#ওহে_প্রিয়
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৩০
_____________
বিরক্তিতে চোখ,মুখ কুঁচকেই আধোআধো চোখে তাকালো আহি। ঘুম ভাঙতেই এতো বড় ঝটকা সে পাবে বুঝতেই পারেনি। হ্যাভেন এসেছে হ্যাভেন? হার্টবিট দ্রুত ওঠানামা করতে শুরু করলো তাঁর পরোক্ষণেই চোখ বন্ধ করে ফেললো। নাহ এতো ভোরে হ্যাভেন কি করে আসবে? এটা তাঁর ভ্রম নিশ্চয়ই? হ্যাঁ ভ্রম সে হয়তো এখনো স্বপ্নের তালেই রয়েছে ভেবেই চোখ মেলে হাই তুলতে তুলতে আড়মোড়া ভেঙে পাশে তাকালো। অনা নেই ফজরের আজান পড়েছে নিশ্চয়ই মায়ের সাথে নামাজ পড়তে বসেছে। তাঁর তো নামাজ নেই তাহলে আরেকটু ঘুমানো যাক। ভেবেই আবার শুতে যাবে যাবে ভাব তখনি অতি পরিচিত পারফিউম এর ঘ্রাণ নাকে এলো সেই সাথে অতি পরিচিত সেই নিঃশ্বাসের শব্দ। এ’কি ভুলা যায়? বুকের ভিতরটা এবার হাতুড়ি পেটা শুরু করে দিলো। চমকিত ভঙ্গিতে আবারো তাকালো পাশে হ্যা হ্যাভেনই বসে আছে। বিছানার পাশে কাঠের চেয়ার পেতে শুধু বসে নয় পায়ের ওপর পা তুলে বেশ আয়েশ করে বসে একগালে হাত রেখে কনিষ্ঠ আঙুলটা ঠোঁটে নাড়াচাড়া করছে আর মিটিমিটি হাসছে। পড়নে তাঁর কালো প্যান্ট এবং সাদা শার্টের ওপর হাতাকাটা শর্ট কালো কোর্ট।
চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে এক ঢোক গিললো আহি। গায়ে ওড়না না থাকায় আশেপাশে নজর বুলালো। যতদূর মনে আছে বালিশের পাশেই ওড়নাটা রেখেছিলো কিন্তু এখন নেই অদ্ভুত! লোকটা যা বেহায়ার মতো তাকিয়ে আছে স্বপ্ন হোক আর বাস্তব হোক এই মূহুর্তে একটি ওড়নার খুব প্রয়োজন তাঁর।
হ্যাভেন নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে। এতোগুলো দিন একসাথে কাটিয়েছে তাঁরা। কতো রাত নিজের উন্মাদনার শিকার করেছে মেয়েটাকে। কতো রাত মেয়েটার উত্তপ্ত শ্বাসের শাক্ষি হয়েছে। তবুও দূরত্ব ঘোচাতে পারেনি পারেনি সম্পর্কে প্রাণ দিতে। এজন্যই বোধহয় বলা হয় দেহ দিয়ে নয় যদি পারো মন দিয়ে আঁকড়ে ধরো নিজের সঙ্গীকে।
মাসের পর মাস মেয়েটা তাঁর পাশেই ঘুমিয়েছে। তাঁর সর্বাধিক প্রয়োজন মিটিয়েছে। অথচ কখনো খেয়ালই করা হয়নি মেয়েটাকে। কখনো দীর্ঘসময় নিয়ে দেখা হয়নি তাঁর ঘুমন্ত শুভ্রের ন্যায় মুখশ্রী। কখনো দেখা হয়নি ঘুমকাতুরে আহির মোহনীয় এই রূপখানি। কখনো গভীরভাবে উপলব্ধি করা হয়নি তাঁর উত্তপ্ত শ্বাসের গভীরতা। দীর্ঘ এক শ্বাস ছাড়লো হ্যাভেন। তাঁর সেই গভীর শ্বাসের শব্দে খানিকটা কেঁপে ওঠলো আহি। হ্যাভেন তাকিয়েই ছিলো সেভাবেই পায়ের ওপর তোলা পা’টা নামিয়ে গাল থেকে হাত সড়িয়ে সোজা হয়ে বসলো। ঘাড় ঝুঁকিয়ে তাঁর স্বভাবসুলভ বাক্যটি আওড়ালো,
-‘ আই লাইক ইট সুন্দরী ‘।
এবার আহি একদম সিওর হয়ে গেলো এটা স্বপ্ন বা ভ্রম নয় সত্যি হ্যাভেন তালুকদার তাঁর সম্মুখে বসে আছে। এবার খেয়াল হলো তাঁর ওড়নাটা হ্যাভেনের গলায় ঝুলানো। আর দেরি করলো না ঝড়ের বেগে ওড়নাটা একটানে ছিনিয়ে নিয়ে নিজের গায়ে জরিয়ে চিৎকার করে ওঠলো,
-‘ আপনি এখানে এসেছেন কোন সাহসে? কেনো এসেছেন আমার কাছে আপনি ‘?
-‘আমাকে আমার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এসে তুমি বলছো আমি কেনো তোমার কাছে এসেছি? তুমি যদি এমন অমানবিক কথা বলতে পারো আমিও না হয় অমানবিক কাজটা করে দেখাই? দ্বিতীয় বারের মতো ছিনিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি তোমায় ‘।
এবার আহি ভয়ংকর রেগে গিয়ে তাচ্ছিল্য সহকারে বললো,
-‘ আপনার পরিকল্পনা আর কখনোই সফল হবেনা মি.হ্যাভেন। নিজেকে শেষ করে দিতেও প্রস্তুত আমি তবুও আপনার মতো অমানুষের কাছে ফিরবোনা ‘।
চমকে ওঠলো হ্যাভেন মূহুর্তেই আহির এমন রূপে বেশ ঘাবড়েই গেলো সে৷ পরোক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে ওঠে দাঁড়ালো। বললো,
-‘ এমন উত্তেজিত হচ্ছো কেনো সুন্দরী? বউরা রাগ করে বাপের বাড়ি চলে এলে স্বামীদের তো উচিত রাগ ভাঙিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া ‘।
বেশ চটে গেলো আহি বিছানা থেকে নেমে এসে হ্যাভেনের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আঙুল ওঠিয়ে বললো,
-‘ মি. হ্যাভেন তালুকদার জলদি ডিভোর্স লেটার পাঠাবেন আর কোন কথা নয় বেরিয়ে যান যান বলছি’৷ বলেই দরজার দিকে ইশারা করলো।
যদিও আঙুল ওঠিয়ে এমন ধমকানোতে হ্যাভেনেরও মেজাজ খারাপ হতে শুরু করে দিয়েছে তবুও নিজের করা ভুলের কথা ভেবে নিজেকে সংযত করে সে আহির হাত ধরে ঠান্ডা মাথায় শান্ত গলায় বললো,
-‘ চুপ চুপ এভাবে চিৎকার চেঁচামেচি করোনা আহি। বোঝার চেষ্টা করো আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি। আমি আমার অসুখের চিকিৎসাও শুরু করেছি দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে। ফিরে চলো তুমি আমার সাথে তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না আহি ‘।
এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিলো আহি। হ্যাভেনের এবার চোখ লাল হতে শুরু করলো। ঠোঁট কামড়ে কিছু বলতে যাবে তাঁর আগেই আবারো নিজেকে সামলে নিয়ে অপরাধীর ন্যায় মুখ করে বললো,
-‘ আ’ম সরি আহি আমার সবভুলের জন্য ক্ষমা চাইছি প্লিজ ফিরে চলো ‘।
আহি অগ্নিচক্ষুতে চেয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকলো আর হ্যাভেনের ভাবমূর্তি বোঝার চেষ্টা করলো। হ্যাভেন আবারো তাঁর অনেকটা কাছে এসে দুগালে আলতো হাত রেখে আদুরে স্বরে বললো,
-‘ অনেক অন্যায় করেছি আমি আহি। অনেক ভুল হয়ে গেছে আমার দ্বারা সেই ভুলগুলো ভালোবাসা দিয়ে মিটিয়ে নিতে চাই একটি সুযোগ দাও ‘।
আহি এবারেরও গায়ের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে হ্যাভেনের হাত ছাড়িয়ে দিলো তাঁর চোখ দু’টো ভয়ংকর লাল বর্ণ ধারণ করেছে। হ্যাভেনও অবাক চোখে আহির সে রূপ দেখতে থাকলো। আহি থেমে রইলো না চিৎকার করে ওঠে বললো,
– ‘ আমাকে কি আপনার খেলনা মনে হয়? যখন ইচ্ছে হলো খেললাম ইচ্ছে হলো ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। এতোদিন আমি খেলনা হয়ে থাকলেও আর না। এবার আর এই আহি চুপ করে থাকবে না। আমি আমার বাচ্চা হারিয়েছি মি.হ্যাভেন তালুকদার সব হারিয়ে আমি নিঃশ্ব হয়ে গেছি। আমাকে আর নিঃশ্ব করতে পারবেন না৷ যে সময়টা আপনার আমার পাশে থাকা উচিত ছিলো সে সময়টাই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। এখন আবার এসেছেন তুলে নিতে তাইনা? কিন্তু আমিতো যাবোনা মৃত্যু কে বরণ করে নিতেও আমি প্রস্তুত তবুও আপনার জীবনে, ঐ কালো অধ্যায়ে আর ফিরে যেতে চাই না ‘।
আহির কথা শেষ হলোনা তাঁর পূর্বেই হ্যাভেন ক্ষিপ্ত হয়ে আহির হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো। বললো,
-‘ যতো রাগ, যতো ক্ষোপ আমার কাছে ফিরে গিয়ে দেখিও আহি আমি কিছু মনে করবোনা শুধু আমার থেকে দূরে থেকো না ‘।
বলেই গায়ের জোর খাটিয়ে রুম থেকে বের করতে নিলেই আহি দিশেহারা হয়ে হ্যাভেনের হাতে সাজোরে এক কামড় বসিয়ে দেয়। হ্যাভেন ব্যাথায় অস্ফুটে স্বরে ‘আহ’ উচ্চারণ করে ছেড়ে দেয় আহির হাত৷ আহিও ছুটে যায় পড়ার টেবিলের সামনে। ড্রয়ার থেকে একটি মাঝারি আকারের ছুঁড়ি বের করে নিজের হাতের শিরার দিকে ইশারা করে ক্রোধান্বিত স্বরে বলে,
-‘ আমি যাবোনা আপনার সাথে আর যদি গায়ের জোর খাটিয়ে আমাকে নিয়ে যেতে চান এই মূহুর্তে নিজেকে শেষ করে দেবো আমি একদম শেষ করে দেবো ‘।
আঁতকে ওঠে হ্যাভেন৷ আহির চোখে, মুখে তাঁর প্রতি যে পরিমাণ আক্রোশ মূহুর্তেই যে কোন দূর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে মেয়েটা৷ কম যাতনা তো সহ্য করেনি মেয়েটা সে হিসেবে মেয়েটার সাহস সম্পর্কে,রাগ সম্পর্কে বেশ ধারণা রয়েছে তাঁর। গলা শুকিয়ে গেলো হ্যাভেনের। চিনচিনে এক ব্যাথা অনুভূত হলো বুকে। ভয়ে দিশেহারা হয়ে নিজের মাথার চুল নিজেই খামচে ধরলো। কয়েক সেকেন্ড মৌন থেকে দু’হাত জোর করে বললো,
-‘ না আহি এমন পাগলামো করো না। যেতে হবে না তোমায় জোর করবো না এই আমায় ছুঁয়েই কথা দিচ্ছি একটুও জোর করবো না। এই মেয়ে বোকা মেয়ে ছুঁড়ি সড়াও সড়াও বলছি ‘।
-‘ ছুঁড়ি তখনি সড়াবো যখন আপনি এ বাড়ির আঙিনা পাড় হবেন। বেরিয়ে যান, বেরিয়ে যান বলছি। আর কখনো আসবেন না আই ওয়ান্ট এ্যা ডিভোর্স। সো যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ডিভোর্স লেটার আমার চাই ‘।
ভয়ে ভয়ে হ্যাভেন দু’পা পিছিয়ে গেলো আতঙ্কিত হয়ে অসহায় মুখো ভঙ্গি তে বললো,
-‘ হ্যাঁ হ্যাঁ আমি চলে যাচ্ছি এই দেখো এখুনি চলে যাচ্ছি তুমি ওটা সড়াও আহি প্লিজ হাতে লেগে যাবে। এতো রাগতে হয় না আহি যাবেনা আমাকে বুঝিয়ে বললেই হতো। তোমার বাবার বাড়ি,আমার শ্বশুড় বাড়ি তুমি যতোদিন খুশি ততোদিন থাকো আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু ডিভোর্স চেয়ো না এটা পাবেনা ‘।
হ্যাভেন চলে যেতেই হাত থেকে ছুঁড়িটা নিচে পড়ে গেলো আহির। নিচে বসে পড়লো সে। বিরবির করে শুধু এটুকুই বললো, ‘সব নাটক, সব অভিনয় ‘ বলেই ডুঁকরে কেঁদে ওঠলো।
.
ফজরের আজানের সময়ই গেটে শব্দ পেয়েছিলো সাজি। ওঠানে দাঁড়িয়ে যখন জিগ্যেস করে ‘কে’? হ্যাভেন গলা খাকারি দিয়ে বলে ওঠে,’ আমি শাশুড়ী মা আপনার বড় মেয়ের জামাই ছোটটা বিয়ে দেননি তাই ছোট মেয়ের জামাই হওয়ার প্রশ্নই আসেনা ‘।
ভোরবেলা গেটের বাইরে থেকে এমন কথা শুনে বেশ ভ্যাবাচ্যাকাই খেয়ে গেলো সাজি। কতক্ষণ তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর যখন হ্যাভেন আবারো হালকা কেশে বলে ওঠলো,
-‘ কি শাশুড়ী মা মেয়ের জামাইকে আর কতক্ষণ গেটের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবেন? এমন জামাই আদর কিন্তু আমি পছন্দ করিনা আই ডোন্ট লাইক ইট শাশুড়ী মা ‘।
মূহুর্তেই হুঁশ ফিরে সাজির। ভয়ে জড়োসড়ো হয়েই এগিয়ে যায় আর যাইহোক এমন সব বাক্য শুনে তাঁর আর বুঝতে বাকি নেই গেটের ওপাশের মানুষ টা কে? গেট খুলতেই হ্যাভেন লম্বা এক সালাম দিলো সাজিকে। সাজি ভয়ে ভয়ে বলে ওঠলো,
-‘ বাবা তুমি এতো সকালে’?
-‘ বউ রাগ করে চলে এসেছে আরো অনেক আগেই আসা উচিত ছিলো বড্ড দেরি করে ফেললাম তাইনা শাশুড়ী মা ‘? বলেই রহস্যময় এক হাসি দিলো হ্যাভেন।
সাজি ভয়ার্ত কন্ঠেই বললো,
-‘ বাবা আমার মেয়েটা খুব অসুস্থ তুমি ওর সাথে রাগারাগি করোনা ‘।
-‘ আহ শাশুড়ী মা এতো বিচলিত হবেন না মেয়ে কোনরুমে আছে তাই বলুন। আর আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন এসেছি যখন বউ,শাশুড়ী, শ্বশুড়, শালিকা সবার মন জয় করেই ফিরবো ‘।
সাজি আর কিছু বলেনি আহির রুমে গিয়ে অনাকে ডেকে তুলে নিয়ে যায়। নামাজ পড়ে মেয়ে জামাইয়ের জন্য নাস্তা পানি রেডি করতে থাকে মা,মেয়ে মিলে। কিন্তু ভিতরে কি হচ্ছিল সেসব বিষয় তাঁদের অজানাই রয়ে যায়। হ্যাভেন যখন আহির রুম থেকে বেরিয়ে ওঠানে যায় অনা আর সাজি তখন রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে। অনা সালাম দেয় হ্যাভেনকে। দুঃশ্চিতার ছাপ স্পষ্ট হ্যাভেনের মুখে তবুও মুচকি হেসে সালাম ফেরায়। সাজি অনাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-‘ যা ওকে রুমে নিয়ে যা আমি নাস্তাপানি নিয়ে আসছি ‘।
-‘ সরি শাশুড়ী মা আজকে সময় নেই আজ আমি যাচ্ছি কিন্তু আবার আসবো বউ যখন এখানে আসতে তো হবেই শুধু আজ যেতে হবে আমায়। শ্বশুড় বাবা কে আমার সালাম দেবেন আজ আসি আসসালামু আলাইকুম ‘।
কাউকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে যায় হ্যাভেন। কিন্তু বিপদ ঘটে বাড়ির সামনে গাড়িতে ওঠার সময়। নামাজ পড়ে গ্রামের মুরুব্বিরা সহ আরো কয়েজন কম বয়সী ছেলেরা মসজিদ থেকে যাচ্ছিলো বাড়ির দিকে। হ্যাভেনকে দেখা মাত্রই তাঁরা বেশ চমকায় সেই সাথে ভয়ও পায়। তাঁদের অবস্থা দেখে হ্যাভেন গাড়িতে না ওঠে তাঁদের সামনে গিয়ে সালাম দেয়। সকলেই ভয়ের সাথে বেশ উত্তেজিতও হয়ে যায় সরাসরি এমপি সাহেবকে দেখে। মূহুর্তেই বেজে যায় হৈচৈ। অনা দ্রুত গিয়ে তাঁর বাবাকে ডেকে তুলে। সেও বেরিয়ে আসে বাইরে। হ্যাভেন তাঁদের সঙ্গে সৌজন্যতা বজায় রেখেই আলাপচারিতা শেষ করে। আজম খান বেরিয়ে আসতেই দেখে সকলেই হ্যাভেনকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সেই সাথে গ্রামের আরো বেশ মানুষ জন এসে ভীড় জমাচ্ছে।
আহির সঙ্গে হ্যাভেনের বিয়ের পর থেকে এলাকায় আজম খানের সম্মান দ্বিগুণ বেড়ে যায়। এলাকায় সকলেই তাঁকে বেশ কদর করে এখন। বাস স্ট্যান্ডে তাঁর ছোট দোকানটায়ও এখন সকাল, বিকাল লোকের ভীড় জমে। এলাকার বড় বড় লোকেরা গিয়ে সেখানে আড্ডা দেয় তাঁর সাথে ভাব জমায়। বেচাকেনাও বেড়ে গেছে দ্বিগুণ। শুধু তাই নয় অনার স্কুলেও বেশ সম্মান তাঁর। এমপির শ্বশুড় সে অনা এমপির শালিকা তাঁদের সকলে আলাদা চোখেই দেখে এখন। সেই সাথে ভয়ও পায়।
আজম খান এগিয়ে যেতেই হ্যাভেন সকলের সম্মুখে শ্বশুড়কে বেশ সম্মান দেয় সেই সাথে বলে,
-‘ যদিও এলাকার সব সমস্যা চেয়ারম্যান, মেম্বাররাই মেটায় এবং সকল বিষয়ে আমাকে অবগত করে তবুও যদি এলাকার কোন সমস্যার বিষয় আমার অজানা রয়ে যায় বা এমন কোন সমস্যা থাকে যা আপনারা আমার কাছে পৌঁছাতে চেয়েও পৌঁছাতে পারেননি তাহলে সেসব কাগজে,কলমে চিহ্নিত করে আমার শ্বশুড় মশাইয়ের হাতে দেবেন ইনশাআল্লাহ আমার নিকট পৌঁছে যাবে’।
সকলের সাথে বেশ ভাব বিনিময় করে এলাকার কিছু পোলাপান সেলফি তোলার জন্য অনুরোধ করায় বেশ কিছু সেলফিও তুলে নিলো। শেষে শ্বশুড় মশাইয়ের কাঁধ জরিয়েও কয়েকটা ছবি তুললো। ছবি তুলে দিলো এলাকারই একজন ছেলে। আজম খান হতবাক হয়ে শুধু চেয়ে রইলো হ্যাভেনের দিকে। যদিও হ্যাভেনকে মন থেকে তেমন পছন্দ করেন না তিনি। হ্যাভেনের ওপর তাঁর আক্রোশের শেষ নেই তবুও এ মূহুর্তে মনে হচ্ছে একজন এমপি হয়ে এমন সাধারণ, স্বাভাবিক আচরণ মহান না হলে কেউ করতে পারেনা। হয়তো রাজনৈতিক দিক থেকে ছেলেটি ভীষণই মহৎ। জনগণের প্রতি সত্যি তাঁর ভালোবাসা, দায়িত্ব একদম নিখুঁত। যদি আহির প্রতি এমন নিখুঁত আচরণ থাকতো তাহলে আজ হ্যাভেন তাঁর কাছে আল্লাহ তায়ালার পাঠানো কোন ফেরেশতার থেকে কম কিছু হতো না।
.
হুমায়ুন তালুকদার প্রচন্ত রাগারাগি করছেন। হ্যাভেন আর পাঁচ টা সাধারণ মানুষের মতো সাধারণ ভাবে চলাফেরা করতে পারেনা। সে আহির বাবার বাড়িতে গিয়েছে এতে তাঁর আপত্তি নেই। কিন্তু বিনা সিকিউরিটি তে সে কোন সাহসে বাড়ির বাইরে যায়। একবার মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েও কি তাঁর শিক্ষা হয়নি? আবার বিপদ না ঘটালে কি তাঁর শান্তি হবে না? এই বয়সে এতোটা সফলতা সে কি খুব সহজে পেয়ে গেছে? শুধু সফলতা পেয়েছে তা তো নয় তৈরি করেছে শত’শত শত্রুমহল। শত্রু পক্ষরা সবসময় উৎ পেতে আছে তাঁর ক্ষতি করার জন্য। আল্লাহ না করুক আবার সুযোগ পেলে প্রাণে না মেরে এমনি এমনি ছেড়ে দেবেনা। অথচ হ্যাভেন উন্মাদের মতো ছুটে গেছে আহির বাসায় ড্রাইভার কে পর্যন্ত নেয় নি। হ্যাভেন বাড়ি ফিরতেই বাবা,মা মিলে তিনভাইকেই শাসন করলো। এ মূহুর্তে তিনজন কে দেখে বোঝা যাবেনা তাঁরা তুখোড় রাজনীতিবিদ বরং মনে হবে তিনটা চোর চুরি করে ধরা খেয়েছে। হ্যারি,হিরার অপরাধ তাঁরা ভাইকে কোন আক্কেলে একা ছাড়লো। সব শেষে হ্যাভেন বেশ বুঝিয়ে শুনিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে উপরে চলে যায়। হ্যারি,হিরাও বড় মা, বড় বাবার চোখের সামনে থেকে সড়ে গিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচে।
______________
দুদিনের ব্যাস্ততা কাটিয়ে রাত আটটার দিকে আহির বাড়িতে যায় হ্যাভেন৷ যা পরিস্থিতি দিনের আলোতে যাওয়া সম্ভব নয়৷ সেদিন তাঁর যাওয়ার খবর চেয়ারম্যান,মেম্বার সহ এলাকার মাতবর গণরা শুনে ফোনের পর ফোন করে জ্বালিয়ে মেরেছে। ছাত্রদলের নেতারাও বেশ উৎসুক হয়ে আছে। একের পর এক দরখাস্ত দিচ্ছে এলাকায় একটি সভার আয়োজন করা হয়েছে সেখানে যেনো অবশ্যই সে যায়। কিন্তু সময়ের অভাবে আপাতত সম্ভব নয় সেই সাথে আহিকে নিয়েও সে বেশ দুঃশ্চিন্তায় ভুগছে । তাই রাত ছাড়া আর কোন অপশন তাঁর কাছে নেই।
গেট খোলা থাকায় সোজা বাড়িতে ঢুকে যায় হ্যাভেন। আহি বিছানার একপাশে বসে ফোন ঘাটাঘাটি করছে অনা চেয়ার,টেবিলে বসে পড়ছে। গতকালই আজম খান আহির জন্য নতুন মোবাইল ফোন কিনে এনেছে। সে ফোনেই সব কিছু সেটিং করছিলো আহি। হ্যাভেন সাজির সাথে কুশলাদি বিনিময় করে এক ব্যাগ ভর্তি বাজার আরেক ব্যাগ ভর্তি ফল সাজির দিকে এগিয়ে দিয়ে সোজা আহির রুমে ঢুকে গেলো। অনা বেশ জোরে শব্দ করে পড়ছিলো। হ্যাভেনকে দেখামাত্রই তাঁর পড়ার গতি কমে এলো। একসময় একদম চুপ হয়ে বলে ওঠলো,
-‘ আপু দুলাভাই ‘।
আহি চমকে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে বেশ ক্লান্ত শরীরে এসে দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়েছে হ্যাভেন। কেমন যেনো মায়া হলো তাঁর ইচ্ছে করলো ছুটে গিয়ে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে এসে সামনে ধরতে। গত দুবছর তো তাই করেছে শুরুটা বাঁধ্য হয়ে শেষটা দায়িত্বে থেকে মায়ায় পড়ে। পরোক্ষণেই নিজের ভিতর জ্বলতে থাকা আগুনটা যেনো ফুঁসে ওঠলো। চেঁচিয়ে উঠে বললো,
-‘ আবার? আবার এসেছেন আপনি? কেনো এসেছেন? বার বার কেনো আসছেন আপনি আমার কাছে? চলে যান বলছি, চলে যান ‘।
বলতে বলতেই বিছানা ছেড়ে ওঠে হ্যাভেনের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো আহি। হ্যাভেন মৃদু হেসে এক কদম এগিয়ে আহির দু’গালে আলতো ছুঁয়ে কপালে গভীর এক চুমু খেলো। মোহময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে মোহনীয় কন্ঠে বলে ওঠলো,
-‘ গত দুদিন যতোবার বাড়ির সদর দরজায় পা রেখেছি ততোবার এই চুম্বনকেই স্মরণ করেছি প্রিয়। গত দু’দিন যাবৎ অভূক্ত আমি শুধু খাবারে নয় তোমার যত্নের,তোমার ভালোবাসার ক্ষুধায় ক্ষুধার্ত হয়ে আছি আমি। তুমিময় পিপাসা পেয়েছে খুব। এই ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত অসহায় মানবের ক্ষুধা,তৃষ্ণা তুমি বিহীন কেউ মেটাতে পারবেনা প্রিয় ‘।
ক্রমশ অস্থিরতারা চেপে ধরলো আহিকে। প্রিয় ডাকটা শুনে হৃদস্পন্দন ঝড়ের গতিতে বেড়ে গেলো তাঁর। নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো হ্যাভেনের মুখপানে। বুকের ভিতর টা তাঁর দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। নিজেকে কোনভাবেই আটকাতে পারছেনা সে। তবুও জোর পূর্বক নিজেকে সংযত রাখলো অশ্রুসিক্ত নয়নেই বোনের দিকে একবার তাকালো। অনা আহির দৃষ্টি বুঝতে পেরে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। আহি এবার হ্যাভেনের দু’হাত বেশ শক্ত করে চেপে ধরে নিজের থেকে ছাড়িয়ে রুমের দরজাটা ঠাশ করে লাগিয়ে দিলো। হ্যাভেন অবাক হয়ে শুধুই চেয়ে রইলো আহির দিকে। আহি তাঁর সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে গা থেকে ওড়না খুলে মেঝেতে ফেলে দিলো। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে হ্যাভেনের একদম কাছে দাঁড়িয়ে হ্যাভেনের মায়াভরা, পবিত্র সে দৃষ্টিতে নিজের ক্রোধান্বিত দৃষ্টি মিলন করে বললো,
-‘ নিন ক্ষুধা মিটান, নিন তৃষ্ণা মিটান এটুকুই তো আপনার কাছে সব এটুকুর জন্যই তো ছুটে এসেছেন। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি আপনার মতো বড়লোকের ছেলে তো চাইলেও শত শত মেয়েকে বিছানায় আনতে পারে। তবুও এই আহিকেই কেনো বিছানায় প্রয়োজন পড়ছে সত্যি বুঝতে পারছিনা। আমার শরীরটাই আপনার প্রয়োজন তাইতো? তাহলে শরীরটুকু পেয়েই বিদায় হন ‘।
আহির কথা শেষ হতেই হ্যাভেন আচমকাই আহিকে এক ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিলো। মেঝেতে পড়ে থাকা ওড়নাটা বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে তুলে আহির দিকে ছুঁড়ে ফেললো। হিংস্র হয়ে আশেপাশে নজর বুলিয়ে পাশে থাকা চেয়ারটায় সাজোরে এক লাথি মেরে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।
চলবে…