আসক্তি পর্ব-২৮

0
1554

#আসক্তি
পর্বঃ২৮
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

“পাখি প্লিজ লিসেন টু মি,আগে তুমি চুপ করো।তোমার সমস্যা হচ্ছে ড্যাম ইট!আমায় একটু সময় দাও আমি সবটা বুঝিয়ে বলব তোমায়”
“এতোদিন, এএেতোদিন কেন বলেন নি কিছু। সেদিন রাতে কেন বললেন না কিছু?কেন আমার জীবনটা এতো জটিল করে দিলেন”-পেট চেপে ধরে চোখ মুখ কুচকে বলে পাখি।দম বন্ধ হয়ে আসছে পাখির।চোখে সবটাই অন্ধকার লাগছে।মাথা চক্কর দিচ্ছে বার বার। চোখ বন্ধ করে শরীরের পুরো ভার হাওয়ার উপর ছেড়ে দেয়।শান দ্রুত এসে জড়িয়ে নেয় পাখিকে।চোখ আস্তে আস্তে খুলে শানের চোখের দিকে চেয়ে থাকে পাখি।

“প্লিজ পাখি প্লিজ,লেট মি ক্লারিফাই। তারপর যদি মনে হয় আমাকে বিশ্বাস করে ঠকেছো তো তার জন্যে যা শাস্তি দেবে মেনে নেব”-কথাটা বলতে শানের কয়েকবার বাধল।ভয় হচ্ছে সবটা বিশ্বাস করবে তো পাখি!
পাখি দুহাতে গলা জড়িয়ে দূর্বল কন্ঠে বলে,”আমি তো আপনাকেই বিশ্বাস করতে চাই সার্জন সাহেব।তাহলে কেন নীরার প্রসঙ্গে নিশ্চুপ থাকলেন আপনি এবং আপনার পরিবার?”
শান পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেয়।পাখি তৃষ্ণার্ত কাকের মতো পানিটা খেয়ে শরীরে সামান্য শক্তি অর্জন করে। বিছানায় বসে মেঝের দিকে চেয়ে থাকে একদৃষ্টে।

পাখি না পারছে শানকে অবিশ্বাস করতে না পারছে নীরার কথাগুলো অবিশ্বাস করতে।বিশ্বাসের এই পরীক্ষায় ঝুলন্ত অবস্থায় পরে আছে ।শান মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পাখির হাত দুটো নিজের হাতে নেয়।অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে পাখির দিকে।পাখি তার নজরে নজর রেখে বলে,”আগে আমায় সবটা বলবেন তারপর ছুঁইবেন আমায়।আমি আপনাকে বিশ্বাস করি সার্জন সাহেব।কিন্তু নীরার কথাকে অবিশ্বাস করতেও পারছি না।বুঝতে পেরেছেন আমি কতোটা যন্ত্রনায় আছি!”
শান লম্বা লম্বা কয়েকটা নিঃশ্বাস ছেড়ে পাখিকে বলে,”চলো….”
“ককোথায়?”
শান পাখির প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে হাত টেনে গাড়ির কাছে চলে যায়।গাড়ি ড্রাইভ করে চলে আসে শহর থেকে অনেক টা দূরে।ঘন্টা দুয়েকের মতো সময় পেরিয়ে গাড়ি থামে নির্জন, নিরিবিলি এক বিশাল বিলের কাছে।দূর দূরান্তে কোন বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে না,মানুষজন তো দূরের কথা।বিলের মাঝে হাজার পদ্মফুলের মেলা।প্রাণ যেন জুড়িয়ে যায়।
সারা রাস্তা পাখি শুধু কেঁদেই এসেছে। শানও আগ বাড়িয়ে কোন কথা বলে নি।গাড়ি থেকে নেমে চারিদিকে চেয়ে দেখে দৃষ্টি আজ অসীমে।শীরশীরে বাতাস, হালকা মেঘ আকাশে।নিচে লাল পদ্মের সমারহ।চোখ জুড়িয়ে যায় পাখির।নিজের সাথে ঘটা কিছুক্ষন আগের সব ঘটনা বেমালুম ভুলে যায় সে।শান অপলকে চেয়ে দেখে পাখিকে।

বিল থেকে কয়েকটা পদ্ম এনে হাতে তুলে দেয় পাখির হাতে।শানের কাজে সম্বিৎ ফেরে চোখ সরিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় পাখি। শান মুচকি হেসে ফুল গুলো গাড়িতে রাখে।
“আমার একটা অতীত ছিলো পাখি।আমি জানি কথাগুলো বলা তোমায় জরুরী ছিলো।বিশ্বাস করো কয়েকবার বলতেও চেয়েছিলাম কিন্তু ভয় হতো, হ্যা ভয় হতো যদি আমায় মেনে না নাও!কারণ ততোদিনে আমি তোমার মায়ায় পরে গেছি। আটকে গেছি তোমার ভালোবাসার শিকলে।আর সময়ও পাই নি সবটা বলার”-শান গড়গড় করে কথা গুলো বলে প্যান্টের পকেটে দুহাত গুঁজে বিলের দিকে চেয়ে থাকে।পাখি অপলকে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে।

শান পাখির কোন প্রতিক্রিয়া না পেয়ে আবার বলে,”ঢাকা মেডিকেলে এডমিশন নেয়ার দুই সেমিস্টার পর নীরার সাথে পরিচয়।ওদের ডিপার্টমেন্ট আলাদা ছিলো। তাই হয়ত এর আগে দেখা হয় নি।কোন একদিন লাইব্রেরীতে ওকে দেখি আমি। কলেজে আমার দেখা সেরা সুন্দরী নারী ছিলো ও।প্রথম দেখায় একটু ভালো লেগে যায়।বুঝতে পারি নি ঐ সৌন্দর্যের আড়ালে কতো কুৎসিত একটা নারীমন লুকায়িত ছিলো।আমার চোখে নিজের জন্যে ভালো লাগাটা নীরা বুঝতে পেরেছিলো।তারই ফায়দা লুটেছিলো সে।খোঁজ নিয়ে জানতে পারি সুন্দরী হওয়ায় অনেক ছেলের ক্রাশ ছিলো ।এদিকে কলেজে আমার লুক, দুই সেমিস্টারের রেজাল্ট টপে ছিলো বলে সবার নজরে পড়তাম।তারউপর কলেজে আমার একটা পাওয়ার ছিলো, কারণ উপাচার্য্য বাবার প্রিয় বন্ধু ছিলো।

আমার ব্যপারে নীরা এসব খোঁজ খবর নেয়।এরপর সময়ে অসময়ে আমার সামনে আসা, মুচকি হেসে ইম্প্রেস করা,নতুন নতুন লুকে নতুন ফ্যাশনে আমার কাছে ধরা দিতো।নীরার এসব কর্মকাণ্ড আমার পরে আর ভালো লাগছিলো না।কেমন যেন ছ্যাচরামি লাগছিলো।এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতাম”-শান এটুকু বলে তাকিয়ে দেখে পাখির দিকে।
নিজের স্বামীর এসব কথা কোন মেয়েই সহ্য করবে না পাখিও ব্যতিক্রম নয়।ঢোক গিলে চোখের পানি মুছে নেয়।

শান দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলে,”কিছুদিন পর বাড়ি থেকে মা ফোন করে, ভাইয়া নাকি দিনাজপুর থেকে মেয়ে ভাগিয়ে বিয়ে করেছে।বাড়ি যেতে হবে তাড়াতাড়ি।হোস্টেল বন্ধ তাই দ্রুতই বাড়ি এলাম।সত্যিই ফয়েজ ভাইয়া বিয়ে করেছে।ততোদিনে সবটা মেনে নেয়া ছাড়া কোন উপায় ছিলো না।পরে ধুমধাম করে ভাইয়ার বিয়ের অনুষ্ঠান করি।বিয়েতে চোখ আটকে যায় লাল গাউন পরিহিতা একটা মেয়ের উপর।লাল টুকটুকে সাজে লাল পরী লাগছিলো।চোখ সরাতে গিয়ে বুঝতে পারলাম মেয়েটা আমার পরিচিত।কলেজের সেই মেয়ে নীরা।খোঁজ নিয়ে জানতে পারি নীরা ভাইয়ার একমাত্র শ্যালিকা। মনের মাঝে অজানা ভালো লাগা ছেঁয়ে যায়।পারিপার্শ্বিকতা আর তার সেদিনের রূপ দেখে আমি প্রেমে পড়ে যাই। বিয়ের আয়োজনের মাঝেই নীরাও বুঝতে পারে আমরা আত্মীয়।এরপর ফোন নম্বরের আদান-প্রদান।কলেজের ছুটি শেষ হলে দুজনেই চলে আসি ঢাকায়।বেশ জমে উঠেছিলো আমার প্রেম…..”

“এতো গভীরে যেতে হবে না, কতো জমেছিলো তাও জানতে চাচ্ছি না”-কাঁদো কাঁদো গলায় বলে পাখি।শান থেমে যায়।

কিছুক্ষন থেমে আবার বলে,”কিছুদিন যাওয়ার পর বুঝতে পারি নীরা আগের মতো নেই।আগের মতো কেয়ার নেই,ফোনে কথা বলতে চায় না।শুধু পড়াশুনার দোহাই দিয়ে ফোন কেটে দিতো।আবার কিছুদিন পর সবটা আগের মতো ঠিক হয়ে যেত।কলেজে আমার ক্ষমতাটার অপব্যবহারও করত মাঝে মাঝে।আমি শুনতাম কিন্তু কিছু বলতে পারতাম না।এভাবে সময় দ্রুত চলে যেতে লাগল।বুঝতে পারলাম তৃতীয় সেমিস্টারের একদম পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি এদিকে ততোদিনে আমার পড়াশুনার বারো বেজে গেছে।সারাক্ষন শুধু নীরার কথা ভাবতাম, কখন কথা বলব? কখন এক নজর দেখব! এসবই ছিলো আমার ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। ফলাফল কোনমতে টেনেটুনে পাশ করলাম।আর টপ স্থান লাভ করলো আমার বেষ্টফ্রেন্ড নাবিদ।হ্যা সেই নাবিদ যার ওয়াইফ কিছুদিন আগে পালিয়ে গেছিলো। লজ্জায় কারোর সামনে যেতে পারলাম না।শুরু করলাম রাত জেগে আগের ন্যায় পড়াশুনা করা।নাবিদ এসব দেখে কেমন যেন অবাক হতে লাগলো।একদিন পড়ার সময়ে রাত তখন ২ টা বাজে হঠাৎ নীরা ফোন করে বলছে তার সাথে এখন দেখা করতে হবে রাইট নাউ।আমি স্ট্রিক্টলি বলে দিয়েছিলাম, “পারব না,পসিবল না।”নীরা অনেক কান্নাকাটি করে বলেছিলো,রাতে তোমায় নিয়ে বাজে স্বপ্ন দেখলাম শান তাই এখনি দেখা করব তোমার সাথে”

আবেগের জোয়ারে ভাসলাম নীরার কথায়।বই পত্র গুছিয়ে রেখে চললাম নীরার হোস্টেলের দিকে।গার্লস হোস্টেল থেকে এতো রাত্রে বের হওয়া কোনদিন সম্ভব না।তাই নীরাকে বললাম কি করবো,”ও বলল হোস্টেলের বাথরুমের পাইপ বেয়ে উঠে বাথরুমের পাশে বেলকোনির দরজাটা খুলে রাখছি তুমি চলে আসো”
কেন জানি না ঐ সময় মান সম্মানের ছিটাফোঁটা ভয়ও ছিলো না।প্রেমে পরলে নাকি বিবেক লোপ পায় আমারও তাই হলো।উঠে পরলাম গার্লস হোস্টেলের বাথরুমে।উঠেই বুঝতে পেরেছি নীরা সামনে দাঁড়ানো।শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।”-শান থেমে যায়। কারণ এরপরের ঘটনা সত্যিই একজন স্ত্রীর কাছে বিব্রতকর।

“থামলেন যে, বলুন কি হলো তারপর?”
“সেদিন আমি হতভম্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকি নীরার সামনে তার কর্মকাণ্ডে।নীরা প্রথম সেদিন আমার ঠোঁটে…… ”
“ছিহহহহ,বিয়ের আগে এতো নোংড়ামি। “-মুখ কুচকে বলে পাখি।

শান আবার বলে,”কিছুক্ষন পর হোস্টেলের কেয়ারটেকার আন্টি আরো দুজন মেয়ে সহ এদিকে এগিয়ে আসে।পায়ের আওয়াজে বুঝতে পারি তারা আমাদের খুব নিকটে।নীরা আমাকে মেইন গেইট দিয়ে বের হতে বলে নিজে দৌড়ে রুমে চলে যায়।বুঝতে পারছিলাম না কি করব। তবে এটা বুঝেছি ফাঁদে পরেছি আমি।হয়ত ক্যারিয়ার শেষ আমার।তবুও চারিদিকে চেয়ে মেইন গেইটে এগিয়ে গেলাম।দাড়োয়ান ঘুমাচ্ছে নাক ডেকে।দ্রুত লক খুলে বেরিয়ে গেলাম।যা হবার তাই হলো, জেগে গেলো পুরো হোস্টেল।আমার অবয়ব দেখে কারোরই চিনতে অসুবিধা হলো না আমি কে!ভোর হতে হতে সবার কানাকানি শুরু হলো তবে কেউ কিছু বলতে পারলো না। ঐ যে বললাম উপাচার্যের ক্ষমতা ছিলো আমার কাছে।

ঐ ঘটনার পর আমাদের সম্পর্ক বেশ ভালোই চলছিলো।জীবনে প্রথম কোন মেয়েকে ওভাবে স্পর্শ করেছি।নীরাকে বড্ডো ভালোবাসতাম ওর শরীর কে নয়।তাই হাজার সুযোগ থাকার পরে কখনো মনে খারাপ চিন্তার উদয় হতো না।নিজের মাসের খরচের এক তৃতীয়াংশ চলে যেত নীরার পিছনে।কিছুদিন পর আমার ফ্রেন্ড পাপড়ি জানায় সেদিন নাকি নীরা কয়েকজন বান্ধবীর সাথে দশ হাজারের বাজি ধরেছিলো।বাজিটা ছিলো আমায় গার্লস হোস্টেলের বাথরুমে নেয়া।নীরা জিতে গিয়েছিলো সেদিন।পাপড়ির কথা বিশ্বাস করলাম না। তবুও নীরাকে জিজ্ঞেসা করলাম কিন্তু কান্ড ঘটলো পুরো উল্টা।রাগে ক্ষোভে নীরা আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলো।আর আমি পাগলের মতো হয়ে গেলাম।বুঝতে পারলাম এতোদিনে আমি আর আগের শান নেই।পুরোই দেবদাস হয়ে গেছি।দিনের পর দিন ফোন দিতাম, নীরা রিসিভ করতো না।মান সম্মান সব একপাশে রেখে ওদের হোস্টেলের গেইটে দাঁড়িয়ে থাকতাম একটু কথা বলব বলে।কলেজে আসলে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে নীরার ক্লাসে উকি দিতাম।এসবে নীরা একদিন বিরক্ত হয়ে বলেছিলো, “আজ রাত ১২ টায় ঠিক ১২ টায় হোস্টেলের সামনে লাল গোলাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকবা।”
ওর কথা অনুযায়ী তাই করলাম।আর ও বেলকোনিতে কয়েকজন বান্ধবীসহ দাঁড়িয়ে দেখছিলো আর জেতার হাসি হাসছিলো।পরে জানতে পারি সেটাও নাকি বাজি ছিলো।কিন্তু বিশ্বাস করো পাখি নীরাকে এতো ভালোবাসতাম, এতো বিশ্বাস করতাম যে বাকি দুনিয়ার সবার কথা মিথ্যে মনে হতো।আমার ধ্যানে জ্ঞানে পুরোটা সময় শুধু নীরা নীরা আর নীরাই ছিলো।তবে এবার আর পড়াশুনার ক্ষতি হতে দিলাম না।চালিয়ে গেলাম আপন গতিতে।ফলাফল স্বরূপ চতুর্থ সেমিস্টারে ফিরে পেলাম আমার আগের পজিশন;টপ পজিশন।নাবিদ যেন কিছুতেই মানতে পারল না এটা।বুঝতাম ও আমায় হিংসা করত কিন্তু আমি ওকে কখনো হিংসা করতাম না;ভালোবাসতাম খুব।সবসময় সব নোট দিয়ে সাহায্য করতাম।কিন্তু কি বলোতো নিজের মেধার পরিধি কম থাকলে যা হয় তাই হলো। নাবিদ আমাকে টপকাতে পারলো না।অবশ্য কখনোই মুখে কিছু বলতো না।নিজের ভাইয়ের মতো আচরন করত।

গত দুই বছরে বাড়িতে সবটা জেনেছে;আমার আর নীরার ব্যপারে।সবাই রাজিও।কারণ সামিহা ভাবি খুব ভালো তার বোনও নিশ্চই ভালো হবে। একদিন মা গেলো আমার কলেজে খোঁজ খবর নিতে।রাস্তায় রিক্সায় করে গাঁ ঘেষে বসতে দেখেছিলো নীরাকে তাও অন্য একটা ছেলের সাথে।মা অবাক হয়ে দেখেছে সেদিন।কারণ কাপল ছাড়া কখনো কেউ ওভাবে বসতে পারবে না।মা সেদিন রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে আমার রুমে ঢুকে সবটা আমায় বলে।বিশ্বাস করো পাখি আমার নিজের মায়ের কথাও সেদিন মিথ্যে মনে হয়েছে।যা তা বলেছি মাকে।কষ্ট পেয়ে মা বাড়ি চলে যাওয়ার জন্যে উঠেছিলো।দরজায় গিয়ে ঠাঁয় দাঁড়ায় কারন নীরাকে যার সাথে ঘুরতে দেখেছে সেই ছেলে দরজায় দাঁড়ানো।নাবিদও বুঝতে পারে নি মা এসেছে।ইনফ্যাক্ট মা এর আগে নাবিদকে দেখে নি।
“এই তো, এই ছেলেই ছিলো নীরার সাথে”-মায়ের কথায় অবনত মাথা তুলে দেখি নাবিদ দাঁড়ানো।শুকনো মুখে ঢোক গিলছে আর নজর এদিক সেদিক করছে।আমি ভ্রুকুচকে বললাম, “নাবিদ”
“আরে দোস্ত আর বলিস না পাপড়ির কয়েকটা নোটস নাকি নীরারর কাছে ছিলো সেটাই পাপড়ি ওদের হোস্টেলে আমায় আনতে পাঠিয়েছিলো।পরে নীরা বললো নাবিদ আমাকে একটু কলেজ অবধি রিক্সায় লিফ্ট দিবা!আমি না করি নি। দুজন একসাথে চলে এসেছি।তাই হয়ত আন্টি দেখেছে”

মায়েরা নাকি সব বোঝে সেদিন নাবিদের ছলনাও মা বুঝে যায়।কিন্তু বুঝতে পারি নি আমি।একদিকে বেষ্টফ্রেন্ড অন্যদিকে ভালোবসা।কাউকেই অবিশ্বাস করা সম্ভব নয়।মা কে হেসে বললাম, “দেখলে মা ওটা নাবিদ ছিলো।আমার বেষ্টফ্রেন্ড আর তুমি তো নাবিদকে আগে দেখো নি।তাই চিনতে পারো নি।”
মা কী বুঝলো না বুঝলো জানি না শুধু হুমম বলেছিলো সেদিন।

কিছুদিন পর একে একে সবার মাঝে কলেজে একটা ব্যপার কানা কানি হয়ে গেলো। নীরা কারো সাথে ল্যাবরেটরি রুমে নাজুক অবস্থায় ধরা পড়েছে।কিন্তু কথাটা কেউ ডিরেক্ট বলার সাহস পায় নি আমায়।পাপড়িই আমতা আমতা করে বলেছিল। আমি সেদিন রেগে তেড়ে গিয়েছিলাম পাপড়িকে মারতে।দিনে দিনে কথাটা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে গেলো বুলেটের গতিতে।কিন্তু কার সাথে ছিলো ল্যাবরেটরির রুমে তা কেউ বলতে পারে না।

শত দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে সেদিন নীরাকে বললাম,”নীরা কলেজে রুমর ছড়িয়েছে তার ব্যপারে তুমি কতোটা জানো?”
“তুমি আমায় সন্দেহ করছো শান?কলেজ লাইফ ছাড়াও তো আমরা ফ্যামিলি আত্মীয়।জেনে নাও আপুর থেকে আমি কেমন?”-নীরা কপোট রাগ দেখিয়ে বলে সেদিন।
আমি নীরার কথার কোন উত্তর দিতে পারি নি। আবার কলেজের গুজবটাও এড়ানোর ক্ষমতা ছিলো না।

নীরা আবার বলেছিলো, “এখন তো মনে হয় সম্পর্কটা এখানেই শেষ করা উচিত আমার।তুমি তো বিশ্বাসই করছো না আমাকে।শান অনেক ভেবে দেখলাম আমাদের স্টপ হওয়া উচিত।তোমার মা নাকি সেদিন নাবিদের সাথে আমায় দেখে আপুকে কি কি সব জিজ্ঞেসা করেছে।এসব ভালো লাগে না আমার শান।”
নীরার কথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিলো মাথায়।বুঝতে ছিলাম না কি করব।
নীরা ব্রেকআপ বলে চলে যেতেই আমি ওর হাত ধরে ফেলি।নীরা হাত ঝটকা মেরে আমার গালে থাপ্পোর বসিয়ে দিয়েছিলো।আমি রাগকে কন্ট্রোল করতে পারি নি নীরার গলা চিপে ধরেছিলাম। ইতোমধ্যে স্টুডেন্টরা জড়ো হলো আমাদেরকে ঘিরে।রাগ দেখিয়ে সবাইকে চলে যেতে বলে নীরাকে ভালোমতো চেপে ধরলাম দেওয়ালে।আমার খেয়াল ছিলো না নীরার চোখ উল্টে আসছে।হঠাত মনে পড়ে গলা ছেড়ে দিই আমি।ওকে মূমূর্ষ অবস্থায় একটা রুমে নিয়ে আসি”-থেমে যায় শান।
“তারমানে সেদিনই আপনারা রুম ডেট…, ছিহহহহ”-পাখি কেঁদে কেঁদে বলে।

“আগে তো শোন পুরোটা তারপর বলো।তবে হ্যা নাক কুচকানো যাবে না।”-বলে শান আবার বলা শুরু করে

“ও সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর আচমকা আমায় বলেছিলো শান তুমি তো আমায় বিশ্বাস করছো না।তো চলো আজকেই বিশ্বাস করাই। দেখো আমি খারাপ নাকি ভালো মেয়ে।নীরার কথার অর্থ বুঝতে একটু সময় লাগলো।তারপর রাগিচোখে ওর দিকে চেয়ে জবাব দিয়েছিলাম,লজ্জা করলো না নীরা এসব বলতে।মেযে মানুষ এতো নির্লজ্জ হয় জানতাম না তো।আরে আমি তো তোমাকে ভালোবাসি তোমার শরীরকে নয় তাই ওসব ভাবতেও পারি না কখনো।আগেও এমন বলেছিলে কিছু বলি নি আজও এরপর এমন কোন কথা আমাদের হবে না।আমার পরিবার এ শিক্ষা আমায় দেয় নি।যা হবে ডিগ্রী কম্পিলিটের পর।দুজনের ক্যারিয়ার গড়ব তারপর বিয়ে আর তারপর বাকিসব।

নীরা সেদিন কি বলেছিলো জানো,”এখন তো আমারই মনে হচ্ছে তুমি অক্ষম।নইলে এতো সুন্দরী গার্লফ্রেন্ডের এরকম প্রস্তাব কেউ ফেরায় না শান।আর তুমি অনেক হ্যান্ডসাম। এটা জানো কি, সুন্দর ছেলেরা অক্ষম হয়!হয়ত তুমিও তাই!আর মডার্ণ যুগে এসব নরমাল”

রাগকে আর নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারছিলাম না।ঠাটিয়ে চড় বসিয়ে দিয়েছিলাম নীরার গালে।
নীরা গাল চেপে বলেছিলো,”কোন অক্ষম পুরুষের সাথে আমি কোন সম্পর্ক রাখতে চাই না আর না কোন ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবতে চাই।তাই খুশি হবো আমার সাথে কন্টাক্ট না করলে।আর যদি কোনদিন আমার প্রোপোজালে রাজি হও তবেই কন্টাক্ট করো তার আগে না।”

আমি স্তম্ভের ন্যায় সেদিন নীরার যাওয়ার দিকে চেয়েছিলাম।কিচ্ছু বলতে পারি নি।নিজেকে সত্যিই অক্ষম মনে হচ্ছিলো।টলমলে পায়ে হোস্টেলে ফিরেছি।তারপর থেকে হাজার বার নীরাকে কল করার ইচ্ছে হলেও কল করতাম না লজ্জায়।নাওয়া খাওয়া সব ভুলে গেলাম।চেহারা ততোদিনে অর্ধেকে চলে এলো।সিগারেট আর মদকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নিলাম।রাত দিন কিভাবে পার হতো বুঝতাম না।হঠাৎ খেয়াল হলো আমি অলরেডি মেডিকেল লাইফের শেষ সেমিস্টারে দাঁড়িয়ে আছি।পরীক্ষা কিছুদিন পরই।নাবিদ সারারাত দিন বই নিয়ে পড়ে থাকতো।এসব দেখে আর ফ্যামিলির কথা ভেবে নতুন করে মনোযোগ দিলাম আমার পড়াশুনায়।কেটে গেলো তিনমাস।এরমাঝে একবারও নীরা কল করে নি।আমার ধারনা ছিলো ডাক্তার হয়েই কন্টাক্ট করব ওর সাথে।ডিরেক্ট বিয়ের প্রস্তাব রাখব।অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছিলাম।

একদিন কলেজের মাঠে বসে আছি। হঠাৎ পাপড়ি দৌড়ে এসে বলরো,”শান নীরা ভীষণ অসুস্থ্য অটিতে নেয়া হলো।”
আমার গায়ের সব লোম দাঁড়িয়ে গেলো।দিগ্বিদিক চিন্তা না করে ছুটলাম মেডিকেলের অটির দিকে।এক ঘন্টা পর স্যার বের হলেন।হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেসা করলাম, “স্যার নীরা কেমন আছে, কি হয়েছে ওর?”
স্যার লজ্জিত মুখে সেদিন আমার আগা-গোড়া দেখে বলেছিলো,”লজ্জা করে নি শান এমন কাজ করতে।তোমরা এ যুগের ছেলে মেয়েরা এতো নোংড়া! বিয়ের আগেই এসব করে বেড়াও আর পরে নিষ্পাপ প্রান গুলোকে মারতে একটুও দ্বিধা করে না”
ক্যাম্পাসের সবাই জানত নীরা আর আমার মাঝে সম্পর্ক ছিলো।স্যাররাও জানত।রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আমার।পাপড়ি হাত চেপে ধরলো আমার।
“স্যার কি হয়েছে নীরার একটু বলুন না প্লিজ”-জানতে চায় পাপড়ি।

স্যার তখন অকপোটে জবাব দেয়, “হাই ডোজের পিল খেয়েছে নীরা সাথে হাই ডোজের ভ্রুন নষ্টকারি ঔষধ সেবন করেছে। যার ফলে অতিরিক্ত ব্লিডিং এ চার মাসের বেবি নষ্ট হয়েছে।আর বেবির বয়স বেশি হওয়ায় নীরার শরীর ঔষধের প্রতিক্রিয়া সহন করতে পারে নি।”

সেদিন পাপড়ি হাত ছেড়ে দেয় আমার।আমি অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে দু পা পিছিয়ে গেলাম।কি করে নীরা এমন হলো বোধগম্য হলো না আমার।পাপড়ি সন্দিহান চোখে তাকালো আমার দিকে।আমি অসহায় কারণ কেউই বিশ্বাস করবে না বাচ্চার বাবা অন্য কেউ।

“তোমার ব্যপারে এবার কলেজ অথোরিটি অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে শান।অনেক করেছো নোংড়ামি আর না”
স্যারের কথায় ধ্যান ভাঙ্গে আমার।কিন্তু ততোক্ষনে সবটা হাতের বাহিরে। সবাই ধরেই নিয়েছে বাচ্চার বাবা আমি”

পাখি পুরোটা সময় অবাক হয়ে চেয়েছিলো শানের দিকে।চোখের কোণে চিকচিকে জল।

শান আবার বলতে শুরু করে,”এখানেই শেষ নয় পাখি আরো অনেক কথা তোমায় শুনতে হবে আজ।আজ কোনকিছুই লুকাবো না আর।সেই ঘটনার পর পাপড়ি ছাড়া কেউ বিশ্বাস করলো না আমি নির্দোষ।
পরীক্ষার কিছুদিন আগে নীরা কলেজ অথোরিটির মিটিং এ বলেছিলো, “বাচ্চার বাবা শান নয়;অন্য কেউ”।সেদিন যদিও আমার মানসম্মান বেঁচে গিয়েছিলো কিন্তু মরে গেছিলো আমার বিশ্বাস।ভাবতেও পারি নি নীরা এমন কিছু করবে।আমার ভালোবাসা, বিশ্বাসের জলাঞ্জলি দেবে……..

চলবে…….