#প্রেমজাল
পর্ব ১৬
জান্নাতুল মাওয়া মাহিমুন
-“আপনি আসলেই একটা অসহ্যকর পাবলিক” বলে উনার পাশ কাটিয়ে চলে আসতে নিলেই উনি পিছন থেকে আমার ডান হাত খপ করে ধরে ফেললেন। আমি হাতের টানের বাধা পেয়ে পিছন না ফিরেই ঠাই দাঁড়িয়ে রইলাম। আয়ান আমার ডান হাত চেপেই সামনে এগোলেন। পিছন থেকে আমার বাম হাত উনার বাম হাতে আবদ্ধ করে নিলেন। পিছন থেকে ঝাপটে ধরতেই আমার ভ্রু স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংকোচন হয়ে গেলো। আমি উনার বলিষ্ঠ বাহু দ্বয়ের মাঝে আবদ্ধ।
-“যদি সারা জীবন এই অসহ্যকর পাবলিককেই সহ্য করে নিতে হয় তখন?
আয়ানের মোলায়েম কণ্ঠ আমার কর্ণপাত হতেই কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেলাম এক অদ্ভুত রাজ্যে। “সারাজীবন” শব্দটি দমকা হাওয়ায় আমার শিরদাঁড়া বেয়ে এক শীতল শিহরণ প্রবাহিত করে দিলো। হৃদ স্পন্দন অস্বাভাবিক মাত্রায় বাড়ছে। কেও মনস্থির করে শুনতে চাইলে নিশ্চিত প্রতিটি স্পন্দনের দ্রিমদ্রিম শব্দ অনুভব করতে পারতো। যদি এই মোহনীয় সময় স্তব্দ করে রাখতে পারতাম। যদি এই মূহুর্ত আটকিয়ে চিরজীবন নিজের কাছে রেখে দিতে পারতাম। যদি চিৎকার করে বলে উঠতে হ্যা আমি এই অসহ্যকর পাবলিকটাকেই অজান্তে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি। সারাটা জীবন এই কাঙ্খিত মানুষের সাথে অতিবাহিত করতে চাই। কতই না ভালো হতো, তাই না? কিছু বলা আমার সাধ্যের বাইরে। কিন্তু তা আমার বলার থেকেও যে ভাবা অন্যায়। নিতান্তই চরম পাপ!! যার আকাশের বুকের ঝলমল করছে উজ্জ্বল প্রদর্শক অন্য কেও, তাকে আপন করে পাওয়ার ভাবা যে নিজেই নিজের হৃদয়কে চুরমার করে দেউলিয়ার আসনে বসানোর সমান। কেনো আমি পারি না স্বার্থপর হয়ে বলতে আমার শুধু আপনাকেই চাই আয়ান। শুধুই আপনাকে। কেনো বলতে পারি না আপনার জন্য আমার মনের কোণে অনুভূতির মালা গাথা আছে। কেনো পেট পর্যন্ত কুড়মুড় করলেও বলতে গেলে গলায় আটকিয়ে যায়? কেনো আমি আষ্ঠেপৃষ্ঠে জরিয়ে আছি অদৃশ্য হাজারো জালে? আদৌ কি এই জাল থেকে কখনো মুক্তি পাবো? কাওকে কি পাবো না আপন করে আমার সারাজীবন কাটাতে? কেও কি পারবে আমার হৃদয়ের ক্ষত-বিক্ষত শূণ্যস্থানকে ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ করে দিতে?
আকস্মিকভাবে খানিকটা হাতে-পিঠে চাপ পেতেই ভাবনার জগত লাথি মেরে বের করে দিলো। আমি হালকা ডানদিকে ঘাড় ঘুরাতেই ডান কানে উনার উথাল পাথাল উষ্ণ নিশ্বাস আমার দিকে প্রবাহিত হতে লাগলো। আমি উনার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালাম। উনি ফিসফিস করে বলতে লাগলো,
-“সারাজীবন কাটানো যেতো যদি দেখতে এতো ভয়ংকর পেত্নি না লাগতো। একটু রূপসী হলে হয়তো থাকতে পারতাম। এই ভয়ংকর পেত্নির মতো চেহারা দেখে পাগলাগারদে যাওয়ার আমার ইচ্ছা নেই”
দুঃখ-কষ্টে, রাগে-অভিমানে, বিরক্ত-অপমান রীতিমতো কান্না আসছে। যদি এখানে অন্য কেও হতো, তাহলে ঠাডায় গালে দিতাম দুই টা। আমাকে পেত্নি বলার সাধ মিটে যেতো৷ কিন্তু ঘটনার চাক্রিকে যেখানে চোখ তুলে তাকাতেই যাকে ভয় পাই, সেখানে চর মারা নিতান্তই বিলাসিতা। গরম ফুটন্ত তেলে পানি পরলে যেমন ছিত ছিত প্রতিক্রিয়া হয়, তেমনি উনার প্রতিটি কথায় আমার গায়ে ফোসকা পরছে। আমি হাতের বাধন থেকে যতই আলগা করছি ততই চেপে ধরছে। আমি বন্দি দশায় থাকা পাখির ন্যায় ছটফট করতে লাগলাম তার হাতের তৈরি খাচা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। পরিশেষে ধৈর্য্য এর বাধ পেরিয়ে কড়া গলায় বিরক্তি মিশ্রিত মনোভাবে মৌনতা কাটিয়ে বললাম,
-“আপনি শুধু অসহ্যকর নন। অতি মাত্রায় অসহ্যকর একটা। নিজের প্রপার্টি ভাবেন আমাকে? ছাড়েন বলছি!! এখনি”
উনি আমার কথা ভ্রুক্ষেপ করলেন না। একটা গা ছাড়া ছাড়া ভাব। অন্যথায় উনি আমার ডান হাত ছেড়ে দিয়ে, উনার বাম হাত দিয়ে ঘুরিয়ে নিলেন। এখন উনি আমার সম্মুখে অবস্থান করছেন। আমি হাতের হালকা স্পর্শ অনুভব করতেই পালাতে চেয়েও পারলাম না। উনার বাম হাত আমার কোমর আকড়ে আছে। তাতে কি? আমিও দমে যাওয়ার পাত্রী না। আমিও ছোটাছুটি করা চলমান রাখলাম। যত বারই দূরে সরে নিস্তার পাই, ততবারই সামনে এগিয়ে চেপে ধরছে। এমন দাপাদাপিকে পাত্তা না দিয়ে আমার ডান গালে উনার আলতো শীতল স্পর্শ অনুভব করতেই বাধ্য মেয়ের মতো চুপচাপ ধারালাম। উনার হাত আমার গালে ভর করে থুতনি খানিকটা উঁচু করলো। আমি কিছুটা বিব্রতবোধ করলেও উনার চোখ আমার দৃষ্টি স্থির রাখলাম।
-“ভয়ংকর পেত্নির চোখ দুটোর লাজুক চাহনি আমার হৃদয় ক্ষরণ না করলেও চলতো। তার অবাধ্য ঢেউ খেলানো চুলের সুবাস আমার নাকের অভ্যাস না করে দিলেও পারতো। তার মিষ্টি দু’টো গালের খিলখিল করা হাসি আমার মনকে উন্মাদ না করলেও হতো। তার ছোয়া আমাকে স্পর্শ কাতর না করলে চলতো। তার রক্ত জবা ঠোঁট গুলো আমাকে না টানলেই পারে। তার কানের পিছনে গুজে রাখা বেলী ফুল, তাকে মায়াবতী কন্যার মতো রূপে অলংকৃত করে আমার এতো বড় সর্বনাশ না করলেই শ্রেয় হতো। সে শুধুই আমার সর্বগ্রাসীনি। শুধুই আমার! কেনো তাকে দূরে ঠেলে দিবো?” বলে বাম গালে সযত্নে গভীর ভাবে চুমু খেলো আয়ান।
উনি আমার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলেও আমার দৃষ্টি এখনো আগের জায়গায় স্থির। উনার হাতের বন্ধন আলগা হওয়ার অনুভব পেয়েও যেনো পারছি না। সারাশরীরে হিম লেগে গেছে। মাথা আমার ফাপা ফাপা লাগছে। সবকিছুর যেনো শুধু কল্পনাতেই অস্তিত্ব আছে। কোনো দমকা হাওয়ায় সব হয়তো বিলীন হয়ে যাবে। উনার প্রতিটি উক্তি আমার মনে জোয়ার-ভাটা এনে দেয়। স্নায়ু উদ্দীপনা দেওয়া বন্ধ করে আমাকে নিস্তেজ করে তুলে।
আচমকা আমার মুখের উপর গরম ফুক অনুভব করতেই ভ্রু সংকোচন হয়ে এক অজানা ঘোর কেটে হকচকিয়ে উঠলাম।
-“সারারাত কি এখানে দাঁড়িয়ে ড্যাবড্যাব করে আমাকে গিলে খাওয়ার ইচ্ছা আছে, মিসেস ভয়ংকর পেত্নি?
স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভাবে আমার মুখে বিরক্তি মুখে ফুটে উঠলো। আমি উনাকে মুখ ঝামটি দিয়ে ঘরের ছোট্ট বারান্দা থেকে বেরিয়ে আসলাম। মনের মধ্যে এক অজানা অনুভূতি হাতছানি দিলেও আমার কাছে ধরা দিচ্ছে না। অজান্তেই ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটলো। সাথে সঙ্গী আছে চাদের আবছা আলোর উপস্থিতিতে একজন প্রিয় মানুষের ছায়া। প্রতি পদাচারণে আমার পিছু পিছু অনুসরণ করে চলেছে সে যা মাঠো পথে কালো ছায়া স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
সারি সারি ঘরগুলোর উঠানের রোয়াকে বসে সেই বৃদ্ধ লোকটি ঢুলছে। সাথে বসে পান চিবোচ্ছে আয়ানের দিদুন। আর তিথি নামক মেয়েটা পানের ডালা সাজাচ্ছে। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েই বৃদ্ধ মহিলা অইখানে আসতে ইশারা করলো। তিথি আমাদের দেখে হ্যাবলা কান্তর মতো একটা হাসি দিলো। আয়ান তার দিদুনের পাশে বসলো। তিথি আর আয়ানের মাঝখানে অবস্থান করছে বৃদ্ধ মহিলাটা। আমি তিথির পাশে বসতে যেতেই বাধ সাধলো আয়ান। অইদিকটায় যাওয়ার আগে হাত চেপে বসলো। আমিও অমত প্রকাশ করলাম না। কারণ এই বেহায়া লোক দ্বারা যেকোনো উদ্ভট কাজ করা সম্ভব। তবে দিদুন আর তিথির মুচকি হাসি আমার চোখ এড়ালো না। নিমিষেই লজ্জায় নুয়ে গেলাম। অনেকটা বিব্রতকর পরিস্থিতির স্বীকার হলাম।
পরক্ষণেই উনারা জুড়ে দিলো রাজ্যের আলাপ। অবশেষে বুঝতে পারলাম এই মহিলা হলো আমাদের দূর সম্পর্কের একজন আত্নীয়। আমাদের পাশের গ্রামেই এই গ্রাম। ছোটবেলায় নাকি খেলতে খেলতে এই খানে অনেকবার এসেছি। তখন আমার বয়স হবে হয়তো মাত্র ৮ কিংবা ৯ আর আয়ানের ১৫ বা ১৬ বছর। ভাবা যায় ১৬ বছরের দামড়া ছেলে নাকি আমার সাথে বর-বউ পুতুল খেলা খেলতে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে আসতো। আর এই তিথি নামের মেয়েটা আমাদের সঙ্গী ছিলো। তাদের আলাপ-আলোচনায় এখন কিছুটা ঝাপসা ঝাপসা মনে পরছে আমার।
#চলবে…