কাশফুলের মেলা পর্ব-১৫

0
406

#কাশফুলের_মেলা
#পর্ব_১৫
#Writer_Nusrat_Jahan_Sara

অনু সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে গেলো।আবির এখনো উঠেনি, বোয়াও আসেনি।অনু নিজেই সকালের নাস্তা বানাতে শুরু করল।হাল্কা পাতলা নাস্তা।রান্না শেষ করে অনু আবিরের রুমের দিকে হাঁটা দিল।দরজায় কয়েকবার টোকা দিয়ে আবিরকে ডাকল।বেশ কিছুক্ষন পর আবির দরজা খুলে দিল।অনু কোনো দিকে না তাকিয়েই বলল,

নাস্তা হয়ে গেছে মুখ ধুয়ে খেতে আসুন।

অনু!!!!

আবিরের এমন শান্ত ভরা কন্ঠে অনুর বুক যেন ধক করে উঠল।সে আবিরের দিকে তাকিয়ে দেখল ওর চুল উসকোখুসকো হয়ে আছে চোখটাও লাল হয়ে গেছে।আবিরের রুমের দিকে তাকিয়ে দেখল রুমের হাল বেহাল।খাটের উপরে ওয়াইনের বোতল। অনু এটার নাম না জানলেও বোতল দেখে এটা বুঝতে পারল আবির মদ খেয়েছে।কিন্তু কেন?ওর কিসের এত অভাব?

ছিঃ আপনি মদ খান?আপনাকে তো ভালো ভেবে ছিলাম।

আবির একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

তো মদ খেলে কী মানুষ খারাপ হয়ে যায়?কোথায় শুনেছ এই কথা?কাল সারা রাত আমি ঘুমাতে পারিনি।কেন জানিনা শুধু তোমাকে মনে পরে। মন চায় তোমাকে একবার ছুঁয়ে দেখতে,কাছে পেতে। কিন্তু তোমাকে কাছে আনলে,ছুঁলে আমার অনু আমার উপরে রাগ করবে। বড্ড দোটানায় পরে গেছি আমি।তাই এই দোটানা থেকে বেড়িয়ে আসতেই এসবের ব্যবস্থ। এখন আবার বলনা সাধারন একটা কারনে আমি মদপান করেছি।আমার মনের অবস্থা তুমি বুঝতে পারবেনা।অনেকে আবার বলে মদ খেলে মানুষ নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনা।কিন্তু দেখ আমও একদম ফিট।দিব্যি তোমার সাথে কথা বলে যাচ্ছি।মদ আমার উপরে এফেক্ট ফেলতে পারেনা।যাই হোক অনেক কথা বলে ফেললাম এখন বল কেন ডেকে ছিলে?

অনু কান্নাভড়া কন্ঠে বলল,

নাস্তা টেবিলে ঢেকে রেখে দিয়েছি।মুখ ধুয়ে খেয়ে নিবেন।

কথাটি বলে সে একমুহূর্তও দাঁড়াল না রুমে চলে গেল।

আমার এখানে বেশিদিন থাকা ঠিক নয়।আবির ভালো ছেলে বিধায় সে আমাকে বাজে ভাবে ছুঁই না। কিন্তু মদপান করে সত্যি কথাটা বলেই দিল।বেচারা হয়ত নিজেকে অনেক কষ্টে কন্ট্রোল করে রেখেছে। আর তাছাড়াও একা একটা বাড়িতে দুজন প্রাপ্ত বয়সি ছেলে মেয়ে ব্যাপারটা কেউই স্বাভাবিক ভাবে নিবেনা।আবির নিজেরও ক্ষতি করছে মদপান করে। আমি এখান থেকে চলে যাব আর এক মুহুর্তও আমি এখানে থাকবনা।

আবির ঘুম থেকে উঠে দেখল বারোটা বাজে।কোনরকমে ফ্রেশ হয়ে মাথা চেপে ধরে নিচে নামল সে।নিজেই লেবু দিয়ে শরবত বানালো।হঠাৎই মনে পরল অনুর কথা। ডাইনিংয়ে রাখা খাবার দেখে তো বুঝা যায়না অনু খেয়েছে?তাহলে কোথায় ও?আর না খেয়েই বা আছে কেন?
আবিরের এবার বেশ রাগ হলো।সে বড় বড় পা ফেলে আরুহির রুমের দিকে হাঁটা দিল।দরজা খুলাই আছে আবির সারা রুমে চোখ বুলাল কিন্তু কোথায়ও অনু নেই।সে চলে আসতে নিবে তখনি চোখ পরল টেবিলের দিকে।একটা সাদা কাগজ উড়ছে।আবির অনেক কিউরিওসিটি নিয়ে কাগজটা হাতে নিলো।সে যেটা ভাবছিলো সেটাই হয়েছে অনু চলে গেছে।যাওয়ার আগে আবার ভাঙা ভাঙা হাতে লিখেও গেছে,,,

প্রিয় আবির!
আমাকে স্বার্থপর ভাববেন না দয়া করে।তিনদিন আমাকে আপনি আপনার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন। আর তার জন্য আমি আপনার কাছে চির ঋনি আমি চাইলেই আপনার উপকারের কথা ভুলে যেতে পারবনা। আর আমার উপকার করার জন্যে আমি আপনাকে প্রতিদান স্বরুপ অনেক বড় একটা উপহার দিব।আমি জানি আমি অনেক বড় অন্যায় করেছি আপনাকে না বলে চলে এসেছি।বিশ্বাস করুন আমি যাওয়ার আগে আপনাকে অনেক ডেকেছি কিন্তু আপনি দরজা খুলেননি।আমি এখন কোথায় যাব তা আমি নিজেও জানিনা।তবে বেঁচে থাকলে আবারও দেখা হবে।আর একটা রিকুয়েষ্ট সবসময় নিজের খেয়াল রাখবেন,একদিন মদ খেয়েছেন খেয়েছেন আর খাবেননা। ভালো থাকবেন।আল্লাহ্ হাফেজ।
ইতি
অনু!!!!

আবির লেখাগুলো পড়ে কাগজটা কুচিকুচি করে ছিড়ে ফেলল।

কে হও তুমি আমার যে আমি তোমার কথা মানব? কেনো এরকম স্বার্থপরের মত চলে গেলে অনু বলো?আমি যদি কোনো অন্যায় করে থাকি তাহলে আমায় বলতে আমি শুধরে নিতাম।কিন্তু আমি ঘুমে থাকা অবস্থায় তুমি পালিয়ে গেলে এটা কী ঠিক করেছো তুমি?আর কী বললে প্রতিদান দিবে?তোমাদের মতো মেয়েদের কাছ থেকে প্রতিদান আশাই করা যায়না। যখন দেখলে তোমার স্বার্থ পুরিয়ে গেলো তখনই পালিয়ে গেলে।বাহ ভালোই করেছো।এই কদিন তোমার কাছে থেকে আমি আমার অনুর খুঁজও করিনি।আজ থেকে আবার ওকে খুঁজবে। ওলিতে গলিতে আনাচে-কানাচে সব জায়গায় ওকে খুঁজব।

মাটিতে কলম পরে আছে। আবির কলমটা তুলতে গিয়ে একটা জিনিস দেখা মাত্রই একেবারে থমকে গেলো।ওর মুখ থেকে শুধু একটা কথাই বেড় হলো “না এটা হতে পারেনা”।

অনু পেটে হাত দিয়ে হাঁটছে।রাতে যে কয়েক লোকমা ভাত মুখে দিয়েছিলো আর কিছুই পেটে পরেনি। খিদেয় পেট ছুঁ ছুঁ করছে।এখন কোথায় যাবে কী করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা সে। আবিরের কাছ থেকে তো চলে এলো। সবাই তো আর আবিরের মতো ভালো নয়। যে ওকে বাসায় থাকতে দিবে।হঠাৎ অনুর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলল।

আমার নিজের বাসায় গেলে কেমন হয়?মেয়ে হয়ে যাবনা কাজের মেয়ে হয়ে যাব।আপাতত মেয়ের পরিচয় না দেওয়াই ভালো হবে। তা নাহলে যা ভেবে রেখেছি সেটার উল্টোটা হয়ে যাবে।ভাগ্যিস আবির সেদিন উনাদের ঠিকানা বলেছিলো।

আবিরের কথা মনে হতেই অনুর মুখটা কালো হয়ে গেলো,

সত্যি আমি ওর সাৎে খুব বড় ভুল করেছি।আসার সময় ওকে দেখে আসা উচিৎ ছিল।কিন্তু আমিই বা কী করব?ওকে যদি বলেও আসতাম তাহলে ও আমায় আসতে দিতনা। এক কথায় হিতে বিপরীত হয়ে যেত।আবির এখন কী করছে কে জানে?

আবিরের দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা দুইটা বেজে গেলো।অনু এখন তারই বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।কথাটা ভাবতেই অনুর মনে খুশির বন্যা বয়ে গেলো।দরজার সাথে লাগানো সাইনবোর্ড। তার মাঝে সুন্দর করে লিখা
” ইশান খান”নামটা জ্বলজ্বল করছে। অনু একবার লিখাটাতে হাত বুলাল। এই প্রথম সে তার মা বাবা ভাইকে সামনাসামনি দেখতে পারবে।অনু আর দেরি না করে কলিংবেল চাপলো।মধ্য বয়সী একজন মহিলা এসে দরজা খুলে দিল। মহিলাকে দেখে সে থতমত খেয়ে গেল।মহিলাটি অনুকে বেশকিছুক্ষন স্ক্যান করে বলল,

তোমাকে জানি কোথায় দেখেছিলাম? হ্যাঁ মনে পরেছে।তেমাকে তো আমি আবিরদের বাড়িতে দেখেছিলাম। তুমি তো ওদের বাড়ির কাজের মেয়ে রাইট?

হ্যাঁ।

তাহলে এখানে কী চাই?

অনু কেনো দিশা না পেয়ে বলল,

আসলে আমার কাজ চাই।আবির বাবু আমাকে বিদায় করে দিয়েছে।এখন যদি কোনো কাজ না পাই তাহলে যে আমায় না খেয়ে থাকতে হবে।দয়া করে আমাকে কাজে নিন।বেতর স্বরুপ দু’বেলা দুমুঠো ভাত হলেই চলবে।

আচ্ছা ভিতরে এসো আমি ভেবে দেখছি।।।

অনু বাসার ভিতরে গিয়ে একেবারে হা।এতবড় বাড়ির মেয়ো সে।চারিদিকে শুধু দামী আসবাবপত্র। অনুর চোখ পরল সেন্ট্রার টেবিলের উপরে রাখা ফুল ভ্যাসের ওপর। ভ্যাসটাতে প্লাস্টিকের অর্কিড ফুল।অনু ফুলগুলো হাতিয়ে দেখছে।

এই মেয়ে কে তুমি?আর এসবে হাতই বা দিচ্ছো কেন?

অনু মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল সেদিনের ছেলেটি।যাকে ও আবিরদের বাসায় দেখেছিলো।ওর নিজরই ছোট ভাই আদিল খান।

এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?আর এসব জিনিসে একদম হাত লাগাবেনা বলে দিলাম। এগুলো আমার প্রিয় ফুল।আমি কাউকে এসব ছুঁতে দিইনা।

অনু মাথা নাড়িয়ে না করল।সিড়ির দিকে চোখ পরতেই দেখল একজন মধ্য বয়স্ক লোক নিচে নামছেন।অনু লোকটাকে চিনতে পারলনা তাই আদিলকে বলল,

উনি কে?

উনি আমার বাবা ইশান খান।

অনু অবাক হয়ে ওর বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। সেদিন আরশি বা ইয়ান কাউকেই অনু ভালো করে ফলো করেনি।আবিরের মাধ্যমে শুধু এটুকুই জেনে ছিলো যে ইশান খান এসেছিলো।মন চাচ্ছে গিয়ে বাবাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরতে।কিন্তু মা?মা কোথায়?

অনু আদিলকে আবারও জিজ্ঞেস করল

আপনার মা কোথায়?

আশ্চর্য একটু আগেই মা আপনার সাথে ছিলো।

কীহ এটা মা ছিলো আর আমি একবার সালাম পর্যন্ত করলাম না।

ইশান সিঁড়ি বেয়ে নিচে এসে অনুর সামনে দাঁড়াল। অনু মায়াবী দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকাল। কত ইচ্ছে ছিলো বাবার বুকে মাথা রেখে সুখ দুঃখ প্রকাশ করবে।কিন্তু আজ বাবাকে কাছে পেয়েও একবার ছুঁতে পারছেনা বুকে মাথা রাখতে পারছেনা। অনুর চোখে পানি টলমল করছে। এই মানুষ গুলো থেকে কী না এতদিন সে দূরে ছিলো।অনু ইশানের দিক থেকে চোখ সরিয়ে আদিলের দিকে তাকাল।আদিল সোফায় বসে পায়ের উপরে পা তুলে ফোন টিপছে।বুকে আবার সানগ্লাসও গেথে রেখেছে হয়তো কোথাও একটা যাবে। বাবার মতোই সুন্দর হয়েছে।অনুর খুব ইচ্ছপ করছে নিজের ভাইটাকে আদর করতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে।আপাতত সে খুব কষ্টে নিজের ইমোশনটাকে কন্ট্রোল করে রেখেছে। ইশান বেশ গম্ভীর গলায় বলল,

চলবে,,,