তুমি আমার প্রেয়সী পর্ব-৪০

0
1770

#তুমি_আমার_প্রেয়সী
#পর্ব_৪০
#তাসনিম_জাহান_রিয়া

নোমান আর কিছু বলতে পারল না সামনে তাকিয়ে। হঠাৎ করে নোমানের এমন চুপ করে সামনে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকায়। বন্যাও গাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাই। বন্যার পিছনে জামান সাহেব দাঁড়িয়ে আছে। জামান সাহেব একবার বন্যার দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার নোমানের দিকে। নোমান ভয়ে ঢোক গিলছে। বন্যা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর ভাবছে, এখন কী হবে?

জামান সাহেব ধপ করে বন্যার পাশের চেয়ারে বসে পড়ে। নোমানের বুক ধড়ফড় ধড়ফড় করছে। এই লোকটাকে সে ভীষণ ভয় পায়। নোমান যতদিন ধরে এই লোকটাকে দেখছে কোনোদিন হাসতে দেখেনি। জীবনে কোনোদিন লোকটা হাসছে বলে নোমানের মনে হয় না। নোমানের সন্দেহ আছে আদোও লোকটা হাসতে জানে তো। জামান সাহেব গম্ভীর কন্ঠে বলে,

হঠাৎ থেমে গেলে কেনো? অসম্পূর্ণ কথাটা সম্পূর্ণ কর।

নোমান বন্যার দিকে একবার তাকাচ্ছে তো আরেকবার জামান সাহেবের দিকে। শুকনো গলায় দুই তিনটে ঢোক গিলে।

আমি…..

তুমি কী? সে যায়হোক তুমি আমার সম্পর্কে কী ভাবো না ভাবো? তাতে আমার কিচ্ছু আসে যায় না। এখন তো তোমাদের ভার্সিটিতে থাকার কথা। এখানে কী করছ?

আমি…….

জামান সাহেব রেগে বলেন, কী তখন থেকে আমি আমি করছ? তুমি কী তোতলা? নাকি কথা বলতে পার না? পড়াশোনা নিয়ে হেলাফেলা করা আমি সহ্য করতে পারি না। ঠিক ঠাক ক্যারিয়ার গড়া না পর্যন্ত তোমাদের ঘোরাঘুরি বন্ধ। ভার্সিটি দেখা হবে টুক টাক কথা বলবে এই যা। ঘোরাঘুরি করার অনেক সময় পাবে। এখন ক্যারিয়ার গড়ার সময়। ক্যারিয়ারে ফোকাস কর।

জামান সাহেব বন্যার হাত ধরে নিয়ে কফিশপ থেকে চলে যায়। নোমান নিস্পলক দৃষ্টিতে বন্যার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।

৮৫

কণা আর আদিয়াত ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। কণা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আর আদিয়াত রেলিংয়ে পিঠ ঠেকিয়ে কণার দিকে তাকিয়ে আছে। দমকা হাওয়ায় কণার চুলগুলো উড়ছে। কণার কিছু চুল আদিয়াতের চোখ মুখে আঁচড়ে পড়ছে। কণা আকাশের দিকে তাকিয়েই বলে,

আপনি যে এতদিন আমার থেকে দুরে ছিলেন। আমি যদি অন্য কারো প্রেমে পড়ে যেতাম।

তুমি আমার প্রেমে পড় নাই, তুমি আমার মায়ায় পড়েছ। এমন এক মায়ায় পড়েছ যার শেষ নেই। যে মায়ায় কেটে যায় চিরকাল, আটকে থাকা যায় অনন্তকাল।

যদি আপনার মায়া কাটিয়ে। আমি অন্য কারো মায়ায় পড়ে যেতাম তখন কী করতেন?

আমি তো তোমাকে বেঁধে রাখতে চায়নি কোনোদিন। আমি তো চেয়েছি তুমি যেনো মুক্ত পাখির মতো উড়ে বেড়াও।

সত্যিকারের ভালোবাসা মানুষকে মুক্ত করে, বেঁধে ফেলে না। ভালোবাসা আফিমের মতো, লোহার শিকল নয়। আপনার ভালোবাসার মানুষ খুব সম্ভবত আপনার কাছে ফিরে আসবে যদি আপনি তাকে মুক্ত করে দেন। লোহার শিকল দিয়ে ভালোবাসার মানুষকে আটকে রাখার চেষ্টা করলে পাখি খাঁচা ভেঙ্গে উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। শেকল পরানোর চেয়ে পাখিকে ভালোবাসার আফিম খাওয়ান বরং।

৮৬

কেটে গেছে তিন তিনটে মাস। সময় কারো জন্য থেমে থাকে না। সে নিজের মতোই বহমান। দিন যায় দিন আসে, সময়ের স্রোতে ভেসে,কেউ কাঁদে কেউ হাসে, তাতে কি যায় আসে। কারোর জন্য কারো জীবন থেমে থাকে না। তেমনি সবাই সবার জীবন নিয়ে ব্যস্ত। নোমান ব্যস্ত নিজের ক্যারিয়ার গড়তে। বন্যা অপেক্ষার প্রহর গুনছে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পাওয়ার। আভিয়ানও ব্যস্ত নিজের লাইফ নিয়ে। এদিকে ছোঁয়াকে আভিয়ান বেশি একটা পাত্তা দেয় না। পড়াশোনা, ভার্সিটি আর অফিস নিয়েই ব্যস্ত থাকে আভিয়ান। ছোঁয়ার দিকে তাকানোর সময়ও তার নেই। কণা আর আদিয়াতও তাদের জীবন নিয়ে সুখী আছে। আরুহি কণার অনেক ক্ষতি করতে চেয়েছিল কিন্তু আদিয়াতের জন্য পারেনি। কণাও অনেক খুশি আদিয়াতকে পেয়ে আদিয়াতের পরিবারকে পেয়ে। আদিয়াতের বাবা-মা কণাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসে। আদিয়াতের বাবা-মাকে পেয়ে কণার নিজের বাবা-মার অভাব পুরণ হয়েছে। মা-বাবার ভালোবাসার অভাব পুরণ হয়েছে।

________________

দীর্ঘ তিন মাস পর আজকে অহি রেসপন্স করছে। সাফাত অহির কপালে ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া দিয়ে যখন চলে যাচ্ছিল। তখন দেখে অহির হাতের আঙ্গুল নড়ছে। সাফাত দৌড়ে যায় ডক্টরকে নিয়ে আসতে। ততক্ষণে অহি চোখ খুলে তাকায়। ডক্টর এসে অহিকে চেকআপ করে। অহির চোখের সামনে ভেসে ওঠে কণার পাহাড় থেকে পড়ে যাওয়ার দৃশ্য। তার হাত ছেড়ে দিয়ে ধাক্কা দেওয়ার দৃশ্য। অহি কণা বলে চিৎকার করে ওঠে।

______________

তিন দিন পর

আজকে সাফাত আর অহি দেশে ফিরে যাচ্ছে। অহি এখনো জানে না কণার নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা। সাফাত জানায়নি কণার কথা অহিকে। ডক্টর বলেছে, এই সময় অহির উত্তেজিত হওয়া একদম ঠিক না। অহির ব্রেনের ওপর যাতে কোনো ভাবেই প্রেসার না পড়ে। তাই সাফাত অহিকে বলেছে কণা একদম ঠিক আছে।

সাফাত অহিকে মিথ্যা কথা বললেও। সেদিন সাফাত চিৎকার করে কেঁদেছিল কণার জন্য। কণাকে সে সত্যিই খুব ভালোবাসে। কণাকে সাফাত প্রথম দেখে থমকে গিয়েছিল। তার কাছে মনে হচ্ছিল কোনো ডল তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কণার মুখে ভাই ডাক শুনে তার কলিজা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকেই সে কারণে অকারণে কণার সাথে কথা বলতে যেতো। কণার সাথে কথা বললে তার মন একদম ভালো হয়ে যেতো।

৮৭

অহি বাসার ভিতরে প্রবেশ করেই কণা বলে চিৎকার করে ডাকতে থাকে। সাফাত অহির পিছন পিছন আসছে। অহির চিৎকারে সবাই বেরিয়ে আসে। আভিয়ান, মহুয়া জাহান, আফিফা বেগম, তিশান আহম্মেদ আর মিতু। সবাই অহিকে প্রাণ ভরে দেখছে। আজ কতগুলো দিনপর বাড়ির মেয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসছে। অহির চোখ শুধু কণাকেই খোঁজছে। আফিফা বেগম গিয়ে অহিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। অহির মুখে হাত বুলিয়ে অজস্র চুমু এঁকে দেয় অহির চোখ মুখে।

আম্মু কণা কোথায়? আমি এতক্ষণ ধরে চিৎকার করে কণাকে ডাকছি ও শুনতে পাচ্ছে না? কণা কী বাসায় নেই?

মহুয়া জাহান রেগে বলে, ঐ মেয়ের নাম মুখে নিবি না তুই। ঐ মেয়ে আমাদের কাছে মৃত।

কণা কী এমন করেছে যে, তোমাদের কাছে বেঁচে থাকতেও মারা গেলও?

কী করেছে তুই জানিস না?

না জানি না তো।

কণা তোকে পাহাড় থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে মারার চেষ্টা করেছিল।

এই কথা তোমাকে কে বলেছে?

ছোঁয়া।

বাহ বাহ কণা আমাকে মারার চেষ্টা করেছিল অথচ আমিই জানি না। কণা আমাকে মারার চেষ্টা করেনি আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল। সাফাত তুমি যে বলেছিল কণা বাসায় আছে। তাহলে কণা কোথায় আমাকে বলো?

ঐ দিনের পর থেকে আর কণাকে খোঁজে পাওয়া যায়নি। অনেক খোঁজার চেষ্টা করেছি। কিন্তু খোঁজে পায়নি। ইনফ্যাক্ট পাপা লোক লাগিয়ে এখনো খোঁজে চলেছে। পুলিশও কোনো খোঁজ দিতে পারে়নি।

অহি গিয়ে সাফাতের কলার ধরে বলে, সাফাত তুমি আমাকে মিথ্যা কেনো বললে? আমার কণা এখন কোথায় আছে? ও ঠিক আছে তো? ও আদোও বেঁচে আছে তো?

প্লিজ অহি এভাবে বলো না। আমি জানি কণার কিচ্ছু হয়নি। আমার বোন আমাকে বলেছিল আমাকে ছেড়ে কখনো কোথাও যাবে না।

তোমার কী মনে হয় সাফাত এত উঁচু পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে কেউ বেঁচে থাকতে পারে? যদি বেঁচে থাকত তাহলে তো এট লিস্ট আমাদের সাথে যোগাযোগ করত।

অহির কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি ওঠে গেছে। সাফাত আর আজকে কাঁদছে না। তিন মাসে তার জল শুকিয়ে গেছে। এখন কান্না পেলেও চোখ দিয়ে পানি আসে না। মহুয়া জাহান অহিকে জিঙ্গেস করে,

কণার কী হয়ছে? আর কে পাহাড় থেকে পড়ে গেছে?

ওহ তোমাকে তো একটা গুড নিউজ তো দেওয়ায় হয়নি। তুমি শুনলে খুশি হয়ে যাবে ছোট আম্মু। কণা পাহাড় থেকে পড়ে গেছে। হয়তো তোমার ইচ্ছা পুরণও হয়ে গেছে। কণা হয়তো তোমাকে মুক্তি দিয়ে আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে।

আফিফা বেগম অহির দুই বাহু চেপে ধরে ঝাকিয়ে বলে,

অহি তুই মজা করছিস তাই না? বল না কণার কিছু হয়নি? কণা আমাদের ছেড়ে যেতে পারে না।

মহুয়া জাহানের চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। অহি আফিফা বেগমের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মহুয়া জাহানের সামনে দাঁড়ায়।

বাহ ছোট আম্মু খবরটা শুনে তো দেখি ভীষণ খুশি হয়েছ। এতোই খুশি হয়েছ যে, খুশিতে কেঁদেয় দিয়েছ। ছোট আম্মু তোমার তো খুশিতে এখন পার্টি করা উচিত। এতোদিন পর তোমার মনের ইচ্ছে পুরণ হলো। তোমার গাড় থেকে একটা বোঝা নেমে গেলো।

অহি চুপ কর। এভাবে বলিস না।

কেমনে বলবো? তোমার চোখে পানি মানায় না। তোমার কান্না দেখে কুমিরের কান্না মনে হচ্ছে। এতোদিন তো কথায় কথায় কণাকে অভিশাপ দিতে। তুমি, ভাইয়া আর আব্বু কম অত্যাচার তো করোনি কণার ওপর। নিজের বাড়িতেও কাজের মেয়ের মতো থাকতে হয়েছে কণাকে। বাড়ির সমস্ত কাজ, রান্না-বান্না কাপড়চোপড় ধোয়া সবকিছু তুমি কণাকে দিয়ে করিয়েছ।

অহি কান্নার জন্য কথা বলতে পারছে না।

সারাজীবন তো একটা কাজের মেয়ের মতোই কণাকে ট্রিট করে গেলে। জীবনে তো কোনোদিন মায়ের মতো ভালোবাসনি। একা একাই বড় হয়েছে কণা। না পেয়েছে কোনোদিন মায়ের ভালোবাসা না পেয়েছে কোনদিন বাবার ভালোবাসা।

হাত তালি দিতে দিতে একটা লোক বাসার ভিতরে প্রবেশ করে। যাকে দেখে সবাই চমকে ওঠে।

চলবে……..