#ভালোবাসার_চেয়েও_বেশি 💞💞
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-৩২
★ ক্লাস শেষে ভার্সিটির সামনে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে নূর। আদিত্য পার্কিং থেকে গাড়ি আনতে গেছে। আর নূরকে বলে গেছে এখানে দাড়িয়ে থাকতে।আজ নাকি আদিত্য ওকে কোথাও নিয়ে যাবে বলেছে। নূর অবশ্য প্রথমে একটু মানা করেছিল, কিন্তু আদিত্য তা শুনেনি। বলেছে কি নাকি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে তাই যেতেই হবে।
নূরও তাই আর মানা করতে পারেনি। বাকি সবাইও নাকি যাবে। ওরাও চলে আসবে এখুনি।
আদিত্যের আসতে সময় লাগছে দেখে, নূর শুধু শুধু দাঁড়িয়ে না থেকে আজকে যে নোট গুলো কপি করেছিলো, সেগুলো বের করে চেক করতে লাগলো।
দুই মিনিট পরই আদিত্য গাড়ি নিয়ে চলে এলো। গাড়ি থামিয়ে আদিত্য গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেই, হঠাৎ ওর ফোনটা বেজে উঠলো। আদিত্য ফোন বের করে দেখলো অফিস থেকে ফোন এসেছে। আদিত্য ফোনটা কানে নিয়ে কথা বলতে লাগলো।
নূর এখনো দাঁড়িয়ে পেপার চেক করছে। হঠাৎ দমকা বাতাসে নূরের হাত থেকে কয়েকটা পেপার উড়ে গেল। নূর একটু ঘাবড়ে যেয়ে তড়িঘড়ি করে পেপার গুলো ধরার জন্য পেপারের পেছনে ছুটতে লাগলো।
আদিত্য অন্য দিকে তাকিয়ে ফোনে কথা বলছে। তাই নূর এদিকে কি করছে সেটা আর ও দেখতে পাচ্ছে না।
নূর পেপারের পেছনে ছুটতে ছুটতে কখন যে রাস্তার মাঝখানে চলে এসেছে, সেই খেয়াল নেই ওর।
আদিত্য কথা বলা শেষে পাশে তাকিয়ে দেখে নূর নেই। আদিত্য ভ্রু কুঁচকে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। মনে মনে ভাবলো, নূর আবার কই গেল?
পিছনে ঘুরে তাকাতেই আদিত্যের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরলো। আদিত্য দেখলো নূর রাস্তার মাঝখানে বসে কি যেন খুঁজছে, আর ওর থেকে সামান্য দূরেই একটা ট্রাক ওর দিকে ছুটে আসছে। নূরের সে খেয়ালি নেই।
মূহুর্তেই যেন আদিত্যের পুরো পৃথিবীটাই থমকে গেল। ওর হার্টবিট যেন চলা বন্ধ করে দিল। হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। আদিত্য নূরকে ডাকতে চাচ্ছে, কিন্তু ওর গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কেউ গলাটা চিপে ধরে রেখেছে।
নূর পেপারটা শেষমেষ হাতে পেয়ে খুশী মনে উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু পাশে তাকাতেই ওর খুশি মুখটা উধাও হয়ে গেলো। সামনে থেকে আসা ট্রাককে দেখে নূরের সারা শরীর ভয়ে জমে গেল। নূর মনে মনে ভাবলো, আজই হয়তো ওর জীবনের শেষ দিন। এটা ভেবেই নূর চোখ বন্ধ করে নিল।
দুই সেকেন্ড পরেই নূরের মনে হলো কেউ ওকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল। নূর যেয়ে রাস্তার পাশে পরে গেলো। একটু পরে নূর পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালো। তারপর নিজের হাত পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো সব ঠিক আছে নাকি। নূর মনে মনে ভাবলো, আমি কি তাহলে বেচে গেছি? কিন্তু কে বাঁচালো আমাকে?
এটা দেখার জন্য নূর পেছনে ফিরে তাকালো। আর তাকাতেই যা দেখলো তাতে নূর স্তব্ধ হয়ে গেল। মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। ওর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। নূর দেখলো আদিত্য রক্তাক্ত অবস্থায় উপর হয়ে রাস্তায় পরে আছে। নূরের বুঝতে বাকি রইলো না যে আদিত্য ওকে বাচাতে গিয়ে নিজেই গাড়ির সামনে চলে এসেছে।
আদিত্যর মাথার নিচে রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
এসব দেখে নূর কেমন অনূভুতি শুন্য হয়ে গেলো। আশেপাশের সবকিছু ঘোলাটে হয়ে গেল। একদম পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো নূর।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওখানে মানুষজনের ভীড় জমে গেল। সবাই নানানরকম কথা বলতে লাগলো। কিন্তু নূরের সেসব কোনো কথাই কানে যাচ্ছে না। ও মূর্তির মতো দাঁড়িয়েই আছে। ওর ভেতর কোনো অনূভুতি কাজ করছে না।
একটু পরে আবির তাসির আর তানি ওখানে দৌড়ে এলো। আদিত্যের এমন অবস্থা দেখে আবির আর তাসির কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। দৌড়ে যেয়ে আদিত্যকে ধরে ওরা দুজন কাঁদতে লাগলো। আবির কাঁদতে কাঁদতে বললো।
….ভা ভাই কি হয়েছে তোর? ওঠনা ভাই। এতো র রক্ত কেন তোর শরীরে? প্লিজ ভাই ওঠনা।
তাসির নিজেকে একটু শক্ত করে আবিরের দিকে তাকিয়ে বললো।
…. এসবের সময় নেই। আমাদের ওকে তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিতে হবে। ওকে ধরে গাড়িতে তোল তাড়াতাড়ি।
আবির মাথা ঝাকালো। তারপর ওরা দুজন আদিত্যকে ধরে গাড়িতে তুললো।
তানি এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছুটা দূরে নূরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর কাছে দৌড়ে গেল। তানি নূরের কাছে এসে দেখলো নূর কেমন অথর্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তানি চিন্তিত স্বরে নূরকে ডাকতে লাগলো। কিন্তু নূরের কোনো হেলদোল নেই। তানি এবার নূরের কাঁধ ঝাকিয়ে উচ্চস্বরে ডেকে বললো।
….নূর নূরর,,,শুনতে পাচ্ছিস? তুই ঠিক আছিস?
নূর এবার একটু নড়েচড়ে উঠে তানির দিকে তাকালো। তারপর নিজের হাতটা উঠিয়ে রাস্তার দিকে ইশারা করে অস্পষ্ট স্বরে তানিকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলো।
….উ উ উ উনি আ আ আআমার জ জ জজন্য,,,,,
আর কিছু বলতে পারলো না নূর।জ্ঞান হারিয়ে পরে যেতে নিলেই তানি নূরকে ধরে ফেললো। তারপর একটা সিএনজি ডাক দিয়ে নূরকে নিয়ে সিএনজিতে উঠে আবিরদের গাড়ির পেছনে পেছনে গেল।
—————————————-
পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালো নূর। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো ও একটা হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে। তানি সামনেই একটা চেয়ারে মাথায় হাত রেখে চোখ বন্ধ করে বসে আছে।
নূরের হঠাৎ আদিত্যের কথা মনে হতেই ঠাস করে উঠে বসলো। শব্দ শুনে তানি তাকিয়ে দেখলো নূর উঠে পরেছে। তানি তাড়াহুড়ো করে বললো।
….তুই ঠিক আছিস?
নূর অস্থির হয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে তানিকে জিজ্ঞেস করলো।
….উ উ উনি কোথায়? কে কেমন আছেন উনি? উ উউনার কিছু হয়নি,উনি ঠি ঠিক আছন তাইনা বল? ক ককথা বল?
তানি নূরের কাঁধে হাত দিয়ে বললো।
… আমি সব বলছি। তুই আগে একটু শান্ত হ।
…আমি ঠিক আছি। তুই আগে আমার কথার উত্তর দে।
তানি দুঃখী গলায় বললো।
…. আদিত্য ভাইয়াকে অপারেশন থিয়েটার নিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন উনার অপারেশন চলছে। অপারেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না।
তানির কথা শুনে নূর হু হু করে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো।
….স সসব আ আমার জন্য হয়েছে। আ আআমিই দায়ী উনার এই অবস্থার জন্য। আ আআমাকে বাচাতে যেয়ে আজ উনার এই অবস্থা হয়েছে।
নূরের এমন অবস্থা দেখে তানিরও খুব খরাপ লাগছে। তবুও নিজেকে একটু শক্ত করে নূরকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো।
…তুই একটু শান্ত হ।দেখ এখানে কারোর কোনো দোষ নেই। এটা শুধু একটা এক্সিডেন্ট। তুই চিন্তা করিস না। দেখবি ভাইয়া একদম ঠিক হয়ে যাবে।
একটু পরে নূর তানির দিকে তাকিয়ে বললো।
….আ আমাকে একটু ওখানে নিয়ে যাবি প্লিজ?
তানি মাথা ঝাকিয়ে নূরের কাঁধ ধরে নূরকে অপারেশন থিয়েটারের সামনে নিয়ে গেল।
নূর আর তানি ওটির সামনে যেয়ে দেখলো। আবির আর তাসির ওটির সামনে চেয়ারে বসে আছে। আবিরের কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ লাল করে ফেলেছে। তাসির চোখ বন্ধ করে দুই হাত দিয়ে নিজের চুল টেনে ধরে মাথা নিচু করে বসে আছে। ওরা এখনো বাসায় খবর দেইনি। বাসায় জানাজানি হলে সবাই ভেঙে পরবে। বিশেষ করে আদিত্যের বাবা। উনি এমনিতেই হার্টের পেসেন্ট। তারউপর এমন একটা খবর শুনলে, উনার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যেতে পারে। তাই আবির আর তাসির বাসায় এখনো কাওকে জানায়নি।
নূর কাঁপা কাঁপা পায়ে ওটির দরজার কাছে যেয়ে, দরজার ওপরে কাচের হোল দিয়ে ভেতরে দেখার চেষ্টা করলো।
নূর দেখলো আদিত্যের মুখে অক্সিজেন দিয়ে রেখেছে। মাথায় আর সারা শরীরে ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে রেখেছে। আদিত্যকে এভাবে দেখে নূরের কষ্টে কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে। নূর আর দেখতে পারলো না। ওখান থেকে সরে এসে পাশের দেয়াল ঘেঁষে নিচে বসে পরলো। মুখে দুই হাত চেপে ধরে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে।
দুই ঘন্টা পর ওটির দরজা খুলে ডক্টররা বের হয়ে এলো। আবির আর তাসির দৌড়ে ডক্টরের সামনে গেল।
নূর ওখানেই পাথরের মতো বসে রইলো। ও ডক্টরের কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। ডক্টর যদি কোনো খারাপ কিছু বলে সেই ভয়ে।
তাসির ডক্টরকে জিজ্ঞেস করলো
….ডক্টর আদিত্যর কি খবর? ওর কিছু হয়নি তো?
ডক্টর ওদের আস্বস্ত করে বললো।
…ডোন্ট ওয়ারি। অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে। হি ইস নাউ আউট ডেঞ্জার।
কথাটা শুনে যেন সবার জানে পানি এলো। তাসিরের চোখে পানি চলে এলো। তাসির বললো।
…থ্যাংক ইউ ডক্টর। থ্যাংক ইউ সো মাচ। আমরা কি আদিত্যের সাথে দেখা করতে পারি?
….হ্যাঁ একটু পরে ওনাকে কেবিনে সিফট করা হবে। আর দুই ঘন্টা পরে ওনার জ্ঞান ফিরবে। তখন আপনারা চাইলে দেখা করতে পারবেন। তবে হ্যাঁ, রোগীর পাশে বেশি ভীড় করা যাবে না। ওনার সমস্যা হতে পারে।
তাসির বললো।
…ঠিক আছে ডক্টর আমরা খেয়াল রাখবো। থ্যাংক ইউ সো মাচ।
—————————————–
আদিত্যকে কেবিনে সিফট করা হয়েছে দুই ঘন্টা হয়ে গেছে। তাসির আর আবির কেবিনের সোফায় বসে আছে।
একটু পরে আবির আর তাসির খেয়াল করলো আদিত্য একটু নড়েচড়ে উঠছে। হয়তো আদিত্যের জ্ঞান ফিরে আসছে। কথাটা ভেবে তাসির আদিত্যের বেডের পাশে টুলে এসে বসলো। তাসির খেয়াল করলো আদিত্য কেমন জানি ছটফট করছে। মনে হচ্ছে ও ঘুমের ভেতর খারাপ কিছু দেখছে। একটু পরে তাসির আবার খেয়াল করলো আদিত্য বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। তাসির ভালো করে শোনার জন্য আদিত্যের মুখের ওপর ওর কানটা ঝুকালো। কিছুক্ষণ শোনার পর তাসির বুঝতে পারলো আদিত্য বিড়বিড় করে শুধু নূরের নাম ধরে ডাকছে।
হাঠাৎ আদিত্য চিৎকার দিয়ে নূরের নাম ধরে ডেকে উঠে চোখ খুলে তাকালো। তাসির খুশি হয়ে বললো।
…আদি তোর জ্ঞান ফিরে এসেছে। তুই ঠিক আছিস? আমি এখুনি ডক্টরকে ডেকে আনছি।
কথাটা বলেই তাসির উঠতে নিলেই আদিত্য অনেক কষ্টে কোনরকমে বলে উঠলো।
…..তা তাতাসির।
তাসির সাথে সাথে থেমে যেয়ে আদিত্যের দিকে ঝুকে তাড়াহুড়ো করে বললো।
….হ্যাঁ হ্যাঁ, বল। কিছু বলবি?
আদিত্য কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো।
….নূ নূ নূর ক ককোথায়? ও ঠি ঠিক আছে তো?
তাসির যেন অবাকের চরম পর্যায়ে। এই মূহুর্তে যার কিনা জীবন মরন নিয়ে টানাটানি সে এখন নূরের চিন্তায় অস্থির। একটা মানুষ কিভাবে কাউকে এতো ভালোবাসতে পারে? তাসিরের ভাবনার মাঝেই আদিত্য আবারও অস্থির হয়ে বললো।
….কি কিরে? কথা ব বলছিস না কেন? নূরের কি কিকিছু হয়নি তো? স সসত্যি করে বল।
তাসির বলে উঠলো।
….আরে তুই চিন্তা করিস না। তোর নূরের কিছু হয় নি। ও একদম ঠিক আছে।
আদিত্য একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো।
….স সসত্যি বলছিস তো? আ আআমার নূর ঠিক আছে?
…হ্যাঁ হ্যাঁ সত্যি সত্যিই বলছি আমার বাপ।
….তা তা তাহলে নূর কো কোথায়? ও ওকে দেখছি না কে কেন? ওকি আ আআসেনি এখানে?
….আরে এসেছে তো। তখন থেকে বাইরে বসে আছে। বেচারি অনেক ভয় পেয়ে গেছিলো তোর জন্য। শুধু নূর কেন, তুই তো আমাদের সবাইকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি শালা। জানিস সবার কি অবস্থা হয়েছিল। ভয়ে সবার আত্মা গলায় চলে এসেছিলো। এখন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে আমাদের রক্ষা কর।
…..নূ নূ নূরকে একটু ডা ডাকনা। ও ওওকে না দেখা পর্যন্ত আ আমার শান্তি হবে না।
…ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুই শান্ত হ আমি নূরকে ডেকে আনছি।
আবির উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো।
…তুই ভাইয়ের কাছে থাক। আমি ডেকে আনছি নূরকে। আর তানিকেও দেখে আসছি।
তাসির মাথা ঝাকিয়ে বললো।
…ঠিক আছে।
আবির বাইরে এসে দেখলো তানি একা একা চেয়ারে বসে আছে। আবির ভ্রু কুঁচকে বললো।
….তুমি একা কেন? নূর কোথায় তানি?
তানি মুখটা ছোট করে বললো।
…..আমি একটু ওয়াশরুম গিয়েছিলাম এসে দেখি নূর এখানে নেই। আমি এদিক ওদিক খুঁজলাম কিন্তু পেলাম না। পরে ওর নাম্বারে ফোন দিলাম তাও ধরলো না। তার কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ওর ম্যাসেজ আসলো যে ও বাসায় চলে গেছে। আমারনা ওর জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে। মেয়েটা আজ অনেক বড়ো ধাক্কা খেয়েছে। নাজানি ওর ভেতর কি চলছে?
আবির তানিকে জড়িয়ে ধরে বললো।
….চিন্তা করোনা সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।
তানি বললো।
….হুম। আচ্ছা আদিত্য ভাইয়ার কি অবস্থা এখন?
আবির তানিকে ছেড়ে দিয়ে বলে উঠলো।
…ও হ্যাঁ আমিতো ভুলেই গেছিলাম। ভাইয়ের জ্ঞান ফিরে এসেছে। আর ভাই এখন নূরের সাথে দেখা করতে চাচ্ছে। এখন ভাইকে কি বলবো? নূরকে না দেখে যাদি ভাই হাইপার হয়ে যায়?
তানি একটু ভেবে বললো।
…চলো আমি ভাইয়াকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি।
আবির মাথা ঝাকিয়ে বললো।
….ঠিক আছে চলো।
আবির আর তানি দুজন কেবিনের ভেতর ঢুকলো। তানি আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বললো।
….আপনি ঠিক আছেন ভাইয়া? এখন কেমন লাগছে?
আদিত্য তানির পেছনে তাকিয়ে নূরকে খোঁজার চেষ্টা করছে। নূরকে না দেখে তানির দিকে তাকিয়ে বললো।
….নূ নূ নূর কোথায়? ও ওওকে দেখছি না কেন?
তানি বললো।
…আসলে ভাইয়া আজ নূরের ছোট মা বাসায় আসার কথা আছে। তাই নূরকে চলে যেতে হয়েছে। নাহলে ওর বাসায় সমস্যা হতে পারে। নূর যেতে চাচ্ছিল না। আমিই ওকে জোর করে পাঠিয়েছি। আপনি চিন্তা করবেন না। কাল সকালেই আবার আসবে নূর। তখন ওর সাথে দেখা করে নিয়েন।
আদিত্য মনে মনে হতাশ হলেও উপরে উপরে জোরপূর্বক একটা হাসি দিল। নূরের বাসার খবর আদিত্যের জানা আছে। তাই আর কিছু বলতে পারলো না। তবে নূরকে না দেখা পর্যন্ত ওর শান্তিও লাগছে না। আদিত্য মন খারাপ করে ভাবছে কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আমার নূরপাখিকে দেখার জন্য।
————————————–
নূর বাসার দরজা খুলে এলোমেলো পায়ে নিজের রুমের দিকে গেল। তারপর ওয়াশরুমে যেয়ে নিজের শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে ঠাস্ করে ফ্লোরে বসে পড়লো।
একটু পরে হঠাৎ নূর দুই হাত দিয়ে নিজের দুই গালে চড়াতে লাগলো। চড়াতে চড়াতে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো।
….সব তোর জন্য হয়েছে। সব তোর জন্য হয়েছে। তোর জন্য আজ উনার এই অবস্থা হয়েছে। তুই দায়ী এসবের জন্য। তুই কেন নিজের অস্তিত্ব ভুলে যাস? কেন ভুলে যাস তুই একটা অপয়া। হ্যাঁ হ্যাঁ, অপয়া অপয়া অপয়া। তারপর নূর চড়ানো বন্ধ করে জোরে জোরে কাঁদতে কাঁদতে আবার বলতে লাগলো।
….তুই কেন ভুলে যাস তুই একটা অপয়া? তুই যার জীবনে যাবি তার জীবন শেষ হয়ে যাবে। তুই যাকে ভালোবাসবি সে তোর থেকে দূরে চলে যাবে। এসব জানার পরও কেন তুই আদিত্যকে ভালোবাসতে গেলি? কেন ওর এতো কাছে গেলি? কেন? কেন?কেন? তোর মতো অপয়ার কাওকে ভালোবাসার কোনো অধিকার নেই। ছোট মা ঠিকই বলে। আমি সবাইকে খেয়ে ফেলি। আমার জন্য সবাই চলে যায়। আজ আমার জন্যই আদিত্যের জীবনেও কাল নেমে এসেছে। না না আমি ওনার কোনো ক্ষতি হতে দেবনা। আমি উনার জীবন থেকে সরে যাবো। কখনও উনার সামনে যাবো না। কখনো না। উনি দূরে থাকুক তবুও ভালো থাকুক। আমি উনাকে দূর থেকেই দেখে যাবো। আমার কি? আমিতো আমার জীবন এভাবেই মেনে নিয়েছি। কিন্তু উনি ভালো থাকুক, সুখে থাকুক এতেই আমি খুশি। হ্যাঁ এতেই খুশি……
চলবে…….
#ভালোবাসার_চেয়েও_বেশি💞💞
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-৩৩
( Confession part)
★ আদিত্যের এক্সিডেন্টের আজ বিশদিন হয়ে গেছে।একয়দিনের ভেতর নূর শুধু একবার আদিত্যের সাথে ফোনে কথা বলেছে। তাও শুধুমাত্র এইজন্য যাতে আদিত্য মেনে নেয় যে নূরের কিছু হয় নি ও ঠিক আছে।
সাতদিন পরেই আদিত্যকে হসপিটাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে। আদিত্য আপাতত ওদের সাভারের বাড়িতে আছে। হসপিটাল থেকে ওখানে নিয়ে এসেছিল সবাই। আদিত্য এখন মোটামুটি অনেকটা সুস্থ। এখন ঠিকমতো চলাফেরাও করতে পারে।
শরীর ঠিক থাকলেও ওর মন মানসিকতা একদম ঠিক নেই। এতোদিন নূরকে দেখতে না পেরে আদিত্যের পাগল প্রায় অবস্থা। নূরের সাথে না দেখা হচ্ছে,না কথা। ফোন দিলে ধরে না।ইদানিং তো ফোনই বন্ধ থাকে। নূর কেমন আছে?ওর কোনো কিছু হলো কিনা?এসব ভেবে আদিত্যের টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে। আবির তাসির অথবা তানিকে কিছু জিজ্ঞেস করলে। ঠিকমতো বলে না। শুধু তালবাহানা করে। কখনো বলে নূরের এক্সাম আছে, আবার কখনো বলে নূরের বাসায় সমস্যা আছে তাই হয়তো আসতে পারছে না।
ওরাই বা কি বলবে? ওরাতো নিজেরাই বুঝতে পারছে না, নূর এমন কেন করছে? তাই তো আদিত্যকে শান্ত রাখার জন্য নানান কথা বলে যাচ্ছে।
কিন্তু এসব কোনো কথাই এখন আদিত্যের মনকে শান্ত করতে পারছে না। ওরতো নূরকে না দেখা পর্যন্ত শান্তিই হবে না। আদিত্য নূরের সাথে দেখা করার জন্য অনেক বার বাসা থেকে বের হতে চেয়েছে। কিন্তু বাসার লোকের জন্য সেটাও পারছে না। অসুস্থ অসুস্থ বলে ওকে কেও বাসা থেকে বের হতেই দিচ্ছে না। এখন ওদের কিভাবে বুঝাবে যে শরীরের কষ্টের চাইতে নূরকে না দেখে থাকার বিষয়টাই বেশি কষ্টকর আদিত্যের কাছে। এক একটা দিন যেন এক একটা বছরের সমান ওর কাছে।
আজ আদিত্য মনে মনে পণ করেছে। আজ আর কারোর কথা শুনবে না সে। যে করেই হোক আজ সে বাইরে যেয়েই ছাড়বে। আর একমূহুর্তও নূরের সাথে দেখা না করে থাকতে পারবে না আদিত্য। তাই তো সকাল সকাল উঠে রেডি হচ্ছে ভার্সিটি যাওয়ার জন্য।
আজ আদিত্যের জেদের সামনে বাকি সবাইও কিছু বলার সাহস পেল না। অগত্যা সবাই মেনে নিল। যেহেতু আদিত্য এখন অনেকটা সুস্থ। তাই আর সবাই তেমন বাঁধা দিল না। আবির সবাই কে আস্বস্ত করে বললো।
…আমি ভাইয়াকে নিয়ে যাবো। তোমরা কেউ চিন্তা করোনা। আমি ওর সাথেই থাকবো।
আবিরের কথায় সবাই রাজি হয়ে গেলো।
——————————————
নূর মনমরা হয়ে রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। আদিত্য এখনো রোজ ড্রাইভার সহ গাড়ি পাঠিয়ে দেয় নূরের জন্য। কিন্তু নূর সে গাড়িতে উঠে না। কারণ নূর চায়না আদিত্যের দেওয়া কোনো সুবিধা ভোগ করতে। এতটা স্বার্থপর ও হতে পারবে না।
এই কয়টা দিন নূরের কিভাবে কেটেছে তা শুধু ওই জানে। নূরের জীবন আগের থেকেও আরো বিতৃষ্ণা পূর্ণ হয়ে উঠেছে। এর ভেতরে নূরের সৎ মাও বাসায় চলে এসেছে।
আদিত্যকে দেখতে না পারার কষ্টে নূর নিজেও ভুগছে। কিন্তু হাজার কষ্ট হলেও নূর নিজের কথায় অটল থাকে। আদিত্যের থেকে দূরে থাকে। তবে রোজ তানির কাছ থেকে আদিত্যের সব খোঁজ খবর নেয়। তানি ওকে অনেক দিন জিজ্ঞেস করেছে তুই এমন কেন করছিস? অনেক চাপাচাপি করায় নূর শেষমেষ তানিকে সব খুলে বলে যে ও এটা আদিত্যের ভালোর জন্য করছে। সব শুনে তানি নূরকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে য,নূর যেটা ভাবছে সেটা ভুল। ও যেন এমন না করে। কিন্তু ওর কথার ওপরই অটল থাকে। নূর উল্টো আরো তানিকে নিজের কসম দেয় যাতে এসব কথা আদিত্যকে না বলে। তানিও আর না পেরে হাল ছেড়ে দেয়।
নূরের ভাবনার মাঝেই হঠাৎ ওর পাশে একটা গাড়ি এসে থামে। নূর একটু ঘাবড়ে যেয়ে দুকদম পিছিয়ে যায়।
গাড়ির জানালা দিয়ে একটা ছেলে মাথা বের করে দিয়ে বলে উঠলো।
….কিরে নূর কোথায় যাচ্ছিস?
নূর একটা ফেক হাসি দিয়ে বললো।
…এইতো ভাইয়া ভার্সিটি যাচ্ছি।
….ও আচ্ছা, আমিও ওইদিকেই যাচ্ছি। চল আমি নামিয়ে দিচ্ছি তোকে।
….না না আপনার কষ্ট করতে হবে না। আমি যেতে পারবো।
….আরে কষ্টের কি আছে? আমিতো ওইদিকেই যাচ্ছি। আর এমনিতেও তোর সাথে অনেকদিন হলো কোনো কথাবার্তাও হয় না। এই সুযোগে একটু কথা বলা যাবে। এখন বেশি কথা না বলে গাড়িতে ওঠ।
নূর মাথা ঝাকিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।
ছেলেটা আবার বলে উঠলো।
….তো কেমন আসিছ? তোর ভার্সিটি কেমন চলছে?
নূর একটা ফেক হাসি দিয়ে বললো।
….এইতো ভাইয়া ভালো। আর ভার্সিটিও ঠিকঠাক চলছে।
…..হুম। তা অনেক দিন হলো আসিস না? বাসায় এসে ঘুরে যাস একসময়।
….ঠিক আছে ভাইয়া। সময় করে একদিন যাবো। আচ্ছা চাচা কেমন আছে? অনেক দিন হলো দেখা হয় না চাচার সাথে।
….বাবা ভালোই আছে। আসলে বাবা একটু গ্রামের বাড়ি গেছে। তাই দেখতে পাসনি। তোকে হয়তো বলার সময় পায় নি।
এভাবে টুকটাক কথার মাঝেই ওরা ভার্সিটি পৌঁছে যায়। ক্যাম্পাসের মাঠে এসে গাড়ি থামে। নূর গাড়ির দরজা খুলে নেমে দাঁড়ালো। ছেলেটাও গাড়ি থেকে নেমে নূরের কাছে এসে দাঁড়ালো। তারপর মুচকি হেসে নিজের এক হাত আলতো করে নূরের গালে রেখে বললো।
….ঠিক আছে তাহলে এখন যাই পরে আবার দেখা হবে। ভালো থাকিস আর হ্যাঁ বাবা নেই দেখে ভাবিস না কোনো কিছুর দরকার হলে আমাকে জানাস কেমন?
নূর জোরপূর্বক একটা হাসি দিয়ে মাথা ঝাকিয়ে বললো।
…ঠিক আছে ভাইয়া। আমি এখন আসি।
…হুম ঠিক আছে।
কথাটি বলেই ছেলেটা গাড়ি নিয়ে চলে গেলো।
নূর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ক্লাসের দিকে এগুলো।
এতক্ষণ যে একজন অগ্নি চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল নূরের সেই খেয়াল নেই।
আদিত্য ক্যাম্পাসের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে উপর থেকে এতক্ষণ সবকিছু দেখছিল আর রাগে ফুঁসছিলো। এমনিতেও নূর এতদিনে একবারও ওর সাথে দেখা করেনি এটা নিয়ে আদিত্যের মনে নূরের জন্য একটু অভিমান জমে ছিল। আজ এতদিন পরে নূরের সাথে দেখা করতে এসেছে। আর সেই মূহুর্তে নূরকে অন্য কারোর সাথে দেখে আদিত্যের আরো রাগ বেড়ে গেল।
নূর হেটে নিজের ক্লাসের দিকে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা ফাঁকা ক্লাসের দরজা দিয়ে কেউ নূরের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। তারপর দরজা বন্ধ করে নূরকে দেয়ালের সাথে দুই হাত আটকে চেপে ধরলো।
আচমকা এমন হওয়ায় নূর প্রচুর ঘাবড়ে গেল। চোখ খিঁচে বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
….ছেলেটা কে ছিল?
পরিচিত কন্ঠ শুনে নূর চমকে চোখ খুলে সামনে তাকালো। হঠাৎ করে আদিত্যকে দেখে নূর থ হয়ে গেলো। অবাক আর মায়ার চোখে একধ্যানে তাকিয়ে রইলো আদিত্যের দিকে। আদিত্যকে সুস্থ সবল দেখে নূরের মনে মনে অনেক খুশী লাগছে। নূরের ভাবনার মাঝেই আদিত্য আবারও অগ্নি চোখে চেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো।
….কি হলো কথা বলছো না কেন? ছেলেটা কে ছিল? আনসার মি ড্যাম ইট।
আদিত্যের কথায় নূরের ঘোর কাটলো। আর তার সাথে ওর বাস্তবতার কথাও মনে পরে গেলো। নূর মনে মনে ভাবলো, আমাকে দূর্বল হলে চলবে না। শক্ত হয়ে উনার সাথে কথা বলতে হবে। যাতে উনি নিজে থেকেই আমার কাছে থেকে সরে যান। এসব ভেবেই নূর মনে মনে একটু
সাহস নিয়ে আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বললো।
….. কে কেন? ছেলেটা যেই হোক আপনাকে কেন বলতে হবে?
নূরের এমন জবাব শুনে আদিত্য একটু অবাক হলো। সাথে সাথে প্রচুর রাগও হলো। আদিত্য চোয়াল শক্ত করে রাগী স্বরে বললো।
…নূর আমার রাগ বাড়িও না। এমনিতেই আমি প্রচুর রেগে আছি। তাড়াতাড়ি করে বলো ছেলেটা কে? আর ওর সাহস কি করে হলো তোমাকে টাচ করার?
নূর মনে মনে প্রচুর ভয় পেলেও, উপরে সেটা বুঝতে দিলো না। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো।
…ছা ছাড়ুন আমাকে।আমার ক্লাসে দেড়ি হয়ে যাচ্ছে। আ আপনার কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য নই।
নূরের এভাবে কথা বলা দেখে আদিত্য প্রচুর অবাক হচ্ছে । সাথে রাগও আরও বাড়সে। আদিত্য এবার একটু ধমকের সুরে বললো।
….অবশ্যই বলতে বাধ্য তুমি। তোমার সবকিছুর ওপর শুধু আমার অধিকার। তোমাকে আমি ছাড়া অন্য কেউ টাচ কেন করবে? এটা আমি কখনোই মেনে নেব না। কখনো না।
আদিত্যের এমন কথায় নূর যেন ভেতরে ভেতরে আবেগে আপ্লূত হয়ে উঠছে। নূর আবারও মনে মনে ভাবলো, না না এভাবে হবে না। উনাকে কিছু কড়া কথা শোনাতে হবে, যাতে উনি এখান থেকে চলে যায়। এসব ভেবেই নূর মুখের ভাবভঙ্গি একটু কঠোর করে বললো।
….কেন? কেন মানবেন না? এটা আমার জীবন। আমি যার সাথে খুশি তার সাথে মিশি। যার সাথে ইচ্ছা তার সাথে ঘুরে বেড়াবো। হাসি আনন্দ করবো। তাতে আপনার কি? আপনি কেন আমার পার্সোনাল লাইফে ইন্টারফেয়ার করছেন? কেন?
নূরের এসব কথা শুনে আদিত্যের রাগ এবার চরম পর্যায়ে উঠে গেলো। আদিত্য অগ্নি চোখে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে নিজের হাত মুঠ করে নূরের মাথার কাছে দেয়ালে একটা ঘুষি মেরে উচ্চস্বরে বলে উঠলো।
……..কজ “আই লাভ ইউ ” ড্যাম ইট।
নূর যেন স্তব্ধ হয়ে গেলো। শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা শীতল বাতাস বয়ে গেলো। ওর কানে শুধু আদিত্যের বলা কথাটাই বাজতে লাগলো।
“আই লাভ ইউ” “আই লাভ ইউ” “আই লাভ ইউ”। মনে হচ্ছে পুরো ক্লাসে কথাটা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
আদিত্য দুই হাতে নূরের মুখটা ধরে নূরের কপালের সাথে নিজের কপাল ঠেকিয়ে লো ভয়েসে আবেগ মিশ্রিত কন্ঠে আবারও বলে উঠলো।
….ইয়েস আই লাভ ইউ। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি শুধু আমার। একান্তই আমার। তাই তোমাকে আমি অন্য কোনো ছেলের পাশে সহ্য করতে পারবো না। কিছুতেই না।
নূরের এখন চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে।চোখ বন্ধ করে মনে মনে ভাবছে, আমি যেই ভয়টা পেয়েছিলাম সেটাই হলো। উনি কেন আমাকে আজ এই কথাটা বললো? এখন আমি কি করবো? কিভাবে নিজেকে সামলাবো? কিভাবে?
নূরের ভাবনার মাঝেই আদিত্য আবার বলে উঠলো।
….আমার জবাব পেয়ে গেছতো? এখন বলো ছেলেটা কে ছিল? দেখ আমি ইচ্ছা করলেই দুই মিনিটের ভেতরই ছেলেটার সব ডিটেইলস যেনে যেতে পারবো। কিন্তু সেটা তখন ছেলেটার জন্য খুব একটা সুখকর হবে না। তখন কিন্তু আমাকে কিছু বলতে পারবে না। তাই যা বলবে জলদি বলো।
নূর এবার অনেক ভয় পেয়ে গেল। তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো।
….উনি আকাশ ভাইয়া। আমার চাচার ছেলে। উনি আমাকে নিজের ছোট বোনের মতোই ভালোবাসে। আর আমিও উনাকে বড়ো ভাইয়ের মতোই মানি।
আদিত্য এতক্ষণে একটু শান্ত হলো। চোখ মুখ স্বাভাবিক করে বললো।
….তো এই কথাটা বলতে এতো সময় লাগে? আগে বললেই তো হয়ে যেতো। শুধু শুধু আমার রাগ বাড়াচ্ছিলে। যাইহোক বাদ দেও এখন।
তারপর আদিত্য একটু মুচকি হেসে নূরের কপালে নিজের ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে গভীর ভাবে একটা চুমু দিয়ে দিলো।
সাথে সাথে নূরের সারা শরীর শিরশির করে কেঁপে উঠলো। দুই হাত দিয়ে নিজের কামিজ চেপে ধরলো।
আদিত্য চুমু দিয়ে বলে উঠলো।
….এখন ক্লাসে যাও। আমি কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে ওয়েট করবো। ক্লাস শেষে ওখানে চলে এসো।
কথাটা বলেই আদিত্য ওখান থেকে চলে গেলো।
আদিত্য চলে যেতেই নূর ধপ করে নিচে বসে পরলো। নিজের হাতটা কপালে নিয়ে আদিত্যের চুমু দেওয়া স্থানে ছোঁয়াতে লাগলো। তারপর হাতটা আবার চোখের সামনে এনে হাতের দিকে তাকিয়ে নিরবে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো।
….কেন করলেন এমনটা? কেন আমাকে ভালোবাসলেন? আমাকে ভালোবাসা যে একদম ঠিক না। আমি যে কারোর ভালোবাসার যোগ্য না। আমাকে ভালোবাসলে আপনার জীবনে শুধু অমঙ্গলই হবে।
নূর নিজের চোখের পানি মুছে নিয়ে মনে মনে বললো। আমাকে দূর্বল হয়ে পরলে চলবে না। আমাকে শক্ত হতে হবে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটাতে অটল থাকতে হবে। কিছুতেই সেটা ভুলে গেলে চলবে না। নিজের স্বার্থের জন্য উনার জীবন বিপদে ফেলতি পারনা আমি।কখনোই না। কথাগুলো ভেবে নূর নিজেকে শক্ত করে উঠে দাড়ালো। তারপর ক্লাস থেকে বেড়িয়ে এলো। বাইরে এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো আদিত্য কোথাও আছে কিনা। আদিত্য কোথাও দেখতে না পেয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো নূর। তারপর দ্রুত ক্যাম্পাস থেকে বেড়িয়ে চলে গেলো। আদিত্যের সামনে আর পরতে চায়না নূর।
—————————————
আদিত্য একঘন্টা ধরে বসে আছে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে। কিন্তু নূরের আসার কোনো খবর নেই। আদিত্য আর থাকতে না পেরে ফোন বের করে নূরের নাম্বারে ফোন দিল। কিন্তু নূরের নাম্বার বন্ধ আসছে। আদিত্যের এবার চরম রাগ হতে লাগলো। মেয়েটার হয়েছেটা কি? এমন করছে কেন? আজতো আমি আমার মনের কথাও ওকে বলে দিলাম। তারপরও এমন করছে কেন? এসব ভেবে আদিত্যের ভেতর প্রচন্ড অস্থির হয়ে উঠছে। আদিত্য আর বসে না থেকে বাইরে বেড়িয়ে এলো।
বাইরে এসে দেখলো আবির আর তাসির দাঁড়িয়ে আছে। আদিত্যকে আসতে দেখে তাসির ভ্রু কুঁচকে বললো।
….কিরে চলে এলি যে? নূর আসেনি?
আদিত্য মাথা ঝাকিয়ে বললো।
….না আসেনি। আর ফোনটাও বন্ধ আসছে। জানিনা কি হয়েছে মেয়েটার? কেমন যেন আজব বিহেব করছে।
তাসির আদিত্যের কাঁধে হাত দিয়ে আস্বস্ত করে বললো।
….আরে চিন্তা করিস না। হয়তো কোনো টেনশনে আছে। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।
আদিত্য আবিরের দিকে তাকিয়ে বললো।
….তুই একটু তানিকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতো, নূর কোথায় আছে?
আবির মাথা ঝাকিয়ে বললো।
…ঠিক আছে ভাই।
আবির তানির নাম্বারে ফোন দিয়ে কথা বললো। কথা বলা শেষে আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বললো।
….ভাই তানিতো বলছে।নূর নাকি আজ ক্লাসেই আসেনি।
আদিত্য ভ্রু কুঁচকে একটু উচ্চস্বরে বলে উঠলো।
….ওয়াট???কি বলছিস এসব? আমি নিজে সকালে ক্লাসের আগে নূরের সাথে কথা বললাম। তাহলে ও ক্লাসে যাইনি কেন?
আবির ঠোঁট উল্টে বললো।
….কি জানি ভাই? তানিতো এটাই বললো।
আদিত্যর এবার মনে মনে সন্দেহ হচ্ছে। নিশ্চয় নূরের কিছু একটা হয়েছে। যার জন্য ও এমন করছে। কিন্তু কি হয়েছে? মেয়েটা তো কিছু বলছেও না।
আবির বলে উঠলো।
….ভাই আমাদের এখন যাওয়া উচিৎ। তোর আবার শরীর খারাপ করতে পরে।
আদিত্য একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা ঝাকালো। মানে ঠিক আছে।
—————————————
রাত ৯ টা
আদিত্য অস্থির ভাবে সারাঘর পায়চারী করছে। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না ও।নূরের ফোন এখনো বন্ধ আসছে। কি হয়েছে নূরের, কেন এমন করছে কিছুই বুঝতে পারছে না আদিত্য। ভেবেছিল আজ কথা বলে সবকিছু সর্ট আউট করে ফেলবে। কিন্তু সেটাও হলো না। আচ্ছা, মেয়েটা কি কোনো সমস্যায় পড়েছে? এসব নানান কথা ভেবে টেনশনে আদিত্যের মাথা ফেটে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে সবকিছু ভেঙে গুড়িয়ে ফেলতে। টেনশনে আদিত্য রাতের খাবার টাও খাইনি।
নাহ আর থাকতে পারছে না আদিত্য। এভাবে আর কতক্ষণ থাকলে হয়তো ও দম বন্ধ হয়ে মরে যাবে। আদিত্য হঠাৎ কোনো কিছু না ভেবে গাড়ির চাবি নিয়ে বেড়িয়ে পরলো।
যাওয়ার সময় বাসার সবাই পেছন থেকে অনেক ডাকাডাকি করলো, কিন্তু আদিত্য কারোর কথা না শুনে বেড়িয়ে পরলো।
আদিত্য ফুল স্পিডে গাড়ী চালিয়ে, সোজা নূরের বাসার সামনে এসে ব্রেক করলো। গাড়ি থেকে নেমে নূরের বাসার দিকে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে একবার ভাবলো নূরের বাসার ভেতর ঢুকে যাবে। আবার এটা ভেবে থেমে গেল যে নূরের সৎ মা দেখে ফেললে নূরের জন্য প্রবলেম হতে পারে। আদিত্য কতক্ষণ অস্থির ভাবে এদিক ওদিক পায়চারী করতে লাগলো। আবার নূরের বাসার জানালা আর বেলকনির দিকে তাকাতে লাগলো। যদি নূরকে দেখতে পায় সেই আসায়। কিন্তু না নূরকে কোথাও দেখতে পেল না আদিত্য। হতাশ হয়ে আবার গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়িতে বসে সিটের সাথে হেলান দিয়ে বসে নূরের বাসার জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো।
নূর শুয়ে শুয়ে আজকের আদিত্যের বলা কথাগুলো ভাবছে আর চোখের পানি ফেলছে। নিজেকে আজ সবচেয়ে বেশি অসহায় মনে হচ্ছে ওর।
কিছুক্ষণ পর নূর চোখ মুছে উঠে বসলো। তারপর জানালার কাছে যেয়ে পর্দাটা হালকা সরিয়ে বিষন্ন মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো।
হঠাৎ নূরকে জানালায় দেখতে পেয়ে আদিত্য খুশি হয়ে গেলো। আদিত্য গাড়ি থেকে নেমে হাত উঁচু করে নাড়িয়ে নূরের দৃষ্টি আর্কষণ করতে চাইলো। কিন্তু নূর সেটা টের পেলো না। আদিত্য জোরে ডাকও দিতে পারছে না। লোকজন দেখলে নূরের বদনাম হতে পারে এটা ভেবে।
কতক্ষণ নাড়াচাড়া করার পরও যখন নূর সারা দিলোনা, আদিত্য তখন হাল ছেড়ে দিয়ে আবারও গাড়ির ভেতর বসে রইলো। গাড়ির ভেতর বসে বসেই নূরকে দেখতে লাগলো।
চাঁদের আলোয় দূর থেকেও নূরকে দেখতে কতো সুন্দর লাগছে। আদিত্যের মনের অস্থিরতাটাও এখন একটু কমেছে। এভাবে নূরকে দেখতে দেখতে একসময় গাড়ির ভেতরেই ঘুমিয়ে পরে আদিত্য।
সকাল বেলা নূর রেডি হয়ে বেড়িয়ে গেলো ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। মন মরা হয়ে রাস্তার আইলেন দিয়ে হেটে যাচ্ছে। হাটতে হাটতে বাসা থেকে অনেকটা দূরে আসতেই হঠাৎ ওর পাশে একটা গাড়ি এসে থামে। নূর একটু ঘাবড়ে দুই পা পিছিয়ে যায়। সামনে তাকিয়ে দেখে আদিত্যের গাড়ী। এটা দেখে নূর চমকে যায়।
আদিত্য ঝট করে গাড়ি থেকে নেমে নূরের কাছে এসে শক্ত করে নূরের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় গাড়ির কাছে। তারপর দরজা খুলে নূরকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর নিজে দ্রুত যেয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দেয়।
আদিত্য রাতে গাড়িতেই ঘুমিয়ে ছিল। সকাল হতেই গাড়িটা ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। আর নূরের জন্য ওয়েট করতে থাকে।
আচমকা এসব হওয়ায় নূর কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। আদিত্যের দিকে তাকিয়ে দেখে আদিত্যকে কেমন যেন বিধ্বস্ত লাগছে। চুলগুলো এলোমেলো চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে প্রচন্ড পরিমাণ রেগে আছে। নূর মনে মনে প্রচুর ভয় পেলেও উপরে উপরে একটু সাহস দেখিয়ে বললো।
….কো কোথায় নিয়ে যাচ্ছ……
নূর আর কিছু বলতে পারে না। তার আগেই আদিত্য নূরের দিকে অগ্নি চোখে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো।
…..সাট আপ। নট এ্যা সিঙ্গেল ওয়ার্ড। চুপচাপ বসে থাকো। নাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেও হবে না।
আদিত্যের রাগের সামনে নূরের আর কিছু বলার সাহস থাকে না। অগত্যা চুপচাপ বসে থাকে। মনে মনে ভাবে দেখা যাক আর কি আছে আমার কপালে?
চলবে……..
(রিচেক করিনি।ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।)