তোমাতেই রহিব বিলীন পর্ব-১০

0
867

#তোমাতেই_রহিব_বিলীন
#পর্ব_১০
#নিশাত_জাহান_নিশি

“এতোক্ষন খুব অসম্পূর্ণ লাগছিলো। তোর আবির্ভাবে প্রভা ষোল আনায় পরিপূর্ণ হলো!”

সন্দিহান দৃষ্টিতে আমি আহনাফের দিকে চেয়ে বললাম,,

“প্রভা ষোল আনায় পূর্ণ হলো মানে? কি মিন করতে চাইছেন আপনি?”

নিষ্ক্রিয় দৃষ্টিতে আহনাফ আমার দিকে তাকালেন। অতঃপর তব্ধ শ্বাস ছেড়ে আহনাফ মিহি কন্ঠে বললেন,,

“সময় হলে বুঝবে। কিছু কথা সময়ের হাতে ছেড়ে দিতে হয়!”

নেহাল ভাই অতি দ্রুত গতিতে হেঁটে এসে ঠিক আমার পাশ ঘেঁষে বসে আমার দিকে প্রেমময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মৃদ্যু হেসে বললেন,,

“আর সেই সময়টা খুব শীঘ্রই আসছে মিস প্রভা!”

আহনাফ আচমকা তড়িৎ বেগে বসা থেকে উঠে দৃষ্টি জোড়া সংকুচিত করে নিলেন। সামনের চুল গুলো জোরালো ভাবে টেনে আহনাফ নেহাল ভাই এবং আমাকে উদ্দেশ্য করে ক্ষীণ কন্ঠে বললেন,,

“একচুয়েলি আই হেভ টু গো নাও। অফিসে অনেক ইম্পর্টেন্ট কাজ পড়ে আছে। তোমরা বসো, কথা বলো!”

পিছু ফিরে আহনাফ প্রস্থান নিতেই আমি দ্রুত গতিতে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। মরিয়া কন্ঠে আমি পেছন থেকে আহনাফকে উদ্দেশ্য করে উচ্চ আওয়াজে বললাম,,

“আহনাফ প্লিজ স্টপ। আমি ও আপনার সাথে যাবো!”

বেদনাময় চক্ষুজোড়া নিয়ে আহনাফ পিছু ফিরে আমার দিকে তাকালেন। গলা জড়ানো কন্ঠে জোর পূর্বক হেসে পুনরায় বললেন,,

“নেহাল তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিবে। এখন থেকে নেহালই তোমার আসা যাওয়ার সমস্ত দায়িত্ব নিবে। প্লিজ এসবের মাঝে অহেতুক আমাকে টেনো না! আমি তোমার জীবনে অপরিহার্য কেউ নই। ঠুনকো কাউকে এতোটা প্রাধান্য দিতে নেই!”

নিরুত্তর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। আহনাফ সেকেন্ডের মধ্যেই আমার সামনে থেকে উধাও হয়ে গেলেন। লোকটার ছায়াটা পর্যন্ত দেখতে পারছি না আমি। উতলা দৃষ্টিতে আমি দরজার আনাচে কানাচে দৃষ্টি বুলাচ্ছি। উনার উপস্থিতি উপলব্ধি করতে চাইছি। আপসোস! তোমার উপস্থিতি আমি চাইলে ও আর উপলব্ধি করতে পারব না। ইতোমধ্যেই মনে হলো নেহাল ভাই আমাকে হেচকা টানে উনার পাশে বসিয়ে দিলেন। আমি বিস্মিত দৃষ্টিতে নেহাল ভাইয়ের দিকে তাকাতেই নেহাল ভাই এক গালে হেসে আমার কপালের দিকে তাকিয়ে কেমন যেনো মোহিত কন্ঠে বললেন,,

“দারুন। কপালে টিপ পড়লে মেয়েদের দেখতে সত্যিই কি এতোটা দারুন লাগে?”

আমি দৃষ্টি সংকুচিত করে ভ্রু যুগল খানিক কুঁচকে সন্দিহান কন্ঠে বললাম,,

“এসব কমপ্লিমেন্টের মানে কি?”

“মানে অবশ্যই আছে!”

“কি মানে?”

“আপাতত বলতে পারছি না। ফার্স্টে দুজন দুজনকে ভালো করে চিনি, জানি। এরপর না হয় সময়, সুযোগ বুঝে বললাম!”

প্রসঙ্গ পাল্টে আমি উদগ্রীব উদাসী কন্ঠে বললাম,,

“আমার আহনাফের সাথে কথা আছে। খুব জরুরী কথা আছে। উনি এভাবে সবকিছু ছেড়ে যেতে পারেন না। আমি চাই না অন্তত আমার জন্য গোটা পরিবারের চোখে উনি খারাপ হউক। যে করেই হোক উনাকে আটকাতে হবে। প্লিজ আপনি ও আমাকে হেল্প করুন। আহনাফকে ফিরিয়ে আনতে হেল্প করুন।”

নেহাল ভাই আচমকা তিক্ত কন্ঠে বললেন,,

“মানে কি? তুমি কি আহনাফকে বিয়ে করতে চাও? যাকে তুমি ভালোবাসো না, মন থেকে মেনে নিতে পারছ না তাকে তুমি বিয়ে করতে চাও?”

“বিয়ে করতে চাই কিনা সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, এই খারাপ সময়টাতে আহনাফের পাশে থাকাটা। রিসেন্ট উনি খুব কষ্ট এবং যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। হয়তো সিদ্ধান্তহীনতায় ও ভুগছেন। তাই উনি দেশ ছাড়ার মতো এতো বড় কঠিন সিদ্ধান্তটা অনায়াসে নিতে পেরেছেন। উনাকে বুঝানো উচিত, উনি যা করছেন ভুল করছেন। আপোসে আমাদের একটা সিদ্ধান্তে আসাটা ভীষণ জরুরী। পরিবারের হাতে বিষয়টা ছেড়ে দেওয়া জরুরী।”

“পরিবারের হাতে বিষয়টা ছেড়ে দিলে কি হবে জানো? উনারা তোমাকে জোর করে ধরে বেঁধে আহনাফের সাথে বিয়ে দেওয়ার জোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। আচ্ছা কি চাও তুমি বলো তো? আহনাফকে বিয়ে করতে চাও? মনের বিরুদ্ধে গিয়ে?”

“পরিবার যদি চায়, আহনাফকে বিয়ে করতে। হ্যাঁ আমি রাজি আহনাফকে বিয়ে করতে। ভালো না বাসলে ও আমি উনাকেই বিয়ে করে উনার সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করব।”

নেহাল ভাই অর্নগল কন্ঠে বলতে আরম্ভ করলেন,,

“যদি বলি আহনাফ তনিমাকে ভালোবাসে বলেই কানাডা ব্যাক করছে তখন তুমি কি করবে প্রভা? আহনাফকে মেনে নিবে? বিয়ে করতে রাজি হবে আহনাফকে?”

চোখ জোড়া প্রকান্ড করে আমি উত্তেজিত কন্ঠে বললাম,,

“মানে?”

“আহনাফ তনিমার জন্যই কানাডা ব্যাক করছে। তোমাকে পাওয়ার আশা আহনাফ ঐদিনই ছেড়ে দিয়েছে। যে মেয়েটা আহনাফকে মন থেকে ভালোবাসে আহনাফ তাকেই মন থেকে মেনে নিয়েছে! হয়তো তোমার সামনে স্বীকার করতে পারে নি। তুমি কষ্ট পাবে বলে!”

থমকে গেলাম আমি। সম্মতি হারিয়েছি বোধ হয়। কিছু সময় পর সম্মতি ফিরে পেতেই আমি কম্পিত কন্ঠে বললাম,,

“আহনাফ কখনো মিথ্যে বলতে পারেন না। হয়তো আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে নেহাল ভাই।”

“তুমি চাইলে তনিমার সাথে কথা বলতে পারো। সিউর হতে পারো। কিছুক্ষণ আগে ও তনিমার সাথে আমার কথা হয়েছে। সি ইজ সো এক্সাইটেড।”

নেহাল ভাই কল রেকর্ডিং শুনালেন। মেয়েটার উত্তেজিত গলার স্বর স্পষ্ট শুনা যাচ্ছে। আহনাফের ফিরে যাওয়ার খুশিতে মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে। আগামী মাসে বিয়ে করার ও প্রস্তুতি নিচ্ছেন উনারা। ব্যথিত মনে আমি খুব মনযোগ সহকারে কল রেকর্ডিংটা শুনছিলাম। কেনো জানি না হুট করেই চোখের কোণে অবাধ্য জলেদের ছুটোছুটি আরম্ভ হলো। বুকের ভেতরটায় নিদারুন কষ্টে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে এলো। লোকটা সত্যি সত্যিই বিয়ে ভেঙ্গে অন্য কারো কাছে নিজেকে সমর্পণ করবেন তা আমি দুঃস্বপ্নে ও ভাবি নি! বদরাগী হলে ও লোকটা যে ভীষন ভালো মনের মানুষ তা হয়তো আমি একটু একটু করে বুঝতে শিখেছি। যখন তার প্রতি আমার ভালো লাগা কাজ করতে আরম্ভ করল, তখনই সে আমাকে একা ছেড়ে অন্য কারো জীবনে ভালোবাসা হিসেবে ধরা দিলো? হায় কপাল! কতোটা নির্মম আমার নিয়তি!

_______________________________________

মাঝখানে ৪ দিন কেটে গেলো খুব অনায়াসে। দু বাড়িতেই এখন থেকে বিয়ের আমেজ খুব জমজমাটভাবে টের পাওয়া যাচ্ছে। আপু কিছুক্ষণ পর পর কল করে জিগ্যেস করছেন আহনাফকে নিয়ে কবে, কখন শপিংয়ে বের হবো। শাড়ি, লেহেঙ্গা, অরনামেন্টস কোন ডিজাইনের নিবো তা নিয়ে ভাবছি কিনা। নিজের আলাদা কোনো পছন্দ আছে কিনা! জিজু ডেইলি টেলিফোন করে নানা রকম ইয়ার্কি, দুষ্টুমি করছেন। এই দিকে আম্মু, আব্বু বিয়ের আনুষাঙ্গিক খরচ নিয়ে ভাবছেন। আত্নীয় স্বজনদের লম্বা লিস্ট নিয়ে বসছেন। বিয়ের ইনভিটিশান কার্ড নিয়ে খুব মাতামাতি করছেন। আহনাফকে বিয়েতে কি গিফট করবেন তা নিয়ে ও বড্ড জল্পনা কল্পনায় আছেন। সবার এতো খুশি, বিয়ে নিয়ে এতো সম্ভাবনা, অপার উত্তেজনা দেখে আমার মনটা বেগতিক খারাপের দিকে যাচ্ছে। সবাইকে কি করে বুঝাই? বিয়েটা হবে না! আহনাফ আমাদের সবাইকে ছেড়ে কানাডা ব্যাক করবেন! বিয়েটা ভেঙ্গে যাবে আমার। সত্যিই এবার বিয়েটা ভেঙ্গে যাবে!

ঐ দিনের পর থেকে আহনাফের সাথে একবারের জন্যে ও যোগাযোগ করার চেষ্টা করি নি আমি। না আহনাফ একটা বারের জন্য চেষ্টা করেছিলেন, আমার সাথে সামান্য যোগাযোগ করার। এই কয়েকদিনে আহনাফকে ঘিরে মনের কোণে অতি ক্ষুদ্র যে ভালো লাগার ফিলিংস গুলো তৈরী হয়েছিলো না? সেই সব ফিলিংস গুলোকে মাটি চাঁপা দিয়ে আমি চেষ্টা করছিলাম ভালো থাকার!

ইদানিং নেহাল ভাই খুব যত্ন নিচ্ছিলেন আমার৷ প্রতিটা মুহূর্তে কল করে আমার খবরাখবর নিচ্ছিলেন। ভার্সিটিতে আসা, যাওয়া উনার সাথেই হচ্ছিলো। আমার মন ভালো করার জন্য উনি হাজারটা চেষ্টা করে কখনো সখনো জয়ী হয়ে যেতেন আমাকে হাসানোর রেইসে। খিলখিলিয়ে হেসে দিতাম আমি। লোকটা ভালো বন্ধু হিসেবে মন্দ নয়। অনায়াসে তার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করা যায়। আমি ও উনাকে ভালো বন্ধু হিসেবে ভাবতে শুরু করছি। তিস্তার পরে উনাকেই বেস্ট ফ্রেন্ডের জায়গাটায় রাখার চেষ্টা করছি।

সকাল ১১ঃ৩০ মিনিটের কাছাকাছি। ভার্সিটিতে ক্লাস করছিলাম আমি। ইতোমধ্যেই ফোন বেজে উঠল। স্ক্রীনের দিকে তাকাতেই আহনাফের ফোন নাম্বারটা ভেসে উঠলো। হার্ট বিট করছিলো দ্রুত গতিতে। শরীরটা অসহনীয়ভাবে কেঁপে উঠছিলো। শ্বাস ভারী হয়ে আসতেই আমি উত্তেজিত হয়ে কলটা রিসিভ করলাম। ঐ পাশ থেকে আহনাফ ক্ষীণ কন্ঠে বললেন,,

“স্যরি। এই অসময়ে তোমায় কল করে ডিস্টার্ব করার জন্য৷”

“উহু। ডিস্টার্বড হই নি আমি।”

“একচুয়েলি, আমি ইয়ারপোর্ট আছি। ৩০ মিনিট পরেই ফ্লাইট!”

দম রিয়ে আহনাফ পুনরায় পীড়াদায়ক কন্ঠে বললেন,,

“চলে যাচ্ছি আমি। ভালো থেকো!”

শুকনো ঢোক গিলে আমি গলা জড়ানো কন্ঠে বললাম,,

“একটা বার আপনার সাথে দেখা করতে পারি?”

আহনাফ হেয় হেসে বললেন,,

“বাট হোয়াই প্রভা? আমার সাথে দেখা করার তো খুব একটা প্রয়োজন মনে করছি না!”

“হয়তো আছে। প্রয়োজন আছে। জানি আপনাকে আটকাতে পারব না। সেই অধিকারটা ও আপাতত আমার নেই। জাস্ট একটা বার আপনাকে দেখতে চাই। জাস্ট এ্যা টাইম।”

“স্যরি। এখন আর পসিবল না। এয়ারপোর্ট থেকে ব্যাক করতে পারব না।”

“কোনো ব্যাপার নাহ্। আমি আসছি।”

আহনাফ আচমকা ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বললেন,,

“ওয়েট ওয়েট৷ তোমাকে কোথাও আসতে হবে না। আমি তোমার ভার্সিটির গেইটের সামনেই আছি। কাম ফার্স্ট!”

আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে আমি স্যার থেকে কোনো রূপ পারমিশান না নিয়েই উচ্চ শব্দে হেসে ক্লাস রুম থেকে বের হয়ে ব্যাকুল কন্ঠে বললাম,,

“তাহলে বললেন কেনো আপনি এয়ারপোর্ট?”

“যাচাই করছিলাম। ভেবেছিলাম দেখা করতে চাইবে না। তাই বাধ্য হয়ে মিথ্যেটা বলতে হলো।”

হন্ন হয়ে আমি যতোটা দ্রুত দৌঁড়ানো যায় ঠিক ততোটাই দ্রুত দৌঁড়ে ভার্সিটির গেইটের সামনে এসে হাজির হলাম। পড়নে ব্ল্যাক শার্ট, ব্ল্যাক প্যান্ট, চোখে গোল ফ্রেমের পাওয়ারফুল চশমা, হাতে ব্ল্যাক ওয়াচ, গালে এবং থুতনীতে ঘন গুচ্ছ কালো দাঁড়ি, খুব ভাব নিয়ে গাড়ির সাথে ঢ্যাশ দিয়ে দাঁড়িয়ে আহনাফ ফোন কানে রেখে ম্লান হাসছিলেন। আমাকে দেখা মাএই উনি ফোনটা কান থেকে সরিয়ে জোর পূর্বক হাসি টানলেন। লোকটাকে এই ড্যাশিং লুকে দেখা মাএই থমকালাম আমি। মুগ্ধ নয়নে উনার দিকে তাকাতেই উনি আমার দিকে কিঞ্চিৎ এগিয়ে এসে তব্ধ শ্বাস ছেড়ে বললেন,,

“এতো দ্রুত চলে আসবে, ভাবতে পারি নি।”

পর পর কয়েকবার তপ্ত শ্বাস নির্গত করে আমি কম্পিত কন্ঠে উনাকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,

“সত্যিই আপনি চলে যাচ্ছেন?”

“কেনো? বিশ্বাস হচ্ছে না?”

অস্থির দৃষ্টিতে আমি আহনাফের দিকে চেয়ে বললাম,,

“থেকে গেলে হয় না?”

আহনাফ উৎসুক কন্ঠে বললেন,,

“থেকে যাওয়ার রিজনটা বললে.. থেকে যাবো সত্যি।”

তনিমার কথা মনে পড়তেই মুহূর্তের মধ্যেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। কোন কারণে লোকটাকে আটকাবো আমি? লোকটা তো এখন অন্য কাউকে ভালোবাসে! সেই ভালোবাসার মানুষটার জন্যই তো উনি আমাকে ছেড়ে কানাডা ব্যাক করছেন। অশ্রুসিক্ত চোখে আমি উনার দিকে আহত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,

“কোনো রিজন নেই। আপনি যেতে পারেন!”

আহনাফ কেমন যেনো ছটফটে কন্ঠে অপার সম্ভাবনা নিয়ে বললেন,,

“যাবে? আমার সাথে এয়ারপোর্ট? নেহালের সাথে আবার ব্যাক করবে!”

চেয়ে ও নিজের ইচ্ছেটাকে আটকাতে পারছিলাম না। সম্মতি জানিয়ে ডানে বায়ে মাথা নাঁড়ালাম৷ বসে পড়লাম ড্রাইভিং সিটে আহনাফের পাশে। সিটবেল্ট লাগাতেই আহনাফ ফুল স্পীডে গাড়িটা স্টার্ট করে দিলেন। আড়চোখে আহনাফের দিকে তাকাতেই আহনাফ প্রশ্নবিদ্ধ কন্ঠে আমায় উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“মনে পড়বে আমায় কখনো?”

বেদনা চেঁপে আমি স্থির কন্ঠে বললাম,,

“নাহ্।”

আহনাফ নির্জীব হেসে বললেন,,

“আই নো দ্যাট। মনে পড়ার মতো কোনো ব্যক্তিত্বই আমি নই। আ’ম নাথিং। জাস্ট নাথিং।”

আমি ছোট শব্দে বললাম,,

“হুম।”

“এগেইন স্যরি।”

“কেনো?”

“অজান্তেই তোমাকে অনেক হার্ট করেছি। খুব গিলটি ফিল হয় জানো? তোমার মুখোমুখি হতে হিজিটেড ফিল হয়। পালিয়ে বেড়াতে ইচ্ছে হয় তোমার থেকে।”

“শুধু মাএ এজন্যই আমায় ছেড়ে যাচ্ছেন? নাকি এর পেছনে ও অন্য কোনো রিজন আছে?”

“ছেড়ে যাওয়ার রিজনটা কখনো কাউকে মুখ খুলে প্রকাশ করতে পারব না হয়তো। কিছু ব্যাথা মনে লুকিয়ে রাখাটাই আই থিংক ব্যাটার।”

“একবার ও জানতে ইচ্ছে করছে না? কে আপনার মন ভেঙ্গেছে? কার দ্বারা আপনি প্রতারিত হয়েছেন?”

“জানার আগ্রহ তো অনেক ছিলো। তবে নিজেকে নতুন করে ব্যাথা দিতে চাইছি না আসলে। সে যেই হোক, আমার মনের গোপন। কখনো কেউ জানতে পারবে না তার ব্যাপারে। সিরিয়াসলি, এতো বড় আঘাত পেয়ে ও তার প্রতি ভালোবাসা আমার এক চুল ও কমবে না। সে আগে যেমন আমার মনের খুব কাছের ছিলো, এখনো ঠিক তেমনটাই আছে এবং ভবিষ্যতে ও থাকবে!”

আমি কৌতুহলী কন্ঠে আহনাফকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,

“আপনি জানেন কে সে?”

“জানি!”

“কে সে?”

“আই থিংক তোমার জানাটা খুব একটা জরুরী নয়।”

“বলতে চাইছেন না তাই তো?”

“ধরে নিতে পারো!”

“আমি কাউকে কিছু বলব না। প্লিজ অন্তত একবার তার নামটা বলুন।”

“শেট আপ৷ বাদ দাও এসব। এখন বলো? আমার ফ্রেন্ড নেহালকে তোমার কতোটা পছন্দ?”

“ফ্রেন্ড হিসেবে অনেকটাই পছন্দ।”

“অনলি ফ্রেন্ড?”

“হুম৷”

“প্রেমিক হিসেবে ও নেহাল মন্দ নয়!”

“প্রেমিক হিসেবে কখনো দেখি নি। ভালো বন্ধু হিসেবেই দেখে আসছি।”

আহনাফ অট্ট হাসলেন। পরক্ষনে একদম নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। কপালে বিরক্তিকর ছাপ ফুটিয়ে আমি প্রশ্নবিদ্ধ কন্ঠে উনাকে বললাম,,

“হাসির কি হলো?”

নিরুত্তর উনি। চোখে, মুখে তিক্ততার ছাপ ফুটিয়ে একমনে ড্রাইভিংয়ে মনযোগ দিলেন। আমি নিষ্পলক দৃষ্টিতে উনার দিকে চেয়ে আছি৷ উনাকে দেখতে দেখতেই কিভাবে যেনো অনেক গুলো ঘন্টা কেটে গেলো। গাড়ি এসে এয়ারপোর্টের সামনে থামতেই আহনাফ ট্রলি ব্যাগ হাতে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন। আমি ও গাড়ি থেকে নেমে আহনাফের পিছু পিছু এয়ারপোর্টের লনে পৌঁছালাম। একটু দূর যেতেই নেহাল ভাইকে দেখতে পেলাম। আহনাফকে দেখা মাএই নেহাল ভাই উচ্চ আওয়াজে হেসে আহনাফকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। আহনাফের পেছনটায় আমাকে দেখা মাএই নেহাল ভাই নাক, মুখ কুঁচকে খড়তড় দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে এক রোঁখা প্রশ্ন ছুঁড়ে বললেন,,

“তুমি এখানে?”

আমি প্রতিত্তুর করার পূর্বেই আহনাফ আচমকা নেহাল ভাইকে ছেড়ে মৃদ্যু হেসে বললেন,,

“হেই। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। আমিই নিয়ে এসেছি প্রভাকে। যাওয়ার সময় তোর সাথেই ব্যাক করবে। সো, ডোন্ট ওরি।”

আমাকে দেখে নেহাল ভাই খুব একটা খুশি হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে না। উনার বিরূপ মুখভঙ্গি দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে তা। ফ্লাইটের টাইম ঘনিয়ে আসতেই আহনাফ ব্যতিব্যস্ত ভঙ্গিতে আমার দিকে চেয়ে ম্লান হেসে বললেন,,

“ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড প্রভা। তোমার বাঁ হাতটা দেখতে পারি?”

ভ্রু যুগল উঁচিয়ে আমি আহনাফের দিকে আশ্চর্যিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই আহনাফ হাত বাড়িয়ে আমার বাঁ হাতটা উনার হাতে নিয়ে তর্জনী আঙ্গুলে থাকা এনগেজমেন্ট রিংটা খুলে অট্ট হেসে বললেন,,

“আজ থেকে তুমি মুক্ত প্রভা। এই রিংটা কেরি করার কোনো মানেই হয় না! তাই রিংটা খুলে নিলাম। মনে আছে? এই সামান্য রিং পড়া নিয়ে কতোটাই না সিনক্রিয়েট করেছিলাম আমি। এসব ভেবে এখন হাসি পাচ্ছে! কতোটা উন্মাদ আমি! আই জাস্ট থিংকিং দিজ।”

নেহাল ভাই রাগান্বিত ভাব নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। চারদিকে এনাউন্সমেন্ট হতেই আহনাফ নেহাল ভাইয়ের থেকে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে আমার দিকে লাস্ট বারের মতো একবার আহত দৃষ্টিতে চেয়ে ফ্লাইটের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। বেহায়া মনকে মানাতে না পেরে আমি অশ্রুসিক্ত চোখে এক ছুটে আহনাফের পেছনে এসে দাঁড়ালাম। নেহাল ভাই দৌঁড়ে এসে পেছন থেকে আমার হাতটা টেনে ধরে বললেন,,

“কোথায় যাচ্ছ তুমি?”

আমি এক ঝটকায় নেহাল ভাইয়ের হাতটা ছাড়িয়ে অজান্তেই আহনাফকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরে কান্নাজড়িত কন্ঠে বললাম,,

“কবে ফিরবেন আপনি?”

আহনাফ তব্দিত কন্ঠে বললেন,,

“হয়তো কখনো না!”

“একা দুটো পরিবারকে কিভাবে সামলাবো আমি?”

“নেহাল তো আছেই!”

“সত্যিই আপনি বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে চাইছেন? সব ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন?”

“কানাডায় নতুন একটা পৃথিবী আমার জন্য ওয়েট করছে!”

মুহূর্তের মধ্যে আহনাফকে ছেড়ে আমি এক দৌঁড়ে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আহনাফের গাড়িতে উঠে বসলাম। ভেতরটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আমার। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে। শুধু ভালো লাগা থেকেই কি উনার জন্য এতোটা অসহ্য কষ্ট হচ্ছে আমার? নাকি এই কয়েকদিনে উনার প্রতি সত্যিই কোনো ভালোবাসা জন্ম নিয়েছিলো আমার?

#চলবে….?