এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব-৩৬+৩৭

0
1279

#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩৬

গাঢ় গোলাপি বাগানবিলাসে ঠাসা পুরো বারান্দা। রেলিংয়ের বাইরে পর্যন্ত এসে পড়েছে কিছুটা। পনেরো তলা বিল্ডিং এর অন্য কোনোকিছু নজর কাড়লো না রাত্রির। হাতের তর্জনী উঁচিয়ে সেই বারান্দা ধরে ফ্লোর গুনতে গুনতে বারো নম্বরে যেয়ে ঠেকলো। নিভ্রান সিটবেল্ট খুলে দিচ্ছিলো। রাত্রিকে আঙ্গুল দিয়ে গুনতি করতে দেখে হেসে ফেললো সে,
—“কি করছো?”
রাত্রি একবার ঘাড় ফিরালো। আবারো নজর দিলো সেদিকে। সূর্যের আলো সরাসরি এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে গাল মুখ। বেগুনী রশ্নির প্রভাবে তাকাতে না পেরে চোখ কুঁচকে গেছে। পিটপিট করে চিনদেশীয় মানুষের মতো করে তাকাচ্ছে সে। ছোট্ট নাকের ডগা টা রক্তশোভিত লাল। ঠোঁটের উপর ঘামের কণা। নিভ্রান রুমাল বের করলো। পাতলা করে ভাঁজ করে খুব সাবধানে ঘাম গুলো মুছিয়ে দিলো। ঠোঁটে মেরুণ রংয়ের লিপস্টিক দেয়া, হাত লেগে গেলে ছড়িয়ে যাবে। রাত্রির এই রংয়ের লিপস্টিক ছিলনা। আসার পথে কিনে দিয়েছে।
গলার উল্টে যাওয়া লকেটটা সোজা করে দিয়ে হাত বাড়িয়ে দরজার লক খুলে দিলো সে। রাত্রি কপালের কাছে হাত দিয়ে রোদের আলো থেকে বাঁচার চেষ্টা করে বললো,
—“ওই বারান্দাটা কি সুন্দর তাইনা? আপনারা কোনটায় থাকেন?”

নিভ্রান তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো। কয়েকসেকেন্ড চেয়ে থেকে চাপা গলায় বললো,”ওখানেই থাকি….মানে থাকতাম।” রাত্রি বুঝলো নিভ্রানের স্হির চোখের ভাষা। চুপ করে গেলো সে। প্রসঙ্গ এড়ানোর জন্য বললো,”চলুন, যাই।”
নিভ্রান সোজা হয়ে বসলো। গাড়ির চাবিটা খুলে নিয়ে পকেটে ভরলো। বের হয়ে পিছের সিট থেকে রাত্রির নিয়ে আসা ব্যাগগুলো একসাথে তুলে নিলো। অত:পর রাত্রির পাশের দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে। ছোট্ট করে বললো,” কুঁচি নেমে গেছে, সাবধানে।”

রাত্রি একহাতে কুঁচি উপরে টেনে ধরলো। নিভ্রানের হাত আঁকড়ে নেমে দাড়ালো। ভারি শাড়িটায় একশো একটা সেফটিপিন ঢুকিয়ে এসেছে তবু নেমে যাচ্ছে। নেহাতই বেশ সুন্দর লেগেছিলো সেজন্য কিছু না ভেবেই এটা পরে ফেলেছিলো। আগে থেকে এতো বিড়ম্বনা জানলে কস্মিককালেও এর ধারে কাছে যেতোনা।

দুপুর তখন দুইটা সাইত্রিশ।
নওশাদ সাহেব সকালে খবরের কাগজ পড়তে পারেননি। নাহিদা ডাইনিংয়ে খাবার সাজাচ্ছে। এই ফাঁকে তিনি সোফায় বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে হাতে ধরা কাগজটায় চোখ বুলাচ্ছেন। কাপের তলের শেষ অংশটুকু গলার ভেতর চালান করে দিয়ে হাঁক ছাড়লেন তিনি,”আরেক কাপ দাওতো নাহিদা।”
নাহিদা চোখ রাঙিয়ে তাকালেন। গরম কন্ঠে বললেন,
—“তোমার এই চা খাওয়ার অভ্যাস যাবেনা? এইযে দুইদিন পরপর প্রেশার হাই হয়ে কাঁপতে থাকো। সব তো এই চায়ের জন্যই। এই চা ই মারবে তোমাকে। আমি বলে দিলাম।”

—“আহা! চায়ে করি দোষ প্রেশারের সাথে ওর কি সম্পর্ক?”

—“তুমি..”তার কথার মাঝেই কলিংবেল বাজলো। নাহিদা থেমে গেলেন। একপলক নওশাদ সাহেবর দিকে তাকিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালেন। মনে মনে গজগজ করলেন কিছুক্ষণ। মানুষজন সব অসময়ে আসে।
রাত্রি সামনে দাড়িয়ে আছে। পিছে নিভ্রান। নাহিদা দরজা খুলে থ বনে গেলেন অকস্স্যাৎ। হাত থেমে গেলো। পা ধরে আসলো। অদ্ভুত দৃষ্টিতে চোখ বুলালেন বারকয়েক। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। তিনি কি সত্যি দেখছেন? ঠোঁটের মাঝে ফাটল ধরলো অজান্তেই। রাত্রি মিষ্টি হেসে বললো,”আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”

নাহিদা আবার পলক ঝাপটালেন। অনাকাঙ্খিত আনন্দগুলো ধারণ করার চেষ্টা করলেন। তার ছেলে এসেছে? সত্যি? এতগুলো বছর পর?
চোখ খুশিতে খুশিতে কানায় কানায় ভরে উঠলো। টলমল করলো ঠোঁট। রাত্রি নিজেই একটু সাইডে সরে দাড়ালো। নাহিদা কেঁদে উঠলেন। হাত বাড়িয়ে নিভ্রানকে ধরলেন। নিভ্রান অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললো,
—“কান্নাকাটি করছো কেনো?”

এই দুপুরবেলা কান্নাকাটির শব্দ শুনে নওশাদ সাহেব মুখের উপর থেকে কাগজটা সরিয়ে এদিকে ঘাড় ফিরালেন। নিভ্রান আর রাত্রিকে দেখে একাধারে চেয়ে রইলেন কতক্ষণ। মুখের কোথাও একটা সুপ্ত আনন্দ। চোখের কোঁণে চাপা হাসি থেকে জন্মানো ভাঁজ। রাত্রি তাকে সেখান থেকেই সালাম দিলো। নওশাদ সাহেব হাতছানি দিয়ে ডেকে সহাস্য মুখে বললেন,”আসো আসো, ভেতরে আসো।” রাত্রি সাইড দিয়েই ঢুকে গেলো। নওশাদ সাহেব এগিয়ে এসে তার মাথার হাত বুলালেন। স্নিগ্ধ চোখে দেখে বললেন,” মাশআল্লাহ….কেমন আছো মা?”

নাহিদার কান্নাকাটি থেমেছে। বহুকষ্টে আচঁল দিয়ে চোখ মুছলেন তিনি। নিভ্রান একপা দু’পা করে ভেতরে ঢুকলো। চোখ বুলালো বড় ড্রইংরুমটায়। বাসায় আসেনা আজ কতবছর। কতকিছু বদলেছে। ল্যান্ডফোনের পাশের লাল শোপিস টা নেই। বেসিনের উপরের কাঁচটা বদলেছে। ড্রাইনিং টেবিলটা নতুন। তার রুমটা কি এখনও আগের মতোই আছে? নাকি ধুলোমাটি জমে ফিকে ঝন্জালের স্তুপ হয়ে গেছে? খুব গোপনে একা অসহ্যকর দীর্ঘ: শ্বাস বেরিয়ে এলো। নিভ্রান ঢুকতেই নওশাদ সাহেব রাত্রিকে বসতে বলে নিশব্দে ভেতরে চলে যেতে উদ্যত হলেন। কেন যেনো অসস্তি লাগছে। খুব অসস্তি। নিভ্রান একনজর তার দিকে তাকালো। অত:পর সোফায় ব্যাগগুলো রেখে বললো,”তুমি থাকো রাত, আমি সন্ধ্যায় এসে নিয়ে যাবোনে।”
রাত্রি না না করে উঠলো। খপ করে ধরে ফেললো নিভ্রানের বাহু। তড়িঘড়ি করে বললো,”নাহ্, আপনি কেনো যাবেন? আপনিও থাকবেন।”

নিভ্রান শান্ত গলায় বললো,”জেদ করেনা। আমি এসে নিয়ে যাবো সন্ধ্যায়।”

রাত্রি হাতের চাপ দৃঢ় করলো। কিছু একটা ভেবে চোখমুখ অসহায় করে কাতর গলায় বললো,”প্লিজ..”

নিভ্রান নিষ্প্রভ নয়নে তাকালো। মেয়েটা জানে এমন করলে সে মানা করতে পারবেনা। ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো সে। সম্মতি দিয়ে বললো,”আচ্ছা, ঠি কাছে।”

নাহিদা ব্যস্ত গলায় বললেন,”জানিয়ে আসবিনা? আমিতো তেমন কিছুই রান্না করিনি। হায় আল্লাহ।”

নিভ্রান সোফায় বসতে বসতে বললো,” এতো ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। আমরা খেয়ে এসেছি। তুমি এসে বসোতো সামনে।”

—“ধুর, চুপ কর। তা কি হয়? আমি যাই। তুই কি খাবি বল। রাত্রি তুমি কি খাবে?”
রাত্রি উওর দেবার আগেই ধুম করে দরজা খোলার শব্দ হলো। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো নিশাদ। চোখমুখ ফুলে মনে হচ্ছে মৌমাছি কামড়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। পরণের টি-শার্ট কুঁচকে কুঁচকে আছে। চুল উদ্ভ্রান্তের মতো। দু’হাতে চোখ ডলতে ডলতে সে বললো
—“সমস্যাটা কি? বললাম আমি আজকে একটু ঘুমাবো। ছুটির দিন, হাউকাউ করোনা। নাহ্, দুপুর না গড়াতেই মাছের বাজার বসে গেছে। আর বাসায় কাকে না কাকে ঢুকিয়েছো পুরো ভাইয়ার মতো গলা।”

—“ওটা আমিই নিশাদ। আমার মতো গলা আবার কার হবে? আর এই ভরদুপুরে কিসের ঘুম? একটুপর বিকাল হয়ে যাবে।”

নিশাদ চকিতে তাকালো। চোখের ঘুম উড়ে ছাঁই। মনিগুলো বড়ো বড়ো করে বুকে থুতু ছিটিয়ে সে বললো,
—“মা, সোফায় বসা মানুষটাকে কি তুমিও দেখতে পাচ্ছো? নাকি শুধু আমিই দেখছি। হরর কিছু নয়তো? ভাইয়ার মতো সেজেছে কেনো? দেখি, ধরা যায় নাকি।” বলেই এগিয়ে এসে নিভ্রানের চোখ মুখ হাতালো সে।
নিভ্রান চেঁচিয়ে উঠলো,
—“হুরর, কি করিস?”

রাত্রি ফিক করে হেসে ফেললো। হাসলো নাহিদাও। ইশশ…ঘরটা যেনো আলোয় আলোয় ঝলসিয়ে যাচ্ছে।

_______________

রুমটা সেই আগের মতোই গোছানো। বিছানা ঝাড়া। ফ্লোর মনে হচ্ছে আজই ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়েছে।
বাগানবিলাসের গোলাপী স্তুপের ছায়ায় ব্যালকনির দরজাটা পর্যন্ত গোলাপী আভায় সুসজ্জিত। পর্দার নিচ দিয়ে কেমন অদ্ভুত আভাযুক্ত রশ্নি সাদা ফ্লোরে বিছিয়ে আছে। নিভ্রান অবাক চোখে দেখলো সব। সন্দেহজনক গলায় প্রশ্ন করলো,
—“এ ঘরে থাকে কেউ?”

নিশাদ মৃত গলায় উওর দিলো,
—“তুই নাই কে থাকবে ভাই?”

—“সব এত গোছানো কেনো? তালাও দেয়া ছিলোনা।”

নিশাদ কিছু বলতে যেয়েও আটকে ফেললো যেনো। কি একটা জানি অভিদের মতো লুকিয়ে ফেললো। রাত্রি যেয়ে পর্দা সরালো। ব্যালকনির দরজাটা খুলতেই প্রাণখোলা হাসিতে ভরে গেলো ঠোঁট। বাগানবিলাসের রাজ্য যেনো। সে হাত বাড়িয়ে দুটো পাতা ছিঁড়লো। নিশাদ গলা ঝেঁড়ে এড়িয়ে গিয়ে বললো,”ভাবি, তাহলে নিয়েই আসলেন ভাইয়াকে। আ’ম ফিলিং প্রাইড অফ মি।”

রাত্রি ঘুরে বললো,”কেনো?”

—“আমি দেবর বলেইতো আপনি অসম্ভব কে সম্ভব করতে পারলেন।”

রাত্রি হাসলো কেবল। উওর দিলোনা। নিভ্রান কিছুক্ষণ থম ধরে বসে রইলো বিছানায়। ইচ্ছা হচ্ছে সব ছেড়েছুড়ে আবার পরিবার নিয়ে সময় কাটাতে। এখানেই থেকে যেতে আজীবন। কিন্তু নাহ, ওইযে ইগো। ইগো জিনিসটাই বারবার আটকে দিচ্ছে। কাঁটাতার বিছিয়ে রেখেছে গলায়, মনে, সবখানে।

খানিকবাদে নিভ্রান ওয়াশরুমের জন্য সেখান থেকে যেতেই রাত্রি হুড়মুড় করে বললো,
—” এবার আমাকে বলেন জলদি। সব এতো গোছানো কেনো? আমি দেখেছি আপনি কিছু লুকাচ্ছেন।”

নিশাদ হেসে ফেললো। মেয়েটা এতটুকুন হলেও বেশ বিচক্ষণ। সবদিকে খেয়াল আছে তার। ওর কাছে লুকানোর মতো কোনো কারণ খুঁজে না পেয়ে সে হাসতে হাসতেই বললো,”বাবার কড়া আদেশ আছে ভাবি। ঘরের কোনো জিনিসে যেনো একফোঁটা ধুলোও না জমে। সেজন্যই মা রোজ সকাল সকালই খালাকে দিয়ে এই সবকিছু পরিষ্কার করিয়ে রাখে। ঘর অগোছালো হবে কি করে?”

রাত্রি আকাশ থেকে পড়ে বললো,
—“বাবা? উনার আর বাবার মধ্য না রেশারেশি?”

নিশাদ তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
—“সে তো বাইরে বাইরে। ভেতরে ভেতরে দেখেন গিয়ে দুজনেই বেরধক ভুগছে।”

রাত্রি অবাক হয়ে হতাশভাবে বললো,
—“আপনি উনাকে বলে দিতেন বাবার কথা। এসব শুনলে, একটু হলেও অভিমান কমতো। রাগ ভেঙে যেতো।”

—“আর বাবা এদিকে আমাকে ভেঙে দিতো। এসব কোনোকিছু যাতে ভাইয়ার কানে না যায় এ ব্যাপারে আগে থেকেই কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে তার।”

~চলবে~

#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩৭

ময়ুখমালী বিদায় নিয়েছে একটুক্ষণ আগেই। সূর্যশূণ্য আকাশটা কে পূর্ণ করতে উঠেনি স্বার্থপর চাঁদ। শুক্ল মেঘমেদুরে আচ্ছাদিত হয়েছে গোটা গোধুলীসন্ধ্যা। বর্ষণপূর্ব মেঘমোহে মায়া লেগে যাচ্ছে জগতের অঙ্গে অঙ্গে। মৃদুতা মারুতে দোদুল্যমান গোলাপি পুষ্পপাপড়ি।
ড্রইংরুমের সাজবাতির আলোতে বসে আছে সবাই। হাসিমাখা আদরে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছে গোটা বাড়িটা।
মধ্যমনি রাত্রিকে ঘিরেই যেনো সবকিছু। নিভ্রান চুপচাপ বসে আছে পাশে। চোখের দৃষ্টি প্রথম থেকেই ফোনের স্ক্রিনে। রাত্রি জোরজবরদস্তি তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। এতো রংমহলের সবকিছুর মাঝেও কোথাও যেনো একটা বিষাদের আভা।

দুজনকে বিদায় দেবার আগমূহুর্তে নওশাদ সাহেব বললেন,”আবার নিয়ে এসো ওকে।”
নিভ্রান কিছুক্ষণ মৌন থেকে জুতার ফিতা বাঁধতে বাঁধতে গম্ভীর গলায় উওর দিলো,”আসবোনে।”
ব্যস, এতেই হাসি ফুটলো রাত্রির মুখে। এতবছরের অভিমান তো আর একদিনে ভাঙবেনা। একটু একটু করেই না হয় ভাঙুক।
________________

রাস্তায় আজ চরম আলোর ঘাটতি। প্রকৃতিকে ঘন ঘটার আশঙ্কা নাকি শুভ্র কিছুর আবেদন জানা নেই নিভ্রানের। বৃষ্টি পড়ছে ঝমঝম। পিচঢালা রাস্তার ধুলোমাটির অস্তিত্ববিনাশ। রাস্তার মোড় ঘুরতেই রাত্রি চেঁচিয়ে উঠলো,
—“ইশশ! দেখেন কত কদম!”

নিভ্রান একপলক দেখলো। কদম ছাপিয়ে নজর কাড়লো কমনীয় অঙ্গনার শোভিত রুপ। কাঁধ থেকে সরে যাওয়া আচঁল। অলঙ্কারহীন বৃষ্টির ছাঁটওয়ালা সিক্ত গলদেশ। চোখের পাপড়ির মৃদু কম্পন। রাত্রি গাড়িতে উঠেই গয়নাগাটি খুলে ফেলেছে। আচঁল আর কোমড়ের কাছের সেফটিপিন খুলে আরাম করে বসেছে। পলক পড়লোনা। নামলোনা চোখের পাতা। তীর্থ হলো মন। বিক্ষিপ্ত হলো হৃদয়। নিভ্রান গাড়ি থামালো। দরজা খুলতে খুলতে হাল্কা গলায় বললো,”এনে দেই।”
রাত্রি আবারো চেঁচিয়ে উঠলো। পাগল লোকটা। এই বৃষ্টিতে নাকি ফুল আনতে যাবে। হায়! একহাতে কোমড়ের শার্ট টেনে ধরে সে বললো,
—“নাহ্, ভিজে যাবেন। দরকার নেই।”
নিভ্রান আলতো করে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। নরম গলায় বললো,”চুপ করে বসে থাকো।”বলে একমূহুর্ত দেরি না করে বেরিয়ে পড়লো সে। রাত্রি চিৎকার করলো ভেতর থেকেই,” লাগবেনা তো। আপনি ভেতরে আসেন। উফফ”।
নিভ্রান শুনলোনা কিছুই। ঝপাঝপ পা ফেলে ভিজতে ভিজতে ছিঁড়ে নিলো পাঁচ ছটা ফুল। গায়ের শার্ট ভিজে লেপ্টে গেলো মূহুর্তেই। রাত্রি মাথা বের করলো। চিৎকার করে বললো,”আপনি আসবেন নাকি আমিই নামবো?”

নিভ্রান এদিক ওদিক তাকালো। রাস্তায় মানুষ ভরা। নির্জন হলে সে নিশ্চিত বাঁধা দিতো না। কিন্তু এখন অসম্ভব। বৃষ্টিসিক্ত রাতের সৌন্দর্য শুধু যে উপভোগ করবে আর কেউ নয়। ফুলগুলো একহাতে মুঠ করে ধরে রাত্রির পাশের দরজা খুললো সে। রাত্রি হাত বাড়িয়ে নিলো। মাথা বের হওয়ার চুলের সামনের অংশ ভিজে গেছে তার। টপটপ করে পানি গড়িয়ে ঠোঁটের কাছে জমা হচ্ছে। রাত্রি মুছেছে হয়তোবা। গাঢ় লিপ্সটিক ছড়িয়ে গেছে। নিভ্রান চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। একাধারে সেই ঠোঁটের ভাঁজে। সরে যাওয়া আঁচলের খুব গভীরে। রাত্রি মুখ খোলার আগেই সে হাত ধরে টেনে বের করে দ্রুত পিছনের দরজা খুলে ভেতরে বসিয়ে দিলো। ঢুকে গেলো নিজেও। রাত্রি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললো,”কি হ..”
কথা সম্পূর্ণ হলোনা। তার আগেই হাত বাড়িয়ে ওপাশের জানালার কাঁচ উঠিয়ে দিয়ে অধরে অধর ছুঁয়ে দিলো নিভ্রান। জানলার কাঁচে ঠেকে গেলো রাত্রির মাথা। কদমগুলো পড়ে গেলো নিচে। নরম হাতদুটো আঁকড়ে ধরলো পিঠ। গাড়ির ইনার লাইট নিভানো তখন। আধো আলোয়ই পিপাসায় কাতর নিভ্রান মত্ত হয়ে উঠলো। বাড়লো ছোঁয়ার প্রগাঢ়তা। অনুভূতিতে পিষ্ট হলো রাত্রি। ঠোঁটের কাছ থেকে গলায় গেলো স্পর্শ। নেমে গেলো আচঁল। সংবেদনশীল স্হান শিরশির করে নিস্তেজ হলো। নরম ভাবটা সরে হঠাৎই হিংস্র হয়ে উঠলো মোলায়েম আদর। নিভ্রান যেনো হুঁশে নেই। রাত্রি কাতরে উঠলো। পিঠ থেকে হাত সরিয়ে নিভ্রানের গালে রেখে আর্তনাদ করে বললো,
—“শান্ত হন।”

নিভ্রান শান্ত হলোনা। উন্মাদ হয়ে উঠলো আরো। হঠাৎ একটা আগ্রাসী কামড়ে চোখের জল ছেড়ে দিলো রাত্রি। একহাত দিয়ে বুকে ঠেস দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে বললো,
—“ব্যাথা পাচ্ছি।”

নিভ্রান থেমে গেলো। একফোঁটা চোখের পানি টুপ করে পড়লো তার ঘাড়ে। মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো তীব্র অনুশোচনা। সে কি করছে? ছিহ্! ঠোঁট সরে গেলো। নিভ্রান স্হির চেয়ে রইলো ভেজা গালে। রাত্রি মাথা নিচু করে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছলো।
কান্নাভেজা কন্ঠেই অপরাধীর মতো ক্ষীণ গলায় থেমে থেমে বললো,”সরি আমি…সত্যিই ব্যাথা পাচ্ছিলাম। নয়তো আপনাকে বাঁধা দিতাম না।”
নিভ্রান নমনীয় চোখে চাইলো। সরি তো তার নিজের বলা উচিত। উল্টো মেয়েটা নাকি সরি বলছে। মাথার পিছে হাত রেখে রাত্রিকে কাছে টেনে নিলো সে। কপালটা নিজের কাঁধে ঠেকিয়ে চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে কোমল গলায় বললো,
—“বেশি লেগেছে রাত?”

রাত্রি কোমড়ের শার্ট মুচরে ফুঁপিয়ে উঠলো। মানুষটা কাছে এলেই কেনো সব ভেস্তে যেতে হবে? কেন সে একটু সহ্য করতে পারলোনা? কেনো ব্যাথা পেতে হলো? কেনো আটকে দিতে হলো?
নিভ্রান দীর্ঘ: শ্বাস ফেললো। চোখ বুজে রইলো বেশ কিছুক্ষণ। অত: পর নম্রভাবে বললো,”আচ্ছা, কাঁদেনা। দেখি, কোথায় লেগেছে? ওষুধ লাগিয়ে দেই, আর জ্বলবেনা।” বলে বাহু ধরে সরাতে নিলো সে। রাত্রি সরলোনা। হাতদুটো দিয়ে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ভেজা বুকের সাথে লেপ্টে রইলো।
নিভ্রান গাঢ় রাশভারি কন্ঠে বললো,
—“আমি তোমাকে চাইছি রাত। এক্ষুণি চাইছি, এ মূহুর্তেই চাইছি। খুব করে চাইছি। কিন্তু, এভাবে নয়। তোমাকে যন্ত্রনা দিয়ে নয় অবশ্যই। তোমার অনুমতি ছাড়া, শতভাগ সম্মতি ছাড়া আমি হাজারবছরও অপেক্ষা করতে রাজি।”

রাত্রি মিনমিন করে বললো,”আমি তো আপনারই।”

নিভ্রান নিশব্দে হাসলো। মাথার তালুতে ছোট্ট চুমু খেয়ে প্রসন্ন স্বরে বললো,
—“আচ্ছা, ছাড়ো। আমি ভিজে আছি। জড়িয়ে ধরে তুমিও ভিজে যাচ্ছো। জ্বর বাঁধবে। ছাড়োনারে বাবা।”

রাত্রি ছেড়ে দিলো। নিভ্রান শাড়ির আচঁল তুলে দিলো কাঁধে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা ফুলগুলো কুঁড়িয়ে দিলো হাতে। রাত্রি ইততস্ত ভঙ্গিতে কি যেনো দেখলো। বামহাতটা একটু উঠিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে নিভ্রানের ঠোঁটের কাছটায় মুছে দিলো। আঙ্গুলে লেগে গেলো গাঢ় লিপস্টিক। মুছে যাওয়ার বদলে আরো ছড়িয়ে গেলো ঠোঁটের কোঁণে। নিভ্রান হেসে ফেললো। বারকয়েক ঘষে ঘষে মোছার চেষ্টা করে বললো,”গেছে?”
রাত্রি দু’পাশে মাথা নাড়ালো। নিভ্রান হাল ছেড়ে বললো,
—“থাক, সমস্যা নেই।”
______________

বাসায় এসে শাওয়ার নিয়ে, খাওয়া দাওয়া করে রুবিনার কোলে মাথা রেখে বহুক্ষণ শুয়ে রইলো রাত্রি। মাথায় ঝট পাকিয়ে আছে গোলমেলে অনুভূতি। হচ্ছে তীব্র চিনচিনে ব্যাথা। রুবিনা মেয়ের ভেজা চুলের গোছা ছড়িয়ে দিচ্ছে বারবার।
হঠাৎই চোখ পড়লো ঘাড়ের লাল হয়ে আসা অংশে। ভ্রু কুঁচকে গেলো। পরক্ষণেই মুখে ফুটে উঠলো মিষ্টি হাসি। মেয়ের সুখের সংসার দেখাই যেনো সবচেয়ে সুখের। কিন্তু মেয়েটা এমন গোমড়া মুখে শুয়ে আছে কেনো? ও বাসায় কি কিছু হয়েছে? হলে তো নিশ্চয়ই বলতো তাকে। নিভ্রানের ডাক শোনা গেলো। উচ্চশব্দে রাত রাত করে চিল্লাচ্ছে সে। রাত্রি ঝটপট উঠে বসলো। “আসি” বলে হাঁক ছেড়ে মা কে ঘুমাতে বলে দ্রুত বেরিয়ে গেলো।

ঘরের বাতি নিভানো। ব্যালকনির কাঁচ সরানো। বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে সাড়াঘরে। নিভ্রান বালিশের সাথে হেলান দিয়ে কোলের উপর ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। স্ক্রিনে হয়তো লাল রংয়ের কিছু বের করা। সেই লাল আলোর আভায় সুদর্শন চেহারার আকর্ষন বেড়ে গেছে। কপালে পড়ে আছে কিছু চুল। রাত্রি মুগ্ধ হয়ে দেখলো।
নিভ্রান ল্যাপটপের দিকে চেয়েই একহাতে পাশের জায়গাটায় দুবার হাতের বারি দিয়ে ইশারা করে বললো,” শুয়ে থাকো এখানে, ভালোলাগছেনা আমার।”
রাত্রি তার বাচনভঙ্গি শুনে হেসে ফেললো। দ্রুত বিছানায় উঠে বসে নিভ্রানের বাহুর নিচ দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে বুকে মাথা রাখলো। পেট জড়িয়ে ধরলো। নিভ্রান অবাক হলেও কিছু না বলে ভালোকরে আগলে নিলো। রাত্রি দু’তিন সেকেন্ড মনিটরের দিকে চেয়ে থেকে বললো,
—“অফিস না আপনার নিজের? তো আপনি এতো কাজ করেন কেনো?”

—“আমার দেখেই তো কাজ বেশি।”

রাত্রি প্রত্যুওর করলোনা। ল্যাপটপের স্ক্রীনের উপরে সময় দেখা যাচ্ছে। বুকের বামপাশটায় কান পেতে সে হৃদস্পন্দন গুনলো পুরো একমিনিট। ১০৩, ১০৪, ১০৫। রাত্রি আৎকে উঠলো। সাধারণত হার্টবিট থাকে ৬০-১০০। ১০০ ও উঠেনা সচরাচর। আর এই লোকের নাকি একশোর বেশি তার সাথে এতো জোরে জোরে স্পন্দিত হচ্ছে। চোখেমুখে আশঙ্কা নিয়ে মাথা তুললো সে। কপালে গলায় এলোমেলো হাত ছুঁইয়ে বললো,
—“আপনি ঠি ক আছেন? হার্টবিট এত বেশি কেনো? একশো পাঁচ প্রতিমিনিটে। শরীর খারাপ লাগছে?”

নিভ্রান ভ্রু কুঁচকে বললো,”মানে? আমার হার্টবিট কতো তুমি কেমনে জানলে?”

—“গুনলাম তো মাত্র।”

নিভ্রান ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বললো,
—“তুমি হার্টবিট গুনছিলে? আর আমি ভাবলাম ভালোবেসে বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়েছে বউটা আমার। আহা! এজন্যই তো হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো হু হু করে।”

—“উফফ! আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”

—“পাওয়াই তো উচিত। তোমার জন্যই তো হার্টবিট বেড়ে গেলো। এখন এটা তো তোমারই কমাতে হবে।”
রাত্রি কপালের চুল কানের পিছে গুঁজতে গুঁজতে বললো,
—“পারবোনা। সরুনতো, মাথা রাখতে দিন।”

—“এখানে যে ঘুমাবে…স্ক্রীনের আলোতে ঘুম আসবে?”

রাত্রি চোখ বুজে বললো,
—“খুব আসবে।”

নিভ্রান একহাত দিয়ে চোখের উপরটা ঢেকে দিলো। আলোর প্রবেশপ্রথ বন্ধ হয়ে যেতেই মুচকি হাসলো রাত্রি।
এতো ভাগ্য তার? এতো সুখ কপালে?
নিভ্রান পাঁচআঙ্গুলে ল্যাপটপের কি- বোর্ড এফোড়ওফোড় করে কাজ শেষ করলো আধঘন্টার মধ্য। ল্যাপটপটা বন্ধ করে কোলের উপর থেকে সরাতেই রাত্রি হাল্কা গলায় বললো,”শেষ?”

নিভ্রান সচকিত গলায় বললো,
—“ঘুমাওনি?”

—“উহু। ঘুম পাচ্ছেনা।”

নিভ্রান ল্যাপটপটা বেডসাইড টেবিলে রাখলো। মৃদু শব্দ হলো। গায়ের ব্ল্যাঙ্কেটটা ঠি ক করলো। আধশোয়া শরীর সোজা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে বললো,
—“কেনো ঘুম পাচ্ছেনা?”

রাত্রি হরিণীর মতো চোখদুটি মেলে চেয়ে রইলো নির্নিমেষ। লাজলজ্জা ভেঙে আচমকাই একটু উঠে গিয়ে চোখ মেলালো চোখে চোখে। কপাল ঠেকালো কপালে। ক্ষণিকসময়ের নিরব কথোপকথন শেষে যা বোঝার বুঝে গেলো নিভ্রান। তৃপ্ত হেসে দু’হাতে কোমড় জাপটে ধরে বললো,”রাত?”
রাত্রি চোখ নামিয়ে নিলো। উষ্ণ অনুভূতিতে তপ্ত হলো আশপাশ। বৃষ্টির গতিকের সাথে তাল মিলিয়ে চললো এতদিনের অপেক্ষার অবসান।

~চলবে~