#আসক্তি২
পর্বঃ৩৬
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম
ইদানিং শানকে বিছানা ছাড়াতে বেশ বেগ পেতে হয় পাখির।মোটামোটি অলসই বলা চলে।শানকে টেনেটুনে তুলে পাখি ফ্রেশ হতে চলে যায়।ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে শান কোলবালিশ জড়িয়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়েছে।আবারো ডাকতে গিয়ে থেমে যায় পাখি।ধীরপায়ে এগিয়ে আসে। পাশে বসে ডান হাতে কপালে নেমে আসা অবাধ্য চুলগুলো তুলে ধরে।চশমা ছাড়া কেমন যেন অন্যরকম লাগে শানকে।মুচকি হেসে কপালে চুমু দিয়ে উঠে আসে পাখি।দ্রুত নেমে আসে নিচে।কারণ শান একবার উঠে গেলে কিছু না কিছু তার খেতেই হবে।রাহেলার দরজায় ডাকতে গিয়ে মনে পড়ে কাল কি এক দরকারে গ্রামের বাড়ি গেছে সে।ও বাড়ি থাকতে পাখিকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে রাহেলা।
বিরসবদনে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।গরম পানি চুলায় দিয়ে পাখি টুকটাক জিনিসগুলো হাতের কাছে নিয়ে আসে।কফি টা করে নিয়ে ব্রেড গুলো সাজিয়ে নেয়। এরপর কফিটা নিয়ে চলে যায় শানের ঘরে।তখনো শান বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।হালকা করে দু একবার ডাকতেই চোখ খোলে শান।
কফির দিকে ইশারা করে বলে,”ঠান্ডা হলে নতুন করে করে দিতে পারব না।অনেক কাজ আছে”
শান কোন জবাব না নিয়েই ওয়াশরুমে চলে যায়।পাখি ততোক্ষনে নিচে চলে আসে।সকালের নাস্তার সমস্ত বন্দোবস্ত করে নেয় সে।বড় বাবার সংসারে কাজ করতে করতে কাজের গতি স্বভাবতই একটু বেশি বৈকি!
ঘেমে নেয়ে একাকার হয় পাখি।ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় গা এলিয়ে দিতেই শান বলে ওঠে,”গোসল টা সেড়ে নাও।ঘাম গুলা শুকালে ঠান্ডা লাগবে নয়ত”
ব্রেডের কোনাটা মুখে নিয়ে বলে,”একা একা আমার খেতে ভালো লাগছে না। কেউ যদি কোম্পানী দিতো তাহলে পুরোটা খেতে পারতাম”
পাখি মুচকি হেসে শানের পাশের দাঁড়ায়। গাল টেনে দেয় শানের।হা হয়ে গালে হাত দেয় শান।
“তুমি, তুমি আমার গাল টানলে?”
“তো”
“আমি তোমার থেকে আট বছরের বড় পাখি।আর তুমি আমায়…..”,বলতে বলতেই শান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।পাখি শানের গাতিবিধি বুঝতে পেরে এক দৌঁড়ে সিঁড়িতে উঠে যায়।শান কোমড়ে দু হাত দিয়ে উপরে পাখির দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে।
“নামো আরেকবার, দেখো কি করি ”
“কিচ্ছু করতে পারবেন না”,বলেই বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরে পাখি।
শান বসে বসে ফোন স্ক্রল করছে।অপেক্ষা,পাখির আগমনের।কিছুক্ষন পর মাথায় তোয়ালে পেচিয়ে পাখি নিচে নেমে আসে।এরপর দুজনের খুঁনসুটির মধ্য দিয়ে সকালের নাস্তা সেড়ে নেয়।
শানের ফোনে কল আসায় রিসিভ করে কানে ধরে।
“হ্যা রাহাত, কিছু পেলে?”
……
ওপাড়ের ব্যক্তি কি বলছে কিছুই বুঝতে পারছে না পাখি।তবে শানের মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে।
“ওকে তুমি ডকুমেন্ট গুলো আমায় ইমেইল করো। ওকে থ্যাংকস ভাই।খুব বড় উপকার হলো”
বলেই থমথমে মুখে ফোনটা কেটে দেয় শান।পাশ থেকে শানের কাঁধে হাত রেখে পাখি প্রশ্ন করে, “কি হয়েছে?এতো টেন্সড লাগছে যে!”
পাখির কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই শানের ফোনের আলো জ্বলে ওঠে।তড়িঘড়ি করে শান ফোন স্কল করে।চক্ষু যেন চড়কগাছ তার।
ফোন এগিয়ে পাখিকে দেখায়।পাখি আতকে ওঠে।
“এতো জঘন্য!”
🌸🌸
হসপিটাল যাওয়ার সময় হয়েছে শানের।পাখি হাতে হাতে এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে।পাখির মাঝে তাড়াহুড়ো দেখে শান শব্দ করে হেসে ওঠে।অবাক হয়ে শানের দিকে তাকায় পাখি।
“হাসছেন কেন?”,প্রশ্ন করেই ফ্যালফ্যাল করে শানের দিকে চেয়ে থাকে।
শান পাখির ডান হাত টেনে সামনে সোজা করে দাঁড় করায়।
“এদিকে আসো”
“কী?”
“আমি হসপিটাল যাচ্ছি, তুমি না”
“হ্যা, তো?”
“এতো তাড়াহুড়োর কিছু নেই।একটু আকটু দেরি হলে ওখানে আমায় কেউ মেরে ফেলবে না”
বলেই স্বশব্দে হেসে ওঠে শান।মুখটা পাংশুটে করে পাখি জবাব দেয়,”ওকে গেলাম তবে।ভালো মতো হেল্প করছি গায়ে লাগছে না”
“শোন না”,কন্ঠের স্বর খাঁদে নামিয়ে বলে শান।
পাখি কিছু না বলে বুকের কাছে দুহাত গুঁজে দাঁড়ায়।
“কথা হচ্ছে,আমি যাচ্ছি।আম্মা ফোন করেছিলো। ও বাড়ির সবাই নাকি রাহেলা চাচির বাড়ি গেছে।তার মা মারা গেছে সেখানে।তো তুমি সাবধানে বাড়িতে থাকবা।ফোন সারাক্ষন কাছে কাছে রাখবা।আমি কিন্তু ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন করব।আর কোন সমস্যা মনে হলে আমায় কল করবে।”,বলেই পাখির দিকে এগিয়ে আসে শান।কপালে চুমু এঁকে দেয়।
পাখি সরুচোখে চেয়ে বলে,”আর কিছু নাই?”
“আরো তো অনেক কিছুর ইচ্ছে হচ্ছে। বাট তোলা থাক ”
“অসভ্য লোক”,বলে চলে আসে পাখি।
“আর শোন তো,আমি সন্ধ্যার পরপরই বাড়ি ফিরব।আজ আমরা রাতে ঘুরতে বের হবো”
খুশি হয় পাখি।
গলা জড়িয়ে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে,”সত্যি!”
“একদম”
🌸🌸
“লাখ লাখ টাকার সম্পদ, আপনি বুঝতে পারছেন?”
“সরি,রায়ান ভাই যেহেতু ওয়ারিশ এখনো জীবিত আর সব সম্পত্তি তার নামেই লিখিত সেহেতু আমি কেন কোন উকিলই কিচ্ছু করতে পারবে না।আপনি বরং খোঁজ নিয়ে দেখুন আমার কথা বিশ্বাস না হলে”,ব্যর্থ কন্ঠে জবাব জানায় মাহমুদ।
মাহমুদের কথায় রাগে ক্ষোভে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে রায়ানের।পারে তো উক্ত স্থানেই গেড়ে দেয় তাকে।মুষ্ঠিবদ্ধ হাত টা টেবিলে জোড়ে আঘাত করে। ডান পায়ে লাত্থি দিয়ে সামনের ফাঁকা চেয়ার টা গুড়িয়ে দেয়।রেগে উকিলের দিকে ঝুঁকে বলে, “শর্টকাট ওয়ে বলুন মিঞা।এতো পেচা পেচির সময় নাই।”
“আহহ্ রায়ান শান্ত হ”
এতোক্ষন বৈঠকে বসে পুরো বৈঠক মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো আয়ান।একই জঠরের হলেও দুই ভাই দুই প্রকৃতির।এ যেন উত্তরমেরু আর দক্ষিণমেরু। কারোর সাথে কারোর স্বভাবের মিল নেই তবে উদ্দেশ্য একই।
রায়ান উগ্র প্রকৃতির। যেকোন কাজ তার তৎক্ষনাৎ হওয়া চাই।ধৈর্যশক্তি শূন্যের কোঠায় বলা চলে।চট করে উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে কার্য হাসিল করতে পছন্দ করে।
অন্যদিকে আয়ান ধীরস্থীর, শান্ত স্বভাবের।সে নিজের বুদ্ধি বিবেক খাটিয়ে কাজ করতে পছন্দ করে।উপস্থিত বুদ্ধির সিদ্ধান্ত বেশির ভাগ সময় ভুল প্রমাণিত হয় কিনা!
রায়ানকে শান্ত হতে বলে উঠে গিয়ে রায়ানের পিঠ চাপড়ায়।
“ভাই আমার, বড় হইলি তবুও মাথা খাটাতে শিখলি না।রিল্যাক্স ব্রো”
বলেই উকিলকে উদ্দেশ্য করে মুচকি হেসে বলে,”আপনি এখন আসুন।পরে প্রয়োজন পরলে আমরা ডেকে নিবো। কেমন!”
আয়ানের ব্যবহার মাহমুদের বরাবরই খুব ভালো লাগে।ফিরতি একটা হাসি উপহার দিয়ে হাত এগিয়ে দেয় মুসাফাহ্’র উদ্দেশ্য।আয়ান হেসে হাত বাড়িয়ে দেয়।এরপর মাহমুদের চলে যাওয়া নিশ্চিত হতেই আয়ান আবার এসে রায়ানের পাশে বসে।
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে রায়ান বলে,”এটা কোন কথা ভাই।এতোদিন জেনে আসলাম কাকা জ্যাঠাদের ছেলে না থাকলে সম্পত্তির বেশীরভাগ অংশ ভাতিজারা পায়।আর আমরা? আমরা কি এভাবেই বসে বসে আঙ্গুল চুষব?”
“সবই ঠিক আছে। কিন্তু চাচাজান তো মেয়ের নামে সব দিয়েছে।এ ক্ষেত্রে ওয়ারিশ একমাত্র সেই’ই।ডোন্ট ওরি….একটা না একটা কিছু মাথায় অবশ্যই আসবে।রিল্যাক্স”,আশ্বস্ত করে বলে আয়ান।ইতোমধ্যে ছক কষা শেষ কিভাবে কি করবে।এখন শুধু এগোনোর পালা।
🌸🌸
বিকেল পরে যায়। শান প্রতিটা ঘন্টায় কয়েকবার করে ফোন করে খোঁজ নিয়েছে পাখির।বলতে গেলে কাজ থেকে একটু ফুসরত পেলেই পাখিকে কল করে। একা একা সেসব ভেবেই হেসে ওঠে পাখি।
বিকেল বেলা হাতে কোন কাজ নেই বললেই চলে।রাতে যেহেতু বাহিরে যাওয়ার পরিকল্পনা সেহেতু রান্নার বন্দোবস্ত আজ আপাতত আর নেই।ফ্রিজ খুলে আইসক্রিমের বক্স টা হাতে নিতেই অমায়িক হাসি ফোটে পাখির মুখে।
সেদিন মদ খেয়ে মাতলামো করেছিলো পাখি।শান অনেকগুলো চকোলেট আর আইসক্রিম এনেছিলো।যদিও সেগুলো খাওয়ার সুযোগ হয় নি।আজ সুযোগ টা কাজে লাগাতে মূহূর্তও দেরি করতে ইচ্ছে করছে না পাখির।দ্রুতই বাটিতে করে নিয়ে বসে পরে টিভির সামনে।চামুচে করে মুখে দিয়েই চোখ বন্ধ করে পাখি।তার পছন্দের খাবারের মাঝে আইসক্রিম সর্বপ্রথম আর তা যদি হয় প্রিয় মানুষের দেয়া তাহলে তো কথাই নেই।
কয়েক চামুচ মুখে দিতেই শান আবার কল করে। তবে এবার ভিডিও কল।ভ্রুকুচকে ফোনের দিকে তাকায় পাখি।শানের ছবিটা জ্বলজ্বল করছে।আইসক্রিমের বাটিটা বাম হাতে নিয়ে কল রিসিভ করে পাখি।কেমন যেন লজ্জা লাগছে।শান রিসিভ করে ফোনটা সামনে রেখে দেয়।পেশেন্টের সাথে কথা বলছে। এক ফাঁকে পাখির দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে প্রেসক্রিপশন লিখছে।পাখিও চুপচাপ খাচ্ছে আর দেখছে সেসব।
প্রেসক্রিপশন টা পেশেন্টের হাতে ধরিয়ে দেয়।এরপর নেমে আসা চমশমাটা আঙ্গুলে ঠেলে উপরে উঠিয়ে বলে,”কি খাচ্ছো তুমি?”
“এই যে আইসক্রিম”,বাটিটা উচিয়ে জবাব দেয় পাখি।
শান এবার দুইহাত টেবিলে রেখে পাখির দিকে সরুচোখে তাকিয়ে বলে,”সকাল সকাল গোসল করছো তার জন্যে তোমার সর্দি সর্দি ভাব বুঝতে পেরেছি এখন আবার এই বিকেল বেলা আইসক্রিম খাচ্ছো।ঠান্ডা লেগে গেলে?”
“আপনি আছেন কি করতে?”,আইসক্রিম টা মুখে দিতে দিতে বলে পাখি।
“আবাদি ডক্টর, তাই না!”
“হ্যা, তাই তো”
“মারব টেনে এক চর।রাখো বলছি”,কপোট রাগ দেখিয়ে বলে শান।
ঠোঁট উল্টিয়ে পাখি বাটিটা পাশে রেখে দেয়।এরপর অভিমান করে ফোনটা খট করে কেটে দেয়।
কয়েক মূহূর্ত পর আবার কল করে শান।কেটে দেয় পাখি।এভাবে তৃতীয় বারের বেলা পাখি ফোনের দিকে চেয়ে থাকে।আনমনে বলে,”এবার দিলে রিসিভ করব”
কিন্তু বিঁধিবাম, কল আসে ঠিক কিন্তু সম্পূর্ণ কল আসার আগেই কেটে দেয় শান।কারণ ফোনের ওপাশে শান আবার পেশেন্টদের ভীড়ে হারিয়ে যায়।
পাখি কাঁদো কাঁদো মুখ করে বাড়ির লাইট গুলো একে একে জ্বালিয়ে দেয়।তখন ইতোমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
হঠাৎ ঘনকালো মেঘে ছেঁয়ে যায় আকাশ।ধীরেধীরে আকাশ গুড়ুম গুড়ুম করে ওঠে।বোঝাই যাচ্ছে আকাশের শামিয়ানা ভেঙ্গে আজ বৃষ্টিরা দলবেঁধে নেমে পড়বে ধরনীতে।
খুব একটা ভীতু মেয়ে নয় পাখি।তবুও থেকে থেকে কেমন যেন গা শিউড়ে উঠছে।শানকে একবার কল করে কিন্তু কল উঠায় নি শান।মনে মনে নিজেকে বোঝায়, “হয়ত ব্যস্ত”
বাতাসের বেগ বেড়ে যায় দ্বিগুন।উপরতলা থেকে কিসের যেন ধপাস করে শব্দ হলো।চমকে ওঠে পাখি।মাথা তুলে উপরের দিকে তাকায়।কলিজা যেন শুকিয়ে আসে তার।এদিকে একটু একটু বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেছে।পাখি সব জানালা গুলো বন্ধ করে দিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে সদর দরজার দিকে চেয়ে আছে।কখন শান আসবে।
কিছুক্ষন পর বাতাস টা আরেকটু বেগে ছোটে।আবারও শব্দ হয়।মূহূর্তেই ইলেক্ট্রিসিটি চলে যায়।সোফার কভার খামচে ধরে পাখি।কেমন যেন ভয়ানক লাগছে সবটা;ভুতুড়ে ভুতুড়ে।হাতরিয়ে ফোনটা খুঁজে ফ্লাশ জ্বালিয়ে পা উচিয়ে দু হাঁটু জড়িয়ে বসে থাকে পাখি।নজর সদর দরজার দিকে।এবার শব্দটা ভীষণ জোড়েই শোনা যায় সাথে বাজ পড়ার বিকট শব্দ।দুহাতে কান চেপে ধরে পাখি।
পরিবেশ কিছুটা শান্ত হলে ফোনটা হাতে শক্ত করে চেপে উপরে দিকে যাওয়ার জন্যে মনঃস্থির করে সে।সিঁড়িতে পা রাখতেই কেমন যেন কলিজা কেঁপে ওঠে।তবুও ভয়ে ভয়ে সবগুলো সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে উঠে সব ঘরের জানালা দরজায় নজর বুলিয়ে নেয়।
“সবই তো বন্ধ। তাহলে……!”
ঠোঁটের ডগায় বিড়বিড় করতেই মনে পড়ে পাখির,”আজ বিকেলে কাপড় উঠিয়ে নেয়ার সময় তো ছাদের দরজা লাগাই নি”
খুব দ্রুত পা চালিয়ে চলে যায় ছাদের দরজার কাছে।দরজা খোলা, আর সেটাই বাতাসের বেগে ধাক্কা লেগে শব্দ হচ্ছিলো।নিজের মাথায় নিজেই গাট্টা মেরে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দেয় পাখি।মূহূর্তেই সব ভয় যেন কেটে যায় মন থেকে।
এবার নিচ থেকে ঝনঝন শব্দ হতেই আবারও কেঁপে ওঠে পাখি।শানের আগমন মনে করে নিচে সিঁড়ি বেয়ে নামতেই দেখে ফোনের ফ্লাশ জ্বালানো কাউকে।ফ্লাশ টা এদিক সেদিক নড়ছে।পাখি প্রথমে ভেবেছিলো শান। কিন্তু পরোক্ষনে মনে হয়,”তিনি হলে তো এভাবে ফ্লাশ এদিক সেদিক করবে না!আমায় ডাকছেও না কেন?”
ভাবতেই গলা শুকিয়ে আসে পাখির।মনে সাহস যুগিয়ে তড়িৎগতিতে নেচে নেমে আসে ।
“কে, কে ওখানে”,কাঁপা কাঁপা কন্ঠে প্রশ্ন করে পাখি।ফ্লাশ লাইট সমেত আগন্তুক লোকটি দাঁড়িয়ে পরে। কাঁধ থেকে যেন বড় একটা ব্যাগ মেঝেতে সরাত করে পরে যায়।হার্ট বিট বেড়ে যায় পাখির।
“ব্যাগ সমেত কে হতে পারে”,নিজমনে আওরিয়ে আবার প্রশ্ন করে সে।
“কি হলো কথা কেন বলছেন না?”
“তুমি কে?”
গা হিম হয়ে আসে এবার। বাহিরে বৃষ্টির বেগ আবারও বেড়ে গেছে।সাঁইসাঁই করে বৃষ্টি পড়ছে বিরতিহীন ভাবে।
পুরুষালী গাঢ় মোটা কন্ঠস্বর টা অচেনা।কিছুতেই এটা ইতোপূর্বে কোনদিনও শোনে নি পাখি।তড়িৎগতিতে ডায়ালে শানের নম্বর টা ডায়াল করে।
কাপাকাপা হাতে ফোনটা কানে নিতেই লোকটা আবার বলে ওঠে,”কে তুমি?কি হলো কথা কেন বলছো না?”
“হ্যালো,হ্যালো, হ্যালো পাখি ”
“ববাড়িতে ততাড়াতাড়ি আসুন।কে যেন…… ”
‘”হেই তুমি কাকে ফোন করছো?আর কে তুমি?কথা কেন বলছো না?”
পাখির কথা শেষ না হতেই বলে ওঠে আগন্তুক লোকটা।পাখি খট করে ফোন কেটে দেয়।ফোনের ফ্লাশ সামনে এগিয়ে মানুষটাকে দেখতে চায় পাখি।কন্ঠে দৃঢ়তা এনে বলে,”একদম এগোবেন না বলে দিচ্ছি।”
বলতে বলতে ডায়নিং এর কাছে চলে আসে পাখি।
ছুড়িটা হাতে নিয়ে বল,”কাছে আসলে এটা ছুড়ে মারব। খুন হয়ে যাবেন একদম। বের হোন, বের হোন বাড়ির থেকে।বের হোন বলছি”
“আরে আজিব তো।কে তুমি? আর ছুড়ি রাখো বলছি, রাখো”,কপোট রাগ দেখিয়ে বলে লোকটা।
পাখি ভয়ে কেঁদে ফেলে নিঃশব্দে।তবুও নিজের সাহসীকতা বজায় রেখে পাখি বলে, “আমি কে মানে?আমি এ বাড়ির বউ”
“বউ!”,বিড়বিড় করে বলে লোকটা।যেটা পাখির কানে এসে পৌঁছায়।
ছুড়িটা শক্ত করে ধরে বলে,”হ্যা বউ। এবার বের হোন বলছি।একা একটা বাড়িতে কি করে ঢুকলেন আপনি? দারোয়ান কিভাবে ঢুকতে দিলো আপনাকে?আজ আসুক উনি বাড়িতে”
শেষের কথাগুলো ক্ষীনস্বরে বলে পাখি।
আগন্তুক লোকটা এগিয়ে আসতেই পাখি কোন কথা ছাড়াই হুট করে একটা কাজ করে বসে। ছুড়িটা ছুড়ে মারে অন্ধকারে লোকটাকে উদ্দেশ্য করে।
“আউচচচ”,চাপা আর্তনাদ হতেই লোকটার হাতের ফোনটা মেঝেতে পরে যায় স্বশব্দে।বিদ্যুৎ চলে আসে তখনি।নিজের সামনে এমন সুদর্শন একজন পুরুষকে দেখে অবাক হয়ে যায় পাখি।ডান হাতের দিকে খেয়াল পরতেই দেখে সাদা টি-শার্টের হাতাটা রক্তে লাল হয়ে গেছে।
লোকটা পাখির দিকে চেয়ে চোখ মুখ কুচকে মাথা নিচু করে আর্তনাদ করে। মূহূর্তেই পাখির খেয়াল হতেই চেঁচিয়ে বলে,”বলেছিলাম না আগাবেন না”
লোকটা উঠে দাঁড়াতেই পাখি ভয়ে দুই পা পিছিয়ে যায়।আর তখনই হন্তদন্ত হয়ে দরজায় পা রাখে শান।অবাক হয়ে পাখির দিকে তাকাতেই দেহে প্রাণ ফিরে পায় যেন।হাতের বাঁ পাশে দেখে কেউ একজন ডান হাতের বাহু চেপে কুঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে।পাখি লোকটাকে একবার দেখে নিয়ে সুযোগ বুঝে দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে শানকে।বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলে।এতোক্ষনের চাপা ভয়, কান্না এবার আর বাঁধ মানছে না যেন।
লোকটা পাখির দৌঁড়ানিতে অবাক হয়ে সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।শান পাখির মাথায় হাত দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে।জড়িয়ে রেখে মাথা তুলে তাকায়…
চলবে…….
#আসক্তি২
পর্বঃ৩৭
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম
পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে চোখ গরম করে আগন্তুক লোকটির দিকে তাকাতেই থমকে যায় শান।আপনাআপনি মুখ হা হয়ে আসে।বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু। ডান বাহুতে নজর ফেলে চোখ মুখ কুচকে নেয় শান।হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
“রনি!”,অবাক বিষ্ময়ে প্রশ্ন করে শান।কান্না থামিয়ে থতমত খেয়ে যায় পাখি।পিটপিট করে শানের আড়াল থেকে মানুষটাকে দেখার চেষ্টা করে।
“ভাইয়া কিছু একটা করো, খুব জ্বলছে”,ব্যথায় দাঁতে দাঁত পিষে বলে রনি।শান তড়িঘড়ি করে পাখিকে সরিয়ে ছুটে যায় রনির কাছে।
আনমনে বিড়বিড় করে পাখি,”তারমানে ইনি রনি!”
শান টি-শার্টের হাত উচিয়ে দেখে চামড়া থেকে অনেকটাই ছিলে গেছে।মনে মনে আল্লাহ্’কে ধন্যবাদ দেয় শান;বেশি কিছু হয় নি ভেবে।
রনি একবার পাখির দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে আগা-গোড়া দেখে নিয়ে হাত টা চেপে ধরে।
পাখি অপরাধীর ন্যায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে শুধু।হঠাৎ শানের ডাকে সম্বিৎ ফেরে।
“পাখি, দ্রুত ফার্স্টএইড বক্সটা নিয়ে আসো কুইক”
পাখি রনির দিকে একবার দেখে নিয়ে উপর ঘরে চলে যায় ফার্স্টএইড বক্স আনতে।
“তুই এভাবে?এই সময়?আমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে না রনি”,হরবরিয়ে একসাথে কতোগুলো প্রশ্ন করে শান।
“আগে কিছু একটা করো ভাইয়া খুব জ্বলছে আমার।সবটা পরে বলছি “,অনুনয়ের স্বরে বলে রনি।
ইতোমধ্যে পাখি চলে আসে হাতে বক্সটা সমেত।এগিয়ে দেয় শানের দিকে।শান হাত বাড়িয়ে সেটা নিতেই পাখির মলিন মুখটার দিকে একবার তাকায়।পাখি অপরাধীর মতো নজর সরিয়ে নেয়।
“দেখি, হাত দে।”,বলেই রনির হাত টা টেনে নেয় শান।স্বগতোক্তি করে বলে,”তোর তো পুরো শরীর ভেজা কিভাবে কি করব আমি! ”
শানের কথা শেষ হতেই রনি উপরের টি-শার্ট খুলতে উদ্যত হয়।পাখি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
“পাখি একটা শুকনা তোয়ালে নিয়ে আসো”
শানের একেকটা কথায় অবাক হয় রনি।হাজার প্রশ্ন এসে মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে।কিন্তু কিছু করার নেই।আগে নিজেকে কোনমতে এই যন্ত্রনা থেকে উদ্ধার করতে হবে তারপর সমস্ত প্রশ্ন।
পাখি একটা শুকনা তোয়ালে এগিয়ে দিতেই বাঁ হাতে সেটা একপ্রকার টেনে নেয় রনি।পুরো গা কোনমতে মুছে হাতটা এগিয়ে বলে,”তাড়াতাড়ি ভাইয়া”
কিছুক্ষনের মাঝে শান ক্ষত হওয়া জায়গাটা পরিষ্কার করে মেডিসিন লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেয়।
“এবার বল, সুদূর আমেরিকা থেকে আমায় কিছু না জানিয়ে এভাবে আসার কারণ কি?”,থমথমে মুখে প্রশ্ন করে শান।
ব্যথায় টনটন করা হাতটা সোফার হাতলে রেখে রনি শানের দিকে চেয়ে থাকে।পিছনে দাঁড়ানো পাখিকে দেখে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,”আগে এটা বলো, এই ডাকাত মেয়েটা কে?”
“রনি”,কপোট রাগ দেখায় শান।
“তুমি জানো না ভাইয়া, এই মেয়ে কতোটা সিরিয়াস।ভাবা যায়!”
“আমি তো দেখছি পুরো দোষ তোর”
হা হয়ে রনি শানের দিকে তাকায়।
“আমার দোষ মানে!আমি কি করলাম?আর ঐ মেয়েটা কে যে এভাবে বলছো “,কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে রনি।
“এভাবে না জানিয়ে আসাটা উচিত হয় নি।ছুড়িটা যদি ঠিক ভাবে লাগতো বুঝতে পারছিস কি অবস্থা হতো?আর ওর এমন আচরন স্বাভাবিক নয় কি?”
“তুমি আমার পুরো কথা না শুনেই বললে সবটা আমার দোষ?”
“আপাতদৃষ্টিতে তাই তো মনে হচ্ছে।আচ্ছা বল শুনি”
“আমি আসলাম তোমায় সারপ্রাইজ দিবো বলে।জানি এই সময় তুমি বাড়িতেই থাকো।এক্সামের কারণে গত মাস থেকে তোমার সাথে ভালো করে কথা হয় না, দেখাও হয় না।তাই এভাবে আসা।এয়ারপোর্ট থেকে সোজা এখানে।আকাশ খারাপ ছিলো কিন্তু গেইটে পা রাখতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। পরে দারোয়ানের ওখানে অপেক্ষা করি।ওখান থেকে দেখি পুরো বাড়ি অন্ধকার।বৃষ্টি একটু থামলে বাড়িতে ঢুকি।দরজা এমনি ভেড়ানো ছিলো।তখন ও সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছিলো ফোনের ফ্লাশ জ্বালিয়ে ।আমার সাথে তর্কাতর্কি করে হঠাৎ অন্ধকারে ছুড়িটা ছোড়ে।আহহহ ভাইয়া হাত গেলো”,বলে ব্যথায় ককিয়ে ওঠে রনি
শান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা ঘুরিয়ে পিছনে দাঁড়ানো পাখির দিকে দেখে নেয়।ঠোঁট উল্টে দাঁড়িয়ে আছে সে।
“আরো কি বলে জানো?ও নাকি এ বাড়ির বউ”,পূনরায় বলে রনি।
“হুম ভুল তো কিছু বলে নি”
“আর ইউ কিডিং ব্রো?বউ আর তোমার?হ্যাহহহ”,শানের কথাকে উড়িয়ে দেয় রনি।
“ও হচ্ছে পাখি। আমার ওয়াইফ”
“ভাইয়া মজা করো না তো।এখন ভালো লাগছে না মজা ।তুমি বিয়ে করবে এটা বিশ্বাস করতে পারব না আমি”,চাপা রাগ করে বলে রনি।
শান হাসতে হাসতে জবাব দেয়,”হুমম এটাই ফ্যাক্ট”
বলে উঠে গিয়ে পাখির সামনে দাঁড়ায়।চোখের কোণে চিকচিক করা জলের কণাটা মুছিয়ে দেয়।মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”তোমায় বলেছিলাম না রনির কথা?কাকার ছেলে?”
মাথা উপর নিচ করে রনির দিকে চেয়ে হ্যা বোধক উত্তর জানায় পাখি।
“এই সেই রনি।কি হতো বলোতো ছুড়িটা যদি হাত ছুঁয়ে পাশ কেটে চলে না যেত?”
পাখি মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে,”আমি বুঝতে পারি নি,সরি।খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম”
বলতে বলতে ঠোঁট কাপিয়ে কেঁদে ফেলে পাখি।শান আলতো হাতে মাথাটা বুকের সাথে ধরে।
রনি দ্রুত উঠে শানের হাত টা টেনে এপাশে করে বলে,”লাইক সিরিয়াসলি! তুমি সত্যিই বিয়ে করেছো?”
“তো বলছি কি এতোক্ষন ধরে!”
অবাকের চরম সীমায় অবস্থান করছে রনির মগজ।ভাবতেও পারছে না শান বিয়ে করবে।এটাই তো স্বাভাবিক।
“যা ফ্রেশ হয়ে নে।সবটা বলছি “,বলে রনিকে তাড়া দেয় শান।রনির কাঁধের ব্যাগটা মেঝে থেকে উঠিয়ে ওকে রুমে নিয়ে যায়।
পাখি এতোক্ষনে হাফ ছেড়ে বাঁচে।বুক হাত দিয়ে বিট বোঝার চেষ্টা করে।নিজের প্রতি নিজেরই কেমন যেন খারাপ লাগা কাজ করছে।নিজের করা ভুলের জন্যে বুক কেঁপে ওঠে পাখির।
“একটুর জন্যে কি হয়ে যেত”
🌸🌸
পাখি তড়িঘড়ি করে রাতের রান্নাটা সেড়ে নেয়।ফ্রিজ থেকে বাকি তরকারিগুলো গরম করে ডায়নিং এ সাজায়।ততোক্ষনে শান রনিকে সহ নিচে নেমে আসে।
ডায়নিং এর চেয়ার টেনে বসতে বসতে শান বলে,”এবার সত্যি করে বল হঠাৎ কেন আসলি?”
“কি বলছো ভাইয়া? দেশে আসব তার কারণ লাগে?”,অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলে রনি।
“আমায় নিজেকে চেনাতে আসিস না।তুই যে কারণ ছাড়া আসিস নি তা আমি জানি।এবার সত্যি সত্যি বল”
“আসলে ভাইয়া, একজনের সাথে মিট করতেই আরকি……”,মিনমিন করে বলে রনি পাখির দিকে তাকায়।
লজ্জাবোধ আর সংকোচে চোখ নিচু করে নেয় পাখি।শানের চেয়ারের কোনা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।
“এক সেকেন্ড….তোমায় কোথাও দেখেছি আমি”,পাখিকে উদ্দেশ্য করে বলে রনি।
পাখি বিব্রত হয়ে কন্ঠের স্বর খাঁদে ফেলে বলে,”আমাকে?”
“হুমম হুমম তোমাকে”
ভ্রুকুচকে শান একবার রনির দিকে আরেকবার পাখির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, “ওকে কোথায় দেখবি তুই?”
“দেখেছি তো অবশ্যই ভাইয়া। তবে মনে করতে পারছি না”,ভাবুকের মতো বলে রনি।
“হইছে আর ভাবতে হবে না। খা….তা বললি না কার সাথে মিট করতে দেশে আসলি?”,খাবারের লোকমা টা মুখে দিতে দিতে বলে শান।
রনি নজর এদিক সেদিক করে বলে,”ততেমন কেউ না। এই আরকি ফেসবুক ফ্রেন্ড”
শান মুচকি মুচকি হেসে বলে,”শেষমেশ ফেসবুক ফ্রেন্ডের টানে দেশে আসলি তবে”
থতমত খেয়ে রনি চুপ করে ভাত গুলো নাড়াচাড়া করে।
শান ওদিকে একবার তাকিয়ে বলে,”গার্লফ্রেন্ড ইস্যু”
“তেমনটাই….বাদ দাও না এসব।বলো আগে এই মিরাকল ঘটলো কি করে?আই মিন বিয়ে তাও এই ডাকাত….”
বলতে বলতে শানের দিকে তাকাতেই থেমে যায় রনি।এরপর শুরু থেকে শেষ অবধি সবটা রনিকে বলে শান।শুনে হেচকি ওঠে রনির। পাখি পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। পানিটা খেয়ে নিজেতে ফিরে আসে রনি।
🌸🌸
সকাল বেলা পাখির কাছে হন্তদন্ত হয়ে ছুট আসে রাখি।তখন রান্নাঘরে ব্যস্ত সময় পার করছে পাখি।রাখিকে হাফাতে দেখে বলে,”কি রে এভাবে হাফাচ্ছিস কিসের জন্যে।”
বলে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এগিয়ে দেয়।রাখি পানিটা খেয়ে পাখিকে ড্রয়িংরুম টেনে আনে।
“কি হইছে কি, বলবি তো?”
“আরে ঐ আমেরিকা প্রবাসী ছেলেটা বলেছিলাম না তোরে?”
“হ্যা, মনে আছে। কি যেন নাম বলেছিলি ইবনে ইবনে ”
“আরে ইবনে জুহায়ের। ওর সাথে গত একমাস থেকে শুধু ঝগড়া লাগে।সময় দেয় না। আমারও ভালো লাগছিলো না ওতো ঝগড়া ঝাটি পরে ব্রেক আপ করি।কাল রাতে বিডি সিম থেকে মেসেজ করে বলছে সে নাকি দেশে এসেছে আর আমায় বিয়ে করে তবেই ফিরবে।কি করি, কি করি আমার মাথায় কুলাচ্ছে না”
“তবে সমস্যা কি? আমি যতোদূর জানি তুইও তো ভালোবাসিস। তাহলে?”
“মা বিদেশে থাকা পছন্দ করেন না।ওর কথা মাকে বলাতে ডিরেক্ট না করেছে।আমি কি করব রে কোন উপায় দে…..”
“তুমি?এখানে?”
রাখির কথা শেষ হতেই উপর থেকে রনি চিল্লিয়ে ওঠে।পাখি রাখি দুজনেই মাথা তুলে তাকায়।রাখি হতভম্ব হয়ে বলে,”তুমি এখানে কেন?”
রনি কিছু না বলে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নেমে আসে।পাখির মাথায় কিছুই ঢুকছে না এখন।ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।
রনি নেমে এসে রাখির সামনে দাঁড়ায়। দাঁত কিড়মিড় করে বলে,”তুমি এখানে কেন? যাক এসে পড়েছ ভালোই হইছে।।আমায় আর কষ্ট করে খুঁজতে হলো না!….এবার বলো তোমার এই সব নাটকের কারণ কি?”
রাখি পিটপিট করে চোখ তুলে তাকায় রনির দিকে।ভাবতেও পারছে না তাদের প্রথম দেখাটা এভাবে হয়ে যাবে।
“কি হলো, আন্সার মি”,রেগে গিয়ে বলে রনি।
পাখি এতোক্ষন চুপ থেকে সবটা বোঝার চেষ্টা করে। এরপর রাখির হাত চেপে বলে,”ও আমার ফ্রেন্ড হয়।আপনি ওকে চেনেন?”
রাখির দিকে তাকিয়ে বলে,”রাখি তুই ওকে চিনিস?
“এইটা রনি “,রিনরিনে কন্ঠে বলে রাখি।
“হ্যা তা তো জানি ”
“এই সেই ইবনে জুহায়ের রনি”
অবাক হয়ে চেয়ে থাকে পাখি।
রনি কিছু বলতে যাবে তার আগেই শান বলে ওঠে,”এতো চিৎকার কিসের? ”
সবাই উপরের দিকে তাকায়।রনি দুই সিঁড়ি উঠে বলে,”ভাইয়া এই সেই মেয়ে। যার জন্যে দেশে আসা”
কটমটে চোখে পাখির দিকে তাকিয়ে বলে,”আর যার জন্যে তোমার ডাকাত বউয়ের ছুড়ির আঘাত সহ্য করা”
রনির কথায় চমকে যায় রাখি।হন্তদন্ত হয়ে বলে,”কিসের ছুড়ির আঘাত দেখি তো”
রনি হাতাটা উচিয়ে অসহায়ের মতো ব্যান্ডেজের দিকে ইশারা করে।রাখি হাতটা দেখে ভয়ার্ত গলায় বলে,”এতোখানি ব্যান্ডেজ?কি করে হলো?”
এরপর রনি কাল রাতের সব ঘটনা রাখিকে খুলে বলে।চাপা রাগতস্বরে বলে,”সবটা হইছে তোমার জন্য”
“আমি আসতে বলেছি তোমারে?”,পা উচিয়ে রাগি চোখে বলে রাখি।
“তা বলতে যাবা কেন? তুমি তো নতুন পাইছো না? ”
“বাজে কথা বলবা না একদম।মেরে বালিচাপা দিবো।ফালতু ছেলে”
“তোমরা থামো এবার?কি শুরু করলে দুজনে?”,হেসে দিয়ে বলে শান।
রনিকে প্রশ্ন করে,” এসবের মানে কি?”
“ভাইয়া ওর সাথে গত একবছর ধরে রিলেশনে আছি।গত মাস থেকে এক্সামের চাপে ব্যস্ত ছিলাম সসময় দিতে পারি নি বলে, বলে কিনা ব্রেকআপ!কিন্তু ও তো জানে না ওর কার পাল্লায় পরেছে”,রাখির দিকে রাগিচোখে তাকিয়ে বলে রনি।
“মিথ্যা কথা ভাইয়া।ও নিউ রিলেশনে জড়াইছে।আর সবথেকে বড় কথা খালি ঝগড়া করে আমার সাথে।তার থেকেও বড় কথা মা কিছুতেই মানছে না যে প্রবাসী কারোর সাথে আমার বিয়ের হোক”,মলিন মুখে বলে রাখি।
শান পাখির দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ঘরিয়ে রাখির দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি কি চাও সেটা বলো?এটা নিশ্চই তোমার মা জানে না যে, রনি আমার ছোট ভাই।”
“আমি কিছু জানি না ভাইয়া, মা যা বলবে তাই….”
রাখির কথায় তেড়ে আসে রনি।
“প্রেম করার সময় মনে ছিলো না, মা মানবে কিনা!”,ভেংচি কেটে কটাক্ষ করে বলে রনি।
“আহ রনি, কি বাচ্চাদের মতো করছিস?আমি কথা বলছি তো”
“তুমি কি করো করো, আমার ওকে চাই।চাই তো চাইই ব্যাস।দরকার পরলে,দরকার পরলে উঠায়ে নিয়ে যাবো”
ভরা মজলিশে এমন কথা রাখিকে বিপাকে ফেলে দেয়। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে।মুচকি হাসিতে একনজর তাকায় রনির দিকে।
“আচ্ছা আমি কথা বলছি তোমার মায়ের সাথে”
বলেই শান উপরে উঠে চলে যায়।যাওয়ার আগে পাখিকে একবার রুমে ডেকে যায়।পাখি, রনি আর রাখির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে শানের পিছন পিছন চলে যায় শানের ঘরে।
“ভাবি তোমায় রাখির ফোনে দেখেছি”,সিঁড়ির দিকে চেয়ে গলা উচিয়ে বলে রি।
🌸🌸
“কাগজ টা দেখে নাও ভালো করে, ডকুমেন্ট গুলো কালেক্ট করেছি। আমার মনে হয় যা করার এখনি করা উচিত। কি বলো তুমি?”পাখির দিকে কাগজপাতি এগিয়ে বলে শান।
শানের কথার কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না পাখি।তবুও কাগজ গুলো হাতে নিয়ে একের পর এক উল্টিয়ে দেখা শুরু করে।কিছুক্ষন পর কাগজ গুলো বন্ধ করে কয়েক মূহূর্তের জন্যে চোখের পাতা বন্ধ করে নেয়।চোখ খুলে বলে,”ছিহ একটা মানুষ কতোটা নীচ হতে পারে ভাবা যায় না।আমি এসবের কি বুঝব বলেন?আপনার যা ভালো মনে হবে করবেন”
শান মুচকি হেসে পাখির দু বাহুতে হাত রাখে। টেনে এনে বিছানায় বসিয়ে গালে হাত রেখে বলে,”তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী। মানে বুঝো? মানে তুমি ডক্টর ফয়সাল আহমেদ শানের অর্ধেক অঙ্গ।আমার লাইফের যা কিছু সুন্দর সবই তোমার আগমনে।আর সেই তুমিটাকে ছাড়া কি করে কোন সিদ্ধান্ত নেই বলো তো!”
ছলছলে চোখে পাখি শানের দিকে তাকায়।
“হুমম বলো এবার, কি করব?নাকি আরো কিছুদিন উড়তে দিবো?তবে পাপের সাম্রাজ্য বেশি বড় হতে দিবো না আমি”,বলতে বলতেই চোয়াল শক্ত হয়ে আসে শানের।
“আপনার মন যা বলে তাই করুন।আমি জানি, আপনি বিচক্ষণ। তবে আমি সবসময়ই আপনার পাশে আছি”,শানের হাতটা দুইহাতে ধরে বলে পাখি।
পাখির দুই হাতের উল্টোপিঠে চুমু দিয়ে এগিয়ে যেতেই পাখি পিছিয়ে যায়।
“কি করছেন? ”
“কি করছি মানে?রাতে তো ভয়ে একদম সিধিয়ে ছিলে। বুকের উপর শুয়ে কখন ঘুমাইছো টেরই পাই নি।পরে দেখি ঘুমে বিভোর”
“হ্যা, তো?”
“তো মানে…. বুঝোই তো ”
“উহু একদম না। আপনাকে দেখলে কেউ বলতে পারবে না আপনি এতোটা দুষ্টু আর অসভ্য”
শব্দ করে হেসে শান জবাব দেয়,”বউয়ের কাছে বাপ্পারাজ হয়ে লাভ নাই।হতে হয় ইমরান হাসমি”
“এই না না, একদম না বলছি”,বলতে বলতেই মিলিয়ে যায় পাখির স্বর।
🌸🌸
রাখি থম মেরে তখন থেকে বসে আছে সোফায়।মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হচ্ছে না যেন।রনি কতোবার কতো প্রশ্ন করেছে সে একটারও জবাব দেয় নি।রাখি বেশ ভালোভাবেই বুঝেছে তার মা এ সম্পর্ক কোনভাবেই মেনে নিবে না।আর সে তার মাকে ফেলে কোনভাবেই পালিয়ে যেতে পারবে না।
“এরকম কেন করতেছো রাখি?কেন বোঝার ট্রাই করছো না আই’ম ইন লাভ উইথ ইউ। ড্যাম ইট”,মুখটা থমথমে করে করূনস্বরে বলে রনি।হুট করে রাখির সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে হাতদুটো ধরে নেয়।
“কিছু তো বলো রাখি।দেখো শুধুমাত্র তোমার জন্যে আমি এতোদূরে এতোবছর পর চলে এসেছি ভাইয়ার কাছে।এভাবে রিফিউজ করো না আমায়।আই কান্ট বেবি, আই কান্ট লিভ উইথআউট ইউ।প্লিজ ট্রাই টু ফিল মাই ফিলিংস।ইট’স রিয়েলি হার্ট’স”,বলতে বলতে পাখির হাতদুটোয় নিজের কপাল ঠেকায় রনি।
কাঁপা কাঁপা হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে রাখি বলে,”ভাইয়া যদি মাকে রাজি করাতে পারে……”
“আমি এককালীন দেশে চলে আসব রাখি “,রাখির কথাকে সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই হরবরিয়ে বলে রনি।কেমন যেন মায়াবি একটা মুখ। এতো অনুনয় করছে রাখিকে।রনিকে উঠিয়ে পাশে বসায় রাখি।
স্মিত হেসে বলে,”আমি আবারও মাকে বোঝাব ”
“সত্যি?”
“একদম”
চলবে…….