এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব-৩৮+৩৯

0
1322

#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩৮

প্রেমস্নিগ্ধ নিশাবসান হলো। প্রত্যুষের নীলাভ আভায় ছেঁয়ে গেছে পৃথিবী। ঘড়ির কাঁটা ভোর পাঁচটা বিশে যেয়ে আটকেছে। রাত্রি চোখ মেললো একটু একটু। আধো জাগ্রত তন্দ্রাঘোরের মাঝেই নিভ্রানের ঘুমন্ত চেহারায় চোখ বুলালো। তাকে বাহুডোরে গুটিয়ে নিয়ে বিভোর হয়ে আছে মানুষটা। দু’নাকের ডগা ছুঁইছুঁই। একটা উক্তি আছে,”মেয়েদের নাকি ঘুমন্ত অবস্থায় সবচাইতে সুন্দর লাগে”। অথচ নিভ্রানের ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখে রাত্রির তক্ষুনি ঘোরতর মিথ্যা মনে হলো এতদিনের প্রচলিত উক্তিটা। ডাহা মিথ্যা! ঘুমন্ত অবস্থায় এই মানুষটাকে সৌন্দর্যের দিক দিয়ে কেও হারাতেই পারবেনা। কক্ষনো পারবেনা। অসম্ভব!
নিজের ভাবনায় ডুবে নিজেই হেসে ফেললো সে। গালের কাছে কিছুক্ষণ বৃদ্ধাঙ্গুল বুলিয়ে কপালের অবিন্যস্ত চুলগুলো বামহাত দিয়ে সরিয়ে গাঢ় করে ঠোঁট ছোঁয়ালো মাঝখানটায়। অনেকক্ষণ, খুব সময় নিয়ে। নিভ্রান একটু নড়েচড়ে উঠলো। ঘুমে আলগা হয়ে আসা হাতের বন্ধন দৃঢ় করলো। তবে চোখ খুললোনা। ঘুম ভাঙলোনা। বাইরে ভোরের আলো ফুটতে আরম্ভ করেছে। বৃষ্টি থামার নাম নেই। পবিত্র প্রেমের সাক্ষী থাকার জন্য সে আজ বিদায় নিতে নারাজ।

আটটার দিকে ঘুম ভাঙলো নিভ্রানের। কাঁধের কাছে মাথা রাখা রাত্রির চুলের গোছা তার নাক- মুখের উপর গড়াগড়ি খাচ্ছে। সুবাসিত নেশা ঘাটানো ঘ্রাণে ঝিঁমিয়ে আসলো নাসিকারন্ধ্র। হাত উঠিয়ে চুলগুলো সরিয়ে দিলো সে। ঘড়ির দিকে চেয়ে যত্ন করে রাত্রিকে বালিশে শুইয়ে গলা পর্যন্ত ব্ল্যাঙ্কেট তুলে দিলো। মেয়েটা ক্লান্ত। আজ আর ভার্সিটির জন্য ডাকার দরকার নেই। ঘুমাচ্ছে ঘুমাক।
______________

রাত্রি উঠেছে দুপুরের দিকে। লোকটা তাকে ডাকেনি কেনো? ক্লাস মিস হয়ে গেলো। অভ্যাসবশত পাশ থেকে ফোন হাতে নিলো। স্ক্রিনে মেসেজ আইকন উঠে আছে। চাপ দিতেই দেখা গেলো নিভ্রানের মেসেজ,”আজকের নোটসগুলো আসার সময় নিয়ে আসবো আমি। চিন্তা করোনা।”
মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটে। ফোনটা রেখে শাওয়ার নিয়ে বাইরে বের হলো সে। টেবিলে খাবার সাজানো। নাস্তা কে বানালো? খালা ঘর মুছছে তখন। তাকে দেখেই একগাল হেসে বললো,”ভাইয়ে আপনের আর খালাম্মার নাস্তা বানায় রাখতে কইছিলো। খালাম্মার টা সক্কালেই দিয়াইসি। আপনেরটা এতক্ষণে ঠান্ডা হইয়া গেসে। গরম কইরা দিমু?”
রাত্রি চেয়ার খুলে বসতে বসতে বললো,
—“না খালা দরকার নেই। আপনার ভাইয়া খেয়েছেন?”

—“না, আমি কইলাম খাইয়া যান, কয় দেরি হইয়া গেসে, খাইবোনা।”

রাত্রির মন খারাপ হয়ে গেলো। মানুষটা না খেয়েই চলে গেছে? এমনেও দুপুরে ঠি ক মতো খায় কিনা জানেনা। কতবার বাসা থেকে খাবার বানিয়ে দিতে চেয়েছে নিবেইনা। জেদি একটা। ইশ! তার ঘুমটা সকালে ভাঙলোনা কেনো? মানুষটার এতটুকু খেয়ালই রাখতে পারেনা সে। ধ্যাত্।

সারাদিন এ ঘর ও ঘর করেই কাটলো। বিকেলের দিকে আলমারি খুলে বসলো রাত্রি। বিয়ের শাড়িটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলো পাক্কা ত্রিশমিনিট যাবত। আলমারির উপরের দিকের একটা তাকে নিভ্রানের কয়েকটা জামাকাপড় আলাদা করে রাখা। রাত্রি হাতের নাগাল পায়না অতদূরে। তাই দেখাও হয়নি কখনো। তবে আজ দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।
কাজ নাই আর কি ই বা করবে এখন? বাড়তি সময়গুলোই হয় যতো অকাজের কারখানা। ডাইনিং টেবিল থেকে একটা চেয়ার এনে সেটার উপর উঠে দাড়ালো সে। এখন আরামে নামানো যাবে কাপড়গুলো।
একটা ব্ল্যাক কালারের পোলো টি- শার্ট, হাল্কা নীল রংয়ের শার্ট, গ্রে কালারের শার্ট, আর দু-তিনটা মেয়েদের চুলের চিকন কালো ক্লিপ। রাত্রি কপাল কুঁচকালো। ভাঁজ করে রাখা কাপড়গুলো দু’হাতে ধরে নামালো। সব শার্ট, টি- শার্ট তো নিচেই রাখা। এগুলো আলাদা কেনো? অদ্ভুততো।

নিভ্রান ফিরলো তাড়াতাড়িই। কলিংবেল না বাজিয়ে পকেট হাতড়ে চাবি বের করে গেট খুললো। রাত্রি ঘরে ছিলো তখন। দরজার আওয়াজ শুনতেই চট করে বেরোলো সে। নিভ্রানকে সবে ঢুকতে দেখে স্হির চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। নিভ্রান একঝলক তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বামহাতটা সোজা বাড়িয়ে দিলো। অর্থ,”কাছে আসো।”
রাত্রি চুপটি করে এগিয়ে গেলো। নিভ্রান কপাল টেনে চুমু খেলো প্রথমেই। পিছন দিয়ে অপরপাশের বাহু জড়িয়ে নিয়ে বললো,” কি করছিলে?”

রাত্রি ছোট্ট করে উওর দিলো,”কিছুনা।”

ঘরে এসে চোখ গেলো বিছানায় রাখা জামাকাপড়গুলোর দিকে। নিভ্রান দেখেও না দেখার ভান করলো।
ব্যাগ থেকে একটা ক্লিয়ার ফাইল বের করে সেন্টার টেবিলের উপর রেখে বললো, “তোমার নোটস। সাবজেক্ট টি চারদের থেকেই আনিয়েছি। ভুল থাকবেনা কোনো।”

রাত্রি হাতে নিলো। নিভ্রান শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে আড়চোখে আরো কিছুক্ষণ দেখে নিলো বিছানার কাপড়গুলো। রাত এগুলো বের করেছে কেনো? কিছু বুঝে গেছে নাকি মেয়েটা? হায় আল্লাহ!
শার্টটা গা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ধীরকন্ঠে বললো সে,”এগুলো বের করে রেখেছো কেনো?”
রাত্রি শুনতে না পেয়ে বললো,
—“জি?”

নিভ্রান গলা ঝেড়ে বললো,”ওগুলো বিছানায় রেখেছো কেনো? আলমারিতে ছিলোতো।”

রাত্রি সহজ গলায় উওর দিলো,”আপনি একয়টা জিনিস আলাদা করে রেখেছেন কেনো?”

নিভ্রান আমতাআমতা করলো। সে খুবই পাগলাটে স্বভাবের। এ জিনিসগুলো যত্নে রাখার পিছনেও কারণ আছে। রাত কে কি বলবে? মেয়েটা উল্টোপাল্টা ভেবে বসবে না তো? কেঁদে দেয় যদি?
রাত্রি উওরের আশায় চেয়ে আছে। নিভ্রান নামানো কন্ঠে বললো,
—“ওগুলো খুব স্পেশাল রাত।”

—“জামাকাপড় স্পেশাল হয় নাকি?”

নিভ্রান হাসলো। রাত্রি সন্দিহান কন্ঠে বললো,”হাসছেন কেনো?”

নিভ্রান ইশারা করে বললো,”নিয়ে আসো, বলছি কেনো স্পেশাল হয়।”

রাত্রি কাপড়গুলো হাতে তুলে নিলো। নিভ্রানের কাছে যেতেই তাকে টেনে উরুর উপর বসিয়ে নিলো সে। টি- শার্ট গুলো নামিয়ে রাখলো কাঁচের টেবিলের উপর। উপরের ক্নিপগুলো একসাথে করে রাখলো।
রাত্রির কানে গোঁজা চুলগুলো অযথাই আবার গুঁজে দিয়ে বলতে শুরু করলো,”এইযে কালো টি- শার্টটা এটা সেই প্রথমদিন পরে ছিলাম আমি। সেই যে তুমি বাসের মধ্যে বুকে মাথা রাখলে, জড়িয়ে ধরলে। আমি বাসায় এসে জামাটা আর ধুইনি কেনো জানো? তুমি কেমনে জানবে? আমি নিজেই জানিনা কেনো ধুইনি। শুধু মনে হচ্ছিলো মেয়েটার ছোঁয়াটা মুছে যাবে। গায়ের ঘ্রানটা মিলিয়ে যাবে। ধুয়ে যাবে পানির সাথে। তাই ওভাবেই রেখে দিয়েছিলাম। আর দ্বিতীয়, এই নীল শার্টটা…. তুমি যেদিন প্রথমবার সজ্ঞানে জড়িয়ে ধরে কান্না করলে। ওইযে মাঝরাস্তায়… ব্রিজের উপর…কষ্টগুলো একেবারে নিংড়ে দিলে বুকে। তোমার এলোপাথারি চোখের পানি লেগে গেলো শার্টটায়। আমি সেটাও ধুইনি। তোমার কান্নাগুলো লেগে আছে যে।
তারপর? তারপর এই গ্রে শার্টটা? এটা পরেছিলাম দুজনে বৃষ্টিতে ভেজার দিনটায়। প্রথম বৃষ্টিবিলাস। তোমার আমার সুন্দর মূহুর্তের চাক্ষুষ সাক্ষী। আমি আর পরিনি এটা। এই নির্লজ্জ শার্টটাও সেদিন তোমাকে ভিজতে দেখেছিলো। এটাকে আর বের করিনি। অসভ্য শার্ট।
উহুম! আর ক্লিপ? ক্লিপ… ক্লিপ গুলোও তোমারই। এ পর্যায়ে হেসে ফেললো নিভ্রান। দু’আঙ্গুলে কপাল ঘষে চোখ লুকিয়ে বলল,”এগুলো আমি নিয়ে এসেছিলাম তোমার বাসা থেকেই। ওইযে ছাতা আনতে গিয়েছিলাম যে। তুমি বোধহয় টের পাওনি। পানির গ্লাসে কদমফুল ডুবাচ্ছিলে তখন কি ভেবে যেনো বালিশের পাশ থেকে ক্লিপগুলো পকেটে ঢুকিয়ে নিলাম। চোরের মতো। নিয়ে এসে রেখেদিলাম যত্ন করে। কি যে ভালো লাগছিলো।”

এতটুকু বলে থামলো নিভ্রান। রাত্রি পানিতে পরিপূর্ণ টলমলে চোখে চেয়ে আছে। ছোট্ট চোখে জায়গা করতে না পেরে টপ টপ করে গাল গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো কান্নারা। নিভ্রানের হাসি মিলিয়ে গেলো। গালে হাত রেখে গমগমে গলায় বললো,
—“এই মেয়ে, খবরদার! কাঁদবে না।”

রাত্রি কথা শুনলোনা। শুনলোনা তার টলমলে চোখ। অবাধ্য অশ্রু বিসর্জিত হতে লাগলো। ঠোঁট কাঁপতে লাগলো থরথর করে। ফোঁপানোর শব্দে নরম হয়ে এলো নিভ্রানের কন্ঠ,
—“এজন্যই বলতে চাচ্ছিলামনা। ধুরো, কাঁদেনা। কেনো কাঁদছো? আমি ক্লিপ চুরি করে এনেছি বলে?”

রাত্রি কাঁধে মুখ গুঁজলো। দু’হাতে গলা জড়িয়ে ঝাঁঝালো স্বরে বললো,
—“আপনি ভালোনা। একদম ভালোনা।”

নিভ্রান হাসলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,” তুমি আমার জন্য কি আমি নিজেও জানিনা রাত। শুধু এতটুকু জানি, অকস্মাৎ এক বৃষ্টির দিনে সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে উপহার পাওয়া আমার একমাত্র মেঘরাণী তুমি। পৃথিবীতে রাত না নামলে সব যেমন অসামন্জস্যতায় ছেঁয়ে যাবে। সূর্যের আলোয় ঝলসে যাবে সমস্ত জগৎ। তেমনি আমার জীবনে তুমি নামক রাতটা না নামলে এই প্রেমিক হৃদয় ঝলসে যাবে, জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে যাবে সব। দগ্ধ হবে প্রেম আর তোমার আমি।”

~চলবে~

#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩৯

কাগজে কাগজে ভরতি বিছানা। কাবার্ড থেকে পুরাতন ফাইলপত্র ঘেঁটে অপ্রয়োজনীয় ফাইলগুলো আলাদা করছে নিভ্রান। জমে জমে স্তুপ হয়ে গেছে। বাইরে ঝলমলে মধ্যাহ্ন। ভাদ্র মাসের রৌদ্রছায়ার খেলা চলছে। এখনি নীল মেঘ আবার বিকেলেই ঘনালি জলধারা নামবে বলে। বর্ষা বিদায় নিলো আজ অনেকদিন তবু যেনো তার রেশটা রয়ে গেছে। রাত্রি ঘুমাচ্ছে বিছানার মাঝখানটায়। ছুটির দিন। শুক্রবার। দুপুরের খাওয়াদাওয়া হয়নি এখনো। বারোটার মধ্য রান্না শেষ করে ঘুম দিয়েছিলো রাত্রি। এখনো উঠেনি। মাঝেমধ্যেই ঝিঁমাতে দেখে আজকাল। নিশাদ বাসায় বেড়াতে এসেছে তিনদিন হলো। সেও নিজের ঘরেই ঘুম। সকালে টেনেটুনে নাস্তা দিয়েছিলো রাত্রি। তারপর আর হুঁশ নেই।
অলস সময়। নিভ্রান কাবার্ড সাফাই করে খালি করলো অনেকটা। দু’বছর আগের ফাইলও জমিয়ে রাখা ছিলো। কোনো কাজ নেই এগুলোর। ফেলে দিবে। রাত্রির পায়ের কাছটায় কাগজগুলো অগোছালো করে রেখেই শাওয়ার নিতে ঢুকলো সে।
বের হলো যখন তখন প্রায় অর্ধশত বা তারও বেশি কাগজের নৌকায় ডুবছে বিছানা। নিভ্রান তব্দা খেয়ে দাড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এলোমেলো চুলের গোছা একটু পর পর কানে গুঁজতে গুঁজতে মনোযোগ সহকারে নৌকার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে ব্যস্ত রাত্রি। পরণে একটা সাদা রংয়ের শাড়ি। ব্লাউজটা গাঢ় সবুজ। সদ্য ঘুম ভাঙা মায়াবী মেঘের শুভ্রতম টুকরো যেনো। ব্লাউজটায় গোলাপপাতার সবুজের ছোঁয়া। আস্ত এক প্রকৃতিকন্যা।

—“কি করছো রাত?”

রাত্রি মুখ তুলে তাকালো। কপাল ভরে চুলের গোছা একপাশ ঢেকে দিলো সঙ্গে সঙ্গেই। কাগজ ভাঁজ করা থামিয়ে চুল সরালো সে। নিভ্রানের উদাম গা। টাওয়াল দিয়ে ভেজা চুল মুছছে। শ্যামবর্ণের বলিষ্ঠ দেহের রোমশ বুকে আরো একবার প্রেমে পড়লো রাত্রি। চোখ নামিয়ে বললো,

—“আপনি ভালো করে মাথা মুছবেন। ভোররাতে আপনার জ্বর এসেছিলো।”

নিভ্রান ভ্রু কুঁচকে বললো,
—“জ্বর এসেছিলো? কই?”

—“জ্বর কি এভাবে দেখা যায় নাকি? আমি ছুঁয়ে দেখেছিলাম। গা গরম ছিলো।”

নিভ্রান টাওয়াল রাখলো। আয়নার সামনে যেয়ে হাত দিয়ে আলগা পানি ঝেড়ে নিলো।

—“ফজরওয়াক্তে উঠে সকাল পর্যন্ত জেগে জেগে আমাকে না দেখলে হয়না তোমার? ঘুমাও না ঠি ক ঠাক। এজন্যইতো শরীর খারাপ করে। পরশুদিন বমি করলে কতবার যেনো? দু’বার নাকি তিনবার?”

রাত্রি খোঁচাটা ধরতে পারলো ঠি কই। আরো একটা নৌকা পাশে রেখে নতুন কাগজ হাতে নিতে নিতে বললো,”ধ্যাত। সারাদিন একটাই কথা।”

নিভ্রান শার্ট গায়ে দিলো। ফোনে কি যেনো করলো। ঘড়ি পড়লো। ভেজা চুলেই চিরুনি ব্রাশ করলো। পকেটে মানিব্যাগ ঢোকালো। গায়ে পারফিউম দিলো। শেষমেষ ড্রয়ের থেকে একটা কাঁটা নিয়ে গিয়ে রাত্রির চুলে খোঁপা বেঁধে দিতে দিতে বললো,
—“শুধু শুধু টমেটো সস আরেকদিন খেতে দেখি তোমাকে।”

রাত্রি তেঁতে উঠলো,”ধুরো, যানতো আপনি।” পরক্ষণেই কি একটা ভেবে হাতের কাগজ রেখে বিছানা ছেড়ে নেমে
বললো,”ওহ না, যাবেন কেনো? দুপুরে তো খাননি। চলুন খাবেন। এই ছুটির দিনে এত সেজেগুজে যাচ্ছেন কোথায়?”

নিভ্রান ছড়ানো ছিটানো নৌকাগুলো একপাশে জড়ো করে রেখে বললো,”যাচ্ছি কাজে। তুমি এতো নৌকা দিয়ে করবেটা কি রাত?”

রাত্রি মিনমিন করলো,”জানিনাতো।”

নিভ্রান হাসলো কেবল। কিছু বললোনা। বাকি কাগজগুলো সেভাবেই পড়ে রইলো। ফেলার চিন্তা সেই কখন চলে গেছে মাথা থেকে।

____________

নিশাদকে উঠাতে উঠাতেই সাড়ে তিনটা বেজে গেছে। এত গাঢ় ঘুম তার। বাসায় ডাকাত পড়ে গেলেও টের পাবেনা। উঠে শাওয়ার না নিয়েই ঢুলতে ঢুলতে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টানলো সে। ভাত গরম। রাত্রি মাত্র গরম করে এনেছে। ধোঁয়া উঠছে এখনো। নিভ্রান বসে আছে পাশে। নিশাদ মাথা কাত করে তার কাঁধে রাখলো। চোখ বন্ধ করলো। রাত্রি ভাত বাড়ছে তিনজনের প্লেটে। মাকে তখন ঘুমানোর আগেই খাইয়ে দিয়েছিলো। রুটিনমাফিক খাওয়াদাওয়া তার। একটু এদিক ওদিক হলে শরীর খারাপ করে। তাই সময়ের হেলাফেলা করেনা একটুও। মায়ের আবার কদিন যাবত পায়ে পানিও এসেছে। হাঁটতে অসুবিধা হয়। আবার ব্যাথাও করে কেনো যেনো।

—“ভাইয়ারে, স্বপ্নে তিন তিনটা পরীর মতো মেয়ে আমাকে খাইয়ে দিচ্ছিলো। পরীর মতো না পরীই মনেহয়, ডানা ছিলোনা শুধু। একজন আপেলের টুকরো, আরেকজন লাল আঙ্গুর, আরেকজন কি জানি একটা? নাম জানি না। তারপর হঠাৎই ভুমিকম্প হলো। আর ভুমিকম্পটা ঘটালো কে জানিস? এইযে তোর বউ, আমার ভাবি।” চোখ খুলে হাতের তর্জনী সোজা রাত্রির দিকে তাক করে বললো নিশাদ। রাত্রি হেসে ফেললো। ভাত বাড়া প্লেটটা সামনে দিয়ে বললো,”সপ্নের খাবার খেয়ে আপনার পেট ভরবে না ভাইয়া। স্বাদও পাবেন না। তার চেয়ে বরং ভাত খান। কাজে দিবে।”

নিশাদ অসহায় কন্ঠে বললো,”আমি স্বাদ পাচ্ছিলাম ভাবি। আপেলটা কি যে মিষ্টি। আর আঙ্গুর? মুখে দিলেই যেনো রসালো শরবত হয়ে যাচ্ছিলো।”

—“হু বলেছে? সপ্নে মানুষ স্বাদ পায়না। সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ। আর ঘ্রান পায় ৭ শতাংশ। সপ্ন শুধুই একটা দর্শনের জিনিস। বুঝলেন?

নিশাদ কাঁধ থেকে মাথা উঠিয়ে ভাতে হাত রাখলো। চোখ ছোট ছোট করে বললো,”আপনিতো জলজ্যান্ত গুগল ভাবি।”

খাওয়া দাওয়া হলো তাড়াতাড়িই। নিভ্রান বেরিয়ে গেলো কাজে। বলে গেলো রাত হয়ে যাবে ফিরতে ফিরতে। রাত্রি সব গুছিয়ে রাখলো। নিশাদ ঘরে গিয়ে আবার শুয়েছে। রুবিনাও ঘুম তখন।
______________

রান্নাঘরে ভ্যাপসা গরম। চায়ের পানি ফুটছে টগবগ করে। চপিং বোর্ডে চিকন চিকন করে আলু কাটছে রাত্রি। উদ্দেশ্য তেলে ভেঁজে ফ্রেন্চফ্রাই করা। কপালে ঘাম ছুটে গেছে চুলার আঁচে। হাতটা কেমন কেঁপে যাচ্ছে বারবার। ছুড়ি দিয়ে কয়েকবার বৃদ্ধাঙ্গুল প্রায় কেটেই ফেলেছিলো। অদ্ভুততো! তার তো কখনো এমন হয়না।

ঝলমলে রেস্টুরেন্টে বসে অফিসের মিটিং করছে নিভ্রান। সামনে ডিলাররা বসে আছে। গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট। ফোন সাইলেন্ট করা। কথা বলায় ব্যস্ত সে।

“ভাবি”, “ভাবি” বলে চিল্লাতে চিল্লাতে রুম থেকে বের হলো নিশাদ। রোজ এইসময় চা দিয়ে যায় রাত্রি। আজ দিলোনা কেনো? রান্নাঘরে কোনো সাড়াশব্দও পাচ্ছেনা। ডাকছে তবু উওর দিচ্ছেনা। বুকে হঠাৎই ধুকপুকানি শুরু হলো।
অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে রাত্রি। কপালটা ফ্লোরে। চুলগুলো মুখের উপরটা ঢেকে দিয়েছে। চায়ের পানি শুকিয়ে গেছে। পাতিল পুড়ে যাচ্ছে। ছুড়িটা কিছুটা দূরে ছিঁটকে পড়ে আছে ফ্লোরে।। নিশাদ চুলাটা নিভালো। দ্রুত ফ্লোরে বসে মাথাটা কোলে তুলে নিলো। চুল সরালো। কপালের কোঁণ ফেঁটে রক্ত বেরিয়ে গেছে। এক দু’বার গালে হাল্কা হাতে থাপ্পড় মেরে রুদ্ধ কন্ঠে ডাকলো,”ভাবি? ভাবি কি হলো? উঠেন। ভাবি?”
কন্ঠে ভয়াবহ আতঙ্ক। মেয়েটার মধ্য তার ভাইয়ের জান থাকে। গলা শুকিয়ে গেছে। খানিকক্ষণ ইততস্ত করে রাত্রিকে কোলে তুলে নিলো সে। নিজের ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিলো বিছানায়। জগে পানি নেই। বালিশের পাশ থেকে ফোন নিয়ে নিভ্রানের নাম্বারে ডায়াল করতে করতে ডাইনিং এ ছুটলো। পানি ঢাললো গ্লাসে। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হলোনা। বুকের ভেতর হাঁতুড়ি পেঁটা হচ্ছে। পানি হাতে ঘরে গেলো। মুখে ছিঁটালো অল্প করে। জ্ঞান ফিরলোনা। নড়চড় নেই একদম। নিভ্রানকে এবারো পাওয়া গেলোনা ফোনে। উপায় না পেয়ে ডাক্তারকে কল করলো সে। বাসায় আসতে বললো। এখান থেকে হসপিটাল অনেক দূরে। যেতে যেতে যদি কিছু হয়ে যায়। এরচেয়ে তার পরিচিত এক ডাক্তারের বাসা কাছে। তার আসতে বেশি সময় লাগবেনা।
একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতেই দেখলো হাতের আঙ্গুলও কেটে গেছে রাত্রির। বৃদ্ধাঙ্গুলের ডগা থেকে অনেকটা নিচ অবধি। টুপটুপ করে রক্তের ফোঁটা সাদা আঁচলে লেগে যাচ্ছে। নিশাদ উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁফ ছাড়লো। ফাস্ট এইড বক্স খুঁজে বসে পড়লো পাশে। কাঁপা হাতে কপালের রক্ত পরিষ্কার করলো। হাতে ব্যান্ড- এইড লাগিয়ে দিলো। পাশে ফোন রেখে লাউডস্পিকার অন করে কল দিয়েই যাচ্ছে সে। সতেরো তম বারে রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে নিভ্রানের চাপা স্বর,
—“আমি মিটিংয়ে নিশাদ। একটুপর..”

নিশাদ কথার মাঝেই বললো,
—“ভাবি সেন্সলেস হয়ে গেছে ভাইয়া। রান্নাঘরে…”

ওপাশ থেকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ানোর শব্দ হলো। তারপর হাঁটার শব্দ। গট গট। নিশাদ এপাশ থেকেই বুঝতে পারলো। নিভ্রান ঠান্ডা গলায় বললো,
—“ও মাঝেমধ্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলে নিশাদ। তুই মুখে পানি ছিঁটা।”

—“ছিঁটিয়েছি ভাইয়া। জ্ঞান ফিরেনি। তুই আয়। ভয় লাগছে।” কপাল ফাঁটার কথাটা এড়িয়ে গেলো সে। নিভ্রান প্যানিক হয়ে উল্টোপাল্টা গাড়ি চালাবে। শেষে আরেক বিপদ হবে।
গাড়ি স্টার্ট দেয়ার ঝনঝনে শব্দ। নিভ্রান বললো,
—“ডক্টর কল করেছিস?”

—“করেছি তুই আয়।”

—“আসছি”। ফোন কেটে গেলো। নিশাদ আবার পানি ছিঁটালো। এবার একটু বেশি করে। চোখমুখ ভিজে গেছে পানিতে। পাপড়িগুলো নড়লো একটু। বামহাতের তর্জনী কাঁপলো।
_____________
মহিলা ডাক্তার। মিস.নিকিতা। রাত্রির পালস চেক করছেন। নিভ্রান বসে আছে মাথার কাছে। ব্যান্ড- এইড লাগানো ডানহাতটা তার দু’হাতের মুঠোয় বন্দি। নিশাদ দাড়িয়ে আছে। রুবিনা চিন্তাপূর্ণ ভেজা চোখে চেয়ে আছে মেয়ের মুখের দিকে।
মিস.নিকিতা কিছুক্ষণ পরীক্ষা করলেন। ডাক্তাররা সাধারণত যা করেন তাই করলেন। চোখ দেখলেন। হার্টবিট মাপলেন। প্রেশার মাপলেন। কপালে আগেই ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। ক্ষতটা অত গাঢ় না।
শেষমেষ বললেন,
—“উনার তো সবকিছুই নরমাল। তাছাড়া আপনারা বললেন,দুদিন আগে বেশ বমি হয়েছিলো। আর এভাবে হঠাৎ ফেইন্ট হয়ে যাওয়া। আমার ধারনা মতে, উনি খুব সম্ভবত সন্তান সম্ভবা।”

নিভ্রান দু’বার পলক ঝাঁপটালো। অনিশ্চিত কন্ঠে বললো,”সরি?”

মিস.নিকিতা হাসলেন,”আমি একেবারে শিওরিটি দিচ্ছিনা। তবে লক্ষণগুলো প্রেগন্যান্সির সাথেই মিলে যায়।
অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আমার ধারণা ভুলও হতে পারে। আপনিতো উনার হাসবেন্ড, আপনি আরো ভালো জানবেন।”

নিভ্রান চুপ থাকলো কিছুক্ষণ। মুঠোয় থাকা ঠান্ডা হাতটা দু’হাতে ঘঁষতে ঘঁষতে বললো,”ওর জ্ঞান ফিরবে কখন?”

—“ফিরে যাবে। একঘন্টার মাঝেই। খাওয়া দাওয়ার দিকে খেয়াল রাখবেন। শরীর দূর্বল। রক্তশূন্যতা আছে।বেদানা খাওয়াবেন বেশি বেশি। আর কাল যেয়ে একটা টেস্ট করিয়ে শিওর হয়ে নিয়েন। যদি পজিটিভ হয় তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ। আর নেগেটিভ হলেও রিপোর্টে এসে যাবে।”

নিভ্রান সৌজন্যমূলক হেসে বললো,”জি অবশ্যই।”

উনি চলে গেলেন একটুপর। কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে গেলেন যাওয়ার আগে। রুবিনা হাসছেন একটু একটু। সামনে বসা নিভ্রানের চোখে মুখে কোনো অস্পষ্টতা নেই। একধ্যানে রাত্রির চুলে হাত বুলাচ্ছে ও। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন পাকাপাকি খুশির সংবাদ আসবে কালকে।
নিশাদ ফিরে এলো। নিভ্রান মলিন হেসে বললো,”মুখটা শুকিয়ে গেছে। একটু ঠান্ডা পানিতে লেবু চিনি মিশিয়ে এনে দে তো। জ্ঞান ফিরলে খাওয়াবো।”

নিশাদ এনে দিলো। নিভ্রান গ্লাসটা পাশের টেবিলে রেখে রুবিনাকে বললো,”আপনি খেয়ে শুয়ে পড়ুন আম্মু। পরে শরীর খারাপ করবে। আমি আছি ওর সাথে। চিন্তা করবেন না।”

রুবিনা গেলো জোরাজোরিতে। নিভ্রান তখনো চেন্জ করেনি। শার্ট- প্যান্টই পরে আছে। নিশাদ সোফায় বসে রইলো কিছুক্ষন। এখন একটু শান্তি লাগছে। নিভ্রান একপলক ভাইয়ের দিকে তাকালো। ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। নিশাদকে রেস্ট নিতে বলে আলতো হাতে রাত্রিকে কোলে তুলে নিলো সে। একটু কি ভার ভার লাগছে শরীরটা? দুজনের ভার? নাকি অবচেতন মন অযথাই বেশি ভেবে বসে আছে? আসলেই কি বেশি? অসম্ভব কিছু তো নয়।

~চলবে~