জলকাব্য পর্ব-১৮ এবং শেষ পর্ব

0
842

#জলকাব্য
#অন্তিম_পর্ব(প্রথম অংশ)
#Suraiya_Aayat

শ্রাবণ এখনো কনফিউজ নীলু ওকে আগের দিন কি বলেছিল , আসলে মেয়েটাকে যখন দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসা করতে গেলো মেয়েটা তখন ঠিক করে কিছুই বলল না আর তাছাড়া অত রাত্রেবেলা নীলুর ঘরে গিয়ে আবার একটা কথা শোনার জন্য বারবার নীলুকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না বলে শ্রাবণ জোর করেনি , কিন্তু পুরো একটা রাত পার হয়ে গিয়ে এখন সকাল সাড়ে দশটা বাজে তবুও শ্রাবণ এখনো বুঝতে পারছে না যে নীলু ঠিক কি বলেছে ৷ আচ্ছা মেয়েটাকে কি ওর এখন জিজ্ঞাসা করে দেখা উচিত?
ঠিক করে তো কিছুই শুনতে পায়নি কি বলেছিল তাই জিজ্ঞাসা করবে যে কি বলেছিল ৷ শ্রাবন কথাগুলো ভাবলো,যেই ভাবা সেই কাজ, নীলুর কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই নীলু গটগট করে হেটে ওর রুমে হাজির, শ্রাবন একপ্রকার চমকে গেল প্রায় ৷ শ্রাবনকে কোনরকম পাত্তা না দিয়ে শ্রাবনের আলমারির দিকে গেল নীলু, একটা ব্লু বেরি কালারের শার্ট নিয়ে দেখতে লাগলো ৷ শ্রাবন অবাক চাহনিতে নীলুর দিকে চেয়ে আছে ৷ শ্রাবণ লক্ষ করেছে আজকাল নীলু একটু অদ্ভুত ব্যবহার করে ওর সাথে যা শ্রাবণের কাছে বড়ই অদ্ভুত বলে মনে হয় কারণ শ্রাবণ লক্ষ্য করেছে যে ওর প্রতি মিলুর একটা অধিকারবোধ জন্মেছে, আজকাল বড্ড অধিকার খাটায় মেয়েটা , কিন্তু কিসের পরিপ্রেক্ষিতে সেটা ও বুঝে না ৷ নীলু মেয়েটা বড্ড চাপা স্বভাবের , কখনোই তেমন কিছু বলেনা কিন্তু কাজের মাধ্যমে ঠিকই কিছু একটা ইঙ্গিত করতে চায় বারবার ৷ শ্রাবনের ভাবনা ভেঙে নীলু একটা ব্লুবেরি কালারের শার্ট এনে শ্রাবণের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল
” বিকালে গড়িয়া যাচ্ছি, তুমি আমার সাথে যাবে তাই এটা পরে রেডি থেকো , বেশি দেরি করো না যেন, তাহলে যে কাজ আছে সেটাই হয়তো আর হবে না ৷” কথাটা বলে নীলু চলে যেতে নিলেই শ্রাবণ নীলুকে ডেকে উঠলো ৷ ” কিন্তু আমরা সেখানে কিসের জন্য যাচ্ছি?”
নীলু একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল
“একটা বিহিত ঘটাতে যাচ্ছি, হয় এসপার নয় ওসপার ৷”
শ্রাবণ নীলুর কথায় কিছু একটা বুঝল তাই নীলুকে আর বেশি ঘাঁটতে চাইল না , ও জানে যে নীলু ওকে নিয়ে যাচ্ছে নিশ্চয়ই তার কোনো কারণ আছে তাছাড়া সেখানে গেলেই জানতে পারবে ব্যাপারটা কি ৷ আর নীলু যখন এখনো সবটা খুলে বলেনি তখন বিষয়টা না হয় শ্রাবনের কাছে একটু চমকের মতোই থাকুক ৷
কথাটা বলে নীলু ঘর থেক বেরিয়ে গেল ৷ মনটা আজ ভারী,ও জানে না যে মিঠি আসলে কি চাইছে , ওর উদ্দেশ্যেটা কি ৷মিঠির কথা খানিকটা হলও বিশ্বাস করেছে নীলু তার কারন কোর্টে রুদ্র ওকে তার কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়েছে যদিও তা নোংরা ইঙ্গিতে, তাই যদি মিঠির সাথে রুদ্র সুখী থাকতো তাহলে রুদ্র কখনো নীলুকে কেস ছেড়ে তার কাছে ফিরে যাওয়ার কথা বলতো না ৷তাই নীলু অনেকআংশে সব ঘটনা গুলো মিলিয়ে নীলুর কথা বিশ্বাস করতে চেয়েছে ৷

“আমরা কোথায় যাচ্ছি নীলু ? সকালে জিজ্ঞাসা করিনি কিন্তু এখন আমরা প্রায় লোকশনে চলেই এসেছি তাই এখন তো জনাতেই পারি তাইনা ?”
নীলু বাইরের দিকে খানিকটা উঁকি মারার চেষ্টা করে দেখতে লাগলো ৷ শ্রাবনের করার উত্তর না দিয়ে বলতে লাগলো ” দাদা এখানে থামান, আমরা এখানেই নামবো ৷”
শ্রাবন খানিকটা অবাক চোখে তাকালো ৷ নীলু এখনো ওকে বললো না ৷ ওরা দুজন গাড়ি জেকে নেমে এলো ৷ ওরা একটা কফিশপের সামনে নেমেছে, লোকশন অনুযায়ী এই জায়গাটাই ৷ নীলু এদিক ওদিক তাকিয়ে কোথায় মিঠিকে পেলো না ৷ নীলু এবার ওর ফোনটা বার করে মিঠির নাম্বারটা খুঁজতে লাগলো,নাম্বারটা আর সেভ ও করেনি নীলু , তবুও ওর ফোনে কারোর ফোন আসে না শ্রাবন ছাড়া তাই নাম্বারটা খুঁজতে বেশি দেরি হলো না ৷নাম্বারটা খুঁজতে খুঁজতে শ্রাবণ আবার প্রশ্ন করে উঠলো
” আমরা এখানে কি করতে এসেছি নীলু ৷” নীলু এবারও শ্রাবনের কথার কোন উত্তর দিলো না, আসলে সবকিছু নিয়ে মনের মাঝে এতো এতো ভয় কাজ রছে তে শ্রাবনকে কথাটা বলার মতো সাহস জুগিয়ে উঠতে পারছে না তাই একপ্রকার ভয়েই বলছেনা, তাছাড়া মিঠি যদি না আসে তখন শ্রাবন না জানি আরো কতো কিছু বলে ওকে বকাবকি শুরু করবে তাই মুখ বন্ধ করেই আছে , যতখন ইগনোর করে পারা যায় ৷
নীলু এবার ও কিছু বলছেনা দেখে শ্রাবনের এবার চরম বিরক্তি লাগলো ৷
হঠাৎ নীলু কল করতে যাবে তখনই একটা মেয়েলি কন্ঠস্বর ওর কানে ভেসে আসলো ৷ নীলুর আর বুঝতে বেশি সময় লাগলো না এটা কার গলা ৷ মিঠির দিকে ঘুরে তাকাতেই মিঠি বলল ” কেমন আছো ?”
নীলু শান্ত কন্ঠে বলল ” যেমন থাকা উচিত ৷ যাই হোক যেটা বলতে চাইছো সেটা বলো ৷”

মিঠি মুচকি হেসে বলল ” ভিতরে বসে কথা বলি ?”
নীলু হ্যাঁ সম্মতি জানালো ৷ শ্রাবন ওদের এই আলাপচারিতা দেখে বুঝলো যে এটা মিঠি, এর আগে ও কখনো মিঠিকে দেখেনি তাই প্রথম দেখাতে চিনতে পারেনি ৷ শ্রাবনের নীলুর ওপর রাগ হতে লাগলো, এই মেয়ে এতকিছুর পরেও কি করে দেখা করতে এলো সেটা ভেবে ৷
ওরা ভিতরে গিয়ে বসতেই মিঠি বলে উঠলো
” যেটা বলতে চাইছিলাম সেটা হলো আই ওয়ান্ট টু হেল্প ইউ ৷ রুদ্রর এগেইনস্টে আমি তোমার হয়ে হাজিরা দেবো,তোমার সাথে যা যা অবিচার হয়েছে আমি সেসব কথা আদালতে জানাবো ৷”

নীলু খানিকটা তাচ্ছিল্যর হাসি হেসে বলল
” আমার প্রতি অবিচার হয়েছে বলছো?”

মিঠি এবার মাথা নীচু করে অনিকটা ভেবে বলল
” হ্যাঁ হয়েছে, আমিও রুদ্রর সাথে সামিল হয়ে তোমার প্রতি অবিচার করেছি, তবে তোমার বেবি নষ্টের পিছনে আমার কোনভাবেই কোন হাত ছিলো না, ওটা রুদ্র করেছে , তবে আমমি রুদ্রকে ভীষনভাবে চাইতাম ওকে ভালোবাসতাম তাই…”
মিঠির কথা থামিয়ে নীলু বলল
” তাই !তাই কি ? এখন আর ভালোবাসো না ? এখন আর তাকে চাও না বুঝি ? ”

” নাহ এখন আর তাকে চাই না তার কারন সে আমাকে অত্যাচার করছে , তার সাথে আমার থাকা কোনভাবেই পসিবল না ৷ ও আমাকে কোনভাবেই ডিভোর্স দিতে রাজি নয় বাট আই ওয়ান্ট ডিভোর্স ‌৷”

নীলু কিছু বলতে যাবে তার আগেই শ্রাবন বললো
” তা অত্যাচার গুলোকে এনজয় করছেন তো ? নাকি এখন সে অন্য পরকীয়াতে লিপ্ত হয়েছে তাই আপনার প্রয়োজন শেষ ‍, কোনটা ? আপনাদের মতো মানুষদের সম্পর্ক গুলোই তো গড়ে ওঠে পরকীয়াকে কেন্দ্র করে ৷ তাহলে এখন বিরক্ত হচ্ছেন কেন?”

মিঠি বুঝতে পারলো যে রুদ্র ওকে ইচ্ছা করে কথাগুলো শোনালো তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বলল
” আসলে আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি , আর তাকেই বিয়ে করতে চাই ৷ রুদ্রর অত্যাচার আমি আর সহ্য করতে পাচ্ছি না, আই নিড ডিভোর্স,তাছাড়া নীলুকে ডিভোর্সের জন্য আমিই ওকে জোর করেছিলাম কিন্তু এখন আমিই ওকে ডিভোর্স দিতে চায় ৷”

মিঠির কথাটা শুনে শ্রাবন হো হো করে হেসে উঠলঝ,নীলু একটা বাঁকা হাসি দিলো , আসলেই আজ প্রমান হলো যারা অন্যর সংসার ভঙে তারা নিজেরাও কখনো সুখী হতে পারে না ৷
নীলু বলে উঠলো ” তা রুদ্রর বিরুদ্ধে প্রমান দেওয়াতে তোমার স্বার্থটা বুঝলাম না ৷ কাইনডলি যদি বলতে ৷”

” আসলে আমি ওর কাছে ডিভোর্স চেয়েছি , ও আমাকে ডিভোর্স দিতে রাজী না, ওর কথা হলো আমার কারনেই ও তোমাকে ছেড়েছে, এখন তুমিও ওর হাতের বাইরে আর আমিও ওর হাতের বাইরে চলে গেলে ওর কাছে আর কিছুই রইলো না , তাই আমি চাই যাতে ও ওর শাস্তি পাক আর আমিও তার সাথে ডিভোর্স এর জন্য কোর্টে আপিল করবো তখন সে ডিভোর্স দিতে বাধ্য হবে ৷ আমি আবার নিখিলের সাথে জীবন শুরূ করতে চাই ৷”

নীলুর ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে উঠে মিঠিকে কয়েকটা ঠাস ঠাস করে চড় মারতে , আর চেঁচিয়ে বলতে
” ভীষন ভাবে ঘৃনা করি তোমাদের, ভীষন ভাবে ৷”
নীলুর চোখে জল চলে এসেছে, তাদের ক্ষনিকের আবেগে ওর জীবনটা নষ্ট ৷ নীলু নিজেকে অনেক শান্ত রেখে বলল ” পরশু আমাদের কোর্টে কেসের ডেট আছে তাই সেখানে তোমার উপস্থিতি আশা করছি , তুমি সেদিন. উপস্থিত না হলে তুমি পুলিশের কাস্টাডিতে চলে যাবে তখন হয়তো তোমার আর নিখিলকে বিয়ে হবে না, আর রুদ্রর হাত থেকে মুক্তিও পাওয়া হবে না ৷এখন তুমি ঠিক করো কি করবে ৷

মিঠি কফির কাপে চুমুক দিয়ে টিসু দিয়ে ঠোঁটের লিপস্টিকের ওপর থেকে কফি মুছে বলল
” আমি সেদিন তোমার হয়ে সাক্ষী দেবো চিন্তা করো না ৷ তাহলে আজ তবে আসি ৷”

শ্রাবন বলে উঠলো ” কি ভীষন তাড়া নাকি ৷ নতুন বয়ফ্রেন্ডের কাছে যাচ্ছেন নাকি ৷”
মিঠি দাঁতে দাঁত চেপে বলল ” বয়ফ্রেন্ড না সে আমার ফিয়ন্সে ৷ তার বাড়িতে আজকে আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কথা হবে ৷”

নীলু প্রশ্ন করে উঠলো ” এই বিকালে ?”

“নাহ রাতে ৷”
নীলু মুচকি হেসে বলল ” সবাধানে থেকে এটাই দোঁয়া করি ৷” মিঠি এটা মিথ্যা হাসি দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো ৷ পরনে আছে ওয়ান পিস, হাতে একটা ব্যাগ আর চোখে সানগ্লাস,মেয়েটার রুপ দেখেই হয়তো রুদ্র আকৃষ্ট হয়েছিলো ৷

____

শাওয়ারের নীচে বসে চিৎকার করে কাঁদছে মিঠি ৷ কিন্তু আফসোস আজ ওর কান্না শুনে ওর কাছে ছুটে আসার মানুষ নেই , কেউ ওর কাধে হাত রেখে ওকে সাহস জোগানোর কেউ নেই ৷ বিয়ে আগে রুদ্রর সাথে পরকীয়া করে শর নিজের শরীর বিলিয়ে দিয়েও কখনো এমন অনুভূতি হয়নি যেমনটা আজ হচ্ছে, আজ ওর নিজেকে ধর্ষিতা মনে হচ্ছে , বারবার কানে বাজছে নিখিলের বলা কথাগুলো আর নিখিলের সেই চেহারা যা মিঠির চিনতে ভুল হয়েছিলো ৷

নীলু আর শ্রাবনের সাথে দেখা করার পর মিঠি নিখিলের ফ্ল্যাটে গেল ৷ কলিংবেল বাজাতেই নিখিল দরজাটা খুলল ৷ মিঠিকে দেখে নিখিল হাত ধরে টেনে নিয়ে ওর বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো ৷ মিঠি লজ্জা পেয়ে বলল ” আরে কি করছো টা কি , তোমার বাবা মা আছে, ওরা দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হবে , কি না কি ভাববে ৷”
নিখিল মিঠির শুনে এর এপাশ ওপাশ তাকিয়ে বলল ” কোথায় আমার বাবা মা ? আর কই আমিতো ওদের দেখতে পাচ্ছি না ৷”
মিঠি অবাক হয়ে নিখিলকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল
” মনে ! তুমি না বলেছিলে আজ মুম্বাই থেকে তোমার বাবা মা আসছেন আমাদের বিয়ের কথা বলতে তাহলে !”
নিখিল মুচকি হেসে বলল ” আরে ওগুলো তো মজা করে বলে ছিলাম ৷বাড়িতে আমি আর জ্যাক ছাড়া কেউ নেই ৷ আমরা কি এখন বিয়ে করছি নাকি ? আমরা তো আগেরুম ডেট করবো তাইনা ৷”
মিঠি নিখিলকে ধাক্কা মেরে বলল ” মানে টা কি নিখিল , তুমি আমাকে মিথ্যা বলে এখানে আনলে ! আর আমি তো তোমাকে বলেছিলাম আমি কোন রুমডেট করবো না, আমি বিয়ে করবো ৷”
নিখিল এবার মিঠির কাছে গিয়ে মিঠিকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল ” ওকে কুল, তুমি রুমডেট করবেনা, বিয়ে করবে তাইতো ?” মিঠি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সম্মতি জানালো ৷ তখনই হঠাৎ নিখিল মিঠির চুলে মুঠি ধরে বলল ” তোর মতো মেয়েদের কে নিখিল বিয়ে কেন ছুঁয়েও দেখে না ৷ তাই তোর জন্য জ্যাক ই পারফেক্ট ৷”
কথাটা বলে নিখিল মিঠিকে ঠেলে ছুড়ে ফেলে দিতেই মিঠি একটা লোকের গায়ে গিয়ে পড়লো, তার নামই জ্যাক ৷
মিঠির ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে, ভয়ে কাঁপছে, নিখিলের হঠাৎ এমন অদ্ভুত কথা মানতে কষ্ট হচ্ছে ৷ নিখিল টেবিল থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে বলল
” জ্যাক নাও সি ইজ ইউরস ৷ আই উইল বি ব্যাক এট নাইট ৷”
নিখিল দরজা দিতে গেলেই মিঠি দৌড়ে ছুটে যেতে গেলেই জ্যাক ধরে ফেলল ৷ মিঠি কাঁদতে কাঁদতে বলল
” নিখিল প্লিজ আমাকে যেতে দাও, তোমার আমাকে বিয়ে করতে হবে না , শুধু আমাকে যেতে দাও ৷”
আর বেশি কিছু বলতে পারলো না, জ্যাক মিঠিকে টেনে নিয়ে গেল ৷

কথাগুলো ভাবছে আর চিৎকার করে কাঁদছে মিঠি ৷

#চলবে,,,,

#জলকাব্য
#সমাপ্ত_পর্ব(শেষ অংশ)
#Suraiya_Aayat

রাতের আকাশে মিটমিট করে তারা জ্বলছে, ছাদের কার্নিশ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ , বাইরে শুষ্ক বাতাস বইছে , জোছনা রাত না হলেও শহরের ছোট অলিগলিতে থাকা ল্যাম্প পোষ্টের আলো গুলোতে চারিপাশে আলোর আবরণে ছেয়ে গেছে ৷ এই শহরে রাত হলেও তা আলোর ছটায় অনুভব করার জো নেই ৷ গ্রামাঞ্চলের পরিবেশ কতোই না সুন্দর হয়, সেখানে রাতের অন্ধকার সমস্তটাকে গ্রাস করে, থেকে থেকে ঝিঝি পোকার ডাক কানের মধ্যে একপ্রকার বেদনা দেওয়াতে মত্ত হয় ৷ শ্রাবন চোখটা বন্ধ করলো ৷ শরীরটা খুব দূর্বল লাগছে, কোন কিছুর চিন্তাতে ভীষন রকম একটা শরীর কাঁপানো নারভাসনেস কাজ করছে ওর মধ্যে ৷ হঠাৎ কারোর পায়ের আওয়াজে শ্রাবনের শরীরটা খানিকটা কেঁপে উঠলো ৷ বেশ চমকালো ভঙ্গিতে তাকিয়ে দেখলো নীলু দাঁড়িয়ে আছে ৷ মেয়েটার মুখটা কেমন যেন থমথমে লাগছে যা শ্রাবণ সেই নীরস শহরের বিষন্ন আলোতেও বুঝতে পারছে যে নীলু এসেছে ৷ নীলুর উপস্থিত বুঝেও শ্রাবণ চুপ করেই রইলো ৷ নীলু মিঠির সাথে দেখা করতে যাবে শ্রাবণ সেটা কখনো ভাবেনি, যদিও এতে তাদের উপকারই হয়েছে তবুও নীলুর ওপর কোন কারনবশত একটা চাপা অভিমানের জন্ম নিয়েছে ৷নীলু গিয়ে শ্রাবনের পাশে দাঁড়ালো তবে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখেই , কাছে আসার অধিকার টুকু হয়তো এখনো ও অর্জন করে উঠতে পারেনি ৷ কিছুখন চুপ থেকে নীলু একটা গম্ভীর নিশ্বাস ফেললো ৷ শ্রাবনের প্রতি ওর একটা অনুভূতির জন্ম নিয়েছে, তা নীলু আগে না বুঝলেও এখন বেশ ভালোই বুঝতে পারে , কিন্তু নীলু প্রকাশ করতে নিরুপায় ৷ মনের মাঝে একরাশ দোটানা কাজ করছে ৷ শ্রাবণকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসাবে বেছে নিলে হয়তো জীবনের একটা সঠিক সিদ্বান্তটাই নেবে ও ৷ আসলেই শ্রাবণ ঠিকই বলেছিলো যে যেদিন নীলু ওর ভালোবাসা বুঝবে সেদিন বড্ড দেরি করে ফেলবে নীলু ৷ আর ঠিক তেমনটাই হয়ে চলেছে ৷ শ্রাবণ আর এখন আগের মতো নীলুর প্রতি অনুভূতির প্রকাশ করে না, বারবার আর নীলুকে এটা বোঝানোর চেষ্টা করে না যে সে নীলুকে কতোটা ভালোবাসে , সে নীলুকে ঠিক কতোটা চাই, সেই ভয়েই হয়তো মনের মাঝে দোটানাটা বেশী ৷ নীলুর গলা শুকিয়ে কাঠ ৷ এই কদিন ধরে কেবল শ্রাবণের গতিপ্রকৃতি লক্ষ করেছে,শ্রাবণকে দূর থেকে যতোটা সম্ভব বোঝার চেষ্টা করেছে , শ্রাবনের জন্য ওর মনের মধ্যে এক বিশাল অনুভূতির জন্ম হয়েছে যা না প্রকাশ করলেই নয় ৷ নীলু শ্রাবণের দিকে তাকালো আগের মতোই চুপচাপ আছে , যাতে করে ওর ভয়টা দ্বিগুন হচ্ছে ৷ নীলু একটা শুকনো ঢোক গিলে বললো
” মন খারাপ ?” শ্রাবন অন্ধকারের মধ্যে মাথা নাড়ালো যা নীলুর চোখকে ফাঁকি দিলো না, নীলু আবার প্রশ্ন করলো ” কোন কারনে চিন্তিত ?” শ্রাবন এবার নীলুর সাইড বরাবর দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকালো ৷ তারপর চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল ” হমম ৷”
নীলু প্রশ্ন করলো ” কারনটা বলবে ?”
শ্রাবণ বিরষ কন্ঠে বলল ” পরশু গানের কম্পিটিশনের ফাইনাল রেজাল্ট তারপর পরশু আবার কেসের ডেট , ভয় লাগছে আর তার সাথে একটা নারভাস নেস ও কাজ করছে প্রবল ৷ ভয়ে নীলুর চোখে জল জমে এলো, তবু নিজেকে সামলে বলল ” চিন্তা করো না ভাইয়া সব ঠিক হবে ৷” নীলুর মনের মাঝে ভয়টাও বেড়ে গেল, আজ শ্রাবণের চিন্তাগুলোকে নিজের চিন্তা বলে মনে হচ্ছে ৷ শ্রাবন শুকনো কন্ঠে বলল ” হমম ৷ তবে আমার পোগ্রাম রাতে তাই কেসের দিন আমিও তোর সাথেই যাবো ৷” কথাটা শুনে নীলু শ্রাবনের দিকে ছলছল চোখে তাকালো , মনের মাঝে পাথরটা যেন ক্রমে ক্রমে সরে গিয়ে ভয়টা কাটছে , এভাবে হয়তো মানুষটা পাশে থাকবে আর ওদের ও একটা দিন আসতে চলেছে , যেদিন থাকবে না কোন পিছুটান আর না কোন কষ্ট ৷

” একি তুমি আজ কোথায় যাচ্ছো ? তোমাকে বলেছিলাম না কোর্টে যেতে হবে সেখানে আমার হয়ে সাক্ষী দিতে হবে ৷ তুমি কি সব ভুলে গেছো ?”শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল রুদ্র ৷
মিঠি ওর ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল
” কোর্টে যাচ্ছি তোমার হয়ে সাক্ষী দেবো , গাড়িতে অপেক্ষা করছি তাড়াতাড়ি এসো ৷” অথাটা বলে মিঠি চলে গেল নীচে ৷ রুদ্র একটা বাকা হাসি দিলো আর বলল ” যাক ফাইনালি পাখি বশ মেনেছে ৷”

রুদ্র গাড়ি চালাচ্ছে আর মিঠি ওর পাশে বসে আছে ৷ মিঠি রুদ্রর সাথে আর একটাও কথা বলেনি দুজনেই চুপচাপ , মিঠি যেন দিনের পর দিন ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে, অফিসের চাকরিটাও আর নেই, গতকাল রাতেই অফিসের ম্যানেজার মিঠিকে ফোন করে জানিয়েছে যে পরেরদিন থেকে তার আর অফিসে আসার দরকার নেই, কারন জিজ্ঞাসা করলে বলল ” স্যার বলেছেন যে অফিসে আপনার মতো স্টাফের দরকার নেই ৷” কথাগুলো শুনে মিঠি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো ৷ নিখিলের বলা শেষ কথাগুলো ওর কাধে বাজে আজ চোখে ভেসে ওঠে সেদিধ সন্ধ্যার সেই ঘটনা আর জ্যাকের সেই হিংস্র রুপ ৷ মিঠি কথাগুলো ভাবে আর তখনই ওর চিৎকার করে কেঁদে উঠতে ইচ্ছ করে ৷ প্রথমে তো ওর বাঁচার ইচ্ছাই শেষ হয়ে গিয়েছিলো , পরে ভাবলো যে আজ নীলু এতো কিছু না করলে ওর এই পরিস্থিতি হতো না ৷ না নীলু ওর আর রুদ্রর জীবনে আসতো আর না ওকে ধর্ষিতা হতে হতো না ৷ তাই ওর এই অবস্থার জন্য ও নীলুকে দায়ী ভাবে ৷ তাই এই কেসে নীলুকে ফাসিয়ে দিয়ে ও শান্তি পেতে চাই , আর রুদ্রর সাথে সব,ঝামেলা মিটিয়ে আবার সংসার করতে চাই ৷ যদি রুদ্র ভুল করেও একবার নিখিলের কথা জানতে পারে তাহলে কখনোই ওকে মেনে নেবে না ৷ তাই মিঠিকে ঘূনাক্ষরেও রুদ্রকে কিছু আঁচ ও করতে দেয়নি , তাতে ওরই বিপদ ৷
গাড়ি চালাতে চাহতে রুদ্র বলল ” কোর্টে হাজিরা দিচ্ছো মানে এই না যে তুমি ডিভোর্স পেয়ে যাবে ৷ তোমাকে আমি ডিভোর্স দেবো না , তোমাকে ডিভোর্স দিলে আমার চাহিদা পূরন করবে কে? নিজের চাহিদা মেটানোর জন্য কি আমি বারবার বিয়ে করবো নাকি ? তাই ডিভোর্সের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও ৷” মিঠি চুপচাপ শুনলো, কিছু বললো না , ও তো এটাই চাই এখন যে রুদ্র ওকে ডিভোর্স না দিক ৷ কথাগুলো বলে রুদ্র গাড়ি চালানোতে মন দিলো ৷

কোর্টের কেসের কার্য প্রক্রিয়া শুরু হবে 12 টাতে , এখন বাজে 11.55 , আর কিছুখন পরই জজ সাহেব চলে আসবেন, কিন্তু মিঠি এখনো এলো না, আর না রুদ্র এলো ৷ নীলুর মনের মধ্যে উথল পাথাল হচ্ছে, তাহলে কি মিঠি আসবে না ? মিঠিকে বিশ্বাস করাই ওর ভুল হয়েছে ৷ শ্রাবন নীলুর পাশে বসে আছে,আর নীলুর কার্যকলাপ দেখছে,সেই থেকে জিয়ল মাছের মতো ছটফট করছে নীলু , পারলে এখান থেকে বেরিয়ে মিঠিকে খুঁজতে শুরু করে ৷হঠাৎ নীলু খেয়াল করলো যে মিঠি আর রুদ্র ঢুকছে , নীলু মিঠিকে দেখে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলো ৷ নীলুর সাথে মিঠির চোখাচোখি হতেই মিঠি অদ্ভুত এক ভঙ্গিতে নীলুরদিকে আক্রোশ নিয়ে তাকালো, নীলু মিঠির তাকানোর ভঙ্গি দেখে শিউরে উঠলো, তাহলে কি ওর ধারনাটাই ঠিক মিঠি ওর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো ৷নীলুর শরীর থরথর করে কাঁপছে, শ্রাবন নীলুকে লক্ষ করে বলল ” কি হয়েছে এভাবে কাঁপছিস কেন? শরীর খারাপ ?” নীলু ক্রমাগত ভয়ে কাঁপছে ,শ্রাবন মিঠির দিকে তাকিয়ে নীলুর হাতটা শক্ত করে ধরলো আর নীলুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
” এটুকু জেনে রাখিস যে তোর গায়ে কখনো কোন আঁচ আসতে দেবো না, ঢাল হয়ে তোর সাথে থাকবো ৷”
নীলুর চোখ দিয়ে টুপিয়ে টুপিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে , শ্রাবন নীলুর চোখের জল মুছে বলল ” আমি আছি তোর সাথে সবসময় , আর তুই চাইলে আজীবন ৷”
নীলু শ্রাবনের দিকে জলভরা চোখে তাকিয়ে আছে , মুখের ভাষা যেন থেমে গেছে ৷ জর্জ যথা সময়ে আসাতে নীলু চোখ মুখে তাদের কাজে মনোযোগ দিলো ৷ নীলুর উকিল জরখজের থেকে পারমিশন নিয়ে মিঠিকে হাজিরা দিতে ডাকলেন আর সাথে ওনার প্রশ্ন শুরু করলেন ৷
” আচ্ছা আপনার নাম কি ?” মিঠি বেশ সাবলীল আর কনফিডেন্সের সাথে উত্তর দিলো ” জ্বি মিঠি আহমেদ, ওয়াইফ অফ রুদ্র আহমেদ ৷” উকিল বললেন ” তা মিসেস মিঠি আপনার সাথে মিঃ রুদ্রর বিয়ে হয়েছৈ ঠিক কতোদিন আগে ?”
” 1 মাস প্রায় ৷”

“আপনার স্বামীর বিপরীত পক্ষ মিস সারিকা নীলাঞ্জনা দাবী করেছেন যে আপনি এবং আপনার স্বামীর যৌথ কাজে এবং তা অত্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক আপনারা তার থেকে টিপছাপ নিয়ে তাকে ডিভোর্স নিতে বাধ্য করেছেন ৷ কথাটা কতোটা ঠিক ৷”

মিঠি নীলুর দিকে ক্ষোভের দৃষ্টিতে তাকালো আর বলল ” উনি যা বলেছেন তার কোনটাই সত্য নয় ৷ উনি আদালতকে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন ৷ তিনি রুদ্র আহমেদের সাথে সম্পর্ক রখতে চাননি, তাছাড়া ওনার পাশে যেই পুরুষটি বসে আছেন তার সাথে ওনার গভীর সম্পর্ক আছে আর ছিলো তাই তিনি নিজের ইচ্ছাতেই ডিভোর্স দিয়েছেন ৷”
মিঠির থেকে এমন কথা শোনার জন্য নীলু মোটেও প্রস্তুত ছিলো না, শেষমেষ শ্রাবণের সাথে ওর পরকীয়ার সম্পর্ক ছিলো এটা প্রমান করতে চাইলো মিঠি ৷ নীলুর ইচ্ছা করছে এখন এখান থেকে দূরে কোথাও চলে গিয়ে নিজের প্রান বিষর্জন দিতে , এগুলো যে শোনাও পাপ ৷ নীলু চোখ বন্ধ করে আছে ৷ হঠাৎ ওকে ওর মন্তব্য পেশ করার জন্য ডাকা হতেই ও চমকে গেল ৷
নীলু শ্রবনের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো, শ্রাবন চোখের ইশারায় নীলুকে আশস্ত করলো ৷ নীলু ভয়ে ভয়ে যেতেই নীলুর উকিল ওকে প্রশ্ন করলো
” তো মিস সারিকা নীলাঞ্জনা আপনি মিঠিআহমেদের সব কথায় শুনলেন , ওনার এবং আপনার দাবী সম্পূর্ণ বিপরীত , আপনি কি বলতে চান ৷ আপনি কি এখনো আপনার দাবীতে অটল ?”

নীলুর মুখ দিয়ে আর কোন কথা বার হচ্ছে না, ওর মুখের ভাষা যেন কেউ কেড়ে নিয়েছে ৷ ওকে চুপ থাকতে দেখে রুদ্রর উকিল বলে উঠলো
” মাই লর্ড মিস সারিকা নীলাঞ্জনার এই নীরবতাই কি যথেষ্ট নয় ?”
তখন নীলুর উকিল জর্জকে উদ্দেশ্য করে বললেন
” মাই লর্ড আমার মক্কেল সারিকা নীলাঞ্জনা তিনি হয়তো নারভাস ফিল করছেন তাই আমি চাইবো শ্রাবন আরহামকে তার মতামত পেশ করতে ৷”
ওনার কথার সপক্ষে জর্জ হাজিরাতে শ্রাবনকে ডাকলেন ৷ রুদ্রর মুখে পৌশাচিক হাসি ৷নীলু মাথা নীচু করে ওর জায়গায় বস‍লো, আর বেঁচে থাকার কোন মানেই খুজে পাচ্ছে না ও ৷ ও আর নিজেকে রাখবে না শেষ করে দেবে এই ভাবনা ভাবতে লাগলো ‌ ৷
নীলুর উকিল বলল
” তা মিঃ শ্রাবন আপনি সারিকা নীলাঞ্জনাকে চেনেন?”
শ্রাবন সততার সাথে উত্তর দিলো ” জ্বি ৷”
” ঠিক কতোদিন বা কতো বছর ধরে চেনেন?”
” কতো দিন বললে ভুল হবে, আমি ওকে আমার ছোট্টবেলা থেকে চিনি, আমরা একই কলোনীতে থাকি , সে আমার প্রতিবেশী সেই সূত্রে ৷”
” আপনার সাথে ওনার সম্পর্কটা ঠিক কেমন ?”
শ্রাবন নীলুর দিকে তাকালো , মেয়েটা ভয়ে আর অপমানে মাথা নীচু করে চোখ বন্ধ করে আছে ৷ শ্রাবন নীলুর থেকে চোখ সরিয়ে বলল ” জ্বি ,তাকে আমি কখনো আমার বোনের চোখে দেখেনি, তাকে আমি আমার জীবনসঙ্গী হিসাবে পেতে চেয়েছিলাম কিন্তু পাইনি , তার আগেই ওনার রুদ্র আহমেদের সাথে বিয়ে হয়ে যাই ৷”
সকলের সামনে শ্রাবন নীলুর প্রতি ওর ভালোবাসা ব্যাক্ত করলো দেখে নীলু চমকে উঠলো । একটা মানুষ ঠিক কতোটা ভালোবাসলে আর কতোটা তাকে চাইলে এতো সাহসিকতার সাথে বলতে পারে নীলু জানেনা ৷ নীলুর উকিল বলল
” আপনার সাথে ওনার বিয়েটা হয়নি কেন?”
“জ্বি, তার প্রধান কারন নীলুর মা , তিনি বরারই লোভী প্রৃতির মানুষ তাই নিজের মেয়েকে একজন উচবিত্তশালী মানুষের সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তাই রুদ্র আহমেদের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন এটা বলায় বাহুল্য ৷”
” তা আপনি কি রুদ্র আহমেদের মতো অর্থনৌতিক ভাবে সচ্ছল নন?”
” জ্বি না, আমি তার মতো এতৈ সচ্ছল পরিবার থেকে নয় বলেই হয়তো আজ এই পরিনতি ৷”
” সারিকা নীলাঞ্জনার মা কোথায় থাকেন তিনি এখন?”
” তিনি তার স্বামী মারা যাওয়ার পরপরই তার সব জমিজমা বেঁচে টাকা নিয়ে নিজের মতো আছেন ৷”
” তো আপনি কতোটা যুক্ত দেবেন এ বিষয়ে যে রুদ্র আহমেদের বিরুদ্ধে করা অভিযোগ সত্য ৷ আপনার কাছে কি উপযুক্ত কোন প্রমান আছে ?”
তখন শ্রাবন মুচকি হেসে বলল ” জ্বি আছে ৷” শ্রাবনের এমন কথা শুনে নীলু শিউরে উঠলো ৷ শ্রাবন প্রমান কোথায় পাবে ? রুদ্র আর মিঠিও চমকে গেল তবে কি এমন প্রমান শ্রাবন দেবে তা দেখার অপেক্ষায় রইলো ৷
” তা আপনার কাছে কি প্রমান আছে সেটা আপনি মহামান্য আদালতের সামনে পেশ করূন তাতে তার সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে সুবিধা হবে ৷”
শ্রাবন তখন একটা পেনড্রাইভ দিয়ে বলল ” এতে মিসেস মিঠির কালকের একটা সাক্ষাতকারের ভয়েজ রেকর্ডিং আছে তা যদি শুনতেন ৷ পুরুষের কন্ঠস্বরটি আমার আর বাকি দুইজন নীলাঞ্জনা এবং মিঠির ‌ ৷ তিনি 2 দিন আগে গড়িয়াতে আমাদের সাথে মিট করেছিলেন রুদ্র আহমেদের বিরুদ্ধে প্রমান দেবেন তাই ,এবং তিনি তার নিজের এবং রুদ্র আহমেদের সমস্ত কুকির্তি স্বীকার করেছেন এবং ইতিমধ্যে তিনি যে একটি তৃতীয় সম্পর্কে জড়িত তাও স্বীকার করেছেন ৷ তবে দুঃখ একটাই তিনি আজ সমস্তটা অস্বীকার করে সারিকা নীলাঞ্জনাকে দোষী প্রমান করার চেষ্টা করেছেন ৷ তবে আশা রাখা যায় যে এটা শুনলে আর কোন প্রশ্ন থাকবে না আর না থাকবে কিছু অজানা ৷”
মিঠি ভয়ে শুকিয়ে কাঠ ৷ ওর কথাগুলো যে কেউ রেকর্ড করতে পারে তা ও কখনোই ভাবেনি ৷ এটা শুনলে নিশ্চিত ওদের সব কার্যকলাপ ফাঁস হবে ৷ রুদ্র মিঠিকে দাঁতে দাঁত চেপে বলল” এগুলো কি মিঠি ৷”
মিঠি চুপ আছে , কি বলবে বুঝতে পারছে না ৷”
কিছুখনের মধ্যেই সমস্তটা জর্জ সহ সবাই শুনলেন এবং প্রমান হলো যে নীলুর করা অভিযোগ সত্য ৷ শ্রাবন নীলুর পাশে বসে আছে ব দুজনের কেউ কারোর দিকে তাকাচ্ছেনা, নীলু যেন এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না সবটা ৷
জর্জ বললেন
” এতদ্বারা সকল প্রমানের ভিতিতে আদালত এই সিদ্বান্তে আসে যে সারিকা নীলাঞ্জনার করা অভিযোগের পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি আছে এবং তাই প্রমানিত তাই আদালত এই কেসের পক্ষে রুদ্র আহমেদ ও মিঠি আহমেদকে 15 বছরের সশ্রম কারাদন্ড ঘোষনা করছে ৷”

নীলু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো ৷ রুদ্র নীলুর দিকে তেড়ে এসে আচমকাই নীলুর গলা চেপে ধরতেই চারিপকশ থেকে পুলিশ এসে ওকে ধরে নিয়ে গেল টানতে টানতে আর মিঠিকেও নিয়ে গেল ‌ ৷ শ্রাবন নীলুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলো ” জীবনটা এতো সহজ না নীলু, আমাদের কে বাঁচার জন্য প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয় ,
হার মানলে তুমি পিছিয়ে পড়বে তাই সব পিছুটান রেখে এগিয়ে যাও ৷”
নীলু আর পারলো না সহ্য করতে শ্রাবনকে আকড়ে ধরে শ্রাবনের বুকে অঝোরে কেঁদে উঠলো ৷ রাঙাবে দুজন ভালোবাসার রঙিন কাব্য যা হবে #জলকাব্য ৷

ফরমাল গেটআপে রেডি হয়েছে শ্রাবন ৷ সন্ধ্যা 7টা বাজে, ওদের অনুষ্ঠান শুরূ 8টা তে ৷ শ্রাবন নীলু আর শাবনের মা রেডি হয়েছে, নীলু একটা লাল রঙের শাড়ি পরেছে যেটা শ্রাবন কোর্ট থেকে ফেরার সময় ওকে কিনে দিয়েছিলো ৷ শাবনের থেকেও নীলুর মনের মাঝে ভয়টা যেন একটু বেশিই কাজ করছে ৷ প্রথম ভয় হলো শ্রাবনের রেজাল্ট নিয়ে আর দ্বিতীয় ভয় আজ ও শ্রাবনকে ওর মনের কথা বলতে চাই , তবে তা এক্ষুনি কিন্তু কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না ৷ নীলু ওর ঘরের মধ্যে পাইচারি করছে ৷ ও এতদিন অপেক্ষা করেছিলো এই দিনটার যেদিন এই কেসটা সলভ হবে আর ও কোন দ্বিধা ছাড়াই শ্রাবনকে নিজের মনের কথাটা জানাতে পারবে ৷ চাইলে ও পরেও বলতে পারে শ্রাবনকে কথাটা কিন্তু ও আজই বলবে কারন আজ যদি শ্রাবন বিজয়ী হয় এবং নীলু যদি পরে ওর মনের কথা বলে তাহলে শ্রাবনের যদি মনে হয় যে নীলু কেবল শাবনের ফেম আর সাফল্য দেখে শ্রাবনকে ভালোবেসেছে , কিন্তু সেটা তো ভুল, নীলুর ভালোবাসা নিঃস্বর্থ ৷নীলু কথাগুলো মনে মনে ভাবলো ৷ ওর ভাবনার মাঝখানে শ্রাবন আসলো ” নীলু, কিরে রেডি হলি ?”
নীলু চমকে উঠলো, থতমত মুখ করে বলল ” হ্যাঁ ,হ্যাঁ আমি তো রেডি ৷”
শ্রাবন নীলু দিকে একবার তাকিয়ে নিলো, মেয়েটাকে একদম অন্যরকম লাগছে শ্রাবনের ভাষায় চোখ ধাঁধানো ৷ শ্রাবন নীলুকে একবার ভালো ভাবে দেখে নিয়ে বলল “চল !”
নীলু আমতা আমতা করে বলল ” ভাইয়া একটা কথা ছিলো ৷” শ্রাবন পিছন ঘুরে মুচকি হাসলো,ও হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে কিন্তু তা নীলুকে বুঝতে দিলে হবে না, শ্রাবন চাই যে নীলু মাঝেও একপ্রকার ছটফটানি হোক ৷ তাই বলল ” পরে শুনবো, এখন চল নাহলে লেট হয়ে যাবে ৷”নীলু আবার বললো
” ভাইয়া এখনই কথাটা শোনোনা প্লিজ , খুব দরকারি ৷” শ্রাবন হাসি কন্ট্রোল করে বলল ” বলেছি না পরে তো পরে ৷” নীলুর মাঝে অস্থিরতা বাড়ছে, ও শ্রাবনকে এখনই বলতে চাই কিন্তু শ্রাবন তো শুনতে নারাজ ৷ এরপর ওরা তিনজন বেরিয়ে গেল ৷ ওয়েটিং রুমে বসে আছে সবাই, এবার মধ্যেই চিন্তার ছাপ ৷ নীলুর শ্রাবনের রেজাল্টের থেকে বেশি ও কিভাবে কথাটা শ্রাবনকে বলবে তাই চিন্তা করছে ৷ নীলু শ্রাবনকে নরম সুরে ডেকে বলল ” ভাইয়া প্লিজ এবার কথাটা শুনবে ?” শ্রাবনের পেট ফাটা হাসি আসছে নীলুর অবস্থা দেখে ৷তবুও নীলুর মধ্যে চঞ্চলতাটা ওর বেশ লাগছে ৷ তাই আবার বলল ” এখন না নীলু পরে শুনবো এখন আমার চিন্তা হচ্ছে ৷”
শ্রাবনের মা বলে উঠলো ” এমন করছিস কেন! মেয়েটা সেই থেকে কি বলবে বলছে তুই শুনতেই রজি না, কি বলছে শুনে দেখ ৷” শ্রাবন আবার বলল ” মা পরে শুনবো বললাম তো ৷” নীলু এবার পারলে কেঁদেই দেবে ৷ শ্রাবন বেশ এনজয় করছে মোমেন্টটা ৷ ও এতবছর ধরে নীলুকে ভালোবেসে গেছে নিরবে আর নীলু এটুকু সময় সহ্য করতে পারছে না !
এবার আসলো সকলের নাম এনাউন্সের পালা ৷ সবাই স্টেজের দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে আছে, সবার সাথে শ্রাবন ও ৷ নীলু এবার শ্রাবনের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে শ্রাবনের শার্টটা ধরে কাদোকাদো গলায় বলল
” প্লিজ ভাইয়া শোনো না ৷” শ্রাবন মুচকি হেসে বলল
” বল কি বলবি ৷” নীলুর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে ৷ শ্রাবন নীলুর চোখ মুছে বলল ” কাঁদলে তোকে পুরো পেতনির মতো লাগে, তা এখন না কেঁদে বল কি বলবি ৷” নীলু চোখ মুছে বলল ” আমি তোমাকে ভালোবাসি ভাইয়া ৷” শ্রাবন মজা করে বলল ” ভালোবাসি ভাইয়া ৷ আমাকে তুই ভাই হিসাবে ভালোবাসিস তাইতো ?” নীলু শ্রাবনের দিকে তাকিয়ে বলল ” তুমি কি সত্তিই বোঝোনি ?” ওদের কথার মাঝেই শ্রাবনের মা শ্রাবনের কাছে এসে বললেন ” এই শ্রাবন তোর নাম ডেকেছে , তুই প্রথম হয়েছিস ৷ উনি আবেগে কেঁদে ফেললেন ‌৷ শ্রাবন ওনার কপালে ভালোবাসার পরশ একে বললেন ” আমি পেরেছি মা ৷”
শাবন স্টেজে গেল, ওর গলায় একটা মেডেল পরিয়ে একটা সম্বদ্ধনা দেওয়া হলো , আর 5 লাখ টাকার একটা চেক ও সাথে গান করার জন্য একটা এ এগ্রিমেন্ট সই করলো ৷” শ্রাবনকে নিজের সমন্ধে কিছু বলতে বললে সে নীলু আর ওর মাকে স্টেজে আসার জন্য বলল ৷ ওনারা স্টেজে যেতেই একপাশে নীলু ও অপর পাশে শ্রাবনের মা দাঁড়ালেন, নীলু মাথা নীচু করে আছে, আজ হাজার হাজার মানুষ ওকে দেখছে গানের জগতে নতুন এক প্রতিভা শ্রাবন আরহামের সাথে ৷ শ্রাবন বলতে শুরু করলো ” প্রত্যেক মানুষের জীবনের সাফল্যের পিছনে একজন নারীর অবদান থাকে আর সেই নরী হলেন আমার মা ৷ অনেক অভাব অনটনের সংসার থাকলেও তিনি কখনো আমাকে অভাবের ছোঁয়া পেতে দেননি ,আগলে আগলে রেখেছেন সবসময় ৷ তাই ওনাকে নিয়ে বললেও আমার ভাষার শেষ হবে না ৷ আর আমার আর এক পাশে যিনি আছেন তিনি হলেন আমার ভবিষ্যৎ জীবনের অর্ধাঙ্গিনী , সারিকা নীলাঞ্জনা ৷ ”

সারিকা নীলাঞ্জনা নামটা শুনতেই রুদ্র চমকে উঠলো ,জেলের ভিতরে কয়েদিদের পোশাক পরে বসে আছে ও আর জেলের বাইরে ওর সামনে থানার ওসি শ্রাবনের লাইভ ফাংশন দেখছেন,ফোনের ভলিউম ফুল স্পিডে দিয়ে, তাই ওর কানে কথাগুলো পৌচ্ছাছে৷ নীলুর নাম শুনে রুদ্রর চোখজোড়া ভরে এলো ৷ মেয়েটা ওর থেকে মুক্তি পেয়ে কতো সুখী ৷ এই জন্যই হয়তো বলে কাউকে আঘাত দিয়ে সুখী হওয়া যাইনা, যার ফলস্বরুপ রুদ্র আজ জেলে ৷
শ্রাবন আবার বলতে শুরু করলো ৷
” জীবনে চলার পথে অনেক কঠিন পথ পার করেছি তবে আজ আর একটা কঠিন রাস্তা পার করতে যাচ্ছি,,,,,
কথাটা বলে ওর নীলুর সামনে হাটুগেড়ে বসে বলল
” উইল ইউ বি মাই কাব্য ? যেটা হবে জলের মতো স্বচ্ছ আর কাব্যগ্রন্থেরর মতো সুন্দর ৷ যাকে আমার ভাষায় আখ্যায়িত হবে # জলকাব্য ৷” নীলু আবেগে কেঁদে ফেলল ৷ চারিদিক থেকে হাততালির আওয়াজে কান ঝালাফালা করার উপক্রম ‌ ৷ সকলের জীবনে ভালোবাসার মানুষটা যদি এভাবেই ভালোবাসতো তাহলে সবার জীবনই হতো এক একটা কাব্য ৷ #জলকাব্য ৷

#সমাপ্ত,,, Suraiya Aayat