#ওহে_প্রিয়
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২৬
___________
অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু প্রাপ্তি মানুষের জীবনকে যেমন বিকশিত করে তুলে তেমনি অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু অপ্রাপ্তিও মানুষের জীবনকে করে তুলে ক্লেশিত।
দুজন মানুষের সম্পর্কে যখন অত্যাধিক পরিমাণে জটিলতা তৈরি হয়ে যায় তখন সেই জটিলতা তাঁদের জীবনে নানারকম বিপর্যয় বয়ে আনে। সেই বিপর্যয়টি যদি হয় উপরওয়ালা কর্তৃক তাহলে তুচ্ছ মানুষ দের করার আর কিছুই থাকেনা। ভাগ্য যেমন মেনে নিতে জানতে হয় তেমন দূর্ভাগ্যকেও মেনে নেওয়াটাই শ্রেয়। কিন্তু বার বার দূর্ভাগ্যকে কি স্বীকার করে নেবে হ্যাভেন তালুকদার? আহিও কি পারবে তাঁর জীবনের ঘটে যাওয়া এতো বড় বিপর্যয় সহ্য করতে?
তীব্র ব্যাথায় পুরো চোখ,মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে আহির। দাঁত, মুখ খিঁচে শ্বাশুড়িকে জাবটে ধরে বসে আছে সে৷ রুবিনা তালুকদার গাড়ির পিছন সিটে আহিকে জরিয়ে ধরে বসে আছেন। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানেই হ্যাভেন, হ্যারি ছুটে এলো। হ্যারি ড্রাইভিং সিটে বসলো হ্যাভেন পিছন সিটে আহির পাশেই গিয়ে বসলো। সামনের গাড়িতে দুজন দেহরক্ষী এবং পিছনের গাড়িতে হিরা আসছে। ক্ষণে ক্ষণে আহি আর্তনাদ করে ওঠছে। হ্যাভেনের শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে। দু’মাস পিরিয়ড মিস গেছে অথচ আহি একটাবার তাঁকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি। তাঁকে না হোক তাঁর মা’কে জানাতে পারতো। এতো কেয়ারলেস কি করে হতে পারে মেয়েটা বুঝে আসছে না হ্যাভেনের। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে তাঁর। পুরো শরীরে প্রবল অস্থিরতা কাজ করছে। সেই প্রবল অস্থিরতা দরুণ শরীরে ঘাম ছেড়ে দিয়েছে তাঁর। যা বিপদ ঘটার ঘটে গেছে বুঝতে পেরে রুবিনা তালুকদারের শরীরও ঘামতে শুরু করলো। হ্যাভেন মায়ের দিকে এক পলক চেয়ে আহির বিধ্বস্ত মুখশ্রী দেখে আঁতকে ওঠলো। রক্তিম আভা ছেড়ে এবার নীল হতে শুরু করেছে মেয়েটা। কি পরিমাণ ব্যাথা সহ্য করছে মেয়েটা তাহলে ভাবতেই বুকের ভিতর অসহনীয় এক ব্যাথা অনুভব করলো হ্যাভেন। দু’হাতে কম্পন ধরে যেতেই এক ঢোক গিলে শুকনো গলাটা ভিজিয়ে নিলো। মায়ের দিকে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
-‘ আমি ধরছি ওকে তোমার কষ্ট হচ্ছে ছাড়ো ‘।
চশমার ফাঁকে ছেলের অসহায় মুখটা দেখতে পেয়ে বুকের ভিতর ভারী কিছু চেপে বসলো যেনো। আহিকে হ্যাভেনের দিকে দিয়ে গা এলিয়ে সিটে মাথা ঠেকিয়ে বসে চোখ দুটো বুজে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রুবিনা তালুকদার। হ্যাভেনের বুকে মুখ গুঁজে সমান তালে কাঁপছে আহি। হ্যাভেন তাঁকে অভয় দিতে তাঁর এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে আরেক হাত মাথায় বুলাতে শুরু করলো। আহি এবার বেশ শব্দ করেই কেঁদে ওঠলো। বারো মিনিটের মাথায় হসপিটাল পৌঁছালো তাঁরা। রুবিনা তালুকদার আহির সাথে কেবিনের ভিতরে রয়েছে বাইরে বসে হ্যাভেন ভিতরের অল্পস্বল্প আওয়াজ পাচ্ছে। দুহাত জোরা বেঁধে তাঁর ওপর মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে হ্যাভেন। হ্যারি ভাইয়ের পাশেই মাথা নিচু করে বসে আছে। হিরা হসপিটালের সামনেই ঘুরাঘুরি করছে। প্রায় এিশ মিনিট পর একজন নার্স কেবিন থেকে বেরিয়ে বললো,
-‘ স্যার আপনার ওয়াইফের বেবি মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। জরুরি ভিত্তিতে ওনার কিছু টেস্ট করিয়ে নেবেন ডক্টরের সাথে কথা বলে নিন ‘।
কেবিন থেকে একজন মহিলা ডাক্তার বেরিয়ে তাঁর নিজের কেবিনে চলে গেলেন। নার্স হ্যাভেনকে বললো তাঁর সাথে যেতে কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হ্যাভেন স্থির দৃষ্টিতে মেঝের দিকে যে চেয়ে আছে একটিবারের জন্যও নার্সের দিকে ফিরে তাকায়নি। হ্যারি নার্সকে ইশারা করে চলে যেতে বলতেই এক ঢোক গিলে নার্স চলে গেলো। হ্যারি ভাইয়ের দিকে ভয় ভয় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কাঁধে হাত রাখতেই ভিতর থেকে আহির চিৎকার শুনতে পেলো। ‘আমার বাচ্চা, আমার বাচ্চা ‘ বলেই চিৎকার করে কাঁদছে মেয়েটা।
পুরো পৃথিবী যেনো থমকে গেছে হ্যাভেনের। কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। পা দুটো অবশ হয়ে আসছে। বুক কাঁপছে রীতিমতো তাঁর, ঝিম ধরে যাচ্ছে মাথাটা। বার বার কানের ভিতর প্রতিধ্বনি হচ্ছে শুধু এটুকুই বাক্য,
-‘ স্যার আপনার ওয়াইফের বেবি মিসক্যারেজ হয়ে গেছে ‘।
পা থেকে মাথা অবদি কেমন ঝটকা লেগে সম্বিৎ ফিরে পেলো হ্যাভেন। পাশে চেয়ে হ্যারিকে এক পলক দেখে নিয়ে আবারো দৃষ্টি স্থির রাখলো মেঝেতে। ভিতর থেকে আহির ক্রন্দনধ্বনি তখনো ভেসে আসছে। দুহাতে চোখ, মুখ মুছে নিয়ে ওঠে দাঁড়ালো হ্যাভেন। হ্যারি ‘ভাইয়া’ বলে ডাকতেই হ্যাভেন ইশারায় তাঁকে বসতে বললো হ্যারি তাই করলো। হ্যাভেন আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো না হসপিটাল থেকে বেরিয়ে সোজা গাড়িতে গিয়ে বসলো। খুব স্পিডে গাড়ী স্টার্ট করেই রওনা হলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। রুবিনা তালুকদার হ্যাভেনের ওভাবে বেরিয়ে যাওয়ার কথা শুনে হ্যারিকে ধমকে বললো,
-‘ তুমি কি করে এমন দায়িত্ব জ্ঞানহীন হতে পারো হ্যারি? আমার ছেলে কতোটা দূর্বল প্রকৃতির তা কি তুমি ওর পরিবারের সদস্য হয়েও জানোনা? আমার ছেলেটা প্রথম ধাক্কা টা সামলে নিয়ে যেভাবে হোক টিকে আছে দ্বিতীয় ধাক্কা টা সে কি করে সামলে নেবে? তুমি এখুনি হ্যাভেনের কাছে ফিরবে এবং তাঁর অবস্থান দ্রুত জানাবে আমায় আমি এদিকটা সামলে নেবো আমার বোনের মেয়ে আসছে কিছুক্ষণের মাঝেই ‘।
-‘ আমি এখুনি যাচ্ছি বড় মা তুমি চিন্তা করোনা ‘।
হ্যারি আর দেরি করলো না তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে গেলো। রুবিনা তালুকদারের ছোট বোনের বড় মেয়ে রেশমি খানম একজন গাইনোকলজিস্ট। হ্যাভেন বাসা থেকে বের হওয়ার সময়ই তাঁকে ফোন করেছিলো। কিছুক্ষণ পূর্বেই সে রুবিনা তালুকদার কে ফোন করে জানিয়েছে সে বিশমিনিটের মধ্যেই পৌঁছাবে।
কাঁদতে কাঁদতে গলা ভেঙে গেছে মেয়েটার। পেট চেপে ধরে অশ্রু বিসর্জন দিয়েই যাচ্ছে। আর ভাঙা আওয়াজে ঠোঁট ভাঙিয়ে বলেই যাচ্ছে ‘আমার বাচ্চা, আমার বাচ্চা ‘।
রুবিনা তালুকদার আহির এ অবস্থা দেখে তাঁর পাশে বসে তাঁকে বুকে চেপে ধরে বললেন,
-‘ কেঁদো না মা আল্লাহর জিনিস আল্লাহ দিয়েছিলো আল্লাহই নিয়ে গেছে এভাবে ভেঙে না পড়ে নিজেকে শক্ত করো৷ আল্লাহ চাইলে আবারো দেবেন ‘।
হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলো আহি আবারো বললো,
-‘ আমার বাচ্চা, আমার বাচ্চা ‘।
একজন নারীর জন্য জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি মা হওয়া। মা-বাবা সহ পুরো পরিবার রঙিন স্বপ্নের জাল বুনতে থাকে নবাগত অতিথিকে নিয়ে। তবে একটি মিসক্যারেজ বা গর্ভপাত নিমিষেই সেই স্বপ্নকে ভেঙে দিতে পারে। হয়তো আহি বা হ্যাভেন কেউই এই বাচ্চা টা কে নিয়ে রঙিন স্বপ্নের জাল বুনতে পারেনি। কি করে বুনবে তাঁর আগমনী বার্তা যে কেউই টের পায়নি। আহি পেলেও বুঝতে পারেনি যে সেগুলো তাঁর ভিতরে কারো উপস্থিতি জানান দিচ্ছিলো। সব থেকে বড় আফসোস এটাই যে আহি একটি বারের জন্যও বুঝতে পারলো না সে প্র্যাগনেন্ট ছিলো। তাঁর গর্ভে হ্যাভেনের সন্তান এসেছিলো। এই সন্তানের উছুলায়ও তো হ্যাভেন আর তাঁর সম্পর্কে নতুন মোড় নিতে পারতো। মানুষটা সবাইকে অবজ্ঞা করতে পারলেও নিজ সন্তান আর নিজ সন্তানের মা’কে কখনোই অবজ্ঞা করতে পারতো না। ডুঁকরে কেঁদে ওঠলো আহি। রুবিনা তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে স্বান্তনা দিচ্ছিলো। এমন সময় ফোন বেজে ওঠলো তাঁর হ্যারির নাম্বার দেখে দ্রুত রিসিভ করতেই হ্যারি বললো,
-‘ বড় মা ভাইয়া বাসায় এসে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে জানালা দিয়ে দেখলাম মেঝেতে বসে আছে নিশ্চুপ হয়ে ‘।
-‘ তুমি আশেপাশেই থেকো ভাইকে দেখে রেখো বাবা’।
-‘ তুমি নিশ্চিন্তে থাকো এদিকটা আমি সামলে নেবো ‘।
.
প্রায় বিশ মিনিট নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে দুহাতে চোখ,মুখ আবদ্ধ করে চিৎকার করে ওঠলো হ্যাভেন। হ্যারি রুমের বাইরেই পায়চারি করছিলো আর ফোন টিপছিলো ভাইয়ের চিৎকার শুনতে পেয়ে চমকে ওঠে এগিয়ে গিয়েও আবার থেমে গেলো৷ এতোগুলো বছর পর আবারো তাঁর ভাইটাকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখলো সে। মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করে একাই ছেড়ে দিলো হ্যাভেনকে। কিন্তু সে আশেপাশেই রইলো যাতে কোন দূর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার আগেই তা থামাতে পারে।
গায়ের শার্টের বোতাম না খুলেই উল্টাপাল্টা টান দিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়লো হ্যাভেন। দৃষ্টি তাঁর ছাদের মেঝেতে স্থির। বুকের ভিতর কি যে অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে তা হয়তো পৃথিবীর কাউকেই বোঝাতে পারবে না সে৷ এ যন্ত্রণার ভয়াবহতা খুবই প্রখর। রূপসা যখন তাঁকে ছেড়ে গিয়েছিলো তখন তাঁর কষ্ট হয়েছে,যন্ত্রণা হয়েছে শেষে একরাশ ঘৃণা এসে সেই কষ্ট যন্ত্রণা গুলোকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দিয়েছিলো। প্রথম ধাক্কা টা সে পেয়েছিলো রূপসার থেকেই। ভালোবাসার মানুষের বিশ্বাস ঘাতকতা মেনে নিতে পারেনি। মানসিক আঘাতে ভেঙে পড়েছিলো অনেকটাই আজ এতোগুলো বছর পর এর থেকেও ভয়াবহ আঘাত তাঁর সমস্ত ইন্দ্রিয় নাড়িয়ে দিয়েছে। বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে পুরোনো সেই অপ্রাপ্তির কথাটা। রূপসার কাছে সে যখন একটা বাচ্চার আবদার করেছিলো তাঁদের ভালোবাসার বাগানে ফুল ফোটাতে চেয়েছিলো মেয়েটা স্বার্থপরের মতো ফিরিয়ে দিয়েছিলো তাঁকে। তখনও সে জানতোনা এই স্বার্থপরতা একসময় বেঈমানীতেও রূপ নিয়ে তাঁকে ধ্বংস করে দেবে। হ্যাভেন আজ মানসিক রোগি, পাষণ্ড হৃদয়ের অধিকারী, শুধু আহির ভাষায় নয় আরো বহুপরিচিত মানুষের ভাষায় সে একজন নিকৃষ্ট মনের মানুষ। আজ তাঁর কারো প্রতি নেই কোন দূর্বলতা। নেই কোন আবেগ নেই কাউকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। ঐ আহির প্রতিও তাঁর বিন্দুমাত্র ভালোবাসার জন্ম নেয়নি। কিছু জেদের বশীভূত হয়েই মেয়েটার জীবনে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করেছিলো সে। সে নিকৃষ্ট, সে পাষাণ। সে খুব খারাপ একজন মানুষ সবটা স্বীকার করছে সে। তাঁর সবটা খারাপ সে স্বীকার করে নেবে। তাঁর করা সব ভুলের জন্য ঐ আহির দু’পা আঁকড়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে নিবে। জোর করে তাঁকে বিয়ে করার দায়ে আজীবন জেল খাটবে। সংসদ সদস্য পদ থেকেও পদত্যাগ করবে। সব ধরনের শাস্তি মাথা পেতে মেনে নেবে সে তবুও তাঁর অংশকে এভাবে নিঃশেষ হতে দিতে পারবে না। সব কিছুর বিনিময়ে হলেও তাঁর বাচ্চা টা কে চাই। পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ স্বামী পাওয়া যাবে কিন্তু একটাও খারাপ বাবা পাওয়া যাবেনা। সে খারাপ, সে জঘন্যতম একজন মানুষ তবুও সে তাঁর অংশকে অস্বীকার করতে পারবেনা। বাবা ডাক শোনার লোভও সামলাতে পারবেনা। মেনে নিতে পারবেনা তাঁর সন্তানের আগমনী বার্তা শোনার আগেই তাঁর নিঃশেষ হওয়ার বার্তা। কখনোই পারবেনা কখনোই না। দুচোখ ভরে অশ্রুপাত ঘটতে শুরু করলো হ্যাভেনের। চিৎকার করে বলতে থাকলো ‘আমার ওকে চাই, আমার বাচ্চা টাকে দিতেই হবে তোমায় আহি। যে কোন মূল্যেই হোক ওকে দিতে হবে তোমায়। আমি আমার সব অপরাধের শাস্তি ভোগ করতে রাজি আছি কিন্তু তাঁর বিনিময়ে আমার বাচ্চা টাকে তোমায় দিতেই হবে ‘।
শোয়া থেকে ওঠে পুরো ঘরের আসবাবপএ ভাঙচুর করতে শুরু করলো হ্যাভেন। আর চিৎকার করে পাগলের মতো প্রলাপ করতে থাকলো। মন কে সে কিছুতেই বোঝাতে পারছেনা তাঁর সন্তান আহির গর্ভে অল্পসময়ের জন্য এসেছিলো। কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা সবটা হ্যাভেন। বার বার মনে হচ্ছে এই সন্তানের প্রতি সবচেয়ে বেশী অবহেলা আহিই করেছে। তাঁর প্রতি রাগ, ঘৃণা থেকেই ইচ্ছে করে সন্তান কে পৃথিবীতে আনতে চায়নি সে। জোর করে বিয়ে করে জোর করে তাঁর সাথে সংসার বাঁধাতে ইচ্ছে করেই এতো বড় শাস্তি তাঁকে দিলো আহি। কারণ তাঁর একমাত্র দূর্বলতাকেই হাতিয়ার বানিয়েছে আহি। ভাঙচুর থামিয়ে কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে বিরবির করে বলে ওঠলো,
-‘ এজন্যই এতো পরিবর্তন দেখিয়েছিলে তুমি তাইনা? এভাবে আঘাত করার জন্যই এ’কদিন মুখোশ পড়ে ছিলে? একটা নিষ্পাপ প্রাণ কে হত্যা করলে? হত্যাকারী! আমার সন্তানের হত্যাকারী তুমি কখনোই ক্ষমা করবো না তোমায় আমি। এই বিয়েটার জন্যই এতো সমস্যা তো? মুক্তি দিয়ে দেবো তোমায়। যে সম্পর্কের ওপর ঘৃণা বজায় রেখে আমার সন্তান কে হত্যা করলে সেই সম্পর্কই শেষ করে দিব আমি। চাইনা কিছু আমার কিচ্ছু চাইনা আমি ‘।
মাথা চেপে ধরে নিচে বসে পড়লো হ্যাভেন। তাঁর মাথায় শুধু একটা কথাই চলতে থাকলো, হয় আহি তাঁকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে পারেনি বলেই সন্তানকেও গ্রহণ করতে পারেনি নয়তো ইচ্ছে করেই বাচ্চা টাকে গর্ভে ধারণ করে মেরে ফেলেছে। একটা মেয়ে সন্তানসম্ভবা হবে অথচ টের পাবেনা তা কি করে সম্ভব? আবারো ওঠে দাঁড়ালো হ্যাভেন। আশেপাশে তাকিয়ে বিছানার পাশে ফোন দেখতে পেয়ে সেটা পকেটে গুঁজে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো। দরজার সামনেই মুখোমুখি হলো হ্যারির। হ্যাভেনের রক্তিম দু’টো চোখ হ্যারির বুকে তীরের ন্যায় আঘাত করলো। হ্যাভেন তাঁকে পাশ কাটিয়ে নিচে নামতে থাকলো। হ্যারিও পিছন পিছন নামতে শুরু করলো। হ্যাভেন গাড়ির দরজা খোলার সময় হ্যারি ছুটে এসে বললো,
-‘ ভাইয়া আমি ড্রাইভ করছি তুমি পারবে না ‘।
সত্যি হয়তো পারবেনা মানসিক শারীরিক দু’দিকেই বেশ ভেঙে পড়েছে সে। তাই কথা না বাড়িয়ে অপরপাশে গিয়ে বসে পড়লো। হ্যারিও ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
____________
রেশমি সমস্ত রিপোর্ট দেখে আহিকে বেশ বকাঝকা করতে শুরু করলো। এমপির ওয়াইফ হিসেবে অন্যান্যরা হয়তো তাঁকে খুব সম্মান করে এবং কিছু বলার সাহস পায়না। কিন্তু রেশমি হ্যাভেনের খালাতো বোন এবং সিনিয়র বোন তাই ভুল করায় শাসন করতে সে পিছু পা হলো না। প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে তাঁর। সাধারণ পেশেন্ট হলে বিষয়টা এড়িয়ে যেতো কিন্তু আহি সাধারণ নয় সে তাঁর পরম আত্মীয়, ছোট ভাইয়ের ওয়াইফ। বাচ্চাটা তাঁরই ভাইয়ের অংশ ছিলো। বেশ ক্ষিপ্ত হয়েই সে বললো,
-‘ আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি তোমরা দুজনই ম্যাচিওর এবং শিক্ষিত তোমরা এতোবড় ভুল কি করে করতে পারো? হ্যাভেনের কথা বাদ দিলাম সে পুরুষ মানুষ তোমার পিরিয়ড ডেট সে মাথায় নিয়ে ঘুরবেনা নিশ্চয়ই? এ ব্যাপারে সচেতন তোমার থাকা উচিত ছিলো৷ বিবাহিত তুমি, স্বামীর সাথে ইন্টিমেট হচ্ছো, দুমাস পিরিয়ড মিস গেছে স্কুল পড়ুয়া মেয়েরাও বুঝে বিবাহিত মেয়েদের দু’তিনমাস পিরিয়ড মিস যাওয়ার মানেটা আর তুমি বুঝোনি? দেড়মাসের প্র্যাগনেন্ট ছিলে তুমি। এ অবস্থায় জ্বরেরধাক্কা সেই সাথে এতো এন্টিবায়োটিক খেয়েছো এ’কদিন মিসক্যারেজ হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। বাচ্চা নেওয়ার জন্য যদি প্রস্তুত নাই ছিলে তাহলে দুজনেরই সচেতন থাকা উচিত ছিলো। ভুলবশত বাচ্চা টা এসে গেলেও সেটা টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব ছিলো একমাত্র তোমার। একটা মিসক্যারেজ মানে বুঝো? কি অদ্ভুত বাচ্চা এসে বাচ্চা মিসক্যারেজ হয়ে যাওয়ার পর মা জানছে সে সন্তান সম্ভবা ছিলো। এমন আপডেট যুগে এমন ঘটনা কতোখানি দুঃখজনক বুঝতে পারছো ‘?
হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলো আহি। রাগ হচ্ছে নিজের ওপর তাঁর কেনো সে একটিবার তাঁর শ্বাশুড়ি কে জানালো না। কেনো সে সেদিন বৃষ্টি তে ভিজতে গেলো। সেদিন না সে বৃষ্টি তে ভিজতো আর না তাঁর মারাত্মক জ্বর হতো আর না এই বাচ্চা টাকে সে হারাতো। তাঁর করা কয়েকটা ভুলের মাশুল এভাবে সন্তান হারিয়ে দিতে হবে যা তাঁর অভাবনীয় ছিলো।
রেশমির কথা গুলো দরজার বাইরে থেকে হ্যাভেন শুনতে পেয়ে ভিতরে ঢুকলো। তাঁর বিক্ষিপ্ত রূপ দেখে ভয়ে কলিজা শুকিয়ে গেলো রুবিনার। আহিও ভয়ে নিজেকে কেমন গুটিয়ে নিয়ে রুবিনাকে শক্ত করে দুহাতে আঁকড়ে ধরলো।
-‘ মিসক্যারেজ হয়ে যাওয়ার পর না আগে থেকেই সে জানতো আপু। আসল অপরাধী আমি! আমিই তাঁকে জোর করে বিয়ে করেছিলাম। আর এটাই ছিলো আমার জীবনের করা শ্রেষ্ঠ ভুল। তাই তো সেই ভুলের শাস্তি স্বরূপ আমার সন্তান কে পৃথিবীর আলো দেখতে দিলো না সে। বাবা হওয়ার মতো পরম সৌভাগ্যকে গ্রহণ করতে দিলো না সে আমায়। আমি অপরাধী তাই এর বিনিময়ে শ্রেষ্ঠ শাস্তি সে আমায় দিয়ে দিয়েছে। আর আমি তাঁকে দেবো তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার ‘। ভাঙা আওয়াজে কথা গুলো বলেই আহির দিকে তাকালো হ্যাভেন।
রেশমি আহির পাশ থেকে ওঠে গিয়ে হ্যাভেনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো,
-‘ এসব কি বলছিস ভাই ‘?
রুবিনা তালুকদারের বুকে মুখ গুঁজে ডুঁকরে কেঁদে ওঠলো আহি। হ্যাভেন ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের দুহাত শক্ত মুঠ করে ফেললো। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তাঁর । কোনরকমে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নিয়ে মায়ের উদ্দেশ্য বললো,
-‘ তাঁকে বলে দিও এই জোর করে বিয়ের সম্পর্কে তাঁকে আর বেঁধে রাখবো না আমি৷ বিনা অনুমতি তে তাঁর জীবনে প্রবেশ করায় শাস্তিস্বরূপ অনেক বড় উপহার আজ দিয়ে দিলো সে আমায়৷ ডিভোর্সের বন্দোবস্ত আমিই করবো সে যেনো তাঁর নিজের বাড়ি ফিরে যায়।আমার বাড়ির ত্রিসীমানায়ও আমার সন্তানের হত্যাকারীকে আর দেখতে চাইনা আমি ‘।
চলবে..