আসক্তি২ পর্ব-২৭

0
2654

#আসক্তি২
পর্বঃ২৭
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

পাখির করা দ্বিতীয় প্রশ্নে দুনিয়া থেমে যায় শানের।নজর সরিয়ে বলে,”এটা না জানলেও চলবে”
হনহন করে চলে আসতেই পাখি ছাদের দরজার কাছে চলে এসে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়।রাগত স্বরে বলে,”এটা জানা আরো বেশী জরুরী আমার”

শান বুঝতে পারে পাখি সবটা জেনে তবেই ক্ষান্ত হবে।ঠোঁট দুটো গোল করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “তুমি খুব জেদি পাখি”
“তাই যদি হয়, তবে তাইই।এবার বলুন”,শানের চোখে চোখ রেখে বলে পাখি।

“ঢামেকে ভর্তি হওয়ার পর বেশ ভালোই চলছিলো সবকিছু।মেয়ে বন্ধুদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতাম।কেমন যেন ওদের দিকে তাকালেই ঘৃনা চলে আসত আপনাআপনি।শুধু পড়তাম আর পড়তাম।ভালো রেজাল্ট করাই ছিলো আমার মূল উদ্দেশ্য।দেখতে দেখতে কেটে যায় তিনটা বছর।তিন ইয়ারেই কলেজ টপার।বেশ নাম ছড়িয়ে পরল চারদিকে।ভালো স্টুডেন্ট হওয়ায় জুনিয়র অনেকেই শর্ট নোট চাইত।ঐ যে বললাম বরাবরই মেয়েদের এড়িয়ে চলতাম।তাই মেয়েদের নোট গুলো অন্য ফ্রেন্ডদের দিয়ে পাঠাতাম।এভাবেই নোটের বদৌলতে পরিচয় হয় নীরা নামোক এক জুনিয়রের সাথে।ও তখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ত।ছোট ছোট বিভিন্ন নোটসের জন্যে আমার কাছে আসত।আমি এড়িয়ে চলতাম।খোঁজ নিয়ে জানতে পারি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের কোন কলেজ থেকে পাশ করে মেধার জোড়ে আর লোকের সহযোগীতায় ঢামেকে চাঞ্ছ পায়।এ ও জানতে পারি মেয়েটা অনেক বেশি অসহায় আর গরীব।সব শোনার পর ওর প্রতি কেমন যেন মায়া হলো খুব।ওকে বিনামূল্য এক ঘন্টা করে পড়ানো শুরু করলাম ;কলেজ শেষে।

এভাবে চলে গেলো ছয়টা মাস। বুঝতে পারলাম পড়ার থেকে ওর আমার প্রতি মনোযোগ অনেক বেশি।তাই পড়ানো বন্ধ করলাম।তবে ওকে সুযোগ দিলাম অন্য টিচারের কাছে পড়ো। বেতন আমি দিবো।ও সেদিন অনেক কান্নাকাটি করে বলেছিল ‘শান ভাই আমি আপনাকে ভালোবাসি’
থমকে গেছিলাম সেদিন।রাগে ওর গালে চর বসিয়েছিলাম।সেদিনের পর জানতে পারি নীরা গ্রামে চলে গেছে।মেস ভাড়া পুষিয়ে দিয়ে;ব্যাগপত্র সমেত।বুঝতে পারলাম সেদিনের ঘটনাটা একটু বেশি হয়ে গেছে।নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হলো।আমার জন্যে মেধাবী একটা মেয়ে পড়াশুনা বন্ধ করবে!
ওর নম্বরে ফোন করলাম।ফোন বন্ধ ছিলো। ঠিকানা নিয়ে গ্রামে গেলাম।এতো গরীব অবস্থা ওর যে, মাথা তুলে ঘরে ঢোকার সামর্থ্য ছিলো না আমার।মাথা গিয়ে ঠেকত মরিচা ধরা ভাঙ্গা টিনের উপর।গিয়ে জানতে পারি ওর পরিবার আর পড়াতে পারবেন না।বিয়ে দিবেন ওর।বেশ অবাক হয়েছিলাম।পরে নিজ দায়িত্বে ওকে আবার নিয়ে আসি।ততোদিনেও ওর প্রতি আমার কোন ফিলিংস ছিলো না।

কলেজ হোস্টেলে সিট নিয়ে দেই।পড়াশুনা বাবদ সমস্ত খরচ আমি চালাতাম।এভাবে সব মিলিয়ে কেটে গেলে বাকি ছয় মাস।এর মাঝে ও কোনদিনও আর ভালোবাসার কথা জাহির করে নি।কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম দিনে দিনে কতোটা এডিক্টেড হয়ে যাচ্ছিলাম ওর প্রতি।নতুন করে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো নীরাকে।আমার চতুর্থ বর্ষের প্রথম এক্সামের শেষে আমি ওকে প্রোপোজ করি।ও কোন কথা ছাড়াই কেঁদে ফেলেছিলো।কান্না টার মাঝে কোন ছলনা ছিলো না।খুব গভীর আর পিওর লাভ ফিলিংস খুঁজে পেয়েছিলাম।এরপর আস্তে আস্তে সমস্ত পরীক্ষা দিলাম।রেজাল্টও পেলাম চতুর্থ বর্ষের।এবার আর টপার হতে পারলাম না।কারণ আমার নিজের পড়াশুনার থেকে ওর পড়াশুনার প্রতি আমার কেয়ার ছিলো অনেক বেশি।নীরা ওর ব্যচে অনেক ভালো রেজাল্ট করল।রেজাল্টের দিন খুশিতে আত্মহারা হয়ে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরেছিলো আমায়।রেজাল্ট শীট হাতে বলেছিল’সব তোমার জন্যে শান’
আমার টপার থেকে তৃতীয় স্থানে আসা রেজাল্ট ওকে জানিয়ে ওর খুশির মূহূর্তটা নষ্ট করতে চাই নি।ওর খুশিতে খুশি হয়েছিলাম।”

“আর শুনব না আমি”,কাটকাট গলায় বলে পাখি।শান নিজের হাসিটাকে দাবিয়ে রেখে বলে,”শুনতে হবে তো।তুমি তো শোনার জন্যে ব্যস্ত।”পাখির হাতটা চেপে ধরে বলে শান।

শান আবার বলতে শুরু করে, “নীরা আর আমার সম্পর্কটা অনেক বেশিই ভালো চলছিলো।লং ড্রাইভে যাওয়া, স্ট্রিট ফুডে দশ পাঁচ টাকা খরচ করা এসবই ছিলো আমাদের প্ল্যানিং।আস্তে আস্তে আমার পঞ্চম বর্ষের দিন ঘনিয়ে আসছিলো।আর কেমন যেন অজানা ভয় মনে জেঁকে বসল।কলেজ ছেড়ে যেতে হবে ইন্টার্ণির জন্যে।নীরাকে ছেড়ে থাকতে হবে।এসব ভয় পেতাম খুব।কিন্তু দিনে দিনে নীরার আচরনে অনেক পরিবর্তন চলে আসে।তার আর স্ট্রিটের দশ পাঁচ টাকার ফুডে পোষায় না,লং ড্রাইভে বাইকে না ;কারে যেতে চায়।আমি অবশ্য ব্যপার গুলো তেমন আমলে নিতাম না।কারণ ওকে ফাইভ স্টার হোটেলে খাওয়ানো,কারে লং ড্রাইভ যাওয়া,দামি দামি পোশাক, কসমেটিক্স দেয়া আমার কাছে কোন ব্যপারই ছিলো না।তো বাবাকে বলে নতুন একটা গাড়ি নিলাম।বাবা আমার কোন চাওয়াই অপূর্ণ রাখত না।কথামতো বাজারের নতুন মডেলের কার কিনে দিলো।মন্দ না সব মিলিয়ে ভালোই চলছিলো।চোখের পলকে আমার ফাইনাল এক্সাম এসে এলো।আর নীরার দ্বিতীয় বর্ষ।পরীক্ষা দিলাম এবার আর রেজাল্টের হেরফের হলো না।অনেক ভালো ফলাফলে মেডিকেল ফাইনালে পাশ করলাম।সময় এবার কলেজ ছাড়ার,ইন্টার্ণি দিয়ে প্রোফেশনে ঢোকার।

মন না চাইলেো কলেজ ছাড়তে হলো।কলেজে থাকাকালীন নীরার সমস্ত আপডেট সংগ্রহের জন্যে ওরই ব্যচের দুজন ভালো ছেলেকে ঠিক করলাম।যাতে নীরার কোনরকম কোন অসুবিধা না হয়।এদিকে আমার ইন্টার্ণশিপ চলছিলো কোন বান্দরবানের কোন এক প্রত্যন্ত হাসপাতালে।দিনে দিনে বুঝতে পারি নীরার সাথে আমার অদৃশ্য এক দূরত্বের তৈরী হচ্ছে।আমার সারাদিনের ইন্টার্ণ শেষ করে ওকে একটু ফোন করলে বিজি দেখাত।নেটওয়ার্কের সমস্যায় পাহাড়ের চূড়ায় বসে ফোন দিতাম ওকে কিন্তু বিজি পেতাম।ঐ ছেলে দুটোর থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি নীরা কোন এক সিনিওরের সাথে ইদানিং বেশি মিশতেছে।ব্যপারটা আমার মোটেও ভালো লাগল না ইন্টার্ণ ছেড়ে আসতে মন চাইছিলো।বাধ্য হয়ে ওকে বিয়ের জন্যে বললাম।কিন্তু ও টোট্যালি নাকোচ করে বলল’শান আমি ডক্টর হতে চাই।আমার গরীব বাবা মায়ের মুখটা উজ্জ্বল করতে চাই।তুমি যেমন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছো আমিও তেমনটা চাই।তারপর না হয় বিয়ের ব্যপারে আগাব’

আমিও আর জোড় করি নি নীরাকে।কারণ ওকে ডাক্তার বানাব বলেই ওর বাড়ি থেকে রিস্ক নিয়ে এনেছিলাম।এভাবে দিন যতো যাচ্ছিলো নীরার আচরন ততোই বাড়ছিলো।দামি দামি জামা কাপড়ের কথা বলত আমায়।যখন বলতাম কে দিয়েছে?তখন বলত ওর নাকি কোন বান্ধবী অনেক বড়লোক সে দিয়েছে।ওর দামি জুতা,ব্যাগ,জামাকাপড় বা বিলাসবহুল জীবন যাপন আমায় ভাবনায় ফেলে।প্রশ্ন করেও মনযুৎ কোন জবাব পেতাম না।কেটে গেলো একটি বছর।আমি ইন্টার্ণশিপ শেষ করলাম;ভালো রেজাল্ট নিয়ে।ততোদিনে নীরা আর আগের নীরা নেই।কেমন যেন খাপছাড়া স্বভাবের হয়ে গেলো।তবে ডিরেক্ট বলতোও না যে ও ব্রেকআপ চায়।ডিপ্রেশনে আমি দিন কাটানো শুরু করলাম।নিজেকে ধাতস্ত করলাম পেশায় নিযুক্ত হওয়ার জন্যে।হয়েও গেলাম।তবুও ডিপ্রেশন কাটলো না।এদিকে নীরাকে অঢেল টাকা পয়সা ঢালতে শুরু করলাম।তবুও দিনশেষে নীরার মন পাওয়াটা কঠিন হয়ে দাঁড়ালো।

এর মাঝে ঘটল আরেক বিপত্তি।ছোট কাকার একটাই মাত্র ছেলে ছিলো, রনি। তাই টিনাকে নিজের সন্তানের থেকে কম কিছু দেখত না কাকি।বরং রনির থেকে অনেক আদর করত। আমরা ঢাকায় সেটেল হওয়ার পর অনেক ডেকেছিলাম কিন্তু টিনা আসে নি।কলেজে পড়াকালীন নাকি ডেভিড নামের খ্রিষ্টান ধর্মীয় আমেরিকান ছেলের সাথে প্রেম হয় টিনার।কোনভাবে ব্যপার টা কাকার কানে আসতেই কাকা এক কথায় নাকোচ করে দেয়।বাধ্য হয়ে টিনা আর ডেভিড গোপনে বিয়ে করে নেয়।কাকা আমাদের এসব কিছুই জানায় নি ;লজ্জায়।পরবর্তীতে টিনা যখন ছয় মাসের প্রেগন্যান্ট তখন ব্যপারটা ডেভিডের পরিবারে জানালে তারা কোনভাবেই মানতে চায় না ।এরপর ডেভিড সহ টিনা আলাদা সংসার পাতে।টিনা যেদিন লেবার পেইনে হসপিটালে কাতরায় সেদিন ডেভিড ডিউটিরত ছিলো একটা ফুড ফ্যাক্টরিতে। আগুন লেগে দশজন ওয়ার্কার মারা যায়।তাদের মাঝে ডেভিডও ছিলো একজন।হাসপাতাল থেকে কাকাকে কল করা হলে কাকা গিয়ে টিনার অপারেশনের সমস্ত ব্যবস্থা করেন।কিছু ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশনের জন্যেই সেই বাচ্চার এপিলেপসি রোগ হয়।ফুটফুটে কন্যা সন্তান জন্ম দেয় আমাদের টিনা।আর সেই সন্তান আর কেউই না।আমাদের ইনায়াহ্ পাখি”

বলেই থেমে যায় শান।পাখিকে প্রশ্ন করে,”ইনায়াহ্’কে কি আর পাঁচটা দেশীয় বাচ্চার মতো মনে হয়? “,
পাখি বিড়বিড় করে বলে,”প্রথম দিন তো বিদেশীর বাচ্চাই মনে হয়েছিলো”
শান মুচকি হেসে বলে,”হ্যা ”
“তারপর কি হলো?”
“তারপর আর কি।ব্যপার টা কাকা কোনভাবেই মানতে পারলেন না।বাধ্য হয়ে সমস্ত ঘটনা আমাদের খুলে বললেন।আর টিনাকে এককালীন দেশে আমাদের কাছে পাঠালেন সদ্য জন্মানো সন্তান সহ।বাবাও কোনভাবে ইনায়াহ’কে মানতে পারলেন না।বলতেন খ্রিষ্টানের বিদেশি বাচ্চার কোন ঠাঁই আমি দিবো না।অনেক করে আমি বাবাকে সবটা বোঝালে সব বুঝে বাবা টিনাকে বাড়িতে রাখে তবে টিনার সাথে কোন যোগাযোগ রাখে না।এক বাড়িতে থেকেও দুজনার মাঝে দেয়াল উঠে যায়।যেটা আমি চাইলেও ভাঙ্গতে পারছিলাম না।টিনাকে দেখাশোনা করার জন্যে পার্মানেন্ট একজন লোক লাগত।কিন্তু সেরকম কাউকেই পেলাম না।অগত্যা শর্মিলা বেগম নিজের কাছে নিয়ে গেলেন টিনাকে।ওহহহ হ্যা, আরেকটা কথা বলা হয় নি। আমরা ঢাকায় শিফট হওয়ার কয়েকমাস পর শর্মিলা বেগম তার সো কল্ড হাজব্যান্ড সহ আমাদের পাশের এলাকায় চলে আসে।আর বাবার বেশিরভাগ সময় শহরের বাহিরে থাকার কারণ মূলত এটাই ছিলো।

ইনায়াহ্ যখন ছয় মাস বয়স তখন আমি একপ্রকার জোড় করে ওকে আমার কাছে আনি।টিনার কিছু শারীরিক প্রবলেম ছিলো যা দিনকে দিনকে বেড়েই চলছিলো।আমি রাহেলা চাচি সমেত ইনায়াহ্’র দেখাশোনা শুরু করি।মাঝে মাঝে ঐ বাড়িতেও গিয়ে থাকত টিনা।কিছুদিন পর বুঝতে পারি টিনা বাবাকে আর পছন্দ করছেন না।আমায় বার বার বলত আমি যেন মায়ের সাথে যোগাযোগ করি কিন্তু আমি করি নি।কারণ টিনা জানে না আমি জানি উনি কতোটা জঘন্য মানুষ। টিনার বাবাকে এতোটা ঘৃনা করার কারণ বুঝতে পারছিলাম না।বাবা বাধ্য হয়ে আলাদা বাড়ি কিনে নেয়।আর সেখানেই থাকতে শুরু করে;আমাদেরকে এ বাড়ি ছেড়ে দিয়ে।টিনাকে আমরা কেউ টু শব্দটি করতাম না কারণ, টিনার হার্টে জন্মগত সমস্যা ছিলো।

এতোসবের মাঝে আমি অনেক বেশিই ব্যস্ত হয়ে পরি। ফলে নীরার সাথে দৈনিক এক থেকে দুইবার কথা বলার সুযোগ হতো।তাতেও নীরার ইচ্ছে থাকত না কথা বলার।পড়াশুনার অযুহাতে আমায় এড়িয়ে চলত।এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো সময়।আর দিনে দিনে টিনার শরীরের অবনতি হচ্ছিলো।এক পর্যায়ে ইনায়াহ্ যখন আঠার মাসের বাচ্চা তখন দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে ইনায়াহ্’কে এতিম করে চলে যায় টিনা।নিজেকে এতো বেশি একা মনে হলো বলার বাহিরে।নীরার হাতে পায়ে ধরে একটু সময় ভিক্ষে চাইতাম।কিন্তু নীরার অন্তর গলত না।

সেদিন রাহেলা চাচি ইনায়াহ্’কে ও বাড়ি নিয়ে যায়।আর আমিও সুযোগটাকে কাজে লাগালাম। সময় বের করে নীরাকে নিয়ে গেলাম লং ড্রাইভে ঢাকার অদূরে।শুধু এটা জানতে যে ও কি চায়!ও সোজাসুজি বলেছিলো ‘আমি তোমাকেই চাই শান।আর তো মাত্র একটা ইয়ার।তারপর ইন্টার্ণ। তারপর প্রোফেশন।আমি না হয় প্রোফেশনে ঢোকার আগেই বিয়েই টা সেড়ে ফেলব। হ্যাপি!’
সেদিন কি যে খুশি হয়েছিলাম বলার মতো না।খুশিতে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে ফিরে আসছি বাড়ির পথে।হঠাৎ কিভাবে যেন গাড়ি ব্রেইক ফেইল করল।গাড়ির গতিবিধি বুঝে নীরার পাশের দরজাটা খুলে রাস্তার পাশে নিরাপদ জায়গায় ওকে ধাক্কা মেরে ফেলি।তৎক্ষনাৎ আমি আমার পাশের দরজা খুলে লাফ দেয়ার আগেই বড় একটা গাছের সাথে ধাক্কা লেগে গাড়ি সমেত পরে গেলাম রাস্তার ভাঙ্গা খাঁদে।

ছোটখাটো না বেশ বড় এক্সিডেন্ট হয়।আর অপারেশনটাও বেশ ক্রিটিক্যাল হয়।জ্ঞান ফিরে বুঝতে পারি আমি হসপিটালের বেডে শোয়া।পাশেই বাবা, রাহেলা চাচি আর আব্দুল্লাহ্ চাচা ;কোলে ইনায়াহ্।চারপাশে তাকিয়ে বলেছিলাম ‘নীরা কোথায় বাবা?’
বাবা তখন সবে প্রথম আমার মুখে নীরার নাম শোনে।বেশ থমকে গিয়ে বলেছিল’একটা মেয়ে নাকি তোমায় হসপিটালে আনে আর তারপর আমাদের খবর দেয়া হয়।কিন্তু মেয়েটার আর কোন খোঁজ তো পাই নি আমি ‘
বেশ চিন্তায় পরে যাই।দ্রুত বাবার থেকে ফোন নিয়ে কল করি নীরার কাছে ;ফোন বন্ধ।হোস্টেলের দায়িত্বে থাকা স্যারের কাছে ফোন করলে স্যার জানায় নীরা নাকি কালকে বন্ধুরা মিলে সাজেক ঘুরতে যায়।মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে আমার।আমায় এতো অসুস্থ্য রেখে নীরা কী করে সাজেকে যেতে পারল?আর এতো টাকাই বা কে দিলো?
এসব ভাবতে ভাবতে পুরো দিন চলে গেলো তবু নীরার কোন খোঁজ হলো না।

সাত দিন পর হসপিটাল থেকে রিলিজ হলে আমি বাড়ি চলে আসি।রাহেলা চাচি প্রত্যেকটা সময় আমার সাথে ছিলো।তার সহযোগীতায় সম্পূর্ণ ভাবে সুস্থ হতে পুরো একটা মাস কেটে যায় আমার।আর এই এক মাসে অনেক কিছুই পাল্টে যায়।আমার অসুস্থ্যতার মাঝে নীরা আমায় দেখতে এসেছিলো বাড়িতে।সেদিন বাবা এ বাড়িতে ছিলো।ঐদিন প্রথম বাবার সাথে নীরার দেখা হয়।তারপর কারণে -অকারনে নীরা আমার বাড়ি আসত। আমি অবশ্য অবাক হতাম আবার পরোক্ষনে খুশি হতাম এটা ভেবে যে,নীরা আগের মতো ভালোবাসছে আমায়।সত্যি বলতে এর পিছনে যে নীরার ঘৃন্য একটা কামনা লুকিয়ে ছিলো তা আমার অজানা ছিলো।

সুস্থ হবার পর আমি আবারো হসপিটালে জয়েন করি।দিনগুলো মোটামোটি ভালোই চলছিলো।নীরার ব্যপারে সবটা জানাইলাম বাবাকে।বাবারও নীরাকে বেশ পছন্দ হলো।রইল বাকি বিয়ের কথা। সেটা নীরার ইন্টার্ণির পর ঠিক হলো।খুব খুশি আমি।একদিন চেম্বারে রোগী দেখছি বাবা আমায় কল করলেন।রিসিভ করতেই বাবার আহাজারি শুনতে পেলাম।বুকের ভিতর টা ধক করে উঠলো।কারণ প্রথম বার মা চলে যাবার পর এভাবে আহাজারি করেছিলো বাবা আর সেদিন দ্বিতীয় বার।ছুটে গেলাম বাবার নতুন বাড়িতে।সদর দরজা পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই পুরো শরীরে ঝিমঝিম করা শুরু করল।বউয়ের সাজে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে আছে নীরা।নিজেকে সামান্য ধাতস্থ করে হাসি টেনর নীরাকে বললাম ‘বউ সেজেছ যে কারণ কি?’
নীরা স্বাভাবিকভাবেই জবাব দিয়েছিলো’বউ হয়েছি বলেই তো বউ সেজেছি’

ওর কথার আগামাথা কিছুই মথায় ঢুকছিলো না।পরে পাশে দাঁড়ানো বাবাকে বললাম ‘বাবা এসব কি?ও বউ সেজে এ বাড়িতে কেন’
পাশ থেকে নীরা জবাব দিলো ‘এতো ভণিতার কিছুই নেই শান। আমি আর নাটক করতে পারছি না।আমি আর তোমার বাবা আই মিন আহমেদ সদিচ্ছায় বিয়ে করেছি ‘

নীরার কথায় চোখের সামনে আমার অন্ধকার ভবিষ্যত ছাড়া কিছুই দেখছিলাম না।দ্বিতীয়বারের মতো কলিজা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলো।কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এসব কিছু।বাবার সামনে গিয়ে বললাম ‘নীরা এসব কি বলছে বাবা?ও কি পাগল হয়েছে’
বাবা আমায় আশ্বস্ত করে বলেছিলো ‘তোমায় সবটা বলছি শান।একটু শান্ত হও’
আমাদের দুজনের কথার মাঝে নীরা বলে উঠল ‘এতো বলা বলির কি আছে?সন্তানপ্রদানে অক্ষম একজন মানুষের সাথে আমি কী করে সারাজীবন কাটাব?আর ওর আছেই বা কি? শুধু বাড়িটা দুটো গাড়ি আর আছে একটা চাকরি।এসবে কোনদিনও আমি সুখে থাকতে পারব না’

একই দিনে পরপর এতোগুলো শক্ড নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না।শরীরটাও অনেক বেশি দূর্বল ছিলো।প্রেশার বেড়ে গেলো শরীরের বেশ বুঝতে পারলাম। চোখ দুটো বন্ধ হতেই আর কিছু মনে নেই।

চোখ খুলে তাকালাম যখন তখন বুঝে গেছি এটা হসপিটাল।অথচ আমার পাশে একটা জনপ্রাণীও নেই।নিজেকে এতো বেশি পরিমান একা লাগল।হুহুস্বরে কেঁদে ফেলেছিলাম সেদিন।কিছুতেই মানতে পারছিলাম না নীরা এমন একটা কাজ করবে।তাও আমারই বাবার সাথে।ছেলে মানুষের কাঁদতে নেই।তাই চুপ করে গেলাম।তবে মনকে কোনভাবেই বোঝাতে পারছিলাম না।কিছুক্ষন পর বাবা এসে পাশে বসলেন।মুখ ফিরিয়ে নিলাম।আমার হাত টা দুহাতের মুঠোয় ভরে বললেন,’আমার কিছু করার ছিলো না বাবা।আমি তোমার বাবা হয়ে এতোবড় কাজটা করতে চাই নি।নীরা সকাল বেলা ফোন করে আমায় ডেকে নিলো।ওর নাকি কি দরকার আছে। পরে সেখানে আমায় আটকে হাত পা বেঁধে বিয়েতে বাধ্য করে।নইলে নাকি রেপ কেসে আমায় ফাঁসাবে।আর তোমাকেও মেরে ফেলবে।তোমার কথা বলাতে আমি আর না করতে পারি নি। বাধ্য হয়েই নীরাকে বিয়ে করি। আমার কোন দোষ নেই বাবা।বিশ্বাস করো।’

বলেই বাবা নিজের কান্না সংবরন করলেন।আমি জানি আমার বাবা কখনোই আমার সাথে ইচ্ছা করে এমন ঘৃন্য কাজ করবেন না।নীরা যে অর্থ সম্পদের লোভে এমন কাজ বাবাকে দিয়ে করিয়েছিলো তা আমি বেশ বুঝতে পেরেছিলাম।পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেলো আমার মন।স্বাভাবিকভাবেই বাবাকে বললাম ‘আমার অপারেশনের ডিটেইলস বলো’

তখন বাবার জবাবে জীবনে বেঁচে থাকার আর কোন আশাই খুঁজে পেলাম না।কার এক্সিডেন্টের অপারেশনের সাথে সাথে আমি চিরতরে হারিয়ে ফেলি বাবা হওয়ার সক্ষমতা। যেটাকে বলা হয় ইমিউনোলজিক ইনফার্টিলিটি।

রাতে বাড়ি ফিরলাম নেশাগ্রস্ত হয়ে।সিদ্ধান্ত ফাইনাল করলাম পৃথিবী ছাড়ব।কারণ নীরার দেয়া আঘাতটা কিছুতেই মানতে পারছিলাম না।টলমলে পায়ে সিঁড়িতে পা রাখতে ইনায়াহ্ দৌঁড়ে এসে পা জড়িয়ে নেয়।মাথা তুলে কোলে নিতে ইশারা করে।মাথা নিচু কর ওকে কোলে তুলে নিতেই ইনায়াহ্ গলা জড়িয়ে নেয়।চোখ বন্ধ করে বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে নিলাম।এবারও আমার সুইসাইড করা হলো না।তবে নিজেকে পুরোদমেই পরিবর্তন করলাম।ঠিক এমন ভাবে, যাতে কেউই আর ভাঙ্গতে না পারে।মেয়েদের উপর থেকে পুরোটাই বিশ্বাস নষ্ট হলো আমার।

এবারো মজার ব্যপার কি জানো পাখি?”,প্রশ্ন করে শান।

শানের বিষাক্ত অতীতের নীল জলে ডুবে যায় পাখি।গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ভাবতেই গলা শুকিয়ে আসে মানুষ কতোটা স্বার্থপর হতে পারে। শানের ডাকে সম্বিৎ ফিরে বলে,”কিহহ?”
“নীরারও ঠোঁটের নীচে সেইম স্থানে একটা কালো তিল ছিলো।সেটাই ছিলো আমার দূর্বলতা।কারণ কোথাও না কোথাও মা কে ভালোবাসার অনুভূতিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠত।সেই অনুভূতি থেকেই নীরার ঐ তিলের প্রতি ভালোলাগা কাজ করত।কিন্তু যখন নীরাও মায়ের মতো সেইম কাজটাই করল তখন ধরেই নিলাম নারীরা জঘন্য আর এইখানে তিল যাদের তারা আরো জঘন্য।”

“আপনার বাবা এখন কোথায়?”,খুব ঠান্ডা কন্ঠে প্রশ্ন করে পাখি।
হতাশাব্যঞ্জক হাসি দিয়ে শান বলে,”বিয়ের সাত মাস পর বাবার হার্টে এ্যাটাক আসে।ব্লক ধরা পরে চারটা।ইমিডিয়েট বাইপাস করতে হয়।আইসিইউ রুমে মূমূর্ষ অবস্থায় আমায় কাছে ডেকে বলেছিলো আমি যেন কোনদিন শর্মিলা বেগমকে ক্ষমা না করি।বাবার কষ্টটা আমি বুঝতাম।জানতাম মায়ের শোকে শোকে বাবার আজ এ অবস্থা।সে বারের মতো সুস্থ হয় বাবা

আমিও সবটা বুকের মাঝে চেপে রেখে দিন কাটাচ্ছি ইনায়াহ্’কে নিয়ে।ধীরেধীরে বেড়ে উঠছে আমার ইনায়াহ্।হঠাৎ একদিন নীরা ফোন করে বলল বাবা নাকি নেই।দুনিয়ার সবথেকে এতিম মনে হলো নিজেকে।কারণ বাবা ছাড়া আমার কেউ ছিলো না।

পরে জানতে পারি এই বাড়ি, গাড়ি ব্যতিত বাবার স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পদের মালিক হিসেবে নীরার নাম দলিলে উল্লেখ্য ।বুঝতে অসুবিধা হয় না নীরা জোড় করে সবটা লিখিয়ে নিয়েছে।আমার বরাবরই টাকা পয়সা,সহায় সম্পদের প্রতি কোন লোভ ছিলো না।তাই কোন প্রকার দাবি ব্যতিতই সবটা ছেড়ে দিয়েছি নীরাকে।তাতেও যদি সে খুশি থাকে।”

থেমে যায় শান।দীর্ঘশ্বাস গুলো বুকের কাছে জমা হয় দলবেঁধে।সেগুলোকে মুক্ত করে দিয়ে শান্তস্বরে শান বলে,”এই তো ! আর কি!এই আমার জীবন।এবার বলো পাখি এই নোংড়া অতীত আর আমার অক্ষমতা নিয়ে কী করে আমার জীবনে তোমায় জড়াই বলো?”
স্বগতোক্তি করে শান বলে, “আমি কোনদিনও তোমায় মা হওয়ার মতো সুখানুভূতি দান করতে পারব না পাখি ”

এতোক্ষনের জমানো কান্নাগুলো বাঁধ ভেঙ্গে যায় যেন।নিঃশব্দে কেঁদে চলে পাখি।শান দুহাতে চোখ মুছিয়ে বলে,”জীবন নাটকের থেকেও নাটকীয় জান আমার।”
শানের কথা শেষ হতেই গলা জড়িয়ে কেঁদে ফেলে পাখি।
“আমি নীরা না”,কান্নাজড়ানো কন্ঠে বলে ।
দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শান বলে,”জানি তো”
“আমাদের ইনায়াহ্ আছে ডাক্তার সাহেব।”
শান চোখ বন্ধ করে দুফোটা অশ্র বিষর্জন করে বলে,”আমায় ছেড়ে যেও না কখনো। সব বিচ্ছেদ মানতে পারলেও তোমার টা পারব না”

চলবে……