#আসক্তি
পর্বঃ৩৯(বোনাস)
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম
“কিছু খেয়ে নাও পাখি, এভাবে শোক প্রকাশের নামে ন্যাকামি করছো নাকি শানের প্রতি ক্ষোভ ঝাড়ছো জানি না।যাইই হোক খেয়ে নাও অন্তত বাচ্চাটার জন্যে”-রাগিস্বরে কথাটা বলে ঘরের দরজা থেকেই ফেরত যান রাশিদা বেগম।পাখি অবাক হয় মায়ের কথায়। তার মা তাকে এর আগে কখনোই এভাবে বলে নি।আজ তুমি করে বলছে তাও নাম ধরে, এ যেন অভাবনীয়,অকল্পনীয়।
অতিরিক্ত কান্না করার ফলে পাখির গলা ভেঙ্গে যায়।চোখ মুখ ফুলে ওঠে ।চোখ থেকে জলের ছাপটাও এখনো যায় নি।
ভাঙ্গা গলায় বলে,”দাঁড়াও মা।”
রাশিদা বেগম নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে যায়।বিপরীত মুখেই দাঁড়িয়ে থাকে।
“ও তোমাদের ভুলভাল বোঝালো আর তোমরা বুঝলে? একটি বারও বাবার কথা ভাবলে না মা?না হয় কয়টা টাকা দিয়ে বাবার হার্টে স্টেন্ট করেছে তাই বলে গেলে মা?তোমার কি মনে হয় না ঘরের থেকে পরকে বেশি মাথায় তুলছো?”
পাখি আবার কেঁদে ফেলে, গলার স্বর উঠছেই না তার।বলতে থাকে,”মা, আমার বাবা কম কষ্টে ওর কলার চেপে ধরেনি সেদিন।বুঝতে পেরেছো কতোটা আঘাত পেলে রেস্টুরেন্ট ভর্তি মানুষের সামনে ওমন কুলাঙ্গার জামাইয়ের গায়ে হাত তুলে কেউ?বুঝতে পেরেছো কম আঘাতে তিন মাসের মাথায়, এক রাতের ব্যবধানে বাবার হার্টে আবার এ্যাটাক আসে?”
“বড্ডো বেশিই বুঝে ফেলছ না পাখি?তোমাকে বার বার বলা হচ্ছে তোমার বাবার ইতোপূর্বে দুইবার হার্টে এ্যাটাক এসেছে।তার হার্টে আগে থেকেই সমস্যা ছিলো। হার্টের পেশেন্ট তিনি।তবুও এভাবে ছেলেটাকে ব্লেইম করতে লজ্জা করছে না একটুও?তোমার বাবার দিন রাতের সঙ্গী আমি ছিলাম।তাই আমি জানি তোমার বাবার কাছে শানের অবস্থান ঠিক কতোটা পাকাপোক্ত ছিলো।”
“সেটারই ফায়দা উঠিয়েছে সে মা!
“নির্লজ্জের মতো কথা বলো না।আচ্ছা তোমার ফুপাও তো সেখানে ছিলো আমরা না হয় শানের কথায় ভুলছি তিনি তো সেখানে বর্তমান ছিলেন তবে তার কাছ থেকেও তো সত্যিটা জেনে নিতে পারো।”
“আমি জানি মা, একটা সংসার ফেরত মেয়ে সমাজে বা পরিবারের জন্যে ঠিক কতোটা বোঝাস্বরুপ।তাই তোমরা চাইছো, যে চলে গেছে গেছে। তোমাদের মেয়ের সংসার যেন ওখানেই হয় তাই তো!আর ফুপাও তো এই চিন্তাই করবে তাই নয় কি!”
“প্রেগন্যান্সিতে মেয়েদের মুড সুইয়িং হয়। মেজাজ হারিয়ে ফেলে ঘনঘন কিন্তু তোমার মতো বিবেকহীন যে হয়ে যায় তা জানতাম না”-বলেই রাশিদা বেগম হনহন করে নিচে চলে আসে।
মায়ের কথায় পাখির কান্নার বেগ বেড়ে যায়।
“তোমাদের কি করে বুঝাই আমি তিনি তোমাদের মেয়েকে সড়ানোর প্ল্যান করেছিলো মা। ও ববহুরূপী মানুষ।”
চোখের পানি মুছে শান্ত করে নিজেকে বলে পাখি,” কেউ যদি আমার বাবা হত্যার বিচার না চায় ;চুপ করে থাকে আমি তো আর পারব না।কারণ বাবার মৃত্যুর জন্যে কোন না ভাবে আমিও দায়ি।কারণ আমার জন্যেই তো চলে গেল আমার বাবা”
আবারও বাবার কথা ভেবে কেঁদে ফেলে পাখি।
🌸🌸
শান পাখিদের বাড়ি থেকে ফিরে আর নিজের ঘরে যায় নি;বাগান বাড়িতে উঠেছে।কারণ ঘরের প্রতিটা কোণে কোণে পাখির বিচরন।ফোনের সব সিম গুলো বন্ধ রেখে হসপিটালে দেয়া নম্বরটাই খোলা রেখেছে সে। একাকিত্বের সঙ্গী হিসেবে বেছে নেয় নিজের বাগান বাড়িকে।আধা নির্মান করা বেলকোনিতে পা নিচে ঝুলিয়ে বসে পরে ।সন্ধ্যে হয়েছে অনেক আগে।চাঁদটা আজও জ্বলজ্বল করছে।পানিতে প্রতিচ্ছবি পরেছে চাঁদের।মনে পড়ে যায় পাখির সাথে কাটানো এখানকার প্রথম রাতটার কথা।পাখিকে দেয়া কথাটা রাখতে পারে না শান।ভুল করে ফেলে প্রথমবারের মতো।দ্রুত ঘরে গিয়ে সিগারেটের আস্ত প্যাকেটটা দেয়াশালাই সহ নিয়ে আবারও বসে পড়ে।একে একে একই সময়ে দশটা সিগারেটই শেষ করে তবুও পাখির কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না।
“এভাবে এতোবড় বদনাম টা না দিলেও পারতে জান।আমি বাবাকে বাঁচানোর আপ্রান চেষ্টা করেছি জানপাখি।পারি নি আমি।এই বিশ্বাস আমার উপর রেখেছিলে?”-আনমনে ভাবতেই দুচোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পরে অঝোড়ে।আর অনবরত সিগারেটের ধোঁয়া ফুকছে।
“আমি জানি তোমার এই ভুলটা ভাঙ্গবে।তবে আমি কোনদিনও তোমার এই ভুলটা ভাঙ্গাবো না।তুমি নিজেই বুঝবে একদিন আমি নির্দোষ।হয়ত সেদিন অনেক দেড়ি হয়ে যাবে।আমি যা করেছি সবটাই তোমার জন্যে করেছি। তুমি ফিরলে আমি কোনদিনও তোমায় ফেরাবো না জান।কারণ বড্ডো ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়”
চাঁদের দিকে চেয়ে শান অস্ফুট স্বরে বলে,”আই লাভ ইউ ব্ল্যাক এঞ্জেল,আই মিস ইউ!”
অন্যদিকে পাখিও জানালার কাছে বসে অনবরত কেঁদেই চলেছে আর আকাশের দিকে চেয়ে ভাবছে,”কিভাবে এতো অভিনয় করতে পারলেন?আমায় সময়ে অসময়ে আদোর করা,চমকে দেয়া,গিফ্ট দেয়া,ঘুরতে নিয়ে যাওয়া সবটাই কি তবে অভিনয় ছিলো সার্জন সাহেব?মনে আছে সে রাতের কথা, যে রাতে আমরা একে অপরের হয়েছিলাম?”
পাখির হেচকি উঠে যায় কাঁদতে কাঁদতে। পেটের উপর হাত রেখে ভাবে,”আমাদের অনাগত সন্তানটার কথা আপনি কখনো জানবেনই না। মনে আছে কবে এসেছে সে?সেই রাতে যে রাতে বৃষ্টি বিলাশ করেছিলাম দুজন।আমায় কাছে পেয়ে পাগলপ্রায় আপনি।তার কিছুদিন পরই আমার পিরিয়ডের ডেইট ছিলো কিন্তু সেটা মিস যায়।সবটাই কি তবে অভিনয় ছিলো সার্জন সাহেব?আমার বাবা জীবন দিয়ে সে অভিনয়ের প্রতিদান দিলো।আমি কক্ষনো ক্ষমা করবো না আপনাকে। আই হেইট ইউ”
কাঁদতে কাঁদতে জানালার পাশে বসেই ঘুমিয়ে যায় পাখি।
🌸🌸
আজ শফিক সাহেব গত হওয়ার তিনদিন।শোকের ছাঁয়া যেন এখনো কাটেনি।তবুও রাশিদা বেগম নিজেকে সহ সন্তানদের খেয়াল রাখছেন।অন্তঃসত্ত্বা বউমার সব কাজ করে দিচ্ছেন।মেয়েকে বকেঝকে খাওয়াচ্ছেন,গোসল করাচ্ছেন।সবটাই সামলে নিচ্ছেন একা হাতে।নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন সাংসারিক কাজে।যাতে স্বামীর শূন্যতা তেমন মনে না আসে।
পাখি আগের থেকে ঘঘরকুনো হয়ে গেছে আরো বেশি।চেহারা খুব খারাপ হচ্ছে প্রতিটা মূহূর্তে।ঘর থেকে বের হওয়ার প্রয়োজনই মনে করছে না।মেয়েকে দেখে রাশিদা বেগমের মায়া হয় অনেক বেশি।মেয়েটা ভুলের উপর দাঁড়িয়ে আছে অথচ বুঝতে পারছে না এ ভুল টা ভুল নয় অন্যায়।।আর অন্যায়ের শাস্তি আল্লাহ্ সবাইকে দেয়।তার মেয়ের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হবে না।এসব ভাবতেই অজানা ভয়ে হাফিয়ে পরে রাশিদা বেগম।
ঘরের কোণে থেকে থেকে কেঁদে ওঠে পাখি।নামাজের সিজদায় গেলে উঠার ইচ্ছে করে না তার।বাবার মৃত্যুর জন্যে নিজেকেই দায়ি মনে করে সে।
এরমাঝে কেটে যায় আরো একটা দিন।
শান বাড়ি ফেরে না দুইদিন হলো।শর্মিলা বেগম ছেলের দূঃচিন্তায় পাগল প্রায়।প্রথম দিন ভেবেছিলেন মন মেজাজ ঠিক নেই তাই বাড়ি ফেরে নি আর আজ তো দুদিন ;ছেলের কোন খোঁজ নেই।ফোন দিলেও ফোন বন্ধ পায়।
বাধ্য হয়ে পাখির কাছে ফোন দেয় তিনি।
“বৌমা, মা গো আমার ছেলে আজ দুদিন ধরে বাড়ি ফেরে না।জানি না কোথায় আছে ও!ফোনও বন্ধ রেখেছে।তুমি একটু খোঁজ করো না মা”
পাখি বসে যাওয়া শক্ত গলায় বলে,”মা আপনার ছেলের খবর কি করে দেবো আমি।দেখুন হয়ত অন্যকোন প্ল্যান করে লুকিয়ে আছে।নয়ত কাউকে নতুন করে মেরে ফেলার ফঁন্দি আঁটছে”
শর্মিলা বেগম আশাহত হয়ে ফোন কেটে দেয়।
🌸🌸
খুব ভোরবেলা টলোমলো পায়ে শান সদর দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকে।তিনদিনের নির্ঘুম রাত কেটে যায় বাগান বাড়িতে।ঘুমাতে গেলেই পাখির চোখে নিজের জন্যে ঘৃনা ছাড়া কিছুই দেখতে পারে না সে।
ধীর পায়ে সিঁড়িতে পা রাখে শান।উঠে যায় নিজের ঘরের দিকে।দরজা ঠেলতেই কাঠের দরজাটায় ক্যাচ ক্যাচ শব্দ উঠে যায়।বুঝার বাকি থাকে না গত তিনদিনে ঘরটায় কেউ ঢোকে নি।
ঘরে ঢুকে শান ভারি চোখের পাতায় খাটের দিকে নজর ফেলে।শূন্য খাটটা দেখে বুকটা ধ্বক করে ওঠে।এগিয়ে যায় সেদিকে।বিছানায় ধপ করে বসে ফোন দুটো আর গাড়ির চাবি টা সাইড টেবিলে রাখে।রাখতেই ড্রয়ারের চাপে সাদা কাগজের কোণা চোখে পড়ে শানের।ভ্রুকুচকে ড্রয়ার টেনে বের করে। বড় একটা সাদা কাগজে কালো কলমের কালিতে বড় বড় করে লেখা,”একটা জন ,দুই জন, তিন জন ”
কাগজ টা টেনে বের করে আনতেই কাগজটার নিচে ছোট্ট ছোট্ট দুটো জিরো সাইজের সাদা জুতো নজরে পড়ে শানের।কিছুই বুঝতে পারে না সে।ভ্রুকুচকে একবার কাগজের দিকে আরেকবার জুতোর দিকে নজর বুলায় সে।কিছুতেই বোধগম্য হয় না শানের।হাতে নিয়ে মেঝেতে পায়চারি করে সমাধান বের করার চেষ্টা করে সে।হঠাৎ পিছন ফিরে চোখ পড়ে ওয়ারড্রবের উপরে দেয়ালে টাঙ্গানো ছোট্ট ফুটফুটে বেবিটার দিকে।বুকে ভর করে দুই হাত একখানে করে শুয়ে আছে বাচ্চাটা।হাতের মুঠোয় একমুঠো রঙবেরঙের ফুল। চোখ জুড়িয়ে যাবার মতো দৃশ্য।
“পাখির ছোট বাচ্চা খুব পছন্দ তাই হয়ত টাঙ্গিয়ে রেখেছে “ভাবতেই ছবির উপরে হাত বুলিয়ে মুচকি হাসে শান।
অন্যদিকে ফিরতেই ভাবনায় ছেঁদ পরে,”ওয়েট, এক জন, দুই জন তিন জন।ছোট্ট একজোড়া জুতা,তারপর বেবির ছবি। তারমানে?তারমানে…….”
ভাবতেই শানের মনে পড়ে পাখির সে রাতের কথা ,”হাত ধরে টেনে নিয়ে আসছিলো ঘরের দিকে।তারমানে এটাই দেখাতে চেয়েছিলো পাখি।মানে আমি বা বা……”
আর কিছু ভাবতে পারে না শান।প্রথম বাবা হওয়ার খুশিতে জুতো জোড়ায় চুমু খেয়ে কেঁদে ফেলে সে।এএরপর পাখির হাতে লেখা কাগজটার উপর চুমু খেয়ে
হেসে দেয়।বুঝতে পারছে না কি রিএ্যাক্ট করা উচিত তার।হাসি কান্নার মিশ্রনে এক অন্যরকম অনুভুতি হয় শানের মাঝে।
পরিবেশ পরিস্থিতিকে একপাশে রেখে গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে পরে শান।দরজার কাছে মা’য়ের দেখা পায়।মাকে জড়িয়ে খুশির খবরটা জানাতে ভোলেনা সে।এরপর গাড়ি টেনে ছুটে আসে পাখির বাড়ি।
চলবে….
🔴আমার সব পাঠকগনের মনমানসিকতা এক হবে তা আমি আশা রাখি না।তবে আমার গল্পটার প্রথম থেকে পড়ে অন্তত এটুকু বোঝা উচিত ছিলো পাঠক নিরাশ হয় এমন কোন গল্প আমি লিখছি না।আমি বুঝি না ,প্রত্যেকবার এমন এপিসোড দিই সবাই হাহুতাস করে ইভেন গল্পটাকে ফালতু বলতেও দ্বিধা করে না,তারপর আবার যখন পরের এপিসোডে সবার ভুলটা ভাঙ্গিয়ে সবটা সমাধান করে দিই তখন সবাই বাহবা দেয়।গল্পটা শেষের দিকে তবুও পাঠকরা নিজেদের গন্ডির ভেতরেই থেকে গেলো,হায়!
যাহ হোক ,কেউ একজন বা দুজন আমার গল্পটা পড়বে আমি তাদের জন্যেই গল্পটা শেষ পর্যন্ত লিখে যাবো।
কয়েকটা ব্যপারে একটু হিন্টস দিই
১.পাখি-শানকে আলাদা করব না
২.নীরার শাস্তি বাকি আছে।সামিহার কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি হবে। কারণ পাপের বোঝা যতো ভারি হয়, শাস্তির পরিমান ততো গাঢ় হয়।
৩.পাখির বিরূপ প্রতিক্রিয়া আরো চলবে।
মেয়েদের একমাত্র নির্ভরযোগ্য আদরণীয় স্থান পিতা।তার ব্যপারে এমন কিছু জানলে তাও আবার প্রেগন্যান্সির মতো কঠিন সময়ে, একটা মেয়ের ওমন আচরন নিছকই স্বাভাবিক ছাড়া কিছুই নয়। আর যেখানে সে জানেই না তার বাবার ইতোপূর্বে দুইবার এ্যাটাক হয়।আপনারা যারা প্রেগন্যান্সির জটিলতা সমন্ধে জানেন না তারা না হয় পাখির মনোভাবটা বুঝতে না পেরে পাখির চরিত্রটাকে হেয় করতে পারেন।তবে পাখির চরিত্রের উপর ভিত্তি করে পুরো গল্পটাকে ফালতু গল্প বলতে পারেন না।তাই বলব, ইচ্ছে হলে ধৈর্য নিয়ে পড়বেন নয়ত গল্পটা না পড়ারই অনুরোধ করবো।গল্পের সমালোচনা করবেন আমি খুশি হবো কিন্তু গল্পটাকে ফালতু,সিরিয়ালের মতো ঘ্যানঘ্যান টাইপ এসব বলবেন না প্লিজ।এভাবে আর যাই হোক সমালোচনা করা যায় না।বাই দ্য ওয়ে, আমি সিরিয়াল ইভেন টিভিই দেখি না।একটা গল্পকে হাসি, কান্না,প্রেম,বিশ্বাস,অবিশ্বাস,সামাজিকতার প্রতিবন্ধকতা,পারিবারিকতা, সাংসারিক মায়া মমতা দিয়ে সাজাতে যা যা প্রয়োজন সবটা করার চেষ্টা করেছি।এভাবে সিরিয়াল হয় কিনা আমার জানা নাই। কারণ আবারও বলছি আমি সিরিয়াল দেখি না।
মূলত উক্ত কথা গুলো আপনাদের জানানোর জন্যেই ছোট্ট করে আজকের এই বোনাস পার্ট।
এবার আসি নামের সার্থকতায়। যে জিনিসে আমরা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাই, যার খারাপ দিক জানা সত্বেও আমরা সেটা ছেড়ে থাকতে পারি না,তবেই তাকে আসক্তি বলে। পরের পার্ট গুলোয় আসক্তিই বুঝাবো।মানে নামের সাথে পুরোদমে মিল খুঁজে পাবেন।🔴
চলবে।
#আসক্তি
পর্বঃ৪০
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম
“বাবা তুমি!এতো সকাল সকাল!”-আঙ্গিনা ঝাড়ু দিচ্ছিলেন রাশিদা বেগম।চোখের সামনে শুভ্র একজোড়া পা দেখে থেমে যান তিনি।মাথা উঠিয়ে একমাত্র মেয়েজামাই শানকে দেখতে পান।মেয়ের ব্যবহারে তিনি ভেবেছেন তার জামাই আর কখনোই এ বাড়িতে পা রাখবেন না।কিন্তু না তার ধারনা মিথ্যে করে শান তিন দিন যেতে না যেতেই তার উঠানে এসে দাঁড়ায়।
হকচকিয়ে রাশিদা বেগম জানতে চায়,”ও বাড়িতে সবাই ভালো আছে তো বাবা?”
“হ্যা মা সবাই ভালো আছে”-এরপর উঠান থেকেই মাথা উচিয়ে বাড়ির ভিতরে দেখার চেষ্টা করছে কোথাও পাখিকে দেখা যায় কিনা!শান আবার বলে,”আপনারা সবাই কেমন আছেন মা?”
“ভালোই”-ঠোঁটে কিঞ্চত হাসি রেখে জবাব দেয় রাশিদা।শানের চোখে কাউকে খোঁজার রেশ বুঝতে পেরে রাশিদা বেগম ঝাড়ু টা রেখে শানকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে যায়। সোফায় বসতে বলে।
এরপর পাখির ভাবি বীনা চলে আসে ঘরে।তার সাথে কুশল বিনিময় করে শান।এক ফাঁকে জানতে চায় পাখির খবর।
“ভাবি,পাখি কোথায়?ওঠেনি এখনো?
ঠোঁট উল্টিয়ে বীনা জবাব দেয়,”কি জানি ভাই, ঘর থেকে বেরই হয় না মেয়েটা।হয়ত নামাজ পড়ে সেখানেই বসে আছে”
শানের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে।চোখ যেন পাখিকে খুঁজছে, চোখের তৃষ্ণা পাখির পেটে নিজের সন্তানকে অনুভব করার।দ্রুত উঠে পাখির রুমের দিকে চলে যায়।দরজা টা খোলা, তবে হালকা ভেড়ানো।তারমানে পাখি উঠেছে।আস্তে করে দরজা টা আরেকটু ঠেলে চারদিকে চোখ বুলায় শান।কোথাও পায় না পাখিকে।মাথাটা উচিয়ে দেখে জায়নামাজে শুয়ে ঘুমাচ্ছে।ধীরপায়ে এগিয়ে যায় শান।পাখির মুখের দিকে চেয়ে থাকে অপলক।কি মায়াময় সে মুখ!মুখে কান্নার দাগ রয়ে গেছে।গাল মুখ ফুলে ফুলে গেছে।শরীরের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হয়েছে।হঠাৎ নজর পড়ে পেটের দিকে।পেটের উপর দুইহাত রেখে ঘুমিয়ে আছে মেয়েটা।খেয়াল হয় নিজের সন্তানের কথা।
অতি সাবধানে কোলে তুলে নেয় পাখিকে।বিছানায় শুইয়ে দেয় আলতো করে।ঘুমের ঘোরেই পাখি শানের গলাটা জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে বলে,”আমি আপনাকে ছেড়ে থাকতে পারি না সার্জন সাহেব।কিন্তু বাবা, বাবাকে যে মেরে….. “-বাকি কথা শেষ হয় না ;মুখেই মিলিয়ে যায়।
শান আনমনে ভাবতে থাকে,”আমি বুঝতে পেরেছি জান কতোটা আঘাত পেলে তুমি এরকম ভুল বুঝতে পারো আমায়।আমি এও জানি তোমার কোন দোষ নেই। তোমার ব্রেইন ওয়াশ করা হয়েছে।আমারই উচিত হয় নি তোমায় রেখে যাওয়া”
চুল সরিয়ে কপালে, গালে গাঢ় চুমু এঁকে দিয়ে শান বলে,”এগুলো তোমার জন্যে,আর”
পেটের উপর পরপর কতোকগুলো চুমু এঁকে বলে, “এগুলো আমাদের বেবির জন্যে”
এরপর উঠে চলে যায় শান।
🌸🌸
শানের চলে যাওয়ার কিছুক্ষন পরপরই ঘুমের থেকে ধরফর করে উঠে বসে পাখি।এতোক্ষন যা হলো তা যেন পাখির কাছে স্পষ্ট।গাড়ির শব্দ যেন কানে রয়েই গেছে।দৌড়ে চলে যায় বেলকোনিতে।নিরাশ হয় পাখি।ফিরে এসে বিছানায় বসে চোখ বন্ধ করে। তৎক্ষণাৎ মনে হয় একটু আগে শান এসে তাকে আদোর করে গেলো।আনমনে ভাবতে থাকে,”কেমনে সম্ভব উনি তো নিরুদ্দেশ।তারমানে সবটাই আমার স্বপ্ন!”
থমথমে মুখে আবার ভাবতে থাকে,”আমি তাকে ঘৃনা করি। সে এলেই বা কি না এলেই বা কি, আই হেইট হিম”
বলেই কেঁদে ফেলে পাখি।
“আমি তো নামাজ পড়ে জায়নামাজেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, বেডে এলাম কী করে?”-আপন মনে ভাবতে থাকে পাখি। মনে পড়ে না কখন উঠেছে বিছানায়।
এরপর চোখের পানি মুছে মায়ের ডাকে ঘর থেকে বের হয় পাখি।সকালের খাবার খেতে হবে।নইলে আবার মায়ের ঘ্যানঘ্যান শুরু হয়ে যাবে।রাশিদা বেগম থমথমে মুখে প্লেটে খাবার বেড়ে দিচ্ছেন।সোহান মাথা নিচু করে খাচ্ছে, বীনা খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। খেতে ইচ্ছে করছে না।পাখি সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে,”এতোগুলো ভাত আমি খেতে পারব…. ”
“কি হলো বৌমা, খাচ্ছো না কেন?তোমাদেরকে খাওয়ানো ছাড়াও আজ অনেক কাজ আছে আমার।”-পাখির কথার মাঝখানে বীনাকে চোখ রাঙ্গিয়ে ধমকে ওঠে রাশিদা।
“খেতে ইচ্ছে করছে না…..”-মিনমিনে গলায় বলে বীনা।কিন্তু শ্বাশুরির মুখ দেখে কথা দমে যায়।মায়ের চোখে মুখে রাগ দেখে শুকনো ঢোক গিলে পাখি খাওয়া শুরু করে আর কোন টু শব্দটি না করে।
রান্নাঘরে এঁটো বাসন রাখতে যায় রাশিদা। এর ফাঁকে সংকোচ দূরে ঠেলে পাখি বীনাকে বলে,”ভাবি,উউনি কি এসেছিলো?”
“কোন উনি? ”
দমে যায় পাখি।কিছু বলতে পারে না।ভাঙ্গা গলায় আবার জানতে চায়, “ডাক্তার বাবববু”
“উনার আসার মুখ রেখেছো যে আসবে।যা নয় তা নিয়ে অপমান করে তাড়িয়েছো। আবার উনার কথা বলো কোন লজ্জায়!নাকি মিস করছো?”
বীনার কথায় পাখির মনে পড়ে যায় বাবার মৃত্যুর কথা।চোখ মুখ শক্ত করে বলে,”কক্ষনোই না।তাকে আমি মিস করতে যাবো কোন দূঃখে!”
খাওয়া শেষে পাখি চলে যায় ছাদে।আকাশে আজ মেঘ করেছে তবুও দেখতে মন্দ লাগছে না।দূরের গোরস্থানে নতুন কবর টা জ্বলজ্বল করছে। চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে। বুক ফেটে কান্না চলে আসে।
এদিকে শান ফিরে আসে অনেক গুলো প্যাকেট সমেত।রাশিদা বেগম অবাক হয়ে বলে,”বাবা কি এগুলো?”
“মা একটু পরেই বুঝতে পারবেন।আপনার মেয়ে কই?”-ভারি প্যাকেট গুলো দুহাতে তুলে বলতে বলতে উপরে উঠে শান।
“ও মনে হয় ছাদে গেছে।”
“যাক বাঁচা গেল।এ সুযোগে আমি আমার কাজ সেড়ে নিতে পারব”-বিড়বিড় করে বললো শান।
রাশিদা বেগম পিছন পিছন উঠে বললো,”সকালে খাবে না বাবা? ”
“খাবো মা, হাতের কাজটা একটু সেড়ে নেই।তারপর…”-কিঞ্চিত হেসে বলে শান।
“আপনি এখন যান, আমি ডাকলে তখন আসবেন”
শানের কথায় শ্বাশুরি মা হেসে ফেলেন।নিচে চলে আসেন ধীরপায়ে।
🌸🌸
পাশের বাড়ির কয়েকজন মহিলা নিয়ে আদা রসুন কাটা বাছা করছেন রাশিদা।একটু পরে শানের ডাকে উঠে যায় উপরে।শানের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়।
“সে কি, এসব কি বাবা?তুমি তো ঘেমে একাকার!”
শান শ্বাশুরি মা’কে থামিয়ে চারিদিকে ইশারা করে বলে,”মা আগে বলেন কেমন লাগছে?”
রাশিদা বেগম স্তম্ভিত হয়ে যায় শানের কাজে।
ভাবতে থাকে,”আমার মেয়ে এতো কষ্ট দিচ্ছে ছেলেটাকে অথচ সে কতোকিছুই না করছে পাখির জন্যে।মেয়েটা আমার বোকাই থেকে গেলো।”
“মা ও বলেনি কিছু? আমরা দুজন থেকে তিনজন হতে চলেছি”-তৃপ্তির হাসি ঠোঁটে শানের।
শানের কথায় রাশিদা হেসে বলে,”জানি বাবা, ও তোমায় সারপ্রাইজ দেবে বলেই আমায় সবকিছু গোপন রাখতে বলেছিলো।কি থেকে কি হয়ে গেলো!”
বলতে বলতেই চোখ ভরে আসে তার।
নিজেকে সামলিয়ে বলে,”বাবা আজকে যেও না।তোমার বাবার জন্যে একটু দোয়ার আয়োজন করেছি।তদারকি করতে হবে তোমাকেই।কে আছে আর আমাদের?”
“ঠিকাছে মা, সমস্যা নেই। আমি আছি”-বলেই মুচকি হেসে নিচে নেমে আসে শান।
…….
পাখি ছাদ থেকে ঘরে চলে আসে।দরজাটা ভিড়িয়ে চারিদিকে চেয়ে চক্ষু চড়কগাছ তার।চারদিকে নানান রকম ফুলের ছবি, প্রকৃতির ছবি টাঙ্গানো।যেন সবগুলো ছবিই জীবন্ত।পাহার বেয়ে ঝড়না নামছে, দেখেই মনে হচ্ছে জ্বলজ্যান্ত সেগুলো।ঘরের আরেক দেয়ালে দুইটা টুইন বাবুর ছবি;একটা ছেলে একটা মেয়ে।না চাইতেও ছবিতে হাত বুলিয়ে হেসে ফেলে পাখি।
“কে রাখলো এগুলো?মা ছাড়া তো কেউ জানে না এসব?আর মা তো আজ এখনো বাড়ি থেকে বের হয় নি তবে”-ভাবতেই চোখ পড়ে যায় হলুদ রঙ্গের ওয়ালমেইটের উপর।বড় বড় করে বাঁধাই করা লেখা,”প্রেগন্যান্সির সময় রঙবেরঙের ফুল, প্রকৃতি দেখলে মায়ের মন ভালো থাকে সাথে বেবিও হাসি খুশি থাকে।জান”
পাখির বুঝতে অসুবিধা হয় না ডাক্তার সাহেব এসেছেন।আবেগে দৌড়ে নিচে নেমে আসে।এসে দেখে মা বেড়ে দিচ্ছে আর উনি খাচ্ছেন।
সিঁড়িতে কারো ধুপধাপ শব্দে পিছনে ফিরে তাকায় শান।পাখির চোখে চোখ পড়ে যায়।সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আবার নিজের খাওয়ায় মনোযোগ দেয় সে।
রাগে গা রি রি করে ওঠে পাখির।
কিছু না বলে আবারও উঠে যায় উপরে।ঘরে ঢুকে ভাবতে থাকে, “উনি বাচ্চার কথা জেনে গেছেন তাহলে!”
রাগে দূঃখে টাঙ্গানো ছবিগুলো ছিড়তে গিয়েই মনটা কেমন করে,”থাকুক না ভালোই তো লাগছে”
আনমনে ভেবে পিছনে পিছিয়ে আসে।ঘুরতেই চোখ পড়ে বুকে দুহাত গুঁজে দরজায় ঠেস মেরে দাঁড়ানো শানের দিকে।
“কি হলো ছিঁড়লে না যে!ছিঁড়ো! “-বলতে বলতে ঘরে ঢোকে শান।
“অবশ্য ছিঁড়তে চাইলে ছিঁড়তে পারো কোন সমস্যা নেই।কারণ এক্সেস গুলোকেও তো জায়গা দিতে হবে তাই না”-ঘরের কোণায় রাখা বড় প্যাকেট দেখিয়ে বলে শান।
পাখি সেদিকে দেখে গোলগোল চোখে তাকায়।মনে মনে ভাবতে থাকে,”এত্তো পাগল কেউ হয়?এতো ছবি কোন পাগলে আনে!”
নিজেকে স্বাভাবিক রাখার ভান করে, কপোট রাগ দেখিয়ে আমতা আমতা করে বলে,”এএসব ককরে কি প্রমাণ করতে চাইইছছেন?ককতো ভালোবাসেন আমায়?নাকি বাবাকে মেরে ফেলার অঅপরাধ টা ধামাচাপা দিতে চান?আমি সবব বুঝি, বোকা না আমি।”
বাবার মৃত্যুর কথাটায় শানের বুকটা আবার ভারি হয়ে আসে।বুঝতে পারে পাখি যতোদিন না বুঝবে ততোদিন এই খোঁটা শুনতেই হবে তাকে।চোখ বন্ধ করে নিজেকে কন্ট্রোল করে শান বলে,”প্রথমত আমি কিচ্ছুটি প্রমাণ করতে চাইছি না।দ্বিতীয়ত তোমাকে না, আমি আমার অনাগত সন্তানকে কতোটা ভালোবাসি সেটা প্রমান করতে চাইছি।তৃতীয়ত, তোমায় বোকা ভাবার মতো বোকা আমি না।যে মানুষ পরের কথায় ঘরের সুখ নষ্ট করে সে আর যাই হোক বোকা না;গর্ধভ।”
শান আরেকটু এগিয়ে এসে চট করে পেটে হাত রেখে বলে,”হে ইউ লিসেন, তোমার জন্যে নয় যা করছি আমি আমার বাচ্চার জন্যে করছি”
পাখির রাগ উঠে যায় শানের কথায়, সাথে মন খারাপ হয়ে যায় ভীষণ।লাল চোখে তাকায় শানের দিকে।
পেট থেকে শানের হাত ছাড়িয়ে দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,”ও আমার সন্তান;আপনার নয়।আমাকে যেমন বাবা হারা করলেন আপনাকেও তেমন সন্তান হারা করব আমি।ঠিক শুনেছেন, এই আমি।”
বলেই পাখি সামনে থেকে সরে যেতে চায়।
শান নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারে না, পাখির একহাত টেনে দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পাখিকে।কানের কাছে মুখটা এনে বলে,”আমি কোন অন্যায় করিনি জান।তবুও যদি তোমার মনে হয় আমি অন্যায় করেছি তবে যা শাস্তি দেয়ার আমায় দাও।আমার বাচ্চাটাকে না।”
এরপর শান একটু নিচে হাঁটু গেড়ে বসে পাখির পেটে মাথা ঠেকিয়ে বলে,”আমার খুব ইচ্ছে, তোমার পেটে আমার বাচ্চার বড় হওয়ার প্রত্যেকটা মূহূর্ত আমি অনুভব করব।প্লিজ পাখি এটা থেকে আমি বঞ্চিত হতে চাই না”
শানের আকুতি দেখে পাখির চোখ ভরে আসে।দুফোটা জল গড়িয়ে পরে শানের মাথার উপর।শানের বুঝতে অসুবিধা হয় না পাখি কাঁদছে।উঠে দাঁড়িয়ে চোখের পানি মুছে শান বলে,”তোমার ব্রেইনে আমার এগেইন্স্টে যে মিথ্যার আস্তরন টা বিছানো হয়েছে, আমি আল্লাহ্ র কাছে চাই সেটা যেন তাড়াতাড়ি ভ্যানিস হয়ে যায়”
মুখ নিচু করে পাখি কেঁদেই চলেছে।শানের কর্মকান্ডে সে দোটানায় পরে যায়।মন বলছে শান সত্যি বলছে;নির্দোষ। কিন্তু ব্রেইন বলছে “শান তোমার বাবাকে মেরে ফেলেছে পাখি।”
শানকে দূরে সরিয়ে জানলার পর্দা সরিয়ে পাখি কান্নাভরা কন্ঠে বলে,”চলে যান আপনি।সহ্য হচ্ছে না আপনাকে আমার।মনে হচ্ছে আমি একজন ঘাতকের সাথে আছি।প্লিজ চলে যান।”
শান বুঝতে পারে এরকম সিচুয়েশন পাখির জন্যে এমনকি বাচ্চার জন্যে ভীষণ ক্ষতিকারক।পাখি যে দোটানায় পড়ছে, সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে তা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে শান।তাই সে কোন চাপ সৃষ্টি না করে নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
দুপুরের দিকে মানুষজনের আনাগোনা শুরু হয় বাড়িতে।দেখতে দেখতে বাবা গত হওয়ার তিন দিন চলে যাচ্ছে।তারই দোয়া মাহফিলের ছোট্ট আয়োজন চলছে বাড়িতে।যোহরের নামাজ পড়ে বাবার জন্যে অনেক দুয়া করেছে পাখি কেঁদেছে অনেকটা।
শান টুকটাক কাজ করে চলছে। যেসব কাজ সে কখনোই করতো না বাড়িতে।লোক থাকত সেসব কাজের।এসব কাজের অভ্যেস না থাকায় সামান্য কাজে ঘেমে নেয়ে একাকার হয় শান।বার বার জানালা থেকে পাখি দেখছে।আবার আড়াল হচ্ছে।শানও ঘাম মুছে মুছে বার বার দোতলার জানলার দিকে তাকাচ্ছে।দুজনার মাঝে নজরের লুকোচুরি চলছে এই মূহূর্তে। শানের কাহিল অবস্থা দেখে নিচে নেমে শান্ত স্বরে মাকে ডাকে পাখি।
“মা, ও মা, কই তুমি?”
“বলো কান আছে, শুনতেছি”-রাশিদা তেড়ছা ভাবে জবাব দিয়ে নিজের কাজে মন দেয়।রান্না ঘর থেকে বারান্দা অনেক মানুষ কাজ করছে আজ।মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে চুপ করে।
“এতো গরমে এখানে আসার মানে কি?যা লাগবে বলো, কাউকে দিয়ে পাঠাবো।নিজের ঘরে যাও।”
পাখি নড়ে না।ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে।
রাশিদা বেগম আবার বলে,”বাচ্চার জন্যে ধোঁয়া কতোটা ক্ষতিকর এটা তো জানো নিশ্চই!”
“মা”
“হুমম”-রাশিদা পিছনে না ঘুরেই জবাব দেয়।
পাখি আমতা আমতা করে বলে,”তোমার জাজামাই এসবে অভ্যস্থ না।ঘঘেমে গেছে একবারে।কাউকে বলে উনাকে ঘরে এনে ঠান্ডা শরবত দাও।আমমি বানিয়ে দিচ্ছি ”
রাশিদা বেগম কাজ থেমে কোন কিছু না বলে দাঁড়িয়ে থাকে।পাখি আবার বলে,”কি হলো মা, ডাকো উনাকে”
“কেন? কেন ডাকব?ওর কি হয় হউক, তোমার তাতে কি?ও তো একজন খুনি তাই না?মরে যাক, পঁচে যাক। তোমার যায় আসার কথা না”-কাটকাট গলায় বলে আবার নিজের কাজে মন দেয় রাশিদা।
মায়ের কথায় বুকের কোথাও যেন ভীষণ টান অনুভব করে পাখি। শানের মরার কথায় গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে ওর।
“উনি তো একজন খুনি।আমি চাই উনার জঘন্য থেকে জঘন্যতম শাস্তি হোক।তাহলে মায়ের কথায় বুকের ভেতর এমন করছে কেন?”-ভাবতেই কান্না চলে আসে পাখির।মায়ের সাথে আর কোন কথা না বলেই পাখি দৌঁড়ে নিজের ঘরে চলে আসে।জানালার গ্লাস খুলে শানকে দেখে শান্ত হয় বুকের ধুকপুকানি।
🌸
হাতের কাজটা অন্য কাউকে বুঝিয়ে দিয়ে রাশিদা বেগম শানের কাছে চলে আসে।
“বাবা, তুমি এসব কেন করছো?তোমায় শুধু বলেছিলাম একটু তদারকি করতে আর কিছু না”
“ভাইয়া ধরুন”-শান তরকারির ডেকচি টা সোহানের সাথে তুলতে তুলতে বলে,”কেন মা, ভাইয়া যদি করতে পারে আমি কেন নয়?”
উপস্থিত সবাই অনেক খুশি হয় শানের কথা শুনে।
“বুঝলে সোহানের মা ভাগ্য গুনে জামাই পেয়েছো একখান।এতো বড় নামি দামি ডাক্তার অথচ মনে কোন অহঙ্কার নেই।”-পাশে বসে থাকা ভাসুর সমন্ধীয় কেউ একজন মুরুব্বী লোক কথাটা বলে ওঠে।
শান কপালের ঘাম টা মুছে সবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।ঘন ঘন ঘাম মোছার ফলে মুখ গলা একদম লাল টকটকে হয়ে যায় শানের।পাখির মা সেদিকে তাকিয়ে আর এক মূহূর্ত দেড়ি না করে শানের হাত টেনে নিয়ে আসে ছাঁয়াযুক্ত বারান্দার কোনে।
“তোমায় আর কিচ্ছু করতে হবে না বাবা।তুমি গোসল সেড়ে নামাজ টা পড়ে কিছু খেয়ে নাও।একটু পরে লোক আসা শুরু করবে ভালোভাবে তখন খাওয়ারই সুযোগ পাবে না বাবা”
“পাখি গোসল সেড়েছে মা,খেয়েছে নাকি এখনো কাঁদছে?
রাশিদা বেগমের চোখে জল টলমল।
“নামাজ শেষে হুহুস্বরে কেঁদে ওঠে আমার মেয়েটা।ও বড্ডো বাপ পাগলি মেয়ে বাবা।তোমাকে না বুঝেই ভুল বুঝেছে।দেখবে ঠিকই নিজের ভুলে নিজেই লজ্জিত হবে”
চোখের পানি মুছে রাশিদা আবার বলে,”তুমি ভেবো না ওকে গোসল করে খাইয়ে দিয়েছি আমি।হয়ত বসে বসে বাবার ছবি দেখছে আর কাঁদছে”
🌸🌸
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো।মানুষের খাওয়া দাওয়ার পালা শেষ হয়েছে। তবুও দু একজন এখনো খাচ্ছে।পাখি জানালা দিয়ে দেখে চলছে সবকিছু। পরপর দুবার বমি হয়ে শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়েছিলো।দুপুরের পর থেকে শানকে আর দেখতে পায় নি পাখি।
বুকের ভেতর অজানা কষ্টের চাপ সহ্য করতে পারছে না সে।না পারছে কাউকে জিজ্ঞেসা করতে শানের কথা।
ছটফট করছে শুধু।
রাত হয়ে গেলো, তবুও শানের দেখা পায় নি সে।এবার দূঃচিন্তা হচ্ছে।নিচে নেমে ভাবিকে দেখতে পায় জিজ্ঞেসা করতে কোথাও যেন বাঁধছে।কাউকে কিছু না বলেই আবার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে নিজের ঘরে ঢুকে রাগটা দরজার উপর ঝাড়ে।সজোড়ে দরজাটা ধাক্কা দিয়ে দেয়।চৌকাঠে লেগে শব্দ করে পূনরায় দরজার পার্ট টা আগের স্থানে এসে থামে।দূঃচিন্তায় কোন কিছু ভালো লাগছে না।বার বার মনে ওঠে শানের কথা।
“হি ইজ আ কিলার।তবুও কেন তার জন্যে এতো দূঃচিন্তা হচ্ছে।কি হয় হোক গিয়ে আমার কি?”
ভাবতে ভাবতে বিছানার মাঝ বরাবর ডান কাত হয়ে শুয়ে পরে।
এপাশ ওপাশ করছে তবু ঘুম চোখে আসছে না। গত তিন রাত থেকে এমন হচ্ছে।ঘুম আসতে আসতে শেষ রাত হয়ে যায়।আজও তার ব্যাতিক্রম হচ্ছে না।ফোনের পাওয়ার বাটনে টিপে দেখে ১২ টা বাজে।তবুও ঘুম আসছে না।হঠাত খেয়াল হয়, “এ সময় তো পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন! আমি কেন জেগে আছি এখনো।”
তড়িঘড়ি করে পাখি কোলবালিশ টা চেপে চোখ বন্ধ করে রাখে।তবুও ঘুম আসছে না।হঠাৎ দরজায় কারো সন্তর্পণে প্রবেশের শব্দে চোখ পিটপিট করে বোঝার চেষ্টা করে কে এলো!
পুরুষালী অবয়ব চোখে পড়ে।চিনতে অসুবিধা হয় না মানুষটা কে!পাখি চোখ বন্ধ রেখেই বোঝার চেষ্টা করে কি করছে শান।
শান ঘরে ঢুকেই ড্রেস চেঞ্জ করে ওয়াশরুমে চলে যায়।এরপর পাখির পাশের ছোট্ট জায়গাটাতে আঁটসাঁট হয়ে শুয়ে পড়ে।এরপর পাখির বাহু থেকে কোলবালিশ টা সরিয়ে পাখির বাম হাত টা টেনে পাখিকে নিজের বুকের উপর ফেলে।হকচকিয়ে ওঠে পাখি।মিছে রাগ দেখিয়ে বলে,”ছাড়ুন আমায়”
“ঢং ছাড়ো।আমিও জানি কার ঘুম কোথায় আসে।আমার বুক ছাড়া যে গাধিটার ঘুম আসে না তা আমার অজানা নয়।”
শানের কথায় পাখি ভরকে যায়।নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,”ওসব অতীত।ও সবকিছুই কারো অভিনয় ছিলো।এখন আমায় ছাড়লেই খুশি হবো”
শান আরো শক্ত করে চেপে ধরে পাখির কথার তোয়াক্কা না করে বলে,”আমার বাচ্চা কেমন আছে?”
পাখি চুপ করে থাকে।কিছু বলে না।শান আবার বলতে শুরু করে,”তোমার জন্যে না। আমার বাচ্চার জন্যে করছি এসব।কারণ তুমি না ঘুমালে সেটার ইফেক্ট আমার সন্তানের উপর পড়বে তা আমি চাই না।”
পাখি রাগে, দূঃখে শানের বুকে কিল মেরে বলে, “ছাড়ুন আমায়, ঘৃনা করি আপনাকে আমি”
শান আরো চিপে ধরে হতাশ স্বরে বলে,”জানি”
এক সময় পাখি শান্ত পাখির মতো বুকের সাথে মিশে যায়।নিঃশ্বাস ভারি হতেই শান আলতো হাতে চুল সরিয়ে কপালে চুমু এঁকে বলে, “জানপাখি বড্ডো বোকা তুমি।কবে সবটা ঠিক হবে আবার!”
চলবে……