জলফড়িঙের-খোঁজে পর্ব-৩৩+৩৪

0
730

#জলফড়িঙের-খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৩৩
.

অবাধ্য সময় তার নিজস্ব গতিতে বয়ে চলেছে। সে কখনই কারো কথা শোনেনা, বোঝেনা, কারও অপেক্ষাও করেনা এটা সবাই জানে। কিন্তু তবুও সময়কে হাতের মুঠোয় বেঁধে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা অনেকেই করে। আবার অজান্তেই সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া মানুষের অভাব নেই। কেউ নিজের সুখের সময়টাকে ধরে রেখে দিতে চায়, আবার কেউ কষ্টের সময়গুলোকে দ্রুত পার করে ফেলতে চায়। কিন্তু সময়তো তার নিজস্ব ধারাতেই চলে। কারো সুবিধা অসুবিধা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। আবার আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুযায়ী তো সময় শুধু মানুষকে নিরাশ করতেই পটু। দেখতে দেখতে দুটো বসন্ত পেরিয়ে গেছে। সময় নিজের সাথে সাথে অনেককিছুই বদলে দিয়েছে। কিন্তু যত যাই হোক জীবন কারোর জন্যে থেমে থাকেনা। তাই সকলের জীবনই নিজের গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কীভাবে এগোচ্ছে সেটাই ভাবার বিষয়।

” Thanks sir, hope you got your answer. It was good to talk. see you at the next meeting.”

” Sure.Good luck to you.”

কথাটা বলে সামনের ব্যাক্তির সাথে হ্যান্ডশেক করে তাকে বিদায় দিল সৌহার্দ্য। ল্যাপটপটা বন্ধ করে চোখ থেকে চিকন ফ্রেমের চশমাটা খুলে টেবিলে রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে একটা লম্বা শ্বাস ফেলল। এরপর টেবিলের ওপরের লাল বাটন চাপতেই দ্রুত দরজার সামনে একজন ছেলে এসে উপস্থিত হয়ে বলল,

” ইয়েস স্যার?”

” পূট এভরিথিং ইন ওর্ডার এন্ড দেন গো। আ’ম লিভিং।”

ছেলেটা মাথা নাড়ল। সৌহার্দ্য কিছু না বলে অফিস থেকে বেড়িয়ে গেল নিজের ফ্লাটের উদ্দেশ্যে। সৌহার্দ্য ফ্লাটের ঢোকার সাথেসাথেই একজন মধ্যবয়সী মহিলা জানতে চাইলেন যে এখন সৌহার্দ্য কী খাবে এখন।

” ব্রিং আ কাপ অফ ব্লাক কফি।”

মহিলাটি কফি আনতে চলে গেলেন। সৌহার্দ্য ফ্রেশ হতে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই উনি একটা ধোঁয়া ওঠা কফির মগ নিয়ে এসে টেবিলে রেখে চলে গেল। সৌহার্দ্য ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে এসে কফির মগটা হাতে নিয়ে চলে গেলো বারান্দায়। বিশাল উঁচু বিল্ডিং এর ব্যালকনি থেকে দেখছে শহরটাকে। বেশ রাত হয়ে গেছে। তবুও শহরটাতে আলো ঝলমল করছে। সূর্য ডুবে যাওয়ায় আলোর বোধ হয় কোন কমতি হয়না এ শহরে। বরং আলোর মাত্রা বেড়ে যায় বলেই মনে হয় সৌহার্দ্যর কাছে। আকাশচুম্বী সব টাওয়ার, বিশাল বিশার আধুনিক স্হাপত্য, এতো আলো, নিচের সমতল বিস্তৃত রাস্তা দিয়ে ছুটে চলা অগনিত যানবাহন। ধোঁয়া ওঠা কফির মগে চুমুক দিতে দিতে ব্যাংককের এই সৌন্দর্য দেখছে সৌহার্দ্য। কিন্তু উপভোগ করছে কি-না সেটা বলা মুসকিল। চারপাশে চোখ বুলিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে চোখজোড়া নিচে নামালো সৌহার্দ্য। হাসিটাতে সম্ভবত তাচ্ছিল্যই মিশে ছিল। হয়ত নিজের ওপরই হাসল ও। সত্যিই জীবনটা অদ্ভুত দিকে মোড় নিয়েছে ওর। দুই বছর অনেকটা সময় কাউকে বদলে দেওয়ার জন্যে। সৌহার্দ্যর মধ্যেও বদল ঘটেছে তবে সেটা অন্যরকম। সৌহার্দ্য আগের মত থাকলেও নিজের জীবন নিয়ে ওর আর কোন সিরিয়াসনেস নেই। ও ওর বর্তমান ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু ভাবছেও না। ওর জীবনের এখন একটাই উদ্দেশ্য যতদিন বেঁচে আছে ততদিন বাবার এই ব্যবসা সামলে যাওয়া। নিজের জীবন নিয়ে অদ্ভুত ভাবনা ভাবতে ভাবতেই ফোন বেজে উঠল সৌহার্দ্য। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল ওর মা মিসেস নাহার ফোন করেছে। সৌহার্দ্য ফোনটা রিসিভ করে সালাম দিলো। মিসেস নাহার সালামের জবাব দিয়ে বললেন,

” কেমন আছিস, বাবা?”

সৌহার্দ্য মুচকি হেসে বলল,

” ভালো। নিজে থেকে একটু ফোনও তো করতে পারিস বল। নিজেকে এভাবে গুটিয়ে রাখার কোন মানে আছে?”

” গুটাতে আর পারলার কই? এতোগুলো পিছুটান আছেতো। গুটিয়ে তো অন্যকেউ গেছে। ছাড়ো এসব, তুমি কেমন আছো? বাবা কেমন আছে? আপুই ঠিক আছে তো? আর চ্যাম্প?”

” আমরা সবাই ঠিক আছে। তোর ফুপা-ফুপি বলছিল..”

বিহান শক্ত কন্ঠে বলল,

“ওনারা কী বলছিল আমি শুনতে চাইনা।”

মিসেস নাহার লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,

“তুই তোর কথা বল, সবার কথা আর কত ভাববি? এবার নিজের জীবনটা গুছিয়ে নে।”

” সবতো গোছানোই আছে।”

মিসেস নাহার এবার একটু রাগী কন্ঠে বললেন,

” না নেই, আর কত এভাবে থাকবি। এবারতো বিয়ে করে নে। নাতি-নাতির মুখ দেখে মরতে দিবিনা না-কি? মেয়েতো আমরা ঠিক করেই রেখেছি। তুই এলেই বিয়ে হবে।”

সৌহার্দ্য বিরক্ত হয়ে বলল,

” মা আমি আগেই বলেছি যা বলার। এসব বলতে ফোন করোনা প্লিজ। আমি কিন্তু ধরব না।”

” আচ্ছা ঠিকাছে বলবনা আর।”

সৌহার্দ্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

” বিহানের কোন খোঁজ পেয়েছ?”

” না রে। কোথায় পাবো। দু’বছর যাবত ছেলেটার কোন খোঁজ নেই। জানিনা কোথায় চলে গেছে।”

সৌহার্দ্য একটা হতাশ নিশ্বাস ত্যাগ করে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকাল। সবকিছুই এমন এলোমেলো হওয়ার কী খুব দরকার ছিল? দু’বছর আগে দেশ ছেড়ে আসাটা কী ভুল ছিল? হয়ত। কিন্তু ও কী করত? ওতো মানুষ পরপর দুজন কাছের মানুষের কাছ থেকে পাওয়া ধাক্কা সামলাতে পারেনি ও। ওখানে খুব কষ্ট হচ্ছিলো, তাইতো চলে এসছিল। ওর মা এখন বিয়ের জন্যে মাঝেমাঝেই খুব চাপ দিচ্ছে ওকে। কিন্তু ওতো পারেনি আর কাউকে মনে জায়গা দিতে। একবার চেষ্টা করেছিল। ভেবেছিল এখানেই বিয়ে করবে। মেয়েটাকে ভোলা প্রয়োজন। কিন্তু পাত্রীর সাথে দুমিনিট কথা বলেই অস্হির হয়ে পরেছিল ও। পারছিল না অন্যকাউকে নিয়ে কিছু ভাবতে। মন আর মস্তিষ্কের যুদ্ধে অবশেষে মস্তিষ্কের হার হয়েছিল। করতে পারেনি অন্যকাউকে বিয়ে। কিন্তু ওর বাবাও নাছোড়বান্দা নিজেই মেয়ে দেখে রেখে দিয়েছে, সৌহার্দ্য ফিরলে যেকোন ভাবেই হোক বিয়ে দেবেনই। একটা ছেলে এভাবে চিরকুমার হয়ে বসে থাকবে সেটা মানা যায়না। কিন্তু সৌহার্দ্য মনে তো এখনও এক রমনীর চঞ্চলতা খেলা করে, সেই খিলখিল হাসি, অদ্ভুত কথা কীকরে ভুলবে? সারাদিন মন থেকে সরিয়ে রাখলেও প্রতিটা নিস্তব্ধ রাতে তুর্বী নামক এই নিষ্ঠুর রমনী হামলা করে সৌহার্দ্যর স্মৃতিজুড়ে, ক্ষতবিক্ষত করে দেয় হৃদয়কে। কেমন আছে ও? নিশ্চয়ই ভালো আছে! আচ্ছা এখনও কী একাই আছে? না-কি বিয়ে করে নিয়েছে। কথাটা ভাবলেই আজও গলা শুকিয়ে আসে সৌহার্দ্যর। আর বিহান? সৌহার্দ্য বিদেশ চলে যাওয়ার পর সৌহার্দ্যর বাবা, বিহানের বাবা-মা সবার ক্ষোভ বিহানের ওপরেই পরে। সেদিন বিহানের বাবা বিহানের ফ্লাটে গিয়ে দ্বিতীয়বারের মত মেরেছিল বিহানকে। প্রথমবারের মত এবারেও বিহান টু শব্দটিও করেনি। পরেরদিন বিহানকে আর ওর সেই ফ্লাটে দেখা যায়নি। কোথায় আছে সেটা আদোও কেউ জানেনা। খবরটা অনেক পরে পৌঁছেছিল সৌহার্দ্যর কানে। সবটা শুনে বেশ রেগে গেছিল সৌহার্দ্য। ফুপার সাথে কথা কাটাকাটিও হয়েছে। তবে ও ফিরতে পারেনি। বিহানের কথা ভেবে সৌহার্দ্যর ভেতর থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেড় হল। একসঙ্গে কাটানো অনেক স্মৃতি এসেও ভর করল। সৌহার্দ্য চোখ বন্ধ করে অস্বুট স্বরে বলল, ‘বিহান’।

___________

প্রচন্ড গরম পরেছে। বিকেল হয়ে গেজে, কিন্তু রোদ এখনও মাথার ওপরে আছে এমনই মনে হচ্ছে আজ। যেমন তীব্র ঝলমলে আলো তেমনই তার উষ্ণতা। বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালীন এই গরম প্রায় সবার অবস্থাই নাজেহাল করে দেয়। লোডশেডিং হয়ে গেছে। গ্রামগঞ্জে এই লোডশেডিং নামক ঘটনাটা তুলনামূলক একটু বেশিই ঘটে। কারেন্ট না থাকায় গরমে সবার অবস্থা আরও খারাপ। রিখিয়া অফিসরুমে নিজের টেবিলে বসে ঘাম মুছছে আর লিখছে। গরমে খুব কষ্ট হচ্ছে এই মুহূর্তে ওর। হঠাৎ ঠান্ডা হাওয়া পেয়ে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল শাফিন হাওয়া করছে ওকে। এ দু’বছরে শাফিনের সাথে রিখিয়ার সম্পর্কটা একটু ভালো হয়েছে। গ্রামে চলে আসার পর ওকে অনেকভাবে হেল্প করেছে শাফিন। ওর বাবে-মাকেও অনেক সাহায্য করে। ওখান থেকেই আস্তে আস্তে ফ্রি হয়েছে দুজন। প্রথমে একটু অপ্রস্তুত হলেও পরে রিখিয়া মুচকি হেসে বলল,

” শাফিন ভাই, আপনি এখানে?”

উত্তরে শাফিনও মুচকি হেসে বলল,

” এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম ভাবলাম দেখা করে যাই। বাড়ি ফিরবে না?”

” হ্যাঁ হাতের কাজটা শেষ করেই ফিরব।”

” চল তাহলে একসাথে ফেরা যাক।”

রিখিয়া সম্মতি জানালো। কাজ শেষ করে দুজনেই গ্রামের রাস্তা ধরে হাটতে হাটতে যাচ্ছে। হঠাৎ শাফিন দেখল আইসক্রিম ওয়ালা যাচ্ছে। রিখিয়া খাবে কি-না জিজ্ঞেস করতে রিখিয়া হ্যাঁ বলে দিল। কারণ প্রচন্ড গরম পরেছে তাই ঠান্ডা কিছু খেলে ভালোই লাগবে। তবে এই আইসক্রিম দামী ক্রিমি আইসক্রিম নয়। এটা কাঠিওয়ালা সস্তার আইসক্রিম, যাকে আইসবারও বলে। দুজনেই ওরেঞ্জ ফ্লেবারটাই নিল। দুজনে পায়ে হেটে এগোচ্ছে আর আইসক্রিম খাচ্ছে। গাছপালা থাকায় মাঝেমাঝে হালকা বাতাসও লাগছে। হঠাৎ শাফিন বলে উঠল,

” কিছু ভেবেছ রিখিয়া?”

রিখিয়া জানে শাফিন কী জানতে চাইছে। কিন্তু ওর উত্তর বদলানোর নয়। তাই বরাবরের মত চুপ করে রইল। শাফিনও রিখিয়ার মৌনতার মানে বুঝে ফেলল তাই আর কিছু বলল না।

বাড়ি ফিরে রিখিয়া দেখতে পেলো ওর ভাই রায়হান আজও এসছে। রিখিয়ার ভ্রু কুচকে গেল। এই দু-বছরে কম করেও হাজারবার এসছে। রিখিয়া বিয়ে করবেনা এটা সে কেন বুঝতে চায়না? রিখিয়া বিরক্তি নিয়ে রুমে চলে গেল। রায়হান বরাবরের মতই কিছুক্ষণ চিল্লাচিল্লি করে চলে গেল। রায়হান চলে যাওয়ার পর রিখিয়া ওর বাবা মায়ের কাছে এলো। এতক্ষণে চেঞ্জ করে নিয়েছে ও। বাবার শরীর ইদানিং খুব খারাপ হয়ে গেছে, যেকোন সময় যা খুশি হয়ে যাবে তাই রিখিয়া রায়হানের ব্যাপারটাকে এড়িয়ে গিয়ে বলল,

” বাবা তোমার ঔষধ সব ঠিকঠাক আছে তো? শেষ হলে মনে করে বলো কিন্তু।”

রেজাউল ইসলাম গম্ভীর মুখে বললেন,

” এখানে বস।”

রিখিয়া কথা না বাড়িয়ে বসল। রেজাউল ইসলাম ওর মাথায় হাত রেখে বলল,

” অনেকতো করলি মা আর কত? নিজের জীবনটাকে আর নষ্ট করিস না। বিয়েটা করে নে এবার। শাফিনকে দেখেছি আমি। খুব ভালো ছেলে।”

রিখিয়া অসহায় গলায় বলল,

” বাবা তুমিও এবার আমাকে জোর করবে?”

রেজাউল ইসলাম একটু কেশে নিয়ে বললেন,

” জোর না মা, আমিতো বাবা। কোন বাপের তার মেয়েকে এভাবে দেখতে ভালোলাগে বল? তাও আমি সুস্থ থাকতাম, বড়লোক হতাম একটা কথা ছিল। আমি আজ আছি কাল নেই। তোকে কার ভরসায় রেখে যাবো তুই বল? আমি জানি আমার মেয়ে অনেক স্ট্রং। সে একা বাঁচতে জানে। কিন্তু আমারও তো ইচ্ছে যে তোর একটা সাজানো সংসার হোক।”

রিখিয়া মাথা নিচু করে ফেলল। কান্না আসতে চাইছে ওর কিন্তু কাঁদতে পারবেনা বাবা-মার সামনে। রিখিয়ার মা বললেন,

” হ্যাঁ তুমিই বোঝাও। আমি তো বলতে বলতে মুখে ফ্যানা তুলে ফেললাম। এখন যে তোমার বুঝ হয়েছে এটাই অনেক। তবুও তো শাফিন ছেলেটা এখন ও তোকে চায়। আমাদের মত বাড়ির মেয়েকে যে ওনারা নিতে চান এটাই তো ভাগ্য।”

” আহা, এভাবে বলছ কেন? আমার মেয়ে একদম খাটি সোনা। নিতে তো চাইবেই।”

” হ্যাঁ সেই সোনা সিন্দুকে তুলে রেখে দাও।বলছি বয়সতো আর কম হচ্ছেনা। এরপর বেশি বয়স হলে ভালো জায়গায় বিয়ে দিতে পারব? আমরা যখন থাকবনা ওর কী হবে ভেবে দেখেছ?”

রিখিয়া ছোট শ্বাস ফেলে উঠে চলে গেল ওর রুমে। দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুজে কেঁদে ফেলল। ওরও তো স্বপ্ন আছে। একজন ভালো স্বামী, শশুর বাড়ি, সংসারের। আর পাঁচটা মেয়ের মত ওও স্বাভাবিক জীবন চায়। কিন্তু ও কী করবে? যতবার সবাই বিয়ের কথা তোলে বিহানের মুখটা ভেসে ওঠে, বিহানের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো বড্ড মনে পরে। ভালোবাসাটা আজ ও একইরকম আছে, পারেনি ও বিহানকে ভুলে যেতে, পারবেও না। তারমানে এটা নয় যে ওর বিয়ে না করতে চাওয়ার কারণ বিহান। যেখানে ও জানে বিহান কোনদিন ওর হবেনা তখন তার কথা ভেবে বিয়ে না করে সারাজীবন বসে থাকাটা ভিত্তিহীন। ওর বাবা-মার কথা ভেবেই বিয়ে করতে চায়না ও। মানুষ দুটো তে ওকে ছাড়া বড্ড অসহায়। আচ্ছা বিহান নিশ্চয়ই ওর ভালোবাসার বা পছন্দের কাউকে বিয়ে করে ভালো আছে। ও সবসময় ভালো থাক এটাই চায় রিখিয়া। ও না হয় সারাজীবন একতরফা ভালোবেসে যাবে। মোবাইলটা হাতে নিতেই ওয়ালপেপারে তুর্বীর সাথে ওর ছবিটা দেখে কান্নার গতি বেড়ে গেল ওর। কেমন আছে তুর্বী? কোথায় আছে? গ্রামে আসার পর ওর বাবা স্ট্রোক করে বসে। সবকিছুর মধ্যে তুর্বীর সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। পরে তুর্বীকে ফোনে আর পায়নি ও।দুমাস পর রিখিয়া শহরে গেছিল ওর খোঁজ নিতে কিন্তু সেখানে পায়নি ওকে। অফিসে গিয়ে শুনল তে তুর্বী ঐ জব ছেড়ে দিয়েছে। তুর্বী এখন কোথায় সেটা রিখিয়ার জানা নেই। ছবিটাতে হাত বুলিয়ে ফোনটা বুকে চেপে ধরে একটু আওয়াজ করেই কেঁদে দিয়ে বলল, ” মিসিং ইউ তুর।”

#চলবে…

#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৩৪
.

কিছুক্ষণ আগে সূর্য পূর্ব আকাশে উঁকি দিয়েছে। সকালের নরম, স্নিগ্ধ, শুভ্র আলো এসে ছড়িয়ে পরেছে গোটা সিলেট শহর জুড়ে। বিভিন্ন উঁচু নিচু পাহাড় আর বিস্তৃত সবুজ প্রকৃতির ওপর সূর্যের হালকা আলোর এই আভা যেন প্রকৃতিকে চোখ ধাধানো রূপে সাজিয়ে তুলছে। অন্ধকার রুমটাকে বাইরের আলো জানালার পর্দা ভেদ করে হালকা আলোকিত করেছে। শান্ত কক্ষটি হঠাৎই এলার্মের আওয়াজে নিজের নিরবতা হারালো। টি-টেবিলে রাখা টেবিল ঘড়িটি বেজে বেজে জানান দিচ্ছে যে সাতটা বেজে গেছে। এলার্মের এই বিরক্তিকর শব্দে ভ্রু কুচকে গেল তুর্বীর। বালিশে মুখ গুজে ডান হাত বাড়িয়ে এলার্মটা বন্ধ করে ফেলল। কিন্তু একটুপর ফোনেও এলার্ম বেজে ওঠল। তুর্বী বুঝে গেল যে ও এখন আর ঘুমোতে পারবেনা। অফিস যেতে হবে। আজ প্রেজেন্টেশন আছে। তাই বিরক্তি নিয়ে উঠে বসে এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে একটা খোপা করে নিল। সামনের কাটা ছোট চুলগুলো উন্মুক্তই রয়ে গেল। উঠে গিয়ে জানালার পর্দা সরাতেই সকালের স্নিগ্ধ আলো সারা রুমে ছড়িয়ে গেল। তুর্বী লম্বা হাই তুলতে তুলতে ওয়াসরুমে চলে গেল। ব্রাশ করে একেবারে শাওয়ার নিয়ে বেড় হল। মাথায় টাওয়েল পেঁচিয়ে রেখেই কিচেনে চলে গেল। গ্যাস অন করে এক কফি বানিয়ে মগে ঢেলে মগ হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে চলে গেল। কফি খেতে খেতে সিলেটের মিষ্টি সকালটা দেখছে। চোখদুটো বহু দূরের পাহাড়গুলোর দিকে। কিন্তু গভীরভাবে ভেবে চলেছে কিছু একটা। কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে কফির সাথে সাথে ভাবনাও শেষ করল। এরপর ভেতরে গিয়ে রেডি হয়ে বেড়িয়ে গেল অফিসের উদ্দেশ্যে। প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে অফিসে পৌঁছালো। অফিসে ঢুকে এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা নিজের ক্যাবিনে চলে গেল। সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে কনফারেন্স রুমে চলে গেল। গিয়ে দেখে ওর জুনিয়ররা এসে বসে আছে। ও যেতেই ওনারা দাঁড়িয়ে গেল। তুর্বী বসার সাথেসাথে ওনারা বসে পরলেন। ওপরপাশে বসে থাকা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল,

” সব রেডি আছে?”

” ইয়েস ম্যাম।”

বলে ছেলেটি তুর্বীর দিকে একটা পেনড্রাইভ দিল। তুর্বী পেনড্রাইভটা হাতে নিয়ে বাকিদের উদ্দেশ্য করে বলল,

” সব করে নিয়েছ?”

সবাই ‘হ্যাঁ’ বলল। তুর্বী ল্যাপটপ অন করে পেনড্রাইভটা ইনসার্ট করে সব চেক করে নিল। এরমধ্যেই ওদের কম্পানির এমডি সহ আরও দুজন ক্লাইন্ট চলে এলো। তুর্বীসহ বাকিরাও দাঁড়াল। ওনারা বসে পরার পর বাকিরাও বসল তুর্বী বাদে। ও সামনে গিয়ে প্রজেক্টরে খুব সুন্দরভাবে নেক্সট প্রজেক্টের প্লান, ডিজাইন সব এক্সপ্লেইন করল। যেটা সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনেছে। এরকমভাবে প্রেজেন্ট করতে খুব কম মানুষই পারে। প্লান পছন্দ না হওয়ার কোন প্রশ্নই নেই। তাই ডিলটা ফাইনাল করে ক্লাইন্টরা এমডি কে কনগ্রাচুলেট করে চলে গেল। এম ডি সাহেবও তুর্বীর ওপর খুব খুশি। খুশি না হওয়ার কোন কারণ নেই! তুর্বীর কারণেই অনেক বড় বড় প্রজেক্ট আর ডিল পায় এই কম্পানি। এ দুই বছরে অনেক কিছু বদলেছে। নিজের স্বপ্ন নামক জলফড়িং কে ধরতে পেরেছে ও। এই দুই বছরের কঠোর পরিশ্রমের ফলে ও আজ একজন সিনিয়র আর্কিটেক্ট হতে পেরেছে। এবং কম্পানির বেস্ট একজন এমপ্লয়ী। সবাই মুগ্ধ ওর কাজ দেখে। তবে তুর্বীর মধ্যকার সেই চঞ্চলতাটা অনেকটা কমে গেছে। সেই লাফিয়ে, ঝাপিয়ে বেড়ানো মেয়েটা এখন ম্যাচুউরড হয়ে গেছে। প্রেজেন্টেশনের ঝামেলা মিটিয়ে তুর্বী ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে হাটা দিল ও। খিদে পেয়েছে প্রচুর। ক্যান্টিনে এককাপ চা আর একটা টোস ওর্ডার করে একটা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে দেখছে। হঠাৎ মাথায় কেউ টোকা দিল। তুর্বী ভ্রু কুচকে পেছন দিকে তাকিয়ে দেখল একটা ছেলে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তুর্বী ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে আবার ম্যাগাজিনে মন দিল। ছেলেটার নাম মিরাজ। তুর্বী আর ওর পোস্ট আলাদা আলাদা হলেও গোটা অফিসে একমাত্র মিরাজের সাথেই একটু ভালো সম্পর্ক তুর্বীর। বাকিদের সাথে তেমন মেশেনা। মিরাজ চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,

” একটু চমকালে কী হয়? কী জিনিস তুই?”

তুর্বীর কাছে মিরাজের প্রশ্নটা অতি অহেতুক মনে হল। তাই কোন উত্তর না দিয়ে ম্যাগাজিনে চোখ রেখেই বলল,

” কী খাবি ওর্ডার কর।”

” তুই কী ওর্ডার করেছিস?”

” তোর আস্ত মুন্ডুটা। তুইও খাবি? শেয়ার লাগবে?”

” আরে রেগে যাচ্ছিস কেন? বলনা।”

তুর্বী এবারেও মিরাজের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আরেক কাপ চা আর টোস ওর্ডার করে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে খাবার চলেও এল। খেতে খেতে মিরাজ বলল,

” আচ্ছা তুর..”

মিরাজকে থামিয়ে দিয়ে তুর্বী বিরক্তি নিয়ে বলল,

” তোকে কতবার বলেছি যে এসব তুর-ফুর বলে ডাকবিনা আমাকে। এসব শর্ট ফর্ম আমার পছন্দ নয়।”

” আচ্ছা সরি ম্যাডাম! ভুলে গেছিলাম, এতো রিঅ্যাক্ট করছিস কেন?”

তুর্বী কিছু না বলে খাওয়ায় মনোযোগ দিল। মিরাজ বুঝতে পারছে তুর্বী একটু রেগে গেছে তাই কথা ঘোরাতে বলল,

” আজতো ফাটিয়ে দিয়েছিস ইয়ার। কী প্রেজেন্টেশন দিলি!”

তুর্বী টোস চিবোতে চিবোতে বলল,

” কেন? সবসময় খারাপ হয়?”

” আরে না। উল্টো বুঝিস কেন? তুই ও না। তোর বর তোকে কীকরে সামলাবে সেটাই ভাবছি। এতো ধৈর্য কার হতে পারে?”

তুর্বী আনমনেই বলল,

” এরচেয়েও বেশি ধৈর্য নিয়ে কেউ আমাকে সামলেছে মিরাজ।”

মিরাজ অবাক হয়ে বলল,

” কী? কে সে?”

” কেউ না। বাদ দে।”

” আচ্ছা। কিন্তু এতো ভালো করে করিস কীকরে বলবি? সেই শুরু থেকে দেখছি। এতো পার্ফেক্টলি এক্সপ্লেইন করিস, ক্লাইন্ডদের ডিমান্ড সম্পর্কে এতো ভালো বুঝিস, ওয়ার্ড সিলেকশন নিয়ে কথা হবেনা। কিন্তু এগুলো এতো প্রপারলি শিখলি কীকরে? নিজে নিজে তো এতো পার্ফেক্টলি শেখা যায় না।”

তুর্বী চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা রেখে মুচকি একটা হাসি দিল। যেই হাসির কারণ মিরাজ জানেনা। তুর্বী মুখে সেই হাসি ধরে রেখেই উঠে ওর কেবিনে চলে গেল। মিরাজ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তুর্বীর যাওয়ার দিকে। মেয়েটা এমন অদ্ভুত কেন? কেমন জেনো! হ্যাঁ তুর্বী আগেও যেমন আলাদা ছিল, এখনো আলাদাই আছে। কিন্তু দুটো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পার্থক্য অনেক। তুর্বী ওর কেবিনে গিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করে ফেলল। চোখ বন্ধ রেখেই আঙ্গুল দিয়ে কলম ঘোরাতে ঘোরাতে নিজের ভাবনায় মগ্ন। ওকে এতো সুন্দরভাবে কাজ তো সৌহার্দ্যই শিখিয়েছে। ঐ কয়েকমাস নিজের হাতে খুব যত্ন করে হাতে কলমে প্রপারলি কাজ শিখিয়েছে সৌহার্দ্য ওকে। ওর আজকের এই সফলতার পেছনে সৌহার্দ্যর ভূমিকা অনেকটা জুড়ে। রিখিয়া চলে যাওয়ার পর তুর্বী মানসিকভাবে খুব ভেঙ্গে পরেছিল। ফোন করেও পাচ্ছিল না রিখিয়াকে। তারওপর সৌহার্দ্যকেও মিস করছিল ও। হ্যাঁ মিস করছিল সৌহার্দ্যর প্রতিটা কেয়ার, ভালোবাসা, কথা। একা জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে গেছিল। তাই ওই জবটা ছেড়ে সিলেট চলে এসছিল। ভেবেছিল নতুন পরিবেশে হয়তো কিছুটা ভালো লাগবে। কিন্তু লাগেনি। জীবনটাও অন্যরকম হয়ে গেছিল। বারবার নিজেকে একটাই প্রশ্ন করত সবকিছুর জন্যে কী ওই দায়ী? সৌহার্দ্যকে কী মেনে নেওয়া যেত না? কিন্তু কীকরে? ওর জন্যেই কী রিখিয়া আজ নেই ওর সাথে? কিন্তু দিনশেষে কোন উত্তরই মেলাতে পারতো না। ধীরে ধীরে বুঝে গেল যে দুনিয়া ছেলেমানুষী মেনে নেয়না। দু-একদিন দেখতে খুব কিউট লাগে। কিন্তু একপর্যায়ে সবাই ছেলেমানুষীর ওপর বিরক্ত হয়ে যায়। এখন তুর্বীর মধ্যকার সেই ছেলেমানুষীটাও আর নেই। তবে কারো জন্যে ও নিজেকে বদলায় নি। ও বদলেছে কারণ ওর ছেলেমানুষী করার কোন জায়গা অবশিষ্ট নেই। এখন ওর ফোকাস শুধু ওর ক্যারিয়ারে। কিন্তু এমন কোন রাত নেই যখন ওর সৌহার্দ্যকে মনে না পরে। বড্ড মনে পরে। ভালোবাসে কি-না জানেনা তবে এটা সত্যিই যে খুব মিস করে সৌহার্দ্যকে। আর রিখিয়ার কথাতো সবসময়ই মনে পরে। ঘুম থেকে ওঠার সময়, খাওয়ার সময়, কফি করার সময়, প্রতি মুহূর্তে রিখিয়ার স্মৃতি তাড়া করে বেড়ায়। ওরা দুজন কেমন আছে, কীভাবে আছে এটুকুও জানেনা ও। চোখ মেলে হাতে পরে থাকা ঘড়িটার দিকে তাকাল ও। যেটা রিখিয়া ওকে দিয়েছিল। গভীর দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলল তুর্বী। চোখ কখন ভিজে উঠেছে নিজেই জানেনা। কিছু করার নেই এখন আর। কিছুই বেঁচে নেই আর। পরে আছে দীর্ঘশ্বাস, শুধুই দীর্ঘশ্বাস!

___________

সূর্য ঢুবতে চলেছে। রুম অন্ধকার হয়ে আসছে বলে লাইট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। রুমটা বড্ড অগোছালো। জানালার পর্দা একটা গুটিয়ে রাখা, আরেকটা ঝুলছে। ফ্লোরে অনেক জায়গা ছিটে ছিটে বিভিন্ন রঙ পরে আছে। বিশাল টেবিলে অনেক রকম রঙের টিউব রাখা। অনেক রঙের ছিটে ছিটে অংশ পরে টেবিলেও লেগেছে। কিন্তু এতোকিছুতে পাত্তা না দিয়ে একমনে পেন্টিং করে চলেছে বিহান। ও বারবার ঘড়ি দেখছে আর কারও আসার অপেক্ষা করছে। বেশ অনেকটা সময় পর কলিংবেল বেজে উঠল। বিহান যেন এটারই অপেক্ষা করছিল। তুলিটা প্লেটের ওপর রেখে রুমাল দিয়ে হাত মুছে নিয়ে দরজা খুলতে গেল ও। দরজাটা খুলে কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তিকে দেখতে পেয়ে হাসল বিহান। হেসে বলল,

” ফরিদ, ভেতরে এসো।”

ফরিদ নামক ছেলেটি বিহানের বয়সীই হবে। শ্যামলা টাইপ, ছিপছিপে শরীরের একজন। ও উত্তরে মুচকি হেসে ভেতরে এলো। ভেতরে এসে সারারুমে চোখ বুলিয়ে নিল। প্রায় দশ বারোটা পেন্টিং আছে রুমে। বিহান হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,

” কয়টা নিতে বলেছে?”

ফরিদ দেখতে দেখতে বলল,

” দুইটা লাগবে আপাতত।”

বিহান ভালোভাবে বেছে নিয়ে দুইটা পেন্টিং আলাদা করে রাখল। কিন্তু ফরিদের দৃষ্টি সাইডে রাখা ঐ বিশাল পেন্টিং এর দিকে। এতো সুন্দর পেন্টিংটা যে বিহান কেন বিক্রি করতে চায়না সেটাই বুঝে উঠতে পারেনা ফরিদ। এই নিয়ে কত বড় বড় ক্লাইন্টের পছন্দ হয়েছে পেন্টিং টা কিন্তু বিহান এটা বিক্রি করেনি। কী এমন আছে এই পেন্টিং এ? ফরিদ এসব ভাবতে ভাবতেই বিহান বলল,

” কখন আসবেন ওনারা?”

” চলে আসবেন। বেশি সময় নেবেন না।”

বিহান মাথা নাড়ল। প্রায় আধ ঘন্টা পর দুজন লোক এলো ফ্লাটে। ওনারা এসে বিহানের সাথে প্রথমে সৌজন্যমূলক আলাপ করলেন। এরপর বিহান ওনাদের ওর সিলেক্ট করে রাখা দুটো পেন্টিং দেখালেন। ওনাদের বেশ পছন্দ হল। কিন্তু হঠাৎ ঐ বড় পেন্টিং চোখ পরতেই দুজনের চোখ আটকে গেল। দুজনের মধ্যে কালো সুট পরা লোকটা বলল,

” ওয়াও! পেন্টিং টা জাস্ট অসাধারণ। মিস্টার বিহান আপনি ওটা কেন বিক্রি করছেন না? আমরা কিনতে চাই।”

বিহান মুচকি হেসে বলল,

” সরি। কিন্তু এটা বিক্রির জন্যে না।”

” প্লিজ ভেবে দেখুন। আমরা বেশ ভালো এমাউন্ট দিতে রাজি আছি।”

” সারা দুনিয়া আমার নামে লিখে দিলেও এই পেন্টিংটা আমি কাউকে দিতে পারব না।”

ওনারা অনেক বুঝিয়েও বিহানকে রাজি করাতে পারেন নি। ও ঐ ছবিটা বিক্রি করতে পারবেনা। অবশেষে ঐ দুটো পেন্টিং নিয়েই ওনারা চেক সাইন করলেন। ওনাদের জন্যে হালকা খাবারের ব্যস্ততা করেছে। খাওয়াদাওয়া করে ওনারা চলে যাওয়ার পর ফরিদ বিহানের পাশে বসে বলল,

” একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

” করে ফেল।”

” ঐ পেন্টিংটায় এমন কী আছে যে আপনি এতো টাকা অফার পেয়েও ওটা বিক্রি করেন না।”

বিহান পেন্টিংটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

” জানিনা কিন্তু এর কাছে সবকিছুই অমূল্য।”

” এই মেয়েটা কী আছে আদোও?”

” আছে।”

” ভালোবাসেন মেয়েটাকে?”

” হয়তো বেসে ফেলেছি। জানিনা ঠিক। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যেও মন থেকে সরাতে পারিনা।”

” এখন কোথায় উনি?”

বিহান স্হির কন্ঠে বলল,

” জানিনা।”

” আমি শুধু ভাবছি যে একটা মেয়ে মনের ভেতর কতোটা গেঁথে থাকলে এরকম নিখুঁত ছবি আঁকা যায়!”

বিহান পেন্টিংটার দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে বলল,

” আচ্ছা ফরিদ, কেউ দূরে চলে গেলেই কী মনে বেশি করে গেঁথে যায়?”

ফরিদ ছোট মুখ করে বলল,

” জানিনা। যায় বোধ হয়।”

বিহান কিছু বলল না। ফরিদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

” আজ তাহলে আসি?”

বিহান সম্মতি দিল। ফরিদ চলে যাওয়ার পর বিহান স্নান করে নিল। গায়ে হালকা রং লেগে ছিল। স্নান করে বেড় হয়ে চুল মুছতে মুছতে পেন্টিংটার কাছে আবার গেল। রিখিয়ার পেন্টিং এটা। রিখিয়াকে বিহান একদিন বলেছিল, জীবনে কোন মেয়ের ছবি আঁকলে রিখিয়ার ছবিই আঁকবে। ও তাই করেছে। একটু একটু করে যত্ন করে এঁকেছে মেয়েটার ছবি। দেখে মনে হয় যেন জীবন্ত। ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ছোট্ট শ্বাস ফেলল ও। আজ ওর মনে হয়, সেদিন যদি রিখিয়াকে আটকাতো তাহলে হয়তো আজ ও ভালোবাসতে পারতো ওকে। এখন হয়তো বেসেও ফেলেছে। কিন্তু কী লাভ? এতোদিনে নিশ্চয়ই রিখিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী সংসার নিয়ে ভালো আছে হয়ত। ওকেও হয়তো ভুলে গেছে। যাওয়াটাই স্বাভাবিক। আর সৌহার্দ্য? ও কী ফিরেছে দেশে? সৌহার্দ্য খোঁজে ওকে? কেন খুঁজবে? ওতো খুব খারাপ একটা মানুষ। সত্যিই খারাপ। একটা মেয়ের মন ভেঙ্গেছে, নিজের ভাইয়ের বিশ্বাস ভেঙেছে। ক্ষমার অযোগ্য ও। কিন্তু ও তো সৌহার্দ্যকে খুব ভালোবাসে। খুব ভালোবাসে নিজের ভাইকে। একটাবার দেখার জন্যে মন ছটফট করে। কিন্তু ও কারো জীবনে ফিরবেনা। ও একটা অভিশাপ। ওর সাথে থাকলে কেউ ভালো থাকবেনা, কেউ না।

#চলবে…