#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৪৫
গলার দাগটা ঢাকার কোনোরকম ব্যর্থ প্রচেষ্টা করছি আর আয়না দিয়ে চরম বিরক্তি নিয়ে তাকাচ্ছি আনভীরের দিকে। উনি এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না যে এই দাগের কারন উনি। তাই উদ্ভ্রান্তের মতো তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। চেহারায় এমন একটা ভাব যে উনি একটা নিষ্পাপ শিশু। আমি আরেকবার চোখ রাঙানি দিতেই উনি ভ্রু কুচকে বললেন,
-আজব তো! এভাবে তাকাচ্ছো কেনো? ওই দাগ তো এক্সিডেন্টলি হয়ে গিয়েছে।
আমার রাগ যেন এবার সীমা অতিক্রম করলো উনার এমন বেপরোয়া ধরনের কথা শুনাতে। উনার দিকে ভেজা তোয়ালে ছুঁড়ে মেরে কড়া গলায় বললাম,
-তো এটা কে করেছে বলেন তো? স্বপ্নে কি ব্যাম্বো চিকেন দেখেছিলেন যে আমার গলা কে ব্যাম্বো চিকেন ভেবে বাইট দিলেন?
উনি গলা খাকারি দিলেন এবার চরম অস্বস্তি নিয়ে। আমি একগাদা বিরক্তি নিয়ে চুল দিয়ে দাগগুলো ঢাকাতে মগ্ন হয়ে গেলাম।আমি জানি এই মহাশয়ের মাথাতে ভুড়ি ভুড়ি অংক ছাড়া কিছুই নাই , রোম্যান্টিকতা তো দূরের কথা। এক্সিডেন্টলি একটা কামড় দিয়েছেন বলে আমায় সরি বলতে বলতে পাগল করে ফেলেছেন। আজীবন মুভি নাটকে দেখেছি সুন্দর ছেলেগুলো উপর দিয়ে ভদ্র আর ভেতর দিয়ে থাকে চরম লেভেলের অসভ্য। আমারটা বেরিয়েছে উল্টা। সবার সামনে অসভ্য অসভ্য কথা বলে আর ভেতরে খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে রোম্যান্টিকতার এক ফোটাও এর মধ্যে নই। দুপুর হয়ে যাওয়াতে পুরো বাড়িতে তোরজোর শুরু হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পরই রাফিদ ভাইয়ার সাথে আমরা বরপক্ষ হয়ে কনেপক্ষের বাড়িতে যাবো। এদিকে আনভীর ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। মামুন ভাইয়া আর নাহিদ ভাইয়ার সাথে বরের সবকিছু গুছগাছ করে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে আছেন খাটে। উনার ভার্সিটি থেকে অনবরত কল আসছে যে কবে ফিরবেন ঢাকায়। কারনটাও স্বাভাবিক।পরীক্ষা শেষ আর উনার একসেট খাতাও দেখা নেই। এদিকে জমা দেওয়ার ডেট ঘনিয়ে আসছে। সবমিলিয়ে উনার ওপর বিশাল চাপ। আমি নিজেকে সুন্দরভাবে গোছগাছ করে উনার কাছে এসে পড়লাম। কপালে হাত দিয়ে পরখ করলাম শরীরে জ্বর রয়েছে কিনা। সবকিছু স্বাভাবিক দেখে মিহি কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
-শরবত নিয়ে আসবো আপনার জন্য?
-উহু।
আড়ষ্ট কন্ঠে বলে উঠলেন উনি। চোখজোড়া বন্ধ। উনাকে এমন দেখে আমার নিজেরও কেন যেন ভালোলাগছে না। এদিকে চাচী এসে অলরেডি ডাক দিয়ে গিয়েছেন সবাই কনেপক্ষের বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে। অগত্যাই উঠে বসলেন উনি। আমি লাগেজ থেকে একটা নেভি ব্লু রঙের পান্জাবী বের করলাম। উনি চোখজোড়া সরু করে বললেন,
-এটা কেনো?
-এটা কেনো মানে? আপনি পান্জাবী পড়বেন না?
-পড়বো তো। তবে তোমার জামার কালারের সাথে ম্যাচ করে। সবুজ রঙের টা বের করো।
-ওটা তো আনি নি।
আমতা আমতা করে বলে ওঠলাম আমি। আনভীরের চোখজোড়া আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো। চোখে মুখে বিরক্তির চরম আভাস। পরিবেশ রুদ্ধকর দেখে বুঝলাম মহাশয় এখনই দু’চারটা ভাষণ দিবেন।যেটা ভাবলাম হলোও তাই। উনি নিজের শুষ্ক অধরজোড়া জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে বলে ওঠলেন,
-আমায় হতাশায় না ফেললে তোমার ভালোলাগে না? এমনিতেও জানো তোমায় নিয়ে পাহাড় সমান চিন্তার সাথে এখানে এসেছি যাতে ওই বজ্জাত বজ্জাত মহিলা গুলোর ঘটকালি দৃষ্টি থেকে তোমায় দূরে রাখতে পারি। আর তুমি? আমি আসার সময়েই বলেছিলাম যে প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানে তুমি আর আমি ম্যাচিং করে ড্রেস পড়বো যাতে আনভীরের এই পিচ্চি বউটার দিকে কেউ আড়নজরে তাকাতে না পারে আর তুমি কি করেছো?’
আমি মুখ কালো করে বসে রইলাম। দোষটা আমারই। আমি আসলে উনার তখনকার কথা এত গভীরভাবে নেইনি। আর এটার শাস্তিই এখন আমি হারে হারে টের পাচ্ছি। উনি তপ্ত শ্বাস ছাড়লেন। বলে ওঠলেন,
-ব্লু শাড়ি আছে তোমার?
-হ্যাঁ।
-ওটা পড়ে আসো ফটাফট।
আমার চোখজোড়া ছানাবড়া হয়ে গেলো। বলে কি পাগলটায়? আমি পুরোপুরি রেডি এখন উনার আমার সাথে ম্যাচিং করা পান্জাবি নেই বলে উনি আমায় পাল্টাতে বলছেন?
-কি হলো যাও?
-আপনি ওয়াশরুে ফ্রেস হয়ে আসেন, পান্জাবি পড়েন। ততক্ষণে আমি চেন্জ করে ফেলবো।
মিহি কন্ঠে বললাম আমি। উনি কথা বাড়ালেন না। শুধু তীক্ষ্ণ নজরে আমার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠলেন,
-নেক্সট টাইম কখনোও যেন এমন ভুল না হয়…..
উনাকে কথা বলতে না দিয়ে উনার থুতনিতে আলতো করে চুমু দিলাম আমি। এভাবে হঠাৎ উনি বোকা বনে গেলেন।আমি ঠোটঁ উল্টে বললাম,
-সরি বললাম তো। প্রমিস এ ভুল আর হবে না।
উনার চোখ মুখে তখনও বিষ্ময়ের আভাস। অতঃপর শান্ত করলেন নিজেকে।কালো সিল্কি চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে আহাজারি কন্ঠে বলে ওঠলেন,
-এখন শান্তিমতো বকতেও পারবো না। ওয়ার্ন করে দিলাম কিন্ত আহি আমার উইকনেসের সুযোগ নিবে না।
বলতে বলতেই উনি খাট থেকে উঠে চলে গেলেন ওয়াশরুমে। আমি তখনকার জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
______________________
কনেপক্ষের বাড়িতে কিছুক্ষণ আগেই গেট ধরার টাকা নিয়ে সবার মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়েছে। আপুরা, নাহিদ ভাইয়ারা কেউই ২ হাজারের বেশি এক টাকা দিত রাজি নয়। এদিকে কনেপক্ষের মেয়েরা সবাই তো রীতিমতো হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ছে। পরে কে জানে কি হলো, আমি বুঝতে পারার আগেই আনভীর টেনে আমায় ওখান থেকে একটু দূরে রুনি আপুর কাছে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। গভীর ফিসফিসালো ভাবে বললেন,
-ওদিকটা আমি দেখছি। তুমি এখানেই থাকো।
উনি ওদিকে যাওয়ার পর ম্যাজিকের মতো সব সংঘর্ষ ভ্যানিশ হয়ে গেলো। ব্যাপারটা অলরেডি চলে গিয়েছে আমার মাথার ওপর দিয়ে। তারপর ভেতরে অনেকগুলো কার্যক্রম সম্পন্ন হলো। বিয়েও পড়ানো হয়ে গেলো। কনেকেও দেখে নিলাম। মেয়েটা ভারী মিষ্টি। রাফিদ ভাইয়ার সাথে দারুন মানিয়েছে এককথায়। তবে এখানে একটা জিনিস খেয়াল করলাম। এখানকার মেয়েগুলো চরম লেভেলের চালু। কেমন করে নাহিদ ভাইয়ের থেকে পটকে বরের জুতা হাতিয়ে নিলো আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। এখানে আমি থাকলে এতকিছুই হতো না কিন্ত সেগুলো আর পারলাম কই? আনভীর তো আমায় ভদ্র মেয়ের মতো মরুব্বিদের সাথে থাকতে বলেছেন আর উনি এখন উধাও। কিছুক্ষণ খোঁজাখুজির পর নাহিদ ভাইয়াকে দেখেই আমি ডাক দিলাম তাকে। অদ্ভুতভাবে আমার ডাক শুনে ভাইয়া উল্টোপথে পা বাড়ালো।আমি অবাক। উনার পথে বাধা হয়ে চোখ রাঙিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-এভাবে আমার ডাক দেওয়াতে চলে যাচ্ছেন কেনো?
নাহিদ ভাইয়া মাথা নিচু করে মিনমিনিয়ে বললো,
-ভাই আপনার সাথে কথা বলতে না করসে ভাবি।
-আপনার ভাই কথা বলতে না দেওয়ার কে? আমি যখন ডাক দেবো ফটাফট এসে পড়বেন। নাহলে বলে দেবো আপনার ভাইকে যে আপনি আমার কথা শোনেন না।
-আচ্ছা বলে দিয়েন ভাইকে। আমি গেলাম। মা ডাকে।
উনি কোনোমতে ছুটে পালালেন আমার কাছ থেকে। আমি হতভম্ব। মানে সিরিয়াসলি? আনভীরকে এত ভয় পান উনি যে একবার না করতেই এভাবে ছুটে পালালেন? আমার আর কি করার। রুনি আপু আর বাকিদের সাথেই ঘুরতে থাকলাম আশপাশে। এর মধ্যে সৌজন্যতার খাতির কনেপক্ষের বেশ কয়েকজনের সাথে পরিচিতও হয়ে নিলাম। এর মধ্যে হঠাৎ একজন যুবক আমার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
-আপনার নাম কি আহি?
-জ্বি। কেনো?
উনি আমার কাছে একটা ব্যাগ এগিয়ে দিলেন। বলেলেন,
-আমার দুলাভাই , মানে রাফিদ ভাইয়া আপনাকে দিতে বলেছে।
আমি নিয়ে নিলাম ব্যাগটা। বুঝলাম উনি হয়তো ভাবির কোনো ভাই-টাই হবে। উনি মিহি হেসে বললেন,
-আপনার নামটা কিন্ত সুন্দর।
আমি প্রতিউত্তরে শুধু ধন্যবাদ বলেই ইগ্নোর করার চেষ্টা করলাম। বুঝেছি এই গুণোধর লোক আমার সাথে লাইন মারতে এসেছে। আমি চরম বিরক্ত হলেও শুধুমাত্র ভদ্রতার খাতিরে কথা বাড়ানোর চেষ্টা করলাম না। মিহি হেসে প্রতিটা কথার প্রতিউত্তর দিলাম। একপর্যায়ে উনি বললেন,
-আপনি কি হুমায়ূন আহমেদের রূপার ভক্ত নাকি? কেননা আপনাকে নীল শাড়িতে দেখে পুরোই হিমুর রূপার মতো লাগছে।
-তাই নাকি? জানতাম না তো? আমি তো এটা জাস্ট আমার বরের সাথে ম্যাচ করে পড়ে নিলাম।
আমার শেষ কথাটি শুনে অবাক হয়ে গেলেন ওই ভাইয়াটি। চরম লেভেলের অভাক যাহাকে বলে। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলেন,
-আপনি,,,,,,,,,,,বিবাহিত?
-জ্বি হ্যাঁ।
উনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠলেন,
-আপনাকে দেখে তো মনে হয়না। কেমন যেন একটা পিচ্চি পিচ্চি ভাব। তাকিয়ে থাকলে শুধু তাকিয়ে থাকতেই মন চায়।
আমি মেকি হাসলাম। পেয়েছি এবার জব্দ করার পালা। আমি উনার কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে বলে ওঠলাম,
-জানেন? আমার হাজবেন্টও সারাদিন আমায় পিচ্চি বউ পিচ্চি বউ বলে ক্ষেপায়। তবুও আমি কিছুই বলিনা, কেন জানেন? কারন উনি পুরাই আইসক্রিম টাইপ। এমন হাজবেন্ট কার ভাগ্যে জোটে বলেন?
বেচারার দেবদাস ওয়ালা মুখ দেখে আমার দম ফেটে হাসি আসার মতো উপক্রম। আসলেই চরম লেভেলের ছ্যাকা খেয়েছে। তৎক্ষণাৎ আমাদের মাঝে আনভীর এসে পড়লেন। আমি ওই ছেলেটাকে দেখে উনার বাহু জরিয়ে বললাম,
-এইযে, আমার বরসাহেব। বলেন তো! সুন্দর না?
আনভীর আমাদের কোনো কথাই বুঝতে পারলেন না। তাই জিজ্ঞেস করলেন,
-‘কি হয়েছে আহি?’
-‘আরে এই ভাইয়া বলছিলো যে আমি যে বিবাহিত এটা উনার বিশ্বাস হয়না। আমার চেহারা পিচ্চি পিচ্চি টাইপ বলে তাকিয়েই থাকতে মন চায়।
বলেই জিভ কাটলাম আমি। ইয়া আল্লাহ! কারে কি বলে ফেলেছি৷ আনভীর প্রথমে সৌজন্যতা নিয়ে থাকলেও আমার কথা শুনে চোয়াল শক্ত করে ফেললো। ছেলেটার দিকে আড়চোখে তাকাতেই তারে আর পায় কে, যেভাবে নাহিদ ভাইয়া কেটে পড়েছিলো ওমনেই ছেলেটা ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে পালালো৷ আমি পরপর কয়েকবার শুকনো ঢোক গিলে তাকালাম উনার দিকে৷ আনভীর চোখ রাঙানি দিয়ে বললেন,
-আজকাল তুমি কিন্ত বড্ড ফাজিল হয়ে যাচ্ছো আহি!(তারপর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে) বাসায় চলো, তারপর দেখাচ্ছি আমি কোন ফ্লেভারের আইসক্রিম টাইপ?
আমার শরীর রীতিমতো জমে পাথর হয়ে গিয়েছে। এই লোকরে ভালোমতো আমার চেনা আছে৷ দেখা যাবে সারারাত স্কুলের স্যারের মতো কান ধরে উঠবোস করাবে। আল্লাহ! এবারের মতো বাচায় দাও। কসম! এই পাগলটারে ছাড়া জীবনেও কারও সাথে ফ্লাটিং করবো না।
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ!
ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।