ছদ্মবেশে লুকানো ভালোবাসা পর্ব-২৪

0
1126

#ছদ্মবেশে_লুকানো_ভালোবাসা
#মৌমি_দত্ত
#পর্ব_২৪

তাহজিব আর আসিফ নিজেদের গাড়িতে আর তারই পাশে স্পন্দন,, কামাল ও আফিম এক গাড়িতে। পিছনে তাহজিব ও স্পন্দনের গার্ডস মিলে মোট ১৪ টা জীপ আসছে। তারা শহরের শেষ মাথার দিকের পোড়াবাড়িটায় যাচ্ছে। যেখানে বর্তমানে রুহি আর ইনায়াত আছে। তাহজিব আড়চোখে একবার আফিমদের গাড়ির দিকে তাকালো। মনে মনে ভাবলো,,
– এই ছেলের মধ্যে এমন কি আছে যে ইনায়াত তার হলো না??
পরমুহুর্তেই নিজেকে নিজে গালাগাল দিলো। ইনায়াতকে নিয়ে যে সে জেদ করছে তা তার বুঝতে অসুবিধা হলো না। নাহয় ইনায়াতের কথা বলে বিপদে রুহিকে নিয়ে আগে চিন্তা এলো কেন মাথায়?? আসিফ গাড়ি চালাতে চালাতে তাহজিবের এমন মুখ দেখে মনে মনে খুশীই হলো। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলো যেন আজকে সব ঠিক হয়। এরপর তাহজিব রুহিও যেন এক হয়।
স্পন্দনদের গাড়ি চালাচ্ছে কামাল। স্পন্দন আর আফিম ব্যাকসিটে বসা। আফিম একটুপর পর হাত ঘড়িতে সময় দেখছে। আফিমের চোখ মারাত্মক রকমের লাল হয়ে গেছে। যেন এক্ষুনি ঝড়ঝড় করে রক্ত বইবে আফিমের চোখ থেকে।
পোড়াবাড়ি থেকে অনেকটা দূরেই গাড়ি পার্ক করে শেষবারের মতো প্ল্যান করে নিচ্ছে সবাই।
.
.
ইনায়াত মুর্তির মতো বসে ছিলো। তখনই দুটো গার্ড হঠাৎ রুমে এসে রুহিকে ধরলো। টেনে হিচড়ে নিয়ে যেতে লাগলো বাইরে। রুহি নিজেকে ছাড়ানোর জন্য হাত পা ছুঁড়ছে,, চিৎকার চেঁচামেচি করছে। ইনায়াতও গার্ডসদের থেকে রুহিকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। লাভ হলো না কোন। রুহিকে বের করে কোথায় যেন নিয়ে গেলো গার্ডসগুলো। ইনায়াত রুহির জন্য দরজা থেকে বের হতে যাবে। তখনই রুমের সামনে হুইলচেয়ারে বসা ইরশাদকে দেখতে পেলো হাসিমুখে বসে থাকতে। রুহির বলা এক একটা কথা ইনায়াতের মাথায় আঘাত করছে। রুহি বলেছিলো ইনায়াতকে যে রুহিকে একসময় না একসময় আলাদা করে দেওয়া হবে। তাই ইনায়াতকে মোবাইলটা দিয়ে গেছিলো নিজের। ইরশাদ আর যাই হোক রুহিকে রুমে রাখবে না কথা বলবার সময় তা রুহির জানা। ইনায়াতকে রুহি বলে গেছে তখন,,
– আপি!! একসময় না একসময় ওরা আমাদের আলাদা করে দেবেই। কেননা ইরশাদ মির্জা ভালোই জানে আমাকে রেখে কথা বলা তোমার সাথে সম্ভব না ওর জন্য। তাই এই নাও আমার মোবাইল। গার্ডস আমার জন্য আসলেই তুমি মোবাইলটার পাওয়ার বাটনে তিনবার পরপর ক্লিক করবে। এতে করে তাহজিবের কাছে কল চলে যাবে মোবাইল থেকে আপনাআপনি। আর হ্যাঁ!! ইরশাদ মির্জার সবটা যে তুমি জেনে গেছো তা তাকে বুঝতে দেবে না। তাহজিবরা না এসে পৌছানো পর্যন্ত ইরশাদ মির্জাকে রাগানোর রিস্ক নেওয়া সম্ভব না। আর হ্যাঁ!! প্লিজ!! আমার কথা বিশ্বাস করে কাজগুলো করো। দেখে নিও ইরশাদ এসে তোমার সাথে একপর্যায়ে খুব আদুরি হয়ে কথা বলবে। আর ভালোবাসার দোহায়ও দেবে।
ইনায়াত হাত পিছনে নিয়ে জামার ভেতর থেকে মোবাইল বের করে তিনবার ক্লিক করলো দ্রুত। তাহজিবের কাছে আপনা আপনিই কল চলে গেলো। প্ল্যান নিয়ে কথা বলছিলো সবাই তখন। হঠাৎই তাহজিবের মোবাইল বেজে উঠায় তাহজিব ভ্রু কুঁচকে মোবাইল বের করে দেখলো রুহির নাম্বার থেকে কল। তাহজিব দ্রুত তা রিসিভ করে লাউডে দিলো।
.
.
– বাবা!! তুমি ঠিক আছো??
ইনায়াত ছুটে এসে ইরশাদের কাছে বসে বললো। রুহির কথা মতো কাজ করলেও ইরশাদকে দেখেই আবেগী হয়ে গেছে ইনায়াত। কি করবে সে?? মানুষটাকে যে সে বাবা বলেই ভালোবেসে আর চিনে এসেছে। ইরশাদ মুচকি হেসে বললো,,
– মেয়ের জন্য এটুকু আমার সয়ে যাবে। তুই ভালো আছিস তো মা??
– আমি কিভাবে ভালো থাকবো তোমাকে এভাবে দেখে?? কেন আমাকে সেদিন পালাতে বললে??
ইনায়াতের কান্না ন্যাকামো মনে হলো ইরশাদের। এখন সকাল ১১ টা। আজকে খুশী মনে লম্বা একটা ঘুম দিয়ে উঠেছে সে। উঠার পর থেকেই উত্তেজনায় আর খুশীতে অস্থির অস্থির লাগছে তার। ভেবেছিলো এই রুমে আসার আগে,, এসে মাত্র দ্রুত মেয়েকে বলে পেপারসে সাইন করাবে। কিন্তু এখানে এই মেয়ে কান্না শুরু করেছে বলেই বিরক্ত ইরশাদ। বিরক্ত হয়ে বলেই ফেললো,,
– উফফফ নাঁকি কান্না থামাও এবার কাজের কথা বলি।
ইনায়াত চমকে তাকালো ইরশাদের দিকে। ইরশাদ কি বলেছে তা শুনতে ভুল হয়নি ইনায়াতের। ইরশাদও বুঝলো সে কি ভুল বলে ফেলেছে। দ্রুত হেসে বললো,,
– তুই তো জানিসই মা!! তুই কাঁদলে আমার কতো মন পুড়ে। এবার কান্না থামা।
এই বলেই ইরশাদ নিজের হাত এগিয়ে ইনায়াতের চোখের জল মুছে দিলো। বেখেয়ালি ইনায়াত পাত্তা দিলো না। সে এখন খুব ভয়ে আছে। রুহির কথা সত্যি হয়ে যাবে বলে ভয়ে আছে ইনায়াত।
– বলছিলাম কি মা!! তুই তো তোর বাবাকে অনেক ভালোবাসিস। তাই না??
ইরশাদ মির্জা আদুরে গলায় গদগদ হয়ে প্রশ্ন করলো। ইনায়াত তাকিয়ে রইলো অবাক হয়ে। রুহির কথা মিলে যাচ্ছে। সত্যিই ইরশাদ আদুরে স্বরে কথা বলছে আর ভালোবাসার দোহায় দিয়েই কথা শুরু করেছে। ইনায়াতের হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে অস্থির উত্তেজনায়।
– কি হলো?? চুপ করে আছিস কেন??
ইনায়াতকে আগে এই প্রশ্ন করলে ঝট করে উত্তর দিতো ইনায়াত। এখন দিচ্ছে না দেখে অস্থির হয়ে উঠলো ইরশাদ।
– হুম বাবা!! অনেক ভালোবাসি।
ছলছল চোখে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো ইনায়াত। ইরশাদ সাহেবের মুখে হাসি ফুঁটলো।
– ইনায়াত!! মা আমার,,, তাহলে আমি যা বলবো তাও নিশ্চয় তুই শুনবি। আর মেনে চলবি।
ইনায়াত অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো ইরশাদের দিকে। এর পরে ইরশাদ সাইনিং বা সম্পত্তি নিয়ে কথা বলবে তা নিয়ে দ্বিধা নেই ইনায়াতের। ইনায়াতের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো নোনাজল। আর এদিকে ইনায়াত উত্তর দিচ্ছে না বলে অস্থির হয়ে আছে ইরশাদ।
ইনায়াত চোখের জল মুছে ইরশাদের চেয়ার ঠেলে বিছানার কাছে আনলো। তখনই কানে এলো রুহির গগনবিদারী চিৎকার। বুক কেঁপে উঠলো ইনায়াতের। রুহির সাথে কোন খারাপ কিছু ঘটছে না তো। ইনায়াত ইরশাদের হুইলচেয়ার খাটের কাছে আনলো। ইরশাদ বিরক্ত হয়ে বললো,,
– আজিব!! উত্তর না দিয়ে কি করছিস তুই??
ইনায়াত তাচ্ছিল্য ভরে বাঁকা হাসলো।
– সরি বাবা!! তোমার সন্তান হলেও একজন মেয়ে।
ইনায়াতের কথা ইরশাদ কিছুই বুঝলো না। ইনায়াত নীরবে বিছানার উপরে থাকা চাদরটা তুলে নিলো। ইরশাদ ভ্রু কুঁচকে ইনায়াতের কাজ দেখছে। ইনায়াত চাদরটা তুলেই লম্বা করে ধরে ইরশাদের পিছনে এলো।
– কি কর,,
পুরো কথা বলবার আগেই আচমকা ইয়া লম্বা চাদর দিয়ে ক্রমশ মুড়িয়ে যেতে লাগলো ইরশাদকে। হুইলচেয়ারের থেকে আলগা কিন্তু পুরো শরীর পেঁচানো অবস্থায় রয়ে গেলো ইরশাদ।একেবারে মমির মতো। ইনায়াতের আচমকা এমন কাজ সে কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। ইরশাদকে বিছানার চাদর দিয়ে বেঁধে ইনায়াত ইরশাদের সামনে হাঁটু ভাঁজ করে বসলো জল ভরা চোখে।
– কেন বাবা?? কেন করলে এমন?? নিজের মেয়ের সাথে এমন শত্রুতা করতে কষ্ট হলো না তোমার?? সম্পত্তিই যদি চাইতে তাহলে বলে দিলেই পারতে। আমার তো তোমাকে দরকার ছিলো। কোন সম্পত্তির প্রয়োজন ছিলো না আমার।
ইনায়াত মুখ চেঁপে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেললো। ইরশাদ ছটফট করছে রীতিমতো। ইনায়াত কিছুক্ষন সেভাবেই কেঁদে দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো। রুহি বিপদে আছে মাথায় এলো তার। ইরশাদকে কোনমতে টেনে খাটের মাঝখানে ফেললো ইনায়াত খুব সাবধানে। নারী মনের এই একদোষ। হাজার আঘাত পেলেও সম্ভব হয় না ভালোবাসার মানুষটিকে আঘাত করা। ইনায়াত ইরশাদকে খাটের মাঝখানে রেখে হুইলচেয়ার ঠেলে ঘরের আরেক প্রান্তে পাঠিয়ে দিলো। খাটের আশেপাশের হালকাপাতলা সব আসবাব যেমন টেবিলের উপর থাকা ফুলদানি থেকে শুরু করে সবটাই সড়িয়ে নিলো সাবধানে। বিষয়টা ইনায়াতের জন্য সিনেমা না। সে ইরশাদকে হুইলচেয়ারে বেঁধে চলে যাবে। ইরশাদ মোচড়ামুচড়ি করতে করতে কিছু একটা ফেলে দেবে যার বিকট আওয়াজে চলে আসবে গার্ডস আর ধরা পড়বে রুহি ও ইনায়াত। এমন নাটকীয় কিছু মোটেও আশা করছে না ইনায়াত। তাই এই আয়োজন। সবটা একবার দেখে নিয়ে ইরশাদের দিকে একবার করুন চোখে তাকালো ইনায়াত। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো এক ফোঁটা জল। চোখ বন্ধ করে জোড়ে একটা শ্বাস নিয়ে দরজার কাছে এসে উঁকি দিয়ে বাইরের অবস্থাটা দেখে নিলো। গার্ডস নেই আপাতত কোন। ইনায়াত দ্রুত জামার ভাঁজ থেকে ফোন বের করলো।
তাহজিব,, স্পন্দন,, আফিম,, কামাল ও আসিফ এতোক্ষন টান টান উত্তেজনা নিয়ে সবটা শুনছিলো। ইনায়াতের গলার স্বরে ” হ্যালো ” শুনে চমকালো সবাই।
– হ,,হ্যালো?? বোনু ঠিক আছিস তুই??
স্পন্দনের গলার আওয়াজ চিনতে কষ্ট হলো ইনায়াতের। অন্য স্বাভাবিক সময় হলে ইনায়াত চমকাতো। কিন্তু এখন নিজের বাবার এমন ক্রুর রূপ দেখে সব কেমন যেন স্বাভাবিক আর সম্ভব মনে হচ্ছে ইনায়াতের।
– স্পন্দন ভাইয়া!! বাপিকে আমি চাদর দিয়ে বেঁধে ফেলেছি। সাবধানে বেঁধে খাটের মাঝখানে রেখে দিয়েছি। হুইলচেয়ার ঘরের আরেক কোণায় রেখেছি যাতে পৌছাতে না পারে কোনভাবে চেয়ার পর্যন্ত। খাটের আশপাশের সব আসবাব সড়িয়ে ফেলেছি যা ধাক্কা খেয়ে পড়ে আওয়াজ করতে পারে। দরজা খুলে বাইরে চেক করেছি আমাকে যে রুমে রাখা হয়েছে সে রুমের বাইরে গার্ডস নেই। এখন আমি কি করবো?? এর মধ্যেই অলরেডি একবার রুহির চিৎকার শুনেছি। ও নিশ্চয় বড় কোন বিপদে আছে। আমি যাচ্ছি তোমরা দ্রুত এসো।
ইনায়াতের কথা শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো তিনজনেরই।
– না বোনু!! তুই যাস না। আমরা এখানেই আছি। আমরা আসছি।
স্পন্দন দ্রুত উত্তর দিলো। আফিমও একপ্রকার হুংকার দিয়ে বললো,,
– ইনায়াত!! ইটস মাই অর্ডার,, খবরদার সাহসিকতা দেখাতে যাবে না। তুমি রুমেই থাকো।
আফিমের গলা শুনে ইনায়াতের মনে ভরসার আলো ফুঁটলো। এর আগেও নিজের সত্যতা প্রকাশ পাওয়ার সময় এই মানুষটাকে ভরসা করে ঠকেনি সে। ইনায়াত উত্তরে কিছু বলতে যাবে তখনই তাহজিবের গলা শুনতে পেলো।
– চাঁদ,, আই বেগ অফ ইউ,, কিছু করো না। তোমাদেরকে আমরা সত্যিই বাঁচিয়ে নেবো। বিলিভ করো।
ইনায়াত “চাঁদ” সম্বোধন শুনেই বুঝলো তাহজিব খোদ নিজেও আছে। কিছু উত্তর দিবে বলে শ্বাস টেনে মুখ খুলবার আগেই কারোর পায়ের শব্দ শুনলো। দরজার কোণা থেকে দেখতে পেলো দুজন গার্ড এদিকেই আসতে আসতে কথা বলছে। এক গার্ড বলছে,,
– জন স্যারের তো আজকে মজাই মজা। খাসা দুইটা মাল পেয়েছে।
আরেকটি গার্ড বললো,,
– এর মধ্যেই একটা খাটে তো গেছে। আর এদিকে এতোক্ষনে এটারও নিশ্চয় দলিল সাইন করা হয়ে গেছে। তার জন্য এটাকেও নিতে পাঠালো।
আগের গার্ডটি বিচ্ছিরির হেসে বললো,,
– দুইটা হুর এক বিছানায়। উফফ!! স্যারের আজকে ভাগ্য খুলে গেলো।
– কাজ শেষে তো আমরাই দুটোকে রুম থেকে বাইরে আনবো। তখন নাহয় আমরাও চেখে দেখবো।
এটা বলেই দুই গার্ড হাসতে লাগলো ওখানেই দাঁড়িয়ে। ইনায়াত তো সবটা শুনলোই। তার সাথে ফোনের অপরপাশের পাঁচজন ও শুনলো। হঠাৎ সবার আগে কামালের খেয়াল হলো কল আর কানেক্টেড নেই। আতকে উঠলো কামাল।
– স্যার!! কল ডিসকানেক্টেড,,
কামালের এই ছোট্ট কথা যথেষ্ট ছিলো সবার মনের অবস্থা আরো খারাপ করে দিতে। আফিম দিশেহারা হয়ে গাড়ির টায়ারে জোড়ে লাথি লাগালো। স্পন্দন মাথার চুল চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আর রুহির কথা শুনে তাহজিব অস্ফুটে ” রুহি ” বলে চুপ হয়ে গেলো । শেষ রক্ষা কি তারা করতে পারলো না তবে???

কি হবে নেক্সট পার্টে?? আমি কি জানি ভাই?? জানতে হলে পড়তে হবে। সাথে থাকেন।

চলবে,,