মে*রে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করছে না।
ইয়াদ কল কেটে সোজা বাড়ির দিকে পা বাড়াল। অলি তাকিয়ে রইলো তার চলে যাওয়ার দিকটায়। কিছুক্ষণ পর ধীরপায়ে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। নিজের পায়ের শব্দ যেন নিজেই শুনতে পাচ্ছেনা। ভারী মন নিয়ে অলি নতুন পথে হাঁটা শুরু করলো। যেদিকে দুচোখ যাবে সেদিকেই চলে যাবে সে। তবুও এই অভিশপ্ত বাড়িতে আর এক মুহূর্তও থাকবে না।
যেই বাড়ি তার থেকে সব কেড়ে নিয়েও ক্ষান্ত হয়নি। এখন তার বাচ্চাটাকেও কেড়ে নেওয়ার জাল বুনছে। এমনকি বেচে থাকার অধিকার টুকুও কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত করছে। সে থাকবেনা আর এই বেঈমান মুখোশধারী জানো*য়ারদের সাথে। যদি আল্লাহ তার নসিবে মৃত্যু লিখে থাকেন, তবে তা হোক অন্য কোথাও; কিন্তু এই জানো*য়ারদের হাতে সে ম*রবে না। আর নাতো এই জানো*য়ারদের হাতে নিজের সন্তানকে তুলে দেবে।
ভোরের দিকে,
ঘুমের ঘোরে অভ্যাসবশতই অলিকে জড়িয়ে ধরার উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দিলো আলভী কিন্তু ফাঁকা বিছানায় হাত পড়তেই তার ঘুম ভেঙে গেলো। মুহূর্তের ভেতরেই চোখ মেলে তাকাল, পাশের জায়গাটা শূন্য পরে আছে। আঁতকে উঠে এক লাফে খাট থেকে নেমে গেলো আলভী। প্রথমেই দৌড়ে গেলো ওয়াশরুমে, তারপর ব্যালকনিতে। প্রতিটি জায়গায় অস্থির চোখে খুঁজলো, কিন্তু কোথাও অলির ছায়া পর্যন্ত নেই। আলভী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মাথার চুল টানতে টানতে দরজা খুলতে চাইলো কিন্তু দরজা বাইরে থেকে লক করা। গতদিন দরজাটা ভেতর থেকে লক থাকায় ভাঙ্গার সময় শুধু ভেতরেই লকটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো কিন্তু বাইরের লকটা পুরোপুরি অক্ষত ছিলো।
এক মুহূর্ত দেরি না করে ফোন খুঁজতে শুরু করল আলভী। বিছানা, টেবিল, চারপাশ সব তন্নতন্ন করে খুঁজেও ফোনের কোনো হদিস মিলল না। কয়েক সেকেন্ডের ভেতরেই বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে উঠলো, অলি কি তবে ছেলেকে নিয়ে অজানায় পাড়ি জমিয়েছে? ব্যপারটা বোধগম্য হতেই আলভীর মাথার ভেতর যেন বজ্রাঘাত হলো। শরীর মুহূর্তেই অবশ হয়ে এলো, হাতপা কাঁপতে লাগলো। দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা হারিয়ে ধপ করে ফ্লোরেই বসে পড়লো,
“অলিইইইইই”
আলভী চিৎকার করে ডাকতে লাগলো। যদিও সে জানে এই ডাক আর অলি অবধি পৌছাবে না। আলভী বহু কষ্টে নিজেকে ব্যালকনি পর্যন্ত টেনে আনলো তারপর সেখানে দাঁড়িয়েই গগনবিদারী চিৎকারে ডাকতে লাগলো,
“অলিইইই যেওনা, আমাকে ছেড়ে। প্লিজ, ফিরে এসো।”
আলভী পাগলের মতো আচরণ করছে। বিভ্রমের বশে যেদিকেই তাকাচ্ছে অলিকেই দেখতে পাচ্ছে, যেমন এখন সে দেখতে পাচ্ছে অলি বাগানের সাইডে থাকা পুকুর পাড়ে বসে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আলভী গলায় কম্পন অনুভব করলো, অসহায় কন্ঠে আবারও চিল্লিয়ে উঠলো,
“হানিবি… দাঁড়াও, আমি আসছি। আমাকে ছেড়ে তুমি যেতে পারোনা। আমি তোমাকে কোত্থাও যেতে দেবোনা।”
বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা সেই মরিয়া অনুভূতি আলভীকে আর স্থির থাকতে দিলোনা। একপর্যায়ে উদ্ভ্রান্তের মতো ব্যালকনির রেলিঙে উঠে গেলো সে। চোখে মুখে ছিল শুধু একটাই দৃশ্য ‘অলি’। আলভী কোনো কিছু না ভেবেই সেখান থেকে ঝাপ দিলো।
“আমি সবকিছু ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম হানিবি শুধু তোমার জন্যই ফিরে এসেছি। আমৃত্যু তোমার জন্যই ফিরে আসবো। পরিস্থিতির চাপে পথ ভিন্ন হতে পারে কিন্তু আমার লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য একমাত্র তুমি অবধি পৌছানো। জীবনের যেই রাস্তা ধরেই হাটিনা কেনো শেষ অবধি আমি বারবার, হাজার বার তোমার কাছেই ফিরে আসবো। তুমি শুধু আমার জন্য অপেক্ষা কোরো। করবে তো?……”
সকাল ১১ টা
“এক্সকিউজ মি, জানালার পাশের সিটটা আমার।”
পুরুষালি কন্ঠ শুনে জানালার পাশের সিটে বসে থাকা নিকাব পরিহিতা নারীটি পুরুষটির দিকে তাকাতেই থমকে গেলো। বিরবির করে উচ্চারণ করলো, “নোমান ভাই?”
এদিকে নিকাবের আড়ালে থাকা ষোড়শী রমণীটিকে চিনতে কিছুটা বেগ পেতে হলো। তবুও কনফার্ম হওয়ার জন্য বলে উঠলো, “মিসেস অলি? আর ইউ মিসেস অলি?”
অলি আনমনেই মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে ফেললো। নোমান যেন আকাশ থেকে পড়েছে। তৎক্ষনাৎ চোখ পড়ে অলির কোলে থাকা জোনাকি পোকা আর্ট করা বেবি র্যাপারে মোড়ানো নবজাতকের উপর।
“ওহ মাই গড। তোমার বেবি?”
অলি একটা শুষ্ক ঢোক গিলে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে। নোমান ধপ করেই অলির পাশের সীটে বসে পড়লো। ট্রেনে করে সিলেট যাওয়াকালীন অলিকে বাচ্চা সমেত দেখাটা যেন কল্পনাতীত ছিলো।
“আলভী ভাই কোথায়?”
অলি এদিক সেদিক তাকিয়ে বলে উঠলো, “আছে আশেপাশেই।”
নোমান একটা শ্বাস ফেলে বলল, “বাহঃ তো কোথায় যাচ্ছো তোমরা?”
অলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে ওঠে, “ঘু…রতে, ঘুরতে যাচ্ছি।”
“এতো ছোট্ট বেবিকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়াটা পিসফুল হবে?”
অলি অবাক চোখে তাকাতেই নোমান কথা ঘুরিয়ে বলে ওঠে,
“না মানে। বলতে চাইছিলাম, বাচ্চা সামলাবে নাকি আনন্দ উপভোগ করবে?”
“আমার বাচ্চাই আমার আনন্দ, আমার সবকিছু।”
নোমানের মুখে ম্লান হাসি ফুটে উঠলো। যাক ভালোবাসার মানুষটিকে সুখে দেখাটাও একটা সৌভাগ্য। যার মাঝে আলাদাই শান্তি আছে। নোমান এই মূহুর্তে সেই শান্তিটাই অনুভব করছে।
“স্যরি ওভাবে বলার জন্য।”
অলি নিশ্চুপ হয়ে রইল।
“আসলে ছেলে জাতির অন্তর্ভুক্ত তো তাই চাইলেও একজন মায়ের ফিলিংসগুলো পুরোপুরি অনুমান করতে পারবোনা।”
অলি প্রতিউত্তর করলোনা। বেশ খানিকক্ষণ কেটে গেলো, নোমান আঁড়চোখে অলির দিকে তাকালো। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে কিন্তু সে আলভীকে একবারও দেখেনি।
“মিসেস অলি, আলভী ভাই কোথায়? ট্রেন তো ছেড়ে দিয়েছে।”
অলি ফের বলল, “আছে আশেপাশেই।”
নোমান আর কিছু বলতে পারলোনা। সে বুঝে গেছে যে ঝামেলা কিছু একটা আছে। আর সেটার ব্যপারে অলি কিছু বলতে চাইছেনা। নোমান ঠিক করলো শেষ পর্যন্ত সে অলিকে পর্যবেক্ষণ করবে।
ঘড়ির কাটা টিকটিক শব্দে জানান দিচ্ছে এখন সন্ধ্যা ৬ টা। ট্রেন টি সবেমাত্র সিলেট শহরের স্টেশনে এসে পৌঁছেছে। পুরোটা রাস্তা নীরবেই কেটেছে। প্রয়োজন ব্যাতিত নোমান অলিকে আর কিছুই জিজ্ঞেস করেনি।
ট্রেন থেকে নামতেই অলি লক্ষ্য করলো নোমান তার পিছুপিছু আসছে। অলি হাটার গতি বাড়িয়ে দিলো ফলস্বরূপ নোমানও তাল মেলালো। অলির একহাতে ব্যাগ আরেক হাতে আরিশ। বাচ্চাটা বেশি জ্বালাতন করেনা বললেই চলে। একদম ঠান্ডা আর শান্ত স্বভাবের বাচ্চা। অলি পেছনে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো, “আপনি আমাকে ফলো করছেন কেনো?”
নোমান দাড়িয়ে গেলো, “ফলো করছিনা আমি জাস্ট দেখতে চাইছি আলভী ভাই কোথায়।”
অলি এবার পিছু ফিরে তাকায়, “নেই কোথাও নেই। আমি তাকে মুক্তি দিয়ে এসেছি। আমার জন্য তার জীবন জাহান্নাম হয়ে গিয়েছিলো। আমি তার বিশ্বাসের যোগ্য ছিলাম না। তাই… আমি…
অলি আর বলতে পারলোনা। গলা শুকিয়ে গেছে। শরীরে আর শক্তি অবশিষ্ট নেই। সে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত, বেচে থাকার জন্য লড়াই করতে করতে সে হয়তো মৃ*ত্যুর খুব নিকটে চলে এসেছে। অলি ফের প্রাণহীন কন্ঠে বলল,
“আপনি দয়া করে আমার পিছু নেবেন না।”
“আমি শুধু তুমি যেখানে যাচ্ছো সেখানে পৌঁছে দিয়ে আসবো। কিছুক্ষণ পর রাত হয়ে যাবে এভাবে একা একা চলাফেরা করাটা সেফ হবেনা।”
অলি ঠোঁট চেপে নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“আমার কোনো গন্তব্য বা লক্ষ্য নেই, আমি আশ্রয়হীন অস্তিত্বহীন এক যাযাবর। নদীর কিনারায় ঘড় বেধেছিলাম কিন্তু পোড়াকপালে সেটাও সইলোনা। দমকা ঝড়ে আমার সুখের ঘড়টা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলো, আমার শেষ আশ্রয়টুকুও কেড়ে নিয়ে আমাকে করে দিলো অস্তিত্বহীন। আমি এখন মৃ*ত্যু পথের যাত্রী। মৃ*ত্যু আমাকে টেনে নিচ্ছে নিজের দিকে। আর আমিও হেটে চলেছি অবলীলায়।”
অলির মতো পিচ্চি একটা মেয়ের মুখ থেকে এতো ভারী কথাগুলো শুনে নোমান রীতিমতো অবাক হলো। সেই সাথে বুঝতেও পারলো, সেদিনের পর অলিকে হয়তো আরও কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছে।
“আমি তোমার কথা বুঝতে পারলাম না মিসেস অলি। তুমি ম*রে যেতেই চাইলে পালিয়ে এলে কেনো? ওখানে বসেই তো ম*রে যেতে পারতে।”
“আ*ত্ম*হ*ত্যা করতে চাইনি আমি তাই পালিয়ে এসেছি। তবে সেখানে থাকলে অন্যের হাতে ম*রতে হতো। আমি অন্যের হাতেও ম*রতে চাইনা। আমার আলোকে তাদের হাতে সঁপে দিতে পারবোনা আমি। ও যে বড্ড নিষ্পাপ। মা হয়ে কি করে জানো*য়ারদের হাতে তুলে দিতাম?”
নোমান নিশ্চুপ হয়ে গেলো। অলি সামনের দিকে ঘুরে হাটা ধরলো।
***
হসপিটালের শুভ্র বেডের উপর শুয়ে আছে আলভী। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। মাথায় আর বাম হাতে ব্যান্ডেজ প্যাচানো। পাশেই হার্টরেট মনিটরিং ডিভাইসের টুংটুং শব্দ জানান দিচ্ছে শেষ নিশ্বাস টুকু এখনো আটকে আছে। কাচের জানালার ওপাশ থেকে শাহানাজ বেগম ছেলের অবস্থা দেখে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন। নূরনাহার তাকে সান্ত্বনা দিতে ব্যস্ত। ঊর্মিলা বাবার বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেদে উঠছে, দিহান, ইয়াদ আর ইয়ামিন মির্জা পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।
“বাবা, ভাইয়া কিভাবে ব্যালকনি থেকে পড়ে গেলো? আর ভাবীই বা ছেলেকে নিয়ে কোথায় উধাও হয়ে গেছে? ভাইয়ার রুমের দরজা বাইরে থেকে লক করা ছিলো কেনো? ফোনদুটোই বা ফুলের টবের উপরে কে রেখেছিলো?”
ঊর্মিলা তখন থেকেই বিলাপ করে যাচ্ছে। হাজারটা প্রশ্ন তার মনে, তবে উত্তর দেয়ার কেউ নেই। বাকিদের মনেও একই প্রশ্ন। দিহানের আজকে বিকেলে ফ্লাইট ছিলো। কিন্তু প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে এই অবস্থায় রেখে যাওয়া সম্ভব নয় বলে টিকেট ক্যান্সাল করে দিয়েছে।
রাত সাড়ে নয়টা,
আলভীর জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে হসপিটালের বেডে দেখে চমকে গেলো। মুখ থেকে অক্সিজেন মাক্সটা সরিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসলো। সামনে বসে থাকা বাড়ির লোকগুলো কিছু বলতে যাবে তার আগেই আলভী চিল্লিয়ে ওঠে,
“হোয়ার ইজ অলি? অলি ফিরে এসেছে? এসেছে তাইনা? আমি জানতাম ও ফিরে আসবে। ওর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। আমিই ওর শেষ আশ্রয়। আমি ছাড়া ওর কেউ নেই। ও কোথায়? আসতে বলো। আমি কিছুই বলবোনা ওকে। তবে এবার থেকে ওকে আমি লক করে রাখবো। দরকার হলে শেকল দিয়ে বেধে রাখবো। ডাকো ওকে।”
আলভীর কথা গুলো শুনে সবাই হতভম্ব হয়ে গেলো,
“কি বলছিস? ভাবী কোথায় গেছে?”
দিহান প্রশ্ন ছুড়লো কিন্তু এই প্রশ্ন শুনেই আলভী বুঝলো অলি ফিরে আসেনি। কথাটা বোধগম্য হতেই আলভী দিকবিদিকশুন্য হয়ে উঠে দাড়ালো। দাঁড়ানো মাত্রই তার মাথা ঘুরে গেলো। ব্যালকনি থেকে পড়ে যাওয়ার কারণে মাথার পেছনের সাইড ফেটে গেছে। বাম হাতটা পিঠের নিচে পড়ায় সেটাও মচকে গেছে। আলভী মাথা চেপে ধরে মনে মনেই আওড়ালো,
“তুই আমাকে ছেড়ে চলে গেলি? কিভাবে পারলি চলে যেতে? আমি কখনো ভাবতেও পারিনি যে তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাবি। আরে আমি তো জানতাম তোর পুরো দুনিয়াটাই আমার মাঝে সীমাবদ্ধ। আর যাই হোক আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারবিনা। এভাবে আমাকে ভুল প্রমাণ করে দিলি? এখন আমি কোথায় খুজবো তোকে?”
আলভীকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে শাহানাজ বেগম জিজ্ঞেস করলেন, “বউমা দাদুভাইকে নিয়ে কোথায় গেছে?”
আলভী বলল, “চলে গেছে।”
“চলে গেছে মানে? কোথায় চলে গেছে?”
দিহানের প্রশ্নের উত্তরে আলভী ছোট্ট করে উচ্চারণ করলো,
“জানিনা।”
আলভী আর কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে চায়না। সে ডান হাত দ্বারা মাথা চেপে ধরে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। বাকিরা শুধু আহাম্মকের মতো তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।
৩ দিন পর।।।
কেটে গেছে ৩ দিন। তবে আলভীর কাছে মনে হচ্ছে ৩ যুগ পেরিয়ে গেছে। অলিকে ছাড়া একেক সেকেন্ড যেনো একেক ঘন্টার সমতুল্য।
এখন মাঝরাত,
ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আলভী। মাথার আর হাতের ব্যান্ডেজ খোলা হয়নি। আরও কয়েকদিন পর খোলা হবে। পুরো রুমে জিনিসপত্রের ছড়াছড়ি, আসবাবপত্রও লণ্ডভণ্ড। খাটের উপর আরিশের জন্য কিনে আনা আদূরে পোশাক আর খেলনা গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। আলভীর চোখ আটকে আছে ড্রেসিং টেবিলের ভাঙ্গা আয়নায়। সেই আয়না, যেখানে প্রতিনিয়তই তার প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠত। এই আয়নাটার সামনে বসেই সে চুল বাধতো। চুল বাধা ছিলো যেন তার মৌলিক কাজের অংশ। আর আলভীর চোখে সেই দৃশ্য ছিল জাদুর মতো। আলভী অগণিত বার তাকে চুল বাধতে দেখেই বেসামাল হয়ে গিয়েছিলো। আজ সেই আয়না শুধু ভাঙা কাঁচের টুকরোয় আলভীর নিঃসঙ্গ প্রতিচ্ছবি ফিরিয়ে দিচ্ছে। চারদিকে ছড়িয়ে থাকা অন্ধকারে সেই প্রতিচ্ছবিও যেন অপরিচিত ঠেকছে।
“তোর আমার কথা মনে পড়ে না, তাই না? তাহলে আমার কেন এতো মনে পড়ে তোর কথা? আমি কি পাপ করেছিলাম বলেই এই শাস্তি পাচ্ছি? তোকে ভালোবাসাটা কি আসলেই পাপ ছিলো? কিন্তু… আমি তো জানতাম ভালোবাসা পাপ নয়।”
আলভী হঠাৎ থেমে গেল। কাঁপা হাতে একটা সিগারেট জ্বালালো। নীলচে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। ঘরের স্তব্ধ বাতাসে ধোঁয়াটা যেন অলির স্মৃতি হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। আলভী ধোঁয়ার আড়াল থেকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ভাঙা আয়নার দিকে। ঠোঁট নড়ে উঠল আবার,
“আমি তোকে খুঁজে বের করবোই। খুঁজে বের করে… শেকল দিয়ে বেঁধে রাখব। তবু তোকে সত্যিটা বলতে পারব না। কেন জানিস? কারণ সেই সত্য সহ্য করার শক্তি তোর কখনো ছিল না, আজও নেই, আর ভবিষ্যতেও হবে না। আর আমি… আমি সেই সত্যটাকে বহু আগেই নিজের হৃদয়ের গহীনে কবর দিয়ে ফেলেছি।”
সিগারেটটা শেষ হতেই আলভী ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ইনজেকশন বের করল। সে জানে, ভেতরে মর*ফিন আছে, এক ধরনের শক্তিশালী ওপিওয়েড, যা দ্রুত শরীরকে নিস্তেজ করে দেয়। ঘাড়ে নিজে নিজে ইনজেকশন পুশ করা ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ, তবুও সে এটাই করবে।
সুচটা ঢুকতেই ঠান্ডা ধাতুর খোঁচায় চামড়া কেটে গেল। ধীরে ধীরে তরলটা শিরায় মিশে যাওয়ার সাথে সাথেই আলভী বুকের ভেতর অদ্ভুত এক ভারি চাপ অনুভব করলো। হাত-পা ক্রমশ ঢিলে হয়ে আসছে, দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আলভীর শরীর এবং মাথা দুটোই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। টলতে টলতে সে ঠাস করে খাটে লুটিয়ে পড়লো। চোখের পাতা যেন ইটের মতো ভারী হয়ে এসেছে। শরীর জুড়ে অদ্ভুত এক অস্থিরতা কাজ করছে, কিন্তু প্রতিরোধ করার শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই। চারপাশের সবকিছু আস্তে আস্তে অন্ধকারে ডুবে গেলো। শ্বাস ধীর হয়ে এলো, তবে মৃদু, স্থির ছন্দে চলতে থাকলো।
আলভীর অবচেতন মস্তিষ্কে ভেসে উঠলো আজ থেকে ২০ দিন আগের ঘটনা,
ফ্ল্যাশব্যাক—
আলভী ল্যাপটপে একটা ইম্পর্ট্যান্ট কাজ করছিলো তখনই তার ফোনে একটা আননোন জিমেইল থেকে মেইল আসে মেইল টা ওপেন করতেই স্ক্রিনে ভেসে ওঠে…
চলবে,,,
শব্দসংখ্যা- ২৬০০+
#১৫_বছর_বয়সী_মা (৫৬ ও ৫৭)
#সোফিয়া_সাফা
🔺 সতর্কীকরণ:
এই পর্বে সহিংসতা, ট্রমা ও যৌন নিপীড়নের বর্ণনা রয়েছে। সংবেদনশীল পাঠক/পাঠিকাদের জন্য এটি পীড়াদায়ক হতে পারে। দয়া করে সতর্কতা অবলম্বন করে পড়ুন।
২০ দিন আগের ঘটনা,
[ফ্ল্যাশব্যাক]
আলভী ল্যাপটপে একটা ইম্পর্ট্যান্ট কাজ করছিলো তখনই তার ফোনে একটা আননোন জিমেইল থেকে মেইল আসে মেইলটা ওপেন করতেই স্ক্রিনে ভেসে ওঠে…
—তোমার বউ আর তোমার সম্পর্কে অনেক গোপন তথ্য আমার কাছে আছে। আমি সব জানি তোমাদের ব্যাপারে কিন্তু তোমার কি মনে হয়? আমি সব জেনে চুপচাপ বসে থাকবো? একদমই না আগামী ১ ঘন্টার মধ্যে আমার দেয়া একাউন্টে ২০ লক্ষ টাকা ট্রান্সফার করে না দিলে তোমার বউয়ের লিংক ভাইরাল হবে।
আলভী বেশ কিছুক্ষণ মেইল টার দিকে তাকিয়ে থেকে পুরোপুরি ভাবে ইগনোর করলো। কিন্তু একঘন্টা যেতেই আবার আরেকটা মেইল আসে। সেটা ওপেন করতেই একটা লিংক ভেসে ওঠে, আলভী কৌতুহল বশত লিংকে ক্লিক করতেই যা দেখলো তা দেখার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা।
ভিডিও টা দেখে তার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করলো। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে সেদিন তিশার মেহেন্দির অনুষ্ঠানের রাতের বদ্ধ রুমটার দৃশ্য। যেখানে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে অলির সাথে আলভী জোরাজুরি করার চেষ্টা করছে। ভিডিওটা বেশি লম্বা ছিলোনা শুধু দেড় মিনিটের একটা ভিডিও।
—কি? পুরো ভিডিও দেখতে চাইছো? আমার কাছে পুরো ভিডিও টাই আছে। তুমি চাইলেই আমি এই ভিডিও টা ভাইরাল করে দিতে পারি।
আলভী এবার রিপ্লাই দিলো,
—কে তুই? আর এই ভিডিও কোথায় পেলি?
—তা জেনে তোমার কাজ নেই, টাকা পাঠাবে কিনা বলো। আমার আবার ধৈর্য্য কম।
—টাকা পেয়ে গেলেই যে, তুই ভিডিও টা ডিলেট করে দিবি, সেটা বিশ্বাস করবো কিভাবে?
—বিশ্বাস না করলে নাই। এমনিতেও আমি ভিডিও টা ভাইরাল করে দিতেই তো চাই।
আলভীর মাথা কাজ করছিলো না সে টাকা পাঠাতে রাজি হয়ে যায়। আর পাঠিয়েও দেয়। কিন্তু পরের দিনেই আবার একই জিমেইল থেকে মেইল আসে।
—আমি আগের ভিডিও টা ডিলেট করে দিয়েছি। কিন্তু তোমার বউয়ের এরকম আরও ভিডিও আছে আমার কাছে। সেগুলো আমি কি করবো বুঝতে পারছিনা। তুমি চাইলে টাকা দিয়ে সেগুলোও ডিলেট করিয়ে ফেলতে পারো।
আলভী এবার রেগে গেল।
—তুই মিথ্যা কথা বলছিস কেনো?
—মিথ্যা কথা? তুই তোর রিফাত বন্ধুকে এতোটাই বিশ্বাস করিস? তোর কি মনে হয় সেই রাতে তুই শুধু একাই মজা নিয়েছিলি?
আলভী এবার আর সহ্য করতে পারলোনা। সে সাইবার ক্রাইম ডিপার্টমেন্টের সাথে সরাসরি গিয়ে আলোচনা করলো। আলভী মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরেছে। সে অলির সাথেও শেয়ার করতে পারছেনা কিছু। তাই সে বাধ্য হয়েই দিহানের সাথে কিছু কিছু বিষয় শেয়ার করে।
“লোকটা যেকোনো সময়ে নিউজ হিসেবে এসব ভাইরাল করে দিতে পারে।”
“কোনসব ভাইরাল করে দেবে? একটু স্পষ্ট করে বলবি?”
আলভী চুপ হয়ে গেলো। দিহান যত ভালোই বন্ধু হোকনা কেনো আলভী তার সাথে নিজের স্ত্রীর ব্যাপারে খোলামেলা ভাবে আলোচনা করতে পারবেনা। কখনোই পারবেনা। এসব ভেবেই আলভী বলল,
“আরে লোকটা অলিকে নিয়ে আজেবাজে বোঝাতে চাইছে। আমাকে বোঝাতে চাইছে যে অলি রিফাতের সাথে মিলে আমাকে ফাঁদে ফেলেছিলো। তারপর আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করেছিলো। আর এও বোঝাতে চাইছে যে অলির গর্ভে থাকা বাচ্চাটা আমার নয়।”
“দূর এসব কি আজেবাজে কথা? ভাবী মেলাবে রিফাতের সাথে হাত? অসম্ভব, তাছাড়া রিফাত ভাবীর সাথে খারাপ কিছু করলে ভাবী তোকে জানাতেন না? আরে ভাবী তোকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলো বাচ্চাটা তোর সেই জন্য। যদি তোর না হতো ভাবী তোকে কক্ষনো বিয়ে করতোনা। আমার মনে হচ্ছে এসব ওই আননোন লোকটা বানিয়ে বানিয়েই বলেছে টাকা খাওয়ার জন্য।”
আলভী হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো কিন্তু মনে মনে বলল,
“অলি বলেছিলো কয়েক মিনিট যেতেই ও নাকি সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলো। তারপর আমি ওর সাথে কি করেছি সেসব সম্পর্কেও ওর ধারণা নেই। ও সেন্সলেস হওয়ার পর সেই রাতে ঠিক কি ঘটেছিলো কে জানে। ড্রাগের প্রভাবে আমারও তো কিচ্ছুই মনে নেই।”
দিহানের সাথে দেখা করে আলভী বাড়িতে ফিরে আসে। ফ্রেশ হয়ে ড্রইংরুমে আসতেই দেখে অলি মন খারাপ করে বসে আছে। আলভীও নিশ্চুপ চিত্তে বসে রইলো।
“শুনুন না।”
অলির ডাকে আলভী ভ্রু কুচকে অলির দিকে তাকায়।
“৩ মাস পর আমাদের এসএসসি পরীক্ষা। ফরম পূরণ করতে হবে।”
আলভী মাথা নেড়ে সায় জানালো।
“কবে যেতে হবে বলো। আমি গিয়ে করে আসবো।”
অলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলো,
“ওখানে তো আমাকে সাইন করতে হবে।”
আলভী চিন্তিত কন্ঠে বলল, “কিন্তু তুমি এই অবস্থায় কিভাবে যাবে?”
অলির গালজোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। সে মূলত এটা নিয়েই চিন্তায় আছে।
“আমি এই অবস্থায় স্কুলে গেলে সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে তাইনা?”
অলির কথা শুনে আলভীর অনূভুতিশূন্য চেহারায় হতাশা ধরা পড়লো। নিম্ন কন্ঠে বলল,
“আমি বুঝতে পারছি এই অবস্থায় স্কুলে যেতে তুমি সংকোচবোধ করছো। আর এই রকম পরিস্থিতিতে তোমাকে যেনো না পরতে হয় সেই জন্যই আমি…
আলভী দেখলো অলি তার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। তাই বাকি কথাটুকু আলভী মনে মনেই বললো,
“তোমাকে এবো*রশন করে ফেলতে বলেছিলাম।”
অলি ভ্রু নাচিয়ে বলল, “কি হলো? অর্ধেক কথা বললেন কেনো?”
“দেখো অলি এই অবস্থায় তুমি কিভাবে জার্নি করবে? সেটা ভেবেই আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম যে তুমি কিভাবে যাবে। আমি তোমার লজ্জার কথা চিন্তা করে প্রশ্ন টা করিনি। মা হওয়াটা লজ্জার নয় অলি।”
অলি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো।
“আমার লজ্জা করছে কারণ আমি আমার ফ্রেন্ডদেরকে সবসময় বলে বেড়াতাম যে আমি কখনো বিয়েই করবোনা। আর সেই জন্যই…
অলি আর কিছু বলতে পারলোনা। আলভী তার পরিস্থিতি বুঝতে পেরে উঠে চলে গেলো।
রাতে অলি ঘুমিয়ে গেলেও আলভী পুরো দমে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো ষড়যন্ত্রকারীকে খুঁজে বের করার। এরই মাঝে তার ফোনে আবারও ইমেইল এলো। সবসময় কেয়ারলেস হলেও এবার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে। লোকটা আবার কি পাঠিয়েছে ভাবতেই গায়ে কাটা দিচ্ছে। আলভী টেবিলের উপর থেকে একগ্লাস পানি নিয়ে পুরোটা খেয়ে ফেললো। তারপর ধীরে সুস্থে ইমেইল টা ওপেন করতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠলো,
—লিংকে ক্লিক করার আগে নিজের জন্য লাইফ সাপোর্ট রেডি করে রাখ। কারণ ভিডিও টা দেখার পর তুই মৃ*ত্যুযন্ত্রণা ভোগ করতে চলেছিস।
আলভীর চোখজোড়া ইতোমধ্যেই রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। তবুও বুকে পাথর চেপে সে লিংকে ক্লিক করতেই এমন কিছু দেখলো যা দেখে তার চোখদুটো ঝলসে গেলো। আলভী দ্রুত অলির পাশ থেকে উঠে ব্যালকনিতে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো তারপর হঠাৎ হাটু মুড়ে বসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
“এই দৃশ্য দেখার আগে আমি অন্ধ কেনো হয়ে গেলাম না? আল্লাহ এভাবে আমাকে পাপের শাস্তি না দিলেও তো পারতেন। এরচেয়ে মৃত্যুযন্ত্রণা সহ্য করা হয়তো সহজ হতো।”
সেদিন অলি আর আলভী ইন্টিমেট হবার পর রিফাত দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করেছিলো। তারপর ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে অচেতন অলির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। কিছুক্ষণ সেভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে একটানে কম্ফোর্টটার তুলে অলির উন্মুক্ত শরীরের ভাজে বিশ্রী ভাবে স্পর্শ করেছিলো। আর ঘুমন্ত আলভীর দিকে তাকিয়ে বলেছিলো,
“তুই বলেছিলি ওর দিকে কেউ তাকালে তার চোখ তুলে ফেলবি। হাত বাড়ালে হাত কেটে ফেলবি। দেখ আমি দুটোই করেছি। পারলে কিছু করে দেখা দেখি।”
রিফাতের এই কথার মাঝেই ক্যামেরাটার স্ক্রিন ঝাকুনি তুলে অফ হয়ে যায়।
এটা দেখেই আলভী যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। সেদিন রিফাতও হয়তো অলির সাথে খারাপ কিছু করেছিলো। আলভী সারাটা রাত ফ্লোরের উপর বসে ছটফট করেছে আর কান্না করেছে। বুঝদার হবার পর থেকে সে কক্ষনো এভাবে অশ্রু বিসর্জন দেয়নি। কাদতে কাদতে সকাল হয়ে যায়। নামাজের সময় হতেই অভ্যাসগত ভাবেই অলির ঘুম ভেঙ্গে যায়। পাশ ফিরে আলভীকে না দেখে ঘাবড়ে গেল। ধীরপায়ে ব্যালকনির দরজা খুলতেই দেখলো আলভী অগোছালো ভঙ্গিমায় চেয়ারের উপর বসে আছে। অলিকে দেখে আলভী দ্রুত দাঁড়িয়ে যায়।
“আপনি এতো সকালে এখানে কি করছেন?”
আলভী নিজের মুখটাকে আড়াল করে বলল,
“তেমন কিছুনা ফ্রেশ হাওয়া খেতে এসেছিলাম।”
অলি আরও কিছু বলতে উদ্যত হতেই আলভী অলিকে পাশ কাটিয়ে রুমে ফিরে আসে। অলিও আর ভ্রুক্ষেপ না করে অজু করতে চলে যায়। এদিকে আলভী সেই সময়েই এসে ক্রাইম ডিপার্টমেন্টের হেড কে ম্যাসেজ পাঠায়,
—আজকের মধ্যে ক্রিমিনাল টাকে খুঁজে বের করতে পারলে আমি আপনাদেরকে ৩ গুন বেশি টাকা দেবো।
আলভীর ম্যাসেজ পেয়ে হেড অফিসার আরও তোড়জোড় করে কাজে নেমে পড়লেন। এদিকে আলভীর মনেও ভয় জন্মাতে শুরু করলো ক্রিমিনাল টা যদি কোনোভাবে বুঝে যায় যে আলভী আইনি সাহায্য নিয়েছে তাহলেই তো সে ভিডিও গুলো অনলাইনে ছড়িয়ে দেবে। তখন সে কিভাবে কি করবে? আজকাল তো মূহুর্তেই এসব নিউজ ভাইরাল হয়ে যায়। তার উপর আলভীর বিজন্যাস প্রতিদ্বন্দ্বীদের ও তো অভাব নেই। তারা এসব ঘুনাক্ষরেও টের পেলে আরও ১০০ গুণ দ্রুত গতিতে সব ভাইরাল হয়ে যাবে।
এসব ভাবনার মাঝেই অলি জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ আদায় করতে লাগলো। আলভী একনজরে তাকিয়ে রইলো অলির দিকে। সেই সময়েই আলভীর মনের মাঝে বাচ্চাটাকে নিয়ে উদ্ভট চিন্তা চলে আসে। সে কিছুতেই রিফাতের বাচ্চাকে মেনে নিতে পারবেনা। তার আগেই জানতে হবে যে বাচ্চাটা আসলে কার।
সকাল নয়টা নাগাদ আলভী অলিকে নিয়ে স্কুলে আসে কিন্তু পথিমধ্যে অলি ফোন হাতে নিলেও আলভী ঘাবড়ে যায়। ক্রিমিনালটা নিউজ যেকোনো সময়েই ছড়িয়ে দিতে পারে ভাবনাটা মাথায় আসতেই আলভী অলির থেকে ফোন নিয়ে যায়। এমনকি স্কুলের কারোর সাথে কথা বলতে গেলেও আলভীর মনে হচ্ছিলো এই বুঝি কেউ অলিকে নিয়ে খারাপ মন্তব্য করে বসবে মূলত এই জন্যই সে পুরোটা সময় অস্বাভাবিক আচরণ করেছে। যেটা অলির কাছে বিরক্তিকর আর অদ্ভুত লেগেছে। বাচ্চাটাকে নিয়েও আলভীর মাঝে প্রেশার বেড়ে যাচ্ছিলো সে সহ্য করতে না পেরেই অলিকে না জানিয়ে NIPP টেস্ট করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়।
বিকেল বেলা,
অলিকে নিয়ে বাড়িতে ফিরতেই আলভী খবর পায় যে ক্রিমিনাল টাকে পুলিশ ধরে ফেলেছে। সে খবরটা পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যায়। গিয়ে দেখে ক্রিমিনাল টা আর কেউ নয় তার এক্স অ্যাসিস্ট্যান্ট লাবিব। সে আরও জানতে পারে এই লাবিব আর রিফাত খুবই ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিলো। আর রিফাতের সাথেই হাত মিলিয়ে তার অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে জয়েন করেছিলো। আলভীকে সামনাসামনি দেখে লাবিব হাসতে হাসতেই বলে,
“আমাকে ধরেই ফেলেছিস তাহলে? শোন আমি তোকে আরো একটা কথা বলে দিচ্ছি। সেই রাতে তোকে যেই ড্রাগস টা দেওয়া হয়েছিলো সেটা আমিই নিয়ে গিয়েছিলাম।”
আলভী ঘাড় কাত করে লাবিবের দিকে তাকাল।
“তো বল বন্ধুর সাথে নিজের ওয়াইফের ঘনিষ্ঠ মূহুর্তের দৃশ্য দেখে কেমন লেগেছে? নিশ্চয়ই মৃত্যু যন্ত্রণা উপভোগ করেছিস?”
আলভী আর সহ্য করতে পারলোনা। লাবিবকে ধরে নির্মমভাবে মা*রতে লাগলো। একপর্যায়ে আলভী লাবিবের গলা চেপে ধরে, লাবিবের মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসলো। শেষের দিকে লাবিব বলে ওঠে,
“তোর হানিবির মাঝে সত্যিই হানি ছিলো ইয়ার। শি ওয়াজ ভেরি টেসটি।”
লাবিবের কথাগুলো শুনে আলভীর কলিজা শুকিয়ে এলো। চোখদুটো দিয়ে যেন রক্ত ঝরছে। আলভী লাবিবের গলা ছেড়ে দিয়ে টেবিলের উপর থাকা ছুরিটা হাতে তুলে নিলো।
“তোর কলিজা আর হৃৎপিন্ড কত্তবড় সেটা আমি মেপে দেখবো।”
কথাটা শোনামাত্রই লাবিবের চোখেমুখে প্রথমবারের মতো ভয় আর অনিশ্চয়তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠলো। ভীত কন্ঠে বলতে লাগলো,
“মজা করেছি আমি। এসব সত্যি নয়। আমাকে ছেড়ে দে প্লিজ। আমি কিচ্ছু করিনি, ভিডিও গুলো আমার কাছে ছিলো তাই ভয় দেখিয়ে টাকা হাতাতে চেয়েছিলাম এর থেকে বেশি কিছুই চাইনি।”
আলভী কর্ণপাত করলোনা বিদ্যুতের গতিতে ছুরিটা লাবিবের হৃৎপিন্ড বরাবর ঢুকিয়ে দিলো। একবার নয়, বারবার। প্রতিটি আঘাতে লাবিবের দেহ কেঁপে উঠছে, আর র*ক্ত ফিনকি দিয়ে ছিটকে পড়ছে আলভীর শরীরে। মুহূর্তের মধ্যেই তার সারা শরীর র*ক্তে ভিজে গেলো। এখন তাকে দেখে কোনো স্বাভাবিক মানুষ নয় বরং এক পাগল সাইকোপ্যাথ মনে হচ্ছে।
আলভীর হাত থামলো না। নিষ্ঠুর মানবের ন্যায়ে সত্যি সত্যিই লাবিবের বুক চিরে ভেতরের হৃদপিণ্ড আর কলিজা বের করে নিলো। চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ আর গোয়েন্দা টিমের সদস্যরা ভয়ে কেঁপে উঠলো। কেউই কিছু বলার সাহস পাচ্ছেনা, তবুও এক অফিসার কাঁপা গলায় উচ্চারণ করলো,
“আপনি কি করলেন মিস্টার তাসনীম মির্জা? আইনকে এভাবে নিজের হাতে তুলে নিলেন!”
আলভী মাথা উঁচু করে বিদ্রুপের স্বরে বলল,
“ফা*ক ইওর রেগুলেশনস।”
আলভী ঠোঁট বাঁকিয়ে আবারও বললো,
“কি করবেন এবার? আমাকে অ্যারেস্ট করবেন? শুনুন… আমাকে বেশিদিন আটকে রাখতে পারবেন না। তার চেয়ে যদি আমাকে হেল্প করেন, প্রত্যেকেই মোটা অঙ্কের টাকা পাবেন।”
নিস্তব্ধতা নেমে এলো। চোখাচোখি হলো টিমের সদস্যদের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত একে একে সবাই মাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেলো আলভীর প্রস্তাবে।
পরের দিন, দুপুর বেলা। (অলির জন্মদিনের দিন)
আলভী নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে লাবিবের ল্যাপটপ থেকে একের পর এক ফাইল ডিলিট করছিল। হঠাৎ তার দৃষ্টি আটকে গেলো একটা প্রাইভেট ফোল্ডারে। কৌতূহলবশত ফোল্ডারটি ওপেন করতেই ভেসে উঠলো দুটো ভিডিও ফাইল। বেশি কিছু না ভেবেই আলভী একটা ভিডিওতে ক্লিক করলো। চোখের পলকেই উন্মোচিত হলো সেই রাতের আরেকটি অধ্যায়। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে আলভী ড্রাগের প্রভাবে ঘুমিয়ে যাওয়ার কয়েক মিনিট পর পরই লাবিব রুমে প্রবেশ করে। শার্ট খুলতে খুলতে এগিয়ে যায় খাটের দিকে। আলভী একহাতে অলিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। দুজনের শরীরেই কম্ফোর্টার জড়ানো। লাবিবের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো বিকৃত হাসি,
“শা*লা তোর এতো বড় হেল্প করলাম আর তুই সব মজা একাই নিয়ে নিবি? সেটা তো অন্যায় হবে তাইনা?”
লাবিবের কথাগুলো শুনে স্ক্রিনের এপাশে থাকা আলভীর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। সেই সাথে পুরো শরীরও কাপতে লাগলো। স্ক্রিনের ওপাশে এতোক্ষণে লাবিব খাটের উপর উঠে গেছে। কিন্তু অলির থেকে আলভীকে আলাদা করার উদ্দেশ্যে ধাক্কা মা*রতেই আলভী চোখ মেলে তাকায়। তার ভয়ানক লাল লাল চোখজোড়া দেখে লাবিব শুষ্ক ঢোক গিললো। তবুও সাহস সঞ্চয় করে অলির শরীর থেকে কম্ফোর্টার টা সরানোর উদ্দেশ্যে হাত বাড়াতেই আলভী নেশার ঘোরেই তাকে ধাক্কা মে*রে বেড থেকে ফেলে দিয়ে পুনরায় অলিকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজলো। লাবিব কোমড়ে মারাত্মক আঘাত পেয়ে আলভীর ধারে কাছেও আর যাওয়ার সাহস পেলোনা। বহু কষ্টে রুম ত্যাগ করলো। স্ক্রিনের এপাশে থাকা আলভীর চেহারায় যেন স্বস্তি ফিরে এলো।
আলভী এবার অন্য ভিডিও টা প্লে করলো যেটা ছিলো রিফাতের সেই ভিডিও টা যেটা লাবিব তাকে পাঠিয়েছিলো। আলভী পুনরায় সেটা দেখতে লাগলো। এই ভিডিও টা হয়তো লাবিব বেরিয়ে যাওয়ার অনেকক্ষণ পরের ভিডিও। আর ভিডিও টা মাত্র ৩ মিনিটেরই। দ্বিতীয় বার হলেও আলভী এই ভিডিওটা দেখে আবারও প্রবল কষ্ট অনুভব করলো। আলভী তখন অন্য দিকে ঘুরে শুয়ে ছিলো। সেই সুযোগেই রিফাত অলিকে স্পর্শ করার সুযোগ পেয়ে যায়। অলির শরীরে করা রিফাতের প্রত্যেকটি অবাঞ্চিত স্পর্শে আলভীর রূহ অবধি কেপে উঠছে। তবে এরপর কি হয়েছিলো সেটা আলভী জানেনা। কারণ ভিডিও টি আগের মতোই একই জায়গাতে এসে অফ হয়ে গেছে। আলভীর সহ্যশক্তি শেষপ্রায়। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে। হঠাৎই হু হু করে কেঁদে উঠলো সে। একহাতে চোখজোড়া মুছে আরেকহাতে ল্যাপটপে থাকা সমস্ত ডেটা একসাথে ডিলিট করে দিলো। তারপরও স্বস্তি মিললো না। রাগে, যন্ত্রণায়, ঘৃণায় ল্যাপটপটিকে আছাড় মেরে ভেঙ্গে চুরমার করে ফেললো। তারপর দিশেহারা ভঙ্গিতে হসপিটালের আনকল রুমের ঠান্ডা টাইলসের ওপর শুয়ে পড়লো, টানটান দেহ যেন আর শক্তি সঞ্চয় করতে পারছে না। একঘণ্টার মতো সময় কেটে গেলো। এরইমাঝে দিহান কল দিলে আলভী কথার মাঝেই বলে ফেলে,
“বাচ্চাটা আমার না হলে আমি দত্তক দিয়ে দেবো। তুই ওর জন্য একটা ভালো ফ্যামিলি খুঁজে রাখিস।”
“এসব কি বলছিস? ভাবীকে তারপর কিভাবে সামলাবি।”
“ও জানবে ওর মৃত বাচ্চা হয়েছে।”
“কিন্তু এসবের পেছনে কে ছিলো সেটা জানতে পেরেছিস?”
“হুম লাবিব ছিলো।”
“কু*ত্তাটাকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছিস?”
আলভী আচমকা হেসে উঠলো, “পুলিশ?”
“হাসছিস কেনো?”
“আমি ওকে মে*রে ফেলেছি ব্রো। নিজের হাতেই মে*রে ফেলেছি।”
আলভীর ঠান্ডা শীতল কন্ঠ শুনে দিহান ভড়কে গেলো। আলভী খু’ন করে ফেলেছে? তাও আবার শুধুমাত্র ফেক নিউজ ছড়ানোর চেষ্টা করার জন্য? সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেনা। দিহানকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আলভী কল কেটে দেয় কিছুক্ষণ যেতেই রাজিব ম্যাসেজ পাঠায়,
—USA এর ল্যাবে স্যাম্পল পাঠিয়ে দেয়া ডান স্যার।
আলভী রিপ্লাই দিলো,
—সবকিছু রাশ মুডে করবে পেশেন্টের অল্রেডি ৩৭ সপ্তাহ চলছে তার ডেলিভারির আগেই যেন রিপোর্ট পেয়ে যাই।
—স্যার কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করবো?
—হুম?
—পেশেন্ট কি আপনার আত্মীয় হয়? না মানে এতো টাকা খরচ করে সবচেয়ে ভালো ল্যাবে পাঠাতে বললেন তার উপর এসব তো আমাদের কাজের মধ্যেও পড়েনা।
—মাইন্ড ইওর বিজনেস আর ভবিষ্যতে কখনো এই ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করবেনা। শুধু যেটুকু বলবো সেটুকুই করবে।
—ওকে স্যার স্যরি। আর করবোনা।
[ফ্ল্যাশব্যাক এন্ড]
বর্তমান…
কেটে গেছে আরও কয়েকটা দিন।
চাঁদের স্নিগ্ধ আলো জানালার পর্দা ভেদ করে রুমে ঢুকছে। অলি বিছানার কিনারায় বালিশ ঠেকিয়ে বসে আছে। ১৫ দিন বয়সের আরিশ মায়ের কোলেই ঘুমোচ্ছে। ছোট্ট বুকটা ধীরে ধীরে উঠছে-নামছে, লালচে ঠোঁট দুটো নিঃশ্বাসের সঙ্গে মৃদু কাঁপছে। অলি একদৃষ্টিতে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা দেখতে একদম আলভীর মতো কেনো হয়েছে সেটাই সে বুঝে উঠতে পারেনা। পুরো নয়মাস পেটে রাখলো সে। এতো কষ্ট সহ্য করে জন্ম দিলো সে আর ছেলেটা দেখতে একদম আলভীর মতো হলো?
“কি ভাবছো অলি?”
নানুর কন্ঠ শুনে অলি তার দিকে তাকালো। মনে পড়ে গেলো ১৪ দিন আগের কথা। সেদিন নোমানকে ফলো করতে না করলেও নোমান তাকে একা ছাড়তে রাজি হয়নি। এমন সময়েই অলি অসুস্থ হয়ে পড়ে। নোমান আশ্বস্ত করে বলেছিলো অলি সুস্থ হবার পর যেখানে ইচ্ছা সেখানে চলে যেতে পারবে নোমান আর তাকে ফলো করবেনা। সেই কথার প্রেক্ষিতেই সেদিন অলি নোমানের সাথে তাদের বাড়িতে এসেছিলো।
“স্বামীর কথা মনে পড়ছে বুঝি?”
অলি ম্লান হেসে নানুর উদ্দেশ্যে বলল, “নতুন করে আর কিইবা মনে পড়বে নানু? আমি যে তাকে একমূহুর্তের জন্যও ভুলতে পারিনা।”
নানু কাথা সেলাই করা বাদ দিয়ে অলির কাধে হাত রেখে বললেন,
“কেনো নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো? ফিরে যাওনা স্বামীর কাছে।”
অলি আরিশের মসৃণ গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“আমি কোনো দিক দিয়েই তার যোগ্য নই, নানু। আমি আর ফিরবো না তার কাছে। আমাদের মিলন এই জন্মে অসম্ভব। সে আসমান, আমি জমিন। আমাদের মিলন মানেই ধ্বংসযজ্ঞ।”
অলির কথা শেষ হতেই কেউ একজন দরজায় কড়া নাড়ল। অলি তড়িঘড়ি করে ওড়নাটা মাথায় টেনে উচ্চারণ করল,
“আসুন।”
নোমান দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। অলি লক্ষ্য করল নোমানের এক হাত পেছনে লুকানো। অলি পুরোপুরি বোঝার জন্য একটু ঝুঁকে তাকাতেই নানু বললেন,
“কি এনেছো নানুভাই?”
নোমান একগাল হেসে হাতে ধরা দু’টো গোলাপ সামনে আনলো। গোলাপ দুটো দেখে অজান্তেই অলির ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। প্রেগন্যান্ট থাকাকালীন গোলাপের রিয়েকশনের কথা মনে পড়তেই অলি কিছুটা দমে গেল। পরমুহূর্তেই মনে পড়ল আলভী বলেছিলো প্রেগন্যান্ট অবস্থায় শরীর একটু বেশিই নাজুক থাকে, বাচ্চা হয়ে গেলে অলি আবারও নরমাল হয়ে যাবে। তার ভাবনার মাঝেই নোমান একটা ফুল নানুর দিকে এগিয়ে দিল। নানু হাসিমুখে ফুলটা নিলেন,
“কি ব্যপার নানুভাই? খুশি খুশি দেখাচ্ছে,”
নোমান আরেকটা ফুল অলির দিকে এগিয়ে দিতেই অলি সযত্নে ফুলটা হাতে নিয়ে মাথা নত করে বলল,
“ধন্যবাদ, ভাইয়া।”
নোমান এবার নানুর পাশে বসে পড়লো,
“আমার চাকরি হয়ে গেছে নানু। সেই খুশিতেই এনেছি।”
অলি উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল, “সত্যিই? আপনি অ্যাডভোকেট হয়ে গেছেন? কংগ্রাচুলেশন, ভাইয়া!”
অলি থেমে গেল, হঠাৎ বলে উঠল, “জানেন, আমারও স্বপ্ন ছিল ল’ নিয়ে পড়াশোনা করে একজন অ্যাডভোকেট হওয়ার।”
নোমানের হাসি আরও বিস্তর হলো,
“তুমি নিশ্চয়ই পারবে। আমি হেল্প করব।”
কথাটা শুনে অলির মুখ চুপসে গেলো।
“আমি কিভাবে পারবো? এসএসসি পরীক্ষাটাই হয়তো দিতে পারবোনা।”
নোমান ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই অলি ফের বলে ওঠে,
“পরীক্ষা দিতে গেলেই তো আলোর বাবা আমার খোঁজ পেয়ে যাবে। আমি নিশ্চিত, সে স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমাকে খুঁজতে হলেও চলে যেতে পারে। আমার রোল নম্বর, রেজিষ্ট্রেশন নম্বর সবকিছুই তো ফরম ফিল-আপের দিন জেনে গিয়েছিলো।”
নোমান কিছু একটা ভেবে বলল, “তুমি মন দিয়ে পড়াশোনা করে প্রস্তুতি নেও। আমি যেকোনো উপায়ে তোমাকে পরীক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে যাবো।”
অলি কিছু বলতে যাবে তার আগেই কোলে থাকা আরিশ ক্ষীণ সুরে “ইঁ…ইঁ…” শব্দ করল। বাচ্চাটার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। হাত-পা নেড়ে হাই তুলছে। অলি এক হাতে তাকে সামলে নেয়, অন্য হাতে ধরা গোলাপটা সামান্য উঁচু করে রাখা। সে খেয়ালই করে না যে আরিশের ছোট্ট আঙুল ফুলের দিকে এগিয়ে গেছে। মুহূর্তেই আরিশ খামচে ধরে পাতলা একটা পাপড়ি টেনে কৌতূহলভরা ভঙ্গিতে মুখে ঢোকাতে উদ্যত হলো।
“আরে” অলি বিষয়টা বুঝে ওঠার আগেই পাপড়িটা ছুঁয়ে যায় আরিশের ঠোঁটের কোণ। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আরিশের ঠোঁটের চারপাশে হালকা লালচে দাগ দেখা দেয়, গালের গায়ে ছোট ছোট দানার মতো ফুসকুড়ি ফুটে ওঠে। নাক কুচকিয়ে, টানা কয়েকটা হাঁচি দিয়েই আরিশ জোরেশোরে কেঁদে উঠলো।
অলি তড়িৎ গতিতে ফুলের পাপড়িটা সরিয়ে ফেলে। এরই মাঝে তার হাতে থাকা ফুলটাও নিচে পড়ে যায়। সে ভীষণ ঘাবড়ে গেছে। ছেলের কান্না দেখে তার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। দ্রুত পায়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ওড়নার একপাশ ভিজিয়ে আরিশের মুখ মুছে দিতে লাগলো।
নোমান তো হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নানু উঠে গেলেন অলির পিছু পিছু। অলি আরিশকে থামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু আরিশের কান্না ক্রমেই তীব্র হলো। ছোট্ট বুক ওঠানামা করছে দ্রুত, অলি দিশেহারা হয়ে পড়লো। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলো ঠোঁটদুটো মারাত্মক ভাবে ফুলে গেছে, গালের কাছে গোলাপি র্যাশ ছড়িয়ে পড়েছে। অলি এবার ডুকরে কেদে উঠলো। কি হলো তার ছেলেটার?
“ভাইয়া ডাক্তারের কাছে চলুন।”
অলি ছেলেকে নানুর কোলে দিয়ে কাদতে কাদতেই গায়ে বোরকা জড়িয়ে নিলো। ওড়নাটা কোনোভাবে মাথায় প্যাচিয়ে ছেলেকে কোলে নিয়ে কোনোদিকে তাকালোনা আর, একছুটে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। নোমান কয়েক মূহুর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে অলির পিছু পিছু ছুটে গেলো।
রাতের অন্ধকারে ল্যাম্পপোস্টের লাল-নীল বাতিগুলো ম্লান আলো ফেলছে, কিন্তু কোনো কিছুই অলির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছেনা। ছেলের চিন্তায় অস্থির সে।
চেম্বারের সাদা আলোয় আরিশকে সাবধানে ধরে বসে আছে অলি। চোখ দুটো ভিজে আছে কান্নায়, বুকের ভেতর ধকধক করছে উৎকণ্ঠায়। নোমান পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে চিন্তার ছাপ,
ডাক্তার আরিশকে কোলে নিয়ে নরম হাতে ঠোঁট, গাল আর নাক পরীক্ষা করলেন। তারপর স্টেথোস্কোপ আলতো করে বুকের উপর রাখলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি মাথা তুলে শান্ত গলায় বললেন,
“ওর এলার্জি হয়েছে। এগুলো সেই এলার্জিরই প্রভাব।”
অলি বিস্মিত চোখে তাকাল। চোখজোড়ায় পানি চিকচিক করছে,
“এলার্জি? ওর বাবার মতো ওর ও গোলাপে এলার্জি?”
ডাক্তার অলির কথা শুনে বললেন,
“ওর বাবার রোজ ফ্লাওয়ারে এলার্জি আছে?”
অলির মনে পড়লো আলভীর কথা। গোলাপ ফুলের সংস্পর্শে এলেই তো আলভীর চোখ লাল হয়ে যেত, চুলকাত, হাঁচি থামত না, চোখমুখ ফুলে মুখের আকৃতি পরিবর্তন হয়ে যেত। অলি আনমনেই হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো। ডাক্তার আরিশকে অলির দিকে এগিয়ে দিলেন তারপর প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে বললেন,
“বাবার যদি রোজ ফ্লাওয়ারে এলার্জি থাকে, তাহলে সন্তানেরও একই জিনিসে এলার্জি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। এটা জেনেটিক প্রবণতা থেকেও হতে পারে।”
অলির বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে গেল। সে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল,
“আমার ছেলে ঠিক হয়ে যাবে তো?”
ডাক্তার মৃদু হাসলেন, “চিন্তার কিছু নেই। আমি স্যালাইন ড্রপ লিখে দিয়েছি, প্রয়োজনে ব্যবহার করবেন। বুকের দুধ নিয়মমতো খাওয়াতে থাকুন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, রোজ ফ্লাওয়ার বা এ ধরনের অ্যালার্জি-সৃষ্টিকারী জিনিস গুলো ওর থেকে দূরে রাখবেন। তাহলেই আর সমস্যা হবে না।”
নোমান একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল, “থ্যাংকিউ ডাক্তার।”
তারপর প্রেসক্রিপশন হাতে তুলে অলিকে নিয়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলো। আরিশ ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে, চোখের কোণে এখনো পানি জমে আছে।
“স্যরি ফ্লাওয়ার কুইন। আমার জন্যই আরিশের এই অবস্থা হলো।”
নোমানের কথা শুনে অলি তার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলল,
“আপনার কোনো দোষ নেই ভাইয়া। আমরা কেউই এই বিষয়ে অবগত ছিলাম না।”
নোমান নিশ্চুপ হয়ে গেলো। অলি আরিশের দিকে তাকিয়ে আনমনেই বলল,
“ভাইয়া আপনার মুখ থেকে ‘মিসেস অলি’ ডাকটা শুনতেই আমার বেশি ভালো লাগে।”
নোমান থমকে গেল, ভুলবশতই ‘ফ্লাওয়ার কুইন’ বলে ফেলেছে। মুহূর্তেই মুখে হাসি টেনে বলল,
“ওকে মিসেস অলি।”
***
আলভী রুমে বসে বসে ড্রিংকস করছিলো। জীবনটাই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। নিজেকে শেষ করে দিতে পারলেই যেন এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া যেতো। কিন্তু সেটারও অবকাশ নেই। সামনেই পড়ে আছে NIPP টেস্টের রিপোর্ট। এতদিন দেখার প্রয়োজন মনে না করলেও আজকে দেখেই নিলো। অবশ্য আরিশকে দেখেই সে সিওর হয়ে গিয়েছিলো যে আরিশ তারই ছেলে। আর এই রিপোর্টেও স্পষ্ট লেখা আছে আলভীই আরিশের জন্মদাতা পিতা। যেটা দেখে আলভী নিজেকে ধন্য বলে মনে করছে একই সাথে সন্দেহ করার জন্য নিজেকেই দোষারোপ করছে।
আলভী এবার অলির ফোনটা হাতে তুলে নেয়। এই ফোনে এমন কিছু আছে যেটা তাকে বরাবরই দ্বিধায় ফেলে দেয়। আলভী এই কয়েকদিনেও অলির নোটপ্যাডে লিখে যাওয়া কথাগুলোর মানে পুরোপুরি ভাবে বুঝে উঠতে পারছে। হ্যাঁ অলি যাওয়ার আগে নিজের ফোনের নোটপ্যাডে লিখে রেখে গেছে, ফোনটা আনলক করতেই আবারও চোখের সামনে অলির লেখাগুলো ভেসে উঠলো,
—আমি নিজেকে আর আলোকে বাচিয়ে রাখতে আপনাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। কখনো ভাবিওনি আপনি আমাকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলবেন। বলেছিলাম যেদিন আমার চরিত্রের দিকে আঙুল তুলবেন সেদিনই আমাদের শেষ দেখা হবে। কথাটা একটুও গায়ে মাখেননি তাইনা? আপনি বরং আপনার ফুপাতো বোনকেই বিয়ে করে নিয়েন। আমি তো এটাই বুঝতে পারছিনা যে ইয়াদ ভাইয়ের সাথে আমার কিসের শত্রুতা। তার সাথে তো আজ পর্যন্ত ভালো করে কথাও বলিনি। সেও আমাকে মে*রে ফেলতে চায় ওই রূপসার জন্য? আমাকে মে*রে ফেলে আমার ছেলেকে রূপসার হাতে তুলে দেবে? আর সেটা আমি মেনে নেবো? তার উপর আলো যে আপনার সন্তান সেটাও আমাকে প্রমাণ দিতে হবে? নইলে আপনি বিশ্বাস করবেন না? এতো এতো অনিশ্চয়তা, এতো অবিশ্বাসের মাঝে আমার পক্ষে আর এখানে থাকা সম্ভব নয়। আমার দুচোখ যেদিকে যাবে আমি সেদিকেই চলে যাবো। শুধু নিশ্চিত থাকুন, আমার দুচোখ আর আপনার দিকে যাবেনা।
আলভী লেখাগুলো অজস্রবার দেখেছে তবুও কোনোটার সাথেই কোনোটা মেলাতে পারছেনা। এরইমাঝে তার দরজায় টোকা পড়ে। আলভী ফোনটা সাইডে সরিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ায়। টলতে টলতে এগিয়ে যায় দরজাটার দিকে। দরজা খুলে দিতেই শাহানাজ বেগম অস্থির কন্ঠে বললেন,
“এভি, বাবা তোর কাকিমার অবস্থা খুবই খারাপ। একটু গিয়ে দেখনা।”
আলভী মায়ের কথা শুনে নূরনাহারের রুমের উদ্দেশ্যে হাটা ধরতেই শাহানাজ বেগম হতভম্ব হয়ে গেলেন,
“এভি তুই ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস?”
আলভী একহাতে মাথা চেপে ধরল,
“কোথায় আবার কাকিমাকে দেখতে যাচ্ছি।”
শাহানাজ বেগম বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আলভীর দিকে,
“উল্টো দিকে যাচ্ছিস। তোর কাকিমার রুম এইদিকে।”
আলভী একটা ঢোক গিলে ঘুরে গিয়ে সোজা দিকে হাটা ধরতেই শাহানাজ বেগম থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“তোর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে তোর নিজেরই চিকিৎসা প্রয়োজন।”
আলভী আনমনেই হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো। শাহানাজ বেগম এবার রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠলেন,
“হ্যাঁ রে ইয়াদকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা আর তুই এই পরিস্থিতিতেও এসব ছাইপাঁশ গিলছিস? নিজের বউ বাচ্চাকে খোঁজারও চেষ্টা করছিস না। কি চাইছিস টা কি তুই?”
“কাম অন মা, যারা নিজে থেকেই পালিয়ে গেছে তাদেরকে কোথায় খুজবো বলো।”
“বউমা নাহয় ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে গেছে কিন্তু ইয়াদ? কোথায় নিখোঁজ হয়ে গেলো ছেলেটা? কি যে হচ্ছে এই সংসারে।”
“হুম আসলেই ভাবনার বিষয় মা।”
আলভীর চোখজোড়া লাল হয়ে গেছে ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা অদ্ভুত হাসিটা দেখে শাহানাজ বেগমের শরীর হিম হয়ে এলো। সে আঁচলে মুখ ডেকে স্থান ত্যাগ করলেন।
আলভী রুমে ফিরে একজন ব্যাংক কর্মকর্তাকে কল করলো, সে আর আলভী স্কুল ফ্রেন্ড ছিলো। প্রয়োজন সাপেক্ষে কিছুদিন আগেই আলভী তার শরণাপন্ন হয়েছে,
—ও কি আজও টাকা তোলেনি?
ফোনের ওপাশ থেকে বলল,
—না এভি। ভাবী শুধু একবারই ঢাকা রেলস্টেশনের সাইডে থাকা এটিএম ব্যুত থেকে ২০ হাজার টাকা তুলেছেন। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত সে আর এক টাকাও তোলেননি।
আলভীর এবার ভয় হতে লাগলো। অলি আর ছেলে ঠিকঠাক আছে তো? আলভী আর ভাবতে পারছেনা। সে কল কেটে দিয়ে গোয়েন্দা টিমের লিডারকে কল দিলো।
—আপনারা এখনো ওদের খুঁজে পেলেন না?
—ঢাকা রেলস্টেশনের সিসিটিভি ফুটেজ থেকে কনফার্ম করা গেছে, সে সিলেটগামী ট্রেনেই চড়েছিলো সেদিন। আমাদের ধারনা সে বর্তমানে সিলেটেই আছে কিন্তু এক্সাক্ট লোকেশন পেতে আমাদের টাইম লাগবে ভাই।
—আর কতো টাইম লাগাবেন? গত ৩ দিন ধরে এই একটা কথাই বলে যাচ্ছেন। এখন তো মনে হচ্ছে আমাকে নিজে গিয়েই ওকে খুঁজে বের করতে হবে।
—ভাই আমরা চেষ্টা করছি তো।
আলভী ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে শান্তকন্ঠে বলল,
—টাকাগুলো পেতে চাইলে মন দিয়ে খুঁজুন ওকে। যত দেরি করবেন টাকার পরিমাণ ততই কমবে।
কথাটা বলেই আলভী কল কেটে দিলো। তারপর ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো আলমারির দিকে, যেখানে বাচ্চার আর অলির কাপড় গুলো পুনরায় ভাজ করে রেখে দিয়েছিল সে। আলমারি খুলে একটা ওড়না বের করে সেটায় মুখ গুজলো আলভী। বড় একটা শ্বাস টেনে ওড়নায় থাকা সবটুকু ঘ্রাণ শুষে নেয়ার চেষ্টা করলো।
“ইউ’আর নট জাস্ট অ্যাডিক্টিভ, ইউ’আর দ্য ভেনম ইন মাই ব্লাড। লাভিং ইউ ফিল্জ লাইক টেকিং পয়জন, সিপ আফ্টার সিপ, নোয়িং ইট’স কিলিং মি। ইউ’আর আ কার্স দ্যাট ওয়্যার্জ দ্য মাস্ক অফ প্লেজার, দ্য রুইন আই ক্যান’ট স্টপ ওয়ান্টিং। মেবি ইউ’আর নট লাভ। মেবি ইউ’আর জাস্ট দ্য স্লোয়েস্ট, সুইটেস্ট ওয়ে আই’ভ চোজেন টু ডাই।”
(অর্থ: তুমি শুধু আসক্তি নও, তুমি আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে থাকা বিষ। তোমাকে ভালোবাসা মানে বিষপান করা, জেনেও যে প্রতিটি চুমুক আমাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। তুমি এক অভিশাপ, যা সুখের মুখোশ পরে আমাকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করে। হয়তো তুমি ভালোবাসা নও, তুমি কেবল আমার বেছে নেওয়া সবচেয়ে ধীর, অথচ সবচেয়ে মধুর মৃ*ত্যু।)
আলভী ওড়নার মাঝে অলিকে খোঁজার চেষ্টায় ব্যাস্ত। তখনই তার কিছু একটা মনে পড়ে। সে ওড়না টা নিয়েই দ্রুত পায়ে রুম ত্যাগ করে। আসার সময় সে নূরনাহারের আহাজারি শুনতে পেলেও একটুও ভ্রুক্ষেপ করলোনা। যার ছেলে ৩দিন যাবত নিখোঁজ তার আহাজারি করা ছাড়া আর কিইবা করার আছে? পুলিশের লোকেরাও তো কম খোজাখুজি করছেনা কিন্তু কোনো সুরাহা মিলছেনা।
***
“আমাকে ছেড়ে দেও ভাইয়া। প্লিজ আমি কিচ্ছু করনি। আর করবোই বা কেনো? ভাবীর হয়তো কোথাও ভুল হয়েছে। আমি তো তার ক্ষতি করার কথা কল্পনাও করতে পারিনা।”
আলভী ইয়াদের সামনে বসে ওড়না টা হাতে প্যাচাচ্ছে আর ইয়াদের কথা মন দিয়ে শুনছে। গত তিন দিন ধরে ইয়াদের এই একই কথা শুনতে শুনতে তার বিরক্তি তিক্ততায় রূপ নিয়েছে।
“তুই রূপকে ভালোবাসিস?”
আচমকা এহেন প্রশ্নে ইয়াদ স্তব্ধ হয়ে গেল। ইয়াদ ভেবেই উঠতে পারছেনা যে কিভাবে আলভী এই কয়েকদিনে এতোকিছু জেনে গেছে।
“ভাইয়া তুমি এসব কি বলছো, ওর মতো একটা তারছেঁড়া মেয়েকে আমি ভালোবাসতে যাবো কোন দুঃখে?”
“তুই নিজেও তো তারছেঁড়া। ভালোবাসতেই পারিস”
“ভাইয়া মাথা ঠান্ডা করো, ওকে ভালোবাসলেই বা আমি তোমার ক্ষতি করার চেষ্টা করবো কেনো? তুমি তো আমার বড় ভাই। প্লিজ আমার হাত পা খুলে দেও।”
“তুই জানিস আমি একটা মার্ডার করেছি?”
আলভীর কন্ঠ যেন সদ্য বরফ গলা পানি। কানে পৌছাতেই সর্বাঙ্গ কেপে উঠলো। ইয়াদ একটু ঘাবড়ে গেলেও মাথা নিচু করে বসে রইলো,
“শুধু মে*রে ফেলেই তৃপ্তি পাইনি, শরীর কেটে কেটে বিশ্লেষণ করেছি। এই বিশ্লেষণকে পোস্ট মর্টেমও বলতে পারিস। এমনকি রিফাতের লাশ টাকেও তুলে এনে পোস্ট মর্টেম করেছি। পৃথিবীর বুক থেকে ওদের শেষ অস্তিত্বটুকুও মুছে ফেলেছি। রিফাত ভেবেছিলো এক্সিডেন্টে ম*রে গিয়ে বেচে যাবে? হাহ, আমি ওকে মৃ*ত্যুর পরেও হাজারবার মে*রেছি। ও যেই হাত আর চোখ দিয়ে দুঃসাহস দেখিয়েছিলো সেগুলোকে আমি গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করেছি। আমার বউজান লিখে রেখে গেছে তোর জন্য সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমার বউজান ভেবেছে তুই আমার ভাই বলে আমি তোকে ছেড়ে দেবো। কিন্তু সে জানেনা, তার স্বামীজান তার জন্য এরকম হাজারটা সম্পর্ক ছিন্ন করতে প্রস্তুত।”
ইয়াদ মূর্তির মতো বসে রইলো। আলভী এবার উঠে গিয়ে তার সামনে দাঁড়ায়।
“রূপ, অলিকে ফেলে দিয়েছিলো জানিস সেটা?”
ইয়াদ হকচকিয়ে যাওয়ার ভান করে বলল, “কি বলছো এসব?”
“অবাক হচ্ছিস কেনো? বিশ্বাস হচ্ছেনা?”
ইয়াদ চুপ হয়ে গেলো। আলভী আবারও বলতে লাগলো,
“আমার মনে হচ্ছে সেই জন্য রূপকে পর্যাপ্ত শাস্তি দেওয়া হয়নি। ভাবছি ওর পোস্ট মর্টেমটা অন্য একজন ডক্টরকে দিয়ে করাবো। আর যাই হোক আমি তো আর মেয়েদের পোস্ট মর্টেম করতে পারবোনা। আচ্ছা তোর পরিচিত কোনো ডক্টর আছে? মেল ডক্টর হলেও প্রবলেম নেই, আমার শুধু একটা নিখুঁত পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট প্রয়োজন। আমি জানতে চাই, ওর চোখের পাওয়ার কতো ছিলো। কলিজা আর হৃৎপিন্ডের সাইজ কতটুকু, মস্তিষ্কে কি এমন প্রবলেম ছিলো যার জন্য আমার সাথে লাগতে আসার স্পর্ধা করলো।”
“ভাইয়া!”
“হুম বল।”
ইয়াদের কণ্ঠ কেঁপে উঠলো,
“ভাইয়া, রূপকে কিছু কোরো না। ও তোমাকে ভালোবাসে। ওর কোনো দোষ নেই।”
আলভীর চাহনি আরও গাঢ় হয়ে উঠলো।
“তাই নাকি? তাহলে কার দোষ?”
ইয়াদ দীর্ঘক্ষণ ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে রইলো। শেষমেশ কাপা কাপা কন্ঠে উচ্চারণ করলো,
“আমার।”
চলবে,,,
শব্দসংখ্যা- ৪৬৫০+