জলফড়িঙের খোঁজে পর্ব-৩৭+৩৮

0
701

#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৩৭
.

আকাশে ঘনকালো মেঘ করেছে। আজ সারাদিনই থেকে থেকে বৃষ্টি পরছে। মেঘের জন্যে চারপাশটাও অন্ধকারে ছেয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরপর মেঘ ডাকছে। বৃষ্টিমুখর পরিবেশটা যেন বান্দরবানের সৌন্দর্যকে একটা নতুন রূপ দেয়। এখন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পরছে। বিহান ওর রুমের বিশাল থাই গ্লাসটা খুলে সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে বৃষ্টি দেখছে। হালকা বৃষ্টির ছিটা খানিকটা ভিজিয়ে দিচ্ছে ওকে। তাতে ওর বিশেষ কিছু যায় আসছেনা। ও ওর ভাবনায় মগ্ন। বিহানের ভাবনায় ছেদ ঘটল ফোনের রিংটনে। এসময় ডিসটার্ব করাতে বেশ বিরক্ত হলো বিহান। ফরিদের নামটা স্ক্রিনে দেখে বিরক্তি মোটেও কমলো না। রিসিভ করে বিরক্তিমাখা কন্ঠেই বলল,

” হ্যাঁ বল?”

ওপাশ থেকে ফরিদ ব্যস্ত কন্ঠে বলল,

” স্যার, নিচের ফ্লোরে যেই কম্পানির আটজনকে ভাড়া দিয়েছি তাদের এমডি দেখা করতে চাইছে আপনার সাথে।”

” আমার সাথে কেন?”

” জানিনা, বললেন কথা বলবে।”

বিহান ভ্রু কুচকে ফেলে বলল,

” উনি আসবেন না আমাকে যেতে হবে?”

ফরিদ ইতস্তত করে বলল,

” আপনি এলে ভালো হয়।”

” আচ্ছা রাখছি।”

বিহান ফোনটা রেখে আবার বৃষ্টি দেখায় মনোযোগ দিল। সিগারেটটা শেষ করে তারপর যাবে দেখা করতে। নতুন কারো সাথে প্রয়োজন ছাড়া পরিচিত হতে ভালো লাগেনা ওর। কিন্তু আপাতত যেতে হবে। কেউ কথা বলতে চাইছে আর ও যদি না যায় তাহলে লোকটাকে অসম্মান করা হবে। সেটা ঠিক হবেনা। সিগারেট শেষ করে লম্বা শ্বাস ফেলে ও নিচে চলে গেল । নিচে করিডরে রেখে দেওয়া লম্বা চেয়ারে সেই কম্পানির এমডি বসে আজিজুল বসে আছেন। বিহানকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি। বিহানও ওনার সাথে হ্যান্ডশেক করে কিছুক্ষণ কুশল বিনিময় করে নিল। আজিজুল বললেন,

” আসলে এবার আমি চাইছিলাম একটু প্রাকৃতিক পরিবেশে নরমালি থেকে এবারের ট্রেনিং সাড়তে। তাই এই বাংলোতে আসা।”

বিহানও হেসে বলল,

” ভালো করেছেন। মাঝেমাঝে প্রকৃতির স্বাদ নেওয়া ভালো।”

” হ্যাঁ একদম। আমার সাথে আমার সাতজন এম্প্লয়ী এসছে। দেখা হয়ে যাবে তোমার ওদের সাথে। বয়সে তুমি আমার অনেক ছোট তাই তুমি বললাম। কিছু মনে করো না।”

বিহান হেসে বলল,

” না কিছু মনে করব কেন? অবশ্যই ডাকতে পারেন!”

দুজনে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করল। বিহানের প্রথমদিকে বিরক্ত লাগলেও পরে বেশ ভালো লাগলো লোকটাকে। বেশ মিশুক টাইপ মনে হল। কত তাড়াতাড়ি মিশে গেল ওর সাথে। আজিজুলের সাথে কথা বলে বিহান ফরিদকে নিয়ে চলে আসার সময় সিড়ির কাছ দিয়ে কারো সাথে ধাক্কা লাগল। বিহান না দেখেই ‘সরি’ বলে চলে যেতে নিলে কেউ অবাক কন্ঠে ‘বিহান’ বলে ডেকে উঠল। বিহান বেশ অবাক হল এখানে ওর নাম ধরে কেউ ডাকাতে। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে তুর্বী দাঁড়িয়ে আছে। ওর দৃষ্টিতেও অবাক হওয়ার ছাপ স্পষ্ট। মিরাজও ছিল তুর্বীর সাথে। তুর্বীকে দাঁড়াতে দেকে ওও দাঁড়িয়ে গেছে। বিহান একটু এগিয়ে এসে বলল,

” তুমি? এখানে?”

তুর্বী অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেই বলল,

” আমি এখানে ট্রেনিং এ এসছি। কিন্তু তুমি এখানে কীকরে?”

” এটা আমারই বাংলো। কিন্তু তুমি ট্রেনিং এ এসছো মানে তুমি এখন সিলেটে থাকছ?”

” হুম। কিন্তু তুমি বান্দরবান শিফট কবে করলে?”

” দু-বছর আগেই। তুমি সিলেট থাকো। আর রিখিয়া? ও কেমন আছে?”.

তুর্বী এবার হাত ভাজ করে চোখ ছোট করে বলল,

” ও কেমন আছে সেটা জেনে তুমি কী করবে? ওর প্রতি তোমার এই ইন্টারেস্টের কোন কারণ আছে কী? তোমার তো ভালো থাকার কথা। তা বিয়ে করে ফেলেছো? না-কি এখনও জামাকাপড়ের মত গার্লফ্রেন্ডস্ বদল করা, বেডরুমে নিয়ে আসা। এসব চালিয়ে যাচ্ছো?”

ফরিদ বড়সর ঝটকা খেল শেষের কথাটা শুনে। বিহানের গার্লফ্রেন্ড? তাও বেডরুমে? কীভাবে সম্ভব? এই দেড়বছরে কোন মেয়ের ধারেকাছে ঠিকভাবে যেতে দেখেনি বিহানকে। বেডরুম তো অনেক দূরের কথা। এই মেয়ে কী বলছে? তুর্বীর এটিটিউটের এরকম পরিবর্তন থেকে বিহান অনেকটা শকড। তুর্বী মানেই ওর চোখে একটা হাসিখুশি প্রাণচ্ছল মেয়ের ছবি ভাসত। কিন্তু এটা কোন তুর্বী? দুই বছরে এতোটা বদলে গেছে মেয়েটা? বিহান শান্ত গলায় বলল,

” সবকিছুর কারণ থাকতে হয়?”

তুর্বী কোন উত্তর দিলো না। বিরক্তি নিয়ে অন্যদিকে তাকাল। বিহানের আচরণে অনেক পরিবর্তন চোখে পরছে ওর। এটা দুবছর আগের সেই বিহান নয়। কথায় কথায় ফ্লার্ট করা, মজা করা, দুষ্টুমি করা সেই বিহান কোথাও একটা মিসিং আছে। বিহান বলল,

“ও কোথায় আছে এখন?”

” ওর গ্রামের বাড়িতে হয়তো।”

” যোগাযোগ নেই তোমার সাথে?”

” যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম চলে যাওয়ার পর কিছুদিন। পারিনি। হয়তো আমার মত খারাপ একটা মেয়ের সাথে যোগাযোগ রাখতে চায়নি।”

বিহানের কিছু বলতে ইচ্ছা করছিল কিন্তু বলল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যেতে নিলেই তুর্বী বলে উঠল,

” সৌহার্দ্য ফেরেনি?”

বিহান থেমে গেল তুর্বীর প্রশ্ন শুনে। পেছন ফিরে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,

” ওর কথা মনে আছে তোমার?

তুর্বী মাথা নিচু করে ফেলল। বিহান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

” ও ওর কথা রেখেছে। যোগাযোগ করেনি আমার সাথে আর। হয়তো ফেরেনি এখনও দেশে। আবার ফিরতেও পারে। জানিনা।”

তুর্বী কিছু না বলে চলে যেতে নিলেই বিহান বলল,

” বদলে গেছ অনেক।”

” তুমিও।”

কথাটা বলে তুর্বী একটা মলিন হাসি দিল।
বিহান আর কথা না বাড়িয়ে ওপরে চলে গেল। ফরিদও পেছন পেছন গেল। তুর্বী নিজের কাজে যেতে নিলে মিরাজ বলল,

” কে ইনি? তোর পরিচিত কেউ?”

কিন্তু তুর্বী কোন উত্তর না দিয়ে চলে গেল। এখন মন মেজাজ একদম ভালো নেই ওর। কারো প্রশ্নের উত্তর দিতে চায়না।

____________

সৌহার্দ্য দু-দিন আগে ফিরেছে দেশে। সৌহার্দ্যর ফিরে আসাতে বাড়ির সবাই খুব খুশি হয়েছে।শফিক রায়হানকে বাড়ি আনা হয়েছে মোটামুটি সুস্থ উনি এখন। কিন্তু অফিসে যেতে পারবেন না। তাই আজ সৌহার্দ্যকেই অফিস যেতে হবে। কিন্তু ওর ভেতরটা কেমন করছে। দু-বছর পর আবার তুর্বীর সম্মুখীন কীকরে হবে? দূরে থেকে নিজেকে সামলে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু এখন সামনে গেলে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে তো? এসব ভেবে ভেবেই সকাল থেকে অস্হির হয়ে যাচ্ছিল ও। কিন্তু অফিসে গিয়ে এতবড় ধাক্কা খাবে ভাবতে পারেনি। অফিস গিয়ে তুর্বীকে পায়নি ও আর। খুব অবাক হয়েছে ব্যাপারটাতে। আরো অবাক হয়েছে এম্প্লয়ীদের লিস্ট চেক করে কোথায় তুর্বীর নাম না পাওয়াতে। ও দ্রুত ম্যানেজারকে ডাকল। ম্যানেজার আসতেই সৌহার্দ্য জিজ্ঞেস করল,

” তুর্বী ইসলামের কথা মনে আছে আপনার?”

” জি স্যার।”

” উনি নেই কেন?”

” স্যার উনিতো জব ছেড়ে দিয়েছেন।”

সৌহার্দ্য হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

” কবে?”

” স্যার প্রায় দুবছর হবে।”

সৌহার্দ্য কিছু ভাবতে ভাবতে বলল,

” উনি বর্তমানে কোথায় আছে জানেন?”

” না স্যার।”

ম্যানেজারকে বিদায় দিয়ে সৌহার্দ্য মাথা চেপে ধরে বসল। তুর্বী আর এখানে নেই? ঐ ঘটনার পরেই চলে গেছে মেয়েটা। কিন্তু কোথায়? সৌহার্দ্য দ্রুত রিখিয়া যেই ব্যাংকে চাকরি করতো সেখানে ফোন করল। আর ওনাদের থেকে ইনফরমেশন নিয়ে জানতে পারল যে রিখিয়াও জব ছেড়ে দিয়েছে। কী হচ্ছেটা কী? কী হয়েছিল সৌহার্দ্য বিদেশ চলে যাওয়ার পর? এদিকে বিহাটারও খোঁজ নেই। ওর অবর্তমানে এখানে সবকিছু এভাবে বদলে গেছে? তাও এভাবে?

সন্ধ্যার অনেক পর বাড়ি ফিরল সৌহার্দ্য। ফ্রেশ হয়ে অনেকটা মনমরা হয়ে এসে ড্রয়িরুমে সোফায় বসল। নুসরাতের ছেলে ‘মীর’ অস্পষ্ট স্বরে ‘মামা’ বলে নুসরাতের কোল থেকে হাত বাড়িয়ে দিল। সৌহার্দ্য মুচকি হেসে ভাগ্নেকে কোলে তুলে নিলো। শফিক রায়হান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,

” বিহানের কোন খোঁজ পেয়েছ?”

সৌহার্দ্য একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

” তুমি আবার ওকে নিয়ে কবে থেকে ভাবছ?”

” ও তোমার ভাই হওয়ার আগে আমার ভাগ্নে। ওকে শাসন করতাম ঠিকই কিন্তু ভালোও কম বাসিনি একসময়। তোমার সন্তান হওয়ার পর সে যদি এরকম জঘন্য একটা কাজ করে তুমি মেনে নেবে? খুন করলেও বিবেচনা করতাম। কিন্তু একটা ধর্ষককে কীকরে ক্ষমা করি?”

সৌহার্দ্য বলল,

” বাবা প্লিজ! অসুস্থ তুমি। আমি এসব নিয়ে তর্ক করতে চাইনা।”

শফিক রায়হান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

” বয়স তো অনেক হল। এবার বিয়েটা করে ফেলো। তোমার বিয়ে দেখে অন্তত মরতে দাও।”

সৌহার্দ্য মীরের সাথে খেলতে খেলতেই বলল;

” পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যারা বিয়ে করেনি। তারা কী বেঁচে নেই? আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি। নতুন কিছু বল।”

এবার মিসেস নাহার বললেন,

” আচ্ছা বিয়ে না করলি। মেয়েটার সাথে কথা বল। কয়েকটা দিন বন্ধুর মতো মেশ। এরপর যদি তোর ইচ্ছে না হয় বিয়ে করতে আমরা জোর করব না। বাবা-মায়ের এটুকু আবদার রাখ?”

সৌহার্দ্য একটা হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে বলল,

” আচ্ছা।”

নুসরাত হেসে বলল,

” যাক একটু হলেও সুমতি হয়েছে।”

শফিক রায়হান গম্ভীর স্বরে বললেন,

” তোমার করিম কাকার মেয়ের বিয়ে সামনের শুক্রবার। আমাদের যেতে হবে। অনেক দূরে গ্রামে বাড়ি। তাই দুদিন আগেই চলে যেতে হবে। এতোদিন পর দেশে এসছো। তোমাকেও যেতে হবে কিন্তু।”

সৌহার্দ্যর কোথায় যাওয়ার ইচ্ছা নেই এখন। কিন্তু এখন না ও করতে পারবেনা। তাই মাথা নেড়ে মীরকে কোলে নিয়েই ওপরে চলে গেল। এখানে থাকতে আর ভালো লাগছে না।

#চলবে…

#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৩৮
.

নিজের রুমে বিছানার ওপর হাটু গুটিয়ে বসে কোলে একটা বালিশ নিয়ে সেটাকে খামচে ধরে বসে আছে রিখিয়া। যেকোন মুহূর্তে কেঁদে দেবে এমন অবস্থা। পাশের রুম থেকে রায়হানের চেঁচামেচির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আজকে আবার এসছে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে। আজ একা আসেনি সাথে নিজের বউ নিলুকে নিয়ে এসছে। বেশ তর্কাতর্কি হচ্ছে আজ। কথার মাঝে জোরে জোরে কেশে উঠলেন রেজাউল ইসলাম। রিখিয়ার পক্ষে আর বসে থাকা সম্ভব হলোনা। বালিশটা কোল থেকে ছুড়ে ফেলে রেখে উঠে দরজা খুলে গেল বসার ঘরে। ওকে দেখে সবাই থেমে গেল। রিখিয়া এগিয়ে গিয়ে রায়হানের দিকে তাকিয়ে বলল,

” কী শুরু করেছ তুমি? বাবা-মার সাথে চেঁচামেচি করছ কেন? বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ আমার। ওনাদের বলছ কেন?”

রায়হান কিছু বলবে তার আগেই নিলু বলল,

” দেখ রিখিয়া আবেগ দিয়ে দুনিয়া চলেনা। তোমার সত্যিই মনে হয় সারাজীবন এভাবে একা কাটিয়ে দিতে পারবে?”

রায়হান তেজী গলায় বলল,

” সেটাই বোঝাও এই মেয়েকে। আমি বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেছি।”

” এতো ভাবতে কে বলে তোমাদের? আর তাছাড়াও তোমরা আবার আমাকে নিয়ে কবে থেকে ভাবতে শুরু করে দিলে বলোতো? স্বার্থ ছাড়াতো তো তোমরা কিছু করোনা। আমার বিয়ে দিয়ে তোমাদের কী স্বার্থসিদ্ধি হবে?”

রায়হান রেগে বলল,

” খুব বেশি কথা শিখে গেছিস আজকাল। তোকে তো আমি..!”

বলে রিখিয়া মারতে নিলেই রেজাউল ইসলাম ধমক দিয়ে বলল,

” খবরদার! আমার মেয়ের গায়ে হাত তুললে আমি কিন্তু তোমাকে পুলিশে দেব।”

রায়হান অবাক কন্ঠে বলল,

” বাবা!”

রেজাউল ইসলাম ঝাঝালো কন্ঠে বললেন,

” বেড় হও এখান থেকে। বেড় হও!”

নিলু এবার নিজের আসল রং দেখিয়ে দিয়ে বলল,

” কথা এতো পেঁচাচ্ছেন কেন বাবা? সোজা কথা বলে দিন না যে এই মেয়ের রোজগারে আপনার ঘর চলে। দু-বেলা ভালোমন্দ গিলতে পারেন। এমন সোনার ডিম পাড়া হাস কেই বা ছাড়তে চায়?”

নিজের পুত্রবধুর মুখে এরকম কথা শুনে ব্যথিত হলেন রেজাউল ইসলাম। সত্যিই কী তাই? নিজের স্বার্থে সে ব্যবহার করছে নিজের মেয়েকে? নিলু বলল,

” তাই বলছি। নিজের মেয়ের জীবনটা আর নষ্ট করবেন না। পারলে__”

নিলুকে থামিয়ে দিয়ে রিখিয়া বলল,

” ভাবি প্লিজ থামো। তোমাদের মুখে এসব মানায় না। ঠিকভাবে তো খবরও নাও না এই মানুষ দুটো বেঁচে আছে কি-না মরে গেছে। আর এখন এসব বলছ? লজ্জা করছেনা একটুও?”

রায়হান একটু অপমানিত বোধ করল। ক্ষীপ্ত দৃষ্টিতে রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে রেড়িয়ে গেল বাড়ি থেকে। নিলুও পেছন পেছন চলে গেলো। রিখিয়া ওখানে রাখা চেয়ারে বসে পরল। বিরক্ত লাগছে ওর কাছে সবকিছূ এখন। কিছুক্ষণ সব চুপচাপ ছিল। নিরবতা ভেঙ্গে রিখিয়ার বাবা বলল,

” একটা কথা বলব, মা?”

” বিয়ে করতে বলবে এইতো?”

শান্ত গলায় কথাটা বলল রিখিয়া। জাহানারা এতোদিন চেঁচামেচি করলেও এবার নরম কন্ঠে বলল,

” দেখ তোকে জোর করব না। কিন্তু নিলু একটা কথাতো সত্যি বলেছে। আবেগ দিয়ে দুনিয়া চলে না। করিম ভাইর মেয়েটা তোর কত ছোট ওরও বিয়ে হয়ে যাচ্ছে কাল। লোকেতো এবার খারাপ বলবে। এমনিতেই অনেকে অনেক কথা বলে।”

রেজাউল ইসলামও বললেন,

” আমাদের অপরাধবোধ আর বাড়াস না মা। সবকিছুর জন্যে নিজেদের দায়ী মনে হয়। আমাদের নিয়ে ভাবতে হবেনা। আমরা ঠিক চালিয়ে নেব। তবুও এই ভার থেকে আমাদের মুক্তি দে।”

রিখিয়া মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে বেড়িয়ে গেল। রেজাউল ইসলাম দুবার ডাকলেও কোন সাড়া দেয়নি রিখিয়া। কী করা উচিত এখন ওর? কোন দিকে যাবে? ভাগ্য বারবার ওর সাথেই এরকম কেন করে? এরকম কঠিন পরিস্থিতিতে ওকেই কেন পরতে হলো? এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির সামনের বড় মাচাটার ওপর বসে পরল। উদাস দৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। এই নদীরও লক্ষ্য আছে; সমুদ্র। পাহাড় থেকে নেমে সে নিরন্তর ছুটে চলে নিজের গন্তব্যে পৌছানোর জন্যে। কিন্তু ওর জীবনের লক্ষ্য কী? ওয গন্তব্য কোথায়? কী আছে ওর ভাগ্যে? হঠাৎ শাফিন এসে বসল ওর পাশে। শাফিনকে দেখে দ্রুত চোখ মুছে নিল। শাফিন একটা মলিন হাসি দিয়ে বলল,

” আর কত লুকাবে নিজেকে? এতোটাও চাপা হওয়া ঠিক নয় রিখিয়া। অতিরিক্ত সবকিছুই খারাপ। ভালো জিনিসটার সাথেও যখন ‘অতিরিক্ত’ শব্দটা যুক্ত হয় সেটাও খারাপ হয়ে যায়। তো এটাই ছিল আমাকে বিয়ে করতে না চাওয়ার কারণ?”

রিখিয়া কোন উত্তর দিলোনা। মাথা নিচু করে বসে রইল। ও বুঝতে পেরেছে আজ শাফিন বাইরে থেকে সবটাই শুনে ফেলেছে। শাফিন বলল,

” রিখিয়া বিয়ে কিন্তু শুধু দুটো মানুষের বন্ধন হয়না। দুটো পরিবারেরও হয়। তোমার আমার বিয়ে হলে তোমার বাবা-মা শুধু তোমার দায়িত্ব না, আমারও দায়িত্বও হয়ে যাবে। আর এতে ছোট হওয়ার কিচ্ছু নেই। এটা তোমার অধিকার। ওনাদের অধিকার থাকবে আমার ওপর।”

রিখিয়া একটু অবাক হয়ে তাকাল শাফিনের দিকে। শাফিন বলল,

” তবুও তোমাকে জোর করব না। সবটাই তোমার ইচ্ছা। আমার কথাগুলো একটু ভেবে দেখো।”

কথাগুলো বলে শাফিন উঠে চলে গেল। রিখিয়া একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শাফিনের যাওয়ার দিকে।

_____________

আকাশে মেঘ করেছে তাই সূর্য দেখা যাচ্ছেনা। কিছু পাখি কিচিরমিচির শব্দ করছে। বান্দরবানের পাহাড়ি রাস্তা, পাহাড়, মেঘলা আকাশ, সবুজ প্রকৃতি সবটাই দেখা যায় এই বাংলোর করিডরের বারান্দা থেকে। তুর্বী কফি খেতে খেতে দেখছে সবটা। তবে ওর দৃষ্টি আপাতত সামনের মাঠের বেঞ্চে বসে থাকা বিহানের ওপর। কেমন উদাসীনভাবে বসে ফোন দেখছে। এই দুদিন গভীরভাবে লক্ষ্য করেছে বিহানকে। ছেলেটার মধ্যে অনেকটা বদল লক্ষ্য করেছে তুর্বী। শুধু ড্রিংক আর স্মোক করা ছাড়েনি। আর সবটাই বদলে গেছে। আর আজ সকালে ফরিদের কাছ থেকে অদ্ভূত কথা জানতে পেরেছে ও। গত দেড় বছরে না-কি বিহান অপ্রয়োজনে কোন মেয়ের কাছেও যায়নি। ভাবা যায় এই বিহানই একসময়ের প্লে বয় ছিল? আরেকটু খোঁজ নিয়ে জেনেছে যে, নেশার কথা বাদ দিলে বিহান এখন অনেকটা সেরকমই যেরকম রিখিয়া বিহানকে দেখতে চাইত। ফরিদের মুখে এটাও শুনেছে বিহানের রুমে একটা মেয়ের পেন্টিং আছে যেটা ও খুব যত্নে রাখে। কাউকে বিক্রি করেনা। ওই পেন্টিং যদি রিখিয়ার হয় তারমানে তো___ এখন অনেক কিছু ঘুরছে ওর মাথায়। হঠাৎ মাথায় কেউ টোকা মারতেই তুর্বী পেছনে না তাকিয়েই রাগী কন্ঠে বলল,

” মিরাজ, সবসময় ভালোলাগেনা।”

মিরাজ হেসে দিয়ে রেলিং এ ভর দিয়ে বলল,

” এতো সিরিয়াসলি কী ভাবছিস?”

তুর্বী বিহানের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল,

” আচ্ছা? কিছু মানুষকে কী সেকেন্ড চান্স দেওয়া যায়? যদি সে নিজেকে বদলাতে পারে?”

মিরাজ কিছুক্ষণ ভেবে বলল,

” উমম। গভীর প্রশ্ন। তবে একটা কথা কী জানিস? জীবন একটাই। তাই যদি কাউকে আরেকটা সুযোগ দেওয়াতে আমাদের ভালো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাহলে একটা চান্স নিতে সমস্যা কোথায়?”

তুর্বী কিছুক্ষণ গম্ভীরভাবে কিছু ভেবে হেসে দিয়ে বলল,

” জীবনে প্রথম একটা কাজের কথা বললি। তবে তার আগে আমাকে আরেকটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে।”

কথাটা বলে তুর্বী চলে গেল। মিরাজ ওর কথার আগা মাথা কিছুই বুঝল না। এটা নতুন কিছু না। মাঝেমাঝেই এমন হয়। এই মেয়ের কথা ওর মাথার অনেকটা ওপর দিয়ে যায়।

পরেরদিন সকালে, বিহান বিছানায় হেলান দিয়ে বসে গেমস খেলছে। তবে দেখেই বোঝা যাচ্ছে পুরো মনোযোগ ফোনে নেই। দরজায় কেউ নক করতেই ও ভাবল ফরিদ এসছে। ও ভ্রু কুচকে খেলতে খেলতেই দরজাটা খুলে দিয়ে বলল,

” এতো সকাল সকাল যে?”

কিন্তু একটা মেয়েলী কাশির আওয়াজ পেয়ে সামনে তাকিয়ে দেখে তুর্বী দাঁড়িয়ে আছে। বিহান একটু অবাক হয়ে বলল,

” তুমি?”

” হুম। আসলে আজ ট্রেনিং অফ আছে। আর সবাই যে যার মত ঘুরছে। আপাতত আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করছিল না। ভাবলাম তোমার সাথে এসে গল্প করি।”

বিহান একটু হেসে বলল,

” হঠাৎ আমার মত একটা খারাপ ছেলের সাথে গল্প করার ইচ্ছে হল যে?”

” চলে যাবো?”

” না, না। এসো, ভেতরে এসো।”

তুর্বী ভেতরে এসে সোফায় বসল। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখল। অনেক পেন্টিং আছে। কিছু কিছু পেন্টিং কাপড় দিয়ে ঢাকা। বিহান ওর দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি হেসে বলল,

” কী খাবে? চা না-কি কফি?”

তুর্বী যেন এই প্রশ্নটা শোনারই অপেক্ষা করছিল। দ্রুত বলে দিল,

” কফি।”

” তুমি বস। আমি এখনি আসছি।”

তুর্বী মাথা নাড়ল বিহান চলে গেল কিচেনে। তুর্বী সাথেসাথেই উঠে সবগুলো পেন্টিং থেকে কাপড় সরিয়ে চেক করতে শুরু করে দিল। কিন্তু কোথাও কোন মেয়ের পেন্টিং নেই। যখন তখন বিহান চলে আসতে পারে। তাড়াতাড়ি করতে হবে। কিন্তু একটাতেও এমন পেন্টিং পেলোনা যেখানে কোন মেয়ে আছে। কোথাও না পেয়ে ও হতাশ হয়ে বসতে যাবে তখনই ওর চোখ গেল সরাসরি দূরে রেখে দেওয়া বড় পেন্টিংটার দিকে, যেটা লাল কাপড় দিয়ে ঢাকা। ও দ্রুত সেখানে গিয়ে লাল রঙের কাপড়টা সরাতেই রিখিয়ার হাসিমুখের একটা পেন্টিং বেড়িয়ে এলো। তুর্বী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এতো নিখুঁত পেন্টিং? মনে চিরস্থায়ীভাবে গেঁথে না গেলে এতো নিখুঁত ছবি হয়না। ওর মনে হচ্ছে রিখিয়াই দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর চোখে সামান্য জল জমলো ওর। বিহানের আসার আওয়াজ পেয়ে চোখ মুছে, পেন্টিংটা ঢেকে, দ্রুত এসে সোফায় বসে পরল। বিহান ওর দিকে কফি এগিয়ে দিতেই বলল,

” থ্যাংকস।”

” ইউ আর ওয়েলকাম।”

বলে বিহানও বসল ওর পাশে। বিহান বলল,

” তো সিনিয়র আর্কিটেক্ট তুর্বী ইসলাম। স্বপ্ন সত্যি হলো তাহলে?”

তুর্বী হেসে বলল,

” তোমার স্বপ্নও তো সত্যি হয়েছে।”

” তা হয়েছে।”

” তো আজ আমায় বান্দরবানের কিছুটা ঘুরিয়ে দেখাও যদি তোমার আপত্তি না থাকে।”

” আপত্তি থাকবে কেন? এগারোটার দিকে চল তাহলে?”

” আচ্ছা!”

কিছুক্ষণ গল্প করার পর কথায় কথায় তুর্বী বলল,

” রিখায়াকে মিস কর?”

প্রশ্নটা শুনে বিহান কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। এরপর একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,

” কী লাভ? এতোদিন হয়তো ও স্বামী সংসার নিয়ে সুখে আছে। আমার মত একটা ছেলের ভাবনায় কী যায় আসে?”

তুর্বী কোন জবাব দিলোনা। তবে মনে মনে বলল, আমি জানি তুই ভালো নেই রিখু। আমার মন বলছে তুই ভালো নেই। তোকে যে যতই ভালোবাসুক তুই ভালো থাকবিনা। কারণ তোকে একমাত্র বিহানই ভালো রাখতে পারবে। আজ আমি ওর চোখে তোর জন্য সেই ভালোবাসা দেখেছি যেই ভালোবাসার স্বপ্ন তুই একসময় দেখতি। দুজন দুজনকে এতোটা ভালোবেসেও এতো কষ্ট পাবি সেটা হয়না। এবার আমি সেটাই করব যেটা আমার করা উচিত। তোদের আবার এক করব আমি। যেভাবেই হোক।

#চলবে…