তার শহরের মায়া পর্ব-২০

0
1232

#তার_শহরের_মায়া 😍
#পার্ট_২০
#Writer_Liza_moni

এখন প্রায় সন্ধ্যা হতে চললো। কিছুক্ষণ আগেই অনু, তূর্য, মাহির আর তনু এসে পৌঁছেছে তাদের বাবার বাড়িতে।বউ ভাতের ঝামেলা চুকে গেলে নতুন বর বউ কে তাদের বাড়িতে নিতে চায় অনুর বাবা। সাথে তনু কে ও। মেয়েটা যে কয়েক মাস আগে বাড়িতে গিয়েছিল আর যায়নি।তাই দুই মেয়ের জামাই সহ তাদের নিয়ে আসেন অনুর মা বাবা।

তূর্য অনুর রুমে এসে ফ্রেশ না হয়েই বিছানায় শুয়ে পড়লো।অনু ওয়াস রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো

শুনুন মিস্টার খাম্বা,
এই টা আমার রুম। আমার বিছানা।তাই ফ্রেশ না হয়ে আমার বিছানায় শোয়া যাবে না।

তূর্য চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল।অনুর কথায় এক চোখ মেলে বললো সিরিয়াসলি আমাকে খাম্বার মতো দেখতে লাগে?

লাগে বলেই তো খাম্বা বলে ডাকলাম।
মাত্র ৬ ফুট ১ ইঞ্চি আমি আর তুমি আমাকে এই ভাবে বলতেছো?

ঠিকই তো বললাম ।ভুল বলি নাই তো!
এখন উঠে ফ্রেশ হয়ে আসেন তারপর আপনার যত ইচ্ছা ততক্ষণ শুয়ে থাকেন। আমি কিচ্ছু বলবো না ।তার আগে আমার বিছানায় আপনার কোন জায়গা নাই।

তুর্য মুখটাকে ছোট বাচ্চাদের মত করে বিছানা থেকে উঠে বসলো। অনু ব্যাগ থেকে তূর্যর জন্য একটা টি শার্ট আর ট্রাউজার বের করে ওর হাতে দিল। পাঞ্জাবীটা বদলে ফেলেন।

তুর্য অনুর হাত থেকে টি শার্ট আর ট্রাউজারটা নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে গেল ফ্রেস হতে।

অনু বিছানায় বসে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। অনেক ক্লান্ত লাগছে তার। চারদিক থেকে আজানের ধনি ভেসে আসছে। মাগরিবের আজান দিচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর তুর্য ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হলে অনু তার উদ্দেশ্যে বললো
নতুন জামাই নামাজ না পড়লে কিন্তু হবে না নামাজ পড়তে যান।
আমি না আজ একটু বেশিই ক্লান্ত। নামাজ টা রুমে পড়ি এখন? মসজিদে কাল সকাল থেকে যাই?

আচ্ছা ঠিক আছে ।আমি তাহলে নামাজের ওযুটা করে আসি একসাথে পড়ে নিব।

হুম।
অনু ওযু করে বের হলে তূর্য আবার ও গেল ওয়াস রুমে। নামাজের ওযু করতে।অনুর রুমে শুধু মাত্র একটা জায়নামাজ আছে।তাই অনু মায়ের কাছে চলে গেল আরেকটা জায়নামাজ আনার জন্য।

মায়ের কাছ থেকে জায়নামাজ নিয়ে আসার সময় মাহিরে সাথে চোখাচোখি হয় অনুর। তনু কে ডাকার জন্য বের হয়েছিল।
অনু মাহির কে দেখে বিড় বিড় করে বললো
নামাজের ওযু করার পর শয়তান কে দেখলে নামাজ হবে তো?

অনু রুমে এসে দেখে তূর্য নামাজে দাঁড়িয়ে গেছে।অনু তূর্য থেকে কিছুটা পেছনে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল।

নামাজ পড়ার পর অনু জায়নামাজ গুলো গুছিয়ে ওয়ারড্রব এর উপরে রাখলো।ড্রইং রুম থেকে কথার আওয়াজ পেয়ে অনু সেদিকে চলে গেল।

মাহির বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফেসবুক স্ক্রল করছে। এমন সময় what’s up এ একটা মেসেজ আসে।তুর্য মেসেজটা সীন করে দেখে মাহির টেক্সট দিয়েছে।

তূর্য বাহিরে যাবি ঘুরে আসি চল বাড়িতে কেমন বোরিং লাগতেছে। তূর্য যাবে বলে জানিয়ে দিল।

তূর্য রুম থেকে বের হয়ে ড্রইং রুমের দরজার সামনে দাঁড়ায়। কিছু বয়স্ক মহিলা বসে আছেন।অনু আর তনু তাদের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে।

তূর্য কে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন বলে উঠলো
এই তো আমার ছোট নাতনির জামাই। এদিকে আসো দাদু ভাই।

তূর্য মুচকি হেসে সবাই কে সালাম দিলো। তার পর গিয়ে মহিলার পাশে বসলো।

বয়স্ক মহিলাটি তূর্যর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন মাশাল্লাহ অনুর জামাই টা তো অনেক সুন্দর। তোদের দুজনকে খুব মানিয়েছে বোন ।সারা জীবন একসাথে থাকিস এই দোয়াই করি।

মাহির সে সময় ড্রইং রুমে আসে।সবাই কে সালাম দিয়ে তনুর পাশে গিয়ে বসলো।

আমার দুই নাতনির জামাই গুলো দেখতে মাশাআল্লাহ।সুখে থাক তোরা সারা জীবন। তূর্যর পাশে অনু কে বসিয়ে দিল অনুর কাকি।

মাহির তূর্য আর অনুর দিকেই তাকিয়ে আছে। তূর্য অনুর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললো একটু বাহিরে যেতাম।

আমি কী করবো?

বুঝেন না? একটু এখান থেকে উঠার ব্যবস্থা করে দিন।

দাদু তোমাদের জামাই বাবুরা একটু বাহিরে যাবেন। এখন ওদের কে ছাড় দাও।

যাও নাত জামাই। ঘুরে আসো। তূর্য আর মাহির উঠে চলে গেল।

তূর্য বের হওয়ার কিছুক্ষণ পর পর অনু ওকে কল দিচ্ছে। ইচ্ছে করেই এমন করছে অনু।যেন মাহির জ্বলে। মাহির যেন বুঝতে পারে তার দেওয়া আঘাতে সে ভেঙ্গে পড়েনি।বরং তূর্য কে পেয়ে সে অনেক হ্যাপি।

অনু তূর্যকে কল দেওয়ার পর তুর্য ফোন রিসিভ করে বলে আমাকে ছাড়া কি ঘুম আসছে না এতবার কল দিচ্ছ কেন?

শুনেন আপনাকে কল দেওয়ার জন্য আমার বয়েই গেছে। বলছিলাম কি আমার খুব ফুচকা খেতে ইচ্ছা করছে ।আসার সময় আমার জন্য বোম্বাই মরিচের ফুচকা গুলো নিয়ে আসবেন। যদি না আনছেন তাহলে আপনার একদিন কি আমার একদিন দেখে নিয়েন।

ছোটখাটো একটা ধমক দিলা তাই না ?আমি বাসায় আসি তোমার এই ধমকের প্রতিশোধ আমি নিবো শুধু দেখো কি করি।

যা বলছি তাই করেন এত কথা বলিয়েন না তো।
বলেই অনু কল কেটে দিল।

পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই অনু আবার ও তূর্য কে কল দিলো। তূর্য তখন মাহিরের সাথে টং এর দোকানে বসে চা খাচ্ছিল আর কিছু কথা বলছিল।তূর্যর ফোন বেজে ওঠে তুর্য ফোনের স্ক্রিনে অনুর নাম্বার দেখে মনে মনে খুব হাসল ।মেয়েটা যে তাকে এতবার কেন কল দিচ্ছে সেটা আর কেউ বুঝুক আর না বুঝুক তুর্য ঠিকি বুঝতে পারছে।

তূর্য কল রিসিভ করে বললো কি ম্যাডাম আজকে আমার কথা এত মনে পড়ছে কেন?

এই শুনেন আপনার কথা মনে পরার কোন কারণ আছে? আমার দরকার পড়ছে তার জন্য আমি আপনাকে কল দিছি। এত কথা শোনান কেন হ্যাঁ? তখন একটা কথা বলতে ভুলে গেছিলাম ।আমার জন্য আসার সময় আইসক্রিম নিয়ে আসবেন। ঝাল খেলে আবার পরে আমার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যাবে ।তখন আমি আইস্ক্রিম কই থেকে পাবো?তাই একসাথে আসার সময় নিয়ে আসবেন।
মনে থাকবে তো? ভুলে গেলে কিন্তু আজকে বাড়িতে জায়গা দেবো না।

তুর্য মুচকি হেসে বলল হ্যাঁ গো মেঘুপাখি,অবশ্যই মনে থাকবে ।তুমি বলছো মনে না থেকে কী পারে?
মাহির চুপ করে তূর্যর কথা শুনছে।চা খাচ্ছে না।অনু কল কেটে দিল।

কীরে ভাই চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো খা?

মাহির তূর্যর কথায় হকচকিয়ে গেল। তার পর চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রেখে বললো খাবো না। ইচ্ছে করছে না।

তূর্য মনে মনে খুব হাসলো।অনুর কথায় আর মাহিরের মুখের ভঙ্গিমা দেখে।চা শেষ করে উঠে বললো মেঘুপাখির জন্য ফুচকা আর চকলেট নিয়ে যেতে হবে।

মাহির ভ্রু কুঁচকে বললো
মেঘুপাখিটা আবার কে?

আমার একটা মাত্র আদরের বউ।অনুমেঘা।তাই আমি ওকে মেঘুপাখি বলেই ডাকি।

ওহ।

তূর্যর ডাকা মেঘুপাখি নামটা শুনে অনুর বুকের মাঝে ধক করে উঠল।অনু হঠাৎ করে চুপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ নিজের মনেই বিড় বিড় করলো নামটা।মেঘুপাখি,,,

নামটা অনুর মন ছুঁয়ে গেল।
.
.
তূর্য সবার জন্য ফুচকা আর আইস্ক্রিম কিনে নিয়ে আসলো। মাহির তনুর জন্য একটা চকলেট কিনে আনলো।

অনু কে ড্রইং রুমের সোফায় বসে থাকতে দেখে তূর্য মুচকি হেসে অনুর হাতে ফুচকা আর আইস্ক্রিম ধরিয়ে দিয়ে কানে কানে বললো এতো বার করে বলেছে আমার বউটা আমি না এনে পারি?

অনু কিছু বললো না। রান্না ঘরে গিয়ে প্লেটে সব গুলো ফুচকা সাজিয়ে নিয়ে আবার ড্রইং রুমে আসলো। বড়রা যেহেতু এত ঝাল খেতে পারবে না তাই অনুর মা তাদের জন্য চা বানিয়ে আনলেন।

অনু ঝাল ঝাল ফুচকা খেয়ে এখন হা হু করছে। তূর্য অনুর হাতে আইস্ক্রিম ধরিয়ে দিয়ে বললো আর একটু ঝাল দিবো ফুচকায়?

অসভ্য লোক।অনুর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে।অনু রুমে চলে গেল।ওয়াস রুমে গিয়ে বমি করে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
তূর্য অনুর পাশে এসে বসে অনুর হাত ধরে বললো

বেশি খারাপ লাগছে?ডাক্তার আনবো?

আরে না। আমি একটু বেশিই ঝাল খেয়ে ফেলেছি।
মাহিরের দিকে তাকিয়ে অনু ফুচকায় ঝাল বেশি দিয়ে ফুচকা টাকে মাহির ভেবে ইচ্ছে মতো চিবিয়ে খেয়েছিল। শয়তান কে খাইলে কি আর হজম হবে? এই জন্যই অনু বমি করেছে।
.
.
সবাই ঘুমিয়ে আছে।অনুর ঘুম আসছে না। বিছানা থেকে উঠে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। বাহিরে সবাইকে সে যতটা হাসি খুশি হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করে ভেতরে কিন্তু সে এতটা হাসি খুশি নেই। মাহির কে যতবার দেখে ততবারই তার অতীতের কথা মনে পড়ে যায়। তবুও নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করে সে।

তূর্য ও ঘুমায়নি।পাশ ফিরে অনু কে না পেয়ে উঠে বেলকনিতে যায়।অনু কে উদাসীন ভাবে বাহিরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো

ঘুমাও নি কেন?

অনু ভাবলেশহীন ভাবে তূর্যর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো যারা ঠকায়,যারা স্বার্থপর দিন শেষে তারাই ভালো থাকে তাই না?

কে বলেছে? সময়ের ব্যবধানে কোনো না কোনো সময় তারা তাদের কর্মের ফল ঠিক পায়।ভালো কাজের ফল ভালো আর খারাপ কাজের ফল খারাপ। মানুষ ক্ষমা করে দিলে ও প্রকৃতি কিন্তু তাদের ক্ষমা করে না।

আপনি জানেন আমার ভালোবাসার মানুষটি কে? গতকাল রাতে তো বলতে দেন নি।আজ শুনবেন তার কথা?মে মানুষটা আমাকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে সেই মানুষটির কথা। শুনবেন?

তূর্য মুচকি হেসে অনুর এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো
আমি জানি সে কে। তার সাথে তোমার কেমন সম্পর্ক ছিল।সে তোমাকে ঠকিয়েছে।সব কথাই আমি জানি।

অনু অবাক হলো। আপনি সত্যি জানেন?

হুম। মাহির তোমাকে ঠকিয়েছে বাজি ধরে।তার জন্য আমাকে তুমি বিশ্বাস করতে পারছো না।

অনু মলিন কন্ঠে বললো বার বার আঘাত পেতে চাই না। বিশ্বাস করতে এখন খুব ভয় করে। এখন কেউ বিশ্বাসের মূল্য দিতে পারে না।

কাচ যে ভাঙ্গে তার কোনো ক্ষতি হয় না।যে জোরা দিতে যায় সেই কাঁচের টুকরোতে হাত কেটে রক্ত খরন হয়।

অনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন কেন?

তুমি আমার লিগেল ওয়াইফ।তার উপর আমার ছোট।তাই তুমি করেই বলবো।

আমি চাকরি করতে চাই। নিজের একটা পরিচয় তৈরি করতে চাই।

তূর্য মুচকি হেসে বললো আমার বউ হয়েছো বলে কী আমি তোমার স্বপ্ন পূরণে বাধা দিবো?এমন হাসবেন্ড আমি না। অনেক রাত হয়েছে ঘুমাতে আসো। এতো দিন নিজের ইচ্ছায় অনেক রাত জাগছো। এখন থেকে তোমার আর রাত জাগা হবে না। ঘুমাতে আসো।

অনু তূর্যকে যত দেখছে তত অবাক হচ্ছে।

চলবে,,, 🍁