এক চিলতে রোদ পর্ব-৪৯+৫০

0
980

#এক_চিলতে_রোদ
#Writer_Nondini_Nila
#Part_49

কতোক্ষণ ভাইয়ার বুকে ছিলাম জানিনা।দরজা ধাক্কা ধাক্কিতে সেটা ভঙ্গ হলো। লতার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে ভাইয়া বিরক্ত হয়ে সরে বসলো। আমি উঠে দরজা খুলে দিলাম।

‘তারাতাড়ি নিচে আয়।’

আমি ভয় পেয়ে বললাম, ‘ কেন কি হয়েছে?’

লতা ভেতরে ঢুকে পরলো। ভাইয়ার সামনে এসে বললো,

‘ ভাইজান। আপনার খালা এসেছে।’

‘ খালা?’

লতা দাঁড়ালো না। যে ভাবে এসেছিলো সেভাবেই চলে গেছে।
আমিও লতার পেছনে পেছনে নিচে চলে এলাম। ড্রয়িং রুমে এক পাশে আমি আর লতা দাঁড়িয়ে আছি। সোফার একপাশে চাচি আর তার সাথে ইহান ভাইয়ের ছোট খালা বসে আছে। আর একটা ছেলে শ্যামলা বর্ণের। এটা ইহান ভাইয়ের ছোট খালার ছেলে।বিয়েতে আসে নি।আসবে কি করে তখন তো থানায় ছিলো। ছেলেটা একদম ভালো না শুনেছি। মেয়েদের ডিস্টার্ব করার জন্য আর মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পরে থাকার জন্য পুলিশ নিয়ে গেছিলো ধরে। এখন হঠাৎ একে নিয়ে খালামনি এখানে হাজির কেন?

ছেলেটা মাথা নিচু করে বসে আছে। শুকনো ছেলেটা চোখের পার কালো। মাতাল দের অবস্থা এমনই হয় বুঝি।
ছেলেটা এমন ভাবে বসে আছে। কেউ অভদ্র বলতে পারবেনা। খুব ভদ্র ছেলেদের মতো বসে আছে।
চাচি আর খালার কথা শুনে বুঝতে পারলাম কেন এসেছেন!
উনার ছেলেকে ওনাদের পাড়া থেকে তারিয়ে দিয়েছে। সেখানে থাকলেই আবার পুলিশের কাছে দেবে বলেছে। কারণ জেল থেকে বেরিয়ে একটা মেয়ের সাথে বাজে আচরণ করেছে‌। তাই ছেলেকে নিয়ে এখানে এসেছে কিছু দিন রাখতে।

‘তোর এই বাজে ছেলেকে আমি কেমনে রাখি বলতো‌? এখানে ও যদি কোন আকাম করে তাহলে তো আমার মান সম্মান সব যাবে।’

খালা চাচির হাত ধরে বললো,’ আপা প্লিজ ওকে তোমার বাসায় রাখো। আমি খুব বিপদে পড়ে এসেছি। আমি তো তোমার বোন আমাকে সাহায্য করবে না।’

চাচি কে খুব মিনতি করতে লাগলো। চাচি কি করবে বুঝতে পারছে না। মনে মনে সে এই বোনকে খুব গালাগালি করছে।
কিন্তু মুখে তা বলতে পারছে না। যতই হোক এটা তার নিজের বোন।বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও এই খারাপ বজ্জাত ছেলেকে নিজের কাছে রাখতে হবে। এখানে সে যদি কোনো গন্ডগোল করে না এটা কি চাচি পুলিশে দিয়ে দেবে ভাবলো।
চাচি শেষমেষ রাজি হলো। ইহান ভাই আবার ঝামেলা করলো। তিনি কিছুতেই ওনাকে এ বাড়ি রাখবে না।

‘আম্মু তুমি কিভাবে রাজি হতে পারলে? আমাদের বাড়িতে ও মেয়ে আছে ও যদি তাদের সাথে অসভ্যতামি করে।’

রেগে বলল। খালা এগিয়ে এসে ইহান ভাইয়াকে বললো,

‘আমি কথা দিচ্ছি। এখানে আর কোন ঝামেলা করবে না ও। তোরা শুধু কিছুদিন ওকে এখানে রাখ।’

‘ তুমি কথা দিলে কি হবে? তোমার ছেলেকে আমার এক দন্ড বিশ্বাস হয় না। এখানে থাকলে যদি কোন সমস্যা হয়?’

‘তোরা যদি এখনো আমাকে সাহায্য না করিস। ওকে নিয়ে কোথায় যাবো ওর বাবা তো ওকে বাসাতেই ঢুকতে দেবেনা।’

ভাইয়া রেগে মেগে রুমে চলে গেল।চাচি শেষমেষ তার বোনের ছেলেকে রেখেই দিলো। সবাই খাবার খেয়ে নিয়েছে ভাইয়া নিচে আসে নাই। ফারিয়া গেছিলো ডাকতে দরজা আটকানো তাই চলে এসেছে।আমাকে বলেছিল আমি যাইনি। ব্যর্থ হয়ে ফারিয়া একাই খেয়ে নিল আজকের। সবার খাওয়া শেষ হলে আমি ভাইয়ার জন্য খাবার নিয়ে উপড়ে আসলাম। দরজা খোলা ছিল আমি ভেতরে ঢুকতেই ভাইয়া বললো,

‘খাবার রেখে আয়। আমি খাব না!’

আমি শুনলাম না। খাবার নিয়ে ভাইয়ার সামনে এসে দাড়িয়ে বললাম,

‘আমিও কিন্তু খাইনি!’

‘তোকেও খেতে হবে না।’

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। আমাকেও খেতে মানা করছে। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

‘আমি কিন্তু খিদে সহ্য করতে পারিনা।’

‘আরে রেখে আয় না।’

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে কপাট রাগ দেখিয়ে চলে এলাম। আমি না খেয়ে আমি শুনেও আমাকে খেতে বললো না। আমি খিদে সহ্য করতে পারিনা জেনেও। খুব কষ্ট পেলাম। আর ভাইয়ার কাছে গেলাম না। খাবার রেখে আমি আমি নিজের রুমে এসে শুয়ে পড়লাম। চোখ নিয়ে টপটপ করে পানি পরছে। আমি কাঁদছি। ভাইয়া এইভাবে বলতে পারলো।
ওইভাবে কখন ঘুমিয়ে পরেছি জানিনা।

বারোটার পনেরো মিনিট আগে ভাইয়া আমার রুমে এলো। দরজা আমি বন্ধ করে ঘুমায় না তাই নিঃশব্দে রুমে ঢুকে পরলো।
ইহান রুমে ঢুকে দেখে জানালা খোলা তাই রুমে আরো এসে পরছে। ইহান ওই আলোতেই ঊষার কাছে চলে এলো। বাচ্চাদের মতো করে ঘুমিয়ে আছে। ঊষার মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে নিচু হয়ে ইহান ঊষার কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো।
ঊষাকে ওইভাবেই কোলে তুলে নিলো।

আমি ঘুমের অনুভব করেছি কেউ আমাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। আমাকে শূন্যে ভাসাচ্ছে। আমি চমকে চোখ মেলে তাকালাম। অন্ধকারে আমি দেখতে পেলাম এটা ভাইয়া। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। কিন্তু সাথে ছুটাছুটি করতে লাগলাম। তখনকার কথা মনে পরতেই।

‘আরে এমন করছিস কেন?’

আমি বললাম,’ ছারুন আমাকে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’

‘ তুই চোখ বন্ধ করে থাক। একটু পর দেখতে পাবি কোথায় নিয়ে যাচ্ছি।’

‘ না আমি চোখ বন্ধ করবো না। আমাকে নামান। আমি কোথাও যাব না।’

‘কেন রাগ করেছিস?’

‘ বলবো না। আপনার তো কিছু আসে যায় না। আপনি আমার চিন্তা একটুও করেন না।’

‘ কোথায় করলাম না?’

‘ এতো দিন এতো এতো ভালোবাসা দেখিয়েছেন। কেয়ার করেছেন। আর আজ যখন আমি বললাম ভালোবাসি তখন থেকে আমাকে হেলা করছেন! কথায় আছে ছেলেদের ভালোবাসি বলতে হয়না। তাহলে তাদের রং পাল্টে যায়।’

‘ তোর মনে হচ্ছে আমার ভালোবাসা কমে গেছে‌।’

আমি মন খারাপ করে বললাম, ‘ মনে হ‌ওয়ায় কি আসে যায়। করেই তো গেছে না হলে আমি খিদে সহ্য করতে পারিনা জেনে ও আপনি না খাইয়ে শান্ত হয়ে থাকতে পারতেন।’

অন্ধকারে ভাইয়া আমার গালে চুমু খেলো। আমি আরো রেগে গেলাম।

‘ আচ্ছা রাগ করেই চোখ অফ কর।’

‘ আমি কিছু করবো না নামান।’

ভাইয়া নামিয়ে দিলো ফট করেই। আমার নেমে আরো রাগ হলো। বললাম তাই নামিয়ে দিতে হবে। ভালোবাসা সত্যি কমে গেছে। আমার আরো কষ্ট হতে লাগলো। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। ভাইয়া তার পকেট থেকে রুমাল বের করে ফট করেই আমার পেছনে গিয়ে আমার চোখ বেঁধে দিলো। আমি চমকে উঠে বললাম,

‘ কি করছেন কি? ‘

ভাইয়া বললো,’ চুপ কোন কথা না। তাহলে মুখ ও বেঁধে দেবো।’

আমি চুপ করে গেলাম। ভাইয়া আবার আমাকে পাঁজ কোলে তুলে নিলো। আমি কি হচ্ছে বুঝতে পারছি না।ইহান ছাদে এসে থামলো।
আমাকে ভাইয়া কোথায় নামালো জানিনা। চোখ মেলে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম।

আমার চোখের সামনে চকলেট কেক। আর সেখানে লেখা Happy Brithday My Love ইংরেজি। আজকে আমার জন্ম দিন। আর আমার মনে ছিলো না। আমি অবাক হয়ে ভাইয়ার দিকে তাকালাম। ভাইয়া আমার পেছনে থেকে জরিয়ে ধরলো।

‘ আমার জন্মদিন আমি ভুলে গেছিলাম।’

‘তোর সব আমার মনে থাকলেই হবে।এবার কেক কাট তারাতাড়ি।এই যে দেখ বারোটা বেজে গেছে কথা পরে বলিস।’

আমি হাত নাড়াতে পারছি না। জীবন কখনো আমি কেক কাটিনি।কেক খেয়েছি কিন্তু নিজের জন্মদিন কেকের সৌভাগ্য আমার হয়নি। ইলা ইমা আপুর জন্মদিনে করা হয়েছে বড় করে। তখন কেক খেয়েছি। নিজের জন্মদিনে কোন ভাবে উদযাপন করা হয়নি কখনো। শুধু ইমা আপু আমাকে কিছু না কিছু গিফট দিয়েছে এই যা। আমার ভাবনার মধ্যে ইহান ভাইয়া আমার কোমর থেকে নিজের হাত উঠিয়ে আমার ডান হাত ধরে চাকু হাতে নিলো আর বললো ফূ দে। আমার চোখ ছলছল করছে আমার সপ্নের মতো লাগছে আমি নিচু হয়ে ফূ দিলাম কিন্তু নিভছে না। আমি উত্তেজনায় ভালো করে দিতে পারছি না। কাঁপছি ভাইয়া ও আমাকে সাহায্য করলো‌। আর মুখে বলতে লাগলো হ্যাপি বার্থডে টু ইউ ঊষা রানী।আমাকে ধরেই কেক কেটে আমার মুখে ঢুকিয়ে দিল। আমি কেকের দিকে তাকিয়ে আছি‌‌।
ভাইয়া আমার সামনে চলে এসেছে আর নিজের মুখ পেতে বলে,

‘ আমাকে খাওয়াবি না।’

আমি কিছু বললাম না। ভাইয়া বললো,

‘ তোর জন্মদিন বলে কি শুধু তুই খাবি নাকি?’

আমি বললাম, ‘ হ্যা আমি খাবো শুধু।’

বলেই আরো উঠিয়ে মুখে দিতে যাব ভাইয়া টেনে আমার হাত নিজের মুখে ঢুকিয়ে চুষতে লাগলো।আমি থমকে গেলাম। সারা শরীর কেঁপে উঠলো। টেনে হাত সরিয়ে নিলাম।

‘আমার টা আমি জোর করে নিতে জানি।’

আমার কাছে এসে বললো,

‘ কাল পার্টি আছে। আর আজ বেশি সাজাতে পারিনি আসলে সবার মাঝে। তুই কি মন খারাপ করেছিস?’

আমি ভাইয়া জরিয়ে ধরলাম। আর বললাম,

‘ আমি কতো খুশি হয়েছি আপনাকে বুঝতে পারবো না।’

ভাইয়া আমাকে টেনে ছাদের বাম কর্নারে নিয়ে গেলো। এখানে এসে আমি হতভম্ব। অবাক চোখে দেখছি ভাইয়া ফুলের দোলনা পেতেছে আর তার পাশে একটা টেবিল মাঝে একটা প্লেট এ কিছু ডাকা। দুটো চেয়ার আমাকে নিয়ে সেখানে বসালো। ভাইয়া ঢাকনা তুললো গরম বিরিয়ানি রাখা কি সুন্দর সুগন্ধ। আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। আমার বিরিয়ানি খুব পছন্দ। ভাইয়া বলল,

‘ আমি নিজের হাতে এতোক্ষণ তোর জন্য এটা রান্না করেছি। এবার খেয়ে বল কেমন হয়েছে?’

আমি আরেক দফা অবাক হয়ে ভাইয়ার দিকে তাকালাম।

‘ আপনি রান্না করেছেন?’

ভাইয়া বললো, ‘ হুম।’

‘ আপনি আমার জন্য এতো কষ্ট করে রান্না করলেন?’

‘ কষ্ট করে করবে কেন? আমি তো খুব আনন্দের সাথে করলাম আমার ঊষা রানীর জন্য। তার জন্মদিন এটাই আমার করতেই হতো।’

আমি এতোটা আনন্দ হলাম। আমি ভাইয়াকে জরিয়ে ধরে কান্না করে দিলাম।ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

আমি কান্না গলায় বললাম,

‘ আমি এমন একজনকে সব সময় চাইতাম। যে আমার থেকেও আমাকে বেশি ভালোবাসবে। আমাকে নানা ভাবে চমকে সারপ্রাইজ দিবে‌। আমার কষ্টে কষ্ট পাবে। আমার আনন্দ তার মুখে হাসি থাকবে। আজ আমি তা পেয়েছি এই জন্মদিন আমি আল্লাহর কাছে চাই আপনি সারা জীবন আমার থাকেন। আমাকে খুব ভালোবাসেন।এটাই আমার একমাত্র চাওয়া।’

‘বোকা আমি তো তোর‌ই শুধু। তোকে আমি কতোটা ভালোবাসি তুই কল্পনা ও করতে পারবি না। কিন্তু এখন আর কান্নাকাটি না‌। এটা খেয়ে পেট ভর।’

আমি সোজা হয়ে বললাম, ‘ আমাকে খাইয়ে দিন‌।’

ভাইয়া নিঃশব্দে খাইয়ে দিতে লাগলো। আমিও হাত বাড়িয়ে খাইয়ে দিতে লাগলাম ভাইয়াকে।
ভাইয়া রান্না খুব ভালো হয়েছে। তিনি এতো ভালো রান্না শিখলো কিভাবে? আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললাম,

‘ আপনি রান্না করলেন কি করে? আপনি কি আগেও রান্না করেছেন?’

‘হুম।লন্ডনে তো আমাকে নিজেই রান্না করে খেতে হতো‌।’

‘ আপনি রান্না করে খেতেন।’

‘ হুম।’

‘ এজন্য তো এতো ভালো পারেন।’

‘হুম ব‌উকে রান্না করে সারপ্রাইজ দেবো এজন্য শিখে রেখেছি। আজ আমার হাতে রান্না খাবার খাওয়াবো বলে তখন খেতে দেয়নি।’

‘আমি যদি নিচে এসে একাই খেয়ে নিতাম।’

‘ আমি না খেয়ে আছি জেনেও আমার ঊষা আমাকে রেখে খেতেই পারবে না।’

‘ এতো বিশ্বাস।’

‘ অনেক।’

আমি মুগ্ধ হয়ে ভাইয়ার হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। ভাইয়া আমাকে টেনে তুলে সাদা দোলনায় বসিয়ে দিলো।এটা সাদা গোলাপ,বেলি, রজনীগন্ধা সব সাদা ফুল দিয়ে বানিয়েছে ইশ কতো সুন্দর। ফুলের সুবাস চারপাশে ছড়িয়ে গেছে। আমাকে ভাইয়া সেই দোলনায় বসিয়ে দিলো।আর একটা ফুলের তোড়া মাথায় পরিয়ে দিলো। আমি মুখে হাসি নিয়ে পা দুলিয়ে বসে আছি। খুব খুশি লাগছে আমার। ভাইয়া আমার পেছনে গিয়ে দোলনা দোলাতে লাগলো।

উপর থেকে ফুলের পাপড়ি পরতে লাগলো আমি চোখ বন্ধ করে আছি কি সুন্দর সেই মুহূর্ত ছিল। ভাইয়া আমার পাশে দোলনায় বসেছিলো। আমি ভাইয়া কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে ছিলাম। আমার চুল খোলা ছিলো। ভাইয়া একহাতে আমাকে জরিয়ে আরেক হাতে হাত ধরে রেখে গল্প করেছিলো।

ভোরে রুমে চলে আসি।এসব কখন করেছে জানতে চাইলে ভাইয়া বললো বিরিয়ানি রান্না করে এটা নিজে হাতে তৈরি করেছে। বাগানে থেকে ফুল আর কিছু দোকানে থেকে এনেছিল।
দুইঘন্টা এসব করেছে। আমি খুব খুশি হয়ে শুনলাম আমার জন্য এসব করার জন্য ভাইয়ার কষ্ট হয়েছে কিন্তু আমি তাতে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করতে লাগলাম এতো ভালোবাসে আমাকে ভাইয়া।

রাতের কথা কেউ জানতে না পারলেও সকালেই সব সবাই জেনে গেলো। বাসায় পার্টির আয়োজন করেছে ভাইয়া। সন্ধ্যা পার্টি হবে আমার জন্মদিন নিয়ে। আমি ভয়ে আটষাট হয়ে আছি। সকালে কয়েকজন চলে এলো বাসা সাজাতে তা নিয়ে শুরু হলো চাচির চেঁচামেচি। তিনি আমার জন্মদিন নিয়ে এসব শুনেই চেঁচিয়ে বাসা মাথায় তুললো। বাকিরা রাগ করলেও কিছু বললো না কারণ সব করা শেষ এখন বলেও লাভ নাই‌। ভাইয়া সবাইকে ইনভাইট করে ফেলেছে।
চাচি না খেয়ে রুমে দরজা আটকে বসে আছে। আমি যেতে চেয়েও পারলাম না ভাইয়া আমাকে যেতে দেয়নি।

সন্ধ্যা আমাকে পরীর মতো সাজানো হলো। রানী গোলাপি রঙের একটা গ্ৰাউন পা পর্যন্ত যা ভাইয়া আমাকে দিয়েছে। এতো সুন্দর আমি প্রথমে কতো সময় হা করে তাকিয়ে ছিলাম জানিনা। এটাই পরার পর আমি নিজেই নিজেকে চিনতে পারিনি। ইমা আপু ফুপিরা সবাই বিকেলে চলে এসেছে চাচি বাংলার পাঁচের মতো মুখ করেই এসেছে সবার সামনে।
ফারিয়া আমার সামনে এসে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,

‘হ্যাপি বার্থডে ঊষা।’

আমি ধন্যবাদ দিলাম। আজকে আমাকে কতো লোক যে উইস করলো উফফ। আমার সতেরো বছরের মধ্যে আমি এতো উইশ পাইনি সব আজকে পেলাম। কতো পরিচিত অপরিচিত মানুষের সাথে কথা হলো। ভাইয়ার এক দল ফ্রেন্ড আমার সাথে পরিচিত হলো‌। ভাইয়া আমার হাত ধরে রেখেছিলো পুরোটা সময়। আমি আর ভাইয়া দাঁড়িয়ে ছিলাম সবাই ক্যাপেল ডান্স করছে তখন ফারিয়া এসে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে ভাইয়াকে বলে,

‘হি ওয়েল ডান্স ওয়েত মি,প্লিজ! ইহান।’

আমি বড় চোখ করে তাকিয়ে আছি। ভাইয়া কি রাজি হবে আমি মন থেকে চাইছি রাজি যেন না হয়।

‘ আমি কিন্তু..

‘ ইহান এখানে সবাই আমার অপরিচিত। আমার তো ডান্স করতে ইচ্ছে হয় প্লিজ প্রেমিকা হিসেবে না করলে ফ্রেন্ড হিসেবে তো করতেই পারো!’

আমি ভাইয়ার হাত শক্ত করে ধরে আছি। ভাইয়া আমার হাত ছারিয়ে নিলো। ফারিয়া সাথে ডান্স ফ্লোরে গেলে আমি কাঁদো কাঁদো মুখ করে তাকিয়ে আছি।

#চলবে

#এক_চিলতে_রোদ
#Writer_Nondini_Nila
#Part_50

ফারিয়ার মনে তো লাড্ডু ফুটছে। খুশিতে ও দিশেহারা হয়ে পরেছে। ও কল্পনাও করতে পারিনি ইহান এতো সহজে মেনে নিবে। ওর সাথে চলে আসবে ডান্স করতে ঊষাকে রেখে।
ও ইহানের পাশে থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে ঊষার মুখটা দেখলো। আহ কি শান্তি লাগছে ওর। ঊষার মলিন মুখটা দেখে বুকের ভেতর সুখের জোয়ার ভেসে ফারিয়ার। ও শয়তানি হাসি দিয়ে ঊষার থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। ডান্স ফ্লোরে এসে হাসি মুখে ইহানের দিকে তাকালো। ওর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো।

‘আমি খুব খুশি ইহান।’

ইহান কপাল কুঁচকে বললো, ‘ এতো খুশি হওয়ার কারণ কি?’

‘ তুমি যে আমার কথা রাখবে এটা আমি ভাবিনি। আমার কথা রাখার জন্য থ্যাংক ইউ সো মাচ।’

‘ আমি তোমার কি কথা রাখলাম?’
অবাক হয়ে বললো ইহান।

ফারিয়া বললো, ‘ এই যে আমার কথা শুনে আমার সাথে ডান্স করতে চলে এলে।’

‘ওহ।’

‘হুম’

ফারিয়া এগিয়ে এসে ইহানের কাঁধে হাত রাখতে যাবে তখন ইহান পিছিয়ে যায়। আর বলে,

‘ ওয়েট ওয়েট।’

ফারিয়া হাত নামিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘ কেন?’

‘ তোমার পার্টনার কে ডাকতে তো দেবে। আমাকে টানছো কেন?’

‘ হোয়াট? তুমি তো আমার সাথে ডান্স করবে তাই না। আবার কাকে ডাকবে।’

‘ আমি তোমার সাথে ডান্স করবো কখন বললাম।’

‘ করবে না বলছো। কিন্তু তাহলে আমার কথা শুনে আসলে কেন?’

‘ তোমার কষ্ট দেখে।’

‘ আমার কষ্ট দেখে মানে?’ অবাক হয়ে বলে।

‘ আমার ফ্রেন্ড ডান্স করার পার্টনার না পেয়ে মন খারাপ করে থাকবে তা কি করে হয়? তাই তো আমি পার্টনার খুঁজে দিতে এলাম।’

‘ হোয়াট? তোমাকে আমি পার্টনার খুঁজে দিতে বলিনি। পার্টনার হতে বলেছি।’

‘ কিন্তু সেটা সম্ভব কি করে বলো? আমার পার্টনার রেখে অন্যকারো সাথে কি করে আমি ডান্স করা তুমি বলো।’

‘ তাই বলে…

ইহান ফারিয়ার কথা শুনলো না পেছনে ঘুরে একটা ছেলেকে ডাকলো।

‘ মিহির।’

একটা ছেলে হাসি মুখে এগিয়ে এলো।
আর ইহানের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ কিরে ডাকছিস কেন? এই ক্যাপেলদের মাঝে আমি আসতে চাইনা। নিজের তো ফাটা কপাল একটা গার্লফ্রেন্ড জুটাতে পারলাম না। এসব দেখে এইখানে কেমন জানি করে রে আমি তাই দূরে বসে আছি।’

‘ তোর জন্য একজন আছে। এই যে আমার ফ্রেন্ড ফারিয়া লন্ডন থেকে এসেছে। ওর ও পার্টনার নাই তোর ও নাই তাই আজকের জন্য দুজন দুজনের পার্টনার হয়ে যায়।’

বলেই মিহির এর দিকে এগিয়ে কানে কানে বললো,

‘ দোস্ত পটাতে পারলে গার্লফ্রেন্ড করে নে সিট খালি আছে।’

মিহির আর ফারিয়ার হাত ধরিয়ে ইহান সরে এলো।
ফারিয়া রেগে ইহানের দিকে তাকিয়ে আছে। এইভাবে ওর আনন্দ মাটি করে দেবে কল্পনা ও করেনি। কতোটা আনন্দ পেয়েছিল আর সেকেন্ড এ ওর আনন্দ নষ্ট করে ইহান। ওই ঊষার কাছে চলে গেলো। ফারিয়া ইহানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইহান ঊষার কাছে গিয়ে কানে ধরে কি যেন বলছে? ঊষা গাল ফুলিয়ে মুখ সরিয়ে নিলো।

রাগে ওর কান দিয়ে ধোঁয়া বের। তখন ও নিজের কোমরে কারো হাতের স্পর্শ পায় সামনে তাকিয়ে অপরিচিত একটা মুখ দেখে। এই ছেলেকে ইহান রেখে গেলো ওর জন্য।ছেলেটা কেমন দাঁত কেলিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে আবার পারমিশন ছাড়াই ওকে দুলিয়ে নাচাচ্ছে। একটা জিনিস খেয়াল ছেলেটার সাথে ওর ড্রেস মিলে গেছে।ছেলেটা ও নীল রঙের কোর্ট পরে আছে। আর ফারিয়া ও নীল শর্ট ফ্রক পরেছে। এই ছেলের সাথে ডান্স করার একটুও ইচ্ছে নাই ফারিয়ার ও হাত ছারানোর ট্রাই করছে কিন্তু পারছে না ছেলেটা ওকে ছারছেই না।ও এবার মুখ খুললো তাও ছারছে না।
মিহির শুধু বলেছে,

‘ আরে আমার সাথে ডান্স করুন না আমি ওতোটাও খারাপ ডান্স করি না।’

‘ ছারুন আমি আপনার সাথে ডান্স করবো না।’

‘ আরে আপনার ও পার্টনার নাই আমার ও নাই এক দিন না হয় দুজন দুজনের পার্টনার হয়ে গেলাম। সমস্যা কি তাতে?’

ফারিয়া রাগে গজগজ করতেছে‌। কিন্তু ছারাতে পারেনি।

‘ আপনি আমাকে রেখে চলে গেলেন আমার কতোটা খারাপ লেগেছিলো জানেন?আমি ভেবেছিলাম আপনি ফারিয়ার সাথে নাচবেন।’

‘ আচ্ছা বাবা সরি। আর ডান্স তো করিনি তাইনা। তাহলে কেন রাগ করছিস?’

‘আমি ভয় পেয়েছিলাম।’

‘ তাহলে আটকালি না কেন?’

‘আমি কেন আটকাবো?’

‘ওকে না আটকালি আমি অন্যদের সাথেই ডান্স করি তাহলে।’

‘খবরদার এটা করলে আমি আপনাকে মেরে ফেলব’

‘না আটকালে আমি এটাই করবো।’

‘ কিন্তু আমি তো আটআতে চাই না। আমি জানি আপনি আমাকে রেখে অন্য কারো কাছে যাবেন ই না‌।’

‘যদি যাই তখন কি করবি।’

‘মেরে ফেলবো।’

‘ তুই আমাকে মারতে পারবি?’

‘ না নিজেকে মারতে পারবো তো।’

আমার কথা শুনে ভাইয়া রেগে গেলো।

‘ কি বললি? নিজের ক্ষতি করার কথা ভাবলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে।’

ভাইয়ার কঠিন কথা শুনে ভয় পেয়ে চুপ মেরে গেলাম।ভাইয়া আমাকে একহাতে জরিয়ে ধরে বললো,

‘ তোর কিছু হলে আমি কি নিয়ে বাঁচবো বলতো? দেখ আমার শরীর কাঁপছে এমন কথা আর কখনো বলবি না।আমি শুধু তোকেই ভালোবাসি বুঝেছিস’

‘হুম।’

ইমা আপু আর রিফাত ভাইয়া নাচছে, আমি তাদের নাচ দেখছি ভাইয়ার সাথে মিশে দাঁড়িয়ে। ফারিয়া আর একটা ছেলে তাদের মুখের ভঙ্গি দেখছি।‌আরো অনেকে। হুট করে ভাইয়া ও আমাকে নিয়ে ডান্স ফ্লোরে চলে এলো।
আমি ভাইয়াকে বলতেছি আমি নাচতে পারি না। তবুও ভাইয়া বলছে তোর নাচতে হবে না শুধু আমার সাথে তাল মিলাবি।আজকে দিয়ে ভাইয়ের সাথে আমার দ্বিতীয়বার ক্যাপেল ডান্স করা হলো। সেই দিন ছিল অনেক অস্বস্তি আর আজকে লজ্জা। লজ্জায় লাল-নীল হয়েছি ডান্স করা পুরোটা সময়।
ভাইয়া আজকে সাদা কালারের ব্লেজার পরেছে। সাদা কালারের ভাইয়াকে শুভ্র দেখা যাচ্ছে। ভাইয়ের ফর্সা গায়ে খুব মানিয়েছে। রানী গোলাপি শার্ট উপরে সাদা ব্লেজার সাদা প্যান্ট পড়েছে। হাতে ঘড়ি আর এক হাতে ব্রেসলেট, সিল্কি চুলগুলো কপালে পড়ে আছে নাচের সময় ভাইয়া ঠোটে মুচকি হাসি ছিলো।আর তার সেই নজর কারা গালে টোল। ভাইয়ার গোল মুখে তার এই টোল পড়া হাসি আমার এত পছন্দ শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।
ভাইয়া ঠোট একদম গোলাপি যেন লিপস্টিক দিয়েছে। এত সুন্দর দেখতে যে আমি তাকিয়ে থাকা শুরু করলে শেষই হয় না।
নাচ শেষে ও আমি হা করে ডান্সফ্লোরে দাঁড়িয়েই তাকিয়ে আছি ভাইয়ের দিকে হা করে।ভাইয়ার ধাক্কা খেয়ে আমি হকচকিয়ে মাথা নিচু করে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে কেউ নাই সবাই চলে গেছে নাচ শেষ করে।
আমি এখনো ভাইয়ার কাধে দুই হাত দিয়ে রেখেছি। তাড়াতাড়ি হাত নামিয়ে আমি সরে দাঁড়ালাম
ভাইয়া হেসে আমার হাত ধরে সবার কাছে চলে এলো। কেক কাটার সময় সবাই চেঁচিয়ে আমাকে উইশ করতে লাগল।আমি চোখভর্তি জল নিয়ে সবার দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে ছিলাম। এবার কেক কাটার সময় আমি কেক কেটে সবার আগে চাচী’র দিকে তাকালাম চাচী’র মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেল। আমি মুখটা মলিন করে চাচা কে দিতে গেলাম চাচা গম্ভীর হয়ে থাকলে ও সবার সামনে কিছু বলল না আমার হাত থেকে নিয়ে নিজেই খেয়ে নিল। আমি এবার ইমা আপুকে দিলাম। আপু আমার মুখে আগে দিয়ে নিজে নিল একটু। ইলা আপু খাবেনা বলে দিলো আমি রিফাত ভাইয়া লতাকে খাইয়ে দিলাম। কেকে সাথে সবাই খাবার খেতে বসে গেল।শুধু ইহান ভাইয়াকে খাইয়ে দেই নাই সবার শেষে। ভাই এত বড় একটা কেকের খন্ড এনে আমাকে খাইয়ে দিলো না আমার দু গালে মাখিয়ে দিল। আমি হতভম্ব হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছি আর মনটা আমি কল্পনা করিনি।

মৃদু চেঁচিয়ে করে বলে উঠলাম, ‘ এটা কি করলেন?’

ভাইয়া বললো, ‘তোকে কেক দিয়ে ভূত বানিয়ে দিলাম।’

‘ধুর।’

আমি নিজের রুমে চলে এলাম মুখ ধুয়ার জন্য। ভাইয়াকে রাগ দেখিয়ে।আমার সব সাজ নষ্ট করে দিলো। আমি তোয়াল দিয়ে গাল মুছে নিচ্ছি। তখন আমার কাঁধে কারো গরম নিঃশ্বাস পেলাম। চমকে ঘাড় ঘুরাতে গেলে ভাইয়া আওয়াজ পেলাম।

‘ আমাকে একটু কেক খাইয়ে দিলি না। সবাইকে দিলি আর আমি বাদ পরলাম।’

আমি বললাম, ‘ ছারুন আমাকে। আপনি কি করছেন? আমার সাজ টাই নষ্ট করে দিলেন।এইভাবে কেউ মুখে কেক দেয়।’

ভাইয়া আমার সামনে এসে দাড়ালো। আর হাতে তে তোয়াল নিয়ে আমার গাল মুছে দিয়ে বললো,

‘ আজ তোকে এতোটা সুন্দর লাগছে যে আমি কন্ট্রোল লেস হয়ে যাচ্ছি বারবার। আমার অনেক কিছু করে ফেলতে ইচ্ছে করছে।’

‘ কি সব বলছেন?’

‘ সত্যি। আমার তোকে…

থেমে গেলো।আমি জিগ্গেস করে তাকিয়ে আছি উৎসুক হয়ে।ভাইয়া আমার কপালে চুমু খেয়ে বললো, তোর জন্য একটা গিফট আছে।’

আমি বললাম, ‘ আবার গিফট‌। এতো এতো সারপ্রাইজ গিফট দিয়ে ও আর কি দেওয়ার আছে।’

‘আছে।’

ভাইয়া একটা ইয়া বড় বক্স বের করলো সেটা খুলতে বললো আমাকে আমি বক্সে কি আছে ভেবে হাত বাড়িয়ে খুলতে লাগলাম। একটা ইয়া বড় টেডি বিয়ার বের হলো। সাদা ধবধবে তার মাথায় ক্যাপ করানো লাল টকটকে। আমি বড় বড় চোখ করে টেডির দিকে তাকিয়ে আছি। উত্তেজিত হয়ে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘ এটা আমার জন্য।’

‘ হুম।’

‘ এতো এতো সারপ্রাইজ গিফট আমি তো আজ হ্যাট এ্যাটাক করবো আমি।’

‘ তুই খুশি তো।’

‘ আমার জীবনের সবচেয়ে খুশির দিন আজকে।এমন স্বপ্নের মতো দিন আমি আজ‌ই প্রথম পেলাম। শুধু আপনার জন্য।’

#চলবে