প্রিয়অপ্রিয়ের সংসার পর্ব-৩৬+৩৭+৩৮

0
28

#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_৩৬_৩৭(ধামাকা পর্ব)
(১৮+এলার্ট পর্ব। প্রাপ্তবয়স্কদের আর মুক্তমনাদের জন্য উম্মুক্ত)
“ফুপি কালকেই বিয়ে হবে আমাদের। আজ এ মুহুর্তে কারো কোনো এক্সকিউজ আমি শুনতে চাই না। এক কথা বলে ফেললাম তার উপর জোরদার চালান সবাই।”

সারোয়ার এর হাত থেকে নিজের হাত ছড়িয়ে শেহরীনা চিৎকার করে ‘না না আমি বিয়ে করব না’ বলে মাটিতে বসে দাপাদাপি করতে লাগল। সারোয়ার শান্ত মেজাজী হওয়ায় মেয়েটা সহজে তার সামনে ন্যাকামি করতে পারছে। যদি সে অন্যান্য টক্সিক পুরুষের মত চরিত্রের অধিকারী হতো। তবে এতক্ষণে মেয়েটার কান্না বন্ধ হয়ে গালে হাত রেখে ফুঁপিয়ে নিরবে হেঁচকি তুলতো সে। সারোয়ার তার সামনে একপা ভাঁজ করে হাঁটু গেড়ে মুখ বরাবর ঝুঁকল। শেহরীনা নিজেকে গুটিয়ে নিল। সারোয়ার এর চোখজোড়ায় পানি এসেছে। লোকটার চোখে এ প্রথম স্পষ্ট রক্তিম আক্রোশ ফুটে উঠেছে।

“দেখো মেয়ে কথার বরখেলাপ না করে চুপচাপ যেয়ে লক্ষ্মী মেয়ের মত খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। এখনিই কাগজে স্বাক্ষর করে আইনগত বিয়ে করব বলিনি। কালকে অব্দি সময় দিয়েছি। শরীয়ত মোতাবেক বিয়ে হবে।”

শেহরীনা কাঁপা গলায় বলে,

“নননা আমি বিবিয়ে করতে চাইছি না। আপনি জানেন তবুও কেনো জোর করছেন। দয়া দেখিয়ে…।”

ধরাম করে মাটিতে হাত মা’রল সারোয়ার। মেয়েটা তাকে অতিরিক্ত পরিমাণে কষ্ট দিয়ে ফেলছে। শেষ অব্দি তার প্রণয় কে ‘দয়া’ শব্দের উপর চালিয়ে দিল। আক্রোশে দাঁত কিড়মিড়িয়ে উঠল তার। শেহরীনা আতঙ্কিত বোধ করে। সন্তপর্ণে মায়ের আঁচল চেপে ধরে। রূপালি বেগম আর নাছির উদ্দিন হয়েছে কী বুঝছেন না! তিনি মেয়ের অসহায়ত্ব দেখে ঝুঁকে বসে মেয়েকে আঁকড়ে ধরে দাঁড় করান। নাছির উদ্দিন প্রশ্নাতীত নজরে তাকান। সারোয়ার ভীষণ আক্ষেপের সুরে তার ফুপির স্বামীর হাত ধরে বিনীত কণ্ঠে বলে,

“ফুপা আপনি চান আমিই যেনো শেহরীনার দায়িত্ব নেই। আপনি কী সেই দায়িত্ব সত্যিকার অর্থে আমাকে দেবেন না!এ মুহূর্তে অঙ্গিকার স্বরুপ আপনার কাছ থেকে, এক পিতার কাছ থেকে তার অংশ,তার মেয়েকে চাই।”

কঠিন আবদার। বিয়ের দিনক্ষণ এর পূর্বেই কাল বিয়ে। এ যেনো নাছির উদ্দিন এর জন্য বিরাট দুঃখজনক। তবে প্রায়োগিক দিক থেকে তিনি খুশি। মেয়েকে নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পৌঁছে দিতে পেরে তিনি মনে আহ্নিক স্বস্তি পাবেন। শেহরীনা বাবার ইমোশন বুঝতে পেরে তৎক্ষণাৎ বাবার হাতের থেকে সারোয়ার এর হাত সরিয়ে নেয়। বিচলিত না হয়ে সারোয়ার একই দৃষ্টিতে নাছির উদ্দিন এর দিকে তাকিয়ে রইল। নিরব বার্তা দুজনের চোখমুখে। রূপালি বেগম শক্ত মনে মেয়ের হাত ধরে তাকে টেনে রুমে নিয়ে যান। স্বামী আর পাত্র যা ঠিক করবে সেটাই হবে মেয়ের সাথে। শেহরীনা কে রুমে বন্ধ করতে গেলে সে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। তিনি অদ্ভুত দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকান। পরক্ষণে অশুভ ঘটনা ঘটেছে কী! সেই ভাবনা আসায় মেয়ের মুখখানা আঁকড়ে নিজের দিকে করেন।

“ত…ততোর সাসাথে কী…।”

শেহরীনার কান্নার জোড় বেড়ে গেল। কাঁপা হাতে সে তার কাঁধের কাপড় সরিয়ে দেখাল। মাথা নেড়ে ঘটনাটা সত্যি বোঝায়। শুনে ধপাস করে মেয়ের বিছানার উপর বসে পড়েন তিনি। এ কী অনর্থ হয়ে গেল!

“মা বল কী হয়েছে কেমনে হয়েছে!”

শেহরীনার কান্না বন্ধ হলেও হেঁচকি এখন অব্দি যায়নি। তার নাক শব্দ করে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। সে মায়ের হাত ধরে ক্যাম্পিং এর সময়ের ঘটনা খুলে বলে। রূপালি বেগম শুনে তার মনে সংশয় জাগে।

“কিন্তু তুই তো বললি তুই অজ্ঞান হয়ে গেলি। তাহলে তোর সাথে শুই’বে কেমনে!”

“মা আপনি বুঝবেন না। আমি বুঝি আমার খুব ব্যথা শরীরে।”

রূপালি বেগম এর মনের খটকা যায়নি। তবুও মেয়েকে শান্ত করতে নিজ হাতে খাবার গরম করে এনে মুখে পুরে দেন। পানি আর ঔষধ খাইয়ে শুয়ে দিলেন। সারোয়ার ড্রয়িং রুমে নাছির উদ্দিন এর সঙ্গে বসে আছে। পিনপতন নীরবতা বিদ্যমান। নাছির উদ্দিন ঘটনা জানতে উপায়ন্তর না পেয়ে নাসমা আর নাসমুর কে রুমে পাঠিয়ে দিয়েছেন। রূপালি বেগম কে দেখে চোখের ইশারায় মেয়ের ব্যাপারে ইঙ্গিত করেন। রূপালি বেগম ইতিবাচক ইঙ্গিত দেন। স্বস্তি পেল দুজনে। তবে রূপালি বেগম নিজের কৌতুহল না দমিয়ে সরাসরি জিজ্ঞাসা করেন।

“বাবা কী হয়েছে! মেয়ে বলতেছে তার সাথে কী!”

“না ফুপি সে যেমনটা ভাবছে তেমন কিছুই হয়নি। সে মনের ভুলে বিয়েতে অমতি করছে। তার ধারণা সে কলঙ্কিত হয়ে গেল তাই আমি দয়া দেখাচ্ছি।”

“কিন্তু বাবা হয়েছিল কী তোমরা গেলে একদিন হলো শুধু। আজ রাতেই তোমাদের ফেরত আসা দেখে অবাক হয়েছি আমরা।”

নাছির উদ্দিন এর কথায় সারোয়ার পুরো ঘটনা বুঝিয়ে বলে,

“ফুপা সেসময় শেহরীনাদের মক্কেল ছিল খন্দকার মিয়া আর মোকতাব মিয়া।”

প্রথম নামটা শুনে চিন্তে পারেননি। তবে দ্বিতীয় নামটা শুনে নাছির উদ্দিন এর চোখজোড়া বড় হয়ে গেল। তবে প্রথম নামটির সাথে তিনি আংশিক পরিচিত মনে করেন। মস্তিষ্কে জোর প্রয়োগ করতেই তিনি তিক্ত গলায় বলেন,

“খন্দকার তো সরলপাড়া হক গ্রামের চেয়ারম্যান। আর এই মোকতাব মিয়া আমার দোকানের পুরাতন মালিক ছিলো। তারে তো টাকাও শোধ কইরা দিছিলাম।”

“ফুপা দিলেও হয়ত সে আপনার করা অপমানের বদলা নিতে চেয়েছিল। আর সেটা শেহরীনাকে ধ’র্ষণ করে। শুধু সে একলা জড়িত নয় খন্দকার তার সাথে মিলিত ছিল।”

নাছির উদ্দিন আর রূপালি বেগম অবাক চিত্ত চোখে তাকিয়ে আছেন। সারোয়ার নিজেই ঘটনা খুলে বলতে লাগল।

অতীত…..
সারোয়ার এর উপর থেকে ঘুমের নেশা প্রায় কেটে এসেছে। চোখ পিটপিট করে খুলতেই দেখে সামনে নিস্তব্ধতা। মাথায় হাত চেপে চৌপাশ তাকিয়ে পানির খোঁজ করে। টিউবওয়েল দেখে সেটার কাছে এগিয়ে যায়। টিউবওয়েল চেপে হ্যান্ডেল জোরে জোরে নাড়া দেয়। যার ফলে একঝাঁক পানি মাটিতে পড়তে লাগল। সারোয়ার তৎক্ষণাৎ পানি হাতে নিয়ে মুখে ছিটিয়ে চোখ মুছে নেয়। ভালোমত চোখ মুছে নিজেকে সটান সজ্ঞানে আনল সে। একে একে তার মনে পড়তে লাগে জুস খাওয়ার সময় তার স্বাদটা ভীষণ বিদঘুটে লেগেছিল। সে ফেলে দিত কিন্তু খন্দকার মিয়ার স্ত্রীর নজরখানা বাঁকা বাঁকা হয়ে থাকায় সে খাওয়ার ভান করে। যতটুকু তার গলা ভেদ করেছে সেইটুকুর আসর তার মস্তিষ্কে হয়েছে। সে মাথায় পানি ঢেলে নিজেকে ভিজিয়ে ধীরপায়ে উঠে দাঁড়ায়। গাড়ির নিকট গিয়ে দরজা খুলে দেখল পানির বোতল রাখা তা হাতে নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে। যে রুমে ইপশিতা আর ফারদিন ছিল সেই রুমে যায়। তারা মরার মত কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। তার ইচ্ছে করছিল না লাভ বার্ডস কে জাগানোর। তবে না জাগিয়ে এখন উপায় নেই। তাদের চোখমুখে পানি ছিটিয়ে ঘুম দূর করার চেষ্টা করল। ইপশিতার নিভু চোখজোড়া খুলতে দেখে সারোয়ার বলে,

“ইপশিতা বোন উঠো ফারদিন কে জাগানোর চেষ্টা করো। আমাদের সাথে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।‌ জলদি উঠো বোন।”

ইপশিতা মাথা চেপে ধরে পাশে বসা ফারদিনের দিকে তাকায়। তারও একটু একটু হুঁশ ফিরছে। সারোয়ার ইপশিতার হাতে বোতল ধরিয়ে বলে,

“বোন ফারদিন জাগাও আমি জাফরানের কাছে যাচ্ছি।”

জাফরান এর রুমে এসে থমকে যায় সারোয়ার। শেহরীনা নেই তার গলার স্কার্ফ মাটিতে অবহেলায় পড়ে রইল, ফোনটা এককোণে জ্বলজ্বল করছে। ফোন হাতে নিতেই দেখল কল আসছে ‘মা’ লিখা নাম্বার থেকে। এই নিয়ে সতেরো বার কল এসেছে। মা যে তার ফুপি সে নিশ্চিত। কাঁপা হাতে কলটা রিসিভ করে।

“মা তুই কোথায় চলে গেছিলি কল ধরছিলি না কেনো!”

“ফুপি আমি বলছি।”

রূপালি বেগম অবাক হলেন। মেয়ের নাম্বারে সারোয়ার কথা বলছে কেমনে!

“বাবা তুই শেহরীনা কোথায়! সেই কখন থেকে কল‌ দিচ্ছি অলস মেয়েটা কল ধরছিলো না। দেখো তুমি ধরলে তাহলে মেয়েটা সেখানে গিয়েও অলসতার কারণে কাজ করছে না। তবে আজ সকাল থেকেই মনটা বিষন্ন হয়ে আছে বাবা। একবার শেহরীনাকে কল ধরিয়ে দেবে।”

মায়ের মন বলে কথা সারোয়ার নিজেই জানে না শেহরীনা কোথায়! তবে নিখোঁজ ব্যক্তিকে না‌ খোঁজা অব্দি প্রমাণ মিলবে না। এর মাঝে শেহরীনার বাবা-মাকে চিন্তায় ফেলার কোনো ইচ্ছে নেই তার। বিধেয় ঢোক গিলে গম্ভীর স্বাভাবিক কণ্ঠে আওড়ায়।

“ফুপি সে এখন ইপশিতার সাথে কেসের বিষয়ে স্টাডি করছে। শেষ হতে সময় লাগবে তাদের। তাই তারা আমার কাছে নিজেদের ফোন জমা দিয়েছে। তবে আপনি বললে আমি ডেকে দেবো।”

সারোয়ার নিসংকোচে বললেও তার ভয় হচ্ছিল। কিন্তু রূপালি বেগম দ্বিরুক্তি করলেন না। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)বাচ্চারা পড়াশোনা নিয়ে কাজ করছে এতে তিনি কথা বলে বিরক্ত করার মনোভাব পোষণ করেন না। সারোয়ার কে সরাসরি না বলে কুশল বিনিময় করে কল কেটে দেন। সারোয়ার তপ্ত শ্বাস ফেলল।
শেহরীনার স্কার্ফটা বুকে জড়িয়ে বলে,

“তুমি চিন্তা করো না প্রিয় আমার। আমি তোমায় খুঁজে বের করবই। যত যাই হয়ে যাক। তোমাকে ছাড়া আমি এ গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছি না।”

সারোয়ার এর মধ্যে হিংস্র জেদ কাজ করছে। জাফরান কেও জাগিয়ে নেয়। ইতিমধ্যে গ্রামে খবর হয়ে গেল অতিথি বেশে আসা লোকদের অজ্ঞান করা হয়েছে। কিংবদন্তী হয়ে তারা খুঁজে চলেছে তাদের এক সাথী কে। তাদের এক সাথীকে অপহরণ করা হয়েছে স্বয়ং চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে। অথচ সেখানে পুরুষ মানুষ দুটো ছিল চেয়ারম্যান আর তার ভাই।
‘ভাই’ শুনে এলাকাবাসী কানাঘুষা করতে লাগে। একজন সারোয়ার এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করে।

“বাবা চেয়ারম্যান তো একলা মানুষ বউ নিয়া থাহে। তার ভাই আইব কৈ থেকে।”

সারোয়ার-রা তব্দা খেল। ফারদিন আতঙ্কিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।

“মানে খন্দকারের কোনো নিজস্ব র’ক্তের ভাইটাই নেই!”

“না বাবা সে থাহে বউ নিয়া। আপনে তার বউরে জিগান।”

“কেমনে জিজ্ঞেস করব আঙ্কেল! বাড়ির ভেতর কোনো কাক পক্ষীও নেই। খন্দকার মিয়ার‌ স্ত্রীকেও আমার এখন ফেইক মনে হচ্ছে। আর তার মেয়েদের কাহিনী নিছক গল্প বৈকি কিছুই নয়।”

সারোয়ার এর কথায় গ্রামবাসী চিন্তায় পড়ে গেল। তবে সে ভেবে পাচ্ছে না শেহরীনাকে অপহরণ করার কারণ কী!
এলাকার লোকদের কাছ থেকে খন্দকার মিয়ার বাড়িঘর এর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে নেয় তারা। একেকজন যেই ঠিকানা দিয়েছে চিরুনি তল্লাশি দিয়ে খুঁজতে লেগে পড়ে।

___
“আন্টি প্লিজ আপনিও একজন মেয়ে। আপনি কেমনে ঐ নরপশুদের জন্য আমায় বিবস্ত্র করছেন! আপনার মধ্যে কী সামান্য মায়াটুকু নেই। আপনিও তো এক বাপের সন্তান আমিও তাই। প্লিজ ছেড়ে দিন না আন্টি প্লিজ….।”

কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল শেহরীনা। খন্দকার মিয়ার স্ত্রী মুখ বাঁকালেন। তিনি চাইলেই পারেন, মেয়েটাকে সরিয়ে দিতে তবে এমনটা করবেন না তিনি। কারণ তিনি সহায়তা না করলে তার স্বামী তাকে খদ্দেরের কাছে পাঠিয়ে দেবেন। তখন সারারাত সে জঘন্য দেহের চাহিদা মেটাতে মেটাতে নিথর হয়ে পড়বে। এই নিয়ে কয়েকবার তার স্বামী সেই কাজ করেছে। যার ফলে তার মন থেকে দয়া মায়া মুছে গিয়েছে চিরতরে। সে এখন শুধু নিজের স্বস্তি, নিজের নিরাপদ চাই। ফলে কয়েক বছর হয়ে গেল আদৌ সে স্বামী ছাড়া অন্য কারো স্পর্শে যায়নি। কারণ তার স্বামী তার উপর সন্তুষ্ট। সে যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে তার উপাধি হবে ‘প’তি’তা’। যা সে এ বৃদ্ধ বয়সে এসে সহ্য করে উঠতে পারবেন না। জীবনের প্রতি মায়া দয়া সবারই থাকে।
নিশ্চুপে উ’ল’ঙ্গ করতে ব্যস্ত হোন তিনি।
শেহরীনার চোখজোড়া ঘৃণায় বন্ধ হয়ে গেল। সে জানে না আজ তার বাঁচার কোনো পথ আছে কি-না! যদি চিরতরে তার যৌবনত্ব কেড়ে নেবে সেই নরপশুরা! তবে সে মা’রা যাবে। কখনো সে আর সারোয়ার কে বলতে পারবে না যে, সেও চেয়েছিল অপ্রিয় মানুষ কে প্রিয়তে পরিণত করতে, চেয়েছিল সুন্দর স্বপ্ন বুনতে। এই তার কপালে লিখন।
হু হা বিকট হাসির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে বাহির থেকে। শেহরীনা খেয়াল করে তার হাত-পা খোলা। অবাক হলেও ঘাঁটল না। তার ছেঁড়া জামা গাঁয়ে জড়িয়ে কাঁপা পায়ে দরজার দিকে এগোলো। বাহিরে মাথা উঁচিয়ে নজর ফেলে। কেউ নেই কিন্তু কথোপকথন আর অদ্ভুত এক শব্দ অমার্জিত শব্দ তার কর্ণকুহরে ভেসে আসছে। খালি পায়ে নিঃশব্দে সেই বিশ্রী শব্দের অনুকরণে সামনে আগায়। দেখতে পেল একটা রুমের ভেতর থেকে আলো জ্বল জ্বল করে বাহিরের দিকে পড়ছে। সে চোরের বেশে জানালার কাছে যায়। চিবুক তুলে জানালার ভেতর তাকাতেই ঘৃণায় তার গাঁ গুলিয়ে আসে। তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে দূরে সরে দ্রুত পা চালিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
দৌড়াতে থেকে চলে আসে জঙ্গলের ভেতর। চারপাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে। কতক্ষণ সেই গুড়া বাড়িতে ছিল কে জানে! তার চিন্তা হচ্ছে সারোয়ার-রা সুস্থ আছে তো!
পেটে ক্ষুধা,গলায় পানির তৃষ্ণা লাগায় এক বড় গাছের নিচে পা সটান হয়ে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। ভোর হওয়া অব্দি তার লুকিয়ে থাকতে হবে। নাহয় সে নরপশুদের খপ্পরে পড়ে যাবে।
‘আচ্ছা আন্টি কি সত্যি আমায় সাহায্য করতে চাইনি! তবে না করতে চাইলে দড়ি বেঁধে রাখল না কেনো!’
তার চোখে ভাসল দড়িতে র’ক্ত ভেজা। সে নিজের হাতে নজর দেয়। হ্যাঁ দড়ির মধ্যে র’ক্ত লেগে চুপসে গেছে যার কারণে যে কেউ দেখলে বলতে পারবে চুপসে যাওয়ায় মেয়েটা দড়ি খুলে পালাতে পেরেছে।
তার ঘৃণা লাগছে বয়স্ক লোক দুটোর নৃশংস ধ’র্ষণ করার দৃশ্য দেখে।
‘ছিঃ এই খন্দকার নিজের বউকে দিয়েই মোকতাবের চাহিদা ভরাচ্ছিল। সেই দৃশ্য সহ্য অথবা দেখার মত নয়। কী নৃশংস ধ’র্ষণ! স্বামী হয়ে স্ত্রীকে ফেলনা ভাবে সে। নাহয় কী নিজ স্ত্রী কে কেউ অন্যের কাছে বিলিয়ে দিতে পারত।’

অন্যদিকে, হৈচৈ শুরু হয়েছে খন্দকার আর মোকতাব মিয়ার মাঝে। কচি মেয়েটার হদিস পুড়া বাড়ির চারপাশ জুড়ে কোথাও নেই। ভয়ে ভয়ে চাদর বুকে জড়িয়ে খন্দকার মিয়ার স্ত্রী সেখানে আসেন। তাকে দেখে রেগে গেলেন তিনি। সামনে সজোরে চ’ড় লাগান। একঝটে মাটিতে নেতিয়ে পড়েন তিনি। একে তো শক্তি সব খুবলে খেল মোকতাব মিয়া তার উপর এ আঘাত। সহ্য সীমা নিঃশেষ হওয়ায় নিথর হয়ে গেল তার শরীর। এতে বিচলিত হোননি খন্দকার মিয়া। তিনি মোকতাব মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলেন,

“চল সামনে যাইয়া দেখি হয়ত পামু ঐ মাইয়ারে।”

তারা দুজনে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়েন।
শেহরীনা খেয়াল করল তার সামনে পুরুষেলী অবয়ব দুটো। সে খুশি হলো মুহুর্তেই অন্ধকারে জড়িয়ে ধরে। পরক্ষণে বিদঘুটে গন্ধ তার নাকে এলে সে চমকে দূরে সরে গাছের সঙ্গে লেগে যায়। মোকতাব মিয়া বিশ্রী হেসে বলেন,

“পাখি উড়াল দিতে চাইলে কী হায়েনার নজর থেকে বাঁচতে পারে কখনো! আয় আয় সোনা মজা পাবি খুব।”

শেহরীনার কাঁধের ফ্রক টেনে ছিঁড়ে দিল। সে চিৎকার করে উঠে। তার চিৎকারের গুঞ্জন রাস্তার মধ্যে এসে ভেদ করল। সেখানে সারোয়ার ছবি দেখিয়ে সবাইকে জিজ্ঞেস করছিল। তার কানে স্পষ্ট চিৎকারের শব্দ ভেসে আছে। তার ষষ্ঠইন্দ্রিয় সজাগ সেই জঙ্গলের দিকে নির্দেশ করছে। জাফরান তখনো গাড়িঘোরার মাঝে হর্নের শব্দ শোনায় বুঝতে পারেনি। তাদের দিকে একপলক তাকিয়ে সারোয়ার তার মনের সংকোচ দূর করতে ছুট লাগায়। তাকে দেখে ইপশিতারা অবাক। ফারদিন জোরে ডাক লাগায় তারাও পিছু নেয়। সারোয়ার ছুটছে তার হাতে টর্চলাইট, গরম মৌসুমে তার শরীর ঘেমে গেছে। অন্ধকারে সে টর্চের আলোতে ছুটছে। পথ স্বয়ং খোদা দেখিয়ে দেবেন। সেই ক্ষীণ আশা নিয়ে ছুটে যাচ্ছে
মোকতাব মিয়া গাছের ডালের সঙ্গে শেহরীনাকে চেপে ধরেন। পিঠের মধ্যে লাগোয়া চেইন একটানে ছিঁড়ে ধারালো নখের আঁচড় কেটে দেয়। মোক্তার মিয়া তার লুঙ্গি উঠিয়ে ফেলেছে।শেহরীনা ছোটার জন্য চিৎকার চেঁচামেচি করছে। অন্ধকারে সে দেখতে না পেলেও আতঙ্কে হাত-পা ছুটাছুটি করে। যার ফলে মোকতাব মিয়ার লিঙ্গে লাথ পড়লে সে ব্যথায় আর্তনাদ করে বসে পড়ে। শেহরীনা অন্ধকারে অবয়ব দুটো কে দেখে ভয়ে পিছিয়ে যেতে গেলে শক্ত ডালের সঙ্গে পা বেজে মুখ থুবড়ে পড়ে। মাথায় ছোট আঘাত পেয়ে তার শরীর নেতিয়ে পড়তে লাগে ক্রমশ। খন্দকার মিয়া মোকতাব মিয়াকে রেখে নিজে গিয়ে মেয়েটার পায়ের উপর পা চেপে ধরে। ব্যথায় শেহরীনার মুখ ভেদ করে গলা ফাটা চিৎকার ফুটে। খন্দকার মিয়া লালসার চোখে কাবু হয়ে শেহরীনার ফ্রক হাঁটু অব্দি টেনে কোমর অব্দি নেওয়ার মুহুর্তেই তার মুখে পাথর ছুঁড়ে মা’রে কেউ।
খন্দকার মিয়া পাথরের আঘাতে আর্তনাদে পড়ে গেলেন। শেহরীনা দেখে শক্তপোক্ত দেহের অবয়ব কয়েকজন দৌড়ে আসছে। সারোয়ার গুঞ্জন এর শব্দে এসে খন্দকার মিয়ার দিকে পাথর নিক্ষেপ করে। শয়তান কে পাথর নিক্ষেপ করে বিতাড়িত করা হতো ঠিক তেমনি মনুষ্য শয়তান কে পাথরের দ্বারা মাটিচাপা দেওয়া হবে। সারোয়ার এর চোখমুখের রঙ পাল্টে গিয়েছে রাগে তার ঘাড়ের রগ উঠেছে। সে একের পর এক শক্ত হাতের প্রহার চালায়। সর্বশেষে দুজনের লিঙ্গ চিরতরের জন্য চাপা দেয়। করুণ ভয়াবহ ব্যথায় দুজন সেখানেই পড়ে রইল। কোনো একসময় বাঘ, ভাল্লুক এসে তাদের ভোজন করবে।

বর্তমান….
নাছির উদ্দিন শুনে রাগান্বিত গলায় বলেন,

“জ্যান্ত পুঁতে কেন দাওনি তাদের। নোংরা কিট বেঁচে থাকলে মেয়েরা নিরাপদ থাকবে না।”

“ফুপা চিন্তা করো না তারা বেঁচে থেকেও মৃত্যু। তবে আপনার মেয়ে যা ভাবছে তা পুরোটা উল্টো। সে কোনো ভাবেও রে’প’ড না শুধু সাময়িক সময়ের জন্য ট্রমাট্রাইজড। আমি চাই তাকে খোলামেলা পরিবেশ দিতে। সে যেনো আমাদের মাঝে থেকে নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারে। প্লিজ ফুপা না করবেন না! আর শেহরীনার পরীক্ষাও সামনে। বিয়ের দিনক্ষণ জরুরি ভিত্তিতে পেছানোই হতো। সেই দিনটা তার পরীক্ষার শেষে রেখে দিলাম। ঐদিন বউভাত এর অনুষ্ঠান করা যাবে। শরীয়ত আর আইনগত ভাবে বৃহস্পতিবার আমার ঘরের কাছে থাকা মসজিদ প্রাঙ্গণে বিয়ে করতে চাই।”

নাছির উদ্দিন ছেলের কথায় সন্তুষ্ট হোন। এতে মেয়ে তার পরীক্ষার জন্য সময়ও পাবেন।

বৃহস্পতিবার দুপুর বারোটায়…
সারোয়ার তার শ্যামবতীর জন্য হালকা সাজের অনুরোধ করেছে। সে নিজে একটা পোশাক দিয়েছে শালীন ঘোমটা লাগোয়া আবায়া। সেই পোশাকের মধ্যে সাজ করিয়েছে ইপশিতা। নিজের বান্ধবী কে নিশ্চুপ দেখে সে হতাশ। কয়েকবার হাসানোর চেষ্টা করেছে লাভ হয়নি। বিধেয় সে সাজ করানোর সময়ই বলে,

“দেখবি এবার থেকে তোর মুখের আদল পরিবর্তন হয়ে যাবে। স্বামী স্ত্রীর অপরুপ ধরণে তুই খিলখিলিয়ে হাসবি ইন শা আল্লাহ।”

শেহরীনা নিজের দিকে একপলক তাকায়। আশ্চর্য আয়নার প্রতিবিম্বে এই কে ! এই কী সেই শেহরীনা। যার কালো বর্ণের হেয়ো করে কটাক্ষ করা হতো। এই কী তার রূপের বাহার! যার দিকে তাকালে সবাই নাক ছিটকে দিতো। আশ্চর্য এতো সুন্দর শ্যামা রং ফুটেছে কেনো! তবে কী সারোয়ার এর প্রণয়ের পরিণয়ে এই রং বিস্তৃতি পেয়েছে। ঠোঁটজোড়া কিঞ্চিৎ ফাঁকা হয়ে যায়। ভাবনার মাঝেই শোনা গেল হৈ হুল্লোড়।
‘বর এসেছে বর এসেছে’। পুতুলের ন্যায় সারোয়ার এর সামনে বসানো হলো।
শরীয়ত আর আইনগত দুজনের বিবাহ সম্পন্ন হলো।
সারোয়ার সকলের মাঝ থেকে দাঁড়িয়ে স্বয়ং নিজ স্ত্রীর নিকট এগিয়ে যায়। এতে সকলের ঠোঁটের কোণে মিটিমিটি হাসি ফুটে। শেহরীনা লজ্জায় নিজের বর নামক ব্যক্তির দিকে একপলক সন্ধিক্ষণে তাকায়নি।
কিন্তু সারোয়ার বিয়ের এই প্রহরে নিজেকে স্ত্রীর নিকট প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকবে! কখনো নয়। আসল দিন বর-বউয়ের চোখাচোখির উত্তম দিন,উত্তম মধ্যম। সমাদরে অন্তর ভেদ করার দিন আজ।

“নাউ ইজ মাই টার্ন শেহরীনা। যেই হাত ধরা থেকে আপনি স্বেচ্ছায় পালিয়ে যেতে চেয়েছেন সেই হাত আজ আমি অধিকারের বলে শক্ত ভাবে ধরে নিলাম।”

সারোয়ার কারো পরোয়া না করে নিজ স্ত্রীর হাত আঁকড়ে ধরল। আগমনকারী স্বামীর দিকে শেহরীনা স্তদ্ধ হয়ে তাকায়। প্রিয়অপ্রিয় সংসার কী তবে আরম্ভ হতে যাচ্ছে।

চলবে…..

#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_৩৮ (স্পেশাল মোমেন্ট)

“শেহরীনা তুমি তোমার বাবাকে এতটা ঘৃণা করো মা। হ্যাঁ আমি মানছি তোমাকে আমি মেনে নিতে চাইনি। কী করতাম বলো! তোমাকে মেনে নিলে তোমাকে আর তোমার মাকে কোথায় রাখতাম! একটা ঘর করব তার জন্য হাতে টাকা পয়সা ও ছিল না। কিন্তু এখন আমার কাছে সব কিছু আছে টাকা পয়সা,তোমাকে সুখে রাখার মত ঘর আছে। এইটা কোনো শ্বশুরবাড়ি হলো! আমি তোর জন্য এর চেয়েও বেটার কাউকে খুঁজে বিয়ে দেবো।”

শেহরীনা নিরব। তার মুখভঙ্গি দেখে বোঝা মুশকিল তার মন গলল কী গলল না। জাহানারা পুষ্প মুখ বাঁকিয়ে তাদের মাঝখান এসে বলেন,

“দেখুন জনাব আপনি নিজের ম্যানার ভুলে যাচ্ছেন। আপনি কী জানেন না ভদ্রলোকের বাড়িতে এসে চিৎকার চেঁচামেচি করা যায় না। সেই ক্ষেত্রে আপনি আমার‌ ছেলের বউয়ের সাথে উঁচু গলায় কথা বলার সাহস কোথার থেকে পান!”

শোয়াইব মিলদাজ এর মেজাজ গরম হয়ে আছে। তবুও তিনি যথেষ্ঠ শান্ত থাকার চেষ্টা করছেন। গলায় কাঠিন্য ভাব এনে তিনি মেয়ের দিকে নিস্তেজ চাহনি রেখেই বলেন,

“দেখেন আমি কথা আমার মেয়ের সাথে বলছি। তৃতীয় কেউ না বললেই খুশি হবো।”

“তিনি অবশ্যই বলবেন। বলবেন না শুধু আপনি‌।”

জাহানারা পুষ্প এর ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি ফুটল। তিনি চুপটি করে তাকিয়ে রইলেন। শেহরীনার গাম্ভীর্য রূপ দেখে থমকে যান শোয়াইব মিলদাজ। ভদ্রলোকের দৃষ্টিকোণ দেখে শেহরীনা তার সামনে থেকে দাঁড়িয়ে যায়। শ্বাশুড়ির কাছে গিয়ে থেমে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,

“আপনি কে সেটা নিয়ে আমার ভাবার দরকার নেই। এই যে বারংবার নিজেকে বাবা বলে পরিচয় দিচ্ছেন না। সেটা বন্ধ করুন। সত্যিকার হোক অথবা মিথ্যে অর্থে হোক আমার বাবা একটাই। আর সে হলেন নাছির উদ্দিন। ফারদার আপনাকে যেনো এ বাড়ির চৌকাঠে না দেখি। সম্মানে এসেছিলেন সম্মানে ফিরেও যান। আমার স্বামী আবার খুব ত্যাড়া টাইপের। সেদিনকার কোর্টের সালিশ ভুলে যাবেন না। আমার স্বামীর ব্যাপারে আপনি কিছুই জানেন না।”

শোয়াইব মিলদাজ এর অপমানে মাথা নুইয়ে নিলেন। আকস্মিক উঁচু কণ্ঠে গা’লি দিয়ে তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে যান। শেহরীনার ঘৃণায় চোখ বুঁজে এলো।
ঠাসস করে চ’ড় এর বিকট শব্দ শুনে পেছন ফিরল সে। শ্বশুর কে রক্তিম আক্রোশ নিয়ে শোয়াইব মিলদাজ এর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিনি দুকদম পিছিয়ে যান। রূপালি বেগম এর ভাইকে তার চেনা আছে। বিধেয় নিরব থাকা শ্রেয় ভেবে নিলেন। মোঃ আবু সিদ্দিক আঙ্গুল উঁচিয়ে শোয়াইব মিলদাজ কে হু’মকি দেন।

“ফারদার আমার বউমার নামে কোনো কটাক্ষ আমি সহ্য‌ করব না। সে যেমন আমার বউমা তেমন আমার আপন ভাগ্নি। তার মুখের উপর কথা বলার সাহস আজ করেছিস পরে আমি তোকে ছেড়ে কথা বলব না।”

চ’ড় খেয়ে শোয়াইব মিলদাজ জ্বলন্ত চোখে সবার দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে যান‌। তবে একপলক পেছন ফিরেও তাকান। তার চোখের দৃষ্টিকোণের দিকে শেহরীনা তাকিয়ে রইল। শোয়াইব মিলদাজ এর চোখে প্রতিশোধ পরায়ণ স্পষ্ট ভেসে উঠেছে। তার ভয় না লাগলেও কোথাও এক অস্থিরতা অনুভব করেছে সে। শোয়াইব মিলদাজ চলে গেলে মোঃ আবু সিদ্দিক শেহরীনার কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,

“তোর কোনো ক্ষতি আমরা হতে দেবো না। হতে পারে সে রেগে আছে। তবে বাপ হিসেবে ক্ষতি করবে না। কারণ তোর রগে রগে তার র’ক্ত দৌড়ে বেড়াচ্ছে।”

“না আব্বু আমি চিন্তা করছিলাম না। ব্যস একটু ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম।”

“মুরব্বি মুরব্বি উহু উহু উহু।”

সারোয়ার এর কণ্ঠস্বর শুনে মোঃ আবু সিদ্দিক চোখ পাকিয়ে তাকান। কোমরে হাত রেখে জিজ্ঞেস করেন।

“কে মুরব্বি হুম!”

“কে আবার আপনি! জানেন তো আজ ছেলের বিয়ে করেছে। তার এখন বউকে নিয়ে আকাশ ভরা তারা গুণা দরকার। সেখানে আপনি আমায় তারা গুণা তো কী তারা ছুঁয়ে দেখার সুযোগ অব্দি দিচ্ছেন না।”

মোঃ আবু সিদ্দিক এর মাথাটা বোধ হয় এবার তার ভদ্রর নতুন ভার্সন অভদ্র ছেলে নষ্ট করেই ছাড়বে। কেউ তার বাবার সামনে ঠোঁট কাঁটা কথা বলে। কোথায় আগে তো তিনি সারোয়ার কে এরূপ বাচ্চাদের মত অবুঝ মজা করতে দেখেননি। তবে কী তার ছেলে স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
জাহানারা পুষ্প তাড়া দিলেন সবাইকে।
সাজিয়া তার স্বামী দেওয়ান,ফারদিন,জাফরান সহ তার বউ রোকসানা আর ইপশিতাও আছে। এতক্ষণ যাবত তারা উঁকি ঝুঁকি দিয়ে চেয়েছিল গেস্ট রুমের দরজায়। তবে মোঃ আবু সিদ্দিক বারণ করায় তারা দমে যায়। কেননা নববধু কে গ্রহণ করার পরপর এক ভদ্রলোক এসে সবার খোশমহলে ব্যাঘাত ঘটিয়ে বলেন,

“আমার থেকে শেহরীনার সাথে কথা আছে।‌ প্লিজ কাইন্ডলি সময় দেবেন।”

শেহরীনা যেহেতু একজন ল নিয়ে পড়ুয়া ছাত্রী। সেই হিসেবে তার সাথে কথা বলতে চাওয়াটা বেমানান নয়। সারোয়ার তো রেগে বোম। সে বিন্দুমাত্র রাজি হয়নি। তবে জাহানারা পুষ্প ছেলেকে থামিয়ে শেহরীনাকে সঙ্গে নিয়ে গেস্ট রুমে বসান ভদ্রলোকের সামনে। তখন গেস্টরুমে কী কথা হয়েছে কেউ জানে না। তার কয়েকক্ষণ পরেই ভদ্রলোকের লাল টসটসে চেহারা দেখে তারা অবাক। তবে সারোয়ার সহ শেহরীনার বন্ধু-বান্ধব শান্ত ভঙ্গিতে বসে ছিল। কেননা তারা লোকটাকে ভালো করেই চেনে। তবে সারোয়ার কথা কী বলেছে জানে না। সেও নিশ্চুপ বসে না থেকে শোয়াইব মিলদাজ যাওয়ার পর রুমের দিকে চলে যায়।
ভেতরের ইমোশনাল পরিস্থিতি দেখেই মজার ছলে কথাটুকু বলে ফেলল সে। নববধুর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিলীমা। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট করছে হ্যান্ডসাম যে একজন পেশায় ব্যারিস্টার ও। তার রুচিবোধ কি-না মিডেল ক্লাস,ওল্ড ফ্যাশন টাইপ মেয়ে। এতেই তার মাথায় ধপধপে আগুন ধরছে। কিন্তু তার মায়ের কারণে চুপ করে সহ্য করছে। তার বোনও আহ্লাদে মিলমিশে গেছে। এত আদিখ্যেতা তার সহ্য হচ্ছিল না। মিশকিতা মেয়েকে আক্রোশ ভরা চোখে নববধু শেহরীনার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সকলের আড়ালে মেয়ের হাত শক্ত করে চেপে তাকে টেনেটুনে একটা নিরব রুমে নিয়ে এলেন। দরজা আটকে মেয়ের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন।

“এ কী তুই রাগছিস কেনো!”

“তাহলে কী তুমি চাও আমি বিষ খেয়ে মরি! কেনো এনেছিলে আমাকে। বলো কেনো এনেছিলে। বলছিলে ব্যারিস্টার করা সারোয়ার আমার প্রেমে পড়ে মত্ত হয়ে যাবে। কিন্তু আজ এ কী দেখছি! তারই বিয়ে হয়ে গেল একটা কাইল্লা মেয়ের সাথে।”

“হুস হুস উহ চুপ কর। বাহিরে অনেক মেহমান আছে। আমি কোনো তর্কে জড়াতে চাই না। তুই নিজের দোষেই সারোয়ার কে হারিয়েছিস। তোকে বলেছিলাম ছেলেকে বুঝতে শিখ, তাকে মান্য কর, তাকে দেখিয়ে তার মত চলতে শিখ। কিন্তু তুই কী করেছিস! তুই তার ব্যক্তিগত জীবনেই ইন্টারফেয়ার করার চেষ্টা করে অপমান হয়েছিস। এতে কী সারোয়ার এর হাত আছে! না নেই। তুই নিজেই ভুল মা।”

“ওওহ মা প্লিজ তোমার লেকচার আমার পছন্দ হচ্ছে না। তুমি প্লিজ আমাকে একা ছাড়ো। আমার মাথা আর গরম করো না। আমি আমার মত দেখে নেবো।”

মিশকিতাকে জোরপূর্বক রুম থেকে টেনে বের করে দরজা আটকে দিল। অন্যথায় নিলীমা রাগে গজগজ করে বেলকনিতে গিয়ে পা দিয়ে থাপড়াতে থাকে। শব্দ খুবই নগণ্য হওয়ায়। কারো কানে অব্দি পৌঁছায় না। মিশকিতা মেয়ের রুমের দিকে একপলক তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চলে যান। নিলীমা বেলকনির থেকে শেহরীনার আপাতমস্তক পরখ করছে। তার বেলকনির থেকে কিছুটা দূরেই সারোয়ার এর রুম। শেহরীনাকে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপে। সে বাঁকা হেসে ‘আ’ উচ্চারণ করার পূর্বেই তার রুমের দরজায় কেউ টোকা দেয়। চমকে নিলীমা রুমের ভেতর চলে আসে। তার পরিকল্পনায় কোন পাহাড় আবার বাঁধা দিতে আসল! তা দেখার জন্য দরজা খুলে দেয়। চিকনচাকন গড়নে, ফর্সা রঙের আদল চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তানভির। তাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে আসল নিলীমার। ছেলেটাকে সে চেনে সারোয়ার এর পিএ। মেয়েটার তীর্যক চাহনি দেখেই তানভির কলিজা শুকিয়ে এলো। ভয়ে ঢোক গিলল সে।

“হেই ছেলে ম্যানার নেই একটা মেয়ের রুমের সামনে এসে টোকা দেন।”

“আভ আসলে আমার ওয়াশরুমে যেতে হতো। আমি এখানে ওয়াশরুম কোথায় পাচ্ছি না। সবাই কাজে ব্যস্ত। কোনো স্টার্ফও পায়নি।”

“তো আমি কী করব! আমাকে আপনার ডাইরেকশনাল মনে হয়।”

“না না ম্যাম আপনি রেগে যাচ্ছেন কেনো! প্লিজ আন্টি উত্তেজিত হবেন না। অনেক জরুরি যেতে হবে প্লিজ যদি হেল্প করতেন!”

“তাহলে কী আমার রুমে এসে হিসু করবেন আপনি! চলে যান এখনি। আপনাকে দেখলেই মাথা নষ্ট হয়ে যায় আমার।”

ধরাম করে তানভির মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল নিলীমা। তানভির এর হিসুর প্রচুর চাপ লেগেছে তাই সে ঝুঁকে আছে। কিন্তু মেয়ের তীর্যক রূপখানা দেখে না হেসে ও পারল না। বহু কষ্টে বলে,
‘এই মরিচে দেখি তুরিচের ঝাল ভরে আছে। এখন তো মনে হচ্ছে খুব শীঘ্র এক বয়াম চিনি খেতে হবে।’

তানভির কে ঝুঁকে পড়ে অসহায় হতে দেখে দেওয়ান অবাক চিত্ত হয়ে তার কাছে যায়।

“কী হলো ভাই কে আপনি! একটা মেয়ের রুমের সামনে অভদ্র বেশে ঝুঁকে আছেন কেনো!”

তানভির অবস্থা টাইট হয়ে গিয়েছে। সে এবার কোনো কথা ছাড়াই হাতের বেবি ফিঙ্গার দেখিয়ে কান্নাময় মুখ করে ফেলে। দেওয়ান বুঝতে পেরে তাকে তৎক্ষণাৎ ওয়াশরুমে নিয়ে যায়।

___
সারোয়ার কে সবাই চেপে ধরে আছে। তার মনে হচ্ছে সে কোনো চিড়িয়াখানার প্রাণী। সবাই তাকে দেখে ছবি তুলছে আর সে চিড়িয়াখানার প্রাণীদের মত হেলেদুলে হেঁটে পোজ দিচ্ছে। সাজিয়া ও কেমন বাচ্চামী করছে। সে থাকতে না পেরে বলে,

“উফ এবার আমি যায়। তোরা থাক অথবা মরগে। আমায় যেতে দে প্লিজ!”

সবাই চিৎকার করে থামায়। সারোয়ার বেচারার হার্টবিট কমে যাচ্ছে। সে বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেলে বলে,

“আরেকবার চিৎকার করবি। সব’কটাকে পিটিয়ে উগান্ডায় পাঠাব।”

“আচ্ছা তাহলে আমাদের হাতে ফটাফট বিশ হাজার টাকা দিয়ে দে। তারপর তোর যেখানে ইচ্ছে সেখানে যা।”

‘বিশ হাজার’ শুনে সারোয়ার তব্দা খাওয়ার ভান করল। দুরু দুরু বুক চাপড়ে ছন্নছাড়া চোখে তাকিয়ে বলে,

“ইশ তোদের কাছে না গিয়ে সোজা বউয়ের কাছে যেতাম তাহলেই ভালো হতো। আরে নিমকহারাম তোদের কথা শুনে তো লাগছে আমি বিয়ে করে বউ না আরএফেল শোরুম থেকে দামি প্রডাক্ট এনেছি।”

“বউ কী আরএফেলের চেয়েও কম কিছু! সারাক্ষণ তো তার সাথে চিপকে কাটাবে তখন তো আর সুযোগ পাবে না। আমরা বাবা খুব দুষ্টু। টাকা না পেলে এখনিই তোর বউয়ের কাছে গিয়ে বলব আপু গল্প শুনতে মন চাইছে। চলো না আমাদের রুমে বলে তাকে ধরে রাখব। তখন তোর পেছন থেকে ধোঁয়া বাতাসের সাথে মিশে কার্বন মনোঅক্সাইড তৈরি হবে।”

না সত্যিই সাজিয়া সহ ফারদিনরা তার পথ অবরোধ করে রেখেছে। এই যেনো বিনা অভিযোগে লকডাউনে মারা খাওয়ার মত অবস্থা সারোয়ার এর। তানভির তার কাজ সেরে সবে আসল। নিজের স্যারকে এখন অব্দি বাসররুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তানভির অবাক হয়। সেও এগিয়ে কথা বলার চেষ্টা করে।‌ তানভির কে দেখে সারোয়ার তাকে টেনেহিঁচড়ে তার পকেট হাতড়ে একটা কার্ড বের করে। সেটা তাদের হাতে ধরিয়ে বলে, ‘টাকা ট্রান্সফার করে নিস’। সবাই খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে যায়। শেহরীনা অস্থির মনে বিছানার উপর বসে আছে। সারোয়ার কে প্রবেশ করতে দেখে তার পা ছুঁইতে নিলে স্বামী হিসেবে সে তাকে থামিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,

“এই স্থানটা অনুভব করো বউ। এটা তোমার জন্য নতুন স্থান। ঐ পা হলো হাঁটাচলা করার জন্য। এটা ছুঁয়ে দেখো এইটা ছুঁতে ছুঁতে একদিন খুব আপন হয়ে যাবে। আমাদের আপনত্ব বাড়ায় এটা।”

শেহরীনা নিশ্চুপ। সে ঘ্রাণ পাচ্ছে এক কড়া পুরুষেলী সুবাস। স্বামীর গলার কাছ থেকে সেই ঘ্রাণ প্রাণ ভরে শুঁকে একটানে নিজেকে সামলে নেয়।লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)সারোয়ার চাই না দাম্পত্য জীবন আগাতে মেয়েটা বিড়ম্বনায় পড়ুক। বিধেয় সে গলা ঝেড়ে বলে,

“চন্দ্র পূর্ণিমা বিলাস করবে! আজ পূর্ণিমা কোণে ছোট এক চন্দ্র কে দেখবে। যেটা অতৃপ্ত হয়ে আকাশে ভেসে উঠে।”

শেহরীনার মৌনতা দেখে সারোয়ার আলগোছে তাকে পাঁজাকোলা করে বেলকনিতে নিয়ে বসায়। বড় আকাশে ছোট এক চাঁদের টুকরো। ইশ কেমনে জ্বল জ্বল করছে! বড্ড অমায়িক লাগছে শেহরীনার কাছে। সারোয়ার সহ্য করল না টুপ করে মেয়েটার দুচোখে চুমু খেয়ে ফেলল। বউ সে একটু চুমু খেলে কিছু হয় না। শেহরীনা চোখ পিটপিট করে তাকালো। আচমকা সে বলে উঠে,

“কালকে থেকে আমি বাবার বাড়িতে থাকব।”

মেজাজটা ভেজায় গরম হয়ে গেল সারোয়ার এর। সে চরম আশ্চর্যান্বিত দৃষ্টিতে নিজের সদ্য বিবাহিত বউয়ের দিকে তাকায়। মেয়েটার মাথায় কী খালি দূর,পালাই এসব ঘুরতে থাকে! খালি দূরে পালিয়ে বেড়ানোর ধান্দা এই মেয়ের।

“বউ তুমি দেখি বড্ড নিষ্ঠুর। আমার মত নিষ্পাপ জামাই কে বউহীন করে দিতে চাইছো। এর জন্য তোমার শাস্তি হবে প্রতিরাতে দরজা খোলা রাখবে। আমি এসে সোজা তোমার গলায় মুখ ডুবাবো। এক বাচ্চা যেমন তার মায়ের বুকে দুধ পান খুঁজে তেমন আমিও বউয়ের গলায় কামড়ে কামড়ে সুখ খুঁজব। তখন কিন্তু তুমি আমায় মানা করতে পারবে না।”

“আপনি একটা পাভার্ট বয় জানেন সেটা! বাবা-মায়ের সামনেও নির্লজ্জ ঠোঁট কাঁটা কথা বলতে পিছপা হোন না।”

বেলকনির অপরপাশ দিয়ে কে যেনো বলে উঠে,
‘স্যার আমি কী চোখে কোনো সর্ষে ফুল দেখছি।’

সারোয়ার এক সেকেন্ডে ধরে ফেলল কণ্ঠস্বর। ছেলেটার কারণে তার রোমান্টিক ভাবসাবে তেরোটা বেজে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে তানভির এর উদ্দেশ্যে বলে,

“যদি সত্যিকারের সর্ষে ফুল দেখতে চাস তাহলে রুমে আয়। তোকে আমি সর্ষে ফল, ফুল, লতাপাতা,চাঁদ, তারা, সূর্য দেখিয়ে দেবো।”

তানভির ভয়ে তৎক্ষণাৎ সেই বেলকনির থেকে সরে গেল। এর মাঝে সারোয়ার দেখল শেহরীনা তার চোখের আড়ালে ওয়াশরুম ঢুকে পড়েছে। বিকৃত মুখ করে তানভির কে দুয়েক গালি দিয়ে বলে,

“তানভি তোকে আমি বনবাসে পাঠাব। আমার রোমান্সের দুশমন সব’কটা। একটুখানি বউয়ের কাছে গেলেই সবার দুনিয়ার কাজ মনে পড়ে। দূরে থাকলে তো কথাই নেই। তখন তো বউকে হারিকেন দিয়ে খোঁজা লাগে।”

চলবে…..