গোধূলী বেলার স্মৃতি পর্ব-৪৫

0
1526

#গোধূলী_বেলার_স্মৃতি (Unexpected story)
#পর্ব- ৪৫
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)

রুদ্রিককে দেখেই জেনি রুদ্রিকের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। নিজের স্বামীর বুকে অন্য কাউকে দেখে আমার বুকটা কেঁপে উঠলো। রুদ্রিকের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে জেনি কেঁদে উঠলো। আমি নিজের সামনে সবকিছু স্পষ্টভাবে দেখতে পারছি । ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি ছুটে গেলাম বাইরের দিকে।
রুদ্রিক কাজলকে দেখতে পেলো। তাই সে নিজের থেকে তাড়াতাড়ি জেনিকে ছাড়িয়ে কঠোর গলায় বলল,

—“কি করছো কি জেনি? বিহেভ ইউর সেল্ফ!
কাজল বোধহয় আমাকে ভূল বুঝলো। ”

জেনি অনুনয়ের চোখে তাঁকিয়ে বলল,

—“আমি আসলে বুঝতে পারিনি। সরি রুদ্রিক। আমি আসলে ইমোশোনাল হয়ে পড়েছিলাম। ”

রুদ্রিক আর অপেক্ষা না করে কাজলের পিছনে ছুটে চলল।

এইদিকে,

আমি এলোমেলো হয়ে হেঁটে চলেছি। হাটতেও কষ্ট হচ্ছে। রুদ্রিককে অফিসে যাওয়ার পরে, অফিসের একজন স্টাফ আমাকে যখন খবর দেয় জেনি অফিসে এসেছে,তখনি আমিও অফিসে যায়।বিষয়টা দেখার জন্যে,কিন্তু বিষয়টা দেখতে এসে এতো বড় সারপ্রাইজড হয়ে যাবো ভাবিনি। জেনি আবারোও রুদ্রিককের জীবনে ফিরে এসেছে। তাইতো রুদ্রিকের আচরণ এতোটা পরিবর্তন।
সবটাই আমি খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছি। আমার ভাবনার মাঝেই রুদ্রিকের গাড়িটা আমার সামনে আসে। আমি থেমে যাই। রুদ্রিক গাড়ি থেকে নেমে আমার কাছে এসে, আমার গালে হাত দিয়ে বলে,

—“জানেমান, তুই এইভাবে চলে আসলি কেনো?তুই জানিস? আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এতোটা দায়িত্বহীন কীভাবে তুই আমাকে বল? তুই কি ভূলে গেলি এখন তুই একা না আমাদের বেবী ও আছে তোর সাথে। ”

রুদ্রিকের কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাঁসি মুখে ফুটে উঠলো। আমি রুদ্রিকের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,

—“তাই বুঝি? তোমার মনে আছে? আমাদের সাথে এখন আমাদের বেবীও আছে। যদি তাই থাকতো তাহলে জেনীকে তুমি নিজের লাইফের আবারো এলাও করতে নাহ রুদ্রিক। ”

রুদ্রিক আমাকে কিছু বুঝাতে চাইবে,আমি আবারোও বলে উঠলাম,

—-“রুদ্রিক আমাকে কিছু বুঝাতে এসো নাহ। আমি সবকিছু নিজের চোখে সবকিছু দেখে ফেলেছি। সো তুমি আমাকে বুঝাতে এসো নাহ। আসলে ভূলটা আমারই ছিলো যে, আমি ভেবেছি তুমি হয়তো পরিবর্তন হয়ে গিয়েছো,কিন্তু আমি ভূল। ”

কথাটি বলে আমি কেঁদে উঠলাম।

রুদ্রিক আমার কথা শুনে তেমন একটা প্রতিক্রিয়া করলো নাহ।

কেননা সে জানে কাজলের প্রতিটা কথায় রয়েছে অভিমান। এই অভিমান দূর করতে অনেক কাঠখড় পুরাতে হবে।

রুদ্রিক নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল,

—-“চোখের দেখা যে সত্যি নয়, তা তো তুই খুব ভালো করে জানিস কাজল। আমি জানি তুই চোখের দেখাটা বিশ্বাস করিস নাহ।
তাহলে তবুও জোড় করে বিশ্বাস করছিস কেন?”

আমি কাঠকাঠ গলায় বললাম,

—“আমার থেকে তুমি আমাকে চিনো বেশি? ”

—-“হুম তুইতো শুধু আমার ভালোবাসার মানুষ তো নয় তুই আমার স্ত্রীও। সংসার করছি,অথচ নিজের স্ত্রীকে চিনবো নাহ। ভালোবাসলেই তো আর একজন মানুষকে চিনা যায়না তাইনা? আগে তাকে পুরোপুরিভাবে চিনতে হলে, তার সাথে সংসার করতে হয়।”

—–“তাইতো আমি তোমাকে চিনতে পারলাম নাহ রুদ্রিক। ”

—-“সত্যি চিনতে পারিস নি? ”

রুদ্রিকের কথায় কোনো জবাবা দিলাম। দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটতে লাগলাম। রুদ্রিক ও আমার পিছন পিছন হাঁটতে লাগলো।

আমি রাগ নিয়েই বাড়িতে হেঁটে চলে এলাম। বাড়িতে এসেই কাউকে কিছু না বলে নিজের রুমের দিকে রওনা দিলাম। আমার পিছন পিছন রুদ্রিক ও বাড়িতে চলে এলো।

রুদ্রিকের মা রুদ্রিককে ইশারা করে বলে ‘কাজলর হঠাৎ কি হলো? ‘

রুদ্রিক মাথা নাড়িয়ে বলল,

—“সব ঠিক আছে মা। ”

রুদ্রিক সিথির কাছে গিয়ে বলল,

—“তোকে রাস্তায় আসার পথে যা যা করতে বলেছিলাম, করেছিলি? ”

সিথি রুদ্রিককে ভরসা দিয়ে বলে,

—“তুই নিশ্চিন্ত থাক ভাইয়ূ। তুই এখন আমার অবুঝ
ভাবিকে গিয়ে বুঝাও। ”

রুদ্রিক উপরে গিয়ে দেখে,কাজল নিজের মতো বিড়বিড় করছে আর কাপড় সব ব্যাগে গুছিয়ে নিচ্ছে।

রুদ্রিক দেখে আমি মুখ ফুলিয়ে আবারো কাপড় গুছাতে শুরু করলাম। রুদ্রিক বলল,

—-“কোথায় যাচ্ছিস? ”

—-“আমি নিজের বাড়ি চলে যাচ্ছি। কেউ যেনো আমাকে না আটকায়। ”

রুদ্রিক কিছু না বললো নাহ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে জেল দিতে লাগলো। আমি রুদ্রিককে দেখে খানিক্টা অবাক হলাম বটে। এই মানুষটা আমার যাওয়ার কথা শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো নাহ কিংবা আমাকে আটকাতেও চাইলো নাহ। এতোটা পরিবর্তন কীভাবে?
আমার এখন গলা ফাঁটিয়ে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। আমি রুদ্রিকের দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে, বেড়িয়ে গেলাম। সিড়ির কাছে আসতেই রুদ্রিক আমাকে কোলে তুলে নিলো। আমি কিছুটা হচকিয়ে গিয়ে বললাম,

—“কি হচ্ছে কি? ”

রুদ্রিক আমাকে কোলে তুলে নিয়ে সিড়ি দিয়ে নীচে নামিয়ে দিয়ে বলল,

—“সিড়িতে তেল ছিলো পড়ে গেলে আমার বেবীর ক্ষতি হতো। তাই আর কি নীচে নামিয়ে দিয়ে গেলাম। এখন তুই যেতে পারিস।

কথাটি বলে রুদ্রিক চলে গেলো।

আমি রুদ্রিকের যাওয়ার পানে তাঁকিয়ে রইলাম। এই মানুষটাকে আমি চিনতে পারছি নাহ।
মা বাইরে চলে গেছে। তাই এই সুযোগেই আমি বেড়িয়ে গেলাম।

কাজল বেড়িয়ে যেতেই সিথি রুদ্রিকের কাছে এসে বলল,

—“ভাইয়ূ কাজল তো একা চলে যাচ্ছে। ”

—-“আপাতত আটকাস নাহ। ”

—-“কিন্তু ভাইয়ূ……

সিথির বলার মাঝেই রুদ্রিক বলল,

—-“আমি ড্রাইভারকে কাজলের পিছনে পাঠিয়ে দিয়েছি। সমস্যা হবেনা।”

সিথি একটা কথা ভেবে বলল,

—-“আমি শুধু একটাই কথা ভাবছি যে, আমাদের বুদ্ধিমতী কাজল এমন ছেলে-মানুষ কীভাবে হয়ে গেলো? ”

সিথির কথার মাঝেই রুদ্রিকের মা এসে বললেন,

—-“মেয়েদের এই সময় মুড সুইং হয় বুঝেছিস? তারা সন্তানকে গর্ভ ধারণ করার সময় নিজেরাই বাচ্ছা মানুষ হয়ে উঠে। ”

রুদ্রিকের মাকে দেখে রুদ্রিক বলল,

—-“মা! তুমি? ”

রুদ্রিকের মা রুদ্রিকের গালে হাত দিয়ে বলল,

—“রুদ্রিক বউমাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো। জানিনা তোমাদের মাথায় কি চলছে কিন্তু একটা বিষয় মাথায় রাখবে হিতে যেনো বিপরীত না হয়ে যায়। ”

লকাপে বসে আছে ইশানি। একজন মহিলা এসে বলে,
—“আপনার হাজবেন্ডের মৃতদেহ নিয়ে আসা হয়েছে।”

ইশানি কিছু না বলে পুলিশ মহিলার পিছন পিছন হাঁটতে লাগলো। ইশানির চোখের নীচে কালি পড়ে গেছে। গোছানো ইশানি কেমন যেনো অগাছালো হয়ে গেছে। ইশানিকে মর্গে নিয়ে আসা হলো। ইশানি দেখেই মাহিরের লাশের থেকে সাদা চাদর দিয়ে আবৃত মাহিরের মুখখানা বের হয়ে গেলো। দীর্ঘ ৭মাস লড়াই করে অবশেষে মাহির মৃত্যুর কাছে পরাজিত হয়ে আজ মারা গেলো। ইশানি এগিয়ে এসে,মাহিরের কপালে হাত বুলিয়ে আবারো মাহিরের মুখে চাঁদর দিয়ে আবৃত করে দিলো। ইশানির চোখ দিয়ে এক ফোটা জল ও গড়িয়ে পড়লো নাহ। সবাই অবাক দৃষ্টিতে ইশানির দিকে তাঁকিয়ে আছে। যে মানুষ নিজের স্বামীকে এতোটা ভালোবাসে, সেই ইশানির নিজের স্বামীর মৃত্যুতে এতোটুকুও চোখে জল নেই। ইশানি আকাশের দিকে তাঁকিয়ে বলল,
—“ভালো থেকো মাহির। অনেক ভালো থেকো।”

একজন পুলিশ এগিয়ে এসে বলল,

—“আমার মনে হয় উনার পরিবারকে খবর দেওয়া উচিৎ। ”

পরিবারের কথা শুনে ইশানি রক্তচক্ষু দিয়ে পুলিশের দিকে তাঁকিয়ে বলল,

—“একদম নাহ। কাউকে খবর দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ”

পুলিশ মহিলা বলে উঠেন,
—“কি বলছেন কি….

মহিলাকে থামিয়ে ইশানি কঠোর গলায় বলল,

—-“আমি মানা করেছি। জানানো হবেনা মানে হবেনা। মাহিরের দাফনের ব্যবস্হা করুন। ”

কথাটি বলে ইশানি মাহিরের দিকে তাঁকিয়েই রইলো।

ইশানি হাবভাব দেখে সবার কেমন যেনো খটকা লাগছিলো।

_________

আমাকে হঠাৎ বাড়িতে দেখে মা এসে বলল,

—-“কাজল, তুই হঠাৎ? ”

আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,

—-“কেনো আমি আসতে পারিনা? ”

—-“নাহ। আমি আসলে বলতে চেয়েছিলাম যে, তুই একা জামাই কোথায়? ”

মায়ের কথা শুনে রাগ হচ্ছে নিজের বাড়িতে আসতে কী এখন একে ওকে নিয়ে আসতে হবে?

আমি রাগ দেখিয়ে নিজের রুমে চলে গেলাম। মা হয়তো কিছুই বুঝলো নাহ আমার মতিগতি।

_________
আমার কথা সব কথা শুনে ছুটকি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

—-“তোর কী মনে হয় আপাই? রুদ্রিক ভাইয়ের জেনির সাথে কিছু আছে। ”

আমি ছুটকির দিকে তাঁকিয়ে বললাম,

—-“আমি জানি রুদ্রিক এমন কিছু করবে নাহ। এর পিছনে অন্য গল্প রয়েছে।
রুদ্রিকের উপর আমার ভরসা আছে। ”

—-“বাবাহ এতেটা বিশ্বাস? ”

—-“হু। কেননা ভালোবাসার মূল মন্ত্র হলো বিশ্বাস,ভরসা। রুদ্রিককে ভালোবাসি অথচ বিশ্বাস করবো নাহ? তার উপর ভরসা করবো নাহ? ”

ছুটকি বলল,

—-“তাহলে হঠাৎ রাগ করে এলে যে? ”

আমি থমথমে গলায় বললাম,

—-“রাগ হয়েছিলো প্রচন্ড। নিজের স্বামীর বুকে অন্য কাউকে কখনোই সহ্য করা যায়না। আমি সেখানে কীভাবে সহ্য করবো বল? যার বুকে আমি মাথা রেখে ঘুমাই, সেই বুকে অন্য কেউ মেয়েকে সত্যি সহ্য করা যায়না। যাক অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়। ”

কথাটি বলে আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। যদিও আমি জানি আজ রাতে আমার ঘুম আর আসছে।

রুদ্রিক কাজলের ছবির দিকে হাঁসলো। কাজলকে ছাড়া আজকে তার সত্যি ঘুম হবে নাহ। তাই রুদ্রিক আকাশপানে তাঁকিয়ে আনমনে গাঁইতে লাগলো,

—-“খোঁলা জানালা দখিনের বাতাসে ঢেকে যায় পর্দার আড়ালে

কখন তুমি এসে হেঁসে বলে দাও আমি আছি তোমার পাশে। ”

চলবে….