#তার_শহরের_মায়া 😍
#পার্ট_১৭
#Writer_Liza_moni
হলুদের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সবাই। তানিশাকে শাড়িয়ে পরিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে।অনু মুখটাকে মলিন করে তানিশার পাশে বসে আছে ওর রুমে। তানিশা কেমন উসখুশ করছে।
অনু ভাঙ্গা কন্ঠে বললো
এই পিচ্চি তুই বিয়েতে রাজি হয়েছিস কেন? আমি ও দিন ফুফু মনি কে কত করে বুঝিয়েছি তিনি তো আমার কথা শুনলোই না।
আমি তো বিয়ে করতে চাইনি অনু আপি।
মা জোর করছে। সাথে বাবা ভাইয়া ও।তিশা আপু ও নাকি বিয়েতে রাজি।
কী যে পাইছে ঐ তূর্যর মাঝে।এত পাগল হয়ে গেছে কেন সবাই বিয়ে দিয়ে দেওয়ার জন্য। নিশ্চয় তাবিজ করছে।
কী বলো আপি।যার সাথে বিয়ে তাকে দেখি ও নাই।আর কথা ও হয়নি।সে আমাকে দেখছে নাকি তাও জানি না।
এইটা কেমন কথা? তোর তো তূর্যর সাথে দেখা করা উচিত ছিল। জানিস উনি তোর থেকে নয় বছরের বড়।
এ্যাঁ এই বুড়ারে আমি বিয়ে করমু না অনু আপি।
এখন আর কিছু করার নেই।
.
অনু তানিশা কে নিয়ে আয় ছাদে। হলুদের পর্ব শেষ করতে হবে তো নাকি।কত বেলা হয়েছে খেয়াল আছে।
আনতেছি বড় ফুফু।
এই উঠ। তোর বান্ধবীরা আসে নাই?
ওরা আসবে একটু পর।
অনু তানিশা কে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে আসার পর ৭,৮ মেয়ে এসে তানিশা কে ঘিরে ধরলো।
ওদের কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে ওরা তানিশার ফ্রেন্ড।অনু তানিশা কে ওদের হাতে ছেড়ে দিয়ে বাগানের দিকে চলে গেল।
এই সব বিয়ে, নতুন জীবন, নতুন মানুষ, এখন আর ভাল্লাগে না ওর। বিয়ে নিয়ে আর পাঁচটা মানুষের মতো ওর ও স্বপ্ন ছিল। কিন্তু তা খুব কঠিন ভাবেই ভেঙ্গে দিছে।
জীবনে সত্যি ভুল মানুষ আসা দরকার। আঘাত পাওয়া দরকার। চেনা মানুষ কে অচেনা দেখা দরকার।স্বপ্ন ভাঙ্গা দরকার। কষ্ট পাওয়া দরকার।
তাহলে ঘুরে দাঁড়ানোর সময় মানুষ যতই আঘাত করুক না কেন তখন আর কষ্ট হয় না। তখন মানুষ নিজেই বুঝতে পারে এতো কষ্ট পেতে পেতে পাথর হয়ে গেছে এরে আর আঘাত করে কোনো লাভ হবে না।সে সব মানিয়ে নিতে পারে।
আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। প্রথমে মানতে কষ্ট হলেও পরে মনে হয় আসলেই তিনি ঠিক কাজটাই করেছেন।
বাগানের ফুল গুলো কে ছুঁয়ে দিতে দিতে এই সব কথা ভাবছে অনু। আনমনে হাঁটার সময় কারো সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যায়।
উফফ। একটু দেখে চলবেন না।হাত ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়ালো অনু। সামনের মানুষটাকে দেখে অনুর চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।
আরে তুমি এখানে কি করো?
ছেলেটা যে অনু কে দেখে ঘাবড়ে গেছে চোখ মুখ দেখে তা খুব ভালো করেই বোঝা যাচ্ছে ।
অনু সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার ও বললো তুমি নাকি এখানে ঘুরতে এসেছো তাহলে এই বাড়িতে কী করছো?
সিয়াম ঢোক গিলে বললো আসলে আপু আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি।
অনু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো সিয়ামের মুখের দিকে।
আসো আমার সাথে।
অনু সিয়াম কে বাড়ির গেটের সামনে এনে হাত দিয়ে রাস্তার দিকে ইশারা করে বললো এই যে মেইন রোড।চলে যাও। বাড়ির বড়রা দেখলে অন্য কিছু ভেবে তোমাকে কেলানি দিবে।তার আগেই চলে যাও।
অনু আর সিয়াম কে ছাদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে থেকে দেখছিলো তানিশা।ভয়ে চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে।
.
তূর্য কে সবাই হলুদ লাগিয়ে ভূত বানিয়ে ফেলেছে পুরো। বেচারা কিছু বলতে ও পারছে না।
খালি আমি একটু ছাড় পাই তখন তোদের অবস্থা খুব খারাপ হবে দেখে নিস।
আচ্ছা দেখবো কী এমন করতে পারিস হু।
.
কী রে অনু তানিশা কে হলুদ ছোঁয়াবি না?
আসছি আম্মু।
অনু গেটের দরজা বন্ধ করে ছাদের দিকে এগিয়ে গেল।
তানিশা মুখ মলিন করে বসে আছে।সবাই ওকে হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছে।
অনু ও তানিশা কে হলুদ লাগিয়ে দেয়। তানিশার চোখে পানি চিকচিক করছে।আর কেউ বুঝুক আর না বুঝুক অনু বুঝতে পারছে তানিশা ও তার প্রিয় মানুষটা কে হারানোর ভয় পাচ্ছে।
অনু মুখে কিছু বললো না। হলুদ লাগিয়ে উঠে চলে এলো।এই সব বিয়ে মানেই চিরকালের জন্য ভালোবাসার মানুষটিকে হারানো।কেউ বিয়ের পর ভালোবাসে।কেউ বা বিয়ের আগেই আমার মতো ভুল মানুষকে ভালোবেসে দুমড়ে মুচড়ে মরে।
.
সকালে বিয়ের আয়োজন করা হয়। পুরো বাড়িতে মানুষে গিজগিজ করছে। চিল্লাচিল্লি শুনতে ভাল্লাগে না অনুর। পার্লারের মেয়েরা আসছে তানিশাকে সাজানোর জন্য।
অনু তাদের নিয়ে তানিশার রুমে গিয়ে দেখে পুরো রুম ফাঁকা। তানিশা কোথাও নেই।অনু ভ্রু কুঁচকে ওয়াস রুমের দরজা মেলে দেখে সেখানে ও কেউ নেই।
বেলকনিতে গিয়ে দেখে ওখানে ও কেউ নেই।
অনু দৌড়ে বাহিরে এসে মা আর ফুফু কে খুঁজে বের করে বললো
তানিশা কে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
সেকি। মেয়েটা কোথায় গেল?আয় হায় হায়।
মাথায় হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো তানিশার মা।
অনু সব জায়গায় খুঁজে দেখ।আছে কোথাও একটা।কৈ যাবে মেয়েটা?
অনু কিছু একটা ভেবে আবার ও তানিশার রুমে চলে গেল। রুমে এসে সব জায়গায় দেখলো তানিশা কোনো ক্লু রেখেছে কিনা।মন বলছে তানিশা পালিয়েছে।
হঠাৎ অনুর চোখ যায় টেবিলের উপরে রাখা একটা কালো রঙের ডায়রির উপর।
অনু এগিয়ে গিয়ে ডায়রিটা হাতে নিয়ে পাতা উল্টিয়ে দেখতে লাগলো।ডায়রির প্রথম পাতায় লিখা আছে
তিশা আপুর বাড়িতে গেলে তার এক দেবরের সাথে আমার দেখা হয়। তখন থেকেই ভালো লাগার সৃষ্টি।আর তা ভালোবাসায় রুপান্তরিত হয়। সিয়াম নামের ছেলেটা কে আমি ভীষণ ভালোবাসি। মাকে বলার পর ও মা রাজী হয়নি বলে আমি এই সিদ্ধান্ত
নিতে বাধ্য হয়েছি। আমাকে ক্ষমা করো।যাকে কোনো দিন দেখি ও নাই তাকে কী করে বিয়ে করি? আমি পারবো না আমার ভালোবাসা কে ছেড়ে থাকতে। কয়েক বছর পর দুই জন থেকে তিন জন হয়ে ফিরে আসবো তোমাদের কাছে।
ডায়রির ভেতর থেকে একটা ছবি পায় অনু।
ওহ আচ্ছা তাহলে এই ব্যাপার।মেয়েটাকে আমি আর ও পিচ্চি মনে করছি। এই মেয়ের পক্ষ নিয়ে ঐ দিন ফুফু মনি কে কত কথাই না বলছি।আর এই মেয়ে দেখি অনেক এগিয়ে আছে। কয়েক বছর পর দুই জন থেকে তিন জন হয়ে ফিরে আসবে।বাহ্ এত্ত ফাস্ট।
তবে তা করছে ভালোই করছে।প্রিয় মানুষটাকে তো আর হারাতে দিলো না।সব ভালোবাসা পূর্ণতা পাক।
বেচারা তূর্যর এখন কী হবে? বিয়ের দিন বউ পালিয়েছে।হায়।
.
অনু বাড়ির সবাই কে গিয়ে তানিশার ডায়রিটা দেখালো। তানিশার ভাই তিয়াশ তো পারছে না তানিশা কে খুন করতে।এত পরিমাণ রেগে আছে বলার মতো না।
ছি ছি ছি
মেয়েটা এতো বেয়াদব হয়ে গেছে। আমাদের মান সম্মানের কথা একটা বার ও চিন্তা করলো না।
শুনেন ফুপা
আপনারা যেমন ওর ভালোবাসার কথা ভাবেননি, এই বিয়েতে ওর মত আছে কিনা জানতে চাননি ঠিক তেমনি ও আপনাদের কথা ও চিন্তা করে নি। আপনাদের উচিত ছিল ওর কথা শোনার।ও আসলে কী চায় সেটা ভাবার।
তুই একটু বেশি জানিস অনু।
আই নো ফুফু মনি আমি একটু বেশি জানি।
চলে গেছে যখন, তখন আর ওর কথা ভেবে লাভ নেই। এখন ছেলে পক্ষ কে কি জবাব দিব সেটা বলো?
সবাই মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। তাদের মাথায় কিচ্ছু আসছে না।অনু দেওয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে আছে।পুরো রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে।
সবার কাছে তানিশা খারাপ হয়ে গেলে ও অনুর কাছে তানিশার করা কাজটাই বেস্ট মনে হচ্ছে।প্রিয় মানুষকে হারানোর মত ভয়াবহ কষ্টের কথা তার অজানা নয়।সে বুঝে প্রিয় মানুষটাকে অন্যের পাশে দেখতে কতটা কষ্ট হয়। হৃদয় ছিঁড়ে রক্ত চুয়ে চুয়ে পড়ার যন্ত্রনা সে বুঝে।
সবাই চুপ। কারো মুখে কোন কথা নেই। হঠাৎ করে তানিশার মা উঠে এসে অনুর হাত ধরে বললো
আমাদের এই অসম্মান থেকে বাঁচা মা।
তানিশার মায়ের কথায় সবাই অনু আর তার দিকে তাকালো।অনু ভ্রু কুঁচকে বললো মানে?
তুই ছাড়া আর কেউ আমাদের মান সম্মান বাঁচাতে পারবে না। এখানে তো শুধু আমাদের মান সম্মানের প্রশ্ন আসে না।তনু আর তোদের মান সম্মানের প্রশ্ন ও আসে।
আজ যদি বিয়েটা না হয় তাহলে তনুর শ্বশুর বাড়ির লোকজন নুন থেকে চুন খসলেই তনু কে কথা শুনাবে। তানিশার পালিয়ে যাবার বিষয়ে।
তোর তো বিয়ের বয়স হয়েছে মা। তুই আমাদের বাঁচিয়ে নে।
অনুর মা তাদের দিকে এগিয়ে যায়।অনু মায়ের দিকে অসহায় ভাবে তাকায়।অনুর মা অনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বললো
মারে তুই বিয়েটা করে নে। তূর্য খুব ভালো একটা ছেলে। তনুর কথা একবার ভাব। তুই বিয়েটা করে নে। তূর্যর মা তোর জন্যই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আমি মানা করে দিয়েছিলাম। আমি বলছি তুই বিয়েটা করে নে।
আরে আজব।বিয়ে কী ছেলে খেলা নাকি? তানিশা পালিয়েছে তাতে কী? তাদের বলে দাও যে বিয়ে হবে না।
ফুপা অনুর বাবা সবাই মিলে অনুকে বুঝতে লাগলো। মেহমানরা জানলে কি হবে? সমাজের মানুষ কী বলবে?মান সম্মান সব শেষ হয়ে যাবে। মাথা উঁচু করে আর চলা যাবে না। সমাজের মানুষ কথায় কথায় খোঁচা মেরে বলবে। তনুকে ও কথা শুনতে হবে। তুই দয়া কর মা।
অনু কিছু না বলে চুপ করে আছে।
অনুর বাবা বলে উঠলো
তোর কী কাউকে পছন্দ আছে মা?
অনু বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো না। আমি কাউকে পছন্দ করি না।
তাহলে তো এই বিয়ে করতে তোর সমস্যা হবার কথা নয়।
আমাকে একটু একা থাকতে দিবা?
আচ্ছা তুই ভেবে বল। একটু পরেই কিন্তু বর যাত্রী চলে আসবে।বলে বাবা সবাই কে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
অনু জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর একটা কথা তার মাথায় আসে।তা হলো মাহিরের শাস্তি। বিয়ে আজ না হয় কাল করতেই হবে। তূর্য ছাড়া মাহিরের আর কোনো ভাই নেই।যা আছে সব পিচ্চি।
মাহিরের সামনেই তার ফুফাতো ভাইয়ের সাথে সুখের সংসার গড়ার ইচ্ছে জাগলো অনুর মনে।অনু শয়তানি হেসে বাহিরে চলে গেল।
বাবা মায়ের কাছে গিয়ে মুখ টাকে গম্ভীর করে বললো আমি রাজী এই বিয়েতে।সবাই খুশিতে অনু কে জড়িয়ে ধরলো।
.
তানিশার জন্য কিনা বিয়ের শাড়ি চুড়ি দিয়ে অনুকে বউ সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। তানিশার রুমে বউ সেজে বসে আছে অনু। ভাগ্যে মে কখন কি লিখা থাকে তা একমাত্র আল্লাহই জানেন।
তূর্যরা চলে এসেছে।তনু মায়ের সাথে দেখা করে তানিশার সাথে দেখা করতে আসলে বউয়ের সাজে অনু কে দেখে থমকে যায়।
মায়ের উদ্দেশ্যে বলে
তানিশার সাথে তূর্যর বিয়ে না হয়ে অনুর সাথে হচ্ছে কেন?
মা তনু কে সব খুলে বললেন।সব শুনে তনু থ হয়ে গেছে।
অনুর পাশে গিয়ে বসে অনু কে দেখে বললো মাশাআল্লাহ আমার জা কে তো অনেক সুন্দর লাগছে।
তোর জা কে হ্যাঁ? এখন ও তোর বোন আছি।বোন বলবি বুঝছোস?
হাহা আচ্ছা বলবো।
কিছুক্ষণ পর কাজী সাহেব অনুর কাছে আসেন। বিয়ের সব কিছু বলে এখন বলছেন কবুল বলার জন্য।
অনুর কেমন জানি ভয় হচ্ছে। অনেক সময় নিয়ে অনু কবুল বলে ফেলে।
সবাই এক সাথে বলে উঠে আলহামদুলিল্লাহ।
তারপর রেজিস্ট্রেশন পেপারে সাইন করিয়ে তূর্যর কাছে গিয়ে বলে কবুল বলার জন্য।
তূর্য ও সময় নিয়ে কবুল বলে।কারন সে জানেই না কার সাথে তার বিয়ে হচ্ছে। রেজিস্ট্রেশন পেপারে সাইন করে তূর্য সারাজীবনের জন্য অনুর হয়ে গেল। নিজের অজান্তেই এক অদ্ভুত মায়ায় আটকে গেল তারা দুজন।পা দিলো নুতন এক জীবনে।
অনুর দুঃখের দিনের অবসান ঘটিয়ে এলো বুঝি অবশেষে।আর বেইমানদের কষ্টের দিন শুরু হবে।
চলবে,,,,, 🍁