আসক্তি পর্ব-৪১+৪২

0
1510

#আসক্তি
পর্বঃ৪১
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

সকাল সকাল পাখির ঘরে হট্টোগোলের শব্দে বাড়ির সবাই উপরে চলে আসে।
“আপনি এখন এই মূহূর্ত থেকে এবাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন। আমি আপনাকে জাস্ট সহ্য করতে পারছি না। প্লিজ চলে যান, প্লিজ”-বলতে বলতে কেঁদে ফেলে পাখি।বোনের অভদ্রতামি এবার চরমে।রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে সোহানের। হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে রাগকে নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করে সে বাহিরে থেকে।

“আই ওয়ান্ট ডিভোর্স!”-কাটকাট গলায় পাখি কথাটা বলে চুপ করে যায়।শান সহ ঘরের বাহিরে উপস্থিত সবাই স্তম্ভের ন্যায় দাঁড়িয়ে যায় পাখির কথায়।শান ভাবতেও পারে নি পাখি এরকম কিছু বলবে।
“একজন খুনির সাথে এক ছাদের নিচে আমি থাকতে পারব না।সেটাও আবার নিজের বাবার খুনি।আমি পারছি না আপনাকে মেনে নিতে”-বলতে বলতেই পাখি দুহাতে মুখ ঢেকে উচ্চস্বরে কেঁদে ফেলে।সোহান আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না।দ্রুতপদে ঘরে ঢুকে পাখির সামনে দাঁড়ায়।সামনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে মুখ তোলে পাখি।রক্তাভ চোখে দাঁড়ানো ভাইকে দেখতে পায়।তৎক্ষণাৎ নিজের গালে পরা থাপ্পোরের প্রতিক্রিয়ায় সিটকে পরে যায় বিছানায়।
“অনেক বলেছিস তুই, আর না।ছেলেটাকে যা নয় তাই বলছিস।ভেবেছিলাম বাবার শোক কাটাতে পারছিস না তাই আবল তাবল বকছিস, কিন্তু তুই তো অকৃতজ্ঞ শেইমলেস রে।”

শান দ্রুত এসে পাখিকে ধরে।রাগিচোখে তাকিয়ে সোহানকে বলে,”ও যা করছে আমার সাথে করছে ভাইয়া, আপনাদের কারোর সাথে নয়।আমি যদি সহ্য করতে পারি আপনাদের সমস্যা টা কি?”
শানের কথায় সবাই অবাক হয়ে যায়।ভাইয়ের করা কাজে চোখ ফেটে জল গড়ায় পাখির।কান্নাজড়িত কন্ঠেই বলে,”ছাড়ুন আমায়।আপনার জন্যে সব হচ্ছে।আমি থাকবো না আপনার……”
বলতে না বলতেই সোহান তেড়ে আসে আবারও। পাখি ভয়ে চুপসে গিয়ে শানের পিছনে পালায়। শানের পিঠে মুখ ঠেকিয়ে কান্না করে।
“ভাইয়া প্লিজ,কি শুরু করলেন?এই অবস্থায় কি ওকে মেরে ফেলতে চান?”
“তুমি বুঝতে পারছো শান ওর গাধামি ঠিক কোথায় গিয়ে ঠেকছে?আজ ও ডিভোর্সের কথা বলছে!ওকে তো আমি মেরেই ফেলবো”-বলতে বলতে সোহান পূনায় তেড়ে আসতেই শান পাখির দিকে ফিরে বুকে জড়িয়ে নিয়ে সোহানকে বলে,”আর একটা আঁচরও যেন ওর গায়ে না পড়ে ভাইয়া, লাস্ট বারের মতো বলছি”

পাখি সোহানের হাবভাব দেখে ভরকে গিয়ে শানের বুকে মুখ লুকায়।শান ইশারা করতেই সবাই বাহিরে চলে যায়।পাখি তখনো ভয়ে কাঁপছে। সে বুঝতেই পারেনি অনেকক্ষণ হলো সবাই চলে গেছে।শান মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”বাচ্চাটা ভালোভাবে ডেলিভারি হোক আমি নিজেই তোমায় ছেড়ে দিবো।ততোদিন প্লিজ আমায় সহ্য করো”
পাখির এবার কান্না বাঁধ ভেঙ্গে যায় ডুকরে কেঁদে ওঠে শানের বুকে, “কেন এমন করলেন সার্জন সাহেব।আমি তো অনেক ভালোবাসি আপনাকে।আমায় একটুও সত্যি সত্যি ভালোবাসা যেতো না!এভাবে আমার বাবাকে কেন মেরে ফেললেন?আমি না পারছি আপনাকে ছেড়ে থাকতে, না পারছি আপনাকে নিয়ে থাকতে।আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না”
শান পাখির মনের অবস্থা বুঝতে পারে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”যদি কোনদিন বুঝো আমি নির্দোষ, ক্ষমা করতে পারবে তো নিজেকে?”
ততোক্ষনে কান্নার বেগ কমে আসে পাখির। কোন কিছু না বলে হেচকি তুলে কাঁদে শুধু।শান বিছানায় বসিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে বলে, “আমি তোমার সামনে পিছনে আশেপাশে কোত্থাও থাকব না শুধু একটা শিওরিটি দাও”
“কি?”
“আমার বাচ্চাটার কোন ক্ষতি হয় এমন কিছু তুমি করবা না।পাখি বিলিভ মি,যখন বাবা হই নি তখন বুঝতে পারি নি এর ফিলিংস টা ঠিক কতোখানি!কিন্তু এখন বুঝতেছি এটা আসলে আল্লাহ্ তাআলার কতোবড় নেয়ামত।আমায় শিওরিটি দাও নিজের খেয়াল রাখবে!”
পাখি চোখ মুছে বলে,”ওর মা আমি। তাই দূঃচিন্তা আমার বেশি।আর আমি কোন খুনি না যে বাচ্চাটাকে মেরে ফেলব”
শান চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস ছাড়ে।আচমকা পাখির পেটে পরপর কতোকগুলো চুমু খেয়ে দ্রুত উঠে চলে যায়।

🌸🌸
“আমায় মাফ করবেন, আপনার মেয়েকে নিয়ে কোনমতেই আর সংসার করা সম্ভব না আমার। “-বৈঠক থেকে উঠতে উঠতে বলে ফয়েজ।প্যান্টের পকেটে হাত রাখতে রাখতে আবার বলে, “ওকে নিয়ে যান।ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবো আমি!”
ফয়েজের কথায় সামিহার বাড়ির সকল লোকজন হা হয়ে যায়।ফয়েজের বাবা মা সহ সবাই আজ নীরব।
কারণ সামিহার কার্যকলাপে সবাই অতিষ্ঠ আজ।ছোট ছেলের সুখী দাম্পত্য জীবনটা বিষময় করে তুলেছে এই সামিহা নীরা।

সামিহার মা কিছু বলতে যাওয়ার আগে ওর বাবা তাকে থামিয়ে বলে, “মেয়েদুটোকে আহ্লাদ দেয়ার পরিনাম বুঝলে তো!কেউ জেলে কেউ ডিভোর্সি!”

সামিহা শান্ত চাহনীতে চেয়ে আছে ফয়েজের দিকে।কখনো ভাবতেও পারে নি ফয়েজের মতো শান্ত ছেলে আজ এভাব ডিভোর্সের কথা বলবে।ফয়েজ একবারও সেদিকে না তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে যেতে যেতে বলে,”দেনমোহর সবটাই বুঝিয়ে দেব।সারাজীবন আপনার মেয়ে বসে বসে খেতে পারবে”
সামিহার চোখ বেয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পরছে।সে ভাবতেও পারি নি তার জিদ তাকে কোথায় এনে ছাড়বে।বোনের জন্যে এবার সত্যি সত্যিই সংসার টা ভেঙ্গে গেলো, ভাবতেই গা শিউরে ওঠে তার

🌸🌸
শান চলে গেছে আজ দুদিন হলো। এই দুদিনে পাখির দিকে তাকানো যাচ্ছে না।বাচ্চার খাতিরে ওর পরিবারের সবাই ওর সাথে কথা বলছে; এর বাহিরে কেউ কোন কথা বলে না ।কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে পাখি।হাঁটুতে মুখে গুঁজে ভাবতে থাকে,”কোন দোটানায় পরে গেলাম আমি।এরকম তো জটিল ছিলো না জীবন টা।আমি জানি আমি অসুন্দর।কিন্তু আপনি তো সুন্দর!তাহলে সুন্দরের ভিতরে এতো গলদ কেন তবে?কেন এতো নোংড়া একটা খেলা খেললেন?”

দিনগুলো কোনভাবে কেটে গেলেও রাতের বেশিরভাগ সময় কেটে যায় শানের কথা ভেবে।তার সাথে কাটানো প্রতিটা সময়, প্রতিটা মূহূর্ত যেন কাঁটার মতো বিধছে পাখির মন-মগজে।হঠাৎ হঠাৎ কিছু খেতে ইচ্ছে করে আবার ইচ্ছেটা দমে যায়।শান থাকলে হয়ত জোড় করে খাওয়াতো।কিছুতেই নিজেকে শানের ভাবনা থেকে সড়াতে পারছে না।রাগে দূঃখে ঘরের কয়েকটা ফুলদানি ভেঙ্গেও ফেলেছে।কখনো ছাদে গিয়ে আনমনে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কেঁদে চলেছে কখনো বা শাওয়ারের নিচে বসে বসে চোখের জল ফেলছে।শানকে ছাড়া তার একটা মূহূর্তও ভালো কাটছে না অথচ এটা ভেবে বসে আছে শানই তার বাবাকে মেরেছে।

দুইদিনের মাঝে একবারও শান ফোন দেয় নি।কল সেন্টার থেকে কল আসে, বন্ধু বান্ধবী, শ্বশুর-শ্বাশুরি সবার থেকে ফোন আসে তবু শানের থেকে ফোন আসে না।বুক ফেটে কান্না আসে পাখির।

পরদিন সকাল বেলা শর্মিলা বেগম, আহমেদ সাহেব চলে আসেন পাখিকে দেখতে।ভীষণ খুশি তারা।এই প্রথম তারা দাদা-দাদি হতে চলেছে।খুশির বাঁধ যেন মানছেই না।তাই তো পাখিদের বাড়ির সবার জন্যে ফল মিষ্টি অন্যান্য খাবারাদি নিয়ে চলে আসেন তারা।তাদের দেখে খুশিতে আত্মহারা রাশিদা বেগম।বসতে দেন ড্রয়িং রুমে।পাখি নিচের আনাগোনা শুনে ধীর পায়ে নেমে আসে।শর্মিলা বেগম সেদিক চেয়ে দ্রুত হাসিমুখে উঠে গিয়ে পাখিকে ধরে।
পাখি অবাক হয়ে বলে,”মা আমি ঠিক আছি”
“তুমি বললেই হলো, প্রথমের দিকের এই সময় গুলো খুব বিপজ্জনক বউ মা।সাবধানে থাকবে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামার কি দরকার বলো!”-পাখিকে ধরে আনতে আনতে বলে শর্মিলা।

রাশিদা ফোঁড়ন কেটে বলে,”ছাড়ুন বেয়ান। উনি শিক্ষিৎ মানুষ;খুব বুঝদার.।আমাদের কোন কথা কি তিনি শুনবে?”
“এভাবে বলবেন না বেয়ান।হাজার হোক আমার বউ মা সে”-আফসোসের সহিত বলে শানের মা।
রাশিদা হতাশাব্যাঞ্জক মুখে বলে,”আপনার বউ মা আমার কোন কথা শোনে না বেয়ান।সারাদিন কেঁদে কেঁদে সময় কাটায়।ওর বাবা চলে যাবার আজ সাত দিন চলছে।”
দূঃখভারাক্রান্ত গলায় একটু থেমে আবার বলে,”কোন মানুষই অমর না।সবাইকেই যেতে হবে;আজ আর কাল।তাই বলে এভাবে না খেয়ে, না দেয়ে থাকতে হবে!ও যে আরেকজনকে দুনিয়া দেখাতে চলছে তার কথাও তো ভাবতে হবে নাকি!”

মলিন মুখে শর্মিলা বলে,”আমার তো মনে হয় বেয়াই সাহেবের শোকে না, অন্যকোন কষ্টে আছে আমাদের বউ মা।”
পাখি অপরাধীর ন্যায় বসে এদিক সেদিক তাকায়।

শর্মিলা ছেলের বউয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আবার বলে,”আমি ওখানে নিয়ে যাই বেয়ান।এখানে বীনা মার দেখাশোনা আবার বউমার দেখাশোনা আপনার জন্যে অনেক কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে”
“আমি যাবো না মা”
পাখির একরোখা কথায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন রাশিদা বেগম।ওনাদের নাস্তা দিয়ে খাবারের বন্দবস্তে লেগে পড়েন।

“আর কেউ আসেনি মা?মামানে টিনা, রনি ভাইয়া?”
আহমেদ সাহেব মুচকি হেসে শর্মিলার দিকে তাকান।
পানির গ্লাস টা রাখতে রাখতে বলেন,”না মা আর কেউ আসে নি।যাকে দেখতো চাও তাকে ডেকে নিলেও তো পারো”
শ্বাশুরি মায়ের কথায় পাখি লজ্জাবোধ করে ভীষণভাবে।
“আমার মাথা ব্যথা করছে মা, আমি উপরে যাই?”
শর্মিলা হাত টেনে পাখিকে বসিয়ে বলে,”এইটা সাথে করে নিয়া যাও বউ মা”
“কি ওতে মা?”
“আমরা কি জানি। শুধু বললো এটা তোমার হাতে দিতে।তাই না ফয়েজের বাবা”-
আহমেদ হেসে বলে,”বউ মা উপরে নিয়ে খুলে দেখো।আমরা দেখিনি কি ওর ভিতরে”
প্রশ্নবাচক চোখে পাখি তাকাতেই শর্মিলা ইশরায় উপরে যেতে বলে।

……
প্যাকেট টা খুলে চোখ জ্বল জ্বল করে পাখির।অনেক গুলো টক ঝাল মিষ্টি আচারের ছোট ছোট বয়াম।দেখে অবাক হয়ে যায় সে।বিভিন্ন রকমের চানাচুর সাথে মিষ্টি কুকিজের প্যাকেট।পাশেই ছোট্ট একটা চিরকুট।
“জানি, এই সময় তোমার মন কি চায়!অল্প করে পাঠিয়েছি।শেষ হলে আবার কারো দ্বারা পাঠাব।লাভ ইউ, নিজের যত্ন নিও সাথে আমার বেবিটারও”

পাখির চোখ ভরে আসে।কাঁদার কোন শক্তিই আর শরীরে নাই।তবুও চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়াচ্ছে।একহাতে জল মুছে চিরকুটটা বুকে নিয়ে কেঁদে কেঁদে অস্ফুট স্বরে বলে,”আমি পারব না আপনাকে ছেড়ে থাকতে।আমি পারছি না। ”

হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে।অনিচ্ছে সত্বেও ফোনটা রিসিভ করে পাখি।রাখি ফোন করেছে।পাখিকে অনেক শান্তনা দিয়ে শেষে কলেজের সংবাদ টা দেয়।
“আমাদের মাস্টার্সের ফর্ম ফিলাপ শুরু হয়ে গেছে,এক্সাম দিবি না?”
পাখি হতাশ স্বরে বলে, “দিবো”
রাখি বুঝতে পারে পাখির কিছু এটা হয়েছে।জিজ্ঞেসা করতে যাবে কি হয়েছে তার মাঝেই ফোনটা খট করে কেটে দেয় পাখি।
পাখির অস্বাভাবিক আচরন রাখির ঠিক মনে হলো না।নম্বর ডায়াল করে শানের

🌸🌸

সকাল সকাল পাখি রেডি হচ্ছে রংপুরে আসার জন্যে।সোহানের কি কাজ আছে রংপুরে সে নিয়ে যাবে সাথে।নিকাবের পিন লাগাতে লাগাতে কানে বাজে গাড়ির হর্ণের কর্কশ শব্দ।মুখে বিরক্তিসূচক শব্দ করে পাখি বেলকোনিতে চলে যায়। গিয়ে চক্ষু ছানাবড়া তার।
“উনার গাড়ি এখানে”
তৎক্ষনাৎ ফোনে মেসেজের টুংটুং শব্দে ফোন হাতে নেয় পাখি।
“রাফির দ্বারা গাড়ি পাঠিয়েছি।গাড়িতেই কলেজ যাতায়াত করতে হবে।না না করলে অন্য পথ বেছে নিতে বাধ্য হবো”

শানের মেসেজে পাখি অবাক হয়ে যায়।ভাবতে থাকে,”উনি জানলেন কি করে কলেজ যাবো আজ।রাখির বাচ্চা!”

সোহানকে ডাকতে যায়।সোহান উত্তরে বলে,”গাড়ি আসছে গাড়িতে যা। আমার কাজ নাই আজ আর”
“আমি ও গাড়িতে যাবো না।তুই কি নিয়া যাবি? ”
সোহান একরোখা জবাব দেয়, “না”

🌸🌸

পাখি হনহন করে নিচে নেমে আসে।রিক্সার জন্যে দাঁড়ায়।রাফি এগিয়ে এসে বলে,”ম্যাডাম স্যার গাড়িতে যেতে বলেছে”
“ভাইয়া উনাকে বলে দিয়েন আমি একাই যেতে পারব।আর আপনি চলে যান।”
রাফির অনেক জোড়াজুড়িতেও পাখি রাজি হচ্ছিলো না।তাই দুষ্টু বুদ্ধি আঁটে রাফি।
“ম্যাডাম, স্যার বলেছে আপনি গাড়িতে না গেলে আমার চাকরি থাকবে না”-কাঁদো কাঁদো স্বরে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে রাফি।

পাখি সেদিকে চেয়ে আর কিছু বলতে পারে। কেন যেন তারও কান্না পাচ্ছিলো।পরে দ্রুত গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢোকে।

ঘন্টা খানিকের মাথায় গাড়ি কলেজের গেইটে এসে থামে।পাখি নেমে যায় গাড়ি থেকে।
“আপনি চলে যান। আর আসতে হবে না।আমি একাই চলে যেতে পারব”-রাফির জানলার কাছে এসে একটু ঝুঁকে বলে পাখি।এরপর গেইট দিয়ে ভিতরে ঢুকে যায়।

ফর্ম ফিলাপ চলছে বলে কলেজে আজ শিক্ষার্থীর আনাগোনা অনেক বেশি।এতোবড় এড়িয়ায় রাখিকে কোথায় খুঁজবে পাখি।তাই ফোন বের করে, রাখির দেয়া ঠিকানায় চলে যায়। কাজ চলছে কলেজের অফিস কক্ষে।গরমে অবস্থা খারাপ সবারই।
রাখি সহ অন্যান্য বান্ধবীরা বসে আছে ঠান্ডা ছায়াময় একটা বেঞ্চে।সেদিকে এগিয়ে গিয়ে কয়েকটা কিল বসায় রাখিকে।
রাখির আর বুঝতে বাকি থাকি না এদের দুজনার মাঝে কিছু হয়েছে।

ওদের কথার মাঝেই একজন এসে পাখিকে ডেকে যায়।রাখিসহ সেদিকে যায়।
“তোমাদের মাঝে পাখি কে? ”
“জ্বি আমি!’
“তোমার কাগজপাতি দাও।তাড়াতাড়ি ফর্ম টা ফিলআপ করো”
পাখি অবাক হয়ে যায়।গরমে অবস্থা বেহাল বলে আর কোন কথা না বলে দ্রুত কাজ সেড়ে নেয়।রাখিও একই সময়ে কাজটা সেড়ে বাহিরে বেরিয়ে আসে।
“আমার মনে হয় তোর সার্জন সাহেব এতোকিছু করছে।তার কথাতেই মনে হয় আমাদের ফর্ম টা তাড়াতাড়ি ফিলআপ হলো।”-
রাখির কথায় পাখি রাগি চোখে তাকিয়ে থাকে।কারণ পাখিরও বোঝার বাকি নেই কাজ টা কে করেছে।

দুজনে এসে বসে আগের জায়গায়।পাশেই কয়েকটা মেয়ে বসে আছে।
“শুনেছিস, ডাক্তার শান নাকি বউ ডিভোর্স দিয়েছে?”
আরেকজন বলে ওঠে,”যাক ভাই আমার সিরিয়াল তবে ক্লিয়ার!”
“যাই বলিস বড়লোকদের ব্যপার সেপার। তাদের কি আর এক বউয়ে জীবন কাঁটে?”
“তা যা বলেছিস।আরে আমি তো নিজেই দেখেছি বউটা দেখতে কেমন কালো কুৎসিত।মায়ের পছন্দে বিয়ে করেছে তা দিয়ে কি আর সারা জীবন চলা যায়?”
“কিভাবে দেখলি তুই?”
“আমার বান্ধবী টিনা আছে না, ওর ভাবি।”
“ওহহহহহহ,তাই বল!”

পাখির চোখের পানি বাঁধ মানছে না আর।রাখি স্তব্ধের ন্যায় শুনে যাচ্ছে সবটা।
“এসব কি বলছে ওরা?”
পাখি ছলছলে চোখে তাকায় রাখির দিকে।কিছু বলে না।
“কি রে বলবি তো কি হয়েছে?”
পাখি এরপর কাঁদতে কাঁদতে সমস্ত কথা বলে দেয়।
“সামিহা ভাবি বললো আর তুই বিশ্বাস করলি?”

“ওঠো,উঠে দাঁড়াও”-ওদের কথার মাঝে শানের গলার স্বরে পিছন ফিরে সবাই অবাক হয়।
“তুমি টিনার ঐ বান্ধবী তাই না, মেহেদী দিয়ে নিছিলা পাখির থেকে?
“ভাভাইয়া আসলে!”
“জাস্ট শাট আপ!কতোটুকু জানো আমার লাইফের ব্যপারে?আর এভাবেই বুঝি বান্ধবীর পরিবারে কথা বাহিরে বলে বেড়াতে হয়।লজ্জা করলো না! তোমাদের কি মিনিমাম কমন সেন্সটুকুও নেই।শিক্ষিত হচ্ছো অথচ অন্যের লাইফের ব্যপারে গোসিপ করছো!
মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলে মেয়েটা।কিছু বলতে পারে না।ততোক্ষনে একটা গোল সমাহার তৈরী হয়।

পাখি চোখের পানি মুছে।ব্যাগটা কাঁধে টেনে সামনে হাঁটা ধরে।রাখিও পিছন পিছন ছোটে,”পাখি দাঁড়া না। এভাবে যাস না!”
পাখি ছুটে যায় অনেকটা দূরে।শান এসে ওর হাত ধরে ফেলে।
“হাত ছাড়ুন আমার ”
শান ছোট ছোট চোখে পাখির দিকে তাকিয়ে আছে।
“কি হলো ছাড়ুন বলছি!”
“কোন প্রকার সিন ক্রিয়েট করবা না এখানে।চুপচাপ হেঁটে গাড়িতে গিয়ে বসবা”
শানের কথায় পাখি রাগি চোখে তাকিয়ে হাত ঝাড়া মেরে সামনে চলতেই শান ওকে কলেজ মাঠেই সবার সামনে কোলে তুলে নেয়।
“নির্লজ্জ লোক।ছাড়ুন আমায়।কি হচ্ছে, সবাই দেখছে না?”
শান ওকে কোলে নিয়ে চলছে সামনে তাকিয়ে।একটু পরে বলে,”সবাই যে ভুল ধারনার উপর সমালোচনা করছে তা ভেঙ্গে যাক”
“ওহহহ আচ্ছা, শোঅফ তাহলে!”
পাখির কথায় শানের পা থেমে যায়।এক নজরে দেখে আবার দ্রুত হাঁটা ধরে গাড়িতে এনে বসায়।

🌸🌸

“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমায়, মগের মুলুক নাকি?আমি আমার বাড়ি যাবো। সোজা চলুন”
ইউটার্ণে গাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে শান বলে, “অনেক হয়েছে তোমার নাটক।আর সহ্য করতে পারব না।এখন থেকে আমার ঘরের চার দেয়ালেই তোমার বসবাস।”
“যাবো না আমি। চিৎকার করব কিন্তু বলে রাখছি!
“করো”
পাখি কান্নাভরা চোখে বলে”এমনটা করছেন কিসের জন্যে?”
“এক কথা বার বার বলতে পারব না। আমার বাচ্চার জন্যে। বাচ্চা ডেলিভারি হবে, আমার বাচ্চা আমায় দেবে।তারপর পৃথিবীর কোন প্রান্তে যাও যাও। আমি বাঁধা দিবো না”

শানের কথায় পাখি হা করে চেয়ে থাকে শানের দিকে।
“কক্ষনো না”
“তাহলে তোমার কোন উপায় নাই।খুনির সাথেই ঘর করতে হবে।”

চলবে…….

#আসক্তি
পর্বঃ৪২
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

“বউ মা! “-অবাক হয়ে সদর দরজা দিয়ে পাখিকে ঢুকতে দেখে বলেন শর্মিলা বেগম।হাসিমুখে সবার সাথে পাখি কুশল বিনিময় করে।এরপর শান তাকে অাস্তেধীরে উপরে নিজের ঘরে নিয়ে যায়।এতোসবের মাঝে বাড়ির সকলেই কানাকানি শুরু করে দিয়েছে।”হঠাৎ কি এমন হলো যে সবটা এতো তাড়াতাড়ি ঠিক হলো!”
শর্মিলা বেগম ঝাঁঝালো গলায় বলেন, “ভাবনা তো আমার মাথাতেও এসেছে। তবে যাইই হোক বউমা এসেছে।সবটা ঠিক হয়েছে এটাই অনেক”

(কিছুক্ষন আগে)
“আমি থাকব না আপনার সাথে। বাড়ি যাবো আমি ”
কি হলো কথা কানে যায় না?”
শান কোন কথা বলে না।রাগে চোয়াল শক্ত করে গাড়ির স্পিড দ্বিগুন পরিমান বাড়িয়ে দেয়।গাড়ির গতি দেখে পাখির কলিজা শুকিয়ে যায়।ভয়ে ভয়ে বলে,”এতো জোড়ে গাড়ি কেন চালাচ্ছেন।কমান বলছি, স্পিড কমান”
শান কোন কথা না বলেই আবারও স্পিড বাড়িয়ে দেয়।এবার পাখি ভয় পেয়ে যায়।কাপাকাপা হাতে শানের হাত ধরে কিন্তু মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয় না।
“আমি খুনি তাই তো?এই কয়টা দিনে আমায় মানসিকভাবে যতোটা ভেঙ্গে দিয়েছো তার দাম তোমায় দিতে হবে।তোমার দেয়া বাদনাম নিয়ে বাঁচতে পারব না।আবার তোমায় ছাড়া থাকতেও পারব না। তাই একসাথেই মরব দুজন।ওপসসস সরি, তিনজন।ভালো হবে না বলো?”-গাড়ির স্পিড আরো বেশি বাড়িয়ে বলে চলেছে শান।
“না না না না, আমি মরতে চাই না।আপনাকেও মরতে হবে না।আমি আর কোনদিন খুনি বলব না।প্লিজ গাড়ি থামান।আমার ভয় করছে”
শান তবুও গাড়ি থামায় না।ওভার স্পিডে চালাতে চালাতে বলে,”কথা দাও আর কখনো বলবা না।সবটা আগের মতো চলবে?”
“হুমমম হুমম এই যে ককথা দিলাম।আর বলব না”-শানের হাত ধরে বলে পাখি।

হঠাৎ গাড়ি থেমে যায়।হকচকিয়ে ওঠে পাখি।ঠোঁট উল্টে কেঁদে ফেলে।ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে।শান অবস্থা বুঝতে পেরে এগিয়ে গিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে নেয় পাখিকে।ভয়ে গুটিশুটি হয়ে যায় পাখি।কলারে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে।শান মুচকি হেসে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয়।কেউ কোন কথা বলে না।
পাখির কান্নার বেগ একটু কমে আসলে পানির বোতলটা হাতে ধরিয়ে দেয় শান।এরপর স্লো মোশনে গাড়ি ড্রাইভ করে বাড়ি পৌঁছে যায়।

🌸🌸
ঘরে এসেই পাখি গুটিগুটি পায়ে ওয়াশরমে চলে যায়।ভয়ের রেশ টা এখনো কাটে নি তার।ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় বসে পরে।শান প্লেটে কিছু ফল আর মিষ্টি নিয়ে আসে।
“এই মূহূর্তে এসব শেষ করবে। একটাও যদি প্লেটে অবশিষ্ট দেখেছি তবে মনে রেখো আমি কি রকম খারাপ হতে পারি”-শানের তেজী গলার স্বরে পাখির অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে।ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে পরে।জোড় করে কয়েকটা ফলের স্লাইস মুখে দিতেই হরহর করে বমি করে দেয় সামনে বসে থাকা শানের গায়ে।
মুখ কুচকে ফেলে শান।
হন্তদন্ত হয়ে পাখি বলে,”আমি বলেছিলাম এসব খাবো না।খাবার দেখলে বমি আসে আমার।আমার কি দোষ,তবুও দিলো”
পাখির মুখ দেখে শানের বড্ডো হাসি পায়।হাসি চেপে রাগি চেহারায় উঠে চলে যায় ওয়শরুমে।

…….
রাত বাজে ১.৩০
শান বুঝতে পারে বুকের উপর পাখি নেই।ভয় ঝেঁকে ধরে।তড়িঘড়ি করে চোখ খুলে দেখে পাখি বিছানায় বসে হাত পা মুচরা মুচরি করছে আর ফুফিয়ে কাঁদছে।শানের বুকের ভিতর কেপে উঠলো।জানতে চাইলো
“কি হয়েছে পাখি?”
পাখি একনজর সেদিকে তাকিয়ে আবার আগেরর মতো কাজ করে।
“বলোনা, কি হয়েছে?”
পাখি কান্নাজড়িত কন্ঠে করূনস্বরে বলে,”হাত পা ব্যথা ব্যথা করছে। ঘুমাতে পারছি না।কিছু ভালো লাগছে না”
শান বুঝতে পারে প্রেগন্যান্সির শুরুতে এরকম হাজারও অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিসের উদয় হয়। তাই দেরি না করে দ্রুত হাত গুলো টিপে টিপে দেয় পাখির।পায়ের কাছে যেতেই সিটকে সরে যায় পাখি।
“না না থাক পায়ে না’
“কেন”-ছোট ছোট চোখে বলে শান।
মুখ ঘুরিয়ে জবাব দেয় পাখি”এমনিই”
শান ওর কথার তোয়াক্কা না করে কোলের উপর পা দুটো নিয়ে আলতো আলতো হাতে ম্যাসাজ করে দেয়।একটু রিলিফ পেতেই ঘুমিয়ে পরে পাখি।কিছুক্ষন পর শানও ঘুমিয়ে পরে।

🌸🌸
“এই দুধ টা আর ফল গুলো এখনি শেষ করবে। টাইম মাত্র ১০ মিনিট”-শার্টের হাতার বোতাম লাগাতে লাগাতে বলে শান।
পাখি চোখ মুখ খিচে রাগি স্বরে বলে,”সকাল সকাল এতো টরচারের মানে কি? পারব না…..”
শানের দিকে চেয়ে গলার স্বর মিইয়ে যায় পাখির।শান রাগি চোখে তাকিয়েই আছে।
মিনমিনে গলায় পাখি আবার বলে,”না মানে, দুধ তো আমার আগে থেকেও অপছন্দ আর ফল খেলে কি হয় তা তো কাল বুঝতেই পারলেন তাই না”
শান আবারও ঘুরে ড্রেসিং টেবিলে নিজেকে সেট করতে করতে বলে,”সবটা ঠিক হয়ে যাবে”
আয়না দিয়েই পাখির পেটের উপর চোখ রাখে শান।মুচকি হেসে ওঠে আনমনেই।রেডি হয়ে পাখির সামনে দাঁড়ায়।পাখি রাগে মুখ সরিয়ে নেয়।জানে এখন শান কি করতে চলেছে!.
পাখিকে অবাক করে দিয়ে বিছনায় বসে পেটের উপর হাত রেখে আনমনে শান ভাবে,”সবটা আমি প্রান ভরে উপভোগ করতে চাই”
এরপর মাথাটা নিচু করে সামান্য ফুলে ওঠা পেটের উপর পর পর কতোগুলো চুমু খেয়ে পাখিকে বলে,”সময় মতো গোসল,সময়মতো খাওয়া সবটাই যেন সময়মতোই হয়।নইলে খবর খারাপ করব তোমার।আসছি আমি”
বেরিয়ে যায় শান। যাওয়ার বেলা টিনাকে বলে যেন সবসময় পাখির সাথে গল্প স্বল্প করে।সুমিকে বলে যেন পাখির কোন কিছু লাগলে সাহায্য করে।

…..

“টিনা, সামিহা ভাবি কোথায়? একবারও চোখে পড়ে নি আজ?”
টিনা থমথমে মুখে জবাব দেয়,”ভাবিকে ভাইয়া বাড়ি পাঠিয়েছে। আর ডিভোর্সের কার্যক্রম চলছে।
পাখি অবাক হয়ে যায়। চমকে উঠে বলে,”ডিভোর্স!কিন্তু কেন?”
টিনা সরুচোখে তাকিয়ে বলে,”তোমার কি মনে হয় ভাবি মেঝভাইয়া তোমার বাবাকে মেরেছে?”
ব্যপারটা কে যতো ভোলার চেষ্টা করে ততোই যেন মাথায় চড়ে বসে।রাগে চোখ মুখ শক্ত করে বলে,”এসব কেন বলছো?আর মনে হওয়ারই বা কি আছে।তোমার ভাই নীরার সাথে দেখা করেছে,আমাকে সড়ানোর প্ল্যান করেছে সবটাই শুনেছে বাবা।এসব তো আর মিথ্যে না।”

টিনা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জবাব দেয়, “সবই ঠিক আছে ভাবি। তবুও এখানে কিছু রয়ে যায়।সামিহা ভাবি তোমায় মিথ্যা বলেছে।আর এটা নতুন নয়।নীরা আপুকে নিয়ে এর আগেও অনেক কিছু হয়েছে বাড়িতে।তখনিই ফয়েজ ভাই ভাবিকে ডিভোর্স দিতে চেয়েছিলো।মেঝভাইয়ার জন্যে হয় নি।তবে এবার তোমার মাথায় যে ভুলভাল কথা ঢুকিয়েছে সেটার শাস্তিস্বরূপ তাকে ভাইয়া ছেড়ে দিয়েছে”

টিনার কথাগুলো মাথায় সুচের মতো বিঁধছে পাখির।আনমনে ভাবতে থাকে,”তারমানে সত্যিই কি তবে সামিহা ভাবি মিথ্যা বলেছিলো?তা না হলে ডিভোর্সের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেবে তাও ফয়েজ ভাইয়ের মতো সাদা মানুষ, ভাবাও যায় না।”
পাখি কিছু না বলে চুপ করে আছে।মনের মাঝেও কোথাও যেন তোলপাড় শুরু হয়ে যায়।মন কোন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না।টিনা আরো কিছুক্ষন গল্প করে চলে যায়।

…..

🌸🌸
সিঁড়ি বেয়ে কারোর উপরে আসার আন্দাজ করতে পারে পাখি।নিজেকে ঠিকঠাক করে নেয়।
“ফুপা,তুমি”-শ্বাশুরি মায়ের সাথে নিজের ফুপাকে এভাবে চোখেরর সামনে দেখবে ভাবতেও পারে নি পাখি।
ঘরে এনে সোফায় বসিয়ে দেয়।
“এই নিন আপনার ভাতিজি।এবার কথা বলুন ভাইসাহেব।আমি নিচে যাই”-বলেই শানের মা হাসি মুখে নিচে নেমে এসে সুমিকে তাগাদা দেয় উপরে নাস্তা দিতে।

“হঠাৎ রংপুরে যে ফুপা।তোমার কোন কাজ ছিলো? “-হরবরিয়ে বলে পাখি।জব্বার সাহেব ঘরটায় চোখ বুলিয়ে বলে,”সত্যিই ভাগ্যকরে তোর বাবা এমন জামাই পেয়েছিলো রে”
বাবার কথায় মন খারাপ হয়ে যায় পাখির।চোখের পানি মুছে বলে,”বসো না।আজ থেকে যাবা কিন্তু!”
“না রে মা আজ না;আরেকদিন।একটু ছিলো রংপুরে।ভাবলাম দেখা করে যাই তোর সাথে”
“ভালো করেছো”-হাসিমুখে বলে পাখি।
“তোকে একটা কথা বলব? ”
“হ্যা বলো না ফুপা!”
” জামাই খুবই ভালো মানুষ রে মা।আর কোন ক্যাচাল না করে মন দিয়ে সংসার কর।”-বলতে বলতেই জব্বার সাহেব পাখির দিকে তাকান।
পাখি বুঝতে পেরে চট করে মুখে হাসি এলিয়ে বলে, “আমি খুব ভালো আছি ফুপা।চিন্তা করো না”

জব্বার সাহেব পাখির মুখে হাসি দেখে ভাবলেন হয়ত সবটা ঠিক হয়েছে তাই আর আগের কথা তুলে মেয়েটার মন খারাপ করতে চান নি তিনি।এরপর রাতে খেয়ে চলে যান বাড়িতে।

সারাটাক্ষন টিনার কথাগুলো মাথায় এসেছিলো।ফুপার বলা কথাগুলো মনে উঠছিলো পাখির।”কোথাও কোন ভুল হচ্ছে না তো আমার”

শান রাতে বাড়িতে ফিরে দেখে পাখি ঘুমিয়ে পরেছে।ড্রেস চেঞ্জ করতে করতে সেদিকে চেয়ে মুচকি হেসে ওয়াশরুমে চলে যায়।ফ্রেশ হয়ে নিচে থেকে খেয়ে আসে।হাতের কয়েকটা কাজ সেরে পাখির পাশে শুয়ে পরে।

🌸🌸

সকালে উঠে চোখ পড়ে দেয়ালে টাঙ্গানো নানান রকমের ফুল আর প্রকৃতির ছবির উপর।আনমনে হেসে ফেলে পাখি। বিছানায় চেয়ে দেখে শান নেই।ভ্রকুচকে চারপাশে তাকায়।কোথাও খুঁজে পায় না।

সিঁড়ি বেয়ে গুটিগুটি পায়ে নিচে নেমে আসে।সেখানেও শান কথাও নেই।মনটা খারাপ হয়ে যায়।নাস্তা সেরে দাদির ঘরে গিয়ে কিছুক্ষন গল্প করে।মনটা তবুও ভালো লাগছে না।সারাদিন পার হয় ছটফট করে। কোথাও মন টিকছে না আজ।

সন্ধ্যা হয়ে যায় তবুও সার্জনের দেখা নেই।এবার যেন কষ্ট গুলো কান্না হয়ে ধরা দেয়।
টিনা এসে অনেক গুলো আচারের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে গেছে। সেগুলোই বসে বসে খাচ্ছে আর চোখের পানি নাকের পানিতে একাকার করছে।

দরজা খোলার শব্দে পাখি চোখ মুখ মুছে সেদিকে তাকায়। শান দরজাটা বন্ধ করে ঘরে ঢুকে এক নজর পাখির দিকে তাকিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।মুখ মুছতে মুছতে বের হয়ে বলে,”কান্না করছিলা কেন?”
পাখি কিছু বলে না।আপন মনে আচার খেয়ে যাচ্ছে।
শান তোয়ালেটা মেলে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,”এতো আচার খাওয়া যাবে না।রাখো”
পাখি তবুও কিছু বলে না।খেয়েই চলেছে।
শান এবার রেগে গিয়ে চট করে প্যাকেটটা কেড়ে নিয়ে নিজে খাওয়া শুরু করে।

দু একবার মুখে নিতেই মুখে বিশ্রীভাব এনে বলে,”এগুলো কি করে খাচ্ছিলে? এতো টক”
শানের মুখোভাব দেখে মনে হচ্ছে দুনিয়ায় এর থেকে বিশ্রী খাবার আর নেই।
“এসব খাওয়া যাবে না। কাল তোমায় ভালো টা এনে দিবো, ঘুমাও এবার”
পাখি কিছু না বলে আরেকটা প্যাকেট খুলে মুখে নিতেই শান রেগে তেড়ে যায় পাখির দিকে।ঝুঁকে গিয়ে বলে,”এতো তেজ দেখাইও না।আমি রেগে গেলে এবার তোমায় হাত পা বেঁধে গাড়িতে ঢুকাব।আর গাড়ি স্টার্ট করে ছেড়ে দিবো”

পাখির চোখ মুখ শুকিয়ে আসে গতবারের কথা ভেবে।
শুকনো ঢোক গিলে মুখ নিচু করে ফেলে পাখি।পাশ ফিরে শুয়ে পরে।শানও একটু পর এসে শুয়ে পাখিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।কাঁধে মুখ গুঁজে দেয়।পাখির অস্থিরতা বাড়তেই কাচুমাচু করে।শান ধমক দিয়ে মুখে বিরক্ত সুচক শব্দ বের করে বলে,”শাস্তির কথা ভুলে গেলা! ”
পাখি শান্ত হয়ে যায়।

🌸🌸
রাত তখন ২.৩০।বাহিরে ভীষণ ঝড় শুরু হয়েছে।জানলার কাপড় গুলো ফরফর করে উড়ছে।বাজে স্বপ্নে ঘুম ভাঙ্গে পাখির।সারা শরীর ঘেমে একাকার।অস্ফুট স্বরে কেঁদে ওঠে।বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় শানের।খেয়াল করে পাখি আজও বসে কাঁদছে।
অস্থির হয়ে হাত পা মালিশ করা শুরু করে।হকচকিয়ে যায় পাখি।
“ব্যথা করছে না”-গম্ভীর গলায় জবাব দেয়।
শান শান্ত ভঙ্গিতে বলে, “কি হয়েছে তবে! ”
পাখি কিছুক্ষন ড্রিম লাইটের আবছা আলোতে শানকে দেখে মুখে ঘৃনার ভাব এনে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

শান ওকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলে,”কি হয়েছে জানতে চাইছি তো”
“আপনার কি মনে হয়, আমাকে আটকে রাখতে পেরেছেন বলেই আমি আছি? -শক্ত গলায় বলে পাখি।
শান সন্দিহান চোখে চেয়ে বোঝার চেষ্টা করে পাখি কি বোঝাতে চাইছে।
শানের প্রতিক্রিয়া না বুঝে পাখি আবারও বলে, “আমি চাইলেই আপনার বাড়ি ঘর আপনাকে ছেড়ে চলে যেতে পারি। কিন্তু যাচ্ছি না কেন জানেন?কারণ আমি নিজেই আপনাকে ছেড়ে থাকতে পারি না।নেহাত আপনার আসক্তিতে আসক্ত আমি।নইলে কি আর নিজের বাবার খুনির সাথে এক বিছানায় থাকে কোন মেয়ে? ”
বলতে বলতেই কেঁদে ফেলে পাখি।

শান বুঝতে পারে পাখির মনের অবস্থা।হাত টা ধরতে ধরতে বলে,”বাবাকে নিয়ে বাজে স্বপ্ন দেখেছো”
পাখি হাত টা সরিয়ে বলে,”আপনার না জানলেও চলবে”
শান এবার চট করে পাখির দুবাহু ধরে বলে,”কি বললে,কিভাবে বললে বিশ্বাস করবে আমি বাবাকে মারি নি?বলো?ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড ড্যাম ইট, আমি কিচ্ছু করি নি।”

বেশ চিল্লিয়ে বলে শান।ঝড়ের রাত না হলে হয়ত বাড়ির সবাই জেগে যেত।পাখি ভয়ে সিঁধিয়ে যায়।
দুহাতে মুখ ঢেকে ফুফিয়ে কাঁদে।শান নিজের রাগকে কন্ট্রোল করে পাখির মুখটা আলতো হাতে আঁজলা ভরে তুলে বলে,”এভাবে কেঁদো না জান।আমাদের বেবির ক্ষতি হবে।আমায় বিশ্বাস না করো ভালো কথা। অপেক্ষা করো দেখবে কোন না কোন ভাবে তুমি তোমার উত্তর পেয়ে যাবা”

পাখি তবুও কেঁদেই চলেছে অনবরত।শান এবার আলতো করে কপালে চুপু এঁকে দেয়, এরপর ধীরেধীরে পাখির সারা মুখে ঠোঁটের স্পর্শে ভরিয়ে তোলে।পাখি হাত দিয়ে দূরে ঠেলে দিতেই শান একটু সরে যায়।নিশ্চুপ হয়ে চেয়ে থাকে পাখির দিকে।শানের সাড়া না পেয়ে চোখ তুলে তাকায় পাখি।শানের চোখের ভাষা বুঝতে অসুবিধা হয় না পাখির, আর না ক্ষমতা থাকে সেই চাওয়া ফিরিয়ে দেবার।শান এবার ধীরে মুখ ডুবিয়ে দেয় মুখ ফিরিয়ে রাখা পাখির চুলের গভীরে।কতোদিনের স্পর্শ যেন প্রথম স্পর্শ হয়ে ধরা দেয়।মেঘের ঝলকানিতে ঘরময় আলোকিত হয় বার বার।আর শানের স্পর্শে নববধূর মতো কেঁপে কেঁপে ওঠে পাখি।

🌸🌸

“চার মাস চলছে পাখি, একবার চেকআপ করাতে হবে।কাল রেডি থেকো আমি নিয়ে যাব মেডিকেলে।”-শান পাখির মাথায় চুমু খেয়ে বলে।
শানের বুকের উপর শুয়ে পাখি অস্ফুট স্বরে জবাব দেয়, “হুমম”

দুজন আজ এতো কাছে তবুও যেন মনের দূরত্ব আজ যোজন যোজন। শান ভাবতে থাকে,” এ দূরত্বও শেষ হবে খুব তাড়াতাড়ি।তবে তোমায় ছোট করে হলেও আমি আমার অনুপস্থিতিটা বুঝাব জান।একটু শাস্তি তোমারও প্রাপ্য আমায় কষ্ট দেয়ার জন্যে।ভাগ্যিস তুমি প্রেগন্যান্ট! ”

চলবে……