১৫ বছর বয়সী মা পর্ব-৬৪+৬৫

0
24

#১৫_বছর_বয়সী_মা (৬৪)
#সোফিয়া_সাফা

আলভীর কথা শুনে বাড়ির সবাই অবাকের শেষপ্রান্তে পৌছে গেল। শাহানাজ বেগম বললেন,
“এভি তুই এটা কি বললি?”
“হ্যাঁ মা আমি ঠিকই বলেছি। ওদের সাথে এক ছাদের নিচে থাকলে আমাকে অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে হবে। এভাবে থাকা যায়না।”

ইয়ামিন মির্জা বলে উঠলেন, “অন্যায় ওরা করেছে, তাই এই বাড়ি থেকে যেতে হলে ওরা যাবে তোমরা না।”

ইয়াদ বাবার কথা শুনে চমকে তাকাল। সবাইকে চুপ থাকতে দেখে ইয়াদ বুঝে গেল যে সবাই এই ব্যাপারে একমত। এটা বুঝতে পেরে ইয়াদ উঠে দাড়াল তারপর সবার উদ্দেশ্যে বলল,
“সমস্যা নেই আমি আর রূপ এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।”

নূরনাহারের প্রচন্ড খারাপ লাগলেও সে কিছুই বলতে পারলোনা। কিইবা বলবেন তিনি? বিবেকহীন মানুষদের মতো তো আর আচরণ করতে পারবেন না। ইয়াদ কারো থেকে উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল, রূপসাও তার পেছন পেছন চলে গেল। আলভী সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ডাইনিং রুমের দিকে চলে গেল,
“আ’ম হাংরী, ডিনার করবো।”

অলি পূর্বের মতোই থম মেরে বসে আছে। সে চায়না সংসার টা এভাবে ভেঙ্গে যাক কিন্তু সেও যে নিরুপায়। কিছুক্ষণ যেতেই ইয়াদ দুটো ব্যাগ আর রূপসাকে নিয়ে ড্রইংরুমে এসে হাজির হল, সবার উদ্দেশ্যে বলল,
“আমরা চলে যাচ্ছি।”

শাহানাজ বেগম না পেরে বলেই ওঠেন, “কদিন পর ঊর্মির বিয়ে। এই সময় না গেলেই কি নয়?”

সবাই একসাথে শাহানাজ বেগমের দিকে তাকাতেই সে বলল,
“আমি বলতে চাইছি কটা দিনই তো, বিয়েটা হয়ে গেলে নাহয়…
“না কাকিমা। আমি আপনাদেরকে অনিশ্চয়তার মধ্যে রাখতে চাইনা।”

ঊর্মিলা ছলছল চোখে ইয়াদের দিকে তাকায়, ইয়াদ একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলে,
“আমি তোর বিয়েতে অবশ্যই উপস্থিত থাকবো। তুই একদম মন খারাপ করিসনা।”

ঊর্মিলা মাথা নিচু করে কেদে উঠল, বললেই হলো মন খারাপ করিসনা? অলি ঠিকই বলেছে ইয়াদের কাছে রূপসার অনুভূতি ব্যাতিত আর কারো অনুভূতির মূল্য নেই। যদি থাকতো তাহলে কি আলভীর সাথে এরকম কিছু করতে পারতো? পারতোনা, ইয়াদ কিভাবে পারলো এভাবে সাজানো গোছানো সংসারটাকে শেষ করে দিতে? একটুও মায়া হলোনা?

“তোরা চলে যাবি ঠিক আছে কিন্তু রাতের বেলাতেই যেতে হবে কেনো? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখ, ১২ টা বাজে।”

উসমান মির্জার কথায় রূপসা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
“সমস্যা নেই মামা, আমরা আপাতত আমাদের বাড়িতে যাচ্ছি। তারপর সেখান থেকেই অন্য কোথাও চলে যাবো। আমাদের অনেক সৌভাগ্য যে ভাইয়া আর ভাবী আমাদেরকে এতো সহজে ক্ষমা করে দিয়েছে। সত্যি বলতে এর চেয়ে বেশি কিছুই চাওয়ার নেই।”

রূপসার কথা শুনে ডাইনিং রুমে বসে থাকা আলভী অদ্ভুত চোখে একবার রূপসার দিকে তাকালো। কিন্তু তার সেই চাহনি কারো নজরে পড়লোনা। ইয়াদ বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে হাটা ধরতেই রূপসা বলে ওঠে,
“দাঁড়াও,”

ইয়াদ ঘাড় বাকিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই রূপসা বলল,
“যাওয়ার আগে নানুমনির সাথে দেখা করে আসি।”

ইয়াদ দ্বিমত পোষণ করল, “এতোরাতে দাদুমনির সাথে দেখা করবি কিভাবে? সে কি সজাগ আছে? তাছাড়া আমাদের চলে যাওয়ার বিষয়টা তাকে জানানো ঠিক হবেনা।”
“তাকে না জানিয়ে যেতে পারবোনা। সে আমার আশায় থাকবে। আমি তাকে এই ব্যপারে জানাবোনা, বলবো বেড়াতে যাচ্ছি।”

ইয়াদ শ্বাস ফেলে রাজি হয়ে যায়।
দাদুমনির সাথে দেখা করা শেষে তারা মির্জা ভিলা থেকে বেরিয়ে গেল।

২দিন পর,

দিনের শেষ আলোটুকু নিভে গেছে, আকাশের বুকটা ঘন কালো মেঘে ঢাকা। ক্ষনে ক্ষনে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বৃষ্টির পানি ছোয়ার তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে একজোড়া নিঃসঙ্গ হাত ব্যালকনির রেলিঙ ভেদ করে শূন্যে ভাসছে। মুহূর্তেই আকাশের বুকে জমে থাকা মেঘগুলো বৃষ্টি রূপে ঝড়ে পড়ল, বৃষ্টির তীব্রতা প্রকোপ। বন্যা হওয়ার পূর্বাভাস ছিল আগে থেকেই। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা রূপসা বৃষ্টির মাঝেও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টির ঝাপটায় ইতোমধ্যেই কাকভেজা হয়ে গেছে। তবুও যেন এতেই শান্তি মিলছে, এতে করে আর খামখা চোখের পানি গুলোকে আটকে রাখার প্রয়াস করতে হচ্ছেনা। সে আজকে কাদতে পারবে। খুব করে কাদতে পারবে, বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে ভেতরে থাকা আবেগ নামের ঝড়টাও ভয়ংকর ভাবে আঘাত হানার প্রস্তুতি নিচ্ছে যেন। সেই ঝড় মোকাবিলার জন্য রূপসা প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন সময় দরজা ঠেলে ইয়াদ প্রবেশ করল, রূপসাকে এভাবে ভিজতে দেখে তার ভ্রুযুগল কুচকে গেল,
“এই, তুই এখানে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিবিলাস করছিস নাকি?”

রূপসা উত্তর দিলোনা, কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই সে ভারসাম্য হারিয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ল। ইয়াদ ভীষণ ঘাবড়ে গেল, একছুটে এসে রূপসাকে সামলানোর চেষ্টা করতে লাগল। রূপসা হঠাৎ করেই ইয়াদকে জড়িয়ে ধরল, ইয়াদের শার্ট খামচে ধরে গগনবিদারী আর্তচিৎকারে ফেটে পড়ল, তার চিৎকারে ইয়াদের শরীর অবশ হয়ে এলো।
“ক…কি হয়েছে তোর? এরকম করছিস কেনো?”

“আমি ম*রে যাচ্ছি ইয়াদ। আমি আর বাচবোনা হয়তো।”
রূপসার বিলাপ শুনে ইয়াদ পাগলপ্রায়। এই দিনটা যেন না দেখতে হয় সেইজন্যই তো সে ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েও অন্যায় করেছিল। তবু্ও কেন তাকে এই দিনটার সম্মুখীন হতে হলো?

রূপসার ভেজা শরীরটা ক্রমশই উষ্ণতা হারিয়ে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে, তবুও সেই নিদারুণ কষ্ট লাঘব হওয়ার নাম নেই, বুক চিড়ে শুধু আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে। এই পর্যায়ে এসে রূপসার প্রবল শ্বাসকষ্ট শুরু হল।
“সে আমার কেন হলোনা ইয়াদ? এতো করে চাওয়ার পরেও সে আমার হলোনা, আমি মেনে নিতে পারছিনা। তার মনের দরজায় সর্বপ্রথম আমি কড়া নাড়ার পড়েও কি করে অন্য কেউ আমার আগে প্রবেশ করলো? আমি এই ব্যর্থতা কিভাবে সহ্য করবো? তাকে ছাড়া আমি যে কিছুই ভাবতে পারিনা। সে আমার সাথে এতোটা নিষ্ঠুর আচরণ কিভাবে করতে পারল?”

ইয়াদের মুখাবয়ব রক্তিম বর্ণ ধারণ করল, এর আগে সে বরাবরই অলির উপর বিরক্ত হয়ে তাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আজ ইচ্ছা করছে আলভীর সাথে সাথে রূপসাকেও মে*রে ফেলতে। আলভীর নামে রূপসার এই বিলাপ এই অভিযোগ গুলো ইয়াদ সহ্য করতে পারছেনা। ইয়াদ ক্রোধের বশবর্তী হয়ে এক বিরাট দুঃসাহস করে বসল, রূপসার মুখটা দুহাতের আঁজলায় নিয়ে রূপসার ওষ্ঠদ্বয়ে নিজের ঠোঁট চেপে ধরল। ঘটনার আকস্মিকতায় রূপসার সমস্ত সত্ত্বা কেপে উঠল।
কিছুক্ষণ পর ইয়াদ রূপসাকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
“আজকের পর থেকে আমার সামনে ভাইয়ার নামে তুলে রাখা অভিযোগের খাতা খুলবিনা কখনো।”

ইয়াদ চলে যেতে নিলে রূপসা তার পা জড়িয়ে ধরে। ইয়াদ চরম বিস্মিত হল,
“আমাকে ছেড়ে যেওনা প্লিজ। আমি ম*রে যাচ্ছি।”

রূপসার কথার মানে বুঝতে পেরে ইয়াদ রক্তচোখে রূপসার দিকে তাকাতেই আকাশে বিদ্যুৎ চমকায়। হাটু মুড়ে রূপসার সামনে বসে নির্লিপ্ত গলায় বলল,
“মৃ*ত্যুবরণ করতে চাস নাকি বাচতে চাস?”

রূপসা ইয়াদকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমি তোমার ভালোবাসার স্বাদ গ্রহণ করে বাচতে চাই। আমি জানি, আমি এখনো স্বার্থপরের মতো বিহেভ করছি। আমি এও জানি, আমার দেহটা ছাড়া তোমাকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই। আমার জন্য তোমার না পাওয়ার তালিকা আরও লম্বা হতে চলেছে। তবে আমার বেহায়া মনটা আজ স্বামীর ভালোবাসা পেতে চায়। মৃ*ত্যুর দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে আসতে চায়। তুমি তোমার এই স্বার্থপর বউটাকে নিজের করে নেও। একবার, প্লিজ। আর কখনো চাইবোনা।”

ইয়াদ অপেক্ষা করলোনা, একদম হঠাৎ করেই রূপসাকে কোলে তুলে নিয়ে বেডরুমের উদ্দেশ্যে হাটা ধরল।

***

ঠান্ডা আবহাওয়ায় উষ্ণতার খোঁজে আলভীর বুকের মাঝে আরও সিটিয়ে গেল অলি। আলভী মাথা উঁচু করে আরিশের গায়ে ভালো করে কম্বল জড়িয়ে দিল। তারপর অলির ঘাড়ের ভাজে মুখ গুজে একটা লম্বা শ্বাস টানলো। অলির শরীরের মাতাল করা ঘ্রাণে আলভীর নিজেকে নে*শাগ্রস্থ লাগছে। সে অলিকে একটানে নিজের বাম পাশে এনে শোয়ালো। তারপর ভাবনা চিন্তা না করেই অলির বন্ধ ঠোঁটজোড়ায় ঠোঁট ডুবিয়ে দিল। ঘুমের ঘোরে দম বন্ধ হয়ে আসায় অলি ফট করে চোখ মেলে তাকায়। ড্রিম লাইটের হাল্কা আলোয় আলভীর মুখটা দেখে অলি ছটফট করতে লাগল। ফলস্বরূপ আলভী একহাত দিয়ে অলির দুহাত চেপে ধরে মন ভরে চুমু খেয়ে অলিকে ছেড়ে দিল, ছাড়া পেতেই অলির মেজাজ খারাপ হল,
“এরকম কেউ করে? আমার দম আটকে যাচ্ছিলো।”

আলভী মাতাল কন্ঠে বলল, “আমি তো তোমার ঠোঁটে চুমু খেয়েছি। দম আটকে যাবে কেনো?”

অলি থতমত খেয়ে গেল। সে কিভাবে বোঝাবে আলভীর ঠোঁটের স্পর্শে অলির শরীর অসাড় হয়ে আসে। এমনকি হৃৎস্পন্দনের ছন্দপতন ঘটে।
“আমি চুমু খেলে তোমার ভালো লাগেনা হানিবি?”

অলি লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ ঢিপঢিপ করছে। আলভী অলির কানের কাছে মুখ নিয়ে হিসহিসিয়ে বলল,
“আমার তো খুব ভালো লাগে।”

অলি প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, “আপনি ঘুমাচ্ছেন না কেনো?”
“ঘুম আসছেনা হানিবি। এরকম ঠান্ডা আবহাওয়ায় বউ পাশে থাকলে ঘুম আসে? বলো,”

অলি কিছু একটা ভেবে বলে উঠল, “আমার পাশে শুয়ে ঘুম না এলে সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়ুন। এখন তো আলো আছেই, আমি ওকে নিয়েই ঘুমাতে পারবো।”

অলি উঠে আরিশের সাইডে যেতে নিলে আলভী তাকে থামিয়ে দেয়।
“এইরকম ওয়েদারে বিবাহিত পুরুষ মানুষ কখনোই বউকে রেখে সোফায় ঘুমাবেনা।”

অলির কপালে চিন্তার ভাজ পড়ল, “মানে কি? এই না বললেন আমি পাশে আছি বলে ঘুম আসছেনা।”

আলভী বিরক্তি সূচক শব্দ উচ্চারণ করল, “তুমি আমার কথা বুঝতে পারছোনা হানিবি। আমি বলতে চাইছি, বৃষ্টির দিনে বউকে আদর না করলে ঘুম আসেনা।”

কথাটা শুনে অলির গালজোড়া গরম হয়ে এলো। আলভী অলির দিকে ঝুকে গিয়ে ভারী গলায় উচ্চারণ করল,
“I LOVE YOU HONEYBEE”

অলির শ্বাস প্রশ্বাস এলোমেলো করে দেওয়ার জন্য আলভীর মুখ নিসৃত উক্ত বাক্যটিই যথেষ্ট ছিল। অলি না পেরে আলভীর বুকে মুখ গুজতে চাইল, আলভী বাধা দিয়ে বলল,
“আমি তোমাকে প্রপোজ করেছি আর তুমি পালাতে চাইছো? তুমি কোনোভাবে আমাকে রিজেক্ট করছো নাতো?”

অলি তড়িৎ গতিতে নাবোধক মাথা নাড়ল। নার্ভাসনেসের ঠেলায় লজ্জাবতী গাছের ন্যায়ে নুইয়ে যেতেই আলভী বলে ওঠে,
“এমনি আমার মাথা ঠিক নেই তার উপর তুমি আমাকে সি*ডিউস করেই যাচ্ছো। কাজটা কি ঠিক করছো?”

অলি উঠে বসতে চাইলে আলভী বাধা দিয়ে অভিমানী সুরে বলে,
“স্বামীকে রিজেক্ট করলে?”

অলি একটা শুষ্ক ঢোক গিলে বলল,
“আমি রিজেক্ট করিনি।”
“তাহলে উত্তরটা দেও।”

অলিকে দোনোমোনো করতে দেখে আলভী ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠল,
“আমার ইনোসেন্ট ওয়াইফ কি প্রপ্রোজ এক্সেপ্ট করতেও জানেনা?”

অলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠল,
“I Love You Too.”

আলভী স্তব্ধ হয়ে গেল,
“কি বললে?”
“I love you too.”

আলভী অস্থির গলায় বলল,
“আরেকবার বলো জান।”
“I love you.”

আলভীর হার্টবিট বেড়ে গেল। গলা শুকিয়ে আসছে। তবুও অলির মুখ থেকে বারবার এই কথাটাই শুনতে মন চাইছে।
“বাংলায় বলো কলিজা।”

অলি এক নিশ্বাসে বলল,
“আমি আপনাকে ভালোবাসি।”

আলভী অলির হাতটা নিজের গালে ঠেকিয়ে বলল,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি।
এভাবে বলো।”

অলি এবার আলভীর দিকে চাইল,
“বললাম তো…

আলভী অলির ঠোঁটে আঙুল ছোয়াল,
“তুমি করে বলো।”
“আপনি করে বললে কি সমস্যা?”
“আহা! বলোই না, দেখি কেমন শোনায়।”

অলি মাথা নিচু করে বলতে শুরু করল,
“আমি”
“হু?”
“তোমাকে ভালোবাসি।”

আলভী অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। মুহূর্তেই অলির কোমড় চেপে ধরল, অলি কিছু বলতে চাইলেও বলতে পারলোনা তার আগেই আলভী অলির গালে ঠোঁট ছোয়াল,
“তোমার মুখ থেকে তুমি ডাকটা শুনে ভালো লেগেছে। তাই এখন থেকে আমাকে তুমি করেই বলবে, ঠিক আছে?”

আলভীর গম্ভীর কন্ঠ শুনে অলি অজান্তেই হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে,
“তাহলে বলো।”
“কি বলবো?”

আলভী অলির ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি বলবে খুঁজে পাচ্ছোনা? উ’ম এক কাজ করো সেদিনের মতো করে বলো ‘আমাকে আদর করো।’

অলি সরে যেতে চেয়েও পারলোনা। আলভী কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
“প্লিজ বলো, আমি শুনতে চাই। তোমার স্বামী শুনতে চাইছে। তুমি বলবে না?”

অলি অসহায় চোখে আলভীর দিকে তাকায়। লোকটা ভালোই বুঝে গেছে তাকে কি বলে দূর্বল করা যায়।
“বলবে না?”

অলি হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে চোখ বন্ধ করে নিল,
“আমাকে আদর করো।”

আলভী ঠোঁট চেপে হেসে উঠল। অলিকে বুকে টেনে নিয়ে বলল,
“তোমার কি মনে হয়? আমি তোমার সাথে জোর করবো?”

অলি প্রতিউত্তর করলোনা। আলভী একটা শ্বাস ফেলে বলল,
“আমি তোমাকে টিজ করছিলাম। ধৈর্য্যের শেষপ্রান্তে না যাওয়া অবধি আমি তোমার সাথে জোরাজুরি করবোনা। এই ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকো। যদিও আমার ধৈর্য্যশক্তি খুব বেশি নয়। তবুও চেষ্টা করবো।”

***

সিলেট অঞ্চলে বন্যার প্রবণতা বরাবরই বেশি। সেই সূত্রে এখানের আবহাওয়া আরও খারাপ। নোমান ফোনে নিউজ দেখছিল, রায়া এতোক্ষণ যাবত চুপচাপ শুয়ে থাকলেও হঠাৎ করেই বলে ওঠে,
“নানু আজকে আমাকে কি বলেছে জানেন?”

রায়ার কথা শুনে নোমান ভ্রু কুচকে রায়ার দিকে তাকায়।
“কি বলেছে শুনি?”
“বলেছে তার নাকি একা একা বাড়িতে থাকতে ভালো লাগেনা। আপনি কাজে চলে যান, আমি কলেজে চলে যাই। সে নাকি আরিশকে খুব মিস করছে।”

নোমান পুনরায় ফোনের স্ক্রিনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল,
“জানোই তো কয়েকদিন পর আলভী ভাইয়ের বোনের বিয়ে, আমাদেরকেও দাওয়াত দিয়েছে, নানুকেও তো নিয়ে যাবো।”
“তো? আমরা তো ২ দিনের জন্য যাবো। তারপর তো নানু আবার একা হয়েই যাবে।”

নোমান শ্বাস ফেলে বলল,
“যা বলার সোজাসুজি বলো।”

রায়া অকপট ভাবেই বলে ওঠে,
“আরিশের মতো যদি আমাদেরও একটা বেবি থাকতো তাহলে নানুর আর একা থাকা লাগতোনা।”

কথাটা শুনে নোমান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। চমকিত নয়নে তাকাল রায়ার দিকে, রায়া মুখে হাসি টেনে বলল,
“এভাবে তাকাচ্ছেন কেনো? আরে এসব তো নানু বলেছে। আমার কি দোষ?”
“শোনো নানু বয়স্ক মানুষ তাই এসব বলবে সেটাই স্বাভাবিক। এসব কথাবার্তা বলা বয়সজনিত একটা রোগ হিসেবে ধরে নেবে।”

রায়ার মুখটা ছোট হয়ে গেল,
“কিন্তু আইডিয়া টা তো খারাপ না।”

নোমান হাল্কা কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল,
“কিছু কি বললে? আমি আসলে শুনতে পাইনি।”

“কিছুনা, আপনি বরং ফোন ঘাটুন। শুভরাত্রি।”
বলেই রায়া মুখ বাকিয়ে উল্টো দিকে ঘুরে চোখ বুজলো।

নোমান নৈশব্দে ফোনটা রেখে রায়ার দিকে ফিরল। কাপা কাপা হাতটা রায়ার দিকে বাড়িয়ে দিল কিন্তু সংকোচবোধ করে নিজেকে সংযত করে নিল।

৩ দিন পর,

আজকে ঊর্মিলার বিয়ের শপিং করার জন্য ঊর্মিলা, নূরজাহান, শাহানাজ বেগম অলি আর আলভী শপিংমলে এসেছে। আলভী আরিশকে কোলে নিয়ে বসে আছে বাকিরা শাড়ি দেখতে ব্যস্ত, এরইমাঝে দিহান এসে হাজির হলো। দিহানকে দেখে ঊর্মিলা ভীষণ খুশি হলো, সে জানতো না যে দিহান আসবে। দোকানদার অনেকগুলো শাড়ির ভাজ খুলে তাদেরকে দেখাচ্ছিল বেশির ভাগ শাড়িই বিয়ের, সেসবের মাঝেই আলভীর নজর পড়ল একটা ডার্ক গ্রিন রঙের শাড়ির উপর, শাড়িটার পাড়ের উপর লাল, নীল, হলুদ রঙের গোলাপ ফুলের কারুকাজ করা। শাড়িটা দেখেই আলভী একটা শুকনো ঢোক গিলল। বাকি সবাই ঊর্মিলার বিয়ের শাড়ি চুজ করছে, অলির খেয়ালও সেদিকে। এই সুযোগে আলভী নির্দিষ্ট শাড়িটি তুলে নিল, শাড়িটা অদ্ভুত রকমের সুন্দর। সে গোলাপ ফুল পছন্দ না করলেও শাড়িটা তার নজর কেড়েছে।

চলবে,,,

#১৫_বছর_বয়সী_মা (৬৫)
#সোফিয়া_সাফা

মির্জা ভিলার চারপাশ লাইটের হরেক রঙা আলোয় ঝলমল করছে। এখন যে রাত্রীবেলা সেটা বোঝারও জো নেই। ঊর্মিলার বিয়ে উপলক্ষে ভীষণ জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন করা হয়েছে। হবে নাই বা কেন? বাড়ির একমাত্র কন্যার বিয়ে বলে কথা।
আজকে ঊর্মিলার গায়ে হলুদ, গতদিন মেহেন্দি উপলক্ষেও বেশ বড় আয়োজন করা হয়েছিল। বাড়ির আনাচেকানাচে মানুষ গিজগিজ করছে। দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয় স্বজন এসেছে। গায়ে হলুদের স্টেজের পুরোটাই গাঁদা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। ঊর্মিলাকে কেন্দ্র করে বসে আছে মেয়েদের দল। ইশা, তিশা, সামিরা আর সামিরও গতকালকেই এসেছে। সেই সাথে ইয়াদ আর রূপসাকেও গতকালকেই আসতে হয়েছে। উসমান মির্জা আসতে বলাতে না এসে পারেই নি। নোমান আর রায়া আজকে বিকালে এসেছে। সবার পরণে কমলা রঙের শাড়ি, ঊর্মিলার গায়ে শোভা পাচ্ছে কাচা হলুদ রঙের শাড়ি। ঊর্মিলার হাতের পাশাপাশি প্রত্যেকের হাত ভর্তি করে মেহেন্দি দেয়া। গতকাল সবাই মাঝ রাত পর্যন্ত মেহেন্দি দিয়েছে।
গায়ে হলুদের পর্ব শুরু হতেই দিহান তার কয়েকজন কাজিনকে নিয়ে উপস্থিত হল। দিহানকে দেখে উৎসুক জনতার ন্যায় মেয়েরা একপ্রকার হামলে পড়ল,
“কি ব্যপার দুলাভাই? বউয়ের জন্য আর একটা দিন অপেক্ষা করতে পারলেন না বুঝি? এতো তরাশ?”

ইশার কথা শুনে দিহান কান চুলকে বলল,
“আজকের মতো স্পেশাল একটা দিনে না এসে পারলাম না গো আধা ঘরওয়ালি।”

দিহানের কথা বলার ধরন শুনে উপস্থিত সবাই হেসে উঠল। তিশা বলল,
“তা শুধু দেখতেই এসেছেন তো?”

দিহান গলা পরিষ্কার করে বলল,
“শুধু দেখতেই আসিনি। অ্যাকচুয়ালি আমি সবার আগে ঊর্মির গালে হলুদ ছোয়াতে চাই।”

সামিরা এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল। সে একটু ভাব নিয়ে বলল,
“তা বেশ তো। পেমেন্ট করুন আগে, তারপরই আমাদের বনুর গায়ে হলুদ ছোয়ানোর অনুমতি পাবেন।”

দিহানের এক কাজিন বলে উঠল, “আরে বেয়াইন আপনি হয়তো একটু বেশিই কাজ করে ফেলেছেন। তাই উল্টো পাল্টা বকছেন। টাকা পয়সার হিসেব আজকে নয় কালকে হবে।”

ইশা কিছু বলতে যাবে তার আগেই রায়া বলে ওঠে,
“তাহলে আপনারাও বরং কালকেই আসুন। আজকে আর কনের দেখা পাওয়া হচ্ছেনা।”

রায়ার কথার পিঠে সবাই হ্যাঁ হ্যাঁ করল। অলি একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলার প্রয়োজন পড়ছেনা বিধায় সে শুরু থেকেই চুপ। নোমানের নানু আসার পর থেকেই আরিশকে নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতে হচ্ছেনা তাকে। মেয়েদের টিমের সাথে না পেরে দিহান চলে গেল আলভীর খোঁজে। বোনের বিয়েতে কি আর ভাই নবাবের মতো ঘুরে বেড়াতে পারে? আলভীও পারছেনা। সব দিকের তদারকি করতে করতে সে বেজায় ব্যস্ততার মাঝে সময় পার করছে। অবশ্য তাকে হেল্প করার জন্য ইয়াদ, সামির আছে। নোমানও টুকটাক হেল্প করার চেষ্টা করছে। আলভী কালকের জন্য ডেকোরেশন করার জায়গায় দাঁড়িয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। দিহানকে আসতে দেখে তার ভ্রুযুগল কুচকে গেল,
“এভি ভাই বাচা আমাকে।”
“ওই তুই এখানে কি করিস? বিয়ের ডেট ভুলে গেলি নাকি?”

দিহান নিজের চুল ঠিক করতে করতে বলল,
“ডেট মনে আছে। আমি তো ঊর্মিকে প্রথম হলুদ ছোঁয়াতে এসেছি। কিন্তু তোর দজ্জাল কাজিনগুলো আমাকে ঊর্মির কাছে যেতে দিচ্ছেনা।”
“যেতে দেবেনা কেন?”
“তুই একটু চল না আমার সাথে।”

আলভীকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দিহান নিয়ে যেতে লাগল। তাকে দিহানের সাথে আসতে দেখে মেয়েদের দল নিজেদের মধ্যে গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করছে,

“কি হয়েছে? দিহানকে যেতে দিচ্ছিস না কেন? ওকে যেতে দে। হাতে বেশি সময় নেই, গায়ে হলুদের পর্ব শুরু করতে হবে।”
সামিরা এগিয়ে এসে বলল,
“আমরা যেতে দেবোনা, সেটা তো একবারও বলিনি। শুধু বলেছি পেমেন্ট করে তারপর যেতে।”

আলভী বিরবির করে উচ্চারণ করল, “পেমেন্ট?”

তিশা বলল, “হুম পেমেন্ট, আমরা ওনাকে আগে হলুদ লাগানোর পারমিশন কি বিনেপয়সাতে দেবো নাকি?”

আলভীর চোখেমুখে বিরক্তি ফুটে উঠল, “এসব আবার কি ধরনের রীতিনীতি? দেখ ওকে বাধা দিসনা, আজকের দিনটা ওদের দুজনের জন্যই খুব স্পেশাল।”

আলভীর কথার পিঠে কথা বলার সাহস কেউ পাচ্ছেনা। সবারই নিজেদের চুল আর গালের প্রতি মায়া আছে। এরই মাঝে সামিরা পেছনে লুকিয়ে থাকা অলিকে টেনে বের করে সামনে ঠেলে দিল। আলভীকে আসতে দেখে অলি নিজেকে আড়াল করে নিয়েছিল। সে এতো সাজগোছ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখলে আলভী রেগে যেতে পারে। সেসব ভেবেই সে আলভীর চোখে পড়তে চায়নি। কিন্তু এরা তো তাকেই বলির পাঠা বানিয়ে ছাড়ল। হঠাৎ করে অলিকে দেখে আলভীর কপালের টানটান ভাবটা কেটে গেল। সে একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত অলিকে পরখ করে নিল। অলির পরণে কমলা রঙের শাড়ি। হাতে, কানে আর গলায় শুভ্র রঙের কাঠগোলাপ ফুলের তৈরি ফ্লোরাল জুয়েলারি। মাথায় আধা ঘোমটা দেয়া। মুখে হাল্কা মেক-আপ, লম্বা চুলগুলো সাইড বেণি করে ডান সাইডে এনে রাখা। সবমিলিয়ে অলিকেই আস্ত একটা কাঠগোলাপ দেখাচ্ছে। আলভী ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অলির দিকে। অলি তো মাথা নিচু করে ঘাসের দিকে তাকিয়ে আছে। আলভীর এই দৃষ্টি যেন তার শরীরে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আলভীকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আশেপাশের সবাই হেসে উঠল। দিহান তাকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“কিরে? স্ট্যাচু হয়ে গেলি কেন? আমাকে তো এখনো যেতে দিচ্ছেনা। একটা রাম ধমক দেনা।”

দিহানের কথা যেন কানেই নিলনা আলভী। এদিকে ইশা এগিয়ে এসে অলির কানে কানে কিছু বলতেই অলি মাথা সোজা করে আলভীর দিকে তাকায়। ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে বলে,
“তুমি ওনার পক্ষ কেনো নিচ্ছো? টাকাটা আমাদের প্রাপ্য, আমাদেরকে আদায় করে নিতে দেও। ভুলে যেওনা তুমি হচ্ছো কনের বড় ভাই। ওনার পক্ষপাতী করা তোমাকে মানায় না।”

আলভীর গলা শুকিয়ে এলো। অলির মিষ্টি কন্ঠস্বর যেন তাকে বশ করে ফেলছে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে দিহান বলে ওঠে,
“ভাবী আপনিও ওনাদের দলে? এটা মানতে পারলাম না।”

অলি দিহানের দিকে তাকাল, “দেখুন ভাইয়া আমরা অনেক কষ্ট করে আপুকে সাজিয়েছি। আর সে এখন পর্যন্ত আপনার বউ হয়নি। সেই হিসেবে তাকে হলুদ লাগানোর পারমিশন আপনাকে তো এমনি এমনি দেয়া হবেনা তাইনা? অন্তত আমাদের সাজানোর পারিশ্রমিক টুকু তো দিবেন নাকি? এতো কিপ্টেমি করলে হয়না।”

দিহান আলভীর পিঠে খোচা মারতেই আলভী শান্ত চোখে দিহানের দিকে তাকায়। ফট করেই বলে ওঠে,
“ওদের কথায় লজিক আছে। তাড়াতাড়ি টাকা দিয়ে দে।”

আলভীর দল পাল্টানো দেখে দিহান বিস্মিত হল। চোখমুখ কুচকে জিজ্ঞেস করল,
“কত টাকা পেমেন্ট করতে হবে?”

ইশা বলে উঠল, “আপাতত ৫০ হাজার দিলেই হবে।”

দিহান আলভীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
“দোস্ত এরা তো দেখছি জনসম্মুখে ডাকাতি করার পরিকল্পনা করেছে। তুই তো কাবিন পরিশোধ করতে গিয়ে ফকির হয়েছিলি। এরা তো দেখি কাবিন লেখানোর আগেই আমাকে ফকির বানিয়ে ফেলবে।”

আলভী দায়সারা ভাব নিয়ে বলল, “মাত্র এই কয় টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে ফকির হলে চলবে নাকি? টাকা দিয়ে ঝামেলা মিট কর তাড়াতাড়ি।”
“তোর দেখি আমার থেকেও বেশি তাড়া, ব্যপার কি?”

আলভী কিছু না বলে অলির দিকে তাকাল। দিহানের কাজিনরা বলেকয়ে ২০ হাজার টাকায় ব্যপারটা মিটিয়ে দিহানকে নিয়ে স্টেজের দিকে চলে গেল। সবাইকে অনুসরণ করে অলিও স্টেজের দিকে পা বাড়াল। ঠিক সেই সময়েই অলি নিজের হাতে টান অনুভব করল, ঘাড় বাকিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখল আলভী তার হাত ধরে টানছে। অলি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আলভী বলে ওঠে,
“এভাবে আমার হক নষ্ট করাটা কি খুব জরুরী ছিল?”

তার কথার অর্থ অলির বোধগম্য হলোনা। আলভী হ্যাচকা টানে অলিকে কোলে তুলে বাড়ির দিকে হাটা ধরল।
অলিকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসিয়ে একটা ভেজা কাপড় দিয়ে অলির মুখ থেকে মেক-আপ তুলে ফেলছে আলভী। অলির এবার কান্না পাচ্ছে, সে কতো কষ্ট করে মেক-আপ করেছিল। এই আলভী কি তাকে একটু সাজতেও দেবেনা? যদিও অলি সচরাচর সাজেনা কিন্তু বাড়িতে এতোবড় অনুষ্ঠান চলছে সেখানে বাড়ির বউ কি কাজের লোকের মতো ঘুরে বেড়াবে? মেক-আপ তোলা হয়ে গেলে আলভী গভীর ভাবে অলির চেহারা পর্যবেক্ষণ করতে লাগল, বিরক্তির শ্বাস ফেলে বলল,
“তোমাকে তো মেক-আপ ছাড়াও সবার থেকে সুন্দর দেখাচ্ছে। কি করি বলোতো?”

অলি গাল ফুলিয়ে বলল, “কতগুলো কালি মেখে যাই তাহলে?”

আলভী ঠোঁট কামড়ে হাসল। আগুনে ঘি ঢেলে বলল,
“গুড আইডিয়া। কালি দিয়ে তোমার গালে আমার নাম লিখে দেবো ভাবছি। তুমি কি বলো?”

অলি এবার হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিল, “না প্লিজ। এমন করবেন না।”

আলভীর হাসি আরও বিস্তর হল, “সবার সামনে তুমি করে বলে এখন আপনি করে বলছো? এখন তো ডেফিনিটলি আমার নাম লিখে দেবো।”

অলি মুখ থেকে হাত সরিয়ে মাথা নিচু করে বলল, “গালে নাম লিখে দিতে হবে কেন? আপনার নাম তো আল্লাহ নিজে আমার কপালে লিখে দিয়েছেন। আর এটা তো কারো অজানা নয়।”

আলভী অলির সামনে হাটু মুড়ে বসে একহাতে অলির কোমড় জড়িয়ে ধরল, আরেকহাতে অলির হাতটা সামনে এনে সেখানে লেখা নিজের নামের উপর বৃদ্ধা আঙুল ঠেকাল,
“আমি তোমার শরীরে নয় তোমার মনের দেয়ালে নিজের নাম লিখতে চাই হানিবি। যেই নামটা চোখ দিয়ে নয় আমি মন দিয়ে অবলোকন করতে পারব।”

অলি কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে আলগোছে আলভীর গলা জড়িয়ে ধরল। আলভীর মুখ বরাবর হাল্কা ঝুকে কম্পিত কন্ঠে বলল,
“তোমার নাম আমার মনে সেদিনই লেখা হয়ে গেছে, যেদিন আমি তোমার নামে তিনবার কবুল বলেছিলাম। তবে এতদিন যাবৎ সেই নামটা ঘন বরফের স্তরের নিচে ঢাকা পড়ে ছিল। ধীরে ধীরে তোমার ভালোবাসার উষ্ণতায় সেই বরফ গলেছে, নামটা আজ উন্মোচিত। এখন চাইলেই তুমি সেই নামটা অবলোকন করতে পারবে… একবার চেষ্টা করে দেখো।”

আলভী বিস্মিত নয়নে অলির দিকে তাকিয়ে আছে। বউটা এতো সুন্দর করে তার সাথে কথা বলছে ভাবতেই শরীর হিম হয়ে আসছে। আলভীর চাহনি দেখে অলির গালজুড়ে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ল, আলভী সময় নষ্ট না করে অলির বুকের ভাজে মুখ গুজল। ঠিক হৃৎপিন্ড বরাবর কান ঠেকিয়ে শুনতে লাগল অলির হৃৎস্পন্দনের শব্দ। আলভীর উষ্ণ আলিঙ্গনে অলি বেসামাল হয়ে আলভীকে শক্ত করে চেপে ধরল। আনন্দ অশ্রুতে ভরে উঠল চোখজোড়া, আলভীর উষ্ণ নিশ্বাস যেন তার সমস্ত সত্তাকে কাপিয়ে তুলছে।

বেশ অনেকক্ষণ এভাবে কাটানোর পর অলি আলভীর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“আমরা হয়তো অনেক কিছু মিস করে ফেলছি। নিচে যাওয়া উচিৎ।”

অলির কথায় আলভী মুখ তুলে তাকাল। তারপর অলির দুগালে ঠোঁট ছুইয়ে তাকে নিয়ে রুম থেকে বের হল।

গায়ে হলুদের পর্ব শেষ হতেই সবাই স্টেজের সামনে থাকা চেয়ারে বসে পড়ল, দিহান অবশ্য স্টেজে ঊর্মিলার পাশেই বসে আছে। অলি বাকিদের সাথে কথা বলছিল। এরই মাঝে আলভী এসে তার সামনে দাঁড়ায়। অলিকে চমকে দিয়ে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে গেয়ে ওঠে,
“গোটা পৃথিবীতে খুঁজো,
আমার মতো কে তোমারে
এতো ভালোবাসে…

অলি অবাক চোখে আলভীর দিকে তাকায়, পাশে বসে থাকা ইশা আর তিশা অলিকে আলভীর দিকে একপ্রকার ঠেলে দিল। তবে অলি অপ্রস্তুত না হয়ে আলভীর বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ধরে আচমকা গেয়ে উঠল,
“এই মনের ঘরে এসো,
এ বুকেরই বা পাশেতে
তোমার নামই জপে…

আলভী খুশি হয়ে অলিকে স্টেজে নিয়ে গেল, পেছন থেকে জরিয়ে ধরে অলির কাধে থুতনি ঠেকিয়ে গাইল,
“একটু আড়াল হলেই কেন
মনে খোড়াক জাগে?
তোমার সঙ্গ পেলেই কেন
দেহ শিউরে ওঠে?…

অলি নাচের তালে আলভীর হাতদুটো নিজের কোমড়ে রেখে গাইতে লাগল,
“এই গা ছুয়ে বলো
ছেড়ে যাবেনা কখনো
তোমার মতো কে আছো বলো…

আলভী অলির হাতজোড়া নিজের বুকে ঠেকিয়ে গানের তালে সিরিয়াস কন্ঠে বলল,
“এই গা ছুয়ে বলো
ছেড়ে যাবেনা কখনো
তোমার মতো কে আর আছে বলো।

মুহুর্তেই চারপাশ হাত তালির শব্দে মুখরিত হয়ে গেল। অলি স্টেজ থেকে নেমে আসতে চাইলেও আলভী তার হাত ছাড়ছেনা। অলি জোরপূর্বক হেসে ফিসফিসিয়ে বলল,
“হয়ে গেছে। ছাড়ো এবার।”

আলভী গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“উহু হয়নি এখনো। তুমি তো আমার গা ছুয়ে বললেই না। আগে বলো তারপর ছাড়বো।”

অলির কপালে ভাজ পড়ল, মিনমিনিয়ে বলল,
“আমি তো আগেই ওয়াদা করেছি।”
“তো? এবার আমাকে ছুয়েও বলে ফেলো।”

অলি আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিম্নস্বরে বলল,
“আপনার গা ছুয়ে বললাম, আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবোনা।”

কথাটা শুনে আলভীর ইচ্ছা করল অলির গালে ঠোঁট ছোয়াতে, ভাবনা মোতাবেক অলির গালের দিকে অগ্রসর হতেই অলি বাধ সাধল,
“কি করছেন হু? আশেপাশে তাকান একবার।”

আলভী বিরক্তি সূচক শব্দ উচ্চারণ করে অলিকে ছেড়ে দিল। এরই মাঝে আলভী লক্ষ্য করল। অলি পুরোপুরি ভাবে তাকে ‘তুমি’ করে সম্মোধন করতে পারছেনা। আলভী ভাবলো এই টপিকের উপর অলির একটা ভালো করে ক্লাস নিতেই হবে।

পরেরদিন রাত্রিবেলা,

এতোক্ষণ যাবত চারদিকে আনন্দ উল্লাস থাকলেও ঊর্মিলা প্রস্থান করার পর যেন সবকিছুই ফিকে হয়ে গেছে। ড্রইংরুমে বসে আছেন বাড়ির সবাই, শাহানাজ বেগম আর উসমান মির্জার সাথে সাথে ঊর্মিলার কাকা কাকিমাও অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন। অলি তাদের পাশে বসে সান্ত্বনার বাণী শোনাচ্ছে,
“আপু তো কালকেই চলে আসবে, আপনারা কাদবেন না।”

অলি আশেপাশে তাকিয়ে আলভীকে খুজল কিন্তু মানুষটা ঊর্মিলা যাওয়ার পর থেকেই নিখোঁজ। যাওয়ার আগে ভাইকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি করেছে ঊর্মিলা। আলভীর চোখে পানি না থাকলেও চোখজোড়া ভীষণ রকমের লাল ছিল, যেটা অলি লক্ষ্য করেছে। সবাই খাওয়া দাওয়া করে শুতে চলে গেল। আলভীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে অলি তাকে খেতে ডাকেনি। আলাদা করে তার জন্য খাবার বেড়ে সেগুলো নিয়ে রুমে ঢুকল। কিন্তু আলভী রুমে নেই, অলি দোলনার দিকে এগিয়ে গিয়ে আরিশকে খুঁজল কিন্তু আরিশও দোলনায় নেই। অলি বার দুয়েক পলক ফেলে বোঝার চেষ্টা করতে লাগল। নোমানের নানু বলেছে আলভী নাকি আরিশকে নিয়ে এসেছে। তাহলে বাপ-বেটা গেল কোথায়? তার ভাবনার মাঝেই ব্যালকনির দরজা ঠেলে আলভী প্রবেশ করল। কোলে আরিশ, যার মানে দাঁড়ায় এতোক্ষণ যাবত হয়তো বাবা ছেলে মিলে ব্যালকনিতে বসে বসে গল্প করেছে। অলি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আলভীর দিকে এগিয়ে গেল,
“ওকে আমার কাছে দিয়ে খেয়ে নিন।”

আলভী বিনাবাক্যে আরিশকে অলির কোলে তুলে দিল। অলির কোলে আসতেই আরিশ ঠোঁট ফুলিয়ে কেদে ওঠে, তার কান্না দেখে অলি হকচকিয়ে গেল। আলভী ম্লান হেসে বলল,
“ছেলেটাকে রেখে সারাদিন অনেক আনন্দ করেছো। সেই জন্যই অভিযোগ করছে।”

অলি সরু চোখে আলভীর দিকে তাকায়,
“আপনি কিভাবে বুঝলেন?”

আলভী হাত ধুয়ে ভাত মাখাতে লাগল,
“আমার ছেলের ভাষা আমি বুঝবোনা?”

অলি আরিশকে নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসল,

“খেয়েছো?”

অলি হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ল। আলভী প্লেটটা নিয়ে অলির সামনে এসে বসল,
“মিথ্যা বলছো কেন? আমি জানি তুমি খাওনি।”

অলি নরম চোখে আলভীর দিকে তাকায়। আলভীর উসকোখুসকো চুল আর মলিন মুখটা দেখে তার বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল,
“আপনি কান্না করেছেন?”

আলভী উত্তর না দিয়ে অলির মুখের সামনে এক লোকমা ভাত ধরল। অলিও বিনাবাক্য হা করল। মুখের ভাতটুকু শেষ হতেই ফের প্রশ্ন করতেই যাবে কিন্তু আলভী আবারও তার মুখে ভাত ঢুকিয়ে দিল। এভাবেই খাওয়া দাওয়ার পালা শেষ হল। অলি বুঝতে পারল এভাবে প্রশ্ন করলে আলভী উত্তর দেবেনা।

অনেকক্ষণ পর,

আরিশ ঘুমিয়ে গেছে, এরই মাঝে অলি অনুভব করে আলভী তাকে নিজের দিকে টেনে নিচ্ছে। অলি তার দিকে ঘুরতেই আলভী বালিশ থেকে মাথা সরিয়ে অলির বুকে মাথা রাখল৷ অলিকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কেদে উঠল। অলি বুঝতে পারল বোনের চলে যাওয়াতে আলভীর একটু বেশিই খারাপ লাগছে। অলিও বুঝদারের মতো কোনো প্রশ্ন ছাড়াই আলভীর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

এদিকে দিহান ঊর্মিলাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছেনা। মেয়েটা কেদে কেটে অস্থির, দিহান ঊর্মিলার চুলে থাকা ক্লিপ গুলো খুলে দিতে দিতে বলল,
“আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখো। তোমার মেক-আপ তো নষ্ট হয়ে গেছে।”

দিহান এবার ঊর্মিলাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে জরিয়ে ধরল,
“আমার রাগিনী রাগের বশে আমাকে খু’ন করলেও আমি সহ্য করে নেবো কিন্তু তার এই কষ্ট যে আমি সহ্য কর‍তে পারছিনা। তাকে শান্ত করার কোনো টেকনিক জানো তুমি? জানলে বলো আমাকে।”

দিহানের কথাটা শুনে ঊর্মিলা কিছুটা শান্ত হতেই দিহান আবারও বলে ওঠে,
“কালকে তো যাচ্ছোই, তারপর তোমার যেকদিন ইচ্ছা হবে সেকদিন থেকে আসবে৷ আমি কিছু বলবোনা, এবার অন্তত কেদোনা রাগিনী।”

ঊর্মিলার কান্না এবার সম্পূর্ণরূপে থেমে গেল। এরই মাঝে তার ফোন বেজে ওঠে। ফোনের স্ক্রিনে অলির নম্বর দেখে সে তাড়াতাড়ি কলটা রিসিভ করে কানের কাছে নিল,
“হ্যালো ভাবী,”

অলি অপরপাশ থেকে শান্তকন্ঠে বলল,
“হুম আপু, তুমি কি এখনো কান্না করছো?”

ঊর্মিলা স্বাভাবিক গলায় বলল,
“না ভাবী আমি কান্না করছিনা একদম। বাড়ির সবাই কি করছে? আমি চলে আসার পর মা বাবা কি খুব কান্না করেছে?”
“খুব করেনি, একটু করেছে। তোমার কেমন লাগছে সেখানে?”
“আমার ভালোই লাগছে ভাবী। আচ্ছা ভাইয়া কোথায়?”
“তোমার ভাই পাশেই আছে। কথা বলবে?”
“হ্যাঁ দেও।”

অলি আলভীকে কথা বলতে বলল কিন্তু আলভী আগের মতোই অলিকে জড়িয়ে ধরে মুখ লুকিয়ে রাখল। অলি উপায়ন্তর না পেয়ে বলল,
“স্যরি আপু, তোমার ভাই ঘুমিয়ে গেছে।”

ঊর্মিলা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,
“থাক তাহলে, ডেকোনা। তুমি একটু ভাইয়ার দিকে খেয়াল রেখো ভাবী। সে মুখ ফুটে কিছুই বলবেনা কিন্তু একা একা কষ্ট পাবে। আমাকে না বললেও আমি জানি ভাইয়া আমাকে খুব ভালোবাসে। আর জানোতো আমিও তাকে খুব ভালোবাসি।”

লাউড স্পিকারে থাকায় আলভীও ঊর্মিলার কথা শুনতে পেয়েছে। অলি আরও কিছুক্ষণ কথা বলে কল কেটে দিল।

রায়া বিছানার একপাশে শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ যেতেই নোমান ওয়াশরুম থেকে বের হতেই রায়া শোয়া থেকে উঠে বসল,
“আপনি কি খুব টায়ার্ড?”

নোমান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই রায়া বলে উঠল,
“না মানে, টায়ার্ড না হলে একটু কথা বলতাম এই আরকি।”
“হুম বলো।”

নোমান রায়ার পাশে বসতেই রায়া বলল,
“তার আগে কথা দিন আমি যাই বলি আপনি তাতে রেগে যাবেন না।”

নোমান আনমনেই বলল,
“হুম বলো শুনি।”
“আচ্ছা আপনি কি আপনার সেই নিষিদ্ধ ভালোবাসাকে কোনোদিনই ভুলতে পারবেন না?”

নোমান একটা শ্বাস ফেলল,
“প্রশ্নটার উত্তর একটু ডিফিকাল্ট। তার প্রতি আমার ফিলিংস গুলো সম্পূর্ণ অন্যরকম। বলতে পারো অপরিপক্ক,”
“মানে?”
“তার জন্য অনুভুতি গুলো বিকশিত হওয়ার পূর্বেই আমি জানতে পারি সে ম্যারিড। এটা জানার পর স্বাভাবিকভাবেই আমি দমে যাই। নিজের অনুভূতি গুলোকে সামলে নিই। তবে তোমাকে বিয়ে করার কয়েকদিন আগে আমি বুঝতে পারি, হাজারও বারণ পেরিয়ে মনের অজান্তেই সেই অনুভূতি গুলো ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে।”

রায়ার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। যেই অনুভূতি গুলো অল্রেডি ভালোবাসায় পরিনত হয়ে গেছে সেই অনুভূতিতে অপরিপক্ক বলা চলেনা। ইতোমধ্যেই যেন তার সব আশা নিরাশায় রূপ নিয়েছে। কান্নারা যেন গলা চেপে ধরেছে, এতো কষ্ট কেন হচ্ছে তার? রায়া উঠে যেতে নিলে নোমান প্রথম বারের মতো রায়ার হাত ধরল। নোমানের ছোয়াতে রায়ার শরীরে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হল। নোমান রায়াকে নিজের সামনে বসিয়ে কোমল গলায় বলতে লাগল,
“এই অনুভূতি গুলো তোমার আগমনের পূর্বে ছিল রায়া। এখন সেগুলোর কোনো ভ্যালু নেই। আমি নিজেও সেই অনুভূতি গুলোকে ভুলে যেতে চাই। তোমার সাহায্যের প্রয়োজন। তুমি আমাকে সাহায্য করবে না?”

রায়া আর কান্না গুলোকে আটকে রাখতে পারলোনা। অশ্রুসিক্ত নয়নেই মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলল। নোমান রায়ার চোখের পানি যত্ন সহকারে মুছে দিয়ে বলল,
“মিসেস অলি আমার কাছে একটা ধন্যবাদ পায়। ভাবছি কালকে বাড়িতে ফেরার আগেই ধন্যবাদটা জানিয়ে দেব।”

রায়া নাক টেনে বলল,
“কিসের জন্য?”
“বাড়ে, তোমাকে আমার জীবনে আনার পেছনে তার ভূমিকাই তো সবচেয়ে বেশি ছিল। তুমি না থাকলে আমি তো সেই নিষিদ্ধ অনুভূতি গুলোর জাতাঁকলে পিষ্ট হয়ে যেতাম।”

নোমানের কথাটা শুনে রায়ার মুখশ্রীতে প্রশান্তির ছায়া নেমে এলো।

***

গতদিনের সব অবসাদ ঘুচিয়ে নতুন দিনের আগমন হল। আজকে সবকিছুই যেন ঠিকঠাক লাগছে। বিকালের দিকে দিহানকে নিয়ে ঊর্মিলা মির্জা ভিলাতে ফিরে এলো। সেই সাথে আত্মীয় স্বজনরাও এক এক করে নিজেদের গন্তব্যে ফিরে যেতে লাগল। রায়া আর নোমান চলে যাওয়ার পূর্বে অলিকে ধন্যবাদ জানাতে ভুললোনা। তাদেরকে খুশি দেখে অলিও দারুণ খুশি হয়েছে। সেদিন যখন নোমান বলল সে সারাজীবন বিয়ে করবেনা অলির মাঝে আলাদাই একটা খারাপ লাগা কাজ করেছিল। নোমানকে সে ভাইয়ের চোখে দেখে। ভাই কতটা কষ্ট পেয়ে উক্ত কথাটা বলেছে ভাবতেই সে ভীষণ করে চেয়েছিল রায়ার সাথেই নোমানের বিয়ে দিতে।

রাত নেমে আসতেই মির্জা ভিলা পুরোনো রূপে ফিরে গেল। আলভী আর দিহান বাদে বাকি সবাই ড্রইংরুমেই বসে ছিল, এরই মাঝে ইয়াদ এসে শান্তকন্ঠে বলল,
“আমরা চলে যাচ্ছি।”

দাদুমনি পাশ থেকে প্রশ্ন ছুড়লেন,
“কোথায় যাবে দাদুভাই?”

ইয়াদ হয়তো কোনো মিথ্যা অজুহাত দিতে চাইছিল কিন্তু তাকে সেই সুযোগ না দিয়ে নূরনাহার বলে উঠলেন,
“জাহান্নামে যাবে। সেখানে যাওয়ার জন্যই তো এত উদগ্রীব হয়ে আছে।”

দাদুমনি ভীষণ চমকে গেলেন।
“এসব কি ধরণের ভাষার প্রয়োগ করছো ছোটবউ? নিজের ছেলেকে কেউ এভাবে বলে?”
“মা আপনি এই ব্যপারে কিছুই জানেন না। তবে এটা অবশ্যই জানেন যে একজন খু’নি আর যাই হোক জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেনা।”

আলভী আর দিহান একসাথে নিচেই আসছিল। নূরনাহারের কথা শুনে তারা দাঁড়িয়ে যায়। শাহানাজ বেগম চোখ রাঙিয়ে থামতে বললেও সেসবের তোয়াক্কা না করেই নূরনাহার বিষমিশ্রিত কন্ঠে বললেন,
“খু’ন করা আর খু’ন করার চেষ্টা করা দুটোই সমান। তুই এই আঁটকুড়া মেয়েটাকে বিয়ে করে বাড়ি ছেড়ে জাহান্নামের পথ বেছে নিয়ে নিজেকে মহান মনে করছিস? আমি তো বুঝে উঠতেই পারছিনা যে এই মেয়েটার কালো ছায়া কিভাবে তোকে গ্রাস করে নিল? আমি কেন কিছু টের পেলাম না? কেন তোকে সঠিক রাস্তা দেখাতে পারলাম না। জান্নাতে স্বামী স্ত্রীর দেখা হবে সেটা জানিস নিশ্চয়ই?”

ইয়াদের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। রূপসা এককোনায় দাঁড়িয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। বাকি সবাই নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। নূরনাহার আবারও বলে উঠলেন,
“এই মেয়ের জন্যই তুই জাহান্নামে যাবি। তোদের দুই স্বামী স্ত্রীর সেখানেই দেখা হবে।”

রূপসা আর সহ্য করতে পারলোনা। চলে যেতে উদ্যত হতেই ইয়াদ তার হাত ধরে ফেলল। তারপর কোনো দিকে না তাকিয়ে হনহন পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

চলবে,,,

শব্দসংখ্যা- ৩০০০+