#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৪৩
.
জোৎস্না রাত। আকাশে চাঁদ সম্পূর্ণ গোল। চাদের আলোতে চারপাশ বেশ ভালোই আলোকিত হয়ে আছে। হালকা ঢালু রাস্তার পাশে একটা বেঞ্চ রাখা আছে। সেই বেঞ্চেই বসে আছে সৌহার্দ্য আর বিহান। দূরে বিশাল পাহাড়, খাদ, গাছ দেখা যাচ্ছে অাবছা আবছা। দীর্ঘ দুই বছর পর আজ দুই ভাই আবার লং ড্রাইভে বেড়িয়েছে। অনেকটা ঘোরাঘুরির পর এখানে এসে বসেছে ওরা। নিরবতা কাটিয়ে সৌহার্দ্য বলল,
” তো কাল সকালেই আমরা ঢাকা ফিরছি। তাইতো?”
বিহান বলল,
” কিন্তু ব্রো, এখান থেকে হুট করে কীকরে যাই? সবকিছু গোছাতে হবে আগে। এরপর__”
সৌহার্দ্য বিহানকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
” অযুহাত দিবিনা একদম। কোন বিজনেস করিস না তুই। যেটুকু গোছানো প্রয়োজন সেটুকু ফরিদ গুছিয়ে নেবে।”
” কী দরকার?-
” দরকার নেই, আমি এতদিন পর দেশে এলাম। আর তুই আমার কাছে থাকবি না? এটা বলতে পারলি তুই?”
বিহান কিছু বলল না। সৌহার্দ্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল,
” ঐ শহরে গেলে রিখিয়াকে খুব মনে পরে না?”
বিহান একটু অবাক হয়ে তাকাল সৌহার্দ্যর দিকে। তারপর হেসে দিয়ে বলল,
” কী সব বলছিস বলত?”
সৌহার্দ্য শান্ত চোখে বিহানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
” তুই আমার ভাই বিহান। আমি চিনি তোকে। ভালোবেসে ফেলেছিস না ওকে?”
” এমন কিছুই না।”
” তাহলে ঐ পেন্টিং?”
বিহান অবাক হয়ে তাকাল সৌহার্দ্যর দিকে। সৌহার্দ্য একটু হেসে বলল,
” তুই যখন ওয়াসরুমে ছিলি তখন দেখেছি ওটা আমি। এরপরও অস্বীকার করবি?”
বিহান বেশ অনেক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” কী লাভ? এতোদিনে ওর নিশ্চয়ই বিয়ে হয়ে গেছে। সুখে আছে। ওর সুখের পথে আর বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে চাইনা আমি। আমি ওকে ভালোবাসি এটুকুই আমার জন্যে যথেষ্ট। এতটাই ভালোবেসেছি যে দূরে থেকেই সারাজীবন ওকে ভালোবেসে কাটিয়ে দিতে পারব।”
সৌহার্দ্য একটা তৃপ্তির হাসি দিল। যাক, সত্যিই তাহলে বিহান ভালোবাসার আসল মানেটা বুঝেছে। এখন ওকে কিছু বলবেনা। ও ওর ধারণা নিয়ে থাকুক আপাতত। আগে দুজনের দেখা করাতে হবে। তারপর বাকি সব।
_____________
নদীর দিক থেকে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। মাঝে মাঝে পাখি ডেকে উঠছে। একটা বড় মেহগনি গাছের সাথে হেলান দিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে তুর্বী। অনেক চিন্তা ঘুরছে ওর মাথায়। ভেবেছিল সবটা ধীরে সুস্থে আস্তে আস্তে ঠিক করবে। কিন্তু এখন যা করার দ্রুত করতে হবে। হাতে সময় খুব কম। এই সময়ই যে বিয়েটা ঠিক হয়ে যাবে সেটা কে জানতো? কাল অনেক রাত অবধি জেগে থেকে রিখিয়াকে বুঝিয়েছে যে, বিয়ের সিদ্ধান্ত এতো হুটহাট নিসনা, আরও ভেবে দেখ। সরাসরি তো আর বলতে পারছিল না বিয়ে করিস না। কিন্তু মেয়েটাকে কোনভাবেই বোঝাতে পারল না। বারবার নিজের পরিবার, শাফিনের পরিবারের কথা বলে কাটিয়ে দিচ্ছিল।বিহানযে এখন ওকে ভালোবাসে সেটা সরাসরি বলেনি রিখিয়াকে ও। কারণ হুট করে ‘ও তোকে ভালোবাসে’ কথাটা বলে দেওয়াটা ঠিক হতোনা। রিখিয়া ফিল করতে পারতোনা ব্যাপারটা। আর না রিখিয়া বিহানের অবস্থাটা বুঝতে পারতো। তাই একটু ঘুরিয়ে বলেছিল কথাটা কিন্তু রিখিয়া শোনেনি।
কাল রাতে ঘুমোনোর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তুর্বী রিখিয়াকে বারবার বলেছে যে, এখনও সময় আছে প্লিজ একটু ভেবে দেখ। রিখিয়া বিরক্ত হয়ে বলল,
” কী সমস্যা তোমার বলবে? আমি বিয়ে করলে তুমি খুশি হবে না।”
এখন তুর্বী সরাসরি বলতেও পারছিল না কিছু তাই ছোট মুখ করে বলল,
” আরে ব্যাপারটা খুশি অখুশির না রিখু। আমার মনে হচ্ছে তুই তাড়াহুড়ো করছিস।”
” তাড়াহুড়ো কীকরে? সে আরও অনেকবছর আগে থেকেই বিয়ে করতে চেয়েছিল আমাকে। তারওপর এখানে আসার পরও দু-বছর কেটে গেছে। তবুও বলবে তাড়াহুড়ো করছি? ভাবার জন্যে এটা যথেষ্ট সময় নয়?”
তুর্বী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। সত্যিই সিদ্ধান্ত তো তাড়াহুড়ো করে হয়নি, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভুল সময়ে নেওয়া হয়ে গেছে। ও ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,
” বিহানকে ভুলে যেতে পেরেছিস?”
রিখিয়া শীতল দৃষ্টিতে তাকাল তুর্বীর দিকে। তারপর মলিন হেসে বলল,
” তাতে কী কিছু যায় আসে তুর?”
তুর্বী কিছুক্ষণ রিখিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
” কিচ্ছু যায় আসে না?”
” আসে কী? সে তো আর আমাকে ভালোবাসেনা। তাই শুধু শুধু বাবা-মাকে কষ্ট দিয়ে কী লাভ?”
” দুইটা বছর অনেকটা সময় রিখু। যদি এই দুই বছরে বিহান তোকে ভালোবেসে ফেলে থাকে তাহলে? মানুষ তো বদলে যেতেই পারে। হতেই পারে বিহান বদলে গেছে!”
রিখিয়া বালিশ ঠিক করতে করতে হালকা হাসল। তারপর বলল,
” কাছে থেকেই ওনার মনে আমার জন্যে সহানুভূতি ছাড়া আর কোন অনুভূতির জন্ম দিতে পারিনি। আর তুমি বলছ দু-বছর এতোটা দূরে থাকার পর উনি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে? এটা হয়? দেখ গিয়ে হয়তো উনি এতোদিনে ভুলেও গেছেন যে রিখিয়া নামের একটা মেয়ে ছিল তার জীবনে।”
তুর্বী আনমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
” মানুষ খুব অদ্ভুত এক প্রাণী। কখন কী করে, কী করলে কী হয়, কার ক্ষেত্রে কী হয়; সেটা বলা খুব মুশকিল। কখনও প্রিয় মানুষটার থেকে দূরে চলে গেলেই মনের সুপ্ত অনুভূতিগূলো জেগে ওঠে। কিছু মানুষের দূরে চলে যাওয়াই বুঝিয়ে দেয় তারা আমাদের কতটা জুড়ে ছিল।”
রিখিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,
” কী হয়েছে বলোতো তোমার? সে এসে থেকে দেখছি তোমার কথাগুলো কেমন গম্ভীর হয়ে গেছে। অনেক বদলে গেছ তুমি। তুরের মুখে এমন কথা বেমানান লাগে। কী হয়েছে বল?”
তুর্বী মুচকি হেসে বলল,
” আমার আবার কী হবে। দুই বছর কেটে গেছে তাই হয়তো আমার সবটাই বদলে গেছে। যাই হোক, তুই আমার কথাটাতো ভেবে দেখ।”
” যা ভাবার আমি ভেবে নিয়েছি। এখন আর এসব ভেবে তুমি সময় নস্ট করোনা। চলো শুয়ে পরো।”
কথাটা বলে রিখিয়া শুয়ে পরল। এরপর রাতে আর কথা হয়নি ওদের। এখন জাহানারা আর রিখিয়া নাস্তা বানাচ্ছে। তুর্বীকে নিজে থেকে ঘুম থেকে উঠতে দেখে প্রচন্ড অবাক হয়েছে রিখিয়া। যে মেয়েকে ঘুম থেকে ওঠাতে ওকে একপ্রকার বিশ্বযুদ্ধ করতে হতো সেই মেয়ে নিজে থেকে এভাবে উঠে গেল? সত্যিই আশ্চর্যের! কিন্তু তবুও ও কিছু বলেনি। তুর্বী ভাবছে যে এখন কী করা যায়। হঠাৎ ওর সৌহার্দর কথা মনে পরল। সৌহার্দ্যকে ফোন করে ওদিকের খবর জানতে হবে, এদিকের খবরটাও ওকে জানাতে হবে। তাই দ্রুত সৌহার্দ্যকে ফোন করল।
ফোনের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল সৌহার্দ্যর। চোখে এখনও প্রচুর ঘুম আছে। কাল অনেকরাত অবধি দুই ভাই ঘোরাঘুরি করে এসে পরে ঘুমিয়েছে। চোখ বন্ধ করেই হাতরে ফোনটা খুঁজে সামনে এনে স্ক্রিনে তাকিয়ে তুর্বীর ফোন দেখে ওর ঘুম পালিয়ে গেল। এতো সকাল সকাল ফোন দিল যে? ও উঠতে গিয়ে দেখল বিহান ওর ওপর এক হাত, এক পা ছড়িয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। আগেও একসঙ্গে থাকলে এমনই করতো বিহান। সৌহার্দ্য হালকা হেসে বিহানকে সরিয়ে উঠে বারান্দায় চলে গেল। তারপর ফোন রিসিভ করে বলল,
” হ্যাঁ বলো। এতো সকালে ফোন করলে যে?”
” ওখানকার কী খবর? সব ঠিক আছে?
” হ্যাঁ এদিকে সব সেট আছে। আমরা ব্রেকফাস্ট করেই ঢাকার উদ্দেশ্য বেড়িয়ে পরব। ওদিকে সব ঠিক আছেতো!”
তুর্বী চিন্তিত কন্ঠে বলে উঠল,
” কিচ্ছু ঠিক নেই। অনেক বড় ঝামেলা হয়ে গেছে।”
সৌহার্দ্য একটু অবাক হয়ে বলল,
” আবার কী হল?”
” রিখুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। নেক্সট মান্থের তেরো তারিখে। মানে আর জাস্ট পনেরো দিন পর। আজ বাদ দিলে চৌদ্দ দিন।”
সৌহার্দ্য যেন আকাশ থেকে পরল। অনেকটা অবাক হয়েই বলল,
” কী? কিন্তু সেদিন যখন গেলাম সবতো ঠিক ছিল। এরমধ্যেই ___”
” হ্যাঁ। এখন কী করব?”
সৌহার্দ্য জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে থুতনিতে হাত রেখে কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
” আচ্ছা, তুমি রিখিয়াকে বলোনিতো বিহানের ব্যাপারে?”
” না, তেমন কিছুই বলিনি আমি।”
” গ্রেট! এখন কিছু না বলাই বেটার। কারণ এতে করে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। ঝামেলা বেড়ে যাবে তখন।”
” আমারও তাই মনে হয়েছে।”
” তাহলে এক কাজ করো। কালকে রিখিয়াকে নিয়ে ঢাকায় চলে এসো। যেকোন একটা বাহানা দিয়ে দাও। শপিং বা ঘুরতে আসা, যা খুশি। আমরা তো আজ ঢাকা আসছিই। কাল আমিও বিহানকে নিয়ে একই জায়গায় যাবো।”
তুর্বী অনেকটা ঘাবড়ানো কন্ঠে বলল,
” সব ঠিক হবে তো?”
সৌহার্দ্য একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,
” আশাতো করছি। কিন্তু এদের দুজনেরও নিজে থেকে এগোতে হবে। নইলে প্রবলেম হয়ে যাবে।”
” হুম! রাখছি তাহলে এখন।”
” বাই।”
তুর্বীও নিচু কন্ঠে বলল,
” বাই।”
ফোনটা কেটে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে সৌহার্দ্য রুমে ঢুকলো। বিহান বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। এই ছেলেকে ভালোভাবে ডাকলে দুই ঘন্টার মধ্যেও তোলা যাবেনা। ও সেটা জানে। অনেক স্বভাব বদলে ফেললেও এই স্বভাব যে বদলাতে পারেনি, সেটা ওর ঘুমের ধরণ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তাই সেই বৃথা চেষ্টা না করে টি-টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে সোজা বিহানের মুখে ঢেলে দিল। বিহান হুড়মুড় করে উঠে বসল। চোখ মুখ ঝামটা দিয়ে জল ঝেড়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করল যে কী হয়েছে। সামনে তাকিয়ে দেখল সৌহার্দ্য গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিহান হতাশ গলায় বলল,
” ব্রো! দিস ইজ নট ডান হ্যাঁ? আগেও এমন করতি।”
সৌহার্দ্য গ্লাসটা রাখতে রাখতে বলল,
” ক’টা বাজে দেখেছিস? উঠে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নে। ব্রেকফাস্ট করে বেড়িয়ে পরব আমরা।”
” তাই বলে এভাবে মুখে পানি মারবি?”
” ভালোভাবে ডাকলে তুমি কত উঠতে, সেটা তুমিও জানো। এখন যা দ্রুত ফ্রেশ হ।”
বিহান আর কিছু না বলে মুখ ফুলিয়ে চলে গেল ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে। সৌহার্দ্য বিহানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে দিল।
___________
বিকেলবেলা তুর্বী সবার জন্যে কফি বানিয়েছে। নিজের হাতে সবাইকে দিয়েছেও। কফিতে চুমুক দিয়ে আবার অবাক হয়েছে রিখিয়া। তুর্বীর কফি মুখে দেওয়া ভীষণ কষ্টের ছিল। অথচ এখন কত চমৎকার কফি বানায়! শাফিনও এসছে আজ রিখিয়াদের বাড়িতে। বসার ঘড়টাকে সবাই একসাথে বসে গল্প করছে। শাফিনকে বেশ ভালোভাবে লক্ষ্য করেছে তুর্বী। বিহান নামক কোন ব্যাক্তির অস্তিত্ব যদি না থাকত তাহলে ও চাইত রিখিয়ার সাথে শাফিনেরই বিয়ে হোক। এতোটাই ভালোলেগেছে ওর শাফিনকে। কথায় কথায় শাফিন তুর্বীকে বলল,
” তোমার কথা অনেক বলত রিখিয়া। দেখার অনেক ইচ্ছে ছিল। আজ দেখে নিলাম। তা হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেছিলে?”
তুর্বী হেসে বলল,
” বান্দরবান ছিলাম।”
এভাবে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিলো ওরা। আড্ডার মধ্যেই তুর্বী রেজাউল ইসলামের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আঙ্কেল! কাল আমি একটু রিখিয়াকে নিয়ে ঢাকা যাই? আসলে আমাদের পুরোনো কিছু ফ্রেন্ডদের সাথে দেখা করতাম। কিছু শপিংও করার ছিল।”
রেজাউল ইসলাম বলল,
” হ্যাঁ যাও। রিখিয়াও অনেকদিন হল কোথাও যায় না। যাও ঘুরে এসো গিয়ে।”
জাহানারা বললেন,
” একেবারে বিয়ের কেনাকাটার সময় গেলে হয়না?”
” তখনতো যাবোই। কিন্তু কাল যাওয়াটা ইম্পর্টেন্ট। একটা দিনই তো কিছু হবেনা।”
অনেক কষ্টে সবাইকে ম্যানেজ করে নিল তুর্বী। শাফিন যেতে চেয়েছিল ওদের সাথে কিন্তু তুর্বী বলেছে প্রয়োজন নেই। ওরা একটু আলাদা ঘুরতে চায়। শাফিনও জোর করেনি। ভাবল দুই বান্ধবী যাচ্ছে যাক। রিখিয়াও শুরুতে যেতে রাজি ছিলোনা। কদিন পরতো শপিং যাওয়াই লাগবে এখন আবার কেন? তবে তুর্বী অনেক বুঝিয়ে রাজি করিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে টেনশন হচ্ছে খুব। কাল কী করবে এরা কে জানে?
#চলবে…
#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৪৪
.
দুপুর বারোটা বাজে। সূর্য মাথার ওপর চড়ে আছে। প্রচন্ড গরম পরেছে। তীব্র রোদে সবার নাজেহাল অবস্থা। পার্কের সরু রাস্তা দিয়ে হাটছে সৌহার্দ্য, বিহান আর দোলা। দোলাকে আনার কোন পরিকল্পনা ছিলোনা। কিন্তু সৌহার্দ্য বেড় হওয়ার সময় ওর মা বলল যেখানে যাচ্ছে দোলাকে নিয়ে যেতে। সৌহার্দ্য একটু বিরক্ত হলেও না করেনি। কারণ ও তো জানে দোলার সাথে ওর কোন সম্পর্ক হবেনা। আর সেটা দোলাও জানে। তাই এতো চিন্তার প্রয়োজন নেই। সৌহার্দ্য বারবার ঘড়ি দেখছে আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। বিহান একটু বিরক্তি নিয়ে বলল,
” তুই হঠাৎ আমাদের এই পার্কে কেন নিয়ে এলি বলবি? কিছু করছিসও না, বলছিসও না। শুধু হেটে যাচ্ছিস। এখানে কেন এলাম সেটাতো বল ইয়ার?”
দোলারও একরাশ অস্বস্তি নিয়ে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,
” এক্সাক্টলি। এখানে আমরা কেন এলাম সেটাই এখনও বললেন না। এই গরমের মধ্যে কড়া রোদে হাটছি।”
কিন্তু সৌহার্দ্য কোন প্রশ্নেরই উত্তর না দিয়ে চারপাশে শুধু চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে। বিহান আর দোলাও বিরক্ত হয়ে আর কিছুই জিজ্ঞেস করল না।
এদিকে সিনএনজি থেকে নেমে তুর্বী দ্রুত ভারাটা দিয়ে রিখিয়ার হাত ধরে পার্কের ভেতরে হাটা দিল। রিখিয়া বলল,
” তুর তুমি চেঞ্জ নাওনি ড্রাইভারের থেকে।”
তুর্বী হাটতে হাটতে হাফানো কন্ঠে বলল,
” আরে বাদ দে তো।”
” কী হয়েছে তোমার বলবে? কত করে বললাম এই গরমে বেড় হতে হবেনা। কিন্তু তুমি এলেই। সেই ভোরবেলা বেড় হতে হল তোমার জন্যে। আর এটা কোথাও নিয়ে এলে বলবে?”
তুর্বী বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে পেছন ঘুরে রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
” তুই না একটুও বদলাস নি ট্রাস্ট মি! একটু ধৈর্য্য ধর!”
বলে হাটা শুরু করল। রিখিয়াও আর উপায় না পেয়ে হতাশ নিশ্বাস ত্যাগ করে তুর্বীর সাথে হাটতে শুরু করল। হঠাৎ করেই তুর্বী থেকে গেল। হেসে দিয়ে বলল,
” ঐতো!”
তুর্বী কথা শুনে রিখিয়া তুর্বীর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে সৌহার্দ্যকে দেখে অবাক হল। একটু হেসে তুর্বীকে কিছু বলবে তার আগেই সৌহার্দ্যর পেছনে তাকিয়ে ওর হাসি মিলিয়ে গেল। ওর পেছনে বিহান আর দোলা আছে। দুজনেই হেসে হেসে কথা বলছে। দোলাকে চেনেনা রিখিয়া। বিহানকে দেখে থমকে গেলেও তার সাথে ওর মন খচখচ করছে যে বিহানের সাথে মেয়েটা কে? রিখিয়া কাঁপাকাঁপা গলায় বলল,
” তুমি ওদের সাথে দেখা করতে এসছো?”
তুর্বী কিছু বলল না। রিখিয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল। সৌহার্দ্যর দৃষ্টি ইতিমধ্যে ওদের ওপর পরে গেছে। সৌহার্দ্য হেসে হাত নাড়িয়ে ওদের এদিকে আসতে বলল। সৌহার্দ্যকে হাত নাড়তে দেখে তুর্বী আবার রিখিয়ার হাত ধরে সৌহার্দ্যদের দিকে এগিয়ে গেল। বিহান এখনও তাকায়নি। ও দোলার সাথে কথা বলছে। তুর্বী এসে বলল,
” হাই!”
তুর্বীর আওয়াজ শুনে বিহান তাকাল। তুর্বীকে এখানে দেখে বেশ অবাক হল ও। কিন্তু ওর পাশে রিখিয়াকে দেখে প্রায় জমে গেল। রিখিয়াও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিহানের দিকে। দুজনের দৃষ্টি দুজনের ওপর স্হির হয়ে আছে। আজ দুই বছর পর আবার এভাবে একে ওপরের মুখোমুখি হবে সেটা ভাবতে পারেনি। একজন ভালোবেসে দূরে গেছে আরেকজন দূরে গিয়ে ভালোবেসেছে। কিন্তু ভালোবাসাটাতো সত্যি! বুকের ভেতরে তোলপাড় হয়ে গেলেও রিখিয়া মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল। কারণ এই দুই বছরে বিহানের প্রতি নিজের অনুভূতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে গেছে ও। শক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু বিহান পারছেনা। ওর ইচ্ছা করছে একটাবার রিখিয়াকে গিয়েছে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু সেই অধিকার কী ওর আছে? বিহান দ্রুত চোখ এদিকে ওদিক নাড়িয়ে আসতে চাওয়া অশ্রুকে আটকে ফেলল। পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঘনঘন ঢোক গিলে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছে। সৌহার্দ্য রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
” কেমন আছো রিখিয়া?”
” ভালো,.আপনি?”
” এইতো!”
তুর্বী হাসি মুখে এলেও দোলাকে দেখে ওর বেশ রাগ হয়েছে। ওর মনে সাথেসাথেই একটা প্রশ্ন এসছে, ‘এখানেও নিজের হবু বউকে নিয়ে আসতে হবে?’ কিন্তু পরে নিজেই নিজের ভাবনায় বিরক্ত হচ্ছে। ও তো এরকম ছিলোনা এরকম হিংসুটে অনুভূতি কেন হচ্ছে ওর মধ্যে? দোলা সৌহার্দ্যকে বলল,
” ওও এদের জন্যেই এখানে ওয়েট করছিলেন? আগে বলবেন তো! কে হয় আপনার?”
” আমার পরিচিত, পুরোনো বন্ধু।”
তুর্বী দাঁতে দাঁত চেপে তাকাল সৌহার্দ্যর দিকে। বিয়ে টেকানোর কী শখ! এক্স গার্লফ্রেন্ডকে বন্ধু বলে পরিচয় দিচ্ছে। বাহ! বিহান আর রিখিয়া কিছুই বলছে না। শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, মাঝেমাঝে একে ওপরের দিকে তাকাচ্ছে। সৌহার্দ্য বলল,
” এই রোদের মধ্যে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবেনা। চল দেখি কোথাও বসা যায় কি-না।”
ওরা পাঁচজন মিলেই হাটতে শুরু করল। বিহান আর রিখিয়া দুজনেই যথেষ্ট দূরত্ব রেখে হাটছে। দুজনেই চুপচাপ আর অন্যমনষ্ক। এদিকে দোলা বেশ চঞ্চল আর মিশুক মেয়ে হওয়াতে কথা বলেই যাচ্ছে। যেহেতু সৌহার্দ্যকেই ও ভালোভাবে চেনে তাই ওর সাথেই কথা বলছে। তুর্বী বারবার কপাল কুচকে তাকাচ্ছে ওদের দিকে। একপর্যায়ে ওর এসব একটু বেশিই ইরিটেটিং লাগল। তাই সৌহার্দ্যর কাছে গিয়েছে দাঁতে দাঁত চেপে আস্তে করে বলল,
” সৌহার্দ্য! হবু বউয়ের সাথে প্রেমালামটা পরেও করতে পারবে। আপাতত যেটা করতে এসছি সেটা করি? সময় নেই।”
সৌহার্দ্য একটু অবাক হয়ে তাকাল তুর্বীর দিকে এরপর নিজেকে সামলে নিয়ে একটু গলা ঝেড়ে বলল,
” ঐতো বেঞ্চ পাওয়া গেছে। চলো আমরা একটু বেঞ্চে গিয়ে বেশি, বেশ গরম এখানে।”
সৌহার্দ্য দোলার হাত ধরে একটু আগে আগে গিয়ে ছোট বেঞ্চটায় বসে পরল। যেখানে দুজনই বসা যাবে। তুর্বী বুঝতে পেরেছে যে সৌহার্দ্য এটা কেন করেছে। তবুও ওর ভালোলাগেনি ব্যাপারটা। ও হনহনে পায়ে গিয়ে বড় বেঞ্চটার এই সাইডে বসে পরল। রিখিয়া তুর্বীর পাশে বসল আর বিহান রিখিয়ার পাশে। ওরা দুজন একদম চুপ হয়ে গেছে। দেখা হওয়ার পর থেকে এখনও কেউই মুখ দিয়ে কোন শব্দ উচ্চারণ করেনি। সৌহার্দ্য ওদের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও বলল,
” কী ব্যাপার বিহান, রিখিয়া? তোরা দুজনে এভাবে চুপ হয়ে গেলি কেন? এভাবে হুট করেই সবার দেখা হওয়াতে অবাক হয়েছ দুজন তাইতো?”
রিখিয়া আর বিহান দুজনেই অবাক হয়ে তাকাল সৌহার্দ্যর দিকে। সৌহার্দ্যতো জানে ওদের অতীত। তাহলে এতো নরমালি কথা বলছে কীকরে? যেন কিছুই হয়নি। সৌহার্দ্য বলল,
” দেখো! আমরা জানি আমাদের অতীতের কিছু তিক্ততা আছে। আর তারজন্যেই আমরা চারজন এই দু-বছর আলাদা আলাদা ছিলাম। কিন্তু এটাতো সত্যি একসময় আমরা চারজন খুব ভালো বন্ধুও ছিলাম? তাহলে কবে কী হয়েছিল তার ওপর ডিপেন্ড করে আমাদের বন্ধুত্বটা নষ্ট করার কী দরকার?”
তুর্বী একটু সোজা হয়ে বসে বলল,
” এক্সাক্টলি! আর এইজন্যই আমি আর সৌহার্দ্য মিলে ঠিক করেছি আমরা দেখা করে এটলিস্ট আমাদের মধ্যে যে তিক্ততা তৈরী হয়েছিল সেটুকু অন্তত মিটিয়ে নেব। তোমাদের আগে থেকে বললে হয়ত আসতেনা। তাই এভাবে___”
রিখিয়া এবার বুঝতে পারল যে কেন তুর্বী ওকে নিয়ে এসছে এখানে, আর বিহানও। ওরা ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে ফেলল। সবকিছুর মধ্যে একটা কথা ঠিক সত্যিই ভেতরকার তিক্ততাগুলো মিটিয়ে নেওয়া উচিত। ভবিষ্যতে আর দেখা বা কথা না হলেও মনে সংশয় আর থাকবেনা। দোলা ওদের কথার কিছুই বুঝছে না। কারণ ও কিছুই জানেনা। কিন্তু বেশ ভালো লাগছে ওর কথাগুলো শুনতে। রিখিয়া আর বিহানও এবার একটু নরমাল হল। একে ওপরের সাথে কথা না বললেও সৌহার্দ্য তুর্বী আর দোলার সাথে কথাবার্তা বলছে। বেশ অনেকক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর পরিবেশটা স্বাভাবিক হল। গুমোট ভাবটা কেটে গেল সবার মধ্যে থেকে। হঠাৎ সৌহার্দ্য বলল,
” দোলা? তোমার একটা পার্স কেনার ছিল রাইট? পার্কের বাইরের মলটা থেকেই কিনে আনছি চল। পরে সময় পাবোনা।”
সৌহার্দ্যর কথা কিছুই বুঝতে পারল না দোলা। ও কখন পার্স কিনবে বলল? ও কিছু বলবে তার আগেই সৌহার্দ্য বলল,
” আরে একটার বেশি বেজে গেছে। লাঞ্চ করতে হবে পরে আবার চল।”
কথাটা বলে সৌহার্দ্য দোলাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। তুর্বী দাঁতে দাঁত চেপে সেদিকে তাকিয়ে রইল। যদিও এটা প্লানের অংশ। কিন্তু ওদের দুজনকে একসাথে দেখে এতো রাগ হয় কেন ওর? হঠাৎ কিছু মনে পরতেই ও উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” রিখু, তোরা বস। আমি এক্ষুনি আসছি। জাস্ট পাঁচ মিনিট।”
রিখিয়া অবাক হয়ে বলল,
” এখন কোথায় যাবে? চল আমিও যাব।”
” আরে তার দরকার নেই। বিহান একা থাকবে নাকি। বস তুই, আমি পাঁচ মিনিটে আসছি।”
বলে তুর্বী দ্রুত বেড়িয়ে গেল। ওখানে কেবল রিখিয়া আর বিহান রইল। এতক্ষণ নরমার থাকলেও এখন দুজনের মধ্যেই তীব্র অস্বস্তি কাজ করছে। ওরা কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছেনা। কিন্তু দুজনেই দুজনকে ফিল করছে। ভালোবাসা আজ দুজনের মধ্যেই আছে। অদ্ভুতভাবে দুজনের্ অনুভূতিটাই আজ গোপন। দুজনেই ভাবছে যে আর সেই অনুভূতি প্রকাশের অধিকার তার নেই। আবার দুজনের মনই বলছে নিজেদের মনের অনুভূতিক্য চিৎকার করে প্রকাশ করতে। এই দীর্ঘ দু-বছরের দুজনেই অনেক কথা জমিয়েছে মনের মধ্যে। একজনের মনে অভিমান আর অভিযোগ। আরেকজনের মনে অনুতাপ আর ভালোবাসা। কিক এতো কথা থাকার পরেও দুজনেই আজ নিশ্চুপ, স্তব্ধ। হঠাৎ করেই বিহান কম্পিত কন্ঠে বলে উঠল,
” রিখিয়া?”
রিখিয়া কেঁপে উঠল। সাথেসাথে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ও জানে চোখ খুলে রাখলেই কেঁদে ফেলবে ও। বিহান সেটা দেখে একটু হাসল। দু-বছর হয়ে গেছে। তবুও কেন এখনও এতো ভালোবাসে মেয়েটা ওকে? ভালোবাসার কোন কারণই দিতে পারেনি ও রিখিয়াকে। দিয়েছে শুধু একবুক কষ্ট, ঘৃণা করার বিশাল কারণ। তবুও এতোটা ভালোবাসা কেন? ও কী এই ভালোবাসার যোগ্য?
#চলবে…