ছদ্মবেশে লুকানো ভালোবাসা পর্ব-১৮

0
1186

#ছদ্মবেশে_লুকানো_ভালোবাসা
#মৌমি_দত্ত
#পর্ব_১৮

আফরা আর স্পন্দন জুটি যেখানে সব শেষে একে অপরের মনের কথা জেনে এক হলো। ওখানে ইনায়াত কান্না করে দেওয়ার যোগাড়। আফিমের কোন কাজ,, কোন কথা তার মাথায় ঢুকছে না। কফি বানিয়ে যখন কফি নিয়ে গেছিলো ইনায়াত। তখন আফিম চিনি কমের গল্প ফাঁদলো। আর ইনায়াতকে দিয়ে জোড় করে হাফ কফি শেষ করালো। এরপর অবশিষ্ট কফি নিজে খেলো। অফিসের কোন কাজ করলো না নিজে। আর না ইনায়াতকে করতে দিলো। ইনায়াতের ছবি আঁকার চেষ্টা করলো। ইনায়াতের চুল খুলে তা দিয়ে হেয়ার স্টাইলের চেষ্টা করলো। এক কথায় সন্ধ্যা পর্যন্ত আফিমের দুষ্টামি সহ্য করতে করতে ইনায়াতের অবস্থা প্লাস্টিক!! এখন একটু আগেই অফিস শেষ হয়েছে। সব স্টাফরা এক এক করে বের হচ্ছে। ইনায়াত আফিমকে আফিমের বাসায় নামিয়ে দিয়ে নিজের বাসায় যাওয়ার অপেক্ষায় অস্থির।
– স্যার!! বাসায় যাবেন না??
– না তো!! তুমি আর আমি ডিনারে যাবো।
– কিইইইই??
– জ্বীইইই।
ইনায়াতের হাত ধরে আফিম নিয়ে আসলো গাড়ির কাছে। এরপর ইনায়াতকে গাড়িতে উঠতে ইশারা করলো। ইনায়াত উঠে বসলো কাঁদো কাঁদো মুখ করে। পরক্ষনেই ইনায়াতের মাথায় ঘন্টা বাজলো। কি ব্যাপার?? আফিম আজকে এমন করছে কেন?? আর গতকালকে আমার বাসায় কেন গিয়েছিলো?? গিয়েছিলো যখন কিছু বললো না কেন?? হাজারটা ভাবনার পর গাড়ি ব্রেইক কষাতে হুশ ফিরলো ইনায়াতের। গাড়ির জানলা দিয়ে দেখলো নদীর পাড়ে এসে গাড়ি থামানো। আফিমের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই আফিম মিষ্টি করে হাসলো। কিন্তু আজকে আফিমের এই ভদ্র ব্যবহার আর মিষ্টি হাসিই যেন ভয়ের কারণ। ইনায়াতের মন বলছে ” আফিম কোনভাবে আমাকে অন্য নজরে দেখছে না তো?? ”
– স্যার!! আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। আমাকে ফিরতে হবে।
কাঁপা স্বরে তোতলিয়ে বললো ইনায়াত। আফিমের ভ্রু কুঁচকে এলো।
– কি হয়েছে ইনায়াত?? শরীর খারাপ লাগছে?? ডাক্তারের কাছে যাবে?? কেমন লাগছে তোমার??
ইনায়াত ক্রমশ ভয়ে সিটিয়ে যেতে লাগলো গাড়ির সিটেই।
– না স্যার!! আমি ঠিক আছি। চলুন নামি।
ইনায়াত দ্রুত নেমে এলো গাড়ি থেকে। আফিমের আশপাশে থাকা ইদানীং তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। আফিমের হাবভাব স্পষ্ট জানান দিচ্ছে তার মনের কথা। তবে তা ভুল হতে পারে বলে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে ইনায়াত। আফিম নেমে এলো নিজেকে শান্ত করে। আজকে সে জোসেফের সাহায্য নিয়ে,, লাবিবার প্ল্যানিং মতো ইনায়াতকে বুঝাবে নিজের ভালোবাসার কথা। কিন্তু ভয়ও হচ্ছে। কোনভাবে যদি ইনায়াত তাকে না বলে দেয়?? সমস্যা নেই!! ইনায়াত রিজেক্ট করলে সে অপেক্ষা করবে,, ইনায়াতের মন জয় করে নেবে বলে নিজেকে সাহস দিলো আফিম। ইনায়াত নদীর দিকে স্থির দৃষ্টি দিয়ে ভাবছে আজকেই সে আফিমকে জানিয়ে দেবে যে এই চাকরি আর করবে না। আর আফিম মনে মনে একবার আউড়ে নিচ্ছে কি বলবে ইনায়াতকে।
– স্যার!!
– ইনায়াত!!
ইনায়াত আর আফিম একে অপরকে একসাথেই ডেকে ফেললো। পরক্ষনেই নিজেরা চুপ হয়ে গেলো। অনেকটা সময় নদীর পারে দাঁড়িয়ে রইলো দুইজন মূর্তীর মতো। তখন আফিমই বললো,,
– বসি একটা জায়গায়??
ইনায়াত মাথা নাড়িয়ে সাঁই জানিয়ে বসে পড়লো ঘাসের উপরেই। আফিমও বসে পড়লো ঘাসের উপর ইনায়াতের পাশে কিছুটা দূরত্ব রেখে।
– ইনায়াত!! তোমাকে আমার কিছু বলার ছিলো।
ইনায়াত ঘামাচ্ছে এখন রীতিমতো। হাতের উল্টো পিঠে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে ইনায়াত বললো,,
– আমারও।
আফিম অবাক হলো। ইনায়াত কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না আফিম। তবুও নিজের সব ভাবনা ঝেড়ে নদীর দিকে তাকালো। চোখ বন্ধ করে বলতে লাগলো,,
– ইনায়াত!! আমার পাস্ট লাইফ নিয়ে তোমাকে কিছু জানানোর আছে।
ইনায়াত এবার চমকে ঝট করে তাকালো আফিমের দিকে। আফিমের কাজেকর্মে আফিম যে ইনায়াতের প্রতি কিছু একটা অনুভব করতে শুরু করেছে তা এই কয়েকদিনের কথা গাড়িতে বসে ভেবেই বুঝেছে ইনায়াত। আফিম নিজের ভালো লাগার ইঙ্গিত দেবে আর মুখেও জানাবে আন্দাজ করেই নিয়েছিলো ইনায়াত। কিন্তু এতো জলদি জানাবে তা ভাবতেও পারেনি। কিন্তু ইনায়াত তো শুনতে চায় না আফিমের এই কথাগুলো। ইনায়াত তো চাকরিটা ছেড়ে দেবে জানাতেই চাইছিলো।
– আমাকে এখন যেমন দেখছো। তেমনটা আমি আগে ছিলাম না। তোমার কাছে হয়তো আমি খুব খারাপ। তবে,,,
– স্যার!! আমি সবটা জানি। নীলা আপুর সাথে যা যা হয়েছে সবটাই। আফরা আপুর ঘটনা আর কনা ও মাহিম নামক মানুষগুলো সম্পর্কেও।
আফিমের কথা মাঝপথে থামিয়ে বলে ফেললো ইনায়াত। আফিম চোখ খুলে তাকালো ইনায়াতের দিকে অবিশ্বাস নিয়ে। আফিমের চোখের ভাষা বুঝলো ইনায়াত ভালো ভাবেই।
– আমাকে লাবিবা আন্টি সব বলেছে। তার থেকেই সবটা জানা।
আফিম মাথা নিচু করে মৃদু হাসলো মাথা চুলকে। ইনায়াত হাতে হাত ঘষে যাচ্ছে ক্রমাগত। কোন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছুই সে শুনতে চায় না। কোনভাবেই শুনতে চায় না।
– তোমাকে আরো কিছু বলার আছে আমার ইনায়াত।
ইনায়াত উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। আফিম ভ্রু কুঁচকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো।
– কি হলো ইনায়াত??
– স্যার!! আমার আপনাকে কিছু বলার আছে।
– আচ্ছা বলবে। আগে আমি বলেনি। আমারটা খুব জরুরি ইনায়াত। তুমি তো কাজ আর কাজ নিয়েই কথা বলবে। কিন্তু আমার তোমাকে নিয়ে কিছু কথা বলার আছে।
ইনায়াত চোখ বন্ধ করে ফেললো অন্যদিকে ফিরে। আফিম মৃদু হেসে বললো,,
– ইনায়াত!! ভালোবাসা কি আমি জানতাম না। কনাকে আসলেই খুব ভালো লাগতো আমার। তাই কনার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলাম আমি। কিন্তু ওর আসল চেহারা সামনে আসার পর আমি একদম শিউর আমি ভালোবাসা কি জানি না। এতোদিন জানতেও চাইতাম না। কিন্তু আমি যে ভালোবাসার জালে আটকা পড়ে গেছি তাও বুঝতে পারিনি। তুমি ছদ্মবেশ নিয়ে আমার জীবনে লুকায়িত ভালোবাসা হয়ে এসেছো। তা তো আমার জানা ছিলো না। হ্যাঁ ইনায়াত!! আমি এখন ভালোবাসার কিছুটা হলেও বুঝতে শিখতে পেরেছি। আর তার থেকেই বলছি,, আমি ভালোবাসি তোমাকে।
আফিম চোখ বন্ধ করে শেষের লাইন হড়বড়িয়ে বলে দিলো। ইনায়াতের জামা খামচে ধরে থাকা হাত দুটো আলগা হয়ে গেলো। জল ভেজা চোখ খুলে অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে রইলো সে শূন্যে।
– মজার বিষয় কি জানো?? তোমাকে ভালোবাসা আমার এখন না। অনেকটা আগে থেকেই। যে আফিম আহসানকে বাগে আনা সম্ভব হয় না কারোর পক্ষে তার মা ছাড়া। সেই আফিম আহসানকে মিস্টার ইনায়াত বাগে এনেছিলো এটা ভাবা কি বোকামি নয়। তোমার প্রতি আমার আলাদা এক টান আর ভালোবাসা ছিলো। তাই হয়তো হাজার বিরক্তির পরেও না বলতে পারিনি তোমার কথার উপর। তুমি আমাকে সামলাতে পেরেছো কারণ আমারও হয়তো কোথাও না কোথাও সাঁই ছিলো। হ্যাঁ এটাও ঠিক যদি তুমি সত্যিই ছেলে হতে,, তাহলে তোমাকে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড বানিয়ে রেখে দিতাম। এই ভালোবাসা তখন মনে জন্মাতো না। কিন্তু এখন যখন তোমার সত্য জানলাম,, স্বাভাবিক ভাবেই মনের ভেতর চাঁপা অনুভুতি জেগে উঠলো। ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে লাগলো আমার মাঝে। এই অনুভুতি আমি স্বীকার করতে চাইনি। বিশ্বাস করো ইনায়াত!! আমি সত্যিই অস্বীকার করার চেষ্টা করেছি এই অনুভুতি। তবুও এই অনুভুতি যখন শেষ হওয়ার পরিবর্তে নিজের ডালপালা বৃদ্ধি করছিলো আমার মাঝে,, তখন তোমার উপর আর নিজের উপর রাগ দেখাতে লাগলাম। আমার জন্মদিনের দিন তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করাটাও এই কারনেই যাতে তুমি দূরে থাকো। আমি ভেবেছি তুমি দূরে থাকলে আমি তোমাকে ভাববো না,, চাইবো না। কিন্তু তুমি যেই আমার সাথে ফর্মালি চলা শুরু করলে,,, আমার থেকে দূরে থাকা শুরু করলে। সেই থেকে আমি যেন পুড়তে লাগলাম। ভালোবাসা আসলে কি তা এক অদ্ভুত মানসিক যন্ত্রনার মধ্যে দিয়ে জানলাম আমি।
চুপ হয়ে গেলো আফিম এটুকু বলেই। মাথা উঁচিয়ে তাকালো ইনায়াতের দিকে।
– আমি তোমাকে ভালোবাসি বলে তোমার ভালোবাসা কামনা করছি না ইনায়াত। আমার সীমা তোমাকে ভালোবাসা পর্যন্তই। কেননা তোমার চোখের সামনেই আমি কম খারাপ কাজ করিনি। আর আমি সেই কাজগুলো অস্বীকারও করিনা। তবে আমি ভালো হতে চাই। একটা সুন্দর জীবন বানাতে চাই। তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে চাই। তবে সবটাই সম্ভব যদি আমি তোমার মন জয় করতে পারি। আমাকে ভালোবাসা দেবে না আমি জানি। একটা সুযোগ অন্তত দাও যাতে আমি তোমার মন জয়ের চেষ্টা করতে পারি। নিজেকে তোমার কাছে প্রমাণ করতে পারি।
– আমি বাসায় যেতে চাই।
কঠিন স্বরে উত্তর দিলো ইনায়াত। আফিম তাচ্ছিল্য ভরে হাসলো। জানা ছিলো এমন কিছুই হবে। আফিম নিঃশব্দে গাড়ির কাছে এগিয়ে গেলো। আর ইনায়াত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আফিমের পিছু পিছু এলো।
.
.
এতোক্ষন এক বডিগার্ড নজর রাখছিলো আফিম আর ইনায়াতের উপর। ঝোঁপের ভিতর থেকে ক্যামেরায় সবটাই ভিডিও হচ্ছিলো ইনায়াত আর আফিমের কার্যক্রম। আফিম আর ইনায়াত চলে যেতেই কল করলো তার বসের কাছে। অপরপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই বললো,,
– স্যার!! আমি ভিডিও করে নিয়েছি।
– সাথের ছেলেটা কি তাহজিব??
– না জন স্যার!! এটা তাহজিব না আমি শিউর।
– তাহলে??
– স্যার!! ইয়াং টাইকুন আফিম আহসান।
– হুম,,, স্পন্দনকে আগে পিছে ঘুরঘুর করতে দেখা যায়নি??
– না স্যার!!
– ভিডিওটা পাঠিয়ে দে।
অপরপাশের থেকে বাঁকা হেসে জনাথন মুলার ফোন কেটে দিলেন।
– কি মেয়েরে বাবা!! এক মেয়ের জন্য তিনজন ছেলে?? ব্যাপার না!! তিনজনকেই রাস্তা থেকে সড়িয়ে দেবো। এই বাঙ্গালী পরী আমার চাই।
মদের গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়ালেন সামনে কি করা যায় তা ভেবে।
.
.
তাহজিব হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলো। আসিফ বিরক্ত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
– কি হয়েছে আসিফ??
– স্যার!! ইরশাদ মির্জা কোথাও নেই। লোকজন লাগিয়েছি তাকে খুঁজতে।
– কি???
– হ্যাঁ স্যার!! আমি বুঝে পাচ্ছিনা হাঁটতে পারে না মানুষটা কোথাও যাবে কিভাবে??
– নিশ্চয় কেও নিয়ে গেছে।
– তাহলে কে নিয়ে গেলো?? কাজটা আমাদের কোন বডিগার্ডের মনে হয় না। সিসিটিভি ফুটেজও নেই সেই সময়টার।
– শিট!! আমি ভেবেছিলাম অনুশোচনায় আছে ঐ শয়তান। কিন্তু ও যে এভাবে পালিয়ে যাবে।
– নির্ঘাত পালিয়ে নতুন প্ল্যান বানাবে আপনার আর ইনায়াত ম্যামের ক্ষতি করার।
– রুহি কোথায়?? রুহি??
হঠাৎ তাহজিবের এমন প্রশ্নে অবাক হলো আসিফ।
– কেন??
– রুহির ক্ষতি করলে ঐ ইরশাদ?? আমি ছাড়বো না ওকে। রুহিকে কল করো। ওকে আমার এখানেই রাখতে হবে।
আসিফ অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। নিজের আর ইনায়াতের কথা ভুলে তাহজিব রুহির কথা ভাবছে?? কিভাবে সম্ভব??

আফিম আর ইনায়াতের সামনে যা হবে তা ইনায়াতের ইচ্ছায়। আর তাহজিব এইডা আজকের পর্বে কি করলো?? যাই হোক রাতে এক পার্ট দিয়ে দিবো আপিরা। ভালো থেকো,, সাথে থেকো

চলবে,,,