ওহে প্রিয় পর্ব-২৯

0
1828

#ওহে_প্রিয়
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২৯
____________
আহির সাথে ফোনালাপ শেষে মুখ টা বেশ কাচুমাচু করে বসে রইলো হ্যারি। ফোনের লাউড স্পিকার বাড়ানোর ফলে সমস্ত বাক্যই শুনতে পেয়েছে হ্যাভেন এবং মারুফ। হ্যাভেন ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে তাকিয়েই আছে হ্যারির দিকে। মারুফ গভীর চিন্তায় মগ্ন। বেশখানিকটা সময় অতিবাহিত হতেই হ্যারির দিকে দৃঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো হ্যাভেন। প্রশ্ন করলো,

-‘ বাপের বাড়ি গিয়ে তাঁর সাহস খুব বেশী বেড়ে গেছে মনে হয় ‘?

হ্যারির তখন বলতে ইচ্ছে করলো, ‘বাপের বাড়ি গিয়ে নয় বরং শ্বশুর বাড়ি থাকাকালীনই সাহস টা জন্ম নিয়েছে শতহোক তরুণ এমপিসাহেবের অর্ধাঙ্গিনী সে। সাহস না থাকলে চলে নাকি? এখন দেখো এই সাহস তোমায় কোন অবদি নিয়ে যায় ভাইসাহেব’ কিন্তু সে উচ্চবাক্যে কিছু বলার পূর্বেই মারুফ বললো,

-‘ আরে নারী জাতির ধর্মই এটা দোস্ত বরের সাথে রাগারাগি করে বাপের বাড়ি যাবে আর ভয় দেখানোর জন্য ডিভোর্স ডিভোর্স করবে কিন্তু যেই ডিভোর্স দিতে যাবি অমনি কান্নাকাটি করে বন্যা বয়িয়ে দেবে ‘।

-‘ আমি ডিভোর্স দিতে যাবো? তোর মনে হয় আমি ওকে ডিভোর্স দিবো’? বলেই চোখ কটমট করে তাকালো।

-‘ দিবিনা তাহলে কি দরকার ছিলো মেয়েটার অসহায় মূহুর্তে ডিভোর্সের নাম নেওয়ার ‘?

-‘ সে সময় আমি দিশেহারা ছিলাম মারুফ। আমার মাথা কাজ করছিলো না ‘৷

-‘ আচ্ছা যা হয়েছে তা নিয়ে হিসাব নিকাশ করে লাভ নেই বরং কিভাবে ভাবিকে ফেরানো যায় সেটা ভাব। আর শোন ভাবিকে ফেরানোর আসল মন্ত্র হচ্ছে সম্মানের সঙ্গে প্রেমিক পুরুষ হওয়া, এক সমুদ্র ভালোবাসা তাঁর পদস্থলে উজার করে দেওয়া। তাঁকে বোঝানো তুই তাঁকে ছাড়া শূন্য, তুই তাঁকে ছাড়া পুরোপুরি দেবদাস, আর কোন প্রকার জোর,জবরদস্তি দিয়ে নয় প্রেম,ভালোবাসা দিয়ে বাঁধার চেষ্টা কর তবেই সাকসেস হবি ‘।

মারুফের কথার প্রতুত্তরে কিছু বললো না হ্যাভেন শুধু হ্যারির দিকে তাকিয়ে খানিকটা অভিমানী সুরে বলে ওঠলো,

-‘ আমার মাথায় না হয় ঘিলু নেই তাঁর মাথায় তো খুব ঘিলু তাহলে সে কেনো মেডিসিন গুলো সঙ্গে নিলো না? সে যে অসুস্থ এটুকু খেয়াল কি তাঁর নেই মেজাজ দেখিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলো ‘?

হ্যারি কিছু বলতে নিবে তাঁর পূর্বেই মারুফ আবারো ব্যাঙ্গ করে বললো,

-‘ তোর বউ মনে হয় আনন্দে আত্মহারা হয়ে বাড়ি ছেড়েছে। যে খুশির ঠ্যালায় সেজেগুজে খাদ্যপানীয়, ওষুধপত্র সব খেয়াল করে করে সঙ্গে নিয়ে যাবে ‘?

-‘ রাগ করেছে বাঁধা নেই, বর ভুল করেছে শাস্তি দিক বাঁধা নেই,কিন্তু নিজের ব্যাপারে এটুকু বেখেয়ালি করলে অবশ্যই আমি বাঁধা হয়ে দাঁড়াবো মারুফ। সেদিন না হয় সে জানতো না তাই বৃষ্টি তে ভিজেছে আজ সে জানে সে কতোটা অসুস্থ তাহলে মেডিসিন কেনো সঙ্গে নিলো না এই কৈফিয়ত তাঁকে দিতেই হবে ‘। বলেই বিছানা ছাড়তে উদ্যত হলো হ্যাভেন।

মারুফ আঁতকে ওঠে তাঁর হাত আঁটকে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

-‘ তুই কি একেবারের জন্যই বউটাকে হারাতে চাইছিস ‘?

-‘ উল্টাপাল্টা কথা বলে মাথা বিগরাবিনা তো মারুফ আমি তাঁকে নিতে যাচ্ছি ‘।

-‘ উল্টাপাল্টা বলছিনা আমি বলছি তুই আজ রেষ্ট কর ভাবিও কিছুদিন বাবার বাড়ি থাকুক মনটা ফ্রেশ করুক মাথা ঠান্ডা হোক রাগ,অভিমান পড়ে যাক তারপর তুই ওনাকে গিয়ে নিয়ে আয়। সে অবদি তুই নিজের ট্রিটমেন্টও কর ‘।

-‘ এতোগুলো দিন আমার অসুস্থ বউটাকে বিনা চিকিৎসায় একা ফেলে রাখবো আমি ‘ চোখ কটমট করে তাকিয়ে দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে কথাটা বললো হ্যাভেন।

হ্যাভেনের এহেন আচরণ এবং বাক্যে বিরবির করে মারুফ বললো,

-‘ ওরে আমার বউওয়ালারে ব্যাটা সাইকো! বউয়ের ওপর টর্চার করার সময় এই দরদ কোথায় ঘাপটি মারছিলো? বউয়ের প্রতি অন্যায় করার সময় এই দরদগুলো উপচে ওঠলেই তো কাজ হতো ‘।

-‘ ভাইয়া তুমি চিন্তা করছো কেনো ভাবিকে মেডিসিনগুলো আমি বা হিরা পৌঁছে দেবো তাহলেই তো হবে ‘।

হ্যারির কথায় খানিকটা শান্ত হয়ে বসলো হ্যাভেন। মারুফও হ্যাভেনের হাত ছেড়ে বললো,

-‘ হ্যাঁ আমিও সেটাই বলতে চাচ্ছি তুই ভাবি কে মেডিসিন গুলো পাঠিয়ে দে নিজেও রেষ্ট কর দুজনই আলাদা থেকে নিজেদেরকে একটু সময় দে। নিজের
চিকিৎসাও করাতে থাক কটা দিন যাক দেখ পরিস্থিতি কি দাঁড়ায় ‘।
.
হ্যারি,হিরা দুজন একসঙ্গেই গিয়েছিলো আহির বাবার বাড়ি। সেখানে তাঁদের দুজনের আদর,যত্নের কোন ত্রুটি রাখেনি কেউ। পেটপুরে খাওয়িয়ে তবেই ছেড়েছে দু’ভাইকে। সাথে বড় ভাইয়ের অবস্থা শুনে সকলেই ভড়কে গেছে। তবু একটুও মন গলেনি আহির। সব শুনেও কাঠ কাঠ গলায় সে বলে দিয়েছে, ‘এসব নাটক করে লাভ নেই ভালোয় ভালোয় এমপি সাহেবকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিতে বলবা। আমি চাইলেও এ ব্যাপারে আগাতে পারছিনা কপাল খারাপ কিনা? এমপির বিরুদ্ধে কেস কেউ নিতে চাইবেনা। এখানেতো একটা সংসার ভাঙনের বিষয় সেক্ষেত্রে আমি আগালে তেমন লাভ হবেনা বরং সবাই সেই ওনার মতামত ওনার পারমিশন চাইবে এর থেকে ভালো বিষয়টা ওনার দিক থেকেই এগোক’। আহির কাঠিন্য সে রূপের কাছে পরাজিত হয়েছে হ্যারি,হিরা। মেডিসিন গুলো নিতে চায়নি কিন্তু রুবিনা তালুকদারের কথা বলে বুঝিয়ে শুনিয়ে দিয়েছে। আসার সময় আহি শান্ত গলায় এটুকু বলে দিয়েছে, ‘ শোনো যতো যাইহোক ওনি যে নিজের ট্রিটমেন্ট করাতে রাজি হয়েছে এটুকু শুনে খুশি হলাম আশা করি নেক্সট কোন মেয়ে ওনার জীবনে আসলে আমার মতো ভুগবে না ‘। হ্যারি, হিরা শুধু নির্বাক দৃষ্টি তে তাকিয়ে ছিলো প্রতুত্তরে কিছু বলতে পারেনি। উঠান পেরিয়ে টিনের গেট পেরোনোর সময় হ্যারি শুধু এটুকু বলে এসেছে,

-‘ তোমার হাতের খাবার আবার কবে খেতে পারবো ভাবি মা? রোজ নিয়ম করে যত্নসহকারে বড়’মার পর তুমিই ওভাবে রেঁধে খাওয়িয়েছো। যাই ঘটুক না কেনো অভিমানের পালা শেষে আমরা আমাদের দ্বিতীয় মা কে সম্মানের সঙ্গে ঘরে ফিরিয়ে নিতে চাই ভাবি মা। মা হারিয়েছে বহু বছর পূর্বে বড়’মায়ের পর তোমার করা যত্নগুলোই মনে গেঁথে আছে। বয়সের দিক দিয়ে আমার অনেক ছোট তুমি কিন্তু সম্মানের দিক দিয়ে তোমার স্থান অনেক উচ্চ ভাবি’মা ‘।

হিরার চোখ দু’টো চিকচিক করছিলো তখন সে কাঁপা কন্ঠে এটুকু বললো,

-‘ আপনি খুব শিঘ্রই ফিরবেন ভাবি’মা বাড়িটা একদম শূন্য শূন্য লাগছে খুব শিঘ্রই আপনি ফিরবেন যেভাবে চান সেভাবেই ফিরবেন তবুও আপনি ফিরবেন ‘।

ওদের দু’জনের অমন আকুতি দেখে নিজের আবেগকে আর লুকিয়ে রাখতে পারেনি আহি। ছলছল চোখে চেয়ে সে বলে,

-‘ আমার কোন ভাই নেই তোমাদের দু’জনকেই এতোগুলো দিন ভাই হিসেবে মেনে এসেছি,শুধু যে ভাই তা নয় ভাইয়ের থেকেও বেশী কিছু তোমরা। জানো আমি শুরুতে খুব বিরক্ত হতাম যে এই দামড়া দামড়া ছেলেগুলা আমাকে ভাবি ডাকে ঠিক আছে সাথে মা,মা কেনো করে? কিন্তু একসময় সয়ে গেছে সেই সাথে তৈরি হয়েছে ভালোলাগা। আজকাল কাজিন ব্রাদারকে এতো সম্মান করতে কজন পারে? বা তাঁর বউকে এতো উচ্চসম্মান কজন দিতে পারে? বর্তমান সময়টাতে তোমাদের মতো এতো ভদ্র আদর্শবান দেবর কজন পায় বলোতো? তবে হ্যাঁ আমার দেবরগুলো ঘরের বাইরে যাই করে বেড়াক না কেনো ঘরের ভিতরে তাঁরা একদম ফেরেশতা ‘।

আহির কথার ইঙ্গিত বুঝতে হ্যারি, হিরার খুব একটা সময় লাগলোনা হিরা লজ্জায় মাথা চুলাচ্ছিলো। হ্যারি বোকা বোকা হাসি দিচ্ছিলো শুধু। আহিও তখন মুচকি হেসে বললো,

-‘ ভাইয়েরা যাই করোনা কেনো কোন মেয়ের জীবন নষ্ট করোনা। হ্যারি সাহেবকে নিয়ে আমি তেমন চিন্তিত নই হিরা সাহেবকে নিয়ে বেশ চিন্তিত’ বলেই ঘাড় উঁচিয়ে হিরার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,

-‘ ভাই সাহেব বহুনারীর সংস্পর্শে আসাকে পুরুষত্ব বলে না বরং এক নারীকেই বৈধভাবে বহুবার বহুভাবে নিজের সংস্পর্শে আনাকে পুরুষত্ব বলে ‘।

হ্যারি অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে বললো,

-‘ আমি ওকে বোঝাবো ভাবি’মা তুমি চিন্তা করো না ‘।
______________
বিকাল থেকে শুরু করে রাত এগারোটা অবদি গভীর ঘুমে তলিয়ে ছিলো হ্যাভেন। কেমন খিদে পাচ্ছে তাঁর, সে কি ডিনার করে ঘুমায়নি? আহি কি তাঁকে খেতে ডাকেনি? শোয়া থেকে ওঠে বসলো পাশে তাকিয়ে আহিকে পেলোনা তাই ওঠে গিয়ে বাথরুম চেক করে ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। ভ্রুযুগল কুঁচকে ফেলে ভাবলো,’রাত বারোটার সময় আহির তো বাইরে থাকার কথা নয় তাহলে সে কোথায়’? দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই হঠাৎ থমকে গেলো। পুরো শরীর জুরে কেমন তপ্ত হাওয়ার স্রোত বয়ে গেলো তাঁর, কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরোচ্ছে, মাথায় কেমন করে যেনো এক চক্কর দিলো। নেই তো আহি নেই! সে তো চলে গেছে তাঁর করা অন্যায়গুলো সহ্য করতে না পেরে চলে গেছে সে। তাঁর করা অবহেলাগুলো ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে মেয়েটাকে। এক আকাশ সমান ভালোবেসেই একজন মানুষ কে আঁটকে রাখা যায় না সেখানে তাঁর ভালোবাসার মাত্রা ছিলো খুবই নগন্য অবহেলার মাত্রা ছিলো খুবই জঘন্য। বুকের ভিতর আচমকাই কি যেন কামড়ে ধরলো। মাথা ঘুরিয়ে মেঝেতেই বসে পড়লো সে। তখনি মনে পড়লো হ্যারি,হিরার তো আহির বাসায় যাওয়ার কথা ছিলো তাঁরা কি ফিরেছে? ফিরলে কেনো তাঁর কাছে একবারো আসেনি? কেনো জানায়নি আহির অবস্থান? পরোক্ষণেই মনে পড়লো সে তো মারুফের দেওয়া সব মেডিসিন গুলো খেয়ে ঘুমিয়েছিলো হয়তো সেখানে স্লিপিং পিলও ছিলো যার ফলে গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলো সে।

চারদিকে শুধু শূন্যতা আর শূন্যতা। বুকের ভিতরটা ভীষণভাবে কাঁপছে। নিঃশ্ব মনে হচ্ছে নিজেকে একেবারেই নিঃশ্ব৷ খারাপ জিনিস, আমাদের জন্য অমঙ্গল বয়ে আনে এমন জিনিসের সংস্পর্শ একটু কষ্ট হলেও ত্যাগ করা যায় কিন্তু যা আমাদের জন্য ভালো,যা আমাদের মঙ্গল বয়ে আনে তেমন জিনিস দূরে চলে গেলো তা কি সহজে মানা যায়? কাছে থাকতে মানুষ টাকে এতটুকু গুরুত্ব দেওয়া হয়নি অথচ দূরে যাওয়াতে তাঁর গুরুত্ব বুকের ভিতর তীব্র যন্ত্রণা দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে উপরওয়ালা। অদ্ভূত হলেও সত্যি সে রাগ করতে পারছে না পারছেনা ক্ষিপ্ত হয়ে কোন অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে৷ কি করে পারবে ? আহি স্বাভাবিক ভাবে তো চলে যায়নি সে চলে যাওয়ার আগে নিঃশ্ব করে দিয়েছে তাঁকে তাঁর পুরোটাকেই দখল করে নিয়ে গেছে। অপরাধীর অপরাধ শুধু চিহ্নিতই করেনি বরং তাঁকে গ্রেফতার করেও নিয়ে গেছে। বন্দি করে রেখেছে তাঁর বক্ষঃস্থলের জেলখানাতে।

গায়ে শার্ট জরিয়ে বোতামগুলো লাগাতে লাগাতে রুমে হাঁটছে আর বিছানার যে পাশটায় আহি ঘুমাতো সে পাশটায় তাকিয়ে দেখছে। কতোগুলো রাত এখানটা পড়ে পড়ে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছে মেয়েটা। কতোটা আকুল হয়ে একটুখানি বুকে ঠাঁই পেতে চেয়েছে। ঝড়,বৃষ্টির রাতে ঘুমের ঘোরে শীতে গুটিশুটি হয়ে মেয়েটা যখন তাঁর বুকের অতি নিকটে মুখ গুজতো মৃদু হেসে সেও তাঁকে বুকে জরিয়ে নিতো এটুকু সে কেনো করতো জানেনা। কখনো তাঁর জাগার পূর্বে বা জাগার পরে দূরে ঠেলে দিতো৷ মেয়েটা কষ্ট পেতো কেনো পেতো? সে তো জানতো তাঁকে জোর করে বিয়ে করা হয়েছে জোর করে বিয়েতে ভালোবাসা কেনো আশা করেছিলো? সে ভালোবাসে বলে? এই ভালোবাসাটুকু কতোটা সত্যি ছিলো তা জানার অধীর আগ্রহ থেকেই তো দূরে সরিয়ে দেওয়া হতো। কখনো ইচ্ছে করতো মেয়েটাকে খুব ভালোবাসতে কিন্তু কিছু তিক্ত অতিতের বিষাদীয় যন্ত্রণায় সেটুকু সে কখনোই করতে পারতো না। যখনি একটুখানি ভালোবাসতে শুরু করতো তখনি মাথায় নাড়াচাড়া দিয়ে ওঠতো কেবল একটি বাক্যই ‘ এক ভুল বার বার করিসনা হ্যাভেন দ্বিতীয়বার মুখে চুনকালি মাখিস না ‘ হারানোর ভয়ে একি যন্ত্রণা দ্বিতীয় বার ভোগ করবেনা বলে মেয়েটাকে কাছে টেনেও টানেনি ভালোবেসেও বাসেনি। তবুও সেই হারিয়েই ফেললো? মেয়েটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েই দিলো ভালোবেসে আগলে রাখতে জানতে হয়। অবহেলার জিনিস বরাবরই ক্ষণস্থায়ী। যদি তাই হবে রূপসা কেনো তাঁর জীবনে দীর্ঘস্থায়ী হলোনা? তাঁকে তো ভালোবেসেই আগলে রেখেছিলো? এর উত্তরও বোধহয় এখন পানির ন্যায় স্বচ্ছ রূপসার প্রতি তাঁর নিখুঁত ভালোবাসা থাকলেও রূপসার ভালোবাসা ছিলো আবর্জনায় ঘেরা৷ উপরওয়ালা বোধহয় তাঁর ভালোর জন্যই রূপসার আসল মুখোশ টা টেনে হিঁচড়ে বের করে দিয়েছে। আজ যদি রূপসার কালনাগিনী রূপ না দেখতো তাহলে আহির মতো নিষ্পাপ, পবিত্র, শুভ্রের ন্যায় রমণী তাঁর কপালে জুটতে না৷ নোংরা চরিত্রের অধিকারীর সঙ্গে আর যাইহোক সারাটাজীবন হাতে হাত রেখে পথচলা সম্ভব নয়। রূপসার মতো নোংরা চরিত্রের মেয়ে তাঁর জীবন থেকে সরে গেছে এজন্য উপরওয়ালার কাছে শুকরিয়াই জানানো উচিত৷ আফসোস না করে স্বস্তির শ্বাস ফেলা উচিত কোন ধোঁয়াশায় রয়ে যায়নি সে। এ মূহুর্তে আর অতিত নয় আর রূপসা নয়৷ এ মূহুর্ত থেকে সে শুধুই বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববে এবং চলবে। রূপসার চ্যাপ্টার ক্লোজ। তাঁর বর্তমান, ভবিষ্যৎ, এবং মৃত্যুর শেষ অবদি শুধু একটা নামই থাকবে আর সে নাম হলো আহি। তাঁকে ফেরানোর জন্য নিজের সর্বাত্মক ভালোবাসা, সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। একবার না বুঝলে দশবার বোঝাবে দশবার না বুঝলে একশবার বোঝাবে। তবুও তাঁর হৃদয়ের উপলব্ধি বুঝিয়েই ছাড়বে। গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে হ্যারির রুমের দিকে পা বাড়ালো হ্যাভেন।
.
ফজরের আজান পড়েছে মাত্র। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে আহি। রুমে লাইট জ্বালানোতে ঘুমের ঘোরেই কপাল কুঁচকে ফেললো। ঘুমটা আলগা হলেও চোখ খুলে তাকালো না। তবে মনে করার চেষ্টা করলো সে কি স্বপ্ন দেখছিলো কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে মনে পড়েও গেলো৷ মনটা আবারো তিক্ততায় ভরে এলো। স্বপ্নে সে হ্যাভেনকেই দেখেছে দুজনের অন্তরঙ্গ মূহুর্তটুকু স্বপ্নে দেখেছে সেটা মনে পড়তেই তিক্ত হয়ে ওঠলো৷ কোথায় যেনো শুনেছিলো একজন মানুষ যদি স্বপ্নে নিজেকে কারো সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে তাহলে বুঝতে হবে ভিতরে ভিতরে সে ভীষণ ভাবে একা৷ একাকিত্ব তাঁকে আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে রেখেছে৷ কিন্তু আহি তো একা নয়। বরং মা,বাবা,আদরের বোনের সান্নিধ্যে আছে সে এখন। একাকিত্ব ভোগ করার প্রশ্নই আসেনা৷ তাহলে কেনো এমন স্বপ্ন সে দেখলো। পরোক্ষণেই ভাবলো এমনটাই তো দেখবে ঐ লোকটার সাথে তাঁর কোন ভালো মূহুর্ত আছে নাকি যে তা দেখবে? ঐ লোকটার স্মৃতি চারণ করতে গেলেও বিতৃষ্ণায় বুকটা ভরে যাবে। কপাল কুঁচকে কথা গুলো ভাবতে ভাবতেই অস্ফুটস্বরে বলে ওঠলো অসহ্য!

হ্যাভেনের মুখে মৃদুহাসি ফুটে ওঠলো। কে বললো শুধু তাঁর অবচেতন মনই এই মেয়েটাকে ভালোবেসেছে? এই মেয়েটার অবচেতন মনও যে তাঁকে ভীষণ ভাবে অনুভব করে। সে অনুভূতি তে ঘৃণার পরিমাণ কতোটা তা সে ভাবতে চায়না শুধু বুঝতে চায় ভালোবাসার পরিমাণ কতোখানি? এই যে তাঁর উপস্থিতিতে তাঁর বউ বিরক্তিতে চোখ, মুখ কুঁচকে ফেলে অসহ্য শব্দটি উচ্চারণ করলো এতেই কি প্রমাণিত হয় না তাঁর বউয়ের অবচেতন মন জেনে গেছে তাঁর উপস্থিতি?

ঘুমন্ত শুভ্রকন্যার কপালে গভীর চুম্বন এঁকে দিলো হ্যাভেন। চুম্বনের পূর্বমুহূর্ত যতোটা শুভ্র, স্নিগ্ধ, মোহময় ছিলো পরবর্তীতে যে ঠিক কতোখানি প্রতিকূল মুহূর্তের সৃষ্টি করবে তা ছিলো অভাবনীয়।

চলবে..