তার শহরের মায়া পর্ব-৪০ এবং শেষ পর্ব

0
1748

#তার_শহরের_মায়া 😍
#অন্তিম_পর্ব
#Writer_Liza_moni

বছর দুয়েক পর,,,
অফিসে নিজের কেবিনে বসে আছে অনু। মনোযোগ দিয়ে ফাইল দেখছে সে।আজ ইন্টার ভিউ আছে তাদের অফিসে।
কিছু কর্ম জিবি নিয়োগ দেওয়া হবে।

মে আই কাম ইন ম্যাম,,,

অনু না তাকিয়ে বললো ,,ইয়েস কাম ইন,,

লোকটা ভেতরে ঢুকে গেল।

কোনো সমস্যা ?
কথাটা বলে অনু চোখ তুলে তাকাতেই থমকে যায়।অনু কে দেখে লোকটি ও চমকে উঠে।

অনু তার দিকে তাকিয়ে বললো,,আরে শুভ্র যে,,তা এত দিন পর তাও আবার আমার অফিসে ?

তুই এখানে ?

অনু বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো এই অফিসের মেনেজার পদে আছি আমি।আর আপনি আমাকে তুই করে বলছেন কেন ?

সরি ম্যাম। আফজাল স্যার বলছে আমার এই কাগজ গুলো চেখে করে দেখার জন্য।

অনু শুভ্রর হাত থেকে ফাইলটা নিয়ে বললো আমি যত দূর জানি আপনার অর্নাসের রেজাল্ট ভালো আসেনি।তাই আর চেক করলাম না। আপনি এই চাকরি পাচ্ছেন না শুভ্র।

অনু প্লিজ এমন করিস না আমার চাকরি টা খুব দরকার।

Shut up ,,, আপনাকে আমি চিনি না। তুই করে বলছেন কেন আপনি?মিনি মাম কমন সেন্সটুকু নেই?

শুভ্র মাথা নিচু করে বললো,,সরি ম্যাম। ভুল হয়ে গেছে। আমাকে প্লিজ চাকরিটা পাইয়ে দেন,, আমার খুব প্রয়োজন একটা চাকরির।

দুঃখিত আপনার সার্টিফিকেট দেখে মনে হয় না আপনি আমাদের কোম্পানির জন্য ডিজার্ব করেন,,,। আপনি আসতে পারেন,,,,

শুভ্র আর কিছু বললো না।যাওয়ার সময় শুধু বলে গেল সেই দিন গুলোর জন্য দুঃখিত।আমরা আমাদের পাপের শাস্তি পেয়ে গেছি। শাকিল বাস দুর্ঘটনায় মারা গেছে আজ দুই মাস। কেয়া বিবাহিত জীবনে সুখী নেই।আর রিফা যে মানুষটাকে ভালো বেসে ছিল সে তাকে ছেড়ে চলে গেছে আজ দুই বছর হতে চললো। আমার মা কে হারিয়ে ফেলেছি চিরতরে। ছোট বোন কে নিয়ে অনেক কষ্টে আছি।

শুভ্র কথাটা বলতে বলতে কান্না করে দেয়। আমাদের ক্ষমা করে দিয়েন।

শুভ্র চলে গেলে অনু ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। শাকিল আর বেঁচে নেই। ভাবতে পারলো না অনু।যেমনই হোক এক সময় তারা অনুর খুব আপন ছিল।
.
.
অফিস থেকে ফেরার পথে বাসে হঠাৎ দেখা হয়ে যায় রিফার সাথে।রিফা অনু কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়।

আমাকে মাফ করে দিস অনু। আমি অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি। তোর সাথে ওমনটা করার জন্য রিশাদ আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলেছে। আমার ও বিয়ে হয়ে গেছে আজ পাঁচ মাস। একটু ও সুখে নেই রে আমরা। শাকিল টা ও চলে গেছে পরপারে। কেয়া কোনো দিন ও মা হতে পারবে না বলে ওর হাসব্যান্ড ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে।

অনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বললো,, কোনো না কোনো ভাবে আমরা আমাদের পাপের শাস্তি ঠিক পাই,,,,হয়তো আগে আবার হয় তো পরে,,,,

বাড়িতে এসে কলিং বেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনু। কিছুক্ষণ পর অনুর মা এসে দরজা খুলে দিলে,,এক বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে আধো আধো বুলিতে ডাকতে থাকে অনু কে।

মাম্মা,,মাম্মা,,

অনু মুচকি হেসে মেয়েটা কে কোলে নিয়ে ইচ্ছে মতন আদর করে। আমার তন্নী সোনাটা কে মাম্মা কতো মিস করেছে।

তূর্য রুম থেকে এসে তন্নী কে অনুর কাছ থেকে নিয়ে বললো,,
আগে ফ্রেশ হয়ে নাও। ধুলো বালি জীবাণু এখন তোমার গায়ে। আমার মামুনিকে এখন তুমি আদর করতে পারবে না।

অনু মুচকি হেসে বললো তুমি কখন আসছো?

কিছুক্ষণ আগেই আসছি।

আচ্ছা আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।
অনু চলে গেল ফ্রেশ হওয়ার জন্য।
তন্নী অনু আর তুর্যর এক মাত্র আদরের মেয়ে। তন্নী যখন হবে তখন অনুর চেয়ে ও তূর্যর কষ্ট বেশি হয়ে ছিল।যখন ডাক্তার বলে ছিল দুই জনের থেকে এক জন কে বাঁচাতে হবে। সেদিন তূর্যর কান্না কে দেখে। আল্লাহর কাছে খুঁজে দুই জনকেই বাঁচিয়ে নিয়ে ছিল তূর্য।
.
.
মাহির ওকে এখন আর চেনা যায় না। সারাক্ষণ ঘর বন্ধি করে রাখে নিজেকে।বাইরের আলো বাতাস দেখেছে আজ পাঁচ মাস হবে। শরীর শুকিয়ে গেছে। মুখ ভর্তি দাড়ি। গায়ের রং আগে থেকে কালো হয়ে গেছে। ভীষণ অগোছালো হয়ে গেছে সে। মাহির কে দেখে মাহিরের মা শাড়ির আঁচল মুখে চেপে কান্না করে,,,

.
.
মাহিন সোনা,,
খাবার টা খেয়ে নাও বাবা। মায়ের সাথে আবার যেতে হবে তো নাকি?

ছোট মাহিনের পিছনে পিছনে ঘুর ঘুর করছে তনু।হাতে খাবারের প্লেট।

কত দুষ্টু ছেলে হয়েছে দেখেছো রুপসা আপু?একদম আমার কথা শুনে না।

রুপশা মেশিনে সেলাই করতে করতে বললো,,ওর বাবা ও হয় তো এত দুষ্টু ছিল।

রুপশার কথা শুনে তনু থমকে গেল।এই দুই বছরে কম মনে পড়েনি মাহিরের কথা। সেদিন মাহিরকে কষ্ট দিতে গিয়ে জেদ ধরে বেড়িয়ে এসে ছিল তনু।
যে সি এন জি তে উঠে ছিল সে ,,মাঝ রাস্তায় সেই সিএনজি এক্সিডেন্ট করে। সেদিন রাস্তার ধারে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা তনু কে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন ৩৪ বয়সী রুপশা বেগম।
নিজের একটা ১৪ বছরের ছেলে কে নিয়ে থাকতেন তিনি।তনু কে নিয়ে আসলে তনু কে নিজের বোনের মর্যাদা দেয়।তনুর অনুরোধে ঢাকা শহর ছেড়ে খুলনায় আসেন তিনি।
.
.
বিছানায় শুয়ে ছোট মাহিন কে ঘুম পাড়াচ্ছে তনু,,,,
দুষ্টু মাহিন টা এক সময় মায়ের বুকের মাঝে ঘুমিয়ে পড়ে।
তনু মাহিনের দু গালে চুমু খেলো।

কত শত দিন চলে গেল,,, এখন ও আমি কাটাতে পারলাম না তার শহরের মায়া।
চাই ও না আমি। অনেক হয়েছে ওর শাস্তি পাওয়া।ওকে কষ্ট দিতে গিয়ে আমি নিজে শেষ হয়ে যাচ্ছি।

তনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।এই দুই বছরে সবাই কে খুব মনে পড়ছে তার। একটা মানুষের ভুলের জন্য কত গুলো মানুষ কষ্ট পেলো।
.
.
তন্নী কে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে আছে অনু। মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে।চাকরিতে জয়েন করেছে মাস তিনেক আগে। সারা দিনে মেয়েটাকে একটু ও কাছে পায় না সে।

তূর্য অনুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো সারা রাত বাবু কে জড়িয়ে ধরলে হবে আমি যে পাশে আছি সে খবর তো আপনার নাই,,,,

অনু তূর্যর দিকে ফিরে তূর্যর নাক টেনে দিয়ে বললো,,
তুমি তো আর পিচ্চি না। আমার মেয়েকে তো আর সারা দিনে আমার কাছে পাইনা।

তূর্য অনুর নাকে নাক ঘষে বললো,,
আমি যেনো তোমাকে কত কাছে পাই,,,

অনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,,তনু আপু যে সেই হারিয়ে গেলো আর খুঁজে পেলাম না। কোথায় আছে কেমন আছে কোন খোঁজ পাওয়া গেলো না ওর।

জানো আজ শুভ্র আর রিফার সাথে দেখা হয়েছিল।

কি বলো,,,?
কি ভাবে দেখা হলো?

অনু তূর্য কে সব বললো।

ইসস শাকিলের জন্য খারাপ লাগছে। অকালে ঝরে গেল।
তূর্য অনুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,,
মানুষ একটা না একটা সময় ঠিক তার পাপের শাস্তি পায়। তাদের কর্মের ফল ভোগ করে। মাহির কে দেখো। কেমন হয়ে গেছে।
ধৈর্য ধরো বিশ্বাস রাখো আল্লাহ একদিন সব কিছুর প্রতিদান দিবেন।
.
.
পরের দিন শুক্রবার থাকায় সবাই বাড়িতে ছিল। দুপুরের দিকে কলিং বেল বেজে উঠলে অনু তন্নী কে কোলে নিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। দরজার ওপাশের মানুষটাকে দেখে অনুর চোখ থেকে আপনা আপনি পানি গড়িয়ে পড়ে।

তনু অনুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। হঠাৎ কান্নার শব্দ শুনে তূর্য রুম থেকে বের হয়ে আসে।তনু কে দেখে তূর্য অবাক হয় ভীষণ। সাথে খুশি ও।অনুর মা বাবা ও আসেন।

তূর্য অনুর কাছ থেকে তন্নী কে কোলে নেয়। দরজার সামনে ১৬ বছরের একটা ছেলের কোলে থাকা মাহিনকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকতে দেখে তূর্যর বুঝতে অসুবিধা হয় নি যে এটাই মাহিরের ছেলে।

তনু ওর মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়।
এত দিন পর নিজের আপন মানুষ গুলো কে কাছে পেয়ে খুশির যেনো বাঁধ ভেঙ্গেছে।

রুপশা বেগমের ছেলে রুপমের থেকে তনুর ছেলে কে কোলে নিয়ে অসংখ্য আদরে ভরিয়ে দিল অনু।

এত দিন কেন দূরে সরে ছিলি বলতো মা।এত বছর পর তোকে দেখে কতটা যে খুশি হয়েছি বলে বুঝাতে পারবো না।

আমি আর কথাও যাবো না। একদম না। তোমাদের সাথে থাকবো।

তূর্যর কোলের ছোট্ট তন্নীকে কোলে নিতে নিতে তনু জিজ্ঞেস করলো,,
কে এই মিষ্টি পরি টা?

আমার আর অনুর মেয়ে তন্নী।

তনু তন্নী কে আদর করে দিয়ে বললো মাশাআল্লাহ আমার তন্নী সোনাটা খুব মিষ্টি দেখতে হয়েছে।

তন্নী কে আদর করতে দেখে মাহিন কান্না করে দেয়।ওর মা কেন ওকে ছাড়া অন্য কাউকে আদর করবে?
গাল ফুলিয়ে কান্না করে দেয় মাহিন।

তনু তন্নী কে তূর্যর কোলে দিয়ে মাহিন কে অনুর কোল থেকে নেয়।

অনু তনুর কাঁধে হাত রেখে শান্ত কন্ঠে বলল,,
মাহিরের সাথে দেখা করে আয়। মানুষ টা তোকে হারিয়ে একদম পাগল হয়ে গেছে।তোকে যে কত খুঁজেছে।

হুম।করবো তো দেখা। ওকে ছেড়ে আমি আর কোথাও যাবো না।

তনু অনুদের নিয়ে মাহিরের ফ্লাটে যায়। কলিং বেল বাজলে কিছুক্ষণ পর মাহিরের মা এসে দরজা খুলে দিল। সবাইকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো,,
কিছু কী হয়েছে অনু?সবাই এখানে কেন?

তখন তনু মাহিন কে কোলে নিয়ে মাহিরের মায়ের সামনে আসেন।
এই মুহূর্তে তনুকে দেখে মাহিরের মা কথা বলতে ভুলে গেছেন।তনু কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেন তিনি ও। তনুর কোল থেকে মাহিন কে কোলে নিয়ে অসংখ্য আদরে ভরিয়ে দিতে লাগলো।

তনু এক পা এক পা করে মাহিরের রুমের দিকে এগিয়ে গেল।

দরজা খোলা।তনু দরজা ঠেলে রুমে ঢুকে দেখে মাহির এক দৃষ্টিতে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।
তনুর চোখে পানি চিকচিক করছে। দৌড়ে গিয়ে মাহির কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল।
মাহির তনু কে নিজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে এক চড় দিয়ে বললো,,
কেন ফিরে আসলি তুই? আমাকে ছেড়ে চলে যখন গিয়ে ছিলি আবার কেন আসলি?

তনু আবার ও মাহির কে জড়িয়ে ধরে বললো আর কোনো দিন ও ছেড়ে যাবো না। একদম না।
মাহির ও তনুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। মাহিরের মা মাহিনকে নিয়ে আসে মাহিরের রুমে।
মাহির একবার মাহিনের দিকে তাকিয়ে আবার তনুর দিকে তাকালো।

তনু মাহিনকে এনে মাহিরের কোলে দিল। তোমার ছেলে।মাহিন।

মাহির মাহিনকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে।
এত দিন পর নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে পেয়ে মাহিরের আনন্দের শেষ নেই।

এই দুই বছরে অনুর কষ্ট গুলো হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে মাহির।

তনু মাহিরের দিকে তাকিয়ে বললো,,কী অবস্থা করেছো নিজের? চেনা যায় তোমাকে?
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখো তো আগের তুমি আর এখন কার তুমির কত তফাৎ।

তুমি ফিরে আসছো না। আবার আগের মত হয়ে যাবো।
ঠিক তোমার মনের মত।
.
.
তূর্যর কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে অনু।কোলে ছোট তন্নী ঘুমিয়ে আছে।

তূর্য অনুর মাথার উপর নিজের মাথা রেখে বললো,,
জীবনটা নাটকের চেয়ে ও বেশি নাটকিয়।
সবাই সুখে থাক। নিজের কর্মের ফল মানুষ কে ভোগ করতে হয়।

অনু তূর্যর এক হাতের মুঠোয় নিজের হাত রেখে বললো,,
যারা ঠকায় তারা ও ঠকে। পার্থক্য শুধু সময়ের।
আমি আমার আর তোমার এই শহরে আর কাউকে আসতে দিবো না।
.
.
তূর্য ঘুমিয়ে আছে। তার পাশেই ঘুমিয়ে আছে ছোট্ট পরি টা।

অনুর চোখে ঘুম নেই।আজ আবারো কেন জানি পুরোনো ক্ষতটা তাজা হয়েছে।
প্রথম প্রেম যে ভুলে যাওয়া এতো সহজ নয়। প্রথম প্রেম সবাই ভুলতে পারে না।অনু কে তূর্য তার সবটুকু দিয়ে ভালো রেখেছে।ভালোবাসে।
অনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,,
তার শহরের মায়া কাটানোর মতো সাদ্ধি আমার না হোক। এই মানুষটাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি ভীষণ।

,,,,,,সমাপ্ত,,,,

(জানি না গল্প টা কেমন হয়েছে? অনেক ভুল হয়েছে গল্পে। অনেক কিছু জানা ছিল না। অনেক কিছু জানা হয়েছে। ভুল গুলো কে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ 💕। সবাই সুস্থ থাকুন ভালো থাকুন।আল্লাহ হাফেজ 🙂)

তার শহরের মায়া সিজন-০২