#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৪৯
আরিশার কথা শুনে আরমান শুকনো মুখে বিষম খেলো রীতিমতো।
আসলে আমার ঘুম খুব পাতলা, একটুতেই ভেঙে যায়।
আরমান কিছু না বলে চুপ করে রইলো।
হঠাৎ আরিশা দাঁতে জিহ্বা কেটে বললো, এই যা, সেই কখন থেকে বকবক করছি অথচ এখনো আপনার নামটাই জানা হলো না আমার। কী নাম আপনার ?
বরাবরের মতো আরমানের ছোট উত্তর, আরমান মাহমুদ।
ওয়াও নাইচ নেইম আর আমার নামের সাথে কিন্তু অনেকটা মিলও আছে।
আরমান ছোট ছোট চোখে তাকালো আরিশার দিকে আর বিনিময়ে আরিশা ফোকলা হাসলো। আরমান চোখ সরিয়ে নিলো।
আরিশা গলার আওয়াজ নিচু করে বললো, আপনাকে একটা সিক্রেট বলছি শুনুন, আপনার কাজে লাগবে।
আরমান আবার ভ্রু কুঁচকে তাকালো আরিশার দিকে আর আরিশা বললো, আমার পাপা হচ্ছে হিটলারের খালাতো ভাই। আস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে থেকে আমাকে বাংলাদেশের কালচারে চলতে বলে সবসময়। এটা কেমন কথা হলো বলুন তো আপনি ? আমাকে চালাকি করে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলো উনার বন্ধুর হ্যাংলা ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য। আমিও কম যাই নাকি, ঐ ছেলের এমন হাল করেছি জীবনে বিয়ের কথা মুখে নিতেও ভয় পাবে।
কথাটা শেষ করে ভাব নিয়ে চশমাটা আবার একটু নেড়েচেড়ে ঠিক করে নিলো। এদিকে আরিশার কথা শুধু আরমানের চোখ রসগোল্লার মতো হয়ে গেছে। মেয়েটাকে দেখে মনে হয় না এতোটা দুষ্টু হতে পারে।
এসব আপনাকে কেনো বলছি সেটা শুনুন। আপনি আমার পাপার আন্ডারে কাজ করবেন তাই আগেই সাবধান করে দিলাম।
আরিশা নিজের সীটে আয়েশ করে বসলো আর আরমান অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। নিজের বাবাকে কেউ হিটলারের খালাতো ভাই বলতে পারে আরমানের ধারণা ছিলো না।
৫৮.
মিনি ছাঁদে বসে আছে ইমা, ইয়াদ এখনো বাসায় ফিরেনি, বেশ ব্যস্ত সময় পার করছে সে। ইমার মন ভালো নেই আজ। এয়ারপোর্ট থেকে আসার পর থেকে একটুও স্বস্তি পায়নি। বারবার আরমানের ব্যথিত চোখ আর ছাহেরা বেগমের কান্না চোখে ভাসছে। ইমার মনে হচ্ছে আরমান চলে যাওয়ার জন্য সেই দায়ী।
ইমা উঠে গিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ালো আকাশের দিকে তাকিয়ে আর বিড়বিড় করে বললো, মণি নিজের কর্মের ফল সবাইকেই ভোগ করতে হয়। মায়ের কাছ থেকে তুমি আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলে আজ ভাগ্যই তোমার থেকে তোমার আদরের ছেলেকে দূরে সরিয়ে দিলো।
ইমা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো চুপচাপ। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরতেই ইমা চমকে উঠে মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখে ইয়াদ। ইমাকে তাকাতে দেখে ইয়াদ ভ্রু নাচিয়ে মুচকি হাঁসলো। ইমা আবার সামনে তাকালো।
ইয়াদ ইমার কাঁধে থুতনি রেখে বললো, কী হয়েছে আমার বউটার ?
ইমা ইয়াদের প্রশ্ন উপেক্ষা করে বললো, আপনি কখন আসলেন ?
আপনি যখন ভাবনায় বিভোর ছিলেন তখনই এসেছি ম্যাম। তোমাকে এখানে বসে থাকতে দেখে ফ্রেশ হয়ে তারপর আসলাম।
ইমা ইয়াদের হাত ছাড়িয়ে বললো, চলুন আপনার খাবার দিচ্ছি।
ইয়াদ ইমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, আগে বলো তোমার কী হয়েছে, এতো মনমরা কেনো তুমি ?
আরমান ভাইয়া আজ চলে গেছে, খালামুনি খুব কান্নাকাটি করছিলেন আর এখনও করছে। কথার ফোন এসেছিলো একটু আগে।
ইয়াদ বললো, না গেলেই তো পারতেন হঠাৎ এভাবে চলে কেনো গেলেন ?
ইমা ইয়াদের প্রশ্ন সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে রুমের দিকে যেতে যেতে বললো, রাত অনেক হয়েছে আপনি খাবেন চলুন।
ইয়াদ আর কথা বাড়ালো না চুপচাপ ইমার পেছনে যেতে লাগলো। খাবার টেবিলেও ইমা একদমই খাচ্ছিলো না শুধু খাবার নাড়াচাড়া করছে। ইয়াদ সেটা খেয়াল করে নিজেই এক লোকমা খাবার ইমার সামনে ধরলো। ইমা একবার ইয়াদের দিকে তাকিয়ে খাবারটা মুখে নিলো। ইমার মুখে খাবার তুলে দিয়ে ইয়াদ ইমার সামনে হা করলো। ইয়াদের কান্ড দেখে ইমা মুচকি হেঁসে ইয়াদের মুখে খাবার তুলে দিলো। এরপর একে অপরকে খাইয়ে দিতে লাগলো। খাওয়া শেষে ইয়াদ রুমে চলে গেলো আর ইমা সব গুছিয়ে রুমে আসলো। ইয়াদকে রুমে না দেখে মিনি ছাঁদে তাকিয়ে ইয়াদকে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো।
কী ব্যাপার এখন আবার এখানে এসে দাঁড়ালেন কেনো, রাত হয়েছে তো ঘুমাবেন চলুন।
ইমা কথাটা বলে চলে আসতে গেলে ইয়াদ হাত টেনে ধরলো ইমার।
ইমা পেছনে ফিরে তাকিয়ে বললো, কী হয়েছে ?
সেটা তো তুমি বলবে।
ইমা অবাক হয়ে বললো, মানে ?
ইমা আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম আমার সামনে তোমাকে স্বচ্ছ কাঁচের মতো দেখতে চাই। কিন্তু আজ তোমাকে আমার কাছে আয়নার মতো মনে হচ্ছে। যার আড়ালে ভিন্ন কিছুও থাকতে পারে আমার অজানা। ইমা আমাকেও বলবে না কী হয়েছে তোমার ?
ইমা ইয়াদের দিকে এগিয়ে গেলো। ইয়াদের বুকে মাথা রেখে দাঁড়ালো, ইয়াদ আলতো করে ইমার মাথায় হাত রাখলো।
সেদিন কফিশপে আরমান ভাইয়া আমাকে বলেছিলো সে নাকি আমাকে ভালোবাসে।
ইয়াদ চমকে উঠলো, একটু বেশি অবাক হলো ইমার কথা শুনে। কারণ ইমার আগে বলা কথা অনুযায়ী আরমান তাকে সহ্যও করতে পারতো না।
ইমা আবার বললো, যে মানুষটা আমাকে সহ্য করতে পারে না তার মুখে হঠাৎ এমন কথা শুনে আমি বিশ্বাস করিনি। তার কথা শুনে এটাও মনে হয়েছিলো আমার জন্যই সে এখান থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। কিছুই মানতে পারিনি আমি তাই আপনাকেও বলিনি। কিন্তু আজ যাওয়ার সময় ভাইয়ার চোখ যেটা বলেছে সেটা মিথ্যা হতে পারে না। এখন আমার মনে হচ্ছে আমার জন্য একটা মায়ের থেকে তার সন্তান দূরে চলে গেছে। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে নিজের কাছে।
ইয়াদ ইমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, এখানে তোমার কোনো দোষ নেই। হয়তো ভাগ্যই এমন ছিলো তাই হয়েছে। আর একটা কথা মনে রেখো প্রকৃতি কখনো শূন্যতা পছন্দ করে না। আরমান ভাইয়ার জীবনেও একদিন তোমার শূন্যতা কেউ পূরণ করে দিবে। হয়তো সেদিন তার মায়ের কাছেও ফিরে আসবে। এসবের জন্য নিজেকে দায়ী করে কষ্ট পেয়ো না। তোমার মনি তোমার আর মায়ের সাথে যে অন্যায় করেছে তার শাস্তিও হয়তো এভাবেই পাওনা ছিলো। এসব চিন্তা মাথা থেকে ছেড়ে ফেলো, এখন চলো ঘুমাবে।
রুমে এসে ইয়াদ ইমাকে বুকে নিয়ে শুয়ে পড়লো, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। ইমাও ইয়াদের বুকে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। এতোক্ষণে বিষন্নতা এক নিমিষে কেটে গেলো তার। সব মন খারাপ আর বিষন্নতার মেডিসিন যেনো এটাই।
৫৯.
ইয়াবা আজ কোথায় গিয়েছিলে ভাবির সাথে ?
আরমান স্যারকে এয়ারপোর্টে ছাড়তে গিয়েছিলো ভাবি আর ভাইয়া আমাকে বলেছিলো ভাবির সাথে যেতে, সেখানেই গিয়েছিলাম।
রেহান মুচকি হাসার চেষ্টা করে বললো, তারজন্যই বুঝি আজ মনটা এতো খারাপ আমার ইয়াবার ?
ইয়ানা মাথা তুলে রেহানের দিকে তাকিয়ে বললো, আমার কোথায় মন খারাপ ?
রেহান মুচকি হেঁসে বললো, নয় বুঝি ?
ইয়ানা আবার রেহানের বুকে মাথা রেখে বললো, একদমই না।
রেহান আর কিছু বললো না চুপচাপ শুয়ে রইলো। আজ ইয়ানার কেনো যেনো আরমানের জন্য খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে না। তখনই খারাপ লেগেছিলো কিন্তু সেটা বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। আজ ইয়ানা একটা কথা খুব ভালোভাবে বুঝে গেছে। অবহেলা আর অযত্নে ভালোবাসাটা একসময় মরে যায়। ইয়ানার মনে আরমানের জায়গাটা অযত্ন আর অবহেলায় চাপা পড়ে গেছে। সেখানে এখন কেবল রেহানের রাজত্ব। রেহানের ভালোবাসার কাছে হার মেনে ইয়ানা বাঁধ্য হয়েছে তাকে ভালোবাসতে। ইয়ানা মাথাটা একটু উঁচু করে টুপ করে রেহানের গালে একটা কিস করলো। ইয়ানার কান্ড দেখে রেহান মুচকি হাঁসলো।
কী ব্যাপার ম্যাডাম, আজ না চাইতেই বৃষ্টি কীভাবে এলো বলুন তো ?
ইয়ানা ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে বললো, কেনো ভালো লাগেনি ? ঠিক আছে ফেরত নিয়ে নিচ্ছি।
রেহান দুষ্টু হেঁসে বললো, বললেই ফেরত নেওয়া হয়ে গেলো নাকি ? দাড়াও আমি ফেরত দিচ্ছি সুদ সমেত।
ইয়ানা কিছু বুঝার আগেই রেহান ইয়ানার দুগালে দুটো কিস করে দিলো। ইয়ানা বাঁকা চোখে তাকালো আর রেহান হা হা করে হাসতে লাগলো। ইয়ানাও মুচকি হেঁসে রেহানের বুকে মুখ লুকালো চুপটি করে।
,,,,,
ইশান একটার পর একটা কল দিয়েই যাচ্ছে কিন্তু কথা রিসিভ করছে না আর কেটেও দিচ্ছে না। এদিকে ইশানের পাগল প্রায় অবস্থা কথার এমন ইগনোর দেখে। কথা মনমরা ছিলো তাতে ইশান একটু বিরক্ত হয়ে বলেছিলো এভাবে মুখ গোমড়া করে থেকো না, ভালো লাগে না। এটা নিয়ে দুজনের ছোট খাটো একটা যুদ্ধ হয়ে গিয়েছে।
কল দিতে দিতে ইশান নিজের মনে বিড়বিড় করে বললো, মিস্টার ইশান আরো করো পিচ্চিদের সাথে প্রেম। কথায় কথায় গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। এ খোদা তুমি উদ্ধার করো এই বিপদ থেকে।
ও তার মানে আমি আপনার জন্য বিপদ হয়ে গেছি এখন, তাই না ?
কপাল খারাপ থাকতে যা হয় আর কী। ইশান ফোন কানে নিয়ে বকবক করছে আর কথা কখন রিসিভ করেছে টেরই পায়নি। ইশানের শেষের কথা শুনে কথা তো আরো রেগে বোম হয়ে গেছে।
এখন তো আমি পুরনো হয়ে গেছি, আমাকে আর ভালো লাগে না ।
ইশান অবাক হয়ে বললো, যা বাবা, এই তো সেদিন একসেপ্ট করলে। পুরনো হলে কখন আবার ?
আপনি আর কথা বলবেন না আমার সাথে, কলও দিবেন না বলে দিলাম।
ইশানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কথা ফোন কেটে দিলো। ইশান হ্যালো হ্যালো করে বুঝতে পারলো অনেক আগেই কেটে দেওয়া হয়েছে। ইশান নিজের চুল টানতে লাগলো৷ কথা আগের মতো আর গম্ভীর নেই, দিন দিন যেনো চঞ্চল হয়ে উঠছে ইশানের সাথে থেকে। ইশান একসময় খুব করে চাইতো কথা সবসময় বকবক করুক তার সাথে ছোট ছোট ঝগড়া করুক। কিন্তু এখন যখন এসব করছে তখন মনে হচ্ছে আগের কথাই ভালো ছিলো তার জন্য। এখন তো তার জীবন ধনেপাতা করে দিচ্ছে। ইশান গাড়ির চাবি নিয়ে বের হয়ে গেলো। এখন এভাবেই ম্যাডামের রাগ ভাঙাতে হবে তার। বাড়ির সামনে গিয়ে কল দিলে কথা রিসিভ করেই মারলো এক ঝাড়ি।
উত্তরে ইশান ছোট করে বললো, নিচে আসো একটু।
এটুকু বলেই কল কাট করে দিলো৷ কথা কিছু বুঝতে না পেরে কিছু সময় হা করে রইলো। তারপর দরজা খোলে উঁকি মেরে দেখলো কেউ নেই। তাই পা টিপে টিপে বের হয়ে এলো বাসা থেকে। গেইটের কাছে বসে দারোয়ান ঘুমে ঝিমাচ্ছে তাই বের হতে প্রবলেম হলো না। ইশান একটা টেডিবিয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাতে লেখা সরি আর সাথে অনেকগুলো চকলেট।
ইশান একহাতে কান ধরে বললো, সব দোষ আমার, সরি সরি সরি আর হবে না।
কথা কিছু না বলে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো ইশানকে আর ইশান মুচকি হাঁসলো।
৬০.
পুরো জার্নি আরমানের মাথা খেয়ে আরিশার স্বস্তি হয়নি এখনো আরমানের পিছু ছাড়ছে না সে।
আরমান বিরক্ত হয়ে বললো, আপনি এবার তো নিজের গন্তব্যে জান।
আরিশা চশমা ঠিক করে আশেপাশে তাকিয়ে বললো, আমার জন্য গাড়ি চলে এসেছে আপনি চলুন আমার সাথে। একই জায়গায় তো যাবো।
আরমান সামনে তাকিয়ে বললো, আমার জন্য অফিস থেকে গাড়ি পাঠানো হবে।
আরিশা জোর গলায় বললো, গাড়ি আসবে আর এসেছে এর পার্থক্য বুঝতে পারছেন না ? এক জায়গায় যেহেতু যাবো তাহলে সাথে গেলে কী প্রবলেম বলুন তো ? আপনাদের অফিস থেকে একটা এপার্টমেন্টেই সবার ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে। আমাদের অবশ্য একটা নিজস্ব বাড়ি আছে তবে পাপার অফিসে যাওয়ার সুবিধার্থে অফিসের দেওয়া ফ্ল্যাটেই থাকি আমরা।
আরমান কী করবে বুঝতে পারছে না। এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার পরও আরিশা কিছুতেই তার পিছু ছাড়ছে না।
আরিশা এবার বিরক্ত হয়ে আরমানের হাত টেনে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে বললো, চলুন তো চুপচাপ। আমি পাপাকে বলে দিচ্ছি অফিস থেকে আর গাড়ি পাঠাতে হবে না।
আরমানের চেহারাটা দেখার মতো হয়েছে। ভয়ে যার সাথে কেউ কথা বলতে পারে না। এই মেয়ের এতো সাহস তার হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে। আরমানের কথা বন্ধ হয়ে গেছে আরিশার কান্ডকারখানা দেখে।
আরিশা নিজের পাপাকে কল দিয়ে বললো, পাপা তোমাদের অফিস থেকে এয়ারপোর্টে যে গাড়ি পাঠানোর কথা ছিলো সেটা ক্যান্সেল করে দাও। মিস্টার আরমান আর আমি একই ফ্লাইটে এসেছি আর এক গাড়িতেই আসছি।
আরিশা নিজের বাবাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিলো একা বকবক করেই। আরমান এই মেয়েকে যতো দেখছে ততই অবাক হচ্ছে।
আরিশা আরমানের দিকে তাকিয়ে আবার বললো, আমি এতো ভালো বাংলা কীভাবে বলতে পারি জানেন ? আমাদের বাসায় বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় কথা বলা সম্পূর্ণ নিষেধ আর তার ক্রেডিট পুরোটাই আমার পাপার পাওনা।
আরমানের আরিশার কথায় কোনো মনোযোগ নেই সে বাইরে তাকিয়ে নতুন এক দেশ দেখছে। রাতের অন্ধকার আড়াল করতে সারি বাঁধা লাইটের বহর। কোনো মিল নেই বাংলাদেশের সাথে। রাস্তায় জ্যাম, হর্ণের আওয়াজ, মানুষের চেঁচামেচি, রাস্তার পাশের নর্দমা স্তুপের দম বন্ধ করা বাজে গন্ধ কিছুই নেই এখানে। তবু আরমানের ভালো লাগছে না এই শহর। এই শহরে তার কোনো আপনজন নেই। মা বলে ডাকতেই কেউ দৌড়ে আসবে না তার কথা শোনার জন্য। এখানে সে সম্পূর্ণ একা কেউ নেই তার পাশে। ছেলে না হয়ে মেয়ে হলে হয়তো হাউমাউ করে কেঁদে বুকের ভারী ভাবটা একটু কমাতে পারতো কিন্তু সেটাও সম্ভব নয়। কারণ সে ছেলে আর ছেলেদের কাঁদতে নেই। বুকের ভেতরটা পুড়ে ছারখার হয়ে গেলেও ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে তুলতে হয় তাদের। আরিশা খেয়াল করলো আরমান বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। তাই বাইরে যা দেখা যাচ্ছে তার ছোট খাটো বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছে আরিশা। আরমান আদৌও সেসব শুনছে কিনা বুঝার উপায় নেই।
অনেক ঝড় ঝাপটা মোকাবেলা করে আরমান অফিসের দেওয়া ফ্ল্যাটে পৌঁছালো। আরমানের ফ্ল্যাট পাঁচ তলায় আর আরিশাদের ফ্ল্যাট সাত তলায়। আরমান আরিশাকে কিছু না বলেই লিফট থেকে নেমে গেলো আর আরিশা তা দেখে মুখ গোমড়া করলো কিন্তু পরক্ষণে কিছু ভেবে মুচকি হাঁসলো। আরমান নিজের রুমে গিয়ে, ওয়াশরুম থেকে লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বেডে শুয়ে পড়লো ধপাস করে। ফ্ল্যাটে দুটো বেডরুম, প্রত্যেক রুমে আলাদা ওয়াশরুম, একটা ড্রয়িংরুম আর সাথেই কিচেন। আরমান বেডে শোয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লো ক্লান্তিতে। এদিকে আরিশা কয়েকবার কলিংবেল বাজালে ঘুমঘুম চোখে তার মা দরজা খোলে দিলো। ভেতরে গিয়ে আরিশা মম বলে চিৎকার করে জড়িয়ে ধরলো।
আশা ঘুমঘুম গলায় বলে উঠলো, এমন চিৎকার চেচামেচি না করে রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়। তোর পাপা অনেক রেগে আছে সকালে কথা হবে।
আরিশা গোমড়া মুখে দাঁড়িয়ে রইলো আর তার মা নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গিয়ে আবার পেছন ফিরে বললো, কিছু খাবি, ক্ষুধা পেয়েছে ?
আরিশা গোমড়া মুখে বললো, না খেয়েছি।
ওকে, তাহলে ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়।
সকালের ব্রেকফাস্ট টেবিলে থমথমে মুখে বসে আছে আবির রায়হান। অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বসে আছে আরিশা।
থমথমে গলায় আবির বললো, তুমি রাকিবকে হেনস্তা করেছো কেনো ?
আমার তাকে পছন্দ হয়নি।
স্পষ্ট গলায় আরিশার উত্তর দেখে আবির বললো, তুমি এ পর্যন্ত কতগুলো ছেলেকে রিজেক্ট করেছো তার হিসাব আছে তোমার কাছে ?
আর করবো না।
আবির অবাক হয়ে বললো, মানে ?
তোমার অফিসে নতুন জয়েন করার জন্য যে গতরাতে আমার সাথে ফ্লাইটে এসেছে। He is much better than Rakib.
আবির রেগে বললো, চেনা নেই জানা নেই একদিনে তাকে পছন্দ হয়ে গেলো তোমার ?
প্রত্যেকবার তুমি যে কথাটা আমাকে বলো আজ আমি সেটা তোমাকে বলছি, সময় নাও চেনো জানো তোমার অফিসেই তো জয়েন করবে। তুমি সময় নাও আমার প্রবলেম নেই। তাকে আমার যতটুকু চেনার প্রয়োজন ছিলো গতকালই চিনে নিয়েছি এবার তোমার পালা।
আরিশা কথা শেষ করে নিজের রুমে চলে গেলো আর আবির রাগে বোম হয়ে বসে রইলো। আবিরের প্রবলেম হচ্ছে মেয়েকে আস্ট্রেলিয়ায় বড় করে মেয়ের উপর আচরণ করে বাংলাদেশের। না দেখে না জেনেই আরমান সম্পর্কে একটা নেগেটিভ ধারণা তৈরি হয়ে গেলো আবিরের মনে। মিসেস আশা নিরব দর্শক মাত্র। আরিশার ঘুম শেষ হয়নি, জরুরি তলবে ডাইনিং টেবিলে হাজির হতে হয়েছিলো৷ বেডে শুয়ে একবার আরমানকে কল্পনা করে মুচকি হেঁসে চোখ বন্ধ করে নিলো।
চলবে,,,,