#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৩৫
.
খুব ভোরবেলা বাইরের হালকা আলো আর পাখির কিচিরমিচির আওয়াজে ঘুম ভাঙলো রিখিয়ার। আজ শুক্রবার অফিস নেই। চাইলে আরেকটু ঘুমিয়ে নিতেই পারতো তবে ওর ভোরে ওঠারই অভ্যেস। তাই তাড়াতাড়ি উঠে পরল। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে দেখে ওর বাবা-মা দুজনেই উঠে গেছে। রেজাউল ইসলাম চেয়ারে বসে আছেন। আর জাহানারা মানে রিখিয়ার মা নিচে বসে তসবি ঠিক করছেন। রেজাউল ইসলাম রিখিয়াকে দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
” কীরে মা? উঠে পরলি যে? আজ তো অফিস নেই আরেকটু ঘুমিয়ে নিতি।”
রিখিয়া রেজাউল ইসলামের পায়ের কাছে বসে ওনার হাটুতে হাত রেখে বললেন,
” আর ঘুম আসছেনা বাবা। অভ্যেস নেই।”
জাহানারা চোখ তুলে বিরক্তি নিয়ে বললেন,
” তা কেন থাকবে। অভ্যেস তো শুধু সারাদিন খেটে বেড়ানোর। নিজের কপালটা নিজেই পুড়ছিস। যা খুশি কর, আমি কিছু বলবনা। আমার কোন দাম আছে না-কি এই বাড়িতে? একদম নেই।”
রিখিয়া নিজের মায়ের কথাতে তেমন পাত্তা দিলোনা। উনি সারাদিন এরকম বলতেই থাকে। মা তো। সন্তানের জন্যে সবচেয়ে বেশি চিন্তা তারই হয়। আর সেইসব উল্টোপাল্টা চিন্তা থেকেই এসব কথা আসে। এগুলো ধরে বসে থাকার কোন মানে নেই। ও রেজাউল ইসলামের দিকে তাকিয়ে বলল,
“চা খাবে বাবা?”
” হ্যাঁ শরীরটা ম্যাচম্যাচ করছে। একটু চা পেলে ভালোই হতো।”
” মা তুমি?”
জাহানারা তজবির দিকে মনোযোগ রেখেই বললেন,
” বাপ-বেটি যখন খাবি তখন আমি আর বাকি থাকব কেন?”
রিখিয়া মায়ের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে রান্নাঘরে চলে গেল। গ্যাস অন করে চায়ের পাত্রে পানি দেওয়ার পরই হঠাৎ তুর্বীর বলা কথাটা কানে বেজে উঠল, ‘ আমার কফি কে বানাবে ইয়ার? তুই জানিস আমার কফি জঘন্য হয়।’ কথাটা মনে রিখিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আচ্ছা তুর্বী এখন নিজে নিজে ভালো কফি বানাতে পারে? সকালে নিজে থেকে ঘুম থেকে উঠতে পারে? কতটা বদলেছে ও? এখন বুঝতে পারছে যে এভাবে চলে আসা ঠিক হয়নি। ও ভেবেছিল সমস্যা কী যোগাযোগ তো থাকবেই। কিন্তু মেয়েটা যে এভাবে হারিয়ে যাবে বুঝে উঠতে পারেনি। চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে চা বানানোতে মনোযোগ দিল। চা করে বাবা-মা দুজনকে দিল। নিজেও এক কাপ চা খেয়ে বাইরে হাটতে বেড় হল। ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগছে না একদম। হাটতে হাটতে নদীর পারে পৌছে গেল ও। এখানে বেশ ঠান্ডা হাওয়া আছে। এই গরমের মধ্যে এখান দিয়ে হাটতে ভালোই লাগবে। নদীর ওপারের গাছপালা, বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট করে দেখা যাচ্ছে। সকালের আবছা আলোর সাথে হালকা রোদ সব নদীর জলে পরাতে এর নদীর সৌন্দর্য কয়েকগুন বেড়ে যাচ্ছে। এপারে বালুর রাস্তা আর অনেকরকমের বড় বড় গাছপালা তো আছেই। রিখিয়া নদীর পার দিয়ে হাটতে হাটতে এই সৌন্দর্য উপভোগ করছে। হঠাৎ কারো কাশির আওয়াজে পাশে তাকিয়ে দেখে শাফিন ওর পাশ দিয়ে হাটছে। রিখিয়া শাফিনকে দেখে হেসে বলল,
” আপনি কখন এলেন?”
শাফিন মুচকি হেসে বলল,
” যখন তুমি প্রকৃতি দেখায় ব্যস্ত ছিলে।”
” হঠাৎ এদিকে?”
” হাটতে বেড়িয়েছিলাম। তোমাকে দেখে চলে এলাম।”
” ওহ।”
” আঙ্কেল, আন্টির শরীর ঠিক আছে তো?”
” হ্যাঁ, ঠিক আছে!”
দুজনে হাটতে হাটতে এমনি কথা বলছে। কথার মধ্যে শাফিন বলল,
” রিখিয়া, কাউকে ভালোবাসতে?”
রিখিয়া থমকে গেল। কিছুক্ষণ শাফিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
” বাসতাম না। এখনও বাসি।”
শাফিনের মনটা খারাপ হয়ে গেল। তাহলে কী ওর এতো বছরের অপেক্ষা সম্পূর্ণই বৃথা? তবুও ও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
” এটাই আমাকে বিয়ে করতে না চাওয়ার কারণ? তবে তাকে বিয়ে করে নিচ্ছোনা কেন?”
রিখিয়া মলিন হেসে বলল,
” সে কখনও আমার হবেনা শাফিন ভাই। আমার ভালোবাসাটা একতরফা। সে হয়তো তার জীবনে এখন খুব সুখেই আছে।”
” যে তোমার কখনও হবেই না তারজন্যে অপেক্ষা করার মানে কী?”
” আপনাকে কে বলল আমি ওনার জন্যে অপেক্ষা করছি? আমি ওনার জন্যে বসে নেই শাফিন ভাই।”
শাফিন একটু অধৈর্য হয়ে বলল,
” তাহলে আমাকে বিয়ে করতে কী সমস্যা? কেন এমন করছো? ছেলে হিসেবে আমি খুব খারাপ?”
” সেরকম কিছু না শাফিন ভাই। আপনি আমার সমস্যাটা বুঝবেন না।”
শাফিন রিখিয়ার হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
” বুঝতে তো চাইছি রিখিয়া। কিন্তু তুমি বুঝতে দিচ্ছ না। আমি তোমাকে আমায় বিয়ে করার জন্যে জোর করছিনা। আমি শুধু জানতে চাইছি। আমায় বিয়ে করতে না চাওয়ার কারণটা কী? এটুকুও কী জানতে পারিনা আমি?”
রিখিয়া কিছু না বলে শুধু ওর ধরে রাখা হাতটার দিকে তাকাল। শাফিন সাথেসাথে হাত ছেড়ে নিয়ে বলল,
” আ’ম সরি! আমি আসলে..”
রিখিয়া কিছু না বলে চোখ সরিয়ে নিল। কী করবে ও? শাফিনকে হ্যাংলার মতো করে বলতে পারবেনা যে ও ওর বাবা-মার কথা ভেবে বিয়ে করতে চায়না। শাফিন তাহলে ভেবে নিতেই পারে যে ও শাফিনকে ইনডিরেক্টলি ওর ফ্যামেলির দায়িত্ব নিতে বলছে। ও কারো কাছে ছোট হতে পারবেনা।
____________
ডুপ্লেক্স বাড়ির বিশাল বারান্দা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে বিহান। হাতে মদের গ্লাস।বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা বলতে গেলে বান্দরবান নামটা প্রথমদিকেই মাথায় চলে আসে। আর যদি বান্দারবান টাই স্হায়ী ঠিকানা হয় তাহলেতো ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং হবে। এটাই সবাই ভাবে। কিন্তু গত দুবছর যাবত বান্দারবানে থেকে বিহান বুঝতে পেরেছে সুন্দর স্হানগুলো বাসস্হান হওয়া উচিত নয়। তাহলে সেই চমৎকার সুন্দর দৃশ্যগুলোকে একপর্যায়ে স্বাভাবিক বলে মনে হয়। তখন চমকে যাওয়া বা মুগ্ধ হওয়ার মত কিছু পরে থাকেনা। একটানা বহুদিন দেখলে ‘প্যাংগং লেকও’ মানুষের কাছে বিশেষ কিছু বলে মনে হবেন। এরচেয়ে ব্যস্ত শহর বা কম উন্নত গ্রামগুলোতে থাকা ভালো। মাঝেমাঝে এরকম জায়গায় ঘুরতে এসে চমকে যাওয়া যায়, মুগ্ধ হওয়া যায়। অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বলা যায় ‘ওয়াও, কী সুন্দর! যদি এখানেই থাকতে পারতাম।’ এই যদিটা ‘যদি’ অবধিই সুন্দর, বাস্তবে রুপান্তরিত করতে গেলেই সবটা পানসে হয়ে যায়। তাইতো বান্দারবানের এই সৌন্দর্য বিহানকে এখন আর সেভাবে টানেনা। তখন পেছন থেকে ফরিদ বলল,
“স্যার আসি?”
ফরিদের ডাকে বিহান ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলো। সোজা হয়ে বসে বলল,
” হ্যাঁ চলে এসো।”
ফরিদ এসে একটা চেয়ার টেনে বসল। তাকিয়ে দেখে বিহান ড্রিংক করছে। ও শুধু এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। বিহান গ্লাসে আবার মদ ঢালতে ঢালতে বলল,
” খাবে? ঢালবো তোমার জন্যে?”
ফরিদ একটু ইতস্তত করে বলল,
” না। আজ নেব না। আমিতো ঐ মাসে এক দু পেক মারি।”
বিহান একটু হাসল। বিহান হঠাৎই এরকম কারণ ছাড়াই হেসে ওঠে। ওর এই হাসির মানে বুঝে উঠতে পারেনা ফরিদ। হাসি থামিয়ে বিহান বলল,
” আচ্ছা যারা নিয়মিত ড্রিংক করে তারা খুব খারাপ হয়?”
” জি স্যার অব্ না স্যার।”
বিহান আবারও হাসল। ফরিদ পরেছে মহা যন্ত্রণায়। এই লোকটাকে আস্ত একটা ধাঁধা মনে হয় ওর। যেই ধাঁধার সমাধান ও দেড় বছরের করতে পারেনি। বিহান বলল,
” আমাকে ভয় পেয়ে বলতে হবেনা। ওনেস্টলি বল। খারাপ হয়?”
ফরিদ মিনমিনে গলায় বলল,
” জানিনা স্যার। এবিষয়ে আমার তেমন অভিজ্ঞতা নেই।”
” এটা বলতে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় না। যাই হোক, নিয়মিত নেশা করার একটা সুবিধা কী জানো?”
ফরিদ কৌতূহল নিয়ে বলল,
” কী স্যার?”
বিহান কিছু বলল না। ফরিদও চুপ করে আছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বিহান সম্পূর্ণ প্রসঙ্গটাই পাল্টে ফেলে বলল,
” প্রেমের অভিজ্ঞতা আছে?”
ফরিদ একটু লাজুক হেসে বলল,
” জি। গার্লফ্রেন্ড আছে।”
” বউ বানানোর ইচ্ছা আছে?”
” ইচ্ছেতো আছে স্যার।”
বিহান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল,
” সময় থাকতে আগলে রেখো।”
ফরিদ কিছু বলল না। শুধু তাকিয়ে রইল বিহানের দিকে। বিহান বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আচ্ছা ফরিদ, তোমার কাছে কী বান্দারবান স্পেশাল কিছু মনে হয়? লাইক এতো দূর থেকে, এতো অর্থ খরচ করে মানুষ দেখতে আসে। সেরকম বিশেষ কিছু?”
ফরিদ কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
” হয়তো কিছু বিশেষ আছে। তাই সবাই ছুটে আসে। এমনি এমনিতো আর এতো টাকা নষ্ট করে আসবেনা। কিন্তু আমার কাছেতো তেমন বিশেষ কিছুই মনে হয়না।”
” এর কারণ জানো?”
” জি-না। আপনি বলুন!”
” না থাক! আমার দেওয়া লজিক তোমার পছন্দ নাও হতে পারে। এটা বরং তুমি ভাবো। মস্তিষ্কচর্চা হবে। বুঝলে?”
” জি বুঝেছি।”
বিহান গ্লাসে আরো একটা চুমুক দিয়ে বলল,
” তুমি কেন এসছিলে সেটা বল।”
ফরিদ এবার একটু গলা ঝেড়ে বলল,
” সিলেট থেকে একটা কম্পানির টিম আসছে বান্দারবানে।”
” ভালো কথাতো। আমি কী করব?”
” ওনারা এই বাংলোর নিচের ফ্লোরটা এক সপ্তাহের জন্যে ভাড়া নিতে চান।”
বিহান গ্লাসটা রেখে ফরিদের দিকে তাকিয়ে বলল,
” কয়টা রুম লাগবে বলেছে?”
” চারটা। মোট আটজন থাকবে।”
” টাকার ব্যাপারে কথাবার্তা বলেছ?”
” জি। ওনারা রাজি।”
বিহান চেয়ারে হেলান দিয়ে মাথায় ওপর দিয়ে হাত রেখে বলল,
” তাহলে দিয়ে দাও।”
” আচ্ছা।”
বিহান কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
” হঠাৎ সিলেট থেকে এখানে আসছে যে?”
” প্রতিবছরই কোথাও না কোথাও ট্রেনিং থাকে। এবার বান্দারবান পরেছে।”
” হোটেল ছেড়ে এখানে কেন?”
” তা ঠিক জানিনা।”
বিহান উঠে দাঁড়িয়ে হাত ঝেড়ে বলল,
” বাদ দাও! লংড্রাইভে যাবে?”
ফরিদও উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” লংড্রাইভে? এখন?”
বিহান আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
” বড্ড অসময় তাইনা?”
” জি।”
” সবকিছুই সময় মেনে করতে হবে এটা কোথায় লেখা আছে? চল!”
বলে চাবি নিয়ে বিহান বেড়িয়ে গেল। ফরিদ বিহানের যাওয়ার দিকে বোকার মত তাকিয়ে থেকে নিজেও পেছন পেছন গেল। ফরিদ বুঝতে পারে বিহান এসব কাজের মধ্যে কাউকে একটা খোঁজে। কিন্তু সেটা কে তা জানেনা। কে আছে যে বিহানের এই আড্ডা, লংড্রাইভ, খোলা মাঠে বসে থাকার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত?
#চলবে…
#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৩৬
.
শব্দহীন রুমটাতে শুধু ল্যাপটপের কিবোর্ড প্রেস করার আওয়াজটাই আসছে। তুর্বী সমস্ত মনোযোগ ল্যাপটপের স্ক্রিনে। যেনো এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তুর্বী আগেও ওর কাজ নিয়ে সিরিয়াস ছিল কিন্তু এখন প্রচন্ড বেশিই সিরিয়াস হয়ে গেছে। মাত্র দুবছরে এতো বড় পোস্টে প্রমশন সেটারই প্রমাণ। তখন মিরাজ দরজায় নক করে বলল,
” আসব ম্যাডাম?”
তুর্বী ওর পুরো মনোযোগ ল্যাপটপের স্ক্রিনে রেখেই বলল
” চলে আয়।”
মিরাজ ভেতরে এসে দেখে তুর্বী খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে। এইমুহূর্তে ওকে জ্বালানো মানেই নিজের জন্যে একটা ফ্রি ধমক বরাদ্দ করা। কাজের সময় ডিস্টার্বেন্স তুর্বী মোটেও পছন্দ করেনা। তাই মিরাজ চেয়ার টেনে বসে গালে হাত দিয়ে চুপচাপ দেখছে। তুর্বীর এটা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। ও ওর মত কাজ করে যাচ্ছে যেন রুমে কেউ নেই। মেয়েটার এরকম অদ্ভুত কিছু বৈশিষ্ট্য মিরাজকে বরাবরই বেশ ভাবায়। সৃষ্টিকর্তা যেন বিশেষ কিছু গুন দিয়ে রেখেছে ওর মধ্যে। যার কারণে ও নিজেকে সবার থেকে এতোটা আলাদা করে তুলতে পারে। প্রায় কুড়ি মিনিট পর তুর্বী ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে মিরাজের দিকে তাকিয়ে বলল,
” কিছু বলবি?”
মিরাজ সোজা হয়ে বসে বলল,
” বলছিলাম যে আজ তো আর আমাদের তেমন বিশেষ কোন কাজ নেই। অফিসে আজ শুধুশুধুই বসে আছি।”
” হ্যাঁ তো!”
তুর্বীর এরকম ভাবে ‘ হ্যাঁ তো’ বলাতে আরও দমে গেল মিরাজ। যেটুকু সাহস করেছিল সেটুকুও শেষ হয়ে গেল। এই মেয়ে কখন না জানি আবার ধমকে বসে। অথচ আজ অবধি তুর্বী কাউকেই বকা বা ধমক দেয়নি। এমনকি ওর জুনিয়রদেরও না। তবুও অদ্ভুত কারণেই সবাই ওকে একটু ভয় পায়। হয়ত এটা ওর এরকম এটিটিউট এর জন্যেই। তুর্বী একগাদা বিরক্তি নিয়ে বলল,
” কোষ্ঠকাঠিন্যের মত সবসময় অর্ধেক বলে আটকে থাকার তোর এই রোগটা ঠিক কতটা বিরক্তিকর তুই জানিস। ক্লিয়ারকাট কথা বল।”
মিরাজ একটুখানি গলা ঝেড়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
” যেহেতু কোন কাজ নেই চল আজ চলে যাই।”
তুর্বী ভ্রু কুচকে নিয়ে বলল,
” কেন গার্লফ্রেন্ডের সাথে মিট করবি না-কি? করলে যা। আমাকে টানছিস কেন?”
” ধূর তোর গার্লফ্রেন্ড! আমি গার্লফ্রেন্ডের কথা বলছিনা। আমি তোর কথা বলছি। চল আজ একটু ঘুরে আসি। রাস্তা দিয়ে হাটাহাটি করব। এই অফিসের একগাদা কাজ করতে করতে বোর হয়ে গেছি। আর তুইও গম্ভীর মুডে বসে থাকিস। জাস্ট নেওয়া যায়না এসব।”
তুর্বীর হঠাৎই রিখিয়াকে মনে পরল। ছুটি পেলেই দুজন ঘুরতে বেড়িয়ে যেত। ফুচকা, আইসক্রিম খাওয়া, সিনেমা দেখা কত কী করত। ওসব ভাবা বাদ দিয়ে তুর্বী মিরাজের দিকে একটু গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকায়। মিরাজ অনেকটা হকচকিয়ে গিয়েই বলল,
” আরে আমিতো জাস্ট এমনিই বলছিলাম ইয়ার! ডোন্ট টেক ইট সিরিয়াসলি। তোর ইচ্ছে হলে যাবি না হলে যাবিনা। এতে কার কী করার থাকতে পারে বল? তোকে জোর করবে কার ঘাড়ে কটা মাথা শুনি?”
তুর্বী আগের ভঙ্গিতেই তাকিয়ে আছে মিরাজের দিকে। মিরাজ এবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” তোকে কে যেতে বলেছে বল? আমি শুধুই আমার কথা বলছিলাম। এইযে চলে যাচ্ছি। টাটা।”
তুর্বী এবার ফিক করে হেসে দিল। মিরাজ বোকার মত তাকিয়ে আছে। তুর্বী হাসি মুখেই ল্যাপটপ বন্ধ করে ব্যাগে ভরতে ভরতে বলল,
” চল। দেখি কোথায় নিয়ে যাস।”
মিরাজ বিশ্বজয় করা এক হাসি দিয়ে বলল,
” তুই সত্যি যাবি?”
” কানে শুনতে পাস না?”
” কিছুক্ষণ আগে ডাউট ছিল। এখন ক্লিয়ার হয়ে গেছি। চল! চল!”
তুর্বী আবারও হাসল ছেলেটার পাগলামী দেখে। ছেলেটার এরকম পাগলামো স্বভাব আর মিশুক হওয়ার জন্যেই অফিসের একমাত্র ওর সাথেই তুর্বীর একটা বন্ডিং তৈরী হয়েছে। তুর্বীকে এতো তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেড় হতে দেখে সবাই মোটামুটি একটা ঝটকা খেল। কারণ এই মেয়েকে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেড় হতে দেখা আর হ্যালির ধুমকেতু দেখা অনেকটাই একরকমই।
সিলেটের পাহাড়ি ঢালু রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি হাটছে তুর্বী আর মিরাজ। বৃষ্টিভেজা রাস্তা, ভেজা সবুজ প্রকৃতি, দূরে দেখতে পাওয়া পাহাড়, আকাশের মেঘ সবমিলিয়ে প্রকৃতি আজ বেশ সুন্দর করেই সেজেছে। ঠান্ডা হাওয়া বইছে। তুর্বীর কপালের মুক্ত ছোট চুলগুলো উড়ছে বাতাসে। মিরাজ বলল,
” কি? ভালো লাখছে তো? তুইতো বেড় হতেই চাস না।”
তুর্বী চারপাশে আরেকবার তাকাল। সত্যিই খুব ভালোলাগছে ওর। কিন্তু সেই ভালোলাগাটাকে পাত্তা না দিয়ে বলল,
” হুম ঠিক আছে।”
হঠাৎ করে মিরাজ চেঁচিয়ে বলে উঠল,
” ওই, বুটভাজা খাবি? ঐ দেখ যাচ্ছে।”
তুর্বী হালকা চমকে উঠল। সৌহার্দ্যর সঙ্গে যখন ঘুরতে যেত। তখন বুটভাজা দেখে তুর্বী এভাবেই চেঁচিয়ে উঠত। সৌহার্দ্য কিনে দিত ঠিকই কিন্তু বাচ্চা বলে টিজও করত। কিন্তু তুর্বী খাওয়ার সময় ঠিকই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখত। তুর্বী বিরক্ত হয়ে বলল,
” হ্যাঁ তাতে এভাবে চেঁচানোর কী আছে? খেলে খা।”
” তুই খাবিনা?”
” আমি এসব খাইনা।”
মিরাজ আর কিছু বলল না। বুটভাজা কিনে ওখানেরই নিচু একটা দালানের ওপর পা ঝুলিয়ে বসল দুজন। মিরাজ বলল,
” পরশু ট্রেনিং এ যাচ্ছি জানিসতো।”
তুর্বী বাইরে দেখতে দেখতে বলল,
” হু, বস বলল তো। বান্দরবান যাচ্ছি তাই তো?”
মিরাজ একটু উৎসাহি হয়ে বলল,
” হ্যাঁ। ভালোই হবে। এবার বান্দরবানও ঘোরা হয়ে যাবে।”
কিন্তু তুর্বীর মধ্যে কোন উত্তেজনা নেই। যেনো সবটাই স্বাভাবিক। মিরাজ শুধু ওর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এই মেয়েটাকে নিয়ে ও সত্যিই পারেনা। এতো অদ্ভুত কেন?
_____________
ব্যাংককে রাত বারোটা ছাব্বিশ বাছে। প্রায় ফাঁকা একটা রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে সৌহার্দ্য। কোথায় যাচ্ছেনা। এমনিই চালাচ্ছে। মাঝেমাঝেই এরকম করে। একা একাই রাতে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পরে। বিহানের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো মনে করে। লং ড্রাইভে যাওয়া, খোলা মাঠে আড্ডা দেওয়া। কীভাবে বিহান আধমাতাল হয়ে পরে থাকত। ভুলভাল বকতো। নিজের মনের সব অভিযোগ, অভিমান, কষ্ট সৌহার্দ্যর কাছে প্রকাশ করত। অনেক কষ্টে ওকে সামলে ধরে এনে গাড়িতে তুলে বাড়ি আনতে হত। সবটা ভাবলে আনমনেই হেসে ওঠে সৌহার্দ্য। খুব মিস করে নিজের ভাইটাকে। বিহানও নিশ্চয়ই করে! কিন্তু কোথায় ছেলেটা। এতো অভিমান! হওয়াটাই স্বাভাবিক। ছেলেটাকে এভাবে একা ফেলে চলে আসাটা ওর জীবনের বড় ভুলগুলোর মধ্যে একটা ছিলো। কী করত? বাবাকে কথা দিয়েছিল, তারওপর বিহানের ওপর রেগেও ছিল। কিন্তু ছেলেটা যে অভিমানে এভাবে গুটিয়ে যাবে সেটা কে জানতো? বিহানযে সুইসাইড করবেনা সেটা জানে সৌহার্দ্য। কারণ যেই বিহানকে ও ছেড়ে এসছে সাত বছর আগের বিহান নয়। পরিচ্ছন্ন, যত্ন করে বানানো একটা বিশাল গ্রাউন্ডের একপাশে গিয়ে বসল সৌহার্দ্য। কিছুই ভালো লাগেনা এখন আর। সৌহার্দ্য আনমনেই বলে উঠল,
” কোথায় আছিস বিহান?”
তখনই ওর ফোনটা বেজে উঠল। এমন সময় ফোন বেজে ওঠাতে ভ্রু কুচকে ফোনটা বেড় করে দেখে ওর মা মিসেস নাহার ফোন করেছেন। হঠাৎ এইসময় ওনার কল দেখে একটু অবাক হল সৌহার্দ্য। রিসিভ করে ও কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে মিসেস নাহার কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে উঠলেন,
” সৌহার্দ্য…তোর বাবা..”
বলে আবারও কেঁদে উঠলেন। সৌহার্দ্য খানিকটা ঘাবড়ে গেল। উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
” মা কাঁদছো কেন? কী হয়েছে বাবার?”
কিন্তু উনা কেঁদেই যাচ্ছেন। সৌহার্দ্য অধৈর্য হয়ে বলল,
” মা তোমার পাশে কে আছে তাকে ফোনটা দাও।”
তখন ওপাশ থেকে নুসরাত বলে উঠল,
” হ্যালো ভাই!”
” আপু! মা কাঁদছে কেনো? কী হয়েছে বাবার?”
নুসরাত ভাঙা গলায় বলল,
” বাবার হার্টঅ্যাটাক হয়েছিল। আমরা এনে হসপিটালে ভর্তি করেছি। তুই টেনশন করবি তাই তোকে আগে জানাই নি।”
সৌহার্দ্য শান্ত গলায় বলল,
” এখন কেমন আছেন?”
” একটু ভালো। তবে ডক্টর ফলেচে অবস্থা বেশি ভালো নয়। তোকে দেখতে চাইছে বারবার। প্লিজ ভাই এবার চলে আয় দেশে।”
” কিন্তু আপু..”
” কোন কিন্তু না। অনেক তো হল। আর জেদ করিস না ভাই, প্লিজ!”
নুসরাতের কাছ থেকে ফোন নিয়ে মিসেস নাহার বললেন,
” তোকে আসতে হবেনা। তুই ওখানেই থাক। থাক তোর জেদ নিয়ে। মরে যাক তোর বাবা। আমিও বাঁচবোনা আর বেশিদিন। আমরা মরে গেলেও আসবিনা বলে দিলাম।”
সৌহার্দ্য আহত গলায় বলল,
” মা..”
” কী মা হ্যাঁ? কী মা? কবে কী হয়েছে সেই নিয়ে এখনও জেদ ধরে বসে আছে। কে হই আমরা? আমাদের কোন মূল্যই নেই তোর কাছে। কী চাস তুই আমরা মরে যাই!”
বলেই কেঁদে দিলেন উনি। সৌহার্দ্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। এরপর গম্ভীর স্বরে বলল,
” নেক্সট ফ্লাইটেই আমি আসছি। বাবার খেয়াল রেখো।”
মিসেস নাহার উচ্ছসিত কন্ঠে বললেন,
” সত্যি?”
সৌহার্দ্য উত্তর না দিয়ে ফোনটা রেখে দিল। এরপর ওর এসিসটেন্টকে ফোন করে বলল বাংলাদেশের নেক্সট ফ্লাইটের টিকিট কেটে রাখতে। সবকিছু ঠিক করে আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌহার্দ্য। অবশেষে দুবছর পর দেশে ফিরতে চলেছে ও। ওখানে গিয়ে কী তুর্বীর সাথে আবার দেখা হবে। ও আছে এখনও ওই শহরে? নিশ্চয়ই আছে। কোথায় আর যাবে? কীকরে মুখোমুখি হবে ওর? কী জানি কী আছে ওর ভাগ্যে।
#চলবে…